শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
‘রাষ্ট্রপ্রধানের পদে মহিলা নির্বাচন জায়েজ-দশজন আলেমের বিবৃতি’ | সংযুক্ত বিরোধী দল | ডিসেম্বর, ১৯৬৪ |
বর্তমান পরিস্থিতিতে
রাষ্ট্রপ্রধানের পদে মহিলা নির্বাচন জায়েজ
(বিশ্ববিখ্যাত ও দেশবরেণ্য ওলামায়ে কেরামের ফতোয়া)
- মরহুম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী
- মরহুম মাওলানা সৈয়দ সোলেমান নদভী
- মাওলানা মূফতী মোহাম্মদ শফী
- মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী
- মাওলানা আতাহার আলী
- মাওলানা শামছুল হক (ফরিদপুরী)
- মাওলানা নুর মোহাম্মদ আযমী
- মাওলানা তাজুল ইসলাম
- শর্ষিনার পীর শাহ মাওলানা মোহাম্মদ ছিদ্দিক
- মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম
হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী(রাঃ) বলেনঃ
রাষ্ট্র ব্যাবস্থা তিন প্রকার,- রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ও গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সদস্যদের সমবায়ে গঠিত পরিষদই রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসনকর্তা। রাষ্ট্রপ্রধান এ পরিষদের একজন সদস্য মাত্র। তিনি জাতি কর্তৃক মনোনীত বা নির্বাচিত হলেও তার পূর্ণ কর্তৃত্ব এখানে নাই। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনিও পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের মত একজন পরামর্শদাতা মাত্র যদিও তার মত অন্যান্য একক সদস্যের মতের তুলনায় অগ্রাধিকার লাভ করে থাকে তথাপি এতে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। যদি তাই হতো তবে অন্যান্য সদস্যদের সমবেত মতের বিরুদ্ধে তার মতামতই প্রাধান্য লাভ করতো; কিন্তু বাস্তবে তা কখনও হয় না।
কোরান মজিদে হজরত বিলকিসের রাজত্ব কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে তার কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে…‘‘মা কুনতু কাতেয়াতান আমরান হাত্তা তাশহাদুন’’ অর্থাৎ বিলকিস তার সভাসদগণকে বলেন, “আপনাদের উপস্থিতি ব্যতীত আমি কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না’’- এ উক্তি থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি শাসনতন্ত্র অনুসারেই হোক বা বিলকিসের স্বাভাবিক অনুসৃত রীতি অনুসারেই হউক গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুরূপই ছিল।
হজরত বিলকিসের মুসলমান হবার পর তার রাষ্ট্রাধিকার কেড়ে নেবার কোন প্রমাণ নেই বরং তার রাজ্য যে আগের মতই বহাল ছিল, ইতিহাসের তার যথেষ্ঠ প্রমাণ রয়েছে। বিলকিসের রাজত্বে ও রাজ্য শাসন পদ্ধতির প্রতি কোরানে কোনরূপ অবজ্ঞা ও অসমর্থন জ্ঞাপন করা হয়নি। উসুলে ফেকাহর সুবিধিত বিধান হচ্ছে, কোরান বা হাদিসে যদি অতীতের কোন ঘটনা বা ব্যবস্থাকে কোনরূপ অবজ্ঞা বা অসমর্থন প্রকাশ না করে বর্ণনা করা হয় তবে তা শরীয়তে প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হতে পারে। সুতরাং বর্ণনা থেকে সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মহিলার নেতৃত্ব চলিতে পারে।
(ইমদাদুল ফাতাওয়া তাতিম্মায়ে ছানিয়া ১৬৯-৭০:৫৪ বৎসর পূর্বে প্রদত্ত)
(দৈনিক আজাদ, ২২শে অক্টোবর ১৯৬৪ ইং)
মাওলানা সৈয়দ সোলেমান নদভী ছাহেব বলেনঃ
রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালনের জন্য ইসলাম যেসব শর্তারোপ করেছে তা পালন করা কোন মহিলার পক্ষে দুঃসাধ্য। এ জন্যই নারী জাতিকে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু এই একমাত্র কারণে যদি কেহ মনে করেন যে কোন অবস্থায়ই মহিলা মুসলমানদের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারেন না, তবে তা ভুল হবে। কারণ যখন জাতি কোন ফেতনা-ফাসাদের সম্মুখীন হয় এবং সে ফেতনা থেকে রক্ষা করতে পারে এমন কোন ব্যক্তিত্ব জনগণের দৃষ্টিতে কোন মহিলা ব্যতীত আর না থাকে, তবে উক্ত মহিলাকেই জাতির নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে।
(সীরাতে আয়েশা, ৩য় খ-১১৩ পৃঃ)
হজরত মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ শফী ছাহেব বলেনঃ
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া ইসলামী শিক্ষা ও ঐতিহ্যের খেলাপ নহে।
(দৈনিক জঙ্গ, ৩রা নভেম্বর, ১৯৬৪ ইং)
হজরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী ছাহেব বলেনঃ
এখন আমি এমন একটি বিষয়ে বলবো, যা খুব জোরে-শোরে তোলা হচ্ছে এবং কিছুসংখ্যক আলেম ও পীরদের দ্বারাও যা লোকসমক্ষে প্রচার করানো হচ্ছে- তা হলো রাষ্ট্রপ্রধান মহিলাকে নিযুক্ত করা। বলা হচ্ছে যে, ইসলামে কোন নারীকে মুসলমানদের নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান বানানো যায় না। এই ব্যাপারে বিশেষ করে আমার লেখা বই থেকে নানা উদ্ধৃতি পেশ করা হচ্ছে। আর আমি সময় ও সুযোগ দেখে ইসলামের নীতি পরিবর্তন করে ফেলি বলে আমার নামে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এর জওয়াবে আমি অবশ্যই জিজ্ঞেস করতে পারি যে, ইসলামের দৃষ্টিতে নারীকে মন্ত্রী ও পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী এবং বিদেশে রাষ্ট্রদূত বানানো যায় কি? ছেলে ও মেয়েদের সহ-শিক্ষা ব্যবস্থা কি ইসলামসম্মত? পুরুষ ও মেয়েলোকের একত্রিত হয়ে একই অফিসে কাজ করা কি জায়েজ? স্টেজে নেমে মেয়েদের নাচ, গান করা কি ইসলাম সমর্থন করে? উড়োজাহাজে যুবতি মেয়েরা সেবিকা হয়ে পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে মদ পরিবেশন করে, তা কি জায়েজ… আর এসব যদি নাজায়েজ কাজই হবে, তাহলে আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ মেনে কাজ করা হয়নি কেন? এ সব ব্যাপারে ইসলামের কথা স্মরণ করা হয়নি কেন? আর আজ নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার প্রশ্নেই কেবল ইসলামের দোহাই দেয়া হয় কেন? এ হচ্ছে পাল্টা প্রশ্ন। এর পরে আমি আসল বিষয়ে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি আপনাদের সামনে পেশ করছি।
একথা সর্ববাদীসম্মত যে, ইসলামে রাজনীতি আর রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ নীতিগতভাবে পুরুষদের কর্মক্ষেত্রের আওতার মধ্যে রাখা হয়েছে, এসবের দায়িত্ব পালনে মেয়েলোকদের শরীক করা হয়নি। মুসলমানদের আমীর বা নেতা হবার জন্যে যেসব শর্ত করা হয়েছে তার মধ্যে পুরুষ হওয়াটা একটা শর্ত, একথা অস্বীকার করা যায় না। আমি নিজেই এ বিষয়ে দলিল-প্রমাণ সহকারে বলিষ্ঠভাবে ইতিপূর্বে কয়েকবারই বলেছি, আর আজও আমি এই কথারই পুনর্ঘোষনা করছি।
কিন্তু বর্তমান মুহূর্তে আমাদের সামনে বিষয়টি এ সাদাসিধেভাবে উপস্থিত হয়নি যে, নারী মুসলমানদের আমীর হতে পারে কিনা তা নিয়েই আমরা মাথা ঘামাতে বসবো। বরং আমরা বর্তমানে এক বিশেষ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে আছি, তা হচ্ছে এইঃ
- দেশে এক জবরদস্তিমূলক অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চালু হয়ে রয়েছে, তা আমাদের ধর্ম, চরিত্র, তাহজীব-তামাদ্দুন, অর্থনীতির পক্ষে অত্যন্ত মারাত্নক।
- এ ধরণের শাসন ব্যবস্থাকে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় পরিবর্তন করার জন্য আগামী নির্বাচনে খোদার দেয়া এক মহা সুযোগ পাচ্ছি।
- দেশে মুহতারিমা ফাতিমা জিন্নাহ ব্যতীত অপর কোন ব্যক্তিত্ব এমন নেই যাকে কেন্দ্র করে দেশের বিরাটসংখ্যক লোক একত্রিত হতে পারে, অ্যার নির্বাচনে সফলতা লাভ করতে পারে ও এই উপায়ে বর্তমান স্বৈরতন্ত্রী জালেম শাসন ব্যবস্থাকে খতম করে দেয়ার কোন সম্ভাবনা হতে পারে।
- মুহতারিমা ফাতিমা জিন্নাহর প্রার্থী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সাধারণ জনতা তার সমর্থনে কোমর বেধে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।
- তার পরিবর্তে অপর কোন ব্যক্তিকে দাড় করানো কিংবা এই নির্বাচনী সংগ্রামে নিরপেক্ষ থাকার মানে বর্তমান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকেই সাহায্য করা।
এমতাবস্থায় আমাদের সামনে আসল প্রশ্ন হচ্ছে যে, একজন মেয়েলোকের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া কি শরীয়তে এতই আপত্তিকর যে তাকে সমর্থন না করে তার বিপরীত বর্তমান জবরদস্তি আর অত্যাচার জুলুমের শাসনকে মেনে নিতে হবে? আমার মতে ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখে এমন কোন ব্যক্তিই বলতে পারে না যে, একজন নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান করার পরিবর্তে এই স্বৈরাচারী ও জালেম শাসনকে কবুল করা উচিত। বরং আমি তো বলবো, একজন নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান বানানো যদি এক আনা দোষের কাজ হয় তা’হলে তার মুকাবিলায় বর্তমান অত্যাচারী ও জালেম শাসনকে বাঁচিয়ে রাখলে কমপক্ষে দশগুণ বেশী গুনাহ হবে। আর খোদার শরীয়ত তো অনেক বড়, সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির একটি বালকও এক টাকা বাঁচানোর জন্য দশ টাকার ক্ষতি স্বীকার করাকে পছন্দ করতে পারে না।
এছাড়া, একথাও মনে রাখতে হবে যে, ইসলামের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান পুরুষ হওয়া একটি শর্ত বটে, কিন্তু নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া ইসলামী শরিয়তে সম্পূর্ণ হারাম- এমন হারাম যে, অত্যন্ত ও সাংঘাতিক প্রয়োজন দেখা দিলেও তা জায়েজ হবে না, এমন কথা কেউই বলতে পারে না। কোরআন-হাদিস থেকে যদি কেউ তা প্রমাণ করতে পারেন তবে করুণ, আমরাও দেখবো। আসলে ইসলামের সাধারণ নিয়মের মধ্যে আমরা কোনই পরিবর্তন করছি না, না তার কোন সংশোধন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু বর্তমানের এই বিশেষ ধরণের অবস্থার কতিপয় প্রয়োজন দেখা দেওয়ার কারণে একজন মহিলাকে রাষ্ট্রপ্রধান করা জায়েজ মনে করছি মাত্র। কেননা, এ কাজ যে চূড়ান্ত ও স্থায়ীভাবে হারাম- এ কথা প্রমাণ করার কোন দলিলই আমরা শরীয়তে পাইনি, এখন একজন নারীকে যদি আমরা মেনে না নেই, তা’হলে তার অপেক্ষা বহুগুণ বেশী বড় অন্যায়কে মেনে নিতে হয়, এবং তা এত বড় যে, শুধু নৈতিক দৃষ্টিতেই নয়, ইসলামের দৃষ্টিতেও তা অত্যন্ত বড় অন্যায় কাজ হয়ে পড়ে।
এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। তা হচ্ছে এই যে ইসলামে রাষ্ট্রপ্রধানের জন্যে কেবল পুরুষ হওয়াই কি একমাত্র শর্ত?… না সেই সঙ্গে আরো অনেক কয়টি শর্ত আছে? কোন এক বিশেষ সময়ে আমাদের সামনে যদি দুই ব্যক্তির মধ্যে একজনকে গ্রহণ করার প্রশ্ন দেখা দেয়, দুজনের একজনকে অনিবার্যভাবে কবুল করে নিতে হয়, আর তাদের একজনের মধ্যে কেবল নারী হওয়া ছাড়া অন্য কোন আপত্তিকর জিনিস না থাকে এবং অপর জনের মধ্যে কেবল পুরুষ হওয়া ছাড়া অন্য সব দিকই হয় মারাত্নকভাবে আপত্তিকর, তা’হলে ইসলামের জ্ঞানসম্পন্ন কোন ব্যক্তি কি আমাদিগকে নারীকে গ্রহণ না করে সেই পুরুষকেই গ্রহণ করার জন্যে বলতে পারে?
ভাইগণ, নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া সংক্রান্ত বিষয়ের শরীয়তের দৃষ্টিতে এ-ই হচ্ছে প্রকৃত অবস্থা। এই কারণেই আমরা আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুহতারিমা ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এমতাবস্থায় আমি দেশবাসীর নিকট আকুল আবেদন করতে চাই, আপনারা দেশের অধিবাসীরা- কেউই যেন এই নাজুক ও জটিল সংকটের সময় গাফিল হয়ে বসে না থাকেন- এই সুবর্ণ সুযোগকে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে কাটিয়ে না দেন। খুব শান্তভাবে ঠান্ডা মনে চিন্তা করে ফয়সালা করুনঃ বিগত ছয় বছর ধরে দেশবাসী যে অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, নিষ্পেষণের তলে নিষ্পেষিত হচ্ছে তাকেই কি স্থায়ী করে রাখতে চান?…. না, এ-কে পরিবর্তন করে এমন এক শাসন-ব্যবস্থা কায়েম করার ইচ্ছা রাখেন, যাতে দেশবাসী এক স্বাধীন মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে জীবন যাপন করার সুযোগ পাবে ও নিজেদের যাবতীয় গুরুতর ব্যাপারে নিজেরাই ফয়সালা গ্রহণ করতে পারেন? প্রথম অবস্থা গ্রহণ করিতে যদি আপনারা রাজী না হন, বরং দ্বিতীয় অবস্থাকেই দেশে বহাল রাখতে চান, তাহলে খোদার ওয়াস্তে বলছি এই সুযোগকে কিছুতেই হারাবেন না। আপনার ভোট পূর্ণ দৃঢ়তার সঙ্গে কেবলমাত্র সম্মিলিত বিরোধী দলের পক্ষে- মুহতারিমা ফাতিমা জিন্নাহর নামে-ব্যবহার করুন। এই সুবর্ণ সুযোগ যদি আপনারা হেলায় হারিয়ে ফেলেন, তা’হলে আপনাকে এবং আপনার ভবিষ্যৎ বংশধরদের এর কুফল দীর্ঘকাল পর্যন্ত ভোগ করতে হবে।
আমি খোদার নিকট দোয়া করছি, তিনি যেন আমাদের সকলকে সঠিক ও নির্ভূল পথ দেখান এবং ভুল পথে যাওয়া থেকে যেন তিনি আমাদিগকে রক্ষা করেন- আমীন।
(২৯শে নভেম্বর পল্টন ময়দানে প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে)
মাওলানা আতাহার আলী সাহেব বলেনঃ
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মুহতারিমা ফাতিমা জিন্নাহকে রাষ্ট্রপ্রধান পদে ভোট দেওয়া যাইতে পারে না বলিয়া একশ্রেণীর আলেম ও পীর নামধারী স্বার্থবাজ ব্যক্তি পবিত্র কোরআন ও হাদিসের যে ধরনের বিকৃত উদ্ধৃতি ও অপব্যাখ্যা দান করিতেছেন তাহা আমি গভীর উদ্বেগের সহিত লক্ষ্য করিয়াছি। আরো পরিতাপের বিষয় এই যে, দেশের সরলপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার কুমতলবে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ হইতে সেইসব বিকৃত উদ্ধৃতি ও অপব্যাখ্যামূলক তথ্যের ভিত্তিতে অসংখ্য পুস্তক-পুস্তিকা ঘরে ঘরে বিলিবন্টন করা হইতেছে।
এমতাবস্থায় খাঁটি সচেতন কোন আলেম ও পীরের পক্ষে কিছুতেই নিশ্চিন্তে বসিয়া থাকা উচিত নহে। আমি দীর্ঘদিন যাবৎ রোগশয্যায় শায়িত থাকিয়াও এইরূপ পরিস্থিতিতে গভীর উৎকন্ঠা বোধ করিতেছি এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একজন নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান পদে ভোট দেওয়া জায়েজ নহে বলিয়া যাহারা দাবী করিতেছেন, তাহাদিগকে উহা প্রমাণিত করার জন্য আমি চ্যালেঞ্জ প্রদান করিতেছি।
পক্ষান্তরে আমি ঘোষণা করতেছি যে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সাহেব যিনি পবিত্র কোরানকে বিকৃত করিয়া বিভিন্ন ধরণের বিধান জারি করেঃ পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর প্রতি চরম অবমাননা প্রদর্শন করিয়াছেন। “তাহাকে ভোট দেওয়া মুসলমানদের পক্ষে সম্পূর্ণ হারাম”।
এই ব্যাপারে কাহারও দ্বিমত থাকিলে তিনি ঢাকা ফরিদাবাদ এমদাদুল উলুম মাদ্রাসার ঠিকানায় আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ তর্কে প্রবৃত্ত হইতে পারেন।
স্বাঃ আতাহার আলী- ১০-১২-৬৪
মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী সাহেবদ্বয় বলেনঃ
যে ব্যক্তি আল্লাহর শাশ্বত চিরন্তন দ্বীনকে আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা চালাইতেছেন, যিনি মুসলিম পারিবারিক আইনের নামে স্বরচিতআইনের দ্বারা আল্লাহ ও রসূলের পবিত্র শরীয়তকে বিকৃত করিয়াছেন এবং ইদ্দত, তালাক ও বিবাহ ইত্যাদি ব্যাপারে কোরানের সুস্পষ্ট আইনকে রহিত করিয়াছেন, তাহাকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য সমর্থন করা কোন মুসলমানের পক্ষে জায়েজ হইতে পারে না।
এইরূপ ব্যক্তির মোকাবেলায় এমন মহিলাকে প্রেসিডেন্ট করা কোনরূপেই অন্যায় হইবে না, যিনি এই শরীয়ত বিরোধী কাজ কখনও করেন নাই।
স্বাঃ নূর মোহাম্মদ আজমী
সেক্রেটারী, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল ওলামা, পূর্ব পাকিস্তান
স্বাঃ নাচিজ শামসুল হক (ফরিদপুরী)
প্রিন্সিপাল, জামেয়া কোরআনীয়া, লালবাগ, ঢাকা।
(১৯৬৪ সালের ৭ই ডিসেম্বর দৈনিক আজাদে প্রকাশিত)
মাওলানা তাজুল সাহেব বলেনঃ
বর্তমানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যিনি প্রধান পুরুষ প্রার্থী-
১. তিনি জনসাধারণের ভোটাধিকার হরণ করিয়া পাকিস্তানের গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করিয়াছেন।
২. তিনি পাকিস্তানকে ইসলামী গণতান্ত্রিক পথ হইতে সরাইয়া একনায়কতন্ত্রের পথে লইয়া যাইতেছেন।
৩. তিনি মুসলিম পারিবারিক আইন জারি করিয়া শরীয়তকে বিকৃত করিয়াছেন এবং ইদ্দত, তালাক, ইসলামের আধুনিকীকরণের চেষ্টা ইত্যাদি ব্যাপারে পবিত্র কোরানের সুস্পষ্ট আইনকে রহিত করিয়াছেন, তাহাঁকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য সমর্থন করা শরীয়তের দৃষ্টিতে কিছুতেই জায়েজ হইতে পারে না, এতদসত্ত্বেও যাহারা তাহাঁকে সমর্থন করিবে, তাহারা ঐ ব্যক্তির যাবতীয় কৃতকর্মের গুণাহের সমঅংশী হইবে।
অপরপক্ষে যিনি মহিলা প্রার্থী-
১. তিনি পাকিস্তানের জন্মের পূর্বে ও পরে গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক।
২. তিনি জনগণের ভোটাধিকার ফিরাইয়া দিতে ওয়াদাবদ্ধ।
৩. তিনি একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটাইয়া পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ওয়াদা করিতেছেন।
৪. তিনি কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক মুসলিম পারিবারিক আইনের অনৈসলামী ধারাসমূহ সংশোধন করার ওয়াদা করিতেছেন এবং পবিত্র শরীয়তকে রক্ষা করার অঙ্গীকার করিতেছেন।
জাতির এই পূর্ণ সংকটময় মূহুর্তে কোরআন বিকৃতকারী ও গণতন্ত্র হত্যাকারীদের অপসারণ করা অপরিহার্য কর্তব্য হইয়া পড়িয়াছে।
এই কার্য সম্পাদন করিতে যদি কোন মহিলার আশ্রয় লওয়া হয়, তবে শরীয়তের দৃষ্টিতে তাহা নাজায়েজ হওয়ার কোনই কারণ নাই। বরং তাহাঁকে জয়যুক্ত করার সব প্রকার প্রচেষ্টা চালাইয়া যাওয়া অবশ্য কর্তব্য হইয়া পড়িয়াছে।
স্বাঃ তাজুল ইসলাম,৮-১২-৬৪
প্রিন্সিপাল, ব্রাক্ষণবাড়ীয়া মাদ্রাসা।
শর্ষিনার পীর মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ছিদ্দীক সাহেব বলেনঃ
একনায়কতন্ত্রমূলক সরকার কর্তৃক ইসলাম ও শরিয়তে ইসলামের খেলাফ কতকগুলি কাজ হওয়ায় দেশের জনসাধারণ, বিশেষ করিয়া ওলামায়ে কেরাম ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিতে বাধ্য হইতেছেন। কিন্তু এই সরকার সে সবের প্রতি কর্ণপাত না করায় দেশের জনসাধারণ ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন হককানী ওলামায়ে কেরামের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ও অসন্তোষের ফলে বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ইসলাম জনসাধারণের স্বার্থে এই সরকার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত শরীয়তের দাবীতে একান্তই সময়োপযোগী এবং শরীয়তসম্মত।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের চিন্তাশীল নেতৃবৃন্দ এবং ওলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্তকে আমি আন্তরিকভাবে সমর্থন জানাইতেছি। এবং আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি আন্তরিকভাবে আবেদন জানাইতেছি যে, জনসাধারণ কর্তৃক অকুন্ঠভাবে সমর্থিত সম্মিলিত বিরোধী দলকে ইসলামের মহান স্বার্থে কামিয়াব করুন।
(দৈনিক আজাদ, ১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৬৪ইং)
মাওলানা মোহাম্মদ আবদুর রহীম সাহেব বলেনঃ
নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া জায়েজ নাই বলিয়া শর্ষিনা হইতে সম্প্রতি যে ফতোয়া প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ মনগড়া কথায় পূর্ণ। তাহাতে যেসব দলিলের উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহার কোন একটি দ্বারাও একথা প্রমাণিত হয় না যে, নিতান্ত প্রয়োজনে ঠেকিয়াও কোন সময়েই নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান করা সম্ভব নহে।
<2.47.255-256>
শিরোনামঃ নির্বাচনোপলক্ষ্যে সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধের সরকারী ব্যবস্থা সম্পর্কে ঘোষণা
সূত্রঃ সরকারী
তারিখঃ জানুয়ারী, ১৯৬৫
সরকার কিছুদিন যাবৎ লক্ষ্য করিয়া আসিতেছেন যে, কিছু সংখ্যক লোক আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রাক্কালে দেশে ব্যপকভাবে শান্তি ভঙ্গকরার পরিকল্পনা করিতেছে। প্রদেশের বিভিন্ন স্থান হইতে বিশৃঙ্খলাজনিত দুর্ঘটনা, শান্তি ভঙ্গ ও ভীতি প্রদর্শনের সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। সুতরাং দেশে যাহাতে মুক্ত ও শান্তিপূর্ণ আবহাওয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতে পারে, সে জন্য সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন। নির্বাচক মণ্ডলীর সদস্যরা যাহাতে পূর্ণ স্বাধীনতার সহিত তাহাদের ভোট প্রদান করিতে পারেন, উহার নিশ্চয়তা বিধানে সরকার স্থিরসংকল্প। এই উদ্দেশ্যে সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছেন। শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রত্যেক নির্বাচন কেন্দ্রে কড়া পুলিশ প্রহরা মোতায়েন কড়া হইতেছে। নির্বাচন কেন্দ্রের বাইরে যে কোন জরুরী অবস্থার মোকাবিলার জন্য ভ্রাম্যমাণ প্রহরার বন্দোবস্ত কড়া হইবে। নির্বাচন মণ্ডলীর সদস্যদের ভীতি প্রদর্শন, অন্যায়ভাবে কোথাও আটক না কোনরূপ বল প্রয়োগ করিলে কঠোর শাস্তি প্রদান কড়া হইবে। প্রদেশের নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি প্রশাসন বিভাগের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দান করা হইয়াছে।
প্রয়োজনবোধে বেসামরিক কর্তৃপক্ষ তলব করিলে শান্তি রক্ষার জন্য সামরিক বাহিনীও আগাইয়া আসিবে। নির্বাচন কেন্দ্রের ভিতরে ও বাইরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনবোধে উপযুক্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করিতে পারিবেন।
নির্বাচনমণ্ডলীর সদস্যদের নির্ভীক ও স্বাধীনভাবে ভোট প্রদানে বাধা দানের জন্য নির্বাচনের পূর্বে বা নির্বাচন চলাকালে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অথবা ভোট কেন্দ্র হইতে প্রত্যাবর্তনের সময় কোন সদস্যের প্রতি বল প্রয়োগ করিলে তাহাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।
শিরোনামঃ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল
সূত্রঃ সরকারী
তারিখঃ ৮ই জানুয়ারী, ১৯৬৫
পরিশিষ্ট ৭
নির্বাচনী রিটার্ন,
১৯৬৫ রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক নির্বাচন কমিশনের নিকট দাখিলযোগ্য
প্রদেশ |
ক্রমিক নম্বর |
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নাম | প্রদত্ত বৈধ ভোটের সংখ্যা | অবৈধ ভোটের সংখ্যা | প্রদত্ত বৈধ ও অবৈধ ভোটের মোট সংখ্যা | প্রত্যেক প্রার্থীর লব্ধ ভোটের শতকরা হার |
পূর্ব পাকিস্তান মোট | ১ | ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খান | ২১,০১২ | ২৭৪ | ৩৯,৮২৪ | ৫৩.১২ |
২ | জনাব কে এম কামাল | ৯৩ | ০.২৩ | |||
৩ | মিয়া বশীর আহমদ | ১১ | ০.২০ | |||
৪ | মিস ফাতিমা জিন্নাহ | ১৮,৪৩৪ | ৪৬.৬০ | |||
পূর্ব পাকিস্তান মোট | ১ | ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খান | ২৮,৯৩৯ | ৫৩৬ | ৩৯,৮৭৬ | ৭৩.৫৬ |
২ | জনাব কে এম কামাল | ৯০ | ০.২৩ | |||
৩ | মিয়া বশীর আহমদ | ৫৪ | ০.১৪ | |||
৪ | মিস ফাতিমা জিন্নাহ | ১০,২৫৭ | ২৬.০৭ | |||
পূর্ব পাকিস্তান মোট | ১ | ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খান | ৪৯,৯৫১ | ৮১০ | ৭৯,৭০০ | ৬৩.৩১ |
২ | জনাব কে এম কামাল | ১৮৩ | ০.২৩ | |||
৩ | মিয়া বশীর আহমদ | ৬৫ | ০.০৮ | |||
৪ | মিস ফাতিমা জিন্নাহ | ২৮,৬৯১ | ৩৬.৩৬ |
আমি, ১৯৬৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী আইনের ৩৮(১) ধারা অনুসারে, এদ্বারা ঘোষণা করছি যে, ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খান সর্বোচ্চসংখ্যক ভোট লাভ করে পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনের এই রিটার্ন এতদ্বারা নির্বাচনী কমিশনের নিকট পেশ করা হল।
স্থানঃ রাওয়ালপিন্ডি স্বাক্ষরঃ জি মঈনুদ্দীন,
তারিখঃ ৮ই জানুয়ারি, ১৯৬৫ সাল। রিটার্নিং অফিসার
<02.48.257-260>
শিরোনামঃ ন্যাপের ১৪ দফা
সূত্রঃ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি
তারিখঃ ৫ জুন, ১৯৬৫
ন্যাপের ১৪ দফা-জাতীয় মুক্তির কর্মসূচী
(ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ৪ঠা, ৫ই, ৬ই ও ৭ই জুনের সভায় গৃহীত)
স্বাধীনতা লাভের ১৮ বছর পর পাকিস্তান আজ বিগত দিনের পুঞ্জীভূত সমস্যায় জর্জরিত হইয়া এক যুগসন্ধিক্ষণে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। একটির পর আরেকটি সরকার আসিয়াছে, কিন্তু তাহারা সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে প্রত্যেকেই পুরাতনের সহিত নতুন সমস্যা যোগ করিয়াছে। ফলে শেষ পর্যন্ত কোন সমস্যাই দূর হয় নাই, উহা আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং দেশের সম্মুখে এক ভয়াবহ ইঙ্গিত বহনকারী সংকটের উদ্ভব হইয়াছে। এই সংকটের গুরুত্ব আরও প্রকটিত হইয়াছে সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়। যুদ্ধের সময় আমরা যে পরীক্ষার সম্মুখীন হইয়াছিলাম তাহার ফলে আমাদের বহু ভুল ধারনা পরিবর্তন হইয়াছে, বহু ধারনার সম্পূর্ণ বিপরীত ফল ফলিয়াছে। ক্ষমতাসীনেরা জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন যে-সমস্ত মৌলিক সমস্যা হিমাগারে নিক্ষেপ করিয়া রাখিয়াছিল তাহা নূতন গুরুত্ব লইয়া অকস্মাৎ প্রকট হইয়া উঠিয়াছে এবং অবসাদগ্রস্ত সমগ্র জাতিকে নাড়া দিয়াছে। বিগত সময়ের যে সকল সমস্যা সমাধান তো দূরের কথা স্পর্শই করা হয় নাই, উহা আজ অধিকতর গুরুত্ব লইয়া হাজির হইয়াছে। সংক্ষেপে বলিতে গেলে বলা যায় যে, সমস্যা আজ সমগ্র জাতির মুখোমুখি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে এবং সমাধানের বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণের আওয়াজ তুলিয়াছে।
পূর্বের যে-কোন সময় অপেক্ষা এখন আমাদের জাতীয় জীবনের অন্তর্নিহিত ত্রুটি ও বৈসাদৃশ্যসমূহ প্রকটভাবে প্রকাশিত হইয়াছে। তাই আজিকার অত্যন্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হইল আমাদের সামগ্রিক জাতীয় গঠন প্রকৃতির একটি নির্দিষ্ট রূপ প্রদান করা। এবার দেশের অর্থনৈতিক পদ্ধতি, প্রশাসনিক কাঠামো, রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং পররাষ্ট্রনীতি, প্রত্যেকটিই সত্যকার পরীক্ষার সম্মুখীন হইয়াছে এবং প্রমানিত হইয়াছে যে, বর্তমানে অনুসৃত নীতির কোনটাই আমাদের প্রয়োজনের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বর্তমান সরকার পদ্ধতি
বর্তমান পদ্ধতির সরকার পাকিস্তানের জনগণের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী; এমনকি মারাত্মক ক্ষতিকর বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। পাকিস্তানে যে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি চালু রহিয়াছে, তাহা আমাদের দেশের প্রয়োজনের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। এক হাজার মাইল বিদেশী রাষ্ট্রের দ্বারা বিচ্ছিন্ন ইহার দুইটি অংশ লইয়া পাকিস্তান এমন একটি প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি চালু রাখিতে পারে না, যেখানে সমস্ত ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হস্তে কেন্দ্রীভূত থাকে। ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল-এর মতো অবিকল একটি কেন্দ্রীয় সরকার, বাজেট ও আইন প্রণয়নের চূড়ান্ত ক্ষমতাহীন একটি জাতীয় পরিষদ, প্রেসিডেন্টের মনোনীত ব্যাক্তি হিসাবে দুইজন প্রাদেশিক গভর্নর ও তাঁহাদের নিজস্ব বাছাই করা ব্যক্তিবর্গকে লইয়া গঠিত মন্ত্রীপরিষদদ্বয় ও কার্যতঃ ক্ষমতাহীন দুইটি প্রাদেশিক পরিষদ পাকিস্তানের প্রয়োজন মিটাইতে মোটেই সক্ষম নহে। বর্তমানে যে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি চালু রহিয়াছে তাহা পাকিস্তানের অদ্ভুত ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য ও ইহার বিভিন্ন ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে সুষ্ঠুভাবে শাসন করিতে পারে না; কারণ ইহা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপান্তরিত করিতে অক্ষম; যেহেতু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পরিষদ এমন ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক নির্বাচিত হন, যাঁহারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার পরিবর্তে একপেশে, উপজাতীয়, পারিবারিক ও অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর স্থানীয় অবস্থার ভিত্তিতে নির্বাচন হইয়া থাকেন, সেহেতু রাজনৈতিক দিক দিয়া প্রেসিডেন্ট কিংবা জাতীয় পরিষদ পাকিস্তানের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, এমন কথা বলা যায় না।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা
১। খাদ্য সমস্যাঃ পাক-ভারত যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন হইয়াছে, এবং এই খাদ্য পরিস্থিতি এখন এত তীব্র রূপ ধারন করিয়াছে যে, প্রদেশব্যাপী বিশেষ করিয়া গ্রাম অঞ্চলে প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করিতেছে। চাউল প্রতিমণ ৪০ টাকা ও তদূর্ধ্ব মূল্যে বিক্রয় হইতেছে- যাহা শতকরা অন্ততঃপক্ষে ৯৫ জন লোকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। গ্রাম অঞ্চলের জনসাধারণ আরও অতিরিক্ত দুর্দশার সম্মুখীন হইয়াছে লেভী ব্যবস্থার ফলে। লেভী ব্যবস্থা এমনভাবে কার্যকরী করা হইয়াছে যে, ইহা জুলুকে পরিনত হয়েছে এবং ইহার সহিত সার্টিফিকেট প্রথা মিলিত হইয়া এই জুলুমকে গ্রামীণ জনসাধারণের নিকট আরও অসহনীয় করিয়া তুলিয়াছে। এই সব কিছুই খাদ্য সমস্যাকে আরও তীব্রতর করিয়াছে এবং জনসাধারণের দুর্দশাকে বহুমুখী করিয়া তুলিয়াছে।
২। পাটচাষী প্রসঙ্গেঃ পাটচাষিদের উপর শোষণ অবাধভাবে অব্যাহত রহিয়াছে, উপরন্তু ইহা আরও তীব্র হইয়াছে। তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য তাহারা পাইতেছে মণপ্রতি ১৩ টাকা। ইহা তাহাদের উৎপাদন ব্যয় অপেক্ষা অনেক কম। ইহার ফলে পাটচাষীরা কোনক্রমে তাহাদের শ্রমমূল্য লাভ করিতে পারে- বাঁচার মত মজুরী তাহারা পায় না। পাটের ন্যায্য মূল্য বাধিয়া দেওয়া উহা কার্য্যকরী করার ব্যাপারে বাস্তব কোন কিছু করা হয় নাই। ফলস্বরূপ, পাট চাষীরা ১৮ বৎসর আগে যেখানে ছিল বস্তুতঃ এখনও সেই একইস্থানে রহিয়াছে-পক্ষান্তরে, জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ব্যয় মাত্র কয়েক বৎসর পূর্বের তুলনায়ও বর্তমানে বহুগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। পাটের বর্ধিত মূল্য হইতে পাটচাষীরা বঞ্চিত হইতেছে, কিন্তু পক্ষান্তরে মুনাফা করিতেছে ফড়িয়া, মিল মালিক ও রফতানীকারকরা।
৩। পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষকদের অবস্থাঃ সামরিক শাসনামলে বহুল প্রচারিত ভূমি সংস্কার আজ অতীতের গর্ভে বিলীন হইয়াছে। প্রাক্তন ভূ-স্বামীরা সামরিক শাসনামলের এই সংস্কারকালে হারানো তাহাদের অধিকাংশ জমির উপর অধিকার পুনরায় ফিরিয়া পাইয়াছে এবং তাহারা পূর্বের ন্যায় উৎপন্ন শস্য নির্ভয়ে ও অবাধে নিজেদের গোলায় লইয়া তুলিতেছে। শত শত বৎসর ধরিয়া ভূমি মালিকেরা যেভাবে ভূমিহীন কৃষকদের উপর শোষণ চালাইয়া আসিতেছে সেই শোষণ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে তাহারা এখনও পূর্ব অধিকার ভোগ করিতেছে।
ভূমিহীন কৃষকদের এই দুর্দশার সহিত যোগ হইয়াছে ‘অদৃশ্য ভূস্বামী’ হিসাবে আমলাতন্ত্রীদের নির্যাতন। বাঁধ এলাকায় বা অন্যান্য সরকারী জমি এই সকল সরকারী কর্মচারীদের সুবিধাজনক দামে বা ‘ইনাম’ হিসাবে প্রদান করা হইতেছে। এইভাবে একটি ‘অদৃশ্য ভূস্বামী’ গোষ্ঠী সৃষ্টি করিয়া চিরন্তন ভূমিহীন চাষীদের উপর তাহাদের চাপাইয়া দেওয়া হইতেছে। এবং তাহারাও এই ‘অদৃশ্য ভূস্বামী’ ক্রীতদাসে পরিনত হইতেছে।
ইক্ষুচাষীদের অবস্থা
পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশেই ইক্ষুচাষীরা শোষিত হইতেছে। চিনি মিল মালিকেরা উচ্চ মূল্যে চিনি বিক্রয় করিয়া যখন প্রচুর অর্থ উপার্জন করিতেছি তখন ইক্ষুচাষীরা বিভিন্ন ধরনের শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হইয়া তাহাদের ন্যায্য উপার্জন হইতে বঞ্চিত। মিল মালিকেরা তাহাদের মর্জিমাফিক ইক্ষুর মূল্য নিয়ন্ত্রন করিয়া থাকে। ইক্ষুর উপর তাহারা তাহাদের নিজেদের নির্ধারিত মূল্য চাপাইয়া দেয়। বেশী মূল্যে তাহারা ইক্ষু ক্রয় করিতে অস্বীকার করিয়া ইক্ষুচাষীদের বাধ্য করে কম মূল্যে তাহাদের পন্য বিক্রয় করিতে। ইক্ষুচাষীদের বাধ্য করিবার জন্য তাহারা কৃষকের পণ্য বিক্রয়ের উপর নানবিধ বাধানিষেধ আরোপ করে। ইক্ষুর পরিবর্তে তাহারা মিলে কাঁচামাল হিসেবে ‘গুড়’ ব্যবহার করে। এইভাবে বিভিন্ন পন্থায় তাহারা ইক্ষুচাষীদের অনাহারে এবং করুণার পাত্র করিয়া রাখে। এই অবস্থায় মিল মালিকরা যে শর্ত আরোপ করে তাহা মানিয়া লইয়া নতি স্বীকার করা ভিন্ন ইক্ষুচাষীদের আর কোন গত্যন্তর থাকে না। ইক্ষুচাষীদের এই অবস্থার প্রতিকার বিধানের ব্যাপারে কাহারও মাথাব্যথা আছে বলিয়া মনে হয় না। ডেপুটি কমিশনাদের ন্যায় সরকারী কর্মচারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরিণত বুদ্ধি সম্পন্ন ও অযোগ্য হইয়া থাকে এবং তাহারা প্রায়শঃই মিল মালিকদের লোভের শিকারে পরিণত হইয়া তাহাদের প্রতি সমর্থন প্রদান করিয়া থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিদিনই কৃষকদের অবস্থার অবনতি ঘটিতেছে। জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততায় বিনষ্ট হাজার হাজার একর জমি চাষের অনুপযোগী হইয়া পড়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিশেষ করিয়া পাঞ্জাবের বিভিন্ন জেলার কৃষকরা এই ভয়াবহ ভবিষ্যতের সম্মুখীন হইয়াছে। অসংখ্য কৃষক আজ এই দুর্যোগময় ভবিষ্যতের মুখোমুখি হইয়াছে। ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা ও অনাবৃষ্টি কৃষকদের একইরূপ অভিশাপের মত কাজ করে। ইহারই ফলশ্রুতি দুইটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দেখিতে পাওয়া যাইবে। প্রথম ক্ষেত্রে, কৃষি উৎপাদন বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। দ্বিতীয়তঃ কৃষক অধিক হারে ভূমিহীন ও কর্পদহীন হওয়ার দরুন শিল্পোন্নয়নের সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণের পরিবর্তে দ্রুত সংকুচিত হইতেছে- যাহার ফলে গুরুতর জাতীয় সংকটের সৃষ্টি হইতেছে।
শ্রমিকদের অবস্থা
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিমূল্যের ফলে শ্রমজীবী জনসাধারণের জীবনধারণ ক্রমশঃ কষ্টসাধ্য হইয়া উঠিতেছে। কল-কারখানার মালিকগণ স্বাধীনভাবে ও নির্ভয়ে শ্রমিকদের শোষণ করিয়া প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। কিন্তু শ্রমিকগণ কয়েক বছর আগে যে বেতন পাইতেন, এখনও কার্য্যতঃ সেই বেতনই পাইতেছেন। ধর্মঘট ও যৌথ দরকষাকষির মৌলিক অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া শ্রমিকদিগকে মালিকেরা খেয়ালখুশীর তাঁবেদার একক ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠীতে পরিনত করা হইয়াছে। তাঁহাদের দুঃখ-দুর্দশা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাইয়া চলিয়াছে, অথচ তাঁহাদের বেতনের হারের কোন পরিবর্তন ঘটে নাই, তদুপরি তাঁহাদের অধিকারসমূহকে খর্ব ও পদদলিত করা হইয়াছে। বিড়ি শ্রমিকগণ বিশেষভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। টেন্ডু পাতার ব্যবহার ও আমদানী নিষিদ্ধকরণের ফলে তাঁহারা বেকারত্ব ও অনাহারের সম্মুখীন হইয়াছে।
ছাত্রদের অবস্থা
শিক্ষা ক্রমবর্ধমান হারে ব্যবসায় পরিণত হইতেছে। স্কুল-কলেজের বেতন প্রদান করা অধিকাংশ পিতামাতার ক্ষমতার বাইরে চলিয়া গিয়াছে। অধিকহারে স্কুল, কারিগরি ও মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ব্যাপারে দৃষ্টি না দেওয়ার ফলে অধিকাংশ পিতা-মাতা তাহাদের সন্তান-সন্ততিকে বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ভর্তি করাতে পারেন না। পাঠ্য পুস্তকের ব্যবসায় চরম জালিয়াতি চলিতেছে। প্রতি বছর পাঠ্য-পুস্তক বদল করার ফলে পুরানো বই আর ব্যবহার করা যায় না। বহু অর্ডিন্যান্স ও অন্যান্য নিয়মকানুনের মাধ্যমে ছাত্রদের স্বাধীন ও অবাধ বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের পথে প্রতিনন্ধকতা সৃষ্টি করিয়া এবং দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে তাহাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের সুযোগ হইতে বঞ্চিত করিয়া তাহাদিগকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করা হইতেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলশিক্ষকগণ এক বিশেষ দুর্দিনের মধ্যে কালযাপন করিতেছেন, তাহাদের কার্যকলাপের উপর গোপন খবর রাখা হইতেছে ও বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হইতেছে।
শিল্পখাত
একচেটিয়াবাদ ও কার্টেলের স্বার্থে পুঁজির একত্রীকরণ আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। ইহা পাকিস্তানের জন্য শুভ ইঙ্গিত নয়। ইহা আরও বেশী ভয়াবহ এই কারণে যে, এই নতুন ধারাটি সরকারের আনুকূল্য ও উৎসাহ লাভ করিতেছে। ইহা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক যে, সম্প্রতি অনুমোদিত ৪৮টি নতুন শিল্প রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য মঞ্জুর করা হইয়াছে। এই সকল উপকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে মুখচেনা রাজনীতিক, আমলা, বর্তমান ও অতীতের বহু মন্ত্রী ও পরিষদ সদস্য রহিয়াছেন। এই সমগ্র নীতিটিকে রাজনৈতিক ঘুষ বলিয়া মনে হয়। ইহা সকলেই জানেন যে, এই সকল শিল্প স্থাপনের জন্য যাঁহাদিগকে অনুমোদন দেওয়া হইয়াছে তাঁহারা সকলেই এই পারমিটগুলো খোলা বাজারে বিক্রি করিতেছেন এবং পুঁজিপতিগোষ্ঠী একটি টেক্সটাইল মিলের (সুতা কল) পারমিটের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা প্রদান করিতেও কুণ্ঠিত নয়। সরকারী খাত হইতে ব্যক্তিগত মালিকানার শিল্প প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর মনোপলির স্বার্থে কাজ করিতেছে। জরুরী সম্পত্তি আইনের সাহায্যে দখলকৃত চা-বাগানসমূহ বিশেষ সুবিধাভোগী একচেটিয়া পুঁজির মালিকদিগকে প্রদান করা হইয়াছে।
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের যুদ্ধ
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পাক-ভারত যুদ্ধের অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ফল পাইয়াছে। ইহা একদিকে আমাদের সকলের মধ্যেকার দেশপ্রেমের চেতনা প্রকাশ করিবার পূর্ণ সুযোগ প্রদান করিয়াছিল। তুরখাম হইতে টেকনাফ পর্যন্ত সর্বত্র প্রতিটি পাকিস্তানী দেশ রক্ষার কাজে সামিল হইয়াছিল। ৬ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি ভূমির স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষাকল্পে মহতী ত্যাগের প্রস্তুতিতে জনগণ নতুন সত্ত্বা লইয়া আত্মপ্রকাশ করিয়াছে।
পাকিস্তানের উভয়াংশে ও ইহার দূর অঞ্চলের জনগণ ইহা প্রমাণ করিয়াছেন যে, তাঁহারা পাকিস্তান, ইহার সংহতি ও ঐক্যের স্বপক্ষে। সাধারণ মানুষের কোন রাজনৈতিক চেতনা নাই- জনগণের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকারের মাধ্যমে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করিয়া ব্যক্তিগত শাসন চিরস্থায়ী ও সীমাহীন সম্পদ কুক্ষিগত করিতে যাহারা অভিলাষী জনগণ তাহাদের এই হীন এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করিয়াছেন। আর বেশী দিন জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহকে অস্বীকার করা যাইবে না এবং জনগণ আর অধিক দিন স্বৈরতন্ত্রকে সহ্য করিবে না কিংবা এক-নায়কত্ববাদকেও গ্রহণ করিবে না।
দ্বিতীয়তঃ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, এই অঞ্চলের শাসকগোষ্ঠীর অধীনে পাক-ভারত উপ-মহাদেশে একটি যৌথ প্রশাসন ব্যবস্থা সৃষ্টি করিয়া আমেরিকার টাকা ও অস্ত্রের সাহায্যে আমাদের উত্তর অঞ্চলের প্রতিবেশীগণকে প্রতিহত করিবার এবং তদ্বারা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে নির্ণয়ের সাম্রাজ্যবাদীদের মহাপরিকল্পনা নিদারুণভাবে মার খাইয়াছে।
পাকিস্তান ও ইহার জনগণ সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে। ভারতের সাথে সরাসরি একত্রীকরণ বা কনফেডারেশন গঠন কিংবা যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অথবা যৌথ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কার্যকরীকরণের সম্ভাব্যতার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে সন্দেহের উদ্ভব হইয়াছিল সাময়িকভাবে হইলেও তাহার অবসান ঘটিয়াছে।
ইহা দুর্ভাগ্যজনক যে, সরকারের বিভিন্ন প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে যুদ্ধের প্রচারের সাথে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করিয়া দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক আবহাওয়াকে বিষাক্ত করিয়া তোলা হইয়াছিল। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্বিচারে আক্রমণের শিকারে পরিণত হইয়াছিল।
<2.48.261-266>
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
১৯৫৮ সালে কতিপয় সমর নেতা কতৃক পাকিস্তানের মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বাতিল , আমাদের পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন , জাতীয় চিন্তার ক্ষেত্রে ভারতের সাথে সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের ফলাফল , রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগনের মধ্যে পুঞ্জীভূত অসন্তোষ এবং এই অবস্থা পরিবর্তনের ইচ্ছা সহ ১৯৫৭ সালে ন্যাপের জন্মলগ্ন হইতে এ যাবত সংঘটিত ঘটনাবলী সম্পর্কে ১৯৫৭ সালে আমরা সুস্পষ্টভাবে যে বক্তব্য তুলিয়া ধরিয়াছিলাম , তাহার সত্যতাই প্রমান হইয়াছে। ইতিহাস আমাদের চিন্তা ধারার যৌক্তিকতা ও ঘটনাপ্রবাহ জাতীয় সমস্যাবলী সম্পর্কে আমাদেরবিশ্লেষণ নির্ভুল বলিয়া প্রমান করিয়াছে।
প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদলের লইয়া গঠিত ফেডারেল সরকারের সাথে জনগনের সরাসরি যোগাযোগকেঅস্বীকার করার ফলেসেপ্টেম্বর যুদ্ধের পরে এক গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি হয়।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও তাঁহার দলের যে কোন জাতীয় প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্র নাই তাহা উদঘাটিত হইয়াছে। এবং জনগনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ভীতি প্রদর্শন ব্যাতিরেকে কোন বিস্ফোরনোন্মুখ রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করিতে তাহারা অক্ষম। ইহা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, গত ৮ বছর যাবত দেশ যে গন প্রতিনিধিত্ববিহীন স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট হইতেছে, ইহা তাঁহারই প্রত্যক্ষ ফল।
খাদ্যের ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান সংকট আমাদের অর্থনীতির দুর্বল চরিত্র কে প্রকট করিয়া তুলিয়া ধরিয়াছে। চড়া হারের সুদে কোটি কোটি ডলারের সাহায্যে গ্রহন করিয়াও সরকার জনসাধারণের অর্থনৈতিক সম্পদ দ্রুত ওক্রমবর্ধমানভাবেপুঞ্জীভূত হইয়া ওঠা এবং আমলাতন্ত্রের একটি নূতন ও শক্তিশালী ভূস্বামী ও শিল্প অভিজাত শ্রেণীতে রুপান্তর এমন এক বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করিয়াছে সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে ছাড়া যাহার মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
বহুদিন পূর্বেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ইহা উপলব্ধি করিয়াছিল যে, পাকিস্তানের দুইঅংশের অর্থনৈতিক জীবনের উন্নতি সাধনে ব্যর্থ হইয়াছে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবারের হাতে দেশেরঅর্থনৈতিক বৈষম্য দুরীভুত হওয়া এবং পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়ন ত্বরান্বিত করা উচিত। শিল্প উন্নয়নের সুফলগুলি ও অর্থনৈতিক উন্নতি কতিপয় এলাকায় অথবামুষ্টিমেয়পরিবারের মধ্যে যেন সীমাবদ্ধ না হয় ,তাহার নিশ্চয়তা বিধানও একান্ত আবশ্যক। যাহাদের বুঝিবার সদিচ্ছা আছে তাহাদের প্রত্যেকের জন্য আমাদের পার্টির পক্ষ হইতে ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রুপরেখা বর্ণিত রহিয়াছে।চীন , ইন্দোনেশিয়া, ইরান তুরস্ক,ও অন্যান্য এশীয় দেশ প্রমাণ করিয়াছে যে , পাকিস্তান তাহাদের মৈত্রীক উপর নির্ভর করিতে পারে। সাম্রাজ্যবাদীদের স্বরূপ উদঘাটিত হওয়ার সাথে সাথে আমাদের বৈদেশিক সম্পর্কের এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা ঘেঁষা রুপরেখা নূতন করিয়া অনুমোদিত হইয়াছে । ঘটনাপ্রবাহ বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা অকাট্য যৌক্তিকতা হাজির করিয়াছে।
অনেক মূল্যের বিনিময়ে দেশ আজ বুঝিতে পারিয়াছে যে রাওয়ালপিণ্ডি হইতে পাকিস্তানকে রক্ষা করা হইবে , উচ্চ স্বরে ঘোষিত এই তত্ত্ব বাস্তব অথবা কার্যোপযোগী নয়।পাকিস্তানের দুই অংশের প্রতিরক্ষার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহনের এবং প্রতিরক্ষা নীতির সমন্বয় সাধন জনিত প্রয়োজনাদি সাপেক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে নৌ-সদর দপ্তর স্থানান্তরের অত্যাবশ্যকতার কথা ১৯৫৭ সালের প্রনীতন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে। আমরা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারী খাতে মূল ও ভারী শিল্প স্থাপনের দাবী ও করেছিলাম। যদি আমাদের প্রস্তাব গ্রহন করা হইত এবং আমলাতন্ত্র উহাকে উপেক্ষা না করিত তবে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত অসহায় অবস্থা এবং অস্ত্র নির্মান কারখানা স্থাপন করিয়া দেশের উভয় অংশ কতৃকঅস্ত্রশস্ত্র নিজ নিজ চাহিদা পূরনের ব্যাপারে অক্ষমতা, যাহা সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের সময় প্রকট হইয়া পড়িয়াছিলো্, এড়ান সম্ভব হইত।
পাকিস্তানেরউভয়াঞ্চলের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তাসেপ্টেম্বরের যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে যাহা প্রকটভাবে দেখা দিয়াছে , আমরা শুরু হইতেই উপলব্ধি করিয়াছি।আমরা ১৯৫৭ সালে দাবি করিয়াছিলাম যে ,পূর্ব ও পশ্চিমপাকিস্তানেরস্বায়ত্তশাসিত দুইটি ইউনিটের ভিত্তিতেপাকিস্তানকে একটি পূর্ন স্বাধীন ও সার্বভৌম এবং জনকল্যানমূলক ফেডারেল রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তোলা উচিত। আমরাপাকিস্তানকে এইরূপ একটি রাষ্ট্রহিসাবে দেখিয়াছি যেখানে রাষ্ট্রেরসার্বভৌম অধিকার জনসাধারনের ওপরই ন্যস্ত থাকিবে এবং সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ও যুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত গন পরিষদ উহা প্রয়োগ করিবে।আমরা পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি আঞ্চলিক ফেডারেশন হিসাবে পুনর্গঠনের দাবি করিয়াছি, যাহার আইন পরিষদে কোন একটি প্রদেশ অন্য প্রদেশ অপেক্ষা অধিক সংখ্যক আসনের অধিকারী হইবে না এবং ভাষা ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিতে প্রদেশ সমূহপুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করিয়াছি।
পাকিস্তানের উভয়াঞ্চলের জনসাধারণ দরিদ্র নির্যাতিত এবং রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার স্বাধীনতা ও মর্যাদা হইতে বঞ্চিত।আমরা মনে করি সমাজতান্ত্রিক সমাজকে গ্রহন করাই ইহার জবাব।বিভিন্ন দেশে মানুষের অর্জিত শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া উচিত।মুষ্টিমেয় ব্যক্তির স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি পরিহার করা উচিত। সকল পাকিস্তানীকেই আমাদের জাতীয় সম্পদের অংশীদার বলিয়া গণ্য করা উচিত। ইহাদের পূর্ণ আত্মবিকাশের অধিকার রহিয়াছে এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অধীনে সম সুযোগের অধিকার রহিয়াছে।
বর্তমানে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার কতৃক আরোপিত শাসনতন্ত্র ও সরকারী নীতিসমূহ শুধু যে একটি মুষ্টিমেয় শ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী এক ব্যক্তির হাতের সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করিয়া দিয়াছে তাহাই নয় ইহা জনসাধারণের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীনতাকে অস্বীকার করিয়াছে। সম্পদ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হইয়াছে। এই অবস্থায় আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হইবে এমন একটি প্রতিনিধিত্বশীল ও গনতান্ত্রিক কাঠামো গড়িয়া তোলা যেখানে ক্ষমতা একটি সম্পূর্ণ সার্বভৌম আইন পরিষদে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদের হস্তে ন্যস্ত থাকিবে। পাকিস্তানে সকল অংশের ঐক্য রক্ষায় ও সকল পাকিস্তানীর অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামের ব্যাপারে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সকল নাগরিকের সমান সুযোগ, বিভিন্ন এলাকা ও জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ হইতেছে আমাদের সামনে যে সমস্যাবলী রহিয়াছে উহার প্রত্যুত্তরে আমাদের জবাব। সকল পাকিস্তানির জন্য জনগনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক আমাদের লক্ষ্য। পূর্ব পাকিস্তানেরঅর্থনৈতিক উন্নয়নের সমস্যার সমাধান অবশ্যই করিতে হইবে এবং উহারজনগণের উপর বিদেশী, পূর্ব পাকিস্তানী বা পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি যেই হউক না কেন তাহাদের শোষন খর্ব ও নিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে। দেশের সকল অংশকে যথাযথ ভাবে রক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে এবং সকল অঞ্চলের জনসাধারণকে জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগদানের পরিপূর্ণ সুযোগ প্রদান করিতে হইবে। সেনাবাহিনীকে জাতীয় ভিত্তিতে গঠন করিতে হইবে এবং ক্রমশ উহার গঠন জনসংখ্যার আনুপাতিক হইতে হইবে। জাতীয় প্রতিরক্ষা , পররাষ্ট্রনীতি ও মুদ্রা এবং এই সকল বিষয়ে কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ফেডারেল সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকিবে। এবং এইগুলি ছাড়া অপরাপর সকল বিষয়কেই প্রাদেশিকীকরন করিতে হইবে । পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সেনাবাহিনীকে ভিত্তি করিয়াপূর্ব পাকিস্তানেরপ্রতিরক্ষার জন্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রদানকে প্রথম অগ্রাধিকার দিতে হইবে। গনতন্ত্র , স্বায়ত্তশাসন ও সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে ঐক্য ও স্বাধীনতার পথে আগাইয়া চল -ইহাই হইতেছে আমাদের শ্লোগান।
সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণ
আমরা একথা বলিতে পারিনা যে ,একটা দেশের মধ্যে যেমন একদল বঞ্চিত ও একদল বিত্তশালী রহিয়াছে তেমনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাষ্ট্র সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করিয়াছে। সর্বাপেক্ষা ধনী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইহার তাবেদার রাষ্ট্রগুলি সহ একটি নতুন ধরনের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়িয়া তুলিয়াছে। যুক্তরাষ্ট্র অর্থও ক্ষমতার উপর তাঁহার একচেটিয়া অধিকার কায়েম রাখার জন্য মনুষ্যজাতীর ওপর একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চাপাইয়া দেওয়ার চেষ্টা করিতেছে। ভিয়েতনামে যুদ্ধ সম্প্রসারন চীনের বিরুদ্ধে নয়া মোকাবেলা, ভারতকে দ্রুত অস্ত্রসজ্জিতকরন , সেন্টো ও সিয়েটো ধরনের সংস্থা গঠনের নয়া প্রচেষ্টা এইসবকিছুই ঐ অভিসন্ধি নির্দেশ করে।পাকিস্তান সম্প্রতি উহার বাণিজ্যকেবহুমুখী করার এবং চীন , সোভিয়েথ ইউনিয়ন, অন্যান্য সমাজতান্ত্রিকরাষ্ট্র ও আফ্রো-এশিয়- লাতিন আমেরিকান রাষ্ট্রগুলির সহিত সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করিতেছে ; কিন্তু আমরা এখনোসেন্টো-সিয়েটো হইতে বাহির হইয়া আসি নাই। এবং এখনো আমাদের দেশে মার্কিন সরকারের ঘাটি বিদ্যমান রহিয়াছে । বিদেশী পুঁজিপতিদের শোষণ ইহারা আমাদের দেশেরপুঁজিপতিদের মধ্যে উৎসুক মিত্র খুজিয়া পায়, বর্তমানে এক নতুন রুপ পরিগ্রহ করিতেছে। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার জন্য পূর্বাহ্ণে পরিশ্রুত অর্থ সাহায্য করিয়াযুক্তরাষ্ট্রআমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করিতেছে। পাকিস্তানের পুঁজিপতি ও আমলাতন্ত্রিরা এই সকল ব্যাপারে গভীর উৎকণ্ঠিত এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থ আরএকবার বিক্রয় করিবার হুমকি দিতেছে। ইহাকে প্রতিহত করার জন্য জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হইতে হবে এবং আমাদের পরিকল্পনাবিদদের অবশ্যই আমাদের জাতীয় সম্পদের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতে হইবে। আমাদের ত্যাগ স্বীকার এবং নুতন উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোকে রাষ্ট্রীয় খাতে স্থানান্তকরন মার্কিনী হুমকির প্রতিক্রিয়াকে আংশিকভাবে ঠেকাইতে সক্ষম হইবে।
সঠিকভাবে আমাদের ভবিষ্যৎনীতি ও কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য অবশ্যই আমাদের শত্রুদের অবস্থান , তাহাদের বর্তমান রণনীতি ও কৌশল সম্পর্কে অবহিত হইতে হবে। আমরা এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে সাম্রাজ্যবাদই আমাদের প্রধান শত্রু আর তাই তাহাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সাম্রাজ্যবাদ কি রণনীতি ও কৌশল গ্রহন করিতেছে সে সম্পর্কে আমাদের ওয়াকিবহাল থাকিতে হইবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গত কয়েক বৎসর এশিয়া ও আফ্রিকার বহু স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হইয়াছে। এই সকল নতুন রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন,চীন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক দেশের সহায়তায় অনেকটা স্বাধীন অর্থনীতি গড়িয়া তুলিতেছে। কিছু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র মুক্তি অর্জনের জন্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতেছে। বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি ইতিমধ্যেই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সহিত এক তীব্র অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হইয়াছে। এই সবই পুঁজিবাদের সাধারন সংকটকে গভীরতর করিতেছে এবং পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যকার বিরোধকে তীব্রতর করিয়া তুলিতেছে। এই অবস্থা হইতে নিজেদের রক্ষা করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা, মূলতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদীচক্র , বারবার যুদ্ধোন্মদনাসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্ধৃত প্ররোচনার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। তাহারা লাওসে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করিতেছে এবং কম্বোডিয়াকে হুমকি প্রদান করিতেছে। দক্ষিন ভিয়েতনামে বারংবার নাজেহাল হইয়া তাহারা মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে।তাহারা যুদ্ধকে আরো বিস্তৃত করিতে চায়। তাহাদের লক্ষ্য হইতেছে চীন।চীনা ভূখণ্ডের উপর সাম্প্রতিককালের মার্কিন বিমানের বেআইনী উড্ডয়ন ইহার একটি জ্বলন্ত প্রমান। এ ব্যাপারে ভারতের বর্তমান শাসক শ্রেণী যুক্তরাষ্ট্রের সহিত হাত মিলাইয়াছে।“নেফা” কে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সামরিক দিক দিয়া পূর্ব পাকিস্তানের গুরুত্ব সমধিক।সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই মার্কিনসাম্রাজ্যবাদীদের দৃষ্টি পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পতিত হওয়ার কথা।অধিকন্তু, যখনই সম্ভব সাম্রাজ্যবাদীরা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশসমূহের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দকে ব্যবহার করিতে চেষ্টা করে। তাঁহার বিভিন্ন সামাজিক,জাতীয় ও উপজাতীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের প্ররোচনা দেয় এবং বিভিন্ন রাজনীতিককে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করিয়া সব চাইতে প্রতিক্রিয়াশীল ও দুর্নীতি পরায়ন এমনসকল রাজনীতিককে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করায়, যাহাদের উন্নতি বৈদেশিক পুঁজির সাথে সহযোগিতা ও সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। পাকিস্তানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি দরদ প্রকাশ করিতে শুরু করিয়াছে। কিছুকাল পূর্বে তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ ম্যাকনগী পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তানীদের সাহায্য করার প্রস্তাব করিয়াছিলেন।
দক্ষিন ভিয়েতনামে একদা মার্কিন শিখন্ডী নগো দিন দিয়েমের অপসারন ও হত্যা ইহাই প্রমান করে যে, যদি তাঁবেদার তাহাদের উদ্দেশ্য হাসিল করিয়া দিতে ব্যর্থ হয়, তাহা হইলে সেই তাঁবেদারকে হত্যা করিতেও সাম্রাজ্যবাদীরা এতটুকু দ্বিধা করে না।ইহাতে কোন সন্দেহ নাই যে, বিশ্বের এই অঞ্চলে মার্কিন বিশ্বরণপরিকল্পনাকে সাহায্য না করার জন্য বর্তমান সরকারের প্রধানের ওপর মার্কিনীরা সন্তুষ্ট নয়।
শত্রুর বিপক্ষে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের নিজস্ব শক্তি সম্পর্কে ধারনা রাখা প্রয়োজন।
আমাদের জনগণ সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে ততটা সচেতন নহে। বিগত পাক ভারত যুদ্ধে জনগণকে অন্তত মার্কিনবিরোধী করিয়াছে। অবশ্য ইহার অর্থ এই নয় যে, তাহারা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হইয়া গিয়াছেন। কিন্তু এখন এই মার্কিনবিরোধী মনোভাবকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাবে পরিনত করা সহজতর হইয়াছে। আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদী অবস্থানের ফলশ্রুতি হিসেবে জনগণ অধিক ট্যাক্স, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অগ্নিমূল্য, বিভিন্ন ফসলের নিম্নমূল্য ও চরম দুর্নীতির চাপ নিশ্চয় অনুভব করিয়া থাকেন। ট্যাক্স, ব্যাবসায় একচেটিয়া আধিপত্য, দুর্নীতি প্রভৃতি সমস্যার উপর আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণকে বর্তমান অদৃশ্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে সামিল করার ও তাঁহাদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী করিয়া তোলার যথেষ্ট সুযোগ রহিয়াছে।
কাশ্মীর
এই সমস্যার দ্বারা যে ব্যাপক আবেগের সৃষ্টি হইয়াছে এই কমিটি তাহা পরিপূরণরুপে আনুধাবন করে এবং তাহার সহিত ঐকমত্য। কাশ্মীরবাসীর আত্ননিয়ন্ত্রণাধিকার সমর্থন বিশ্বের স্বাধীনতা ও শান্তির সংগ্রামের একটি অবিচ্ছদ্য অংশ বলিয়াই আমরা মনে করি। জে পর্যন্ত কাস্মীরবাসি তাহাঁদের নিকত গ্রহনযোগ্য নহে আমন একটি সরকারি ব্যবস্থার অধিনে নিষ্পিষ্ট হইতে থাকিবেন এবং তাহাদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার প্রদান সম্পর্কে ১৯৪৯ সালে ভারত,পাকিস্তান ও জাতিসংঘের মধে জে ঐকমত্য প্রতিস্থা হইয়াছিল তাহা অস্বীকার করা হইবে ততদিন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়া অনিশ্চয়তা বিরাজ করিবে এবং ভারত ও পাকিস্তান তাহাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনা করিয়া তাহাদের জনগনের দুখ- দুর্দশা অবসানকল্পে সর্বতোভাবে তাহাদের শক্তি নিয়োগ করিতে পারিবে না।
উপসংহার
জনগনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপাইয়া দেওয়া একটি অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতাণ্ত্রিক শাসনের অধিনে দেশ আজ নিষ্পিষ্ট হইয়াচে। দুর্নীতি জাতির অস্থিমজ্জা প্রবেশ করিয়াচে। পুঁজিপতি ও সমাজবিরোধীরা তাহাদের জীবনে চরম সুযোগ লাভ করিতেচে। এক রাজনৈতিক শাসরুদ্ব্ধকর ও বুদ্ধি বৃত্তির স্থবিরতার পরিবেশে মানুষের মন আজ দ্বিধাগ্রস্ত, মৌলিক স্বাধীনতার অস্বীকৃতি দেশের মূলে আঘাত হানিতেছে এবং সন্দেহ ও হতাশার এক পরিবেশে সম্রাজ্যবাদী সক্তিসম্মুহ আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সুযোগ লাভ করিতেছে ।
ন্যাশনাল আওমালিগ পার্টির কেন্দ্রিও কার্যনির্বাহী সংসদ জনগনের ঐক্য ,প্রদেশ সমূহের স্বায়ত্ত শাসন ,পাকিস্তানের সংহতি , ফেডারেল ধরনের পারলামেন্টারী গনতন্ত্র, বর্তমান স্বৈরাচারী একনায়কত্বের উচ্ছেদ সাধন ও সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রগতির স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের উদ্দেশে নিজেদেরকে, পার্টি ও জনগণকে সংগঠিত করার জন্য পার্টির সকল সদস্যের প্রতি আহবান জানাইতেছে । এই উদ্দেশে আমরা নিন্ম লিখিত দাবীসমূহ আদায়ের জন্য সমাজতন্ত্র ও গনতন্ত্রে বিশ্বাসী সকল পাকিস্থানিকে ঐক্যবদ্ধ গণ আন্দোলন গড়িয়া তোলার আহবান জানাইতেছিঃ
১। বর্তমান আইন পরিষদগুলি ভাঙ্গিয়া দিয়া প্রত্যক্ষ ও প্রাপ্তবয়স্কের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নূতন আইন পরিষদ নির্বাচন করিতে হইবে এবং অনুরূপভাবে নির্বাচিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নিন্মোদ্ধৃত বিষয়গুলির ব্যবস্থা করার জন্য শাসনতন্ত্র সংশোধন করিবেনঃ
(ক) ফেডারেল শাসন ব্যবস্থার অধিনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারনের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান। কেবলমাত্র দেশরক্ষা,বৈদেশিক সম্পর্ক ও মুদ্রা এই তিনটি বিষয়ের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ন্যস্ত থাকিবে।
(খ)সংস্কৃতি ও ভাষার সমতা এবং ভৌগলিক সংলগ্নতার ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমুহকে স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসেবে পুনরগথন।
পশ্চিম পাকিস্থানের পুনর্গঠিত প্রদেশসমুহের গনতান্ত্রিক গঠন কাঠামো একইরূপ হইবে এবং তাহারা (প্রদেশসমুহ) একটি আঞ্চলিক ফেডারেশনে ঐক্যবদ্ধ হইবে। এই ফেডারেশনের আইন পরিষদে কোন প্রদেশই নিজের সংখ্যাধিক্যের বলে একত্রে অবশিষ্ট প্রদেশসমূহের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ যে সকল বিষয়ে একমত হইবেন, পরিষদ সেই সকল সাধারণ বিষয় কার্যকর করিবে। একটি আঞ্চলিক ফেডারেশনের দ্বারা বর্তমান এক- ইউনিট ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার উপরোক্ত লক্ষ্য শাসনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধ্তির মাধ্যমে অর্জন করা হইবে। বর্তমান উপজাতীয় এলাকা, দেশীয় রাজ্য , ইজারাধিন এলাকা, এজেন্সী সমূহ ও অনুরূপভাবে এলাকা সমুহকে সন্নিহিত প্রদেসগুলির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে যুক্ত করিতে হইবে। যাযাবর, আধা- যাযাবর ও উপজাতীয় জনসাধারণকে বৃহত্তর জীবনের সহিত সম্পৃক্ত করিতে হইবে যাহাতে তাহার উন্নত নাগরিক জীবনের সুযোগ- সুবিধাদি ভোগ করিতে পারে।
সকল পাকিস্তানীর মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব বোধের বিকাশকে উৎসাহিত ও শক্তিশালী করিতে হইবে।সামাজিক সম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়কে উৎসাহিত করিতে হইবে।এবং উভয়াঞ্চলীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও স্বল্পব্যয়সাধ্য করিতে হইবে।
(গ) পরিষদগুলিকে আইন ও বাজেট পাশের পূর্ন ক্ষমতা প্রদান করিতে হইবে এবং প্রেসিডেন্ট ও গভর্নরগনের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রহিত করিতে হইবে।
(ঘ)জনগনকে মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা দিতে হইবে এবং জাতিসংঘ কতৃক ১৯৪৮ সালে গৃহীত মানবাধিকার সনদে স্বীকৃত সকল অধিকার ভোগ করিতে দিতে হইবে।
২। পূর্ন ব্যক্তি স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ঘোষিত জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করিতে হইবে।সকল দমনমূলক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে।
৩। প্রিন্স করিম, আব্দুস সামাদ খান আচাকযাই, আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল,সেনমনিকৃষ্ণ, আব্দুল হালিমসহ রাজনৈতিক কারনে সাজাপ্রাপ্ত ও বিনাবিচারে আটক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল বন্দীকে আজ মুক্তি দিতে হইবে। রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে সকল বিচারাধীন মামলা ও গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং রাজনৈতিক কারণে বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি ও জরিমানা প্রত্যর্পণ করিতে হইবে।
৪।পাকিস্তানকে “সিয়াটা” ও ‘সেন্টো’ হইতে সদস্য পদ প্রত্যাহার করিতে হইবে। পাকিস্তানে সকল মার্কিন ঘাঁটির বিলোপ সাধন করিতে হইবে এবং এই ধরনের আর কোন জড়িত হওয়া চলবেনা।
৫।পাকিস্তান প্রতিরক্ষা কাঠামোকে পুনর্গঠন করিতে হইবে। প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে আত্ননিভরশীল করিয়া তুলিতে হইবে। নৌ-বাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানকে স্থানান্তরিত করিতে হইবে।
৬।পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও শিল্প সংক্রান্ত নীতির প্রধান লক্ষ্য হইবে এখানকার জনসাধারনের কল্যাণ সাধন। পূর্ব পাকিস্থান হইতে পুঁজি পাচার বন্ধ করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তান বা পশ্চিম পকিস্তান যেখানেই হউক না কেন, জনসাধারণকে শোষণের এবং গুটিকয়েক পরিবার কতৃক দেশের সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করার চেস্তাকে বন্ধ করিতে হইবে।সকল গুরুত্বপূর্ণ ও মুল শিল্পগুলি সরকারী খাতে প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।
৭।দেশের শিল্প সরকারী খাতে সিমাবদ্ধ রাখিতে হইবে এবং উহা দেশের উভয়াংসে স্থাপন করিতে হইবে।
৮।আমলাতান্ত্রিক ও সম্রাজ্জবাদি পুঁজি এবং বাঙ্ক,বিমা কোম্পানি ও পাট ব্যবসায় জাতীয়করণ করিতে হইবে।
<2.49.267-270>
আমাদের বাঁচার দাবী
৬-দফা কর্মসূচী
আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা,
আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবীরুপে ৬-দফা কর্মসূচী দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করার পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থীদের দালালরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছেন। জনগণের দুশমনদের এই চেহারা ও গালাগালির সহিত দেশবাসী সুপরিচিত। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবী যখনই উঠিয়াছে, তখনি এই দালালরা এমনিভাবে হৈ-হৈ করিয়া উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী, পূর্ব-পাক জনগণের মুক্তি-সনদ একুশ দফা দাবী, যুক্ত-নির্বাচন প্রথার দাবী, ছাত্র-তরুণদের সহজ স্বল্প-ব্যয় শিক্ষা লাভের দাবী, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবী ইত্যাদি সকল প্রকার দাবীর মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাহাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন।
আমার প্রস্তাবিত ৬-দফা দাবিতেও এঁরা তেমনিভাবে পাকিস্তান দুই টুকরা করিবার দুরভিসন্ধি আরোপ করিতেছেন। আমার প্রস্তাবিত ৬-দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত বঞ্ছিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে ও সভা-সমতির বিবরণে, সকল শ্রেণীর সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ- উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি- তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ আমার ৬-দফা দাবী অনুমোদন করিয়াছেন। ৬-দফা দাবী আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবীতে পরিণত হইয়াছে। এ অবস্থায় কায়েমী স্বার্থী শোষকদের প্রচারণায় জনগণ বিভ্রান্ত হইবেন না, সে বিশ্বাস আমার আছে।
কিন্তু এও আমি জানি, জনগণের দুশমনদের ক্ষমতা অসীম, তাঁদের বিত্ত প্রচুর, হাতিয়ার এঁদের অফুরন্ত, মুখ এঁদের দশটা, গলার সুর এঁদের শতাধিক। এঁরা বহুরূপী। ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে এঁরা আছেন সরকারী দলে। আবার ইসলাম ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়া এঁরা আছেন অপজিশন দলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুশমনির বেলায় এঁরা সকলে একজোট। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিষ্কাম সেবার জন্য এঁরা ইতিমধ্যেই বাহির হইয়া পড়িয়াছেন। এঁদের হাজার চেষ্টাতেও আমার অধিকার সচেতন দেশবাসী বিভ্রান্ত হইবেন না তাতেও আমার কোন সন্দেহ নাই। তথাপি ৬-দফা প্রতিটির দফার দফাওয়ারী সহজ সরল ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও যুক্তিসহ এই পুস্তিকা প্রচার করিলাম। আওয়ামী লীগের তরফ হইতে এবিষয়ে আরও পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশ করা হইবে। আশা করি, সাধারণভাবে সকল গণতন্ত্রী, বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের কর্মীগণ ছাড়াও শিক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানী মাত্রেই এই সব পুস্তিকার সদ্ব্যবহার করিবেন।
১নং দফা
এই দফায় বলা হইয়াছে যে, ঐতিহাসিক লাহোর- প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়িতে হইবে। তাতে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্ত-বয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইনসভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে।
ইহাতে আপত্তির কি আছে? লাহোর-প্রস্তাব পাকিস্তানের জনগণের নিকট কায়েদে আজমসহ সকল নেতার দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। মুসলিম বাংলার জনগণ এক বাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোটও দিয়াছিলেন এই প্রস্তাবের দরুনই। ১৯৫৪ সনের সাধারণ নির্বাচনেপূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের সতকরা সাড়ে ৯৭টি যে একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল, লাহোর-প্রস্তাবেরভিত্তিতে শাষনতন্ত্র রচনার দাবিছিল তার মধ্যে অন্যতম প্রধান দাবি। মুসলিম লীগ তখন কেন্দ্রের ও প্রদেশের সরকারী ক্ষমতার অধিষ্ঠিত। সরকারী সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা লইয়া তাঁরা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধতা করিয়াছিলেন। এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেইসলাম বিপন্ন ও পাকিস্তান ধ্বংস হইবে, এসব যুক্তি তখন দেওয়া হইয়াছিল। তথাপি পূর্ব বাংলার ভোটাররা এই প্রস্তাবসহ একুশ দফার পক্ষে ভোট দিয়াছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষে কথা বলিতে গেলে এই প্রশ্ন চূড়ান্তভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে মীমাংসীত হইয়াই গিয়াছে। কাজেই আজ লাহোর-প্রস্তাব ভিত্তিক শাষনতন্ত্র রচনার দাবি করিয়া আমি কোনও নতুন দাবি তুলি নাই; পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পুরাণ দাবিরই পুনরুল্লেখ করিয়াছি মাত্র। তথাপি লাহোর-প্রস্তাবের নাম শুনিলেই যাঁরা আঁতকাইয়া উঠেন, তাঁরা হয় পাকিস্তান সংগ্রামে শরিক ছিলেন না, অথবা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি-দাওয়ার বিরোধীতা ও কায়েমী স্বার্থীদের দালালি করিয়া পাকিস্তানের অনিষ্ট সাধন করিতে চান।
এই দফায় পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার, সার্বজনীন ভোটে সরাসরি নির্বাচন ও আইন সভার সার্বভৌমত্বের যে দাবী করা হইয়াছে তাতে আপত্তির কারণ কি? আমার প্রস্তাবই ভাল, না প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতির সরকার ও পরোক্ষ নির্বাচন ও ক্ষমতাহীন আইনসভাই ভাল, এ বিচার-ভার জনগণের উপর ছাড়িয়া দেওয়াই কি উচিৎ নয়?তবে পাকিস্তানের ঐক্যসংহতির এই তরফদারেরা এই সব প্রশ্নে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে জনমত যাচাই-এর প্রস্তাব না দিয়া আমার বিরুদ্ধে গালাগালি বর্ষণ করিতেছেন কেন? তাঁরা যদি নিজেদের মতে এতই আস্থাবান, তবে আসুন এই প্রশ্নের উপরই গণ-ভোট হইয়া যাক।
২নং দফা
এই দফায় আমি প্রস্তাব করিয়াছি যে, ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এই দুইটি বিষয় থাকিবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্টেটসমূহের (বর্তমান ব্যবস্থায় যাকে প্রদেশ বলা হয়) হাতে থাকিবে।
এই প্রস্তাবের দরুনই কায়েমী স্বার্থের দালালরা আমার উপর সর্বাপেক্ষা বেশী চটীয়াছেন। আমি নাকি পাকিস্তানকে দুই টুকরা করতঃ ধ্বংস করিবার প্রস্তাব দিয়াছি। সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি ইহাদের এতই অন্ধ করিয়া ফেলিয়াছে যে, ইহারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলি পর্য্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছেন। ইহারা ভুলিয়া যাইতেছেন যে, বৃটিশ সরকারের ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ সালে যে ‘প্ল্যান’ দিয়াছিলেন এবং যে ‘প্ল্যান’ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই করিয়াছিলেন, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এইতিনটি মাত্র বিষয় ছিল এবং বাকী সব বিষয়ই প্রদেশের হাতে হইয়াছিল। ইহা হইতে এটাই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে, বৃটিশ সরকার, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলের মত এই যে, এই তিনটি মাত্র বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকিলেই কেন্দ্রীয় সরকার চলিতে পারে। অন্য কারনে কংগ্রেস চুক্তি-ভঙ্গ করায় ক্যাবিনেট প্ল্যান পরিত্যক্ত হয়। তা না হলে এই তিন বিষয় লইয়াই আজও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, চলিতে থাকিত। আমি আমার প্রস্তাবে ক্যাবিনেট প্ল্যানেরই অনুসরণ করিয়াছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা আমি বাদ দিয়াছি সত্য কিন্তু তার যুক্তিগত কারণও আছে। অখন্ড ভারতের বেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থারও অখন্ডতা ছিল। ফেডারেশন গঠনের রাষ্ট্র-বৈজ্ঞানিক মূলনীতি এই যে, যে-যে বিষয়ে ফেডারিং স্টেটসমূহের স্বার্থ এক ও অবিভাজ্য, কেবল সেই সেই বিষয়ই ফেডারেশনের এখতিয়ারে দেওয়া হয়। এই মূলনীতি অনুসারে অখন্ড ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য ছিল। পেশাওয়ার হইতে চাটগাঁও পর্যন্ত একই রেলে চলিতে পারিত। কিন্তু পাকিস্তানে তা নয়। দুই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য ত নয়ই বরঞ্চ সম্পূর্ণ পৃথক। রেলওয়েকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ট্রান্সফার করিয়া বর্তমান সরকারও তা স্বীকার করিয়াছেন। টেলিফোন-টেলিগ্রাফ পোষ্টাফিসের ব্যাপারেও এ সত্য স্বীকার করিতে হইবে।
তবে বলা যাইতে পারে যে, একুশ দফায় যখন কেন্দ্রকে তিনটি বিষয় দিবার সুপারিশ ছিল, তখন আমি আমার বর্তমান প্রস্তাবে মাত্র দুই বিষয় দিলাম কেন? এ প্রশ্নের জবাব আমি ৩নং দফার ব্যাখ্যায় দিয়াছি। এখানে আর পুনরুক্তি করিলাম না।
আরেকটা ব্যাপারে ভুল ধারনা সৃষ্টি হইতে পারে। আমার প্রস্তাবে ফেডারেটিং ইউনিটকে ‘প্রদেশ’ না বলিয়া ‘স্টেট’ বলিয়াছি। ইহাতে কায়েমী স্বার্থী শোষকেরা জনগণকে এই বলিয়া ধোঁকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করিয়াছে যে, ‘স্টেট’ অর্থে আমি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’ বা ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ বুঝাইয়াছি। কিন্তু তা সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র বড় বড় ফেডারেশনেই ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রভিন্স’ না বলিয়া ‘স্টেটস’ বলা হইয়া থাকে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকে ফেডারেশন অথবা ইউনিয়ন বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মানী, এমন কি আমাদের প্রতিবেশি ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাঁদের প্রদেশসমূহকে ‘স্টেট’ ও কেন্দ্রকে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন বলিয়া থাকে। আমাদের পাশ্ববর্তী আসাম ও পশ্চিম বাংলা ‘প্রদেশ’ নয় ‘স্টেট’। এর যদি ভারতের ইউনিয়নের প্রদেশ হইয়া ‘স্টেট’ হওয়ার সন্মান পাইতে পারে, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে এইটুকু নামের মর্যাদা দিতেই বা কর্তারা এত এলার্জিক কেন?
৩নং দফা
এই দফায় আমি মুদ্রা সম্পর্কে দুইটি বিকল্প বা অলটার্নেটিভ প্রস্তাব দিয়াছি। এই দুইটী প্রস্তাবের যে কোনও একটি গ্রহন করিলেই চলিবেঃ
(ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। এই ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সী কেন্দ্রের হাতে থাকিবে না, আঞ্চলিক, সরকারের হাতে থাকিবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুইটি স্বতন্ত্র ‘স্টেট’ ব্যাঙ্ক থাকিবে।
(খ) দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সী থাকিবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানের পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকিবে; দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকিবে।
এই দুইটি প্রস্তাব হইতে দেখা যাইবে যে, মুদ্রাকে সরাসরি কেন্দ্রে হাত হইতে প্রদেশের হাতে আনিবার প্রস্তাব আমি করি নাই। যদি আমার দ্বিতীয় অল্টার্নেটিভ গৃহীত হয়, তবে মুদ্রা কেন্দ্রের হাতেই থাকিয়া যাইবে। ঐঅবস্থায় আমি একুশ-দফা প্রস্তাবের খেলাফে কোন সুপারিশ করিয়াছি, এ কথা বলা চলে না।
যদি পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা আমার এই প্রস্তাবে রাজী না হন, তবেই শুধু প্রথম বিকল্প অর্থাৎ কেন্দ্রের হাত হইতে মুদ্রাকে প্রদেশের হাতে আনিতে হইবে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভুল বুঝাবুঝির অবসান হইলে আমাদের এবং উভয় অঞ্চলের সুবিধার খাতিরে পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা এই প্রস্তাবে রাজী হইবেন। আমরা তাঁহাদের খাতিরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ত্যাগ করিয়া সংখ্যা-সাম্য মানিয়া লইয়াছি, তাঁরা কি আমাদের খাতিরে এইটুকু করিবেন না?
আর যদি অবস্থাগতিকে মুদ্রাকে প্রদেশের এলাকায় আনিতেও হয়, তবে তাতে কেন্দ্র দুর্বল হইবে না; পাকিস্তানের কোনও অনিষ্ট হইবে না। ক্যাবিনেট প্ল্যানে নিখিল ভারতীয় কেন্দ্রের যে প্রস্তাব ছিল, তাতে মুদ্রা কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল না। ঐ প্রস্তাব পেশ করিয়া বৃটিশ সরকার এবং ঐ প্রস্তাব গ্রহন করিয়া কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মুদ্রাকে কেন্দ্রীয় বিষয় না করিয়াও কেন্দ্র চলিতে পারে। কথাটা সত্য। রাষ্ট্রীয় অর্থ বিজ্ঞানে এই ব্যবস্থার স্বীকৃতি আছে। কেন্দ্রের বদলে প্রদেশের হাতে অর্থনীতি রাখা এবং একই দেশে পৃথক পৃথক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকার নজির দুনিয়ার বড় বড় শক্তিশালী রাষ্ট্রেও আছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চলে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের মাধ্যমে পৃথক পৃথক ব্যাঙ্ক দ্বারা। এতে যুক্তরাষ্ট্র ধ্বংস হয় নাই; তাঁদের আর্থিক বুনিয়াদও ভেঙ্গে পড়ে নাই। অত যে শক্তিশালী দোর্দন্ডপ্রতাপ সোভিয়েট ইউনিয়ন, তাদেরও কেন্দ্রীয় সরকারের কোন অর্থমন্ত্রী বা অর্থদফতর নাই। শুধু প্রাদেশিক সরকারের অর্থাৎ স্টেট রিপাবলিকসমূহেরই অর্থমন্ত্রী ও অর্থদফতর আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক প্রয়োজন ঐসব প্রাদেশিক মন্ত্রী ও মন্ত্রী দফতর দিয়াই মিটিয়া থাকে। দক্ষিন আফ্রিকার মত দেশেও আঞ্চলিক সুবিধার খাতিরে দুইটি পৃথক ও স্বতন্ত্র রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বহুদিন আগ হইতেই চালু আছে।
আমার প্রস্তাবের মর্ম এই যে, উপরোক্ত দুই বিকল্পের দ্বিতীয়টি গৃহীত হইলে মুদ্রা কেন্দ্রের তত্ত্বাধানে থাকিবে। সে অবস্থায় উভয় অঞ্চলের একই নকশার মুদ্রা বর্তমানে যেমন আছে তেমনি থাকিবে। পার্থক্য শুধু এই হইবে যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাতে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘ঢাকা’ লেখা থাকিবে। পশিম পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাতে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ বা ‘লাহোর’ লেখা থাকিবে। পক্ষান্তরে, আমার প্রস্তাবের দ্বিতীয় বিকল্প না হইয়া যদি প্রথম বিকল্পও গৃহীত হয়, সে অবস্থাতেও উভয় অঞ্চলের মুদ্রা সহজে বিনিময়যোগ্য থাকিবে এবং পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতীক ও নিদর্শনস্বরুপ উভয় আঞ্চলিক সরকারের সহযোগিতায় একই নকশার মুদ্রা প্রচলন করা যাইবে।
একটু তলাইয়া চিন্তা করিলেই বুঝা যাইবে যে, এই দুই ব্যবস্থার একটি গ্রহন করা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানকে নিশ্চিত অর্থনৈতিক মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করার অন্য কোন ও উপায় নাই। সারা পাকিস্তানের জন্য একই মুদ্রা হওয়ায় ও দুই অঞ্চলের মুদ্রার মধ্যে কোন পৃথক চিহ্ননা থাকায় আঞ্চলিক কারেন্সী সার্কুলেশনে কোনও বিধি-নিষেধ ও নির্ভুল হিসাব নাই। মুদ্রা ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকায় অতি সহজেই পূর্ব পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তানে চলিয়া যাইতেছে। সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, শিল্প-বানিজ্য, ব্যাংকিং, ইনসিওরেন্স ও বৈদেশিক মিশনসমূহের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত থাকায় প্রতি মিনিটে এই পাচারের কাজ অবিরাম গতিতে চলিতেছে। সকলেই জানেন সরকারী স্টেট ব্যাঙ্ক ও ন্যাশনাল ব্যাঙ্কসহ সমস্ত ব্যাঙ্কের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে। এই সেদিন মাত্র প্রতিষ্ঠিত ছোট দু-একখানি ব্যাঙ্ক ইহার সাম্প্রতিক ব্যাতিক্রম মাত্র। এইসব ব্যাঙ্কের ডিপোজিটের টাকা, শেয়ার মানি, সিকিউরিটি মানি, শিল্প-বাণিজ্যের আয়, মুনাফা ও শেয়ার মানি এক কথায় পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতসমস্ত আর্থিক লেনদেনের টাকা বালুচরে ঢালা পানির মত একটানে তলদেশে হেড অফিসে অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে চলিয়া যাইতেছে, পূর্ব পাকিস্তান শুকনা বালুচর হইয়া থাকিতেছে। বালুচরে পানি দরকার হইলে টিউবয়েল খুঁদিয়া তলদেশ হইতে পানি তুলিতে হয়। অবশিষ্ট পানি তলদেশে জমা থাকে। পুর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় অর্থও তেমনি চেকের টিউবয়েলের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানেই জমা থাকে। এই কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে ক্যাপিটাল ফর্মেশন হইতে পারে নাই। সব ক্যাপিটেল ফর্মেশনপশ্চিমে হইয়াছেন। বর্তমান ব্যবস্থা চলিতে থাকিলে কোনও দিন পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গঠন হইবেও না। কারণ সেভিং মানেই ক্যাপিটেল ফর্মেশন।
<2.49.271-274>
শুধু ফ্ল্যাইট-অব-ক্যাপিটেল বা মুদ্রা পাচারই নয়, মুদ্রাস্ফীতিহেতু পূর্ব পাকিস্তানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দুর্মূল্যতা, জনগনের বিশেশতঃ পাটচাষিদের দুর্দশা সমস্তর জন্য দায়ী এই মুদ্রা ব্যবস্থা ও অর্থনীতি। আমি ৫নং দফার ব্যাখ্যায় এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি। আখানে শুধু এইটুকু বলিয়া রাখিতেছি যে, এই ফ্ল্যাইট-অব-ক্যাপিটেল বন্ধ করিতে না পারিলে পূর্ব পাকিস্তানীরা নিজেরা শিল্প-বাণিজ্যে এক পা-ও অগ্রসর হইতে পারিবে না। কারন এ অবস্থায় মূলধন গড়িয়া উঠিতে পাড়ে না।
৪নং দফা
এই দফায় আমি প্রস্তাব করিয়াছি যে, সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা-কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউ-এর নিরধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে অটোমেটিক্যালি জমা হইয়া জাইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাঙ্কসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসন্তন্ত্রেই থাকিবে। এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের তহবিল হইবে।
আমার এই প্রস্তাবেই কায়েমী স্বার্থের কালোবাজারি ও মুনাফাখোর শোষকরা সবচেয়ে বেশি চমকিয়া উঠিয়াছে। তারা বলিতেছে, ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের না থাকিলে সে সরকার চলিবে কিরুপে? কেন্দ্রীয় সরকার তাতে যে একেবারে খয়রাতী প্রতিষ্ঠানে পরিনত হইবে। খয়রাতের উপর নির্ভর করিয়া কেন্দ্রীয় সরকার দেশরক্ষা করিবেন কেমনে? পররাষ্ট্র নীতিই চালাইবেন কি দিয়া? প্রয়োজনের সময় চাঁদা না দিলে কেন্দ্রীয় সরকার ও অনাহারে মারা যাইবেন। অতএব এটা নিশ্চয়ই পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র।
কায়েমী স্বার্থবাদীরা এই ধরনের কত কথাই না বলিতেছে। অথচ আর একটা কথাও সত্য নয়। সত্য যে নয় সেটা বুঝিবার মত বিদ্যাবুদ্ধি তাঁদের নিশ্চয়ই আছে। তবু যে তাঁরা এসব কথা বলিতেছেন, টার একমাত্র কারন তাঁদের ব্যক্তিগত ও শ্রেণীগত স্বার্থ। সে স্বার্থ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে অবাধে শোষণ ও লুণ্ঠন করার অধিকার। তাঁরা জানেন যে, আমার এই প্রস্তাবে কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের দায়িত্ব দেওয়া না হইলেও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিঘ্নে চলার মত পূর্ব পাকিস্তানে যথেষ্ট অর্থের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। সে ব্যবস্থা নিখুঁত করিবার শাসনতান্ত্রিক বিধান রচনার সুপারিশ করা হইয়াছে। এটাই সরকারী তহবিলের সবচেয়ে অমোঘ, অব্যর্থ ও সর্বাপেক্ষা নিরাপদ উপায়। তাঁরা এটাও জানেন যে, কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা না দিয়াও ফেদারেশন চলার বিধান রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বীকৃত। তাঁরা এ খবরও রাখেন যে, ক্যাবিনেট মিশনের যে প্ল্যান ব্রিটিশ সরকার রচনা করিয়াছিলেন এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই গ্রহন করিয়াছিলেন, তাতেও ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা প্রদেশের হাতে দেওয়া হইয়াছিল; কেন্দ্রকে সে ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই। ৩নং দফায় আমি দেখাইয়াছি যে, অর্থমন্ত্রী ও অর্থদফতর ছাড়াও দুনিয়ার অনেক ফেডারেশন চলিতেছে। টার মধ্যে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ফেডারেশন সভিয়েত উইনিয়নের কথাও আমি বলিয়াছি। তথায় কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রী বা অর্থদফতর বলিয়া কোনও বস্তুর অস্তিত্ব নাই। তাতে কি অর্থাভাবে সভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংস হইয়া গিয়াছে? পড়ে নাই। আমার প্রস্তাব কার্যকরী হইলেও তেমনি পাকিস্তানের দেশরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হইবে না। কারন আমার প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় তহবিলের নিরাপত্তার জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হইয়াছে। সে অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন বিধান থাকিবে যে, আঞ্চলিক সরকার যেখানে যখন যে খাতেই তকা ট্যাক্স ধার্যে ও আদায়ের ঝামেলা পোহাইতে হইবে না। দ্বিতীয়তঃ ট্যাক্স ধার্যে ও আদায়ের জন্য কোনও দফতর বা অফিসার বাহিনী রাখিতে হইবে না। ত্রিতিয়তঃ অঞ্চলে ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা ও কেন্দ্রের জন্য ট্যাক্স ধার্যে ও আদায়ের ডুপ্লিকেশন হইবে না। তাতে আদায়ী খরচায় অপব্যয় ও অপচয় বন্ধ হইবে। ঐভাবে সঞ্চিত টাকার দ্বারা গঠন ও উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করা যাইবে। অফিসার বাহিনীকেও উন্নতর সৎকাজে নিয়োজিত করা যাইবে। চতুর্থতঃ ট্যাক্স ধার্যে ও আদায়ের একত্রিকরন সহজতর হইবে। সকলেই জানেন, অর্থ-বিজ্ঞানীরা এখন ক্রমেই সিংগল ট্যাক্সেশনের দিকে আকৃষ্ট হইতেছেন। সিংগল ট্যাক্সশনের নীতিকে সকলেই অধিকতর বৈজ্ঞানিক ও ফলপ্রসূ বলিয়া অভিহিত করিতেছেন। ট্যাক্সশনকে ফেডারেশনের এলাকা হইতে অঞ্চলের এখতিয়ারভুক্ত করা এই সর্বোত্তম ও সর্বশেষ আর্থিক নীতি গ্রহনের প্রথম পদক্ষেপ বাল যাইতে পারে।
৫নং দফা
এই দফায় আমি বইদেশিক বাণিজ্য ব্যাপারে নিন্মরুপ শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করিয়াছিঃ
(১) দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে।
(২) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকিবে।
(৩) ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা দুই অঞ্চল হইতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারাহারি মতে আদায় হইবে।
(৪) দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানী-রফতানী চলিবে।
(৫) ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি-রফতানী করিবার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে।
পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক নিশ্চিত মৃত্যু হইতে রক্ষা করিবার জন্য এই ব্যবস্থা ৩নং দফার মতই আবশ্যক।
যেঃ
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা দিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প গড়িয়া তোলা হইয়াছে এবং হইতেছে। সেই সকল শিল্পজাত দ্রব্যের অর্জিত বিদেশী মুদ্রাকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা বলা হইতেছে।
(খ)পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গড়িয়া না ওঠায় পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের নাই এই অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বিদেশী আয় পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হইতেছে। এইভাবে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পায়িত হইতে পারিতেছে না।
(গ) পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমানে আয় করে সেই পরিমান ব্যয় করিতে পারে না। সকলেই জানেন, পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমান রফতানি করে আমদানি করে সাধারণতঃ তার অর্ধেকেরও কম। ফলে অর্থনীতির অমোঘ নিয়ম অনুসারেই পূর্ব পাকিস্তানে ইনফ্রেশন বা মুদ্রাস্ফীতি ম্যালেরিয়া জ্বরের মত লাগিয়াই আছে। তার ফলে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম এত বেশি। বিদেশ হইতে আমদানী করা একই জিনিসের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি দামের তুলনা করলেই এটা বুঝা যাইবে। বিদেশী মুদ্রা বণ্টনের দায়িত্ব এবং অর্থনৈতিক অন্যান্য সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ার থাকার ফলে আমাদের এই দুর্দশা।
(ঘ) পাকিস্তানের বিদেশী মুদ্রার তিন ভাগের দুই ভাগই অর্জিত হয় পাট হইতে। অথচ পাটচাষিদের ভাগ্য আজ শিল্পপতি ও ব্যবসায়িদের খেলার জিনিসে পরিনত হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান সরকার পাতের চাষ নিয়ন্ত্রন করেন কিন্ত চাষীকে পাটের ন্যায্য দাম দিতে পারে না। এমন অদ্ভুত অর্থনীতি দুনিয়ার আর কোন দেশে নাই। জতদিন পাট থাকে চাষীরা ঘরে, ততদিন পাটের দাম থাকে পনের-বিশ টাকা। ব্যবসায়ীদের গুদামে চলিয়া যাওয়ার সাথে সাথে তার দাম হয় পঞ্চাশ। এ খেলা গরীব পাট-চাষী চিরকাল দেখিয়া আসিতেছে। পাট-ব্যবসায় জাতীয়করণ করিয়া পাট রফতানীকে সরকারী আয়ত্তে আনা ছাড়া এর কোনও প্রতিকার নাই, একথা আমরা বহুবার বলিয়াছি। এ উদ্দেশ্যে আমরা আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার আমলে জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন গঠন করিয়াছিলাম। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যে পুঁজিপতিরা আমাদের সে আরব্ধ কাজ ব্যর্থ করিয়া দিয়াছেন।
(ঙ) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রাই যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হইতেছে তা নয়। আমাদের অর্জিত বিদেশী মুদ্রার জরে যে বিপুল পরিমান বিদেশী লোন ও এইড আসিতেছে, তাও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হইতেছে। কিন্ত সে লোনের সুদ বহন করিতে হইতেছে পূর্ব পাকিস্তানকেই। ঐ অবস্থার প্রতিকার করিয়া পাটচাষীকে পাটের ন্যায্য মুল্ল দিতে হইলে, আমদানী-রফতানী সমান করিয়া জনসাধারণকে সস্তা দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ হরিয়া তাঁদের জীবন সুখময় করিতে হইলে এবং সর্বোপরি আমাদের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা দিয়া পূর্ব পাকিস্তানির হাতে পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করিতে হইলে আমার প্রস্তাবিত এই ব্যবস্থা ছাড়া উপায়ান্তর নাই।
৬নং দফা
এই দফায় আমি পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠনের সুপারিশ করিয়াছি। এ দাবি অন্যায়ও নয়, নূতনও নয়। একুশ দফার দাবিতে আমরা আনসার বাহিনীকে ইউনিফর্মধারী সশস্ত্র বাহিনীতে রুপান্তরিত করার দাবি করেছিলাম। তাতো করা হয়ই নাই, বরঞ্চ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনস্থ ই,পি,আর বাহিনীকে এখন কেন্দ্রের অধীনে নেওয়া হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র-কারখানা ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করতঃ এ অঞ্চলকে আত্মরক্ষায় আত্মনির্ভর করার দাবি একুশ দফার দাবি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বার বছরেও আমাদের একটি দাবিও পূরণ করেন নাই। পূর্ব পাকিস্তান অধিকাংশ পাকিস্তানির বাসস্থান। এটাকে রক্ষা করা কেন্দ্রীয় সরকারেরই নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে আমাদের দাবি হইতে হইবে কেন? সরকার নিজ হইতে সে দায়িত্ব করেন না কেন? পশ্চিম পাকিস্তান আগেই বাঁচাইয়া সময় ও সুযোগ থাকিলে পড়ে পূর্ব পাকিস্তান বাঁচান হইবে, ইহাই কেন্দ্রীয় সরকারের অভিমত? পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষা ব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানেই রহিয়াছে এমন সাংঘাতিক কথা শাসনকর্তারা বলেন কোন মুখে? মাত্র সতের দিনের পাক-ভারত যুদ্ধই প্রমান করে নাই আমরা কত নিরুপায়? শত্রুর দয়া ও মর্জির উপর তো আমরা বাঁচিয়া থাকিতে পারি না। কেন্দ্রীয় সরকারের দেশরক্ষা নীতি কার্যতঃ আমাদেরকে তাই করিয়া রাখিয়াছে।
তবু আমরা পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির কারনে দেশরক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখিতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে এও চাই যে, কেন্দ্রীয় সরকার পুরব পাকিস্তানকে এ ব্যপারে আত্মনির্ভর করিবার জন্য এখানে উপযুক্ত পরিমান দেশরক্ষা বাহিনী গঠন করুন। অস্ত্র-কারখানা স্তাপন করুন। নৌ-বাহিনীর সদর দফতর এখানে নিয়া আসুন। এ সব কাজ সরকার কবে করিবেন জানি না। কিন্ত ইতিমধ্যে অল্প খরচে ছোটখাটো অস্ত্রশস্ত্র দিয়া আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করিতেও পশ্চিমা ভাইদের এত আপত্তি কেন? ঐ সব প্রশ্নের উত্তর চাই। তবু কেন্দ্রীয় ব্যাপারি অঞ্চলের হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার আমরাও চাই না। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান যেমন অরিয়া পারে গরিবী হালেই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করিবে, এমন দাবি কি অন্যায়? এই দাবি করিলেই সেটা হবে দেশদ্রোহিতা?
এ প্রসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইবোনদের খেদমতে আমার কয়েকটি আরজ আছেঃ
এক. তাঁরা মনে করিবেন না আমি শুধু পূর্ব পাকিস্তানীদের অধিকার দাবি করিতেছি। আমার ৬-দফা কর্মসূচীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দাবিও সমভাবেই রহিয়াছে। এ দাবি স্বীকৃত হইলে পশ্চিম পাকিস্তানীরাও সমভাবে উপকৃত হইবেন।
দুই. আমি যখন বলি পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার ও স্তূপীকৃত হইতেছে তখন আমি আঞ্চলিক বৈষম্যের কথা বলি না। আমি জানি, এ বৈষম্য সৃষ্টির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীরা দায়ী নয়। আমি এও জানি যে, আমাদের মত দরিদ্র পশ্চিম পাকিস্তানেও অনেক আছে। যতদিন ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান না হইবে, হইবে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এই অসাম্য দূর হইবে না? কিন্ত টা আগে আঞ্চলিক শোষণও বন্ধ করিতে হইবে। এই আঞ্চলিক শোষণের জন্য দায়ী আমাদের ভৌগলিক অবস্থান এবং সেই অবস্থানকে অগ্রাহ্য করিয়া যে অস্বাভাবিক ব্যবস্থা চালাইবার চেষ্টা চলিতেছে সেই ব্যবস্থা। ধরুন যদি, পাকিস্তানের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে না হইয়া পূর্ব পাকিস্তানে হইত, পাকিস্তানের দেশরক্ষা বাহিনীর তিনটি দফতরই যদি পূর্ব পাকিস্তানে হইত, তবে কার কি অসুবিধা-সুবিধা হইত একটু বিচার করুন। পাকিস্তানের মোট রাজস্বের শতকরা ৬২ টাকা খরচ হয় দেশরক্ষা বাহিনীতে এবয় শতকরা বত্রিশ টাকা খরচ হয় কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায়। এই একুন শতকরা চুরানব্বই টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে না হইয়া তখন খরচ হইত পূর্ব পাকিস্তানে। আপনারা জানেন অর্থ-বিজ্ঞানের কথাঃ সরকারী আয় জনগনের ব্যয় এবং সরকারী ব্যয় জনগনের আয়। এই নিয়মে বর্তমান ব্যবস্থায় সরকারের গোটা আয়ের অর্ধেক পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত থাকায় সরকারী, আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বিদেশী মিশনসমূহ তাঁদের সমস্ত ব্যয় পশ্চিম পাকিস্তানেই প্রেরন করিতে বাধ্য হইতেছেন। এই ব্যয়ের সাকুল্যই পশ্চিম পাকিস্তানের আয়। ফলে প্রতি বছর পশ্চিম পাকিস্তানের আয় ঐ অনুপাতে বাড়ছে এবং পূর্ব পাকিস্তান তার মোকাবিলায় ঐ পরিমান গরীব হইতেছে। যদি পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের রাজধানী হইত তবে এই সব খরচ পূর্ব পাকিস্তান হইত। আমারা পূর্ব পাকিস্তানীরা এই পরিমান ধনী হইতাম। আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানীরা ঐ পরিমানে গরীব হইতেন। তখন আপনারা কি করতেন? যেসব দাবি করার জন্য আমাকে প্রাদেশিক সংকীর্ণতার তহমত দিতেছেন সেই সব দাবী পানারা নিজেরাই করিতেন। আমাদের চেয়ে জোরেই করিতেন। অনেক আগেই করিতেন। আমাদের মতো আঠার বছর বসিয়া থাকিতেন না। সেটা করা আপনাদের অন্যায় হইত না।
তিন. আপনারা এইসব দাবী করিলে আমরা পূর্ব পাকিস্তানীরা কি করিতাম, জানেন? আপনাদের সব দাবী মানিয়া লইতাম। আপনাদিগকে প্রাদেশিকতাবাদী বলিয়া গাল দিতাম না। কারন, আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, অসব আপনাদের হোক পাওনা। নিজের হক পাওনা দাবী করা অন্যায় নয়, কর্তব্য। এ বিশ্বাস আমাদের এতই আন্তরিক যে, সে অবস্থা হইলে আপনাদের দাবী করিতে হইত না। আপনাদের দাবী করার আগেই আপনাদের হক আপনাদিগকে বুঝাইয়া দিতাম। আমরা নিজেদের হক দাবি করিতেছি বলিয়া আমাদের স্বার্থপর বলিতেছেন। কিন্ত আপনারা যে নিজেদের হকের সাথে সাথে আমাদের হকটাও খাইয়া ফেলিতেছেন, আপনাদেরকে লোকে কি বলিবে? আমরা শুধু নিজেদের হকটাই চাই। আপনাদের হক আত্মসাৎ করিতে চাই না। আমাদের দিবার আওকাৎ থাকিলে বরঞ্চ পরকে কিছু দিয়াও দেই।
<2.49.275-276>
হকের সাথে আমাদের হকটাও খাইয়া ফেলিতেছেন। আপনাদেরে লোকে কি বলিবে? আমরা শুধু নিজেদের হকটাই চাই। আপনাদের হকটা আত্মসাৎ করিতে চাই না। আমাদের দিবার আওকাৎ থাকিলে বরঞ্চ পরকে কিছু দিয়াও দেই। দৃষ্টান্ত চান? শুনুন তবেঃ
- প্রথম গণপরিষদে আমাদের মেম্বর সংখ্যা ছিল ৪৪; আর আপনাদের ছিল ২৮। আমরা ইচ্ছা করিলে গণতান্ত্রিক শক্তিতে ভোটের জোরে রাজধানী ও দেশ রক্ষার সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে আনিতে পারতাম। তা করি নাই।
- পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যাল্পতা দেখিয়া ভাই এর দরদ লইয়া আমাদের ৪৪ টা আসনের মধ্যে ৬ টা তে পূর্ব পাকিস্তানীর ভোটে পশ্চিম পাকিস্তানী মেম্বর নির্বাচন করিয়া ছিলাম।
- ইচ্ছা করিলে ভোটের জোরে শুধু বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিতে পারিতাম। তা না করিয়া বাংলার সাথে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষার দাবী করিয়াছিলাম।
- ইচ্ছা করিলে ভোটের জোরে পূর্ব পাকিস্তানের সুবিধাজনক শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারিতাম।
- আপনাদের মন হইতে মেজরিটি ভয় দূর করিয়া সে স্থলে ভ্রাতৃত্ব ও সমতাবোধ সৃষ্টির জন্য উভয় অঞ্চলে সকল বিষয়ে সমতা বিধানের আশ্বাসে আমরা সংখ্যাগুরুত্ব ত্যাগ করিয়া সংখ্যা–সাম্য গ্রহণ করিয়াছিলাম।
চার, সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানী ভাই সাহেবান, আপনারা দেখিতেছেন, যেখানে সেখানে আমাদের দান করিবার আওকাৎ ছিল আমরা দান করিয়াছি। আর কিছুই নাই দান করিবার। থাকিলে নিশ্চয় দিতাম। যদিপূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী হইত তবে আপনাদের দাবী করিবার আগেই আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে সত্যসত্যই দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করিতাম। দ্বিতীয় রাজধানীর নামে ধোঁকা দিতাম না। সে অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রকার ব্যয় যাতে উভয় অঞ্চলে সমান হয় তার নিখুঁত ব্যবস্থা করিতাম। সকল ব্যপারে পশ্চিম পাকিস্তানকে সামগ্রিকভাবে এবং প্রদেশসমূহকে পৃথক পৃথকভাবে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দিতাম। আমরা দেখাইতাম,পূর্ব পাকিস্তানীরা মেজরিটি বলিয়াই পাকিস্তান শুধু পূর্ব পাকিস্তানের নয় ছোট বড় নির্বিশেষে তা সকল পাকিস্তানির। পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী হইলে তার সুযগ লইয়া আমরা পূর্ব পাকিস্তানীরা সব অধিকার ও চাকুরী গ্রাস করিতাম না। পশ্চিম পাকিস্তানীর শাসনভার পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতেই দিতাম। আপনাদের কটন বোর্ডে আমরা চেয়ারম্যান হইতে যাইতাম না। আপনাদের প্রদেশের আমরা গভর্নর হইতেও চাহিতাম না। আপনাদের পি–আই- ডি- সি, আপনাদের ওয়াপদা, আপনাদের ডি-আই- টি, আপনাদের পোর্ট ট্রাস্ট, আপনাদের রেলওয়ে ইত্যাদির চেয়ারম্যানিআমরা দখল করিতাম না। আপনাদেরই করতে দিতাম। সমস্ত অল পাকিস্তানী প্রতিষ্ঠানকে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত করিতাম না। দুই অঞ্চলের মধ্যে এই মারাত্মক ডিস্প্যারিটি সৃষ্টি হইতে দিতাম না।
এমনি উদারতা, এমন নিরপেক্ষতা, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে এমন ইনসাফ বোধই পাকিস্তানী দেশপ্রেমের বুনিয়াদ। এটা যার মধ্যে আছে কেবল তিনি ই দেশপ্রেমিক। যে নেতার মধ্যে এই প্রেম আছে কেবল তিনিই পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের উপর নেতৃত্বে যোগ্য। যে নেতা বিশ্বাস করেন, দুইটি অঞ্চল আসলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দেহের দুই চোখ, দুই কান, দুই নাসিকা, দুই পাতি দাঁত, দুই হাত, দুই পা; যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানকে শক্তিশালী করিতে হইলে এই সব জোড়ার দুইটিকেই সমান সুস্থ ও শক্তিশালী করিতে হইবে; যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানের এক অঙ্গ দুর্বল হইলে গোটা পাকিস্তানই দুর্বল হইয়া পড়ে; যে নেতা বিশ্বাস করেন ইচ্ছা করিয়া বা জানিয়া–শুনিয়া যারা পাকিস্তানের এক অঙ্গকে দুর্বল করিতে চায় তারা পাকিস্তানের দুশমন; যে নেতা দৃঢ় ও সবল হস্তে সেই দুশমনের শায়েস্তা করিতে প্রস্তুত আছেন, কেবল তিনিই পাকিস্তানের জাতীয় নেতা হইবার অধিকারী। কেবল তাঁরই নেতৃত্বে পাকিস্তানের ঐক্য অটুট ও শক্তি অপরাজেয় হইবে। পাকিস্তানের মত বিশাল ও অসাধারন রাষ্ট্রের নায়ক হইতে হইলে নায়কের অন্তরও হইতে হবে বিশাল ও অসাধারণ। আশা করি আমার পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা এই মাপকাঠিতে আমার ছয় – দফা কর্মসূচীর বিচার করবেন। তা যদি তাঁরা করেন তবে দেখিতে পাইবেন, আমার এই ছয় দফা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবী নয়, গোটা পাকিস্তানেরই বাঁচার দাবি ।
আমার প্রিয় ভাইবোনের , আপনারা দেখিতেছেন যে, আমার ৬–দফা দাবি একটিও অন্যায়, অসঙ্গত, পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব করি নাই। বরঞ্চ আমি যুক্তিতর্ক সহকারে দেখাইলাম, আমার সুপারিশ গ্রহন করিলে পাকিস্তান আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হইবে। তথাপি কায়েমী স্বার্থের মুখপাত্ররা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার এলজাম লাগাইতেছেন, এটা নতুনও নয়, বিস্ময়ের কথাও নয়। পূর্ব পাকিস্তানের মজলুম জনগনের পক্ষে কথা বলিতে গিয়া আমার বাপ দাদার মত মুরুব্বীরাই এদের কাছে গাল খাইয়াছেন। এদের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করিয়াছেন, আর আমি কোন ছার? দেশবাসীর মনে আছে, আমাদের নয়নমণি শেরে–বাংলা ফজলুল হককে এরা দেশদ্রোহী বলিয়াছিলেন। এও দেখিয়াছেন যে পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা, পাকিস্তানের সর্বজনমান্য জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবরন করিতে হইয়াছিল এদেরই হাতে। অতএব দেখা গেল পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবির কথা বলিতে গেলে দেশদ্রোহিতার বদনাম ও জেল জুলুমের ঝুঁকি লইয়াই সে কাজ করিতে হইবে। অতীতে এমন অনেক জেল- জুলুম ভুগিবার তকদীর আমার হইয়াছে। মুরুব্বীদের দোয়ায়, সহকর্মীদের সহৃদয়তায় এবং দেশবাসীর সমর্থনে সেসব সহ্য করিবার মত মনের বল আল্লাহ আমাকে দান করিয়াছেন। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানীর ভালবাসাকে সম্বল করিয়া আমি এ কাজে যে কোন ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি ! আমার দেশবাসির কল্যানের কাছে আমার মত নগন্য ব্যক্তির জীবনের মূল্য কতটুকু? মজলুম দেশবাসির বাঁচার দাবির জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছুই আছে বলিয়া আমি মনে করি না। মরহূম জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ন্যায় যোগ্য নেতার কাছেই আমি এ জ্ঞান লাভ করিয়াছি। তাঁর পায়ের তলে বসিয়াই এতকাল দেশবাসির খেদমত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। তিনিও আজ বাঁচিয়া নাই, আমিও আজ যৌবনের কোঠা বহূ পেছনে ফেলিয়া প্রঢ়ত্বে পৌছিয়াছি। আমার দেশের প্রিয় ভাইবোনেরা আল্লাহর দরগায় শুধু এই দোয়া করিবেন, বাকী জীবনটুকু আমি যেন তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনায় নিয়োজিত করিতে পারি।
৪ঠা চৈত্র , ১৩৭২ আপনাদের স্নেহধন্য খাদেম
শেখ মুজিবুর রহমান ।