দৈনিক পাকিস্তান
২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
ছাত্র-জনতার দুর্বার সংগ্রামের সাফল্য : তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার :
মুজিবসহ সকলের মুক্তিলাভ
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
পূর্ব বাংলার শত শহীদের তাজা রক্তে উজ্জীবিত জাগ্রত ছাত্র জনতার দুর্বার সংগ্রাম জেলের তালা ভেঙ্গেছে শেখ মুজিবকে মুক্ত করেছে। অজেয় গণ জোয়ারে আগরতলা মামলা ফেঁসে গেছে আর কুর্মিটোলা সেনানিবাস হতে জনসমুদ্র এসে শির উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন শেখ মুজিবের সাথে আরো তেত্রিশ জন। ফেরেননি শুধু একজন মরহুম সার্জেন্ট জহুরুল হক।
শুধু তাই নয়, কারাগারের লৌহ কপাট উন্মুক্ত করে ছিনিয়ে এনেছে বিত্তহীনদের সংগ্রামের অগ্নিপুরুষ মনি মহারাজ মনি সিংকে।
সংগ্রামী জননেতা শেখ মুজিবের মুক্তির সংবাদ বিদ্যুতের মত শহরময় ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সারা শহরে উৎফুল্ল জনতা বেরিয়ে আসে রাস্তায় রাস্তায়। সারা শহরের অলি গলি যেন মিশেছিল একই সড়কে। পদভারে সঞ্চরমান সে সড়কের গতি ছিল একমুখী। জেলের তালা ভেঙ্গেছি শেখ মুজিবকে এনেছি— শ্লোগানে মুখরিত লক্ষ জনতা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছিল ধানমণ্ডি এলাকায় শেখ মুজিবের বাসভবন অভিমুখে। কেউ কেউ বাজিয়ে চলেছিল ঢোলক মাদল। আবার কোন কোন মহল্লাবাসী ব্যাণ্ডপার্টি বাজিয়ে মুখরিত করে চলেছিল সারা পথ।
বেলা একটার মধ্যে তাঁর বাসভবন এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। তাঁর বাড়ীর আঙ্গিনা ও ছাদও বোঝাই হয়ে যায়। শেখ মুজিবকে এক পলক দেখার জন্যে উদগ্রীব জনতার ভিড়ে এক পর্যায়ে শেখ মুজিবর রহমান ব্যালকনীতে এসে দাঁড়ালে উৎফুল্ল জনতা শ্লোগানে আকাশ-পাতাল মুখরিত করে তোলেন। সান্নিধ্যে পৌঁছাতে অক্ষম অনেকে এই সময় মালা ও পুষ্প দূর থেকে তার কাছে পৌঁছাবার জন্যে নিক্ষেপ করে শ্রদ্ধা জানান। শেখ মুজিব তাদের উদ্দেশ্যে এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন ও কক্ষের অভ্যন্তরে ফিরে গিয়ে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। জনতার ভিড় ঠেলে বহু কষ্টে বেলা পৌনে ৩টার সময় তাকে একটি খোলা জীপে তুলে এক দীর্ঘ মিছিল শহীদ মিনার অভিমুখে যাত্রা করে। জীপটির অগ্রভাগে পাকিস্তানের একটি জাতীয় পতাকা উড্ডীন করা হয়।
জীপটি নিউ মার্কেট অভিমুখে যাত্রা শুরু করলে পথের দু’পাশে, বাড়ীর বারান্দা ও ছাদে অপেক্ষমান অগণিত নরনারী করতালি, হর্ষধ্বনি ও পুষ্প বৃষ্টি বর্ষণ করে শেখ মুজিবকে অভিনন্দন জানান। বিপুল জনতার কাতার ভেদ করে মিছিলটি ইডেন কলেজ হোস্টেলের সামনে এসে পৌঁছলে হোস্টেলের ছাত্রীরা তাকে পুষ্প বর্ষণ করেন। এরপর শহীদ সড়ক হয়ে মিছিলটি কেন্দ্ৰীয় শহীদ মিনারে পৌঁছলে মিনার এলাকা মেডিকেল কলেজ ও নার্স হোস্টেলের ছাদে বারান্দায় অপেক্ষমান শত সহস্র নর-নারী মহা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং শেখ মুজিব জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে তাঁকে সম্ভাষণ জানান।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌছে শেখ মুজিব একুশের মহান ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের পুণ্য স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং মোনাজাত করে শাহীদানের মাগফেরাত কামনা করেন।
ধানমণ্ডি থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছতে মিছিলটি একটি চলমান জন সমুদ্রে পরিণত হয় এবং এই পথ অতিক্রম করতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে।
শহীদ মিনার থেকে মিছিলটি মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ও খাজা নাজিম উদ্দীনের মাজারে পৌঁছে এবং সেখানে শেখ মুজিবর রহমান এই তিনজন নেতার মাজার জিয়ারত করেন। এখান থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনে গিয়ে তার মুক্তি ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে আমরণ অনশনরত ৫ জন ছাত্রের অনশন ভঙ্গ করান। এরপর তিনি আজিমপুরে মরহুম সার্জেন্ট জহুরুল হকের কবর জেয়ারত করেন এবং হাসপাতালে গুলীতে আহত ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাত করেন। এদিকে পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবের জনসভার খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং লক্ষাধিক জনতা তাদের প্রিয় নেতাকে দর্শনের জন্যে পল্টন ময়দানে এসে জমায়েত হন। ইতিমধ্যে তথাকথিত আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে খান শামসুর রহমান, লেঃ কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, জনাব আলী রেজা, সদ্য সাজামুক্ত কৃষক নেতা জনাব হাতেম আলী খান, মিসেস মতিয়া চৌধুরী, জনাব ওবায়দুর রহমান ও ছাত্রনেতা জনাব আবুল কালাম আজাদ জনতার ভিড় ঠেলে মঞ্চে এসে পৌঁছলে জনতা করতালি ও হর্ষধ্বনি দিয়ে তাঁদেরকে খোশ আমদেদ জানান। তাঁদেরকে সমবেত জনতার নিকট পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এবং জনতার পক্ষ থেকে মাল্যভূষিত করা হয়। কিন্তু জনসভার শেষের দিকে ক্লান্ত শেখ মুজিবের পক্ষে পল্টনের জনসভায় আসা সম্ভব হচ্ছে না বলে ঘোষণা করা হলে জনসমুদ্র ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিয়ে মিছিলে মিছিলে রাজপথে বেরিয়ে পড়েন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে গতকাল শনিবার সরকার তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করেছেন এবং মামলার প্রধান অভিযুক্ত শেখ মুজিবসহ অপর ৩৩ জন ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়েছেন।
১৯৬৬ সালের ৮ই মে দেশরক্ষা আইনে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯৬৭ সালের ১৮ই জানুয়ারী তাঁকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় আগরতলা মামলার প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে পুনরায় গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে সামরিক হেফাজতে নেয়া হয়। এছাড়া গতকাল মামলার অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ মুক্তি পেয়ে নিজ নিজ বাসায় পৌঁছলে তাদের বহু আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধব তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯