৭৮ সুতা প্রতিষ্ঠান মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ
ঢাকা: চট্টগ্রাম জেলায় সুতা বণ্টন ও তাঁতের অস্তিত্ব সম্পর্কে ব্যাপক দুর্নীতি ধরা পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংশ্লিষ্ট ৭৮টি ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ৬৩টি সুপারিশকৃত ভুয়া প্রতিষ্ঠান, লাইসেন্সপ্রাপ্ত ৮টি ভুয়া প্রতিষ্ঠান, কেন্দ্রীয় অফিস থেকে সুপারিশকৃত ৪টি ভুয়া প্রতিষ্ঠান ও অতিরিক্ত তাঁত প্রদর্শনকারী তিনটি প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রীর পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ দল তদন্ত করে এই দুর্নীতি ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, দেশের অন্যান্য স্থানেও সুতা বণ্টন, তাঁতের অস্তিত্বসহ অন্যান্য বিষয়ের দুর্নীতি সম্পর্কেও প্রধানমন্ত্রীর পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষক দল তদন্ত শুরু করবেন। পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ দলের তদন্তের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ক্ষুদ্রশিল্প সংস্থার চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসের ৪ জন অফিসারকে বরখাস্ত ও তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা দায়ের ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে সুপারিশ দেয়ার জন্যে বিসিকের ঢাকা অফিস, চট্টগ্রাম ডেপুটি কমিশনারের অফিস ও শিল্প দফতরের মহাপরিচালকের অফিসের জড়িত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত, সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে কালাে তালিকাভুক্ত করা এবং এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করার নির্দেশ দিয়েছেন। জরিপ রিপাের্টে ৬৩টি ভুয়া অস্তিত্বহীন তাঁত শিল্পের নাম অন্তর্ভুক্ত করার অপরাধে যে ৪ জন বিসিক কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসের সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট মােহাম্মদ তৌহিদুল আলম, জুনিয়র অ্যাসিসটেন্ট জনাব মােস্তাফিজুর রহমান এবং জুনিয়র অ্যাসিসটেন্ট জনাব সুলতান আহমেদ।
ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নাম: জরিপ রিপাের্টে ৬৩টি ভুয়া অস্তিত্বহীন তাঁত শিল্পকে চালু তাঁত শিল্প হিসেবে দেখিয়েছেন: শিকারপুরের ঝিলন তাঁতশিল্প, ফিরােজ ইন্ডাস্ট্রিজ দরগা তাঁত শিল্প, বাংলাদেশ কুটির শিল্প, সাহেরা খাতুন তাঁত শিল্প, শিবালী শিল্প, ফাতেমা লুঙ্গি শিল্প, জাহাঙ্গীর শিল্প, সিরাজুল ইসলাম, এম, এম, গােলাম কাদের সারদা শিল্প, বােচন আলী কুটির শিল্প। চট্টগ্রাম জেলার ফতেহাবাদের রফিক তাঁত শিল্প, ইদ্রিজ কটেজশিল্প, শিকদার শিল্প নিকেতন। হাটহাজারী গরদুয়ারার চৌধুরী বয়নঘর, নাহার কটেজ ইন্ডাষ্ট্রিজ, চৌধুরী শিল্প কুটির, নাজিম কটেজ শিল্প, সরকার তাঁত ফ্যাক্টরী, জরিনা কুটির শিল্প, কবির আহমেদ রাজা কটেজ, পুবালী কুটির শিল্প, রউফ ফ্যাক্টরী, নুরানী কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, ওবায়দুল হক, কাজেম আলী, কামাল উদ্দিন, মির্জা সালামউল্লাহ তাঁত শিল্প ফ্যাক্টরী, সীতাকুণ্ডের সলিমপুরের মেসার্স চৌধুরী তাঁত ফ্যাক্টরী। সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়ার মেসার্স আক্তার হ্যান্ডলুম ইন্ডাস্ট্রিজ, মােশতাক হ্যান্ডলুম ইন্ডাস্ট্রিজ, তাসমি হ্যান্ডলুম ইন্ডাস্ট্রিজ, শাহ আলম সংস্থা, সাবেরা হ্যান্ডলুম ইন্ডাস্ট্রিজ, আমিনুল হক সংস্থা, হিল সাইড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, পাইওনীয়ার কো-অপারেটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ, সাবেদ কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, তৌহিন হ্যান্ডলুম ইন্ডাস্ট্রিজ, মীরেশ্বরাই এর আবু তােবারের মেসার্স বীরেন্দ্র নাথ, ননী গােপাল। দেবনাথ, শ্রীমতি লক্ষ্মীবালা দেবী, যাত্রামােহন নাথ, ক্ষেত্র মােহন নাথ, অভিলাষ মােহন নাথ, শ্ৰীমতী বল্লাবাসী, জগবন্ধু রায়, আবু তােরাব তাঁত শিল্প, শ্রীমতি সুষতী কর্মকার, রাম মােহন নাথ, শ্ৰী ধৰ্মচন্দ্র ভৌমিক, শ্ৰী লাভলী বয়ন শিল্প। মীরেশ্বরাই এর মগাদিয়ার মাে. ইউনুস, মুন্সি মিয়া, মধুসূদন বণিক নিহার বালা মানিক। এগুলাের মধ্যে প্রথম ৩৫ টির রিপাের্ট দিয়েছেন, জনাব তৌহিদুল আলম এর পরের একটি জনাব মােসতাফিজুর রহমান, তার পরের ১০ টি মাে. সুলতান আহমদ, এবং শেষের ১৭ টি জনাব মনসুর আহমদ। প্রধানমন্ত্রীর গণসংযােগ অফিসার জনাব আবদুল তােয়াব খান সাংবাদিকদের কাছে গতকাল শনিবার এই তথ্য প্রকাশকালে আরাে জানিয়েছেন যে, পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ দলের কাছে জনাব মােসতাফিজুর রহমান স্বীকার করেছেন। বান্দরবন এলাকায় ২শ তাঁত সম্পর্কে তিনি যে রিপাের্ট দিয়েছেন, তা সরেজমিনে তদন্ত না করেই দিয়েছেন। জনাব মনসুর মিঠানালা এলাকায় ৪১টি তাঁত সম্পর্কে যে রিপাের্ট দিয়েছেন সেগুলাের কোনাে অস্তিত্ব নেই। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ছাড়া। প্রধানমন্ত্রী অবিলম্বে এইসব তাঁত শিল্পকে কালাে তালিকাভুক্ত করে সুতা বণ্টন না করার এবং মালিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করার নির্দেশ দিয়েছেন।
সুতা আমদানির লাইসেন্স: প্রধানমন্ত্রীর পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ দল তদন্তকালে উদঘাটন করেছেন যে, চট্টগ্রামের অস্তিত্বহীন ৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বিদেশ থেকে সুতা আমদানির লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। শিল্প বিভাগের মহাপরিচালকের অফিসের কর্মচারীর সুপারিশে এই আমদানির লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত করে দুর্নীতির মামলা দায়ের, সুতা আমদানির লাইসেন্স প্রদানের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানগুলােকে স্থায়ীভাবে কালাে তালিকাভুক্ত করা এবং শিল্প মহাপরিচালকের অফিসের যেসব কর্মচারীর সুপারিশে এ আমদানি লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তাদেরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা ও তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই ৮টি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে: চট্টগ্রামের বক্সিহাটের আলী কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, বন্দরপট্টির রাজিয়া কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, কাদের খিলের প্যারেড স্কয়ারের বিলকিস কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, কাদুরখিলের খলিল হ্যান্ডলুম ইন্ডাস্ট্রিজ, ইসলামিয়াতের কাদেমুলন ইসলাম ইন্ডাস্ট্রিজ, জোয়ারার আহমুদা কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ ও মাে. ইসহাক হ্যান্ডলুম ফ্যাক্টরী।
তাঁতের সংখ্যা বাড়িয়ে: তদন্তে আরাে প্রকাশ পেয়েছে যে, চট্টগ্রামের ফতেহাবাদের ঝিনুক শিল্প নিকেতন, গারদায়ারা শিল্প নিকেতন এবং গহিরার আক্তার হ্যান্ডলুম ইন্ডাস্ট্রিজের প্রকৃত তাঁত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি তাঁত দেখানাে হয়েছে। প্রথমটিতে তাঁতের সংখ্যা ১০ কিন্তু দেখানাে হয়েছে ১৫। দ্বিতীয়টিতে ২০ টি তাঁত দেখানাে হয়েছে, কিন্তু আছে মাত্র ৮টি। এই ৮টির মধ্যে ৬টি কোন দিন ব্যবহৃত হয়নি। বাকি ২টিতে পুরােনাে সুতা জড়ানাে অবস্থায় পাওয়া গেছে। তৃতীয়টিতে তাঁতের সংখ্যা মাত্র ৫টি কিন্তু দেখানাে হয়েছে ২৫ টি। চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনারের অফিসের কর্মচারী কর্তৃক এই মিথ্যা রিপাের্টের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যে সব কর্মচারীর সুপারিশ করেছিল, তাদের বরখাস্ত ও তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করার প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভবিষ্যতে সুতা বণ্টনের ক্ষেত্রে কালাে তালিকাভুক্ত করা ও মালিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করার নির্দেশ দিয়েছেন।
বিসিক কেন্দ্রীয় অফিস থেকে: বাংলাদেশ ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থার কেন্দ্রীয় অফিসের রিপাের্টে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে রাজিয়া কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, আলী কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ (মালিক একই), বিবির হাটে ভাগলপুর হ্যান্ডলুম ইন্ডাস্ট্রিজ ও ফতেহাবাদে হােসেন কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ নামে যে ৪টি তাঁত শিল্প আছে বলে দেখানাে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ দল এ ৪টির কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিসিকের যেসব কর্মচারী এই জরিপ রিপাের্ট দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা দায়ের এবং অভিযােগের গুরুত্ব বিচার করে তাদের শাস্তি বিধানের নির্দেশ দিয়েছেন। উল্লেখযােগ্য যে, সারা দেশে সুতা বণ্টন নিয়ে ব্যাপক কারচুপি ও সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার বাণীতে সুতা বণ্টনে দুর্নীতি ভুয়া তাঁত ও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের ব্যাপারে দুর্নীতি সম্পর্কে বহু রিপাের্ট প্রকাশিত হয়েছে। এবং এসব রিপাের্টে বলা হয়েছিল যে, সঠিক তদন্ত করলে এই দুর্নীতি ধরা পড়বে।৫
রেফারেন্স: ২ মার্চ, ১৯৭৪, বাংলার বাণী
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত