You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.01.05 | ন্যাপ কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সভায় রাজবন্দীদের অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্তে উদ্বেগ | সংবাদ - সংগ্রামের নোটবুক

সংবাদ
৫ই জানুয়ারি ১৯৬৯
ন্যাপ কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সভায় রাজবন্দীদের অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্তে উদ্বেগ
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)

গতকাল (শনিবার) ঢাকায় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দেশব্যাপী সরকারী নির্যাতন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পূর্ব পাকিস্তানে রাজবন্দীদের অনশন ধর্মঘট ও দেশব্যাপী রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি প্রশ্নে ব্যাপক আলোচনার পর কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় গৃহীত রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্যদের ষড়যন্ত্র মামলা সহ সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের দাবী জানানো হয়।
পাকিস্তান ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ আমীর হোসেন শাহ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রদেশের রিপোর্ট শ্রবণ করা হয়।
পাকিস্তান ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক জনাব মাহমুদুল হক ওসমানী সভায় পূর্ব দিন রাত্রে বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহিত বিরোধীদলসমূহের ঐক্য প্রশ্নে তাঁহার আলোচনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দান করেন। সভার কাজ আজ (রবিবার) শেষ হইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে।
পূর্বাহ্নে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, যুগ্ম সম্পাদক দেওয়ান মাহবুব আলী, পাঞ্জাব ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক শেখ রফিক আহমদ ও পূর্ব পাক ন্যাপের পীর হাবিবুর রহমান প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে আগামী ৭ই জানুয়ারী পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে আটক রাজবন্দীদের অনশন ধর্মঘট শুরু করার সংবাদে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয় যে, চলতি মাসের শেষ নাগাদ রাজবন্দীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন ধর্মঘট শুরু করিবেন।
তাঁহাদের ন্যায্য দাবী-দাওয়া পূরণে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হওয়ায় রাজবন্দীরা উক্ত অনশন ধর্মঘটে বাধ্য হইয়াছেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকটও তাঁহারা এই মর্মে যে স্মারকলিপি প্রেরণ করেন উহার কোন উত্তর তাহারা পান নাই৷
প্রস্তাবে বলা হয় যে, অধিকাংশ বন্দীকে পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধিবলে আটক রাখা হইয়াছে এবং তাঁহারা অনেকটা মনুষ্যতর জীবনযাপন করিতেছে। একজন বন্দীর পক্ষে দৈনিক ১ টাকা ৫০ পয়সায় দৈনন্দিন খাবার গ্রহণ ও অন্যান্য খরচ বহনের কথা আজকাল চিন্তা করা কঠিন ব্যাপার। তাহাদের পক্ষে মাসে মাত্র ৫ টাকায় মাথার তেল, সাবান, টুথ ব্রাস ও পোষ্ট ও খবরের কাজগের ব্যয় নির্বাহ করা কিভাবে সম্ভব?
প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, রাজবন্দীদের পারিবারিক ভাতাও দেওয়া হয় না। ফলে অধিকাংশ পরিবার নিদারুণ দৈন্যের মাঝে কাল কাটাইতেছেন। জেলখানায় চিকিৎসার ভাল ব্যবস্থা নাই এবং কর্তৃপক্ষ গুরুতর পীড়িত রাজবন্দীদের বাহিরে হাসপাতালে স্থানান্তরে প্রায়শঃ আপত্তি করিয়া থাকেন।
রাজনৈতিক বন্দীদের উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হয় না। ডি পি আর অনুযায়ী রাজবন্দীদের শ্রেণী বিভাগে একদর্শী ও অযৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণে তাঁহাদের অবস্থা আরও খারাপ হইয়াছে। বর্তমানে অধিকাংশ রাজবন্দী নানা প্রকার রোগে ভুগিতেছেন। দীর্ঘকাল আটক রাখায় তাঁহাদের অনেকের স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। এই অবস্থায় অনশন ধর্মঘট তাঁহাদের ভয়াবহ পরিণতি ডাকিতে পারে।
অতএব সভায় অবিলম্বে সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবী করা হয়। সভায় রাজবন্দী সংক্রান্ত নিয়মাবলির আশু সংশোধনক্রমে তাহাদের জন্য অধিকতর সুযোগ-সুবিধা ও সুষ্ঠু জীবন ধারণের উপযোগী ব্যবস্থার বিধান করিয়া তাঁহাদের আশু ধর্মঘট হইতে বিরতি রাখার দাবী জানান হয়।
সভায় সরকারকে সমঝাইয়া দিয়া বলা হয় যে, দেশপ্রেমিকদের এভাবে জেলের মধ্যে পচাইয়া মারার সরকারী মনোভাবে দেশব্যাপী গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হইয়াছে এবং তাঁহাদের প্রতি সরকারের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট করার পর কোন রাজবন্দীর জীবন সংশয় ঘটিলে দেশবাসী ক্ষমা করিবে না। সভার গৃহীত এক প্রস্তাবে দেশব্যাপী ন্যাপ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার ও তাঁহাদের বিনাবিচারে আটক রাখার সরকারী নীতির বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা প্রকাশ করা হয়। উল্লেখযোগ্য যে, সরকার পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান, সরহাদ ন্যাপের সভাপতি আরবাব সিকান্দর খান ও সাধারণ সম্পাদক আজমল খটক, সিন্ধু ন্যাপের সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ লেঘারী ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ বাকর শাহের কেন্দ্রীয় ন্যাপ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হাতেম আলী, শ্রী মনি কৃষ্ণ সেন, সিন্ধু ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাফিজ কোরেশী, পূর্ব পাক ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক আবদুল হালিম, চট্টগ্রাম ন্যাপ সভাপতি পূর্ণেন্দু দস্তিদার, পূর্ব পাক ন্যাপ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যা মিসেস মতিয়া চৌধুরী, করাচী ন্যাপের প্রচার সম্পাদক আলতাফ আজাদ ও আরও বহুসংখ্যক ন্যাপ-কর্মীকে গ্রেফতার করিয়া বিনাবিচারে আটক রাখিয়াছে। একই প্রস্তাবে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড, এ, ভূট্টো, পূৰ্ব পাক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এবং হায়দার বক্স জাতুই, নগেন সরকার, কবি শেখ আলাম, মনিকৃষ্ণ সেন ও জীতেন ঘোষকে গ্রেফতার ও বিনাবিচারে আটক রাখার বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন নিন্দা জ্ঞাপন এবং বিনাশর্তে ও অবিলম্বে আটক সকল রাজবন্দীকে মুক্তির দাবী জানান হয়।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯