স্বাধীনতা দিবসে রােগশয্যা থেকে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে জাতির জনকের বাণী
ঢাকা: যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। বাংলায় সােনার মানুষ আছে, সােনার মাটি আছে। ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশকে সােনার বাংলা করা যাবে। তাই সকলে মিলে কাজ করুন। মস্কোর বারভিকার ক্লিনিকে অসুস্থ শয্যাশায়ী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বাণীতে তার প্রিয় দেশবাসীর প্রতি উপরােক্ত আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারই ডাকে লাখাে লাখাে বাঙালি বাবা-মা, ভাই-বােনেরা জীবন দিয়েছেন। শয্যায় অসুস্থ অবস্থায় আজ সেসব শহীদদের কথাই তার মনে পড়ছে। মনে পড়ছে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের কথা। তিনি বাংলাদেশের মানুষের ভাত কাপড় বাসস্থানসহ সীমাহীন দুঃখকষ্টের কথা উল্লেখ করে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকারী আত্মত্যাগের মনােভাব নিয়ে কঠোর পরিশ্রমের অনুরােধ জানান। তিনি আরও বলেন, কঠোর পরিশ্রমেই বাংলায় একদিন সুদিন আসবে। জনগণের উদ্দেশ্যে রােগশয্যায় শায়িত বঙ্গবন্ধু গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, জনগণ আজ খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছে। এমতাবস্থায় এক দল লােক বিদেশিদের হাতের খেলার পুতুল হয়ে তাদের এজেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ পাটের গুদামে আগুন লাগায়, রেললাইন নষ্ট করে সরকারি জিনিসপত্র পুড়িয়ে দেয়। তারা বােঝে না এ সম্পত্তি এদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের, কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। তিনি শহীদদের নামে শপথ করে জনগণকে সবরকম দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি থেকে দূরে থাকার অনুরােধ করেন।
বঙ্গবন্ধুর বাণীর পূর্ণ বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলাে:
দেশবাসী ভাই ও বােনেরা, আজ আমি অনেক দূরে মস্কো বারভিকা ক্লিনিকে অসুস্থ অবস্থায়। চিকিৎসাধীন আছি। এই দিনে আপনাদের পাশে আমি থাকতে পারলাম না। এজন্য নিশ্চয়ই আমি মনােকষ্ট ভােগ করছি। ১৯৭১ সালের এই দিন রাতে ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লােকজন আমার নিজের বাড়ি এবং বাংলাদেশের মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। সেদিন আমি যে ডাক দিয়েছিলাম এবং স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলাম, গ্রেফতারের আগে দেশবাসী জনসাধারণ আমার কথামত তাদের হত্যার মােকাবেলা করেছিল। তাই আমার মনে পড়ে লক্ষ লক্ষ শহীদদের কথা। লক্ষ লক্ষ মা-বােনের কথা যারা নির্যাতিত, অত্যাচারিত হয়েছেন। লক্ষ লক্ষ বাপ-মাভাইদের কথা যাদের আপনজনকে হারিয়েছে। শয্যায় অসুস্থ অবস্থায় সব সময় তাদের কথাই আমার মনে পড়ে। আর মনে পড়ে আমার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি দুঃখী মানুষের কথা। আমি আজ আপনাদের কাছে বেশি কিছু বলতে পারবাে না। ডাক্তারের হুকুমও নাই আমার বেশি কথা বলার। শুধু এটুকুই বলতে চাই যে, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বহু ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা পেয়েছি। এই স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার দায়িত্ব বাংলাদেশের জনসাধারণের। আজ বাংলাদেশের মানুষ অনেক দুঃখকষ্ট ভােগ করছে। বহুকাল পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধছিল। বহুদিন ধরে তারা শােষিত। এই ধ্বংসস্তুপের উপর আমরা স্বাধীনতা পাই। আজ সকলের, জনসাধারণের বহু কষ্ট। ভাতের কষ্ট, কাপড়ের কষ্ট, থাকার কষ্ট, শত কষ্ট-যে কষ্টের কোন সীমা নাই। তবে কঠোর পরিশ্রম করলে সৎ পথে থেকে যদি কাজ করা যায় যে আত্মত্যাগের মনােভাব নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিল দেশের জনসাধারণের সেই আত্মত্যাগের মনােবল নিয়ে যদি তারা কাজে এগিয়ে যায় ইনশা আল্লাহ বাংলার সুদিন একদিন নিশ্চয় ফিরে আসবে। আপনাদের কথা সকল সময় আমার মনে পড়ছে কিন্তু দুঃখের ভিতর দিয়ে আপনারা আজ দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু আজকের এই দিনে আমার আফসােস একদল লােক বিদেশিদের হাতের পুতুল হয়ে এবং তাদের এজেন্ট বাংলাদেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করছে। কেউ কেউ পাটের গুদামে আগুন লাগায়। রেললাইন নষ্ট করে, সরকারি জিনিসপত্র পুড়িয়ে দেয়। তারা বােঝে না এ সমস্ত সম্পত্তি এদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণের, কারাে ব্যক্তি সম্পত্তি নয়। আমি আপনাদের কাছে এই দিনে শহীদদের আত্মত্যাগের কথা মনে করে শপথ করতে অনুরােধ করছি যে, আপনারা দেশের গঠনমূলক কাজে হাত দেন। দুর্নীতি থেকে দূরে থাকুন, স্বজনপ্রীতি থেকে দূরে থাকেন আর যাতে জনসাধারণ জিনিসপত্র ন্যায্য মূল্যে পায় সেদিকে খেয়াল রাখুন। দুঃখ হয় একদল লােক গুপ্তহত্যায় লিপ্ত হয়েছে। সচরাচর রাজনৈতিক কর্মীকে তারা রাতের অন্ধকারে হত্যা করছে এবং এর ফলাফল খুব ভালাে নয়। এটা আমি বারবার অনুরােধ করছি সকলকে বন্ধ করার জন্য। সকলে এগিয়ে আসুক দেশ গঠনের কাজে। কেউ কাউকে বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু যারা প্রকাশ্যে সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলে তারা বাংলার মাটিতে রাজনীতি করার অধিকার আছে কি না সেটা আপনারাই বিবেচনা করবেন। আজ বড় কর্তব্য হলাে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানাে। তাদের জন্য কিছু করা। তারা যেন ভাত পায়, কাপড় পায়, বসবাসের স্থান পায়, শিক্ষার আলাে পায় এবং বেকার সমস্যা দূর করা যায়। সেই জন্য সকলের কর্তব্য আজ আমাদের রয়েছে। শুধু সরকারি কয়েকজন কর্মচারী আর রাজনীতিবিদদের কর্তব্য নয়, এই দিনে সকলকে আমি আবেদন করবাে এ অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে যে আপনারা দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানাের জন্য সােনার বাংলা গঠন করার জন্য আপনারা কাজ করুন। নিশ্চয়ই খােদা আপনাদের সহায় আছেন। যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। বাংলাদেশে সােনার মানুষ আছে সােনার মাটি আছে। ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশকে সােনার বাংলা করা যাবে। তাই সকলে মিলেমিশে আপনারা কাজ করুন। আমি আপনাদের এই অনেক দূর থেকে আমার এই আবেদন আপনাদের কাছে রইলাে। খােদা হাফেজ। জয় বাংলা। শেষ কথাটা বলতে চাই আপনারা সকলে দোয়া করেন। আজ আমার মন রয়েছে আপনাদের কাছে। তাড়াতাড়ি যেন আরােগ্যলাভ করে আপনাদের কাছে ফিরে আসতে পারি। যে বাংলার মাটিকে আমি এতাে ভালােবাসি, যত দূরেই যে খানেই আমি যাই একটা মুহূর্তের জন্যেও ওদের কথা আমি ভুলতে পারি না। আপনারা আমার বেয়াদবী মাফ করবেন। খােদা হাফেজ। জয় বাংলা।৯৮
রেফারেন্স: ২৫ মার্চ, ১৯৭৪, বাংলার বাণী
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত