You dont have javascript enabled! Please enable it!

অবিলম্বে স্বীকৃতি দাও বাংলাদেশ

ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে ভারত। নেই আর অপেক্ষার সময়। অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। পাক-দরদীরা চারদিকে ফেলছে বড়যন্ত্রের জাল। ইয়াহিয়া বলছেন। পূর্ব পাকিস্তানে নেই দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা। অবস্থা খুবই স্বাভাবিক। শরনার্থীরা নির্ভয়ে ফিরে আসতে পারেন নিজেদের বাড়ীঘরে। রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষকরা একবারও মুখ খুলে বলেননি, দুর্ভিক্ষ এবং মহামারী আন্ন। তবু বিশ্বসভার মানব -প্রেমিকেরা আর্ত সেবার প্রেরণায় আত্মহারা। খাদ্য-বস্ত্র নিয়ে যাবেন তারা বাংলাদেশে। তদারকী করবেন দুর্গতদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বণ্টন ব্যবস্থার। রাখবেন বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যােগাযােগ। তাতে ইয়াহিয়ার নেই কোন আপত্তি। অবস্থাটা খুবই ঘােরাল। ইতিপূর্বে সাইক্লোন বিধ্বস্ত অঞ্চলের পরিবহনগুলাে ইসলামাবাদ ব্যবহার করেছেন বাঙালী নিধনে। এগুলাে পাকিস্তানের নিজস্ব সম্পত্তি নয়, আর্ত ত্রানের জন্য বৈদেশিক দান। একটা গৃঢ় উদ্দেশ্য নিয়ে ইয়াহিয়া খান আহব্বান করেছেন রাষ্ট্রসংঘের আর্তসেবীদের। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণে পাক-চম্ নাজেহাল। ভেঙে পড়েছে ওদের যােগাযােগ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রসংঘের আড়ালে হয়ত হবে তা অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা। গেরিলরা মানবেন না কোন বাধা। তীব্র হয়ে উঠবে তাদের লড়াই। ইসলামাবাদ তখন সুরু করবেন উল্টো প্রচার। অনশনক্লিষ্টদের দুঃখ ঘুম নেই তাদের চোখে। আর্তত্রাণে বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা অকৃপণ হাত। তাতে বাদ সাধছে দুস্কৃতকারীরা (মুক্তিবাহিনী)। এদের প্রশ্রয়দাতা ভারত। পাক-সমর্থক আমেরিকা। ইয়াহিয়াকে বাচাতে সে কৃতসঙ্কল্প। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার আশীবাদযুক্ত যে কোন পরিকল্পনা এখন সন্দেহজনক।
বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ আসন্ন। বিভিন্ন বেসরকারি মহলের মূল্যায়নে ঘনিভূত হয়ে উঠেছে এ আশঙ্কা। হঠাৎ করে ভারতে শরনার্থী আগমনের সংখ্যা বৃদ্ধিতে মিলছে তার প্রমাণ। এই শােচনীয় অবস্থার জন্য দায়ী ইয়াহিয়া খান। রাষ্ট্রসংঘের মানব প্রেমিকরা টেনে আনছেন না ইসলামাবাদের মানব শত্রুদের আসামীর কাঠগড়ায়। তাদের ছন্নছায়াতলে করতে আসছেন বাংলাদেশে মানবসেবা। স্বাভাবিক কারণেই মুক্তিবাহিনী এদের দেখবেন সন্দেহের চোখে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত পান নি অন্য কোন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি। কিন্তু তাদের অস্তিত্ব বাস্তব। জনতার মুক্তিসংগ্রাম গােটা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের দ্বারা অভিনন্দিত। বাংলাদেশে ব্যাপক আর্তত্রাণ সবার কাম্য। যারা এখানে সেবাব্রত নিয়ে আসবেন তাঁদের পক্ষে ইয়াহিয়ার অনুমতিই যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ সরকারেরও অনুমতি দরকার। ভারত এবং অন্যান্য গােটাকয় রাষ্ট্র তাদের স্বীকৃতি দিলেই জোরদার হবে স্বাধীন সরকারের আইনের যুক্তি। নয়াদিল্লী আগাগােড়াই মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। বর্তমান সঙ্কট মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের পাশে এসে দাঁড়ানােই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। কিসের আশায় ইতস্ততঃ করছেন কেন্দ্রীয় সরকার? প্রেসিডেন্ট নিন প্রকাশ্যে জোগাচ্ছেন ইয়াহিয়ার দুষ্কর্মের ইন্ধন। বৃটেনের রক্ষণশীল সরকারও হয়ত খাবেন ডিগবাজী। কিম্বা পশ্চিম ইউরােপের শাসকদের মাধ্যমে ইসলামাবাদের উপর কার্যকর চাপ সৃষ্টির নেই কোন সম্ভবনা। প্রেসিডেন্ট নিক্রনের সম্ভাব্য চীন সফরের ঘােষণায় দ্রুত পাল্টাচ্ছে। সােফিয়েত রাশিয়ার মতিগতি। টনক নড়েছে পূর্ব ইউরােপের। ওরা এখন এসে পড়েছে ভারতের অতি কাছে। দুনিয়ার পাক সমর্থক শাসকগােষ্ঠী নিজেদের দেশের প্রগতিবাদী জনগণ থেকে বিছিন্ন। বাংলাদেশের নারকীয় ঘটনায় ঘটনায় ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে বিদেশী জনতা সােচ্চার। এমন কি, প্রতিবাদের ঢেউ লেগেছে সুদূর কান্ডিনেভিয়ান রাষ্ট্রগুলােতে। তার উপর ওয়াশিংটন এবং নিউইয়কের পাক-মিশনের বাঙ্গালী কর্মীরা একযােগে ইস্তফা দিয়েছেন ইসলামাবাদের চাকরিতে। তারা নিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের আনুগত্য। প্রেসিডেন্ট নিক্রনের চোখের সামনে ঘটেছে, এই অঘটন। সারা বিশ্বের দৃষ্টি আবার পড়েছে বাংলাদেশের উপর। তার স্বাধীন সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানের এই সুবর্ণ সুযােগ।
ইয়াহিয়া বুঝে ফেলেছেন তার দুর্বলতা। নৈরাশ্যের অন্ধার ঘনিয়ে আসছে চার দিকে। হামেশাই দিচ্ছেন তিনি রণহুঙ্কার। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে চলছে পাকহানা। মরছেন ভারতীয় নাগরিক। গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছেন তারা। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে ভারত সীমান্তে পাকিস্তানের হানাদারী। মরিয়া হয়ে উঠবে ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনী। গেরিলাদের সন্ধানে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনতার উপর চলবে নির্মম অত্যাচার। ক্ষুধার তাড়নায় এবং পাক-চমূর নির্যাতনে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আসবেন ভারতে। তাদের সংখ্যা আগামী ক’সপ্তাহের মধ্যেই হয়ত দাঁড়াবে এক কোটিতে। চুপ করে বসে থাকা এখন আত্মহত্যা। বাঁচতে হবে ভারতকে। মুক্তিসংগ্রামীদের জায়া যুক্ত করাই বাচার একমাত্র পথ। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের হাতে পুরাে শাসন ক্ষমতা এলেই শরণার্থীরা ফিরবেন স্বদেশে। এ কাজ সহজসাধ্য নয়। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খান জড় করেছেন প্রায় চার ডিভিশন সৈন্য। মুক্তিবাহিনী সেকেলে অস্ত্র-সজ্জিত। শুধুমাত্র মনের বল নিয়ে লড়ছেন ওরা। এ ধরনের অসমান যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। তাতে বাড়বে সমস্যার জটিলতা। গত চার মাসে আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর দ্রুত পরিবর্তন এবং পাক-দরদীদের গােপন চক্রান্ত তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বাংলাদেশের স্বীকৃতি যদি তিন মাস আগে আসত তবে বেশী দরে ছড়াতে পারত না পাক-ষড়যন্ত্রের জাল। শরণার্থীর ভারে নুয়ে পড়ত না ভারত। সে সুযােগ হেলায় হারিয়েছেন নয়াদিল্লী। আবার এসেছে অনুকূল সময়। লুফে নিতে হবে এ সুযােগ। যুদ্ধের ঝুকি থাকবে সব সময়। বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি না দিলেও ঘুচবে না ভারতের বিড়ম্বনা। ইয়াহিয়ার রক্তচক্ষুতে জড় হবে আরও রক্ত। ব্ল্যাকমেইল চলবে পূর্ণে উদ্যমে। এই মরণ জ্বালার অবসান দরকার। রিত্রাণের একমাত্র পথ বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান এবং এখনই।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ আগস্ট ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!