দাউদকান্দির বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু
দাউদকান্দি: জাতির জনক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, নেপাল ও শ্রীলংকা এবং উপমহাদেশের ৩টি দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে এতদঞ্চলের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্যে অবশ্যই শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনােভাব নিয়ে বসবাস করতে হবে। তিনি আরও জানান যে, আমরা কারাে সাথে শত্রুতা চাই না। আমরা উপরােক্ত দেশগুলাের সাথে আমরণ সার্বভৌম সমতা ও মর্যাদার ভিত্তিতে সহ-অবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু গতকাল দাউদকান্দি ফেরীঘাটে আয়ােজিত এক বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে এ কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু এই প্রসঙ্গে বলেন যে, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব কামনা করি। আমরা শান্তির নীতিতে বিশ্বাসী। তিনি বলেন, নেপাল, সিংহল, ভারত, পাকিস্তান এসব দেশের সাথে বাংলাদেশ সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আত্মমর্যাদা নিয়ে ভাই ভাই হিসেবে পাশাপাশি বাস করতে চায়। আমরা কেউ কোনদিন কারাে আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে আমাদের এক কোটি মানুষ পুনরায় রক্ত দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির মাধ্যমে সত্যের জয় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি উত্তর পরিস্থিতির উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে যে সব সমস্যার সমাধান আজও হয়নি আলােচনার মাধ্যমে আমরা তার নিষ্পত্তি করতে চাই। এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন যে, তােমরা সুখে থাক। তােমরা স্বীকার কর তােমরা অন্যায় করেছ। আল্লার কাছে মাফ চাও। বাঙালি জাতি জানে কেমনে করে। মাফ করতে হয়।
এবারের সংগ্রাম: প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ঘােষণা করেছেন যে, এবারের সংগ্রাম চোরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখাের ও মুনাফাখাের খতমের সংগ্রাম। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, প্রয়ােজন হলে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়ােগ করা হবে। দাউদকান্দি আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়ােজিত এই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জনাব লস্কর আলী মুন্সী। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেন যে, সমস্ত দেশ আজ দুর্নীতি হয়ে গেছে। এই দুর্নীতিবাজদের দমন করা বাঙলার মানুষের আজ মহান কর্তব্য। বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলার যুবসমাজ তথা সমগ্র জনগণকে আমি হুকুম দিয়েছি যারা দুর্নীতি করছে, যারা অরাজকতা সৃষ্টি করছে, যারা গরীবের প্রয়ােজনীয় জিনিস বেশি দামে বিক্রি করছে তাদেরকে পিটিয়ে শায়েস্তা করতে হবে। অবশ্য তিনি তাদের প্রাণে না মেরে ফেলার কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন যে কোনাে ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে হবে। ঘুষ দূর করতে হবে। বঙ্গবন্ধু এসব দুর্নীতিবাজ ও অসৎ ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, কার জন্য এই মুনাফার পাহাড় গড়ে তােলার ন্যক্কারজনক প্রতিযােগিতা? তিনি তাদের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে দিয়ে বলেন একটুকরাে কাপড় আর ৬ হাত মাটি ছাড়া কিছুই সঙ্গে নিতে পারবে না। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু পুনরায় বলেন যে, চলতি মাস থেকেই এই দুর্নীতি দমন অভিযান পরিচালনার নির্দেশ আমি দিয়েছি। আমি চাই বাংলার মানুষ আর একবারের মতাে জেগে উঠুক। বঙ্গবন্ধু আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলেন যে, বাংলার মানুষের অভাব অনটন দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনলে মাঝে মাঝে আমি পাগল হয়ে যাই। সহকর্মীদের বলি আমি সব ছেড়ে আমি আবার জনতার কাতারে সামিল হব। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি আপনাদের দুঃখ জানি, অভাব বুঝি। আমি জানি আপনাদের পেটে খাবার নেই, পরনে বস্ত্র নেই। তবুও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। বিদেশ থেকে খাদ্য ও কাপড় এনে আপনাদের প্রয়ােজন মেটানাের চেষ্টা করছি কিন্তু বলতে দুঃখ হয় যে, বাংলার বুকে মায়ের অশু আজও শুকায়নি। যে বাংলার বুকে আজও ভাই কাঁদে সে বাংলার বুকে মুনাফাখাের আর ঘুষখােরের দল বিদেশ থেকে আনা জিনিসপত্র নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। বঙ্গবন্ধু আবেগাপ্লুত কণ্ঠে পুনরায় অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলেন যে, বাংলার মানুষের যে ভালােবাসা আমি পেয়েছি, বিশ্বের ইতিহাসে আর কোন নজির নেই। আমি যখন পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন গুনছি তখন বাংলার লক্ষ লক্ষ মা-বােন-ভাই আমার জন্য দোয়া করেছে। তাদের দোয়াতেই আমি পুনরায় আবার বাংলার মাটিতে ফিরে আসতে পেরেছি। অতএব আমার জীবন তাদের জন্যই নিবেদিত। যেকোন দিন যেকোন মুহূর্তে বাংলার মানুষের জন্য আমি হাসতে হাসতে জীবন উৎসর্গ করতে পারি। বঙ্গবন্ধু বলেন, পৃথিবীতে ভিক্ষুকের জাতের কোন কদর নেই। আমরা ভিক্ষুকের জাত হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই না। এর জন্য আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজের পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আশা প্রকাশ করে বলেন যে, আমরা নিশ্চয়ই আত্মনির্ভরশীল হব। কারণ বাংলাদেশের মতাে এমন সােনার মাটি বিশ্বের কোথাও নেই। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, কৃষি ও শিল্প উভয় ক্ষেত্রেই উৎপাদন বৃদ্ধি না করলে বাঁচার কোনাে উপায় নেই। কারণ তেল, কাপড় চাল থেকে শুরু করে প্রতিটি জিনিসের দাম বিশ্বের বাজারে অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু দেশের কৃষকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি চাই না বাংলার একটুকরাে জমিও খালি পড়ে থাক। বঙ্গবন্ধু দেশের ছাত্রসমাজকেও অবসর সময়ে বাপ-মার সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তাদের চরিত্র সৎ ও কর্মঠ হিসেবে নিজেদের গড়ে তােলার কথাও উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, এই দেশকে গড়ে বিশ্বের মানুষকে আমরা দেখাতে চাই বাঙালিরাও তাদের দিক থেকে পিছিয়ে নেই। তিনি জনগণকে কঠোর পরিশ্রম ও সৎ পথে চলার আহ্বান জানান। পরিশেষে বঙ্গবন্ধু বিগত স্বাধীনতা আন্দোলনে দাউদকান্দির জনগণের ত্যাগ-তিতিক্ষার ভূয়সী প্রশংসা করে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।১৩
রেফারেন্স: ৪ মার্চ, ১৯৭৪, বাংলার বাণী
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত