দুর্নীতিবাজদের তাড়াতে হবে: আওয়ামী লীগ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা
ঢাকা: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুস্পষ্ট ভাষায় ঘােষণা করেছেন যে, পারমিট শিকারী দুর্নীতিবাজদের আওয়ামী লীগ হতে উৎখাত করা হবে। তিনি বলেন, এদের স্থান আওয়ামী লীগে নেই। তিনি জোর দিয়ে বলেন, দু একজনের জন্য ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের বদনাম হতে দেয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ কাউন্সিল উদ্বোধনী প্রসঙ্গে এ কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু তার সারাজীবনের সাধনা ও স্বপ্ন সােনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিজেদের মধ্যে আত্মসমালােচনা, আত্মসংযম এবং আত্মশুদ্ধির আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশকে সােনার বাংলা রূপে গঠনের জন্য এবং সমাজতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানাের জন্য নিঃস্বার্থ কর্মী বাহিনীর প্রয়ােজন রয়েছে। তিনি সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে সমাজতান্ত্রিক ক্যাডার হিসেবে নিজেদের তৈরি করার জন্যে আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন এবং রাষ্ট্রের ৪টি মূলনীতি বাস্তবায়ন করতে আওয়ামী লীগ কর্মীদেরই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কর্মীরাই এর জন্য গত ২৫ বছর শত নির্যাতনের মুখে সংগ্রাম করেছেন। এমনকি তাদের রক্ত পর্যন্ত দিতে হয়েছে বলে তিনি জানান। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, যারা আওয়ামী লীগের নীতি, আদর্শ এবং ঘােষণাপত্রে বিশ্বাস করেন না এবং যারা দুর্নীতিমুক্ত হতে চান না তারা আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে যেতে পারেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবেত কাউন্সিলার এবং ডেলিগেটদের উদ্দেশ্য করে বলেন, বাংলার মানুষকে সুখী, শােষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের চার নীতি বাস্তবায়ন এবং সােনার বাংলা কায়েমের জন্য আওয়ামী লীগ। কর্মীদের এই সম্মেলনে নতুন করে শপথ গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, উপরােক্ত আদর্শগুলাে বাস্তবায়ন করতে না পারলে তিনি শান্তিতে মারা যাবেন না।
মুক্তির যুদ্ধ শুরু হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে দেশে একটি সুখী সুন্দর শােষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি ব্যতীত স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, স্বাধীনতা লাভের পর দেশগঠন এবং অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলেন, যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধও সফলতা লাভ করবে। তিনি দেশে সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য সমাজতান্ত্রিক ক্যাডার সৃষ্টি করতে আওয়ামী লীগের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি তাদের ট্রেনিং নেয়ার উপরও গুরুত্ব আরােপ করেন। তিনি বলেন, আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র কায়েম করবাে-দুনিয়ায় সমাজতন্ত্র কায়েমের একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবাে।
রাষ্ট্রের চার নীতি: প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি বলেন, জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। কারণ জাতীয়তাবাদই হচ্ছে স্বাধীনতার অন্যতম মূলমন্ত্র বলে তিনি মন্তব্য করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, গণতন্ত্র কায়েমের জন্য বাংলার মানুষ দীর্ঘ ১৫ বছর সংগ্রাম করেছেন। এমনকি এর জন্য আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা। কর্মীদের রক্ত দিতে হয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকার কায়েমের জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে। তিনি বলেন, যে কোন মূল্যে গণতন্ত্র কায়েম করা হবে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গণতন্ত্র যাতে কায়েম হতে না পারে তার জন্য গণতন্ত্র বিরােধীরা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য রাষ্ট্রের অন্যতম আদর্শ সমাজতন্ত্র অবশ্যই কায়েম করতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি নস্যাৎ করার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। সমাজতন্ত্র বিরােধীরা সূক্ষভাবে সরকারের সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি বানচালের জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের গ্রামের মানুষকে সমাজতন্ত্রের আদর্শ ও উদ্দেশ্য বােঝাবার আহ্বান জানিয়েছেন।
স্বাধীনতাবিরােধী ষড়যন্ত্র চলছে: প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, বিদেশি দালালরা সহজে দেশের স্বাধীনতাকে গ্রহণ করেনি। তারা চুপ করে বসে নেই। তিনি বলেন, এসব দালালরা বাংলাদেশের বহু কষ্টার্জিত স্বাধীনতা নস্যাতের ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। তারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে চায় বলে তিনি উল্লেখ করেণ। বঙ্গবন্ধু বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। তা আওয়ামী লীগ কর্মীরা জীবন দিয়েও রক্ষা করবে। তাই এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর-স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কষ্টকর।
পররাষ্ট্রনীতি: প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দানকালে বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবেই জোটবহির্ভূত নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বাস করে এবং তা অনুসরণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কারাে পকেটে নয়— ভবিষ্যতেও কারাে পকেটে যাবে না। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম মূল আদর্শ। তিনি আরাে বলেন, বাংলাদেশ প্রত্যেকের সাথেই বন্ধুত্ব কামনা করে কারাে সাথে শত্রুতা করা বাংলাদেশের কাম্য নয়। তবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং আত্মসম্মান বিক্রি করে বাংলাদেশ কারাে সাথে বন্ধুত্ব কায়েম করতে চায় না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা চীনের সাথেও বন্ধুত্ব কামনা করি। তবে তা আত্মসম্মান বিক্রি করে নয়। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের বিপক্ষে চীনের ভােটদান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করেন, “ইহা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ প্রসঙ্গে তিনি আরাে বলেন, আমরা কামনা করি চীনের মনােভাব পরিবর্তন হবে; তবে যদি না হয়, তাহলে কিছু আসে যায় না। আলােচনা বা আর টি সি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ত দিয়ে অর্জিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের সাথে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এই নীতির কোন পরিবর্তন হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বাংলার মানুষ ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরব ভাইদের ন্যায্য দাবীর পেছনে আছে। ইতােমধ্যেই বাংলাদেশ আরব ভাইদের সাহায্য ও সহযােগিতায় এগিয়ে গিয়েছে বলে তিনি জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সর্বশক্তি দিয়ে আরব ভাইদের ন্যায্য সংগ্রামে সাহায্য ও সহযােগিতা দান করবে।
সমাজবিরােধী কারা? প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাজবিরােধীদের চিহ্নিত করে বলেন, চোরাচালান, কালােবাজারী, ঔষধে ভেজাল, বিদেশি এজেন্ট, হাইজ্যাক এবং বিদেশে টাকা রাখার কাজে একশ্রেণির শিক্ষিত ভদ্রলােকরাই জড়িত রয়েছে। গ্রামের কৃষকরা বা কলকারখানার শ্রমিকরা এ জাতীয় কাজ করবেন না। তিনি কালােবাজারী, মজুতদার, ঘুষখাের। এবং চোরাচালানীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি সমাজের দুষ্টক্ষত দুর্নীতি দমনের জন্য আওয়ামী লীগ কর্মীদের জনমত গঠনের উপদেশ দেন। শ্রমিক এবং কৃষকদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজ নিজ ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানান। এই প্রসঙ্গে তিনি উৎপাদন বৃদ্ধির সংগ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করার উপর গুরুত্ব আরােপ করেন। ছাত্র সমাজের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু বলেন, বগুড়ার ছাত্রদের ন্যায় নিজে আয় করে লেখাপড়া করার অভ্যাস করতে হবে।
৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণার তারিখ: জাতির পিতা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, প্রকৃত পক্ষে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, তিনি ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম’ ঘােষণা করেই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। এর পরে ২৪ এবং ২৫ মার্চ তিনি দলীয় নেতাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, ৫৮টি মহকুমায় স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য কমান্ডার পূর্ব থেকেই নিয়ােগ করা হয়েছিল। যার জন্য সারাদেশে একই দিনে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ যুদ্ধ করা সম্ভব। হয়েছিল। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনাকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং অবদানের কথা উল্লেখ করে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ হঠাৎ শুরু হয়নি। ১৯৪৮ সাল থেকেই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয় এবং তা ধাপে ধাপে বিজয়ের পথে অগ্রসর হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের জন্ম ইতিহাস বর্ণনা করেন। তিনি ১৯৪৮ সাল হতে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং তার নিজের অবদানের কথা বিস্তারিত বর্ণনা করেন।৬৫
রেফারেন্স: ১৮ জানুয়ারি ১৯৭৪, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত