পল্টনের জনসভায় মওলানা ভাসানীর বক্তৃতা
ঢাকা: বর্ষীয়ান জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিকালে পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বলেন, ‘মুজিববাদ, লেনিনবাদ এবং মাওবাদ দিয়ে দেশের শান্তি আসতে পারে না। এক মাত্র হুকুমতে রাব্বানিয়ার কথায় ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেই দেশের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানী রবিবার হুকুমতে রব্বানীয়া সমিতি আয়ােজিত পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন জনাব বজরুল সাত্তার।
অন্যথা আমরণ অনশন ধর্মঘট: মওলানা ভাসানী দেশের খাদ্য সমস্যা ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধের জন্য সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, অন্যথায় আগামী ২৯ এপ্রিল থেকে আমি আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করব। দেশের খাদ্য সমস্যা ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ, চোরাচালান, গুপ্তহত্যা, খুন, গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা খােলা, গ্রামে রেশনিং ব্যবস্থা চালু, দ্রব্য মূল্য হ্রাস, রাশিয়ার সাথে গােপন চুক্তি বাতিল ও হুকুমতে রাব্বানিয়া শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য মওলানা ভাসানী অনশন ধর্মঘট করবেন বলে উল্লেখ করেন। মওলানা ভাসানী তাঁর অনশন সমর্থন করে সর্বস্তরের জনগণকে আগামী ২৯ এপ্রিল হতে ৩ দিন ব্যাপী সারাদেশে ধর্মঘট করার আহ্বান জানান।
মওলানা ভাসানী বলেন, ‘মুজিব, আমি তােমায় আমার ছেলের চেয়ে বেশি স্নেহ করি। তুমি ভালাে হও। আমার শেষ কথা শুনাে। সর্বদলীয় সভা ডাকো। সকল রাজনীতির উর্ধ্বে আমরা সকল খাদ্য সমস্যা মােকাবেলা করবাে। আমি তােমাকে পূর্ণ সহযােগিতা করব। তুমি দেশের মানুষকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচাও। আওয়ামী লীগসহ আমরা সীমান্তে ১৪’শ মাইল ব্যাপী সভা করব। চোরাচালান বন্ধ করব। মুজিব, নতুবা তােমার কলঙ্ক নিয়ে মৃত্যু হবে।’
আখেরী আরজ: মওলানা ভাসানী বলেন, সাংবাদিকরা আপনারা ৩ দিন কাগজের অফিসে যাবেন না। রেল শ্রমিক, দোকানদার, অফিস আদালত, কোট-কাছারী, স্কুল কলেজসহ দেশের সর্ব শ্রেণির জনগণের প্রতি আমার আখেরী আবেদন, অনশত সমর্থন করে আপনারা ৩ দিন ধর্মঘট করুন।’ তিনি বলেন, “এই আমার শেষ জনসভা। আখেরী চাওয়া তােমাদের নিকট মন্ত্রীত্বের অংশীদার চাইবাে না। এমপি হতে চাই না। আমার ছেলেদের লাইসেন্স পারমিট চাইবাে না। আমি আর দুর্ভিক্ষ দেখতে চাই না। মানুষকে বাঁচাও। আমি তােমাদের শেষ সময় দোয়া করেই যাবাে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকাণ্ড: বিশ্ববিদ্যালয়ে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে মওলানা ভাসানী বলেন, যে অমানুষিক বর্বরােচিত হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার নিন্দা করার ভাষা আমার নেই। তিনি বলেন, প্রায় ৪ ডজন মন্ত্রীর চোখের সামনে বিডিআর, রক্ষী বাহিনী, পুলিশ, মুজিববাহিনী ও যুবলীগের কর্মকর্তাদের সামনে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আর যারা হত্যা করেছে তাদের হেড অফিসও ঢাকায়। মওলানা সাহেব এই হত্যাকাণ্ডের দায়ী ব্যক্তিদের ফাঁসিতে ঝুলাবার দাবী জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, যারা সাপ নিয়ে খেলা করে, তারা সাপের ছােবলেই মারা যায়।
আজ বড় দুঃখ হয়: মওলানা ভাসানী বলেন, মুজিব, আমার আজ বড় দুঃখ হয়। তােমরা উড়ে এসে জুড়ে বসােনি। তােমাদের পাস্ট কেরিয়ার আছে। তােমাদের অতীত ইতিহাস আছে। কিন্তু সে অতীত ইতিহাসে ডুবে গেল, ছারখার হয়ে গেল। ১৩ বছর আমার সাথে সংগ্রাম করেছ। বিহারীদের বাড়ি, গাড়ি দখল করে, বিদেশি ব্যাংকে ঢাকা জমিয়ে, চোরাচালান করে তােমাদের ইতিহাস মুসলিম লীগের ইতিহাসকে ম্লান করেছে। তিনি বলেন, বাঙালি গাড়ি, বাড়ি, টাকাপয়সা, মন্ত্রীত্বের জন্য সংগ্রাম করেনি। বাঙালির মতাে সংগ্রামী জাতি দুনিয়ার কোথাও নাই। তােমরা লুটপাট করে সারা বিশ্বে বাঙালি জাতির ইজ্জত ডুবিয়েছ।
আগে রাজবন্দীর মুক্তি দাও: মওলানা ভাসানী বলেন, দেশের দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধে সকল বিরােধী দলকে ডাকো। রাজনৈতিক কোন্দলের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করাে। আমার ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব মেনে নাও। এই প্রসঙ্গে তিনি সকল রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীদের মুক্তির দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি, রব, জলিল, মতিন, আলাউদ্দিন, টিপু বিশ্বাসের মুক্তি দান ও কাজী জাফরের হুলিয়া তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান।
যুদ্ধবন্দিদের বিচার: মওলানা ভাসানী বলেন, মুজিব, তুমি বলেছাে, এক জন যুদ্ধাপরাধীও ছাড়া পাবে না। বাংলার মাটিতে তাদের বিচার হবে। তুমি তাদের ছেড়ে দিয়েছ। জিজ্ঞাস করি, মতিন, টিপুবিশ্বাস, আলাউদ্দিন, কাজী জাফর, রব-জলিলের অপরাধ বেশি নাকি যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ বেশি?
মােনাজাত: বক্তৃতা শেষে মওলানা ভাসানী বলেন, এই আমার শেষ জনসভা, আখেরী চাওয়া আল্লাহ তুমি দেশবাসীকে সুখে রেখাে। তাদের চরিত্র গঠনের সুযােগ দাও, খুন, হত্যা বন্ধ করাে। হিন্দু, মুসলমান যেন ভাই-ভাই হিসেবে বসবাস করতে পারে। আল্লাহ মুজিবকে হেদায়েত করাে, মন্ত্রীদের হেদায়েত করাে, চোরাচালান বন্ধ করাে। পরিশেষে তিনি বলেন, হিন্দুস্থানের ভাইয়েরা, বাংলার মানুষকে ভালােবাসুন। দুর্ভিক্ষে সাহায্য করুন। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন না। তাহলে বন্ধুত্ব থাকবে না। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব জন্মসূত্রে গড়ে উঠেছে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী চোরাচালান বন্ধু করুন। বাংলার সম্পদ লুট করলে কিন্তু বন্ধুত্ব থাকবে না। সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন জনাব আবদুল হারিস পীরজাদা খাজা আবু তাহের ও জনাব এরফানুল বারী।৪৯
রেফারেন্স: ১৪ এপ্রিল, ১৯৭৪, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত