You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

    শিরনাম         সুত্র         তারিখ
মুলনীতি কমিটির অন্তরবর্তিকালীন রিপোর্ট  পাকিস্তান গনপরিসদ ৭ই নভেম্বার ,১৯৫০

বরাবর

  পাকিস্তান গনপরিসদ ,

  করাচী

  গনপরিষদ আইনের ধারা  ৭২(১) এর বিধান অনুযায়ী আমি এর সাথে মুল নিতিমালা কমিটির রস্ট্রিয় এবং প্রাদেশিক সংবিধান ও ক্ষমতা বন্টন সংক্রান্ত অন্তরবর্তীকালিন প্রতিবেদন পেশ করছি ।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে সংসদে উত্থাপিত আলোচনা অনুযায়ী গনপরিষদ গৃহিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক যেই নীতিস্মুহের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সংবিধান এর রূপরেখা নির্ধারিত হবে সেগুলির বিষয়ে  প্রতিবেদন পেশ করার জন্য মূল নীতিমালা কমিটিকে ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ নিজুক্ত করা হয় ; গৃহিত সিদ্ধান্তের মূল পাঠ্যাংশ অংযোজনি ১ এ দেওয়া আছে ।এর সদস্য হিসাবে পূর্ব-বাংলা প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রি ,সিও ও এন,ডাব্লিও,এফ,পি এবং মাননীয় বিচারপতি আব্দুর রশিদ কে সহ যোজিত করা হয়েছিল ।

মূল কমিটির কার্যপরিধি, কার্য বিবরণী এবং কার্য-পদ্ধতি বিষয়ে একটি প্রতিবেদন করার জন্য মূল নীতিমালা কমিটির একটি পরিচালনা উপ-কমিটি নিয়োজিত করে এবং সেই প্রতিবেদন অনুসারেই নিম্নোক্ত তিনটি উপ-কমিটিকে রুপদাঙ্কারী মুল নীতিমালাসমুহ প্রস্তাবনার জন্য নিযুক্ত করেঃ

১। রাষ্ট্রীয় এবং প্রাদেশিক সংবিধান ও ক্ষমতা বন্টন বিহয়ক উপকমিটি

২, ভোটাধিকার বিষয়ক উপকমিটি

৩।বিচার বিষয়ক উপ-কমিটি ।

এছাড়া ৫ সদস্য বিশিস্ট তালিমাত-ইস্লামিয়া বোর্ড গঠনের সিধান্ত নেওয়া হয় ।এই বোর্ডকে লক্ষ্য নির্ধারন এবং মুলনীতিমালা কমিটি অথবা অন্য উপকমিটির কার্যাবলী বিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ প্রদানের জন্য বলা হয়।

৪ জন সদস্য নিয়ে তালমিয়াত-ইস্লামিয়া বোর্ড ১৯৪৯ এর সেপ্টেম্বার থেকে কার্যকর হয়। তখনও চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মওলানা সুলাইমান নাদবি দ্বায়িত্ব নেন নি।উপকমিটি কর্তৃক রাষ্ট্রীয় এবং প্রাদেশিক সাংবিধানিক কমিটীর একটি বিশেষ কমিটি, তালিমাত-ই-ইস্লামিয়া বোর্ড এবং প্রতিবেদন সহকারে তাদের প্রস্তাবনা নিরীক্ষিত ও বিবেচিত হয়।

রাষ্ট্রীয় এবং প্রাদেশিক সংবিধান ও ক্ষমতা বন্টন বিষয়ক উপ-কমিটি এর প্রতিবেদন ১১ জুলাই,১৯৪৯ তারিখে জমা দেয় ।এবং মুলকমিটি ১৯৫০সালের ৫,৯,১০,১১ আগস্ট সভা চলাকালে এই প্রতিবেদন বিবেচনায় আনে। ভোটাধীকার এবং বিচার বিষয়ক অন্য দুটি উপকমিটির প্রতিবেদন তখনও পেশ করা হয়নি ।

<001.046.169>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

অর্থনৈতিক বন্টন, পরিভাষা, রাজ্য প্রধানের যোগ্যতা প্রভৃতির মত কিছু বিষয়ে কমিটি তখনও তাদের প্রস্তাবনা পুরাপুরি সম্পন্ন করে উঠতে পারেনি ।

মুলনীতিমালা কমিটির সুপারিস সমুহ যথাযথ ভাবে সংসদে অন্তর্বর্তীকালিন প্রতিবেদন সরূপ উপস্থাপিত হয়। কমিটীর পরিকল্পনা মোতাবেক শুধুমাত্র মূল নীতিমালা নিয়েই কাজ করা হয়।

সংযোজনি ২ ও ৩ এ কমিটির সুপারিশ সমূহ দেওয়া আছে। সংযোজনি ২ এ প্রদত্ত সুপারিশ সমূহ নিম্নে প্রদত্ত খেত্রগুলো নিয়ে ছিলঃ

১। রাষ্ট্রসংঘের ধরন

২। রাষ্ট্রীয় ্সংবিধানের বৈশিষ্ট সমুহ

৩। আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী

৪। রাষ্ট্র প্রধানের ক্ষমতা ও কার্যাবলী

৫। অবশিষ্ট ক্ষমতার নীতিমালা

৬। আইনসভার দ্বন্দ সঙ্ক্রান্ত নীতিমালা এবং

৭। অর্থনৈতিক সহ-প্রশাসনিক ক্ষমতার বন্টন

আইনসভার জন্য কেন্দ্রে এবং প্রদেশে বিভিন্ন বিষয়ের বন্টন এবং নিম্নোক্ত তালিকার বিষয়গুলি নিয়ে সংযোজনি ৩ গঠিতঃ

১। কেন্দ্রীয় আইনসভাকে প্রদত্ত ক্ষমতার তালিকা

২। প্রাদেশিক আইনসভাকে প্রদত্ত ক্ষমতার তালিকা

৩। সহঘটিত বিষয়াবলির তালিকা

কেন্দ্র এবং প্রদেশের ভেতর অর্থনৈতিক বন্টন বিষয়ক প্রশ্ন গুলো নিরিক্ষনের জন্য কমিটি পাকিস্থান কেন্দ্রীয় বাংকের গভর্নর জনাব জাহিদ হুসেইনকে বিশেষজ্ঞ হিসাবে নিযুক্ত করে।

মুলনীতিমালা কমিটি যথোপযুক্ত পরিভাষা নির্ধারনের জন্যও ডক্টর মাহামুদ হুসেইন কে আহ্বায়ক এবং ডঃ ই হ কুরেইশি কে সদস্য করে একটি কমিটী গঠনের মাধ্যমে নিযুক্ত করে ।

                                      তাজুদ্দিন খান

                                      চেয়ারম্যান

                                   মূলনীতিমালা কমিটি

করাচী,

সেপ্টেম্বর ৭,১৯৫০ ।

<001.046.170>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

সংযুক্তি ১

সমাধান

যে এই আইনসভা বিধান দেয় যে এই কমিটি প্রেসিডেন্ট সহ নিম্নোক্ত নামের সদস্য বিশিষ্ট হবেঃ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

সংযুক্তি ২

যুক্তরাষ্ট্রীয় ও প্রাদেশিক সংবিধান এবং ক্ষমতার বিভাজনের উপর স্মারকলিপি

অংশ ১

রাষ্ট্র কর্মপন্থা পরিচালনা নীতি

. লক্ষ্য নির্ণয়

                রাষ্ট্র কর্মপন্থা পরিচালনা নীতি রূপে অভীষ্ট লক্ষ্য তৈরি করতে হবে, বিধানের বিষয় যে এটি যথাযথ স্থানে সংবিধানে মৌলিক অধিকার আনয়ন প্রবণ হবে না।

. শিক্ষা

                অভীষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী সরকারী কার্যক্রমের প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যে মুসলমানেরা কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী তাদের জীবন ধারণ করতে পারে।

       এই ধরণের কার্যসমূহ সংবিধানে পুরোপুরি উল্লেখ করা সম্ভব নয়। অভীষ্ট লক্ষ্য গ্রহণ, যেভাবে হোক, রাষ্ট্র কর্মপন্থা পরিচালনা নীতি রূপে এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার ও তার অংশ সমূহকে পরিচালিত করবে।

       একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হল মুসলমানদের জন্য সুবিধার বিধান কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন কী বুঝতে এবং, তারপর, কমিটি, অন্যান্য জিনিসের মধ্যে, মুসলমানদেরকে বাধ্যতামূলক কোরআন শিক্ষার নির্দিষ্ট গুরুত্ব আরোপ করে।

. ওয়াক্‌ফ ও মসজিদ

                ওয়াক্‌ফ ও মসজিদ যথাযথ ধারা অনুযায়ী সংগঠিত করা উচিত।

অংশ ২

যুক্তরাষ্ট্র ও তার অঞ্চলসমূহ

. যুক্তরাষ্ট্রের নাম ও অঞ্চলসমূহ

       রাষ্ট্রের নাম অবশ্যই পাকিস্তান হওয়া উচিত, যা গভর্নরের প্রদেশসমূহের সংযুক্তি হওয়া উচিত, প্রধান কমিশনারের প্রদেশ, যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী এবং এই রাষ্ট্রসমূহ যুক্তরাষ্ট্রে সম্মতি প্রদান করেছে অথবা সম্মতি প্রদান করতে পারে।

       অন্যান্য সব অঞ্চল যেসব উপরে নির্দিষ্ট করা হয়নি যেসব সংবিধান প্রবর্তনের সময় পাকিস্তানের অংশ হয়েছে সেসব অবশ্যই পাকিস্তানের অঞ্চল হিসেবে সংযুক্ত হবে।

. প্রদেশের সীমানা ও নাম পরিবর্তন

       কেন্দ্রীয় সংসদ আইন অনুসারে করতে পারে-

       (ক) যেকোন প্রদেশের সীমানা বৃদ্ধি;

       (খ) যেকোন প্রদেশের সীমানা কমানো;

       (গ) যেকোন প্রদেশের সীমানা পরিবর্তন; এবং

       (ঘ) যেকোন প্রদেশের নাম পরিবর্তন।

<001.046.172>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

পাকিস্তান সরকার বাদে এই উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় আইনসভার কোন কক্ষে কোন বিল উপস্থাপন করা যাবে না এবং যদি না-

       (ক) হয়– () যে প্রদেশ থেকে অঞ্চলটি আলাদা অথবা অন্তর্ভুক্ত হতে চায় সে অঞ্চলের প্রাদেশিক আইনসভার সংখ্যা গরিষ্ঠ প্রতিনিধিগণ কর্তৃক সরকার প্রধানের নিকট এই উদ্দেশ্যে একটি প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হয়; অথবা

       () বিলের প্রস্তাবনা অনুযায়ী যে প্রদেশের সীমানা প্রভাবিত হবে সে প্রদেশের আইনসভায় এই সম্পর্কে সিদ্ধান্ত পাস করা হয়; এবং

       (খ) যেখানে বিলের প্রস্তাবনা যেকোন প্রদেশের সীমানা অথবা নাম প্রভাবিত করে, বিল উপস্থাপনার প্রস্তাবনা ও বিধান উভয় সম্পর্কে সে প্রদেশের আইনসভার দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে সরকার প্রধান দ্বারা নির্ণিত হয়েছে।

       . নতুন প্রদেশ প্রতিষ্ঠা

                কেন্দ্রীয় আইনসভা সময় অনুযায়ী, আইনের দ্বারা, যেসব শর্ত ও অবস্থা যোগ্য মনে করে সেসব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিতে পারে অথবা নতুন প্রদেশ গঠন করতে পারে।

অংশ ৩

যুক্তরাষ্ট্র

অধ্যায় ১

নির্বাহী

. সরকার প্রধান

                (১) একজন সরকার প্রধান থাকা উচিত।

       (২) যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী সরকার প্রধানের অধীনে থাকবে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী কর্ম পরিচালনা জন্য।

       (৩) ঐসব ক্ষেত্র ব্যতীত যেখানে আইন হয়েছে যে সরকার প্রধান তার বিচক্ষণতা অনুযায়ী কাজ করবেন অথবা, যদি না সেখানে কোন দ্বন্দ্ব থাকে, “সরকার প্রধান” পরিভাষাটি বুঝায় যে সরকার প্রধান মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করে।

. সরকার প্রধান নির্বাচন

(১)কেন্দ্রীয় সংসদের উভয় কক্ষের যুক্ত অধিবেশনে সরকার প্রধান নির্বাচন হওয়া উচিত এবং কোন কক্ষেরই সদস্য হওয়া উচিত না।

       (২) যেকোন কক্ষের একজন সদস্য, যদি সরকার প্রধান নির্বাচিত হয় তবে তার নির্বাচনের তার সদস্যপদ বাতিল করা উচিত।

. সরকার প্রধানের দপ্তরের মেয়াদ

       দপ্তর অধিগ্রহণের সময়কাল থেকে শুরু করে সরকার প্রধানের দপ্তরের মেয়াদ পাঁচ বছর হওয়া উচিত। মৃত্যু, পদত্যাগ ও অন্যান্য কারণে সরকার প্রধানের দপ্তর শূন্য হলে, নতুন সরকার প্রধানের মেয়াদ পাঁচ বছর হবে।

<001.046.173>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

১০. পুনরায় নির্বাচিত হবার যোগ্যতা: পরপর দুই পূর্ন মেয়াদের পর কোন ব্যক্তিই সরকার প্রধানের দপ্তর ধরে রাখার জন্য অনুমোদিত নয়।

১১. সহকারী সরকার প্রধানকোন সহকারী সরকার প্রধান থাকবে না।

১২. সরকার প্রধানের দপ্তরে নৈমিত্তিক ছুটি

       (১) সরকার প্রধানের অনুপস্থিতিতে নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ সরকার প্রধান হিসেবে কাজ করবেন যতক্ষন পর্যন্ত না নতুন সরকার প্রধান নির্বাচিত হয় এবং নিম্নোক্ত যথাক্রমে দপ্তর অধিগ্রহণ করবেনঃ

(i) হাউজ অব ইউনিট্‌স এর প্রধান
(ii) হাউজ অব পিপলসের প্রধান।
(iii)  পাকিস্তানে থাকা প্রদেশেগুলোর সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ গভর্নর।

       (২) যতক্ষন পর্যন্ত হাউজ অব ইউনিট্‌স এর প্রধান সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ততক্ষণ তিনি হাউজ অব ইউনিট্‌স এর প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, অথবা কোন ভাবেই এর প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। সরকার প্রধানের  দায়িত্ব পালনের কারণে হাউজ অব ইউনিট্‌সে তিনি তার আসন অথবা দপ্তর হারাবেন না। তার পরিবর্তন হলে একই আইন হাউজ অব পিপল্‌সের প্রধান অথবা সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ গভর্নরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

১৩. সরকার প্রধানের শপথ

                সুপারিশকৃত ধারা ও গঠন অনুযায়ী সরকার প্রধান পাকিস্তান সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের শপথ ও দপ্তর ও গোপনীয়তার শপথ গ্রহণ করবেন।

১৪. নির্দিষ্ট ঘটনায় সরকার প্রধানের কার্যক্রম বাতিল

       সংবিধানে না  থাকা নির্দিষ্ট বিষয়ে সরকার প্রধানের কার্যক্রম বাতিলের বিধান প্রণয়নের অধিকার কেন্দ্রীয় সংসদের থাকবে।

১৫. সরকার প্রধানের বিশেষ ক্ষমতা

সরকার প্রধানের বিশেষ ক্ষমতা ধারণ করা উচিত, যেমন নির্বাচন পরিচালনা, এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত সেসব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কর্তৃত্ব দেওয়া উচিত।

১৬. সামরিক বাহিনী সমূহের সেনাপতিত্ব

                সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ আদেশ দান ক্ষমতা সরকার প্রধানের অধীনে থাকবে।

১৭. সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও কর্মকর্তা নিয়োগ তিন সামরিক বাহিনীর প্রত্যেকটির সর্বাধিনায়ক, সামরিক বাহিনী সমূহের সর্বাধিনায়ক, যদি থাকে এবং সামরিক বাহিনী সমূহের কর্মকর্তা সরকার প্রধান নিয়োগ দিবেন।

<001.046.174>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

১৮. রাষ্ট্র প্রধানের ফরমায়েশি ক্ষমতা

                নিম্নোক্ত ক্ষমতাগুলো রাষ্ট্র প্রধান তার ইচ্ছায় চর্চা করতে পারবেনঃ

       (১) ক্ষমাশীলতার ক্ষমতা, এবং

(২) নির্বাচন ট্রাইব্যুনাল নিয়োগ।

ব্যাখ্যা- “বিশেষ ক্ষমতা” অথবা “বিশেষ দায়িত্ব” শব্দদ্বয় যেখানেই ব্যবহার করা হোক, এগুলো অবশ্যই রাষ্ট্র প্রধান অথবা প্রদেশ প্রধান কর্তৃক তার ঐচ্ছিক ক্ষমতার চর্চা বুঝাবে।

১৯. রাষ্ট্র প্রধানের বেতন ও ভাতা

                রাষ্ট্র প্রধানের পদমর্যাদা ও সম্মান অনুযায়ী বেতন ও ভাতা নির্ধারণের যথাযথ বিধান তৈরি করা হবে।

       কমিটি এই নীতি গ্রহণ করেছে যে একটি যৌক্তিক অংক পেনশন অথবা ভাতা রূপে রাষ্ট্র প্রধানকে তার অবসর পরবর্তী জীবনের জন্য দেওয়া যেতে পারে। লাভজনক কর্মে থাকলে এই ভাতা অথবা পেনশন স্থগিত গন্য করা হবে।

       যদি সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র প্রধানকে তার অসদাচরণের জন্য বহিষ্কার করা হয় তবে তিনি কোন পেনশন অথবা ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত নন।

২০. রাষ্ট্র প্রধানের জন্য নিরাপত্তা

                (১) রাষ্ট্র প্রধানকে কোন আদালতের নিকট জবাবদিহিতা করতে হবে না তার দাপ্তরিক ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালন ও চর্চার জন্য অথবা এসব ক্ষমতা ও দায়িত্ব চর্চা ও পালনে তার দ্বারা কোন কাজ করা হয়েছে অথবা করার অভিপ্রায়ের জন্য।

       (২) যতক্ষণ তিনি দায়িত্বে থাকবেন ততক্ষণ যেকোন আদালতে যেকোন বিষয়ে ফৌজদারি কার্যক্রম গঠন অথবা চালানো যাবে না।

       (৩) যতক্ষন পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে থাকবেন ততক্ষণ পর্যন্ত কোন আদালতে তার গ্রেফতার কারাবন্দীকরণ অথবা হাজির হওয়ার প্রক্রিয়া করা যাবে না।

       (৪) লিখিত বিজ্ঞপ্তি তার দপ্তরে যাওয়ার ৬০ দিন পার না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে বা পরে রাষ্ট্র প্রধান তার ব্যক্তিগত সক্ষমতায় যেসব করা হয়েছে বা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন সেসবের জন্য তার মেয়াদ চলাকালীন সময়ে তার অব্যাহতি চেয়ে কোন দেওয়ানি মামলা গঠন করা যাবে না, অথবা তার দপ্তরে মামলার প্রকৃতি, কার্যের কারণ পাশাপাশি যে দল কর্তৃক এই মামলা গঠন করা হয়েছে তার নাম, বিবরণ এবং আবাসস্থল এবং যে অব্যাহতি সে চেয়েছে রেচকে যাওয়া হয়।

২১. রাষ্ট্র প্রধান ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রতিবন্ধকতা

                রাষ্ট্র প্রধান, প্রদেশ প্রদান, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী এবং সংসদদের অভিশংসনের জন্য সংবিধানে কোন বিধি তৈরি করা যাবে না।

<001.046.175>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

২২. রাষ্ট্র প্রধানের অপসারণ

                কেন্দ্রীয় সংসদ প্রত্যেক সংসদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা থেকে আসা একটি চাহিদা পত্রের দ্বারা রাষ্ট্র প্রধানকে তার দপ্তর থেকে অপসারণ ক্ষমতার অধিকারি হবে এবং সিদ্ধান্তটি মোট ক্ষমতার দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সংসদের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে পাস হবে, এবং কেবল সাংসদদের উপস্থিতি ও ভোটিংয়ে নয়।

       উপরন্তু রাষ্ট্র প্রধানকে অপসারণের জন্য একমাসের নোটিশ জরুরী।

মন্ত্রী পরিষদ

২৩. রাষ্ট্র প্রধানকে সহায়তা ও পরামর্শের জন্য মন্ত্রী পরিষদ

                রাষ্ট্র প্রধানের উচিত একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া যিনি, তার মতে, কেন্দ্রীয় সংসদের উভয় কক্ষ সংখ্যা গরিষ্ঠদের আস্থা যৌথভাবে পরিচালনা করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ দিতে হবে।

২৪. মন্ত্রীদের প্রতি অন্যান্য বিধান

                যে কোন সংসদ কক্ষের সদস্য নয় তাকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিধি তৈরি করতে হবে, যাতে থাকবে যে যদি নিয়োগ পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে যদি নির্বাচিত না হয় তবে তার মন্ত্রিত্ব স্থগিত বাজেয়াপ্ত করা হবে।

২৫. আইনসভার প্রতি যৌথ দায়িত্ব

       কেন্দ্রের মন্ত্রীরা আইনসভার প্রতি যৌথভাবে দায়বদ্ধ থাকবে।

২৬. মন্ত্রীদের শপথ

       মন্ত্রীদের দপ্তরের আনুগত্য ও গোপনীয়তার শপথ নেওয়া বাধ্যতামূলক।

পাকিস্তানের জন্য সরকারী প্রধান উকিল

7. পাকিস্তানের জন্য সরকারী প্রধান উকিল

                রাষ্ট্র প্রধান কর্তৃক নিয়োগকৃত একজন সরকারী প্রধান উকিল থাকতে হবে। সরকারী প্রধান উকিল এমন ব্যক্তি হবে যিনি যুক্ত আদালতের প্রধান বিচারক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তার ক্ষেত্রে বয়সের কোন সীমা থাকবে না।

সরকারী কার্য পরিচালনা

২৮. পাকিস্তান সরকারের কার্য পরিচালনা

       রাষ্ট্র প্রধানের দ্বারা পাকিস্তান সরকারের কার্য পরিচালনার জন্য আইন গঠনের জন্য সংবিধানে বিধি তৈরি করা উচিত।

২৯. রাষ্ট্র প্রধানের নিকট তথ্য সরবরাহে মন্ত্রীদের দায়িত্বসমূহ

                বিধি তৈরি করা উচিত যার দ্বারা মন্ত্রী পরিষদের সকল সিদ্ধান্ত ও আইনসভার জন্য প্রস্তাবসমূহ সম্পর্কে রাষ্ট্র প্রধান অবহিত থাকবেন। রাষ্ট্রে বিষয়সমূহ পরিচালনা ও আইনসভায় যেসব প্রস্তাবনার জন্য তাকে ডাকা হতে পারে সে সম্পর্কিত তথ্যও রাষ্ট্র প্রধানকে সরবরাহ করতে হবে।

 <001.046.176>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

২য় অধ্যায়
কেন্দ্রীয় আইন্ সভা
৩০- সংবিধান, ক্ষমতা ও কেন্দ্রিয় আইন সভার কার্যকারিতা
দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি কেন্দ্রিয় আইন্ সভা থাকতে হবে
house of unit আইন সভার unit গুলোর প্রতিনিধিত্ব করবে
house of people জনগন দ্বারা নির্বাচিত হবে।

৩১- প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব
বেলুচিস্তান সহ সকল প্রদেশ গুলোর house of unit এ সমান প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।

৩২- কেন্দ্রিয়প্রশাসনিক এলাকার প্রতিনিধিত্ব
যদিও কেন্দ্রিয় প্রশাসনিক এলাকা গুলো house of unit এ প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেনা , কারন সেগুলো কোনো প্রদেশ নয়। কিন্তু কমিটি তাদের সুপারিশ করে House of people এ প্রদেশ হিসাবে প্রতিনিধিত্ব করতে।

৩৩- মেম্বার দের অযোগ্যতা –
কোনো মেম্বার ই একসাথে-
-কেন্দ্রিয় আইন সভার দুই হাউজ এর ই সদস্য হতে পারবেনা
– একি সাথে কেন্দ্রিয় আইন সভা ও প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য হতে পারবেনা।
৩৪- কেন্দ্রিয় আইন্সভার স্থায়িত্ব
-কেন্দ্রিয় আইন্ সভার স্থায়িত্ব হবে ৫ বছর।

35- কেন্দ্রিয় আইন সভার সমন জারি
রাষ্ট্রের প্রধান কেন্দ্রিয় আইন সভায় সমন জারি করবে।
– বছরে দুইটির বেশি সভা হতে পারবেনা এবং দুইটি সভার মধ্যবর্তী সময়ের পার্থক্য হবে ৬ মাস।
-প্রধান মন্ত্রি নিয়োগ পাওয়ার ৩ মাসের মধ্যেই একটি সেশান অনুষ্ঠিত হতে হবে।

৩৬- কেন্দ্রিয় আইন্সভার যৌথ সেশান-
রাষ্ট্র প্রধানের নির্দেশ অনুযায়ি নিম্নোক্ত কারন গুলো থাকলে জয়েন্ট সেশান হতে পারবে
-আইন সভার মধ্যে কোনো রকম দন্দ থাকলে ,
– নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন রাশট্র প্রধান মনোনীত করা হলে।
– টাকা পয়সা সংক্রান্ত কোনো বিষয় হলে
– মন্ত্রী সভায় অনাস্থা সৃষ্টি হলে

<001.046.177>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

৩৭- কেন্দ্রিয় আইন সভা স্থগীত করন-
রাষ্ট্র প্রধানের নির্দেশে কোনো বিশেষ কারনে আইন সভা স্থগীত হতে পারে।

৩৮-কেন্দ্রিয় আইন সভার বিভক্তি-
-প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কেন্দ্রিয় আইন সভার বিভক্তি সম্ভব।
– তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্দেশে কোনো বিভক্তি হতে পারবেনা।
– কোনো জরুরী অবস্থার সৃষ্টি হলে রাষ্ট্র প্রশানের অধীনে কেন্দ্রিয় আইন সভা বিভক্ত হতে পারে এবং পূনরায় নির্বাচন হতে পারে।

৩৯- দুই হাউজ এর ক্ষমতা ও মধ্যকার দন্দ –

কেন্দ্রিয় আইন সভার দুই হাউজ এর ক্ষমতা এক সমান হতে হবে।তাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে একটি যৌথ সেশান এর মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে পোউছাতে হবে।
বাজেট ও টাকা পয়সার যেকোনো ব্যাপার দুই হাউজ এর মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে নিতে হবে।

৪০- কেন্দ্রিয় আইন্সভায় মন্ত্রী ও আইঞ্জীবিদের অধিকার
কোনো হাউজ এর মেম্বার না হলেও মন্ত্রী ও আইনজীবীদের দুইটি হাউজ এর উপর ই অধিকার আছে। কিন্তু আইনজীবীদের ভোট দেয়ার অধিকার নেই।
কোনো মন্ত্রী যে হাউজ এর মেম্বার না, তিনি সেখানে ভোট দিতে পারবেন না।

৪১- কেন্দ্রিয় আইন সভার চেয়ারমেন ও ডেপুটি চেয়ারম্যান
প্রতিটি হাউজ এর একটি চেয়ারমেন ও ডেপুটি চেয়ারম্যান থাকবে
সংবিধানে চেয়ারমেন ও ডেপুটি চেয়ারম্যান কে নির্বাচিত করার নিয়মাবলি থাকবে।
-কেন্দ্রিয় আইন সভার প্রতিটি হাউজ একজন করে চেয়ারমেন ও ডেপুটি চেয়ারমেন নির্বাচিত করবে। তাদের এই পদ খালি হয়ে গেলে তখন অন্য দুজন কে পূনরায় নির্বাচিত করা হবে।
– চেয়ারমেন বা ডেপুটি চেয়ারম্যান তাদের পদ থেকে সরে যাওয়া মাত্র রাষ্ট্র প্রধান বরাবর একটি চিঠি লেখার মাধ্যমে তার অফিস খালি করে দিতে হবে।

<001.046.178>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

– চেয়ারম্যান এর অফিস যখন খালি থাকবে, অফিসের দায়িত্ব তখন ডেপুটি চেয়ারম্যান পালন করবে। আর ডেপুটি চেয়ারম্যান এর পদ ও খালি থাকলে রাষ্ট্র প্রধান সেই দায়িত্ব পালন করবে। কোনো সভায় যদি চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকে তাহলে ডেপুটি চেয়ারম্যান সেই দায়িত্ব পালিন করবে। তিনিও অনুপ্সথিত থাকলে হাউজ এর অন্য কোনো দায়িত্তব বান ব্যাক্তি এই দায়িত্ত পালন করবে।

– ডেপুটি চেয়ারম্যান এর অফিস এও একই নিয়ম পালন করা হবে। হাউজ এর চেয়ারমেন এর দায়িত্ব পালন কালে ডেপুটি চেয়ারম্যান ও প্রিজাইডিং অফিসারের ক্ষমতা সমান হবে। চেয়ারম্যান থেকে ডেপুটি চেয়ারম্যান এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপ্রেও কিছু নীতিমালা থাকতে হবে।

-জয়েন্ট সেশানে হাউজ অফ ইউনিট এর চেয়ারম্যান প্রতিনিধিত্ব করবে। উনার অনুপস্থিতে হাউজ অফ পিপল এর চেয়ারম্যন প্রতিনিধিত্ব করবে।দুইজন ই অনুপ্সথিত থাকলে কোনো যোগ্য ব্যাক্তি প্রতিনিধিত্ব করবে।

 

  1. The Secretariat of the Central Legislature

The Committee unanimously held the view that the Secretariat of each of the Houses

of the Central Legislature should be absolutely independent and should be under the

House as such. Also there was unanimity on the point that the Finance Committee of

each House should scrutinize all the financial proposals relating to the expenditure of its

respective House and thereafter the Budget should be presented to the House.

The Chairman of each House should be the Chairman and the Finance Minister as ex

officio Member of its Finance Committee; the Finance Committee of each House should

exercise similar power of control and direction in matters relating to the finances of each

House of the Central Legislature as are exercised by the Standing Finance Committee

with regard to Government expenditure.

In view of the special nature of the work rules should be framed by the Finance

Committee to secure to itself closer contact and effective voice in regulating the finances

of the House to which it relates.

  1. Oath to Members: Failure or Refusal to take Oath

The Members of the Central Legislature should be required to take an oath of

allegiance. No Member should take his seat in the House as long as he has not taken the

prescribed oath.

<001.046.179>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

বিধান এমন রাখা উচিত যেখানে আইনসভায় যোগদানের সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে একজন মেম্বার ব্যর্থ হলে, প্রত্যাখ্যান করলে অথবা শপথ করতে অস্বীকৃতি জানালে তার পদ খালি ঘোষণা করা হবে। যদিও ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও বিশেষ বিবেচনায় চেয়ারম্যান সেটা বাড়াতে পারবেন।

৪৪. ইন হাউজ ভোটিং এবং কোরাম

প্রদেশের প্রধান কে অপসারণের মত বিশেষ পরিস্থিতি ব্যতিত কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রতিটি সিদ্ধান্ত হাউজ সম্পর্কিত বিধি অনুসারে নিতে হবে। যে কোন আইনসভার প্রিজাইডিং অফিসার কোন ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না যদি না ভোটের ফলাফল সমান সমান হয়। আইনসভায় যদি একটি খালি পদ থেকেও থাকে, তার ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি নিজেদের গতানুগতিক কাজ চালিয়ে যাওয়া জরুরী।

প্রতি হাউজের কোরাম মিটিং অথবা দুইটি হাউজের যৌথ মিটিং এ মোট মেম্বারের অন্তত সাত ভাগের এক ভাগ অংশগ্রহণ করা জরুরী।

৪৫. প্রদেশের প্রধান কর্তৃক প্রদত্ত অধ্যাদেশ

আইনসভার দুই মিটিং এর মধ্যবর্তী সময়ে প্রাদেশিক প্রধান কর্তৃক অধ্যাদেশ প্রণয়ন করতে পারেন। এক্ষেত্রে অবশ্য কার্যক্রম ভেদে পরিবর্তন হতে পারে।

৪৬. উভয় হাউজের মধ্যবর্তী আলোচনা

দুই হাউজের মধ্যবর্তী আলোচনার নিয়মনীতি নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নেয়া হবে।

৪৭. বিল প্রণয়নে সম্মতি

(ক) যখন কেন্দ্রীয় আইনসভা কর্তৃক একটি বিল পাস হবে তখন সেটি প্রাদেশিক প্রধানের কাছে নিতে হবে তার সম্মতির জন্য।

(খ) প্রাদেশিক প্রধানের কাছে বিল প্রদানের ৯০ দিনের মধ্যে তিনি তার সম্মতি প্রদান কিংবা কোন ধরণের সম্মতি প্রদান ছাড়াই বিল আইনসভার কাছে ফেরত পাঠাতে পারবেন। যদি আইনসভা আবারও বিলটি পাশ করতে পারে তাহলে এক্ষেত্রে প্রাদেশিক প্রধান সম্মতি প্রদানের জন্য ৩০ দিন পাবেন।

(গ) আর্থিক বিলের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক প্রধান তিন দিনের মধ্যে বিলে সম্মতি প্রদান কিংবা ফেরত পাঠাতে পারবেন। যদি হাউজ সেটি আবার ফেরত পাঠায় তাহলে পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে সম্মতি প্রদান করতে হবে।

৪৮. বার্ষিক আর্থিক বিবরণ

প্রাদেশিক প্রধানের কাছ থেকে বার্ষিক আর্থিক বিবরণ প্রণয়নের জন্য কোন আনুষ্ঠানিক সুপারিশের প্রয়োজন নেই। এই ধরণের প্রস্তাব আইনসভার কাছে সরকারের পক্ষে থেকে একবারই উত্থাপন করা হবে।

<001.046.180>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

৪৯. বাজেট

উক্ত ব্যাপারে কমিটি সুপারিশ করে যে বাজেট এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা প্রথমে যৌথ আইনসভার কাছে প্রদান করা জরুরী। এছাড়াও কমিটি আরো সুপারিশ করে যে বাজেট ও অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা গুলো আইনসভারর কাছে উত্থাপন, পাশ ও বাস্তবায়নের ব্যাপারে বিশেষ কার্য পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরী।

৫০. ব্যয় তফসিল যাচাই করণ

প্রাদেশিক প্রধান ব্যয় তফসিলের তথ্য যাচাই ও বাছাই করবেন।

৫১. কার্যপদ্ধতির নিয়ম

প্রতিটি হাউজেরই নিজেদের কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য কিছু নিয়ম নীতি প্রণয়ন জরুরী। গতানুগতিক নিয়ম পরিবর্তন করে তার উপর নতুন নিয়ম বর্তানো প্রয়োজন। এই ধরণের পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ জরুরী।

একাউন্টের হিসাব নিরীক্ষণ এবং এর জন্য হিসাব নিরীক্ষক নিয়োগ প্রদান

৫২. পাকিস্তানের প্রধান হিসাব নিরীক্ষক

নতুন অনুশাসন অনুযায়ী নিম্নোক্ত বিধানগুলো প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরী –

(ক) পাকিস্তানের একজন প্রধান হিসাব নিরীক্ষক প্রয়োজন যাকে প্রাদেশিক প্রধান নিয়োগ দেবেন এবং ফেডেরাল কোর্টের বিচারক তাকে বরখাস্ত করতে পারবেন।

(খ) প্রধান নিরীক্ষকের দায়িত্ব হবে প্রাদেশিক প্রধান কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসারে দায়িত্ব পালন। এবং দায়িত্ব শেষে তিনি তার অফিস এবং পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য। যদিও বলে রাখা ভালো কোন কারণে ছুটিতে গেলে বা অবসর গ্রহণ করলে তার বেতন এবং অন্যান্য সুবিধার কোন পরিবর্তন হবে না।

(গ) প্রধান হিসাব নিরীক্ষক নিজের দায়িত্ব এবং ক্ষমতা এমন ভাবে ব্যবহার করবেন যাতে তা প্রাদেশিক প্রধানের নির্দেশনা কিংবা কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রণয়নকৃত অধ্যাদেশ মেনে চলে। বলে রাখা ভালো যে কোন বিল বা সংশোধনীর ব্যাপারে প্রাদেশিক প্রধানের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা অনুসারে কাজ চলবে।

(ঘ) প্রধান হিসাব নিরীক্ষকের বেতন, অন্যান্য খরচ ও ভাতা সরকারী রাজস্ব থেকে ব্যয় করা হবে। তবে তার সাথে কাজ করছে এমন সদস্যদের বেতন, খরচ ও ভাতা সরকারী রাজস্বের বাইরে থেকে খরচ করতে হবে।

<001.046.181>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

৫৫. প্রাদেশিক হিসাব নিরীক্ষক

একজন প্রাদেশিক হিসাব নিরীক্ষকের নিয়োগ প্রদান ও বরখাস্ত করণ যারা প্রধান হিসাব নিরীক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন তাদের মাধ্যমেই করা হবে।

(ক) প্রতি দশ বছর পর প্রাদেশিক আইনসভা তাদের হিসাব নিরীক্ষক এর বেতন ভাতার পরিমাণ পরিবর্তন করতে পারবেন যা কিনা প্রাদেশিক রাজস্ব থেকে ব্যয় হবে। একজন প্রাদেশিক হিসাব নিরীক্ষক প্রাদেশিক প্রধান কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, যার কাজ হবে প্রদেশের হয়ে প্রধান হিসাব নিরীক্ষকের মত একই দায়িত্ব পালন ও ক্ষমতার ব্যবহার করণ করা।

(খ) পাকিস্তানের প্রধান হিসাব নিরীক্ষকের ব্যাপারে যে সকল বিধান থাকবে তা প্রাদেশিক হিসাব নিরীক্ষকের প্রতিও বর্তাবে।

(খ-১) একজন ব্যক্তি যিনি পূর্বে প্রাদেশিক হিসাব নিরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি পাকিস্তানের প্রধান হিসাব রক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার যোগ্য।

(খ-২) প্রধান হিসাব নিরীক্ষক সম্পর্কিত (খ) এবং (গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রধান হিসাব নিরীক্ষকের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় আইনসভার যে বিধান তা প্রাদেশিক আইনসভার বিধান দ্বারা পরিবর্তিত হবে প্রাদেশিক হিসাব রক্ষকের ক্ষেত্রে। এবং একই ভাবে প্রধান হিসাব নিরীক্ষকের জন্য প্রাদেশিক প্রধানের যে অধ্যাদেশ তা প্রাদেশিক হিসাব নিরীক্ষকের ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হবে।

(খ-৩) প্রধান হিসাব নিরীক্ষক সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ (ঘ) প্রধান হিসাব নিরীক্ষকের বেতন ভাতার ব্যাপারে সরকারী রাজস্বের বিষয়টি প্রাদেশিক হিসাব নিরীক্ষকের ব্যাপারে প্রাদেশিক রাজস্বে পরিবর্তিত হবে।

৫৪. একাউন্ট নির্দেশনার জন্য প্রধান হিসাব নিরীক্ষকের ক্ষমতা

সরকারী হিসাব একাউন্ট গুলো এমনভাবে পরিচালনা করা উচিত যাতে প্রধান হিসাব রক্ষক চাইলে প্রাদেশিক প্রধানের অনুমতি ক্রমে পরামর্শ, পরিচালনা ও নির্দেশনা দিতে পারেন। এবং সেই হিসেবে সকল প্রাদেশিক সরকারের উচিত নিজেদের হিসাব একাউন্ট গুলো জমা রাখা।

৫৫. নিরীক্ষণ রিপোর্ট

পাকিস্তানের প্রধান নিরীক্ষক হিসাব একাউন্ট সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট প্রাদেশিক প্রধানের কাছে প্রদান করবেন যিনি কিনা সেটি কেন্দ্রীয় আইনসভার কাছে পাঠাবেন। অন্যদিকে প্রধান হিসাব নিরীক্ষক এর মত প্রাদেশিক হিসাব নিরীক্ষকের একাউন্ট সম্পর্কিত রিপোর্ট প্রাদেশিক প্রধানের কাছে পাঠানো হবে যেটি কিনা প্রাদেশিক আইনসভার কাছে হস্তান্তর করা হবে।

<001.046.182>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

চতুর্থ ভাগ

প্রদেশ সমূহ

প্রথম অধ্যায়

নির্বাহী বিভাগ

৫৬। প্রদেশের নেতৃবৃন্দ
প্রতিটি প্রদেশ জন্য প্রদেশের একটি হেড হওয়া উচিত।

৫৭। প্রদেশের নির্বাহী ক্ষমতা

প্রদেশের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানের পক্ষ থেকে এবং সংবিধান ও আইন অনুযায়ী প্রয়োগ করা উচিত।

শুধুমাত্র যেসব   প্রেক্ষাপট   ব্যতীত  যেখানে প্রদেশের প্রধান তার বিচক্ষণতা অনুযায়ী  পদক্ষেপ নিবেন  এবং যদি প্রেক্ষাপটে বিপরীত কিছু উল্লেখিত  না থাকে , “প্রদেশের প্রধান’’  এর  অর্থ ‘ মন্ত্রনালয় অর্পিত দায়িত্বে ভারপ্রাপ্ত প্রদেশ প্রধান’

যে সব  ক্ষেত্রে প্রদেশের প্রধান তার বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে মন্ত্রীদের বরখাস্ত  এবং নিয়োগ দেবেন , তিনি যেন  রাষ্ট্র প্রধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, পরিচালিত ও তত্তাবধিত হন।

৫৮। প্রদেশের প্রধান নিয়োগ
প্রদেশের প্রধান রাষ্ট্রের প্রধান দ্বারা নিযুক্ত করা উচিত।

৫৯। রাষ্ট্র প্রধানের কার্যদিবস
প্রদেশের প্রধানকে রাষ্ট্র প্রধান দ্বারা নির্ধারিত  সময়ে পদে বহাল থাকা উচিৎ

৬০। প্রদেশ প্রধানের শপথ
প্রদেশের প্রধানকে স্ব স্ব পদের প্রতি আনুগত্য ও প্রয়োজনীয় গোপনীয়তা রক্ষার শপথ নিতে হবে।

৬১। নির্দিষ্ট কিছু সম্ভাব্য ঘটনার  প্রেক্ষিতে প্রদেশের প্রধানের এর কার্যাবলী

নির্দিষ্ট সম্ভাব্য অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রদেশ প্রধানেকে  সংবিধানে অনুপস্থিত কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য   প্রাদেশিক আইন সভার সাহায্যে  ক্ষমতা  প্রদত্ত করা উচিত  ।

৬২  ক্ষমা প্রদান, শাস্তি রদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রদেশের প্রধানের ক্ষমতা
ক্ষমা, সাময়িক উপশম, ইত্যাদি দান করার    ক্ষমতা    প্রদেশের প্রধানের বিবেচনার ভিত্তিতে  প্রয়োগযোগ্য।

(মাননীয় খান আবদুল কাইয়ুম খানে ভিন্ন মত পোষণ করেন  )

৬৩। প্রদেশ প্রধানের ক্ষমতা গ্রহন
জরুরী অবস্থায় প্রদেশের প্রধানের রাষ্ট্র প্রধানের সমমান ক্ষমতা থাকা উচিত, কিন্তু সেই ক্ষমতা শুধুমাত্র  রাষ্ট্র প্রধানের দিকনির্দেশনা ছাড়া প্রয়োগযোগ্য হবে না।

<001.046.183>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

৬৪।  প্রদেশ প্রধানের    বিশেষ ও সাধারন ক্ষমতা

প্রদেশের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান   প্রদেশের প্রধানের  একটি বিশেষ দায়িত্ব হওয়া উচিত এবং  সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করার ক্ষমতা প্রদান করা উচিত।
নির্বাচন ট্রাইব্যুনাল নিয়োগে প্রদেশের প্রধানের এর বিচক্ষণতার উপর ন্যাস্ত করা উচিত।

৬৫। প্রদেশ প্রধানের নিরাপত্তা
(১) প্ক্ষমতার প্রয়োগ বা কার্যক্রমের জন্য প্রদেশ প্রধানকে আদালতে জবাবদিহিতা করতে হবে না।

(২) প্রদেশের প্রধান যতদিন সে পদে অধিষ্ঠিত থাকেন, ততদিন তার বিরুদ্ধে  কোন ফৌজদারী কার্যধারা পরিচালিত হবে না।

(৩) প্রদেশের প্রধান   যতদিন উক্ত পদে অধিষ্ঠিত আছে ততদিন গ্রেফতার, জেল বা কারাভোগের  জন্য কোন ধরনের প্রক্রিয়া আদালত থেকে অনুমোদিত হবে না।

(৪)  প্রদেশ প্রধানের  মেয়াদকালে কিংবা তার পূর্বের কর্মকাণ্ডের সময় ব্যক্তিগত ক্ষমতার ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে চাইলে  তা বিচারকার্য প্রকৃতি, মামলার কারণ, নাম, বিবরণ  উল্লেখিত নোটিশের প্রদানের  ৬০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত শুরু করা যাবে না।

৬৬।  প্রদেশ প্রধান কে সাহায্য ও পরামর্শ প্রদানের জন্য মন্ত্রী পরিষদ
প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা  প্রাপ্ত  কোন ব্যাক্তিকেই একটি প্রদেশের প্রধান মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে প্রদেশ প্রধান নিয়োগ দিতে পারে।

 প্রদেশ প্রধানের মুখ্যমন্ত্রী পরামর্শক্রমে  অন্যান্য মন্ত্রীবর্গ নিযুক্ত করা উচিত।

মন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত বিষয়ক সিদ্ধান্ত গুলো নেয়ার সময় প্রদেশের প্রধানকে  রাষ্ট্র প্রধানের তত্ত্বাবধায়নে  কাজ করা উচিত।

৬৭। মন্ত্রীদের শপথ
প্রদেশের মন্ত্রীবর্গ ক্ষমতায়   থাকাকালীন  সময়ের জন্য আনুগত্য প্রদর্শন ও গোপনীয়তা রক্ষার  শপথ নেবে।

৬৮।  প্রাদেশিক আইনসভায় মন্ত্রীদের যৌথ দায়িত্ব

 প্রাদেশিক মন্ত্রীবর্গ যৌথভাবে তাদের নিজ নিজ আইনসভার দায়ভার গ্রহন করবে।

<001.046.184>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

৬৯।  আইনানুসারে মন্ত্রীদের  নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিরাপত্তা

প্রদেশের প্রধান যদি কোন মন্ত্রী  নিয়োগ কিংবা চাকরীচ্যুত  করে থাকেন, এ বিষয়ে  আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

 ৭০। প্রাদেশিক সরকারের কার্যক্রম
প্রদেশের সরকারি কার্যচালনার নিয়ম প্রণয়নের  জন্য প্রদেশ প্রধানের  সাংবিধানিক সংযোজন  করা উচিত।

৭১।  প্রদেশ প্রধানকে তথ্য সরবরাহে মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব

 মন্ত্রী  পরিষদ প্রদেশের প্রধানকে  সকল সিদ্ধান্ত এবং আইন প্রণয়নের প্রস্তাব সম্পর্কে  অবহিত রাখবে।   এছাড়াও প্রদেশের প্রধানকে  প্রদেশের প্রশাসনিক বিষয়াবলি ও কার্যক্রম  এবং আইন গঠনের প্রস্তা সংক্রান্ত তথ্য দেয়া উচিৎ ।

প্রাদেশিক অ্যাডভোকেট জেনারেল

৭২।  প্রাদেশিক অ্যাডভোকেট জেনারেলরা

একটি প্রদেশের অ্যাডভোকেট জেনারেল প্রদেশের প্রধান দ্বারা নিযুক্ত হবেন  ।সেই ব্যক্তির হাইকোর্টের একজন বিচারক হবার যোগ্যতা  থাকা অত্যাবশ্যক । কোন বয়স সীমা থাকবে না।

প্রাদেশিক আইনসভা

৭৩প্রাদেশিক আইনসভা এর সংবিধান
প্রতিটি প্রদেশে  এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা  জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে।

৭৪। প্রাদেশিক আইনসভার মেয়াদকাল
একটি প্রাদেশিক আইনসভা পাঁচ বছর পর্যন্ত বহাল থাকবে।

৭৫। প্রদেশিক আইনসভা তলব
(১) প্রদেশের প্রধান মন্ত্রিপরিষদ পরামর্শে প্রাদেশিক আইনসভা তলব করা উচিত.
(২) প্রতি বছর নুন্যতম দুইটি সেশন অনুষ্ঠিত হবে গত অধিবেশনের শেষ দিন এবং পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম দিন মধ্যবর্তী সময় ছয় মাসের অধিক হবে না।
(৩) প্রাদেশিক আইনসভার অধিবেশন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগের তারিখ হইতে তিন মাসের  মধ্যে ডাকতে হবে ।
৭৬। প্রাদেশিক আইনসভা এর  ব্যাক্ষেপ
প্রাদেশিক আইনসভা প্রদেশের প্রধান আদেশ দ্বারা স্থগিত হবে।

<001.046.185>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

৭৭. প্রাদেশিক আইনসভা ভঙ্গ

       (১) প্রথমবার আইনসভা প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ভঙ্গ হবে।

       (২) প্রাদেশিক আইন সভা ভঙ্গের তারিখ এবং সদ্য নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের মধ্যবর্তী সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্দেশে কোন আইনসভা ভঙ্গ হবে না।

       (৩) যদি এমন কোন আকস্মিক ঘটনা ঘটে যখন আইনসভা গঠনের মত কোন আস্থাভাজন মন্ত্রনালয় না থাকে, তখন প্রদেশের প্রধানকে তার জরুরী ক্ষমতার বলে আইনসভা ভঙ্গের এবং নির্বাচন সংগঠনের ক্ষমতা দেওয়া হবে।

৭৮. প্রাদেশিক আইনসভা  অনুযায়ী মন্ত্রীদের এবং অ্যাডভোকেট জেনারেলের অধিকার

       (১) আইনসভার সদস্য নয় এমন একজনকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিধান থাকবে, তবে শর্ত থাকে যে সেই ব্যক্তির মন্ত্রীত্ব স্থগিত করা হবে যদি না তিনি তার নিয়োগের দিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচিত হন।

       (২) মন্ত্রী ও প্রদেশের অ্যাডভোকেট জেনারেলের প্রাদেশিক আইনসভায় বক্তব্য দেওয়ার অধিকার থাকা উচিত, যদিও বা তারা আইনসভার সদস্য না হন। অ্যাডভোকেট জেনারেলের ভোট দেওয়ার কোন অধিকার থাকবে না যেহেতু তিনি আইনসভার সদস্য হবেন না। এমন কোন মন্ত্রী, যিনি আইনসভার সদস্য নন তারও ভোট দেওয়ার কোন অধিকার থাকবে না।

৭৯. প্রাদেশিক আইনসভার চেয়ারম্যান ডেপুটি চেয়ারম্যান

       নিম্ন লিখিত পদ্ধতি অনুযায়ী আইনসভার একজন চেয়ারম্যান ও একজন ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিধান থাকা উচিতঃ

       (১) প্রত্যেক আইনসভার উচিত, যত দ্রুত সম্ভব আইনসভার দুইজন সদস্যকে চেয়ারম্যান ও ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা এবং ঘটনা অনুযায়ী যখনি চেয়ারম্যান বা ডেপুটি চেয়ারম্যানের পদ খালি হবে, আইনসভা অন্য একজন সদস্যকে চেয়ারম্যান বা ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করবে।

       (২) একজন সদস্য যিনি কোন আইনসভার চেয়ারম্যান বা ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে আছেন, তিনি  তার পদ ত্যাগ করবেন যদি তিনি আইনসভার সদস্যপদ ত্যাগ করেন এবং যেকোন সময় প্রদেশ প্রধানের উদ্দেশ্যে স্বহস্তে লিখিত পত্রের মাধ্যমে ইস্তফা দিতে পারেন ও আইনসভার অধিকাংশ সদস্য কর্তৃক গৃহীত কোন রেজল্যুশনের মাধ্যমে তার পদ থেকে অপসারিত হতে পারেন কিন্তু এই উপ-অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যে কোন রেজল্যুশন উত্থাপিত হবে না যদি না রেজল্যুশন উত্থাপনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্তত চৌদ্দ দিনের নোটিশ দেওয়া হয়।

       শর্ত থাকে যে, যখনি আইনসভা ভঙ্গ হবে, আইনসভা ভঙ্গের পর অবিলম্বে আইনসভার প্রথম মিটিংয়ের পুর্বে চেয়ারম্যান তার পদ ত্যাগ করতে পারবেন না।

<001.046.186>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

(৩) যখন চেয়ারম্যানের পদ খালি হবে, সেই পদের দায়িত্ব গুলো ডেপুটি চেয়ারম্যান পালন করবেন, অথবা যদি ডেপুটি চেয়ারম্যানের পদও খালি থাকে তাহলে প্রদেশের প্রধান এই উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক আইনসভার যে সদস্যকে নিয়োগ দিবেন তিনি এই দায়িত্ব পালন করবেন। প্রাদেশিক আইনসভার কোন অধিবেশনে চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে, ডেপুটি চেয়ারম্যান বা যদি তিনিও অনুপস্থিত থাকেন সেক্ষেত্রে আইনসভার কার্যপ্রনালীর বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত একজন ব্যক্তি অথবা যদি এমন কেউ উপস্থিত না থাকেন তাহলে প্রাদেশিক আইনসভা কর্তৃক নির্ধারিত অন্য কেউ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

৮০. আইনসভার দপ্তর

       প্রাদেশিক আইনসভার দপ্তর সম্পুর্নভাবে স্বাধীন হবে এবং আইনসভার নিজস্ব অধীনে থাকবে। আইনসভার অর্থ কমিটি আইনসভার ব্যয় সংক্রান্ত সকল প্রস্তাব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে নিরীক্ষন করবে এবং এরপর আইনসভায় বাজেট উত্থাপন করা হবে।

       প্রাদেশিক আইনসভার চেয়ারম্যান হবেন চেয়ারম্যান এবং প্রদেশের অর্থমন্ত্রী, অর্থ কমিটির একজন প্রাক্তন সদস্য। আইনসভার অর্থ কমিটি প্রাদেশিক আইনসভার আর্থিক বিষয়াবলি নিয়ন্ত্রন ও নির্দেশনায় একই ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগ করবে যেমনটা সরকারি ব্যয় সম্পর্কে প্রাদেশিক আইনসভার বর্তমান অর্থ কমিটি কর্তৃক ব্যবহৃত হয়েছে।

       কাজের বিশেষ ধরনের প্রেক্ষিতে অর্থ কমিটির উচিত এর ঘনিষ্ট যোগাযোগ এবং আইনসভার অর্থায়নের নিয়ন্ত্রনে কার্জকর সত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিধান তৈরী করা।

৮১. সদস্যদের শপথ

       আইনসভার সদস্যদের আনুগত্যের একটি শপথ নিতে হবে। যতক্ষন পর্যন্ত না কোন সদস্য তার যথাবিহিত শপথ গ্রহন করবেন, তিনি আইনসভায় তার আসন গ্রহন করতে পারবেন না। আইন করা হবে যে, যে ক্ষেত্রে একজন সদস্য আইনসভার প্রথম মিটিংয়ের তারিখ হতে অনধিক ছয় মাসের মধ্যে আনুগত্যের শপথ নিতে ব্যর্থ হন বা প্রত্যাখ্যান করেন অথবা অপারগ হন সেক্ষেত্রে তার আসনটি শুন্য ঘোষণা করা হবে। শর্ত থাকে যে, উপরে উল্লেখিত সময়সীমা অতিক্রান্তের পুর্বে  চেয়ারম্যান কোন উপযুক্ত কারন দর্শানো ছাড়াই সময়সীমা বাড়াতে পারেন।

৮২. ভোটদান এবং কোরাম

       যে সকল ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আছে, সেগুলো ছাড়া প্রাদেশিক আইনসভার সকল সিদ্ধান্ত উক্ত প্রাদেশিক আইনসভা কর্তৃক প্রনীত নিয়ম অনুযায়ী নেওয়া হবে। সমান সমান ভোটের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক আইনসভার প্রিজাইডিং অফিসার নির্ধারিত ভোট ছাড়া আর কোন ভোট পরিচালনা করবে না। প্রাদেশিক আইনসভাকে এর দায়িত্ব পরিচালনার জন্য অভিহিত করা উচিত যদিও সেখানে একটি পদ খালি থাকে এবং সেই হিসেবে সভার কার্যধারা বাতিল হবে না।

       প্রাদেশিক আইনসভার একটি মিটিংয়ের জন্য কোরাম হবে প্রাদেশিক আইনসভার মোট সদস্য সংখ্যার সাত ভাগের এক ভাগ।

<001.046.187>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

৮৩. প্রাদেশিক আইনসভা এবং এর সদস্য ও কমিটির ক্ষমতা, বিশেষ সুবিধা ও নিরাপত্তা।

       প্রাদেশিক আইনসভাকে সভার কার্যপরিচালনার স্থায়ী আদেশ ও বিধানের সাপেক্ষে এর সদস্যদের বিশেষ সুবিধা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে  আইন জারি করার জন্য অভিহিত করা উচিত। বাক স্বাধীনতা এবং যেকোন কিছুর ভিত্তিতে কোন কোর্টে চলা কার্যধারা থেকে নিরাপত্তা বা প্রাদেশিক আইনসভার একজন সদস্যের দেওয়া কোন ভোট অথবা তার বদলে একটি কমিটি দিতে হবে এবং প্রাদেশিক আইনসভা কর্তৃক বা তাদের অধীনে প্রকাশনার কোন রিপোর্ট, কাগজ, ভোট বা কার্যধারার জন্য কোন ব্যক্তি দায়ী হবে না। একই ধরনের সুবিধা তারাও পাবেন যারা যদিও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নন কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী প্রাদেশিক আইনসভা এবং এর কমিটির কার্যধারায় উপস্থিত থাকা, বক্তব্য দেওয়া এবং অংশগ্রহন করার জন্য অনুমতি প্রাপ্ত।

       এই জাতীয় বিষয়াবলি সংক্রান্ত আইন পাশকে অমীমাংসিত রেখে, যুক্ত রাজ্যের হাউস অফ কমন্স এর সদস্যগণ যে সকল সুবিধা ও নিরাপত্তা পান, আইনসভার সদস্যগণও সেগুলো ভোগ করবেন।

৮৪. বিলের অনুমোদন

       প্রাদেশিক আইনসভা কর্তৃক পাশ করা বিল প্রদেশ প্রধানের কাছে উপস্থাপন করতে হবে এবং প্রদেশ প্রধান হয় ঘোষণা দেবেন যে তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের নামে বিলের অনুমোদন দিচ্ছেন অথবা তিনি সেখানেই বিলের অনুমোদন নাকচ করছেন বা তিনি রাষ্ট্র প্রধানের বিবেচনার জন্য বিলটি সংরক্ষন করছেন।

       যখন প্রদেশ প্রধান রাষ্ট্র প্রধানের বিবেচনার জন্য কোন বিল সংরক্ষন করেন, তখন রাষ্ট্র প্রধান ঘোষণা দেবেন যে হয় তিনি বিলটির অনুমোদন দিচ্ছেন বা অনুমোদন নাকচ করছেন, শর্ত থাকে যে, রাষ্ট্র প্রধান যদি উপযুক্ত মনে করেন তবে তিনি প্রদেশ প্রধানকে একটি বার্তা সহ প্রাদেশিক আইনসভাকে বিলটি ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন, যখন একটি বিল এভাবে ফেরত আসবে, প্রাদেশিক আইনসভা সেই অনুযায়ী সেটাকে পুনর্বিবেচনা করবে এবং যদি সেটা সংশোধন করে বা সংশোধন ছাড়া আবারো প্রাদেশিক আইনসভা কর্তৃক পাশ হয়, তাহলে সেটা আবারো রাষ্ট্র প্রধানের বিবেচনার জন্য তার কাছে উপস্থাপন করতে হবে।

       শর্ত থাকে যে, যদি রাষ্ট্র প্রধান মনে করেন যে তার অনুমোদন দেওয়া উচিত না কারন বিষয়টিতে কেন্দ্রীয় আইন সভার প্রয়োজন আছে তাহলে তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভার পরবর্তী অধিবেশনে উক্ত আইন পাশ না হওয়া পর্যন্ত তার অনুমোদন স্থগিত করতে পারবেন।

       আর্থিক বিলের ক্ষেত্রে প্রদেশ প্রধান হয় অনুমোদন দেবেন অথবা তিন দিনের মধ্যে তা পুনর্বিবেচনার জন্য প্রাদেশিক আইনসভায় ফেরত পাঠাবেন। যদি প্রাদেশিক আইনসভা সেগুলো আবার পাঠায় তবে তাকে তিন দিনের মধ্যে অনুমোদন দিতে হবে।

<001.046.188>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

৮৫. বার্ষক আর্থিক বিবৃতি

                সেখানে বিভাগীয় প্রধানের বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি সংক্রান্ত কোন আনুষ্ঠানিক সুপারিশ থাকা উচিত নয়। এই রকম প্রস্তাব শুধুমাত্র জরুরী অবস্থায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে প্রাদেশিক আইন সভায় উপস্থাপন করা উচিত।

৮৬. ব্যয় তফসিলের যথার্থতা

                বিভাগীয় প্রধানের উচিত ব্যয় তফসিলের যথার্থতা নিশ্চিত করা।

৮৭. কার্যপ্রক্রিয়ার বিধিনিষেধ

                প্রত্যেক প্রাদেশিক আইন সভার উচিত তার ব্যবসায়িক লেনদেনে জন্য নিজস্ব নিয়মকানুন নির্ধারন করা। নতুন নিয়ম তৈরী স্থগিত রেখে, প্রচলিত নিয়ম গুলোকেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা উচিত। এই ধরনের পরিবর্তনকে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা উচিত। এছাড়াও বর্তমান শাসনতন্ত্রের অধীনে, কোন আইন সভা নেই এমন কোন বিভাগের কোন প্রতিষ্ঠানের কার্যপ্রনালীর নিয়ম কানুন তৈরীর ক্ষেত্রেও এই মেশিন গুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

৮৮. প্রাদেশিক আইন্সভার অবকাশকালে বিভাগীয় প্রধানের অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতা

                বিধান, প্রাদেশিক আইনসভার অবকাশকালে বিভাগীয় প্রধানকে অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতা দাওয়ার জন্য তৈরী করা হবে, কিন্তু এই ক্ষমতাগুলো রাষ্ট্র প্রধানের নির্দেশ অনুযায়ী ও তার নিয়ন্ত্রনে প্রয়োগ করতে হবে। অধ্যাদেশের কার্যাবলী সীমাবদ্ধ করার জন্য কিছু সময়সীমা বেধে দাওয়া উচিত।

পঞ্চম খন্ড

ফেডারেশন এবং এর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সম্পর্ক

৮৯. বিষয়আইনের যে সকল বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় আইনসভা এবং প্রাদেশিক আইনসভা কর্তৃক প্রনীত হতে হবে

                কমিটি আইন সভার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর তিনটি বিস্তারিত তালিকা তৈরী করেছে।

       (১) শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় আইনসভা কর্তৃক তৈরী

       (২) শুধুমাত্র প্রাদেশিক আইনসভা কর্তৃক তৈরী

       (৩)কেন্দ্রীয় আইনসভা এবং প্রাদেশিক আইনসভা উভয় কর্তৃক তৈরী

       এই তিনটি তালিকা-কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক এবং যৌথ-সংযুক্তি ৩ এ পাওয়া যাবে।

       আইনসভার অবশিষ্ট ক্ষমতা কেন্দ্রের উপর ন্যস্ত করা উচিত।

৯০. প্রাদেশিক চলতি তালিকার বিষয়গুলো অনুযায়ী পরিকল্পনা স্বমন্বয় করন

<001.046.189>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

 

বিধানগুলো বানানো হবে প্রাদেশিক ও চলতি তালিকার বিষয়গুলো অনুযায়ী কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা ও স্বমন্বয় করার জন্য এবং কেন্দ্রীয় আইনসভাকে এই সম্পর্কিত আইন পাস করার যোগ্য হতে হবে।

৯১. কেন্দ্রীয় আইন্ সভার অন্য কোন এলাকার গ্রহন মতামতের ভিত্তিতে এক বা একাধিক এলাকায় আইন প্রনয়নের ক্ষমতা

                যদি এক বা একাধিক প্রদেশের আইনসভার এটা মনে হয় যে, শুধু মাত্র আইনত জরুরী অবস্থায় প্রাদেশিক তালিকায় উল্লেখিত যে সব বিষয় ঐ এলাকা গুলোতে কেন্দ্রীয় আইনসভা কর্তৃক পরিচালিত হবে সেগুলো ছাড়া, ওই এলাকা বা এলাকা গুলোতে আইন তৈরীর কোন ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আইন সভার থাকা উচিত নয়, এবং এ সম্পর্কে প্রত্যেক প্রাদেশিক আইনসভার পাশ করা রেজল্যুশন কেন্দ্রীয় আইনসভার ঐ বিষয় গুলো পরিচালনার জন্য আইন পাশের ক্ষেত্রে বৈধ হবে, এবং পাশ করা যে কোন আইন ঐ সকল এলাকায় প্রযোজ্য হবে এবং অন্য যেকোন এলাকায়ও, যেখানে এটা পরবর্তীতে এ সম্পর্কিত বিষয়ে আইনসভার রেজল্যুশন পাশের মাধ্যমে গৃহীত হয়েছে।

৯২. কেন্দ্র কর্তৃক প্রনীত আইন বাতিল

                পুর্ববর্তী অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইনসভা কর্তৃক গৃহীত কোন আইন যা গৃহীত হয়েছে কিন্তু হওয়া উচিত নয়, কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রনীত বা গৃহীত অন্য কোন আইন দ্বারা বাতিল বা সংশোধন হতে পারে, যে সকল এলাকায় এটি প্রযোজ্য সে সকল এলাকায় আইনসভার কোন আইন দ্বারা এগুলো পরিবর্তন বা বাতিল করা যাবে।

৯৩. কেন্দ্রীয় আইনসভা এবং প্রাদেশিক আইনসভা কর্তৃক প্রনীত  আইনের মধ্যে অসংগতি

                সংঘাতের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক আইনের বদলে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রচলিত আইন চালু করার বিধান থাকা উচিত।

৯৪. একটি প্রাদেশিক আইনকে নিয়মবিরুদ্ধ ঘোষনা করার ক্ষমতা

       একজন বিভাগীয় প্রধানের কোন প্রাদেশিক আইনকে নিয়মবিরুদ্ধ ঘোষনা করার ক্ষমতা থাকা উচিত না। সাংবিধানিক ভাবে শুধুমাত্র ফিডেরাল কোর্টকে এই ক্ষমতা দাওয়া উচিত।

৯৫. ক্ষমতা অর্পন

       কেন্দ্রকে কোন প্রদেশ বা প্রদেশের অনুমোদন প্রাপ্ত কোন অফিসারের কাছে এর ক্ষমতা অর্পনের কর্তৃত্ব দাওয়ার বিধান থাকা উচিত।

       এছাড়াও একাধিক অঞ্চলের অনুরোধে প্রাদেশিক তালিকায় উল্লেখিত কোন বিষয়ে বিধানিক বা নির্বাহী পদক্ষেপ নাওয়ার ক্ষমতা কেন্দ্রের থাকবে।

       এই তালিকার বাইরে প্রাদেশিক সরকার অথবা ফিডেরাল রাষ্ট্রের শাসকের অনুমতি সাপেক্ষে বিভাগীয় প্রধান শর্ত সাপেক্ষে বা নিঃশর্তে সেই সরকার বা শাসক, অথবা তাদের কোন সন্মানিত অফিসারের ওপর এমন কোন বিষয়ের কার্যাবলি নিয়ে বিশ্বাস করতে পারেন যাতে ফেডারেশনের বর্ধিত ক্ষমতা আছে।

       এরপরও এমন কোন বিষয় যাতে প্রাদেশিক আইন সভার আইন প্রনয়ন বা ক্ষমতা প্রদান করার ক্ষমতা নেই তাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়ার ও ক্ষমতা প্রদান এবং কোন প্রদেশ বা অফিসার এবং কর্তৃপক্ষেকে তাদের দায়িত্ব দেওয়া কেন্দ্রীয় আইনসভার আর একটি আইন হতে পারে।

<001.046.190>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

কেন্দ্রীয় আইনসভার একটি আইন যা ক্ষমতা প্রদান এবং দায়িত্ব দাওয়ার অথবা প্রদেশ বা  অফিসারকে ক্ষমতা বা দায়িত্ব দাওয়ার কর্তৃত্ব প্রদান এবং শাসকদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কর্তৃত্বের বিন্যাস করা পর্যন্ত ফেডেরাল রাষ্ট্রের ক্ষমতা বর্ধিত করতে পারে।

       যেখানে এই ব্যবস্থার উৎকর্ষ, ক্ষমতা এবং দায়িত্ব কোন প্রদেশ বা ফিডেরাল রাষ্ট্রের ওপর অথবা কোন অফিসার বা কর্তৃপক্ষের ওপর আরোপ করা হয়েছে সেখানে ফেডারেশন প্রদেশ বা রাষ্ট্রকে অনুমদিত অর্থ প্রদান করবে অথবা, অর্থের পরিমান নির্ধারনে সম্মত না হলে পাকিস্তানের প্রধান বিচারকের নিয়োগকৃত একটি সালিশে, এই ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালনের জন্য প্রদেশ বা রাষ্ট্রের যেকোন অতিরিক্ত খরচসহ এই অর্থের পরিমান নির্ধারিত হবে।

৯৬. জরুরী অবস্থা ঘোষনা সম্পর্কে প্রাদেশিক তালিকার যেকোন বিষয় সম্পর্কিত আইন

                জরুরী অবস্থা ঘোষনার ক্ষেত্রে প্রাদেশিক তালিকার যেকোন বিষয়ে আইন প্রনয়নের জন্য কেন্দ্রকে ক্ষমতা দাওয়ার বিধান করা উচিত।

৯৭. সীমানা সামঞ্জস্যের জন্য যন্ত্রপাতি

                বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যকার সীমানর মধ্যে সামাঞ্জস্য আনার জন্য যন্ত্রপাতি স্থাপনের আইন করা উচিত।

       ব্যাখ্যা-সীমানা সামঞ্জস্য বলতে কোন বিদ্যমান প্রদেশের বিলুপ্তি বোঝায় না।

৯৮. প্রদেশ এবং ফেডারেশনের দায় কতিপয় ক্ষেত্রে প্রদেশের ওপর ফেডারেশনের নিয়ন্ত্রন

       (১) প্রতিটি প্রদেশের নির্বাহী ক্ষমতা, কেন্দ্রীয় আইনসভার আইন এবং সেই প্রদেশে প্রযোজ্য যেকোন বিদ্যমান আইনের মধ্যে অনুবর্তিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োগ করা উচিত এবং ফেডারেশনের নির্বাহী ক্ষমতা একটি প্রদেশে পাকিস্তান সরকারের সে উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দাওয়া পর্যন্ত বর্ধিত করা উচিত।

       (২) প্রতিটি প্রদেশের নির্বাহী ক্ষমতা ফেডারেশনের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ কে বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত না করার জন্য ব্যবহার করা উচিত এবং ফেডারেশনের নির্বাহী ক্ষমতা কোন প্রদেশে পাকিস্তানি সরকারের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া পর্যন্ত বর্ধিত করা উচিত।

       (৩)কোন প্রদেশে, জাতীয় ও সামরিক ক্ষেত্রে ঘোষিত গুরুত্বপুর্ন যোগাযোগ স্থাপন ও রক্ষার উদ্দেশ্যে নির্দেশ দাওয়ার জন্যও ফেডারেশনের নির্বাহী ক্ষমতা বৃদ্ধি করা উচিত;

       উল্লেখ্য যে, এই উপ-অ্নুচ্ছেদের কোন কিছুই কেন্দ্রীয় আইনসভার কোন মহাসড়ককে জাতীয় মহাসড়ক এবং কোন জলপথকে জাতীয় জলপথ ঘোষনা বা মহাসড়ক অথবা জলপথ ঘোষনায় ফেডারেশনের ক্ষমতা কিংবা নৌ, সামরিক, বিমান বাহিনীর সাথে এর কাজের জন্য যোগাযোগ তৈরী ও রক্ষার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হবে না।

 

 

<001.046.191>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

(৪) ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী ক্ষমতা বৃদ্ধি করে প্রদেশের নির্দেশনা প্রদান তথা প্রদেশের রেলওয়ের নিরাপত্তার জন্য পরিমাপ নেয়া হবে।

(৫) উপ-অনুচ্ছেদ (৩) অনুযায়ী কোনো প্রদেশে কোনো নির্দেশনা নির্বাহকালে কোনো নির্মাণ বা রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে যোগাযোগের কোনো মাধ্যম কিংবা উপ-অনুচ্ছেদ (৪) অনুযায়ী কোনো রেলওয়ের  নিরাপত্তায় নেয়া পরিমাপ সম্বন্ধে যদি প্রদেশের সাধারণ দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার নির্দেশনা না থাকে তবে সেসব ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচ যুক্ত হবে । চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান সরকারকে এই মোট প্রদেশকে দিতে হবে কিংবা চুক্তি অনুযায়ী প্রদেশে অতিরিক্ত খরচ যুক্ত করার জন্য পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি কতৃক ধার্য বিচারক দ্বারা এই অংক নির্ধারন করতে হবে ।

৯৯. সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বিরোধ

প্রদেশগুলোর মধ্যে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বিরোধের জন্য আন্তঃ কিংবা কেন্দ্রের এবং অন্য এক বা একাধিক প্রদেশের জন্য ফেডারেল আদালত উল্লেখিত হবে।

১০০. সাধারণ বিরোধ

কেন্দ্র এবং প্রদেশের কিংবা প্রদেশের মধ্যে আন্তঃ সকল বিরোধ ট্রাইবুনাল কতৃক সমাধান করা হবে যা যেকোনো দলের অনুরোধে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।

১০১. আন্তঃ প্রদেশীয় পরিষদ

প্রদেশের নেতার  দলীয় সম্মতি দ্বারা প্রদেশগুলোর মধ্যে সাধারণ বেপার কিংবা কেন্দ্রের সাথে প্রদেশের সাধারন বেপারে   এক বা একাধিক পরিষদ গঠনের ক্ষমতা থাকবে।

১০২. পাকিস্তান সরকারের ঋণ

প্রদেশের চাওয়া অনুযায়ী কেন্দ্রের অর্থ ঋণ নেয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে।

১০৩. প্রদেশ কতৃক করা ঋণ

কেন্দ্রের প্রতিনিধিত্বে প্রদেশ নিজ যোগ্যতায় ঋণ নিতে পারবে, কোনো বিধান প্রয়োজনীয় নয় এক্ষেত্রে।

৬ষ্ঠ অংশ

ফেডারেশন ও  প্রদেশের অধীনে সেবা

১০৪. সেবার নিরাপত্তা

নিম্নোক্ত চরণে সরকারী কর্মচারিদের মামলা ইত্যাদির বিরুদ্ধে নিরাপত্তার উল্লেখ করা হলঃ

 

 

<001.046.192>

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

পাকিস্তানে রাজ্যের নির্দিষ্ট কর্মীদের নিরাপত্তা  উঠানো বা সীমাবদ্ধ করার জন্য কোনো বিল বা সংশোধনী প্রদান করা হবে না , অপরাধী প্রক্রিয়া আইন (১৮৯৮) ১৯৭ ধারা বা বেসামরিক প্রক্রিয়া আইনের(১৯৮০) ৮০-৮২ ধারা পরিচিত করা হবে অথবা কেন্দ্রীয় আইনসভার পূর্ব অনুমতি ছাড়া  রাষ্ট্রের মুখ্য কিংবা প্রাদেশিক আইনসভায় পূর্ব অনুমতি ছাড়া  রাজ্যের মুখ্য আনা হবে।

যেখানে একজন সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে বেসামরিক মামলা জারি হবে,যার মানে হবে বেসামরিক প্রক্রিয়া আইন,১৯০৮,এই সম্পর্কে তার মনে তার সরকারি দক্ষতা নিয়ে কোনো কর্মের অভিপ্রায় জাগে ,সম্পূর্ণ অথবা খরচের একটি অংশ তার দ্বারা  সংযুক্ত হবে এবং কোনো ক্ষতি বা ক্ষতির নির্দেশ তাকে বহন করতে হবে,যদি  ফেডারেশনের  এই ব্যাপারে যুক্ত কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে  রাষ্ট্রের মূখ্য নির্দেশনা দেয় , কিংবা প্রদেশের  এই ব্যাপারে যুক্ত কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে প্রদেশের মূখ্য নির্দেশনা দেয় তবে তাকে খরচ বহন করতে হবে এবং ফেডারেশন কিংবা প্রদেশের রাজস্বে অভিযুক্ত হতে পারে হয়ত।

১০৫.  ফেডারেশন ও প্রদেশের জন্য জনসেবা কমিশন

কেন্দ্রে একটি জনসেবা কমিশন থাকতে হবে এবং প্রতিটি  প্রদেশে একটি জনসেবা কমিশন দিতে হবে।এটি হয়ত দুটি আ কয়েকটি প্রদেশে যুক্ত জনসেবা কমিশনের ক্ষেত্রে অনুমোদনযোগ্য।

১০৬.জনসেবা কমিশনের সভাপতি ও সদস্যদের সাক্ষাৎ

প্রক্রিয়া অনুসারে কেন্দ্রে জনসেবা কমিশনের সভাপতি ও সদস্যদের সাক্ষাৎ এমনকি প্রদেশেও তা করতে হবে যা হয়ত উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য জমা রাখা হবে।

৭ম খন্ড

বহির্ভূত কিংবা আংশিক বহির্ভূত এলাকা

১০৭.বহির্ভূত কিংবা আংশিক বহির্ভূত এলাকা

“বহির্ভূত” এবং “আংশিক বহির্ভূত” রাশিগুলো যথাক্রমে বোঝায় যে, যেগুলো ফেডারেশন গঠনের তৎক্ষণাৎ পূর্বে বহির্ভূত কিংবা আংশিক বহির্ভূত ছিল।অথবা এই এলাকাগুলো অতঃপর রাষ্ট্রের মুখ্য দ্বারা বহির্ভূত বা আংশিক বহির্ভূত ঘোষনা করা হয়েছে।

১) প্রদেশের কার্যনির্বাহী কতৃপক্ষ তাতে বহির্ভূত ও আংশিক বহির্ভূত এলাকা সম্প্রসারণ করেছে,কিন্তু পরন্তু সংবিধানে যেকোন কিছু , কেন্দ্রীয় আইনসভা অথবা প্রাদেশিক আইনসভা বহির্ভূত কিংবা আংশিক বহির্ভূত এলাকা নিয়ে আইন প্রয়োগ করতে পারবে না,যদি না প্রদেশের মূখ্য  কতৃক কোন জনপ্রজ্ঞাপন বা নির্দেশ না দেয়, এবং প্রদেশের মূখ্যের কোনো আইন সংক্রান্ত এই ধরণের নির্দেশনা যে এই আইনটি ঐ এলাকায় প্রয়োগ করা হবে,অথবা এর নির্দিষ্ট অংশে  প্রয়োগ করা দরকার,তবে এই ক্ষেত্রে তিনি যেভাবে  প্রত্যাশা ও অদলবদলে মানানসই মনে করেন সেভাবে পারবেন।

 

<001.046.193>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

 

২) প্রদেশের মূখ্য হয়ত শান্তি ও মঙ্গলময় সরকারের  জন্য প্রদেশের যেকোনো এলাকায় নিয়ম তৈরী করতে পারবেন,যেটি  ঐ সময়ে বহির্ভূত কিংবা আংশিক বহির্ভূত এলাকার জন্য এবং যেকোনো নিয়ম যা কেন্দ্রীয়  বা প্রাদেশিক আইনসভার কোনো আইনকে  বাতিল বা সংশোধন করা কিংবা কোনো বিদ্যমান আইন যেটি এই সময়ে ঐ এলাকার জন্য কার্যকর।এই উপ অনুচ্ছেদের অধীনে তৈরী হওয়া নিয়মগুলো অবিলম্বে রাষ্ট্রের নেতাকে দেখাতে হবে এবং তার সম্মতি না পাওয়া পর্যন্ত এর কোনো প্রভাব থাকবে না।

                                       ৮ম খন্ড

                                      জরুরি বিধান

১০৮. জরুরি অবস্থার ঘোষনা

যদি রাষ্ট্র বাহ্যিক কোনো আক্রমণ কিংবা অভ্যন্তরীণ ঝামেলার সম্মুখীন হয় তবে জরুরি অবস্থার ঘোষণা করা হবে।

১০৯. রাষ্ট্রের জরুরি অবস্থা অথবা নিরাপত্তার হুমকিতে রাষ্ট্রপ্রধানের সংবিধান স্থগিত করার ক্ষমতা

রাষ্ট্রের জরুরি অবস্থা অথবা নিরাপত্তার হুমকিতে অথবা সংবিধানের ব্যর্থতায় রাষ্ট্রপ্রধান যদি মনে করে তবে সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক সংবিধান  স্থগিত করার ক্ষমতা থাকবে।

১১০.প্রদেশে সংবিধানের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধানের সংবিধান কিংবা সংবিধানের অংশ স্থগিত করার ক্ষমতা

কোনো প্রদেশে সংবিধানের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে  রাষ্ট্রেপ্রধানের সংবিধানের ঐ অংশ স্থগিত করার ক্ষমতা থাকবে  যদি সেটি প্রশাসনের বহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়,তবে এই ক্ষমতা ফেডারেল আদালত বা উচ্চ আদালত রদ করা পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে না অথবা ফেডারেল ও উচ্চ আদালতে সংবিধান অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করে।

১১১. দেশের অর্থনীতির হুমকিতে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষমতা

দেশের স্থায়িত্ব ও  অর্থনৈতিক জীবনে বা এর কোনো অংশ হুমকির সম্মুখীন হলে সকল জরুরি অবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে।

১১২. অর্থনৈতিক  স্থায়িত্বের হুমকির ক্ষেত্রে রক্ষণাবেক্ষণ ,নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা

অর্থনৈতিক প্রয়োজনের খাতিরে কতৃপক্ষ রক্ষণাবেক্ষণ ,নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপ্রধানকে ন্যস্ত  করবেন।

১১৩.কেন্দ্রের নির্দিষ্ট ক্ষমতার অনুশীলন

প্রাদেশিক  তালিকায় কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা ঘোশোনা করার জনয কেন্দ্রের আইন প্রণয়নের অধিকার থাকা উচিত।

কেন্দ্রকে ক্ষমতাবান করার জন্য বিধান তৈরী করা উচিত যাতে প্রয়োজনীয় ব্যাপারে জরুরি অবস্থা তৈরী হলে প্রদেশে নির্দেশনা ইস্যু করা যায়।

 

 

<001.046.194>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

 

রাস্ট্র প্রধানের কেন্দ্রীয় আইন নিয়ন্ত্রনের বিধানিক ক্ষমতা থাকা উচিত।যদি আইনগত কারনের জন্য কোন কারনে যথাসময়ে বাজেট অনুমোদন  দেয়া সম্ভব না হয়,তাহলে ব্যায় অনুমোদনের জন্য রাস্ট্র প্রধানকে ক্ষমতা দেবার বিধান চালু করা যেতে পারে।
114. Laying of Proclamation of Emergency before the Central Legislature

Provision should be made making it compulsory on the part of the Head of the State

to lay the Proclamation of Emergency  issued by  him before the  Central Legislature in

case the Legislature is in existence and can meet.

নবম অংশ
বিবিধি

১১৫-উপাধি এবং সজ্জা
পাকিস্তান রাস্ট্রে কোন উপাধি গ্রহন করা হবে না;পাকিস্তানের কোন নাগরিক কোন ধরনের কোন উপাধি কোন রাজা,রাজপুত্র অথবা বিদেশী রাস্ট্র থেকে গ্রহন করতে পারবে না। This should not, however, bar the award by the Head of the State of decorations in recognition of service in its Defence services, Police and other similar organizations, or decorations

for velour.

১১৬ চুক্তি-ক্ষমতা তৈরি
সকল চুক্তি রাস্ট্রপ্রধান দ্বারা স্বাক্ষর এবং অনুমোদন পাবে।সকল চুক্তি কেবলমাত্র ঐ বিভাগ ব্যাতিত যেগুলো হয়ত বা নির্দিস্টভাবে এই ধারা থেকে ছেটে ফেলা হয়েছে তা ব্যাতিত সকল বিষয় কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ দ্বারা অনুমোদন লাভ করবে।চুক্তি বাতিল রাস্ট্রের প্রধান দ্বারা অনুমোদন করা যেতে পারে।এই কমিটির উপদেশ পর্যবেক্ষন হল এই যে,নির্দিস্ট চুক্তির এমন এক গুরুত্বপূর্ন বৈশিষ্ট্য আছে যে তাদের অনুমদনের জন্য কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের প্রতিটি কক্ষে আলাদা ভাবে বসা যেতে পারে।এই ধরনের ব্যাতিক্রমী ঘটনায়,এই বিষয়গুলো দুই পরিষদের যুগ্ম সেশনে আলোচনা করা যেতে পারে।
১১৭ কূটনৈতিক অভ্যর্থনা জানানোর ক্ষমতা
রাস্ট্রপ্রধানের কুটনীতিক অভ্যর্থনা জানানোর ক্ষমতা থাকবে।
১১৮ যুদ্ধঘোষণার ক্ষমতা
রাস্ট্রপ্রধানের যুদ্ধ ঘোষনার ক্ষমতা থাকবে
১১৯
ফেডারেশনের পাকিস্তানের বাইরের রাজ্যে সম্পর্ক এর অধিকার
পছন্দমত বিধান আইন কর্তাদের জন্য সংবিধানে যুক্ত করা যেতে পারে এবং একটি অতিরিক্ত প্রাদেশিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিচারিক এখতিয়ার

<001.046.195>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

১২০ রাষ্ট্রভাষা

উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হতে পারে

১২১ পরিভাষা

পরিভাষা হতে পারে রাস্ট্রভাষার সাথে সংবিধানের ইংলিশ ভার্ষনের ইংরেজী অনুবাদ।
এই কমিটি ডঃ মৌলভী আব্দুল হক,ডঃ আই এইচ কুরায়েশি এবং ডঃ মাহমুদ হুসাইন দারা গঠিত একটি বিশেষায়িত কমিটিকে নিয়োগ দিল যাতে তারা উপযুক্ত পরিভাষার পরামর্শ প্রদান করতে পারে।

১২২ শপথ

যেখানেই সংবিধানের অধীনে শপথ নেবার প্রয়োজন হোক না কেন, মুসলমানরা আল্লাহর নামে শপথ নিতে পারে এবং নন মুসলিমদের ক্ষেত্রে এটা উন্মুক্ত রাখা যেতে পারে হয় ঈশ্বরের নামে শপথ নিতে অথবা অন্য বিবৃতিতে।

১২৩ সংবিধানের ব্যাখ্যা

সংবিধানের ব্যাখ্যা বিচারপতিগনের জন্য রাখা যেতে পারে।কিন্তু যখন বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হবে তখন কোন রকমের প্রয়োজনীয় বিলম্ব ছাড়াই এর চুড়ান্ত দায়িত্ব পাকিস্তানের উচ্চ আদালতকে দেয়া যেতে পারে।

১০ম অংশ
সংবিধান পরিবর্তন

১২৪ সংবিধান পরিবর্তনের জন্য প্রক্রিয়া

কমিটির দৃষ্টিভংগি হল সংবিধান পরিবর্তনের প্রক্রিয়া কঠিন হওয়া উচিত।সে মোতাবেক নিম্নোক্ত প্রক্রিয়া সুপারিশ করা যেতে পারে।

যদি প্রাদেশিক পরিষদের এক তৃতীয়াংশ এর চেয়ে কম সদস্য নয় এমন স্বাক্ষরিত নোটিশ গ্রহন করা হয়, যারা প্রাদেশিক পরিষদের ভিতরে সংবিধান পরিবর্তনের জন্য প্রস্তাব উত্থাপন জ্ঞাপনের অনুমতি চাচ্ছে,এটা পরিষদের এজেন্ডা সম্পর্কিত হিসেবে এবং বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। কোন কাররে যদি এটা অধিকাংশের দ্বারা অনুমোদিত হয়,তাহলে বিষয়টি অন্য পরিষদে বিবেচনার জন্য একই উদ্দেশ্য পাঠানো যেতে পারে।যখন দ্বিতীয় পরিষদ দ্বারা অনুমোদন দেয়া হবে,প্রস্তাবটি পরিষদে এর চেয়ারম্যান দ্বারা উত্থাপন করা যেতে পারে যিনি এটি শুরু করে থাকেন। প্রত্যেক আইন পরিষদের চেয়ারম্যান,যার দ্বারা এই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে,আইন পরিষদের সম্মানিত চেয়ারম্যান যিনি এই প্রস্তান উত্থাপন করেছিলেন তিনি এই সিদ্ধান্ত জ্ঞাপন করতে পারেন।কেন্দ্রীয় একইভাবে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সিদ্ধান্ত বেশিরভাগের ভোটের মাধ্যমে গ্রহন করা যেতে পারে।যদি প্রাদেশিক পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য প্রস্তাব বিবেচনার সমর্থন দেন,এটা পরিষদের বিবেচনা হিসেবে এজেন্ডায় রাখা যেতে পারে।
কোন কারনে এটি যদি পরিষদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের উপস্থিতিতে এবং ভোটে অনুমোদন পায়,এটি অন্য পরিষদে প্রেরন করা যেতে পারে একই ধরনের ব্যাবস্থা নেয়ার জন্য।যদি পরবর্তি পরিষদও প্রস্তাব বেশিরভাগের মাধ্যমে অনুমোদন করে থাকে,তাহলে এই সংশোধনী অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।

<001.046.196>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

একাদশ অংশ
১২৫ পরিবর্তনকালীন সময় পর্যন্ত বিধান
১ দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানোর জন্য বিশেষ বিধান চালু করা যেতে পারে।যত দ্রুত সম্ভব নতুন সংবিধান বাস্তবায়নের আগে বর্তমান সংবিধান অনুসারে কার্যক্রম চালান যেতে পারে।
২ বিদ্যমান প্রশাসনকে নতুন সংবিধান জারীর সকল সুবিধাজনক পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যাবার সক্ষমতা তৈরির জন্য নতুন বিধান করা যেতে পারে।

সংযোজনী ৩
তালিকা ১ (যুক্তরাষ্ট্রীয়)

১ শান্তিকালীন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে রাস্ট্রের প্রতিরক্ষা নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিষয়।

২ প্রশিক্ষন,রক্ষন্সবেক্ষন এবনহ নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রন,সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর ও তাদের পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য চাকরি এবং পাকিস্তানে আইন প্রয়োগকারী এবং এর বিধান ও অন্য বাহিনী যাদের নিরাপত্তা এবং বর্ডারে সেবা দিতে হয় ইত্যাদি বিষয় উত্থাপন।

  1. Preventive detention  in  the  territory  of  Pakistan  for  reasons  connected  with

defence, external affairs or the security of Pakistan,
Persons subjected to preventive detention under the authority of the Federation.

৪ প্রতিরক্ষা শিল্প এবং পরমানু শক্তি

৫ 5. All  work  connected  with  services  set  up  under  Nos.  1  and  2  and  Local  Self-

Government  in  Cantonment  areas,  powers  and  functions  within  such  areas  of

Cantonment  authorities,  control  of  house  accommodation  in  such  areas  and  the

delimitation of such areas

৬ পররাষ্ট্র সম্পর্কিত ,সকল বিষয় যা কোন বিদেশি রাস্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্থাপন করবে।

৭ কূটনৈতিক,বাণিজ্যদূত সংক্রান্ত এবং প্রতিনিধিত্ব।

৮ আন্তর্জাতিক সংস্থা,আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহন,সংস্থা এবং অন্যান্য বিষয় ও সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন যা রিট তৈরি করেছিল।

৯ যুদ্ধ এবং শান্তি ও অঞ্চল তৈরি এবং তাদের বাস্তবায়ন

১০ বিদেশ এবং অতিরিক্ত আঞ্চলিক বিচারিক ব্যাবস্থা

<001.046.197>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

১৫. পাসপোর্ট এবং ভিসা

১৬. পাকিস্তান এবং জাতীয় আইনের বিরুদ্ধে পাইরেসি এবং অপরাধ।

১৭. পাকিস্তান হতে ভর্তি হওয়া, প্রবাস এবং নির্বাসন।

১৮. চাকরীস্থল পাকিস্তানের বাইরে।

১৯. বিদেশীদের চাকরীস্থল পাকিস্তানের ভেতরে।

২০. আন্ত-প্রদেশ এবং বন্দর পৃথক করা, নাবিক সমুদ্র এলাকার হাসপাতাল গুলো আলাদা করা।

২১. পাকিস্তান সরকারের প্রণীত আইনে আমদানি-রপ্তানি পরিচালনা।

২২. সব রকম যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন- রেলওয়ে, বিমান পথ, জাহাজ চলাচল, সমুদ্র ও আকশ পথে ন্যাভিগেশন, জাতীয় সড়ক, জাতীয় বন্দর, ডাক বিভাগ, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, বেতার সম্প্রচার, টেলিভিশন সবকিছু আইন সভার অনুমোদনে চলে।

জোয়ার প্রবন এলাকায় চলাচল, শিক্ষা নীতি, বাণিজ্যিক সমুদ্রযান, বেসামরিক বিমান চলাচলের প্রশিক্ষন সহ সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল ও নাভিগেসন সবকিছু প্রাদেশিক এবং অন্যান্য সংস্থার বিধানে চলে।

২২ ক. বিমান পথ, বিমান এবং এয়ার ন্যাভিগেশন; বিমানশালার নীতি; এয়ার ট্রাফিক এবং বিমানশালার নীতিমালা ও সংস্থা; বিমান শিক্ষা এবং প্রশিক্ষন এইসব কিছু প্রদেশ এবং অন্যান্য সংস্থা থেকে দেয়া।

অন্তর্দেশীয় পানিতে জাহাজ চালনা এবং ন্যাভিগেশন, যান্ত্রিক জল-পরিবহন, যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের জন্য ছিল আইন-সভার বিধি-বিধান।

২৩. জাতীয় ভাবে ঘোষিত প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, পাঠাগার এবং জাদুঘর এর অর্থায়ন না করা।

২৪. গবেষণা, পেশাগত বা প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষন বা বিশেষ শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত ফেডারেল সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান সমূহ।

২৫. ফেডারেল জরিপ ও ফেডারেল আবহবিদ্যাগত প্রতিষ্ঠান সমূহ।

২৬. পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক, ব্যাংকিং, মুদ্রা, বৈদেশিক লেনদেন, টংকন, আইন স্বীকৃত টেন্ডার, চেক, লেনদেনের হিসাব, সঞ্চয়পত্র এবং এই সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয় সমূহ।

২৭. ইনস্যুরেন্স

২৮. প্রাতিষ্ঠানিক আইন

২৯. কপিরাইট, নকশা, পেটেণ্ট, উদ্ভাবন, বাণিজ্য ও পণ্যদ্রব্য

৩০. ফেডারেল নিয়ন্ত্রনে শিল্প উন্নয়নের আইন জনসাধারনের বিবেচনার জন্য প্রকাশ করা।

<001.046.198>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

৩১. ফেডারেল আইনে লোহা, স্টিল, কয়লা, পেট্রোলিয়াম, খনিজ পদার্থ সহ এরকম অন্যান্য পদার্থ গুলো কে জাতীয় স্বার্থে ব্যাবহারের আইন প্রণয়ন করা হয়।

ফেডারেল আইনে খনি, তেলখনি সমূহ এবং খনিজ উন্নয়ন জনস্বার্থে ব্যাবহারের জন্য সমীচীন মনে করা হয়।

৩২. বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে খনি ও তেলখনি স্রমিকদের নিয়মনীতি এবং নিরাপত্তা জনিত বিতর্ক।

৩৩. আন্তপ্রদেশিয় বাণিজ্য নীতি।

৩৪. ওজন ও পরিমাপের আদর্শ

৩৫. বিক্রয় বা রপ্তানির উদ্দেশে আফিম আবাদ এবং উৎপাদন

৩৬. সংবিধান, প্রতিষ্ঠান, অধিক্ষেত্র এবং ফেডারেল আদালতের ক্ষমতা এবং ফি।

৩৭. আদমশুমারি

৩৮. যেকোনো উদ্দেশে এই তালিকার যেকোনো বিষয়ে অনুসন্ধান এবং পরিসংখ্যান।

৩৯. কেন্দ্রীয় ইন্টেলিজেন্স সংস্থা

৪০. ফেডারেল জনসেবা এবং ফেডারেল জনসেবা কমিশন।

৪১. কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচন এবং রাষ্ট্রপতি সহ অন্যান্য ফেডারেল নির্বাচন।

৪২. দেশের সমুদ্রসীমার বাইরে মাছ ধরা এবং মৎস্যশিল্প।

৪৩. লবন

৪৪. দেশের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার আইন।

৪৫. এই তালিকার যেকোনো বিষয়ে আইন লঙ্ঘন।

৪৬. ইউনিভার্সিটি, সমবায়ী সমিতি এবং পৌরসভা ব্যাতিত ব্যাংকিং, ইনসিওরেন্স এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহ  অন্যান্য করপরেশনের উন্নয়ন।

৪৭. পাকিস্তানে আন্তঃপ্রাদেশিক স্থানান্তর।

৪৮. বিভিন্ন প্রতিস্থানের নামে ভূসম্পত্তি অধিগ্রহন করা

৪৯. প্রতিস্থানের সম্পত্তি এবং এর থেকে অর্জিত রাজস্ব কেন্দ্রীয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ

৫০. রাষ্ট্রের নামে বিভিন্ন প্রতিস্থানের ঋণ।

৫১. যাকাত।

৫২. সাজসজ্জা এবং সন্মানিয় উপাধি।

<001.046.199>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

৫৩. বিষাক্ত পানীয় এবং চেতনানাশক ওষুধ।

৫৪. প্রদর্শনীর জন্য চলচ্চিত্র ফিল্ম এর বরাদ্দ।

৫৫. অস্ত্র, বন্দুক, গুলি এবং বিস্ফোরক

৫৬. পোস্ট অফিস সেভিং ব্যাংক

৫৭. নৌবাহিনী অধিক্ষেত্র

৫৮. জাহাজ এবং বিমানের নিরাপত্তার জন্য বাতিজাহাজ, দিক নির্দেশক এবং অন্যান্য নিয়ম কানুন।

৫৯. ফেডারেল আইনে পেট্রলিয়াম এবং অন্যান্য তরল পদার্থ দখলে রাখা, সংরক্ষণ করা বা পরিবহনের জন্য মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ ঘোষিত হয়।

৬০. কেন্দ্রীয় আইন বিভাগের মন্ত্রি, উপমন্ত্রী, চেয়ারম্যান, সহঃচেয়ারমান ও সদস্যদের বেতন, ভাতা এবং অন্যান্য সুবিধা সম্পর্কিত এবং উপযুক্ত দলিল উপস্থাপন না করার শাস্তি।

৬১. কেন্দ্রীয় আইন বিভাগের সামনে দলিল উপস্থাপনকারীর জোরপূর্বক উপস্থিতি নিশ্চিতকরন।

৬২. একটির চাইতে বেশি প্রদেশের জন্য প্রয়োজনীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, চাষাবাদ এবং হাইড্র-ইলেক্ট্রিক পাওয়ার নিশ্চিতকরনে পানির গতিপথ উন্নয়ন।

৬৩. স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ বাজার।

৬৪. হাই কোর্টের অধিক্ষেত্র ক্ষমতা প্রদেশের বাইরে প্রয়োগের জন্য বর্ধন।

৬৫. সুপ্রিম কোর্ট ছাড়া অন্যান্য কোর্টের ক্ষেত্রে এই তালিকার যেকোনো বিষয়ে ক্ষমতা।

৬৬. কোন নির্দিষ্ট প্রদেশের পুলিশ সদসসের অধিক্ষেত্র ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্র নির্ধারণ।

৬৭. অন্য সব বিষয় সমূহ যা ১ ও ২ নম্বর তালিকায় উল্লেখ করা হয়নি।

তালিকাঃ ২ (প্রাদেশিক)

১. প্রকাশ্য আদেশের তদারকির জন্য (বেসামরিকদের জন্য সামরিক বাহিনির ব্যাবহার এর অন্তর্ভুক্ত নয়), বিচার প্রশাসন,  ফেডারেল কোর্ট ছাড়া অন্যান্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এবং নিবর্তনমূলক আটক এর জন্য গৃহীত ফি।

<001.046.200>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

  1. জেল/হাজতখানা, বন্দি সংশোধনাগার, কিশোর পুর্নবাসন কেন্দ্র এবং এরকম অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেখানে অপরাধীদের বন্দী রাখা হয়, এসব প্রতিষ্ঠানসমূহ অন্য প্রভিন্সের সাথে জেলখানা হিসেবে ব্যবহার করবে

পুলিশ

৩.—

৪.প্রভিন্সের সরকারি দায়

৫. প্রভিন্সিয়াল পেনশন; যা প্রভিন্স কর্তৃক পরিশোধিত

৬. প্রভিন্সিয়াল সেবা ও প্রভিন্সিয়াল পাবলিক সার্ভিস কমিশন

৭.পূর্ত, ভূমি ও দালান কোঠা যা প্রভিন্সের নিকট অর্পিত কিংবা অধিকারে রয়েছে

৮. কেন্দ্র কিংবা প্রভিন্সের প্রয়োজনে কোন সম্পত্তি বা ভূমি অধিগ্রহন কিংবা অধিযাচন

৯.যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থগার, জাদুঘর এবং এরকম অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যার কর্তৃত্ব ও অর্থায়ন করে প্রভিন্স

১০.জনস্বাস্থ্য, সেনিটেশন, হাসপাতাল, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন

১১. মৃত্যু ব্যক্তির সতকার ও গোরস্থান

১২.প্রভিন্সিয়াল পরিষদের নির্বাচন, মন্ত্রী ও চেয়ারম্যানদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি।সংসদীয় কমিটির সামেনর দালিলিক প্রমান হাজির করতে না পারলে তাদের বিচার নিশ্চিত করা

১৩.স্থানীয় সরকার; মিনিসিপালিটি, ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট, ডিস্টিক্ট বোর্ড, মাইনিং সেটেল্টমেন্ট কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যার মাধ্যমে লোকাল সেলফ গর্ভমেন্টকে তরান্বিত করে

১৪. প্রভিন্সের আওতাধীন ধর্মীয় স্থানসমূহ

১৫. শিক্ষাব্যবস্থা

১৬. যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন রোড, সেতু, ফেরী ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম যা তালিকা-১ এর অন্তর্ভক্ত নয়, মিউনিসিপাল ট্রামওয়ে, রোপওয়ে, আভ্যন্তরিন নৌরোট ও অন্যান্য রাস্তাঘাট যা তালিকা-৩ এর অধিভূক্ত এসব নৌপথ ও বন্দর যা  তালিকা-১ এ জাতীয় বন্দরের অন্তর্ভক্ত, যানবাহন যা যন্ত্রচালিত যানবাহন ব্যতিরেকে

১৭. পানি সরবরাহ, সেচ ব্যবস্থা ও খাল, পয়ঃনিষ্কাসন ও বাঁধ ও পানি সংরক্ষনাগার

১৭. জল বিদ্যুত

১৮. কৃষি, কৃষি শিক্ষা ও গবেষনা, ক্ষতিকর পোকামাকড় প্রতিরোধ ও বৃক্ষ/গাছপালার রোগ প্রতিরোধ করা, গবাদি পশুর জাত উন্নয়ন ও রোগ নিয়ন্ত্রন, ভেটেনারি ট্রেনিং, গবাদিপশুর চারণভূমি সুরক্ষা করা

 

<001.046.201>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

১৯- ভূমি,ভূমির উপর অধিকার,মধ্যসত্তভোগকারি,ভূমির মালিক ও সেখানে বসবাসকারীদের মধ্যকার সম্পর্ক , ভাড়া ওঠানো, কৃষি ভূমির ক্ষমতা হস্তান্তর, জমির উন্নয়ন, কৃষি ঋণ, উপনিবেশিক স্থাপনা।

২০-বন ও বন্য পশুপাখি সংরক্ষন।

২১-গ্যাস ও গ্যাস এর কাজ।

২২- তালিকা ১ এ বর্ণিত সুবিধাদি অনুসারে খনিজ সম্পদ ও তেলের খনির রক্ষণাবেক্ষণ।

২৩- মাৎস্য সম্পদ

২৪- সরাইখানা, দোকান ও সেলুন রক্ষণাবেক্ষণ।

২৫- উপমহাদেশের বানিজ্য, মেলা ও বাজারসমূহ

২৫ ক- অর্থ দাতা ও অর্থ গ্রহীতা

২৬- মালামালের উৎপাদন ও বিতরণ এর রক্ষনাবেক্ষন,তালিকা১এউল্লেখিতশিল্প কারখানা সমূহের উন্নয়ন।

২৭-খাদ্য ও অন্যান্য পন্যের ভেজাল রোধ।

২৮-মদ ও ড্রাগ এর ব্যাপারে সচেতনতা।

২৯-দারিদ্রতা, বেকারত্ব নিরসন ও বিভিন্ন দাতব্য কাজ ও সংস্থার কাজের তদারকি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় বৃত্তি।

৩০- তালিকা ১-এ যেসব সংস্থার উল্লেখ আছে সেসব প্রতিষ্ঠানের তদারকি। অপ্রাতিষ্ঠানিক লেনদেন; সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, ধর্মীয় এবং মুসলিম সমাজের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য সমাজ ব্যবস্থাসমূহ।

৩১- জুয়া খেলা ও বাজি ধরা।

৩২- থিয়েটার,নাটক ও সিনেমা (বিনামূল্যে প্রদর্শনের জন্য সিনেমা ব্যাতীত)।

৩৩-লিস্টের অন্যান্য ব্যপারে তদন্ত ও তথ্য সংগ্রহ

৩৪-আইন বিরুদ্ধ কোনো ব্যাপার থাকলে তার তদারকি

৩৫- মসজিদ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান।

তালিকা (সহাবস্থিত)

১- ফৌজদারি আইন, এই আইন পাসের দিন থেকে ভারতীয় দণ্ডবিধির অন্তর্ভুক্ত সকল বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত কিন্তু ১ নং অথবা ২ নং তালিকার উল্লেখিত যেকোন বিষয়ের আইন বিরুদ্ধ অপরাধ এবং বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় নৌ, সামরিক এবং বিমান বাহিনীর ব্যবহার ব্যতীত।

২- ক্রিমিনাল আইনের সব বিষয় যা ওইদিন পাশ করা হয়েছে।

<001.046.202>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

৩- দোষী ব্যাক্তি ও আসামি দের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশ এ স্থানান্তর

৪- বেসামরিক কার্যকলাপ,সে সংক্রান্ত সব আইন কানুন,বা এসব আইনে যা জটিলতা আছে,জমির বকেয়া খাজনাসহ সব বিষয়েরক্ষণাবেক্ষণ করা।

৫- সূচনা ও শপথ গ্রহণ; আইন, সামাজিক নীতি ও আদালতের শাসনের পরিচিতিকরণ।

৬- বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, বিবাহের বয়স এই সংক্রান্ত সব আলোচনা।

৭- জমির দলিল, দলিলবিহীন বা মালিকানা বিহীন কৃষি জমির রক্ষণাবেক্ষণ।

৮- কৃষি জমি ছাড়া অন্যান্য সম্পত্তিরহস্তান্তর সংক্রান্ত কার্যাবলী; নথিভুক্তি ও অন্যান্য।

৯- ট্রাস্ট ও ট্রাস্টি

১০-কৃষি জমি ছাড়া অন্যান্য সব রকম চুক্তি যেমন- কোন সংস্থার অংশীদারিত্ব বা মালামাল সংক্রান্ত

১১-সালিশ ব্যবস্থা

১২-দেউলিয়া হওয়া বা অর্থশূন্যতা বা ব্যাংক সংক্রান্ত অন্যান্য কার্যাবলী

১৩- বিভিন্ন রকম স্ট্যাম্প এর মুল্য জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের দ্বারা সংগ্রহ করা হবে।

১৪-তালিকা ১ ও ২ এ উল্লেখিত যেকোনো সম্ভাব্য দোষমূলক কাজ এড়িয়ে চলতে হবে।

১৫-ফেডারেল কোর্ট ছাড়া অন্যান্য সকলআদালতেরক্ষমতা ও সীমা এই তালিকায় উল্লেখ থাকবে।

১৬- চিকিৎসা ওঅন্যান্য পেশা।

১৭-খবরের কাগজ , বই ও অন্যান্য মুদ্রণ প্রেস।

১৮- মানসিক সমস্যা ও মানসিক বিকারগ্রস্থতার চিকিৎসার জন্য স্থান

১৯-বিষ ও অন্যান্য ক্ষতিকর ড্রাগ

২০- যান্ত্রিক বাহন

২১- বয়লার

২২- প্রানীদের প্রতি হিংস্র আচরণ প্রতিরোধ করা।

২৩- গৃহহীন,যাযাবর, অপরাধী ও যারা অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হচ্ছে

২৪-কারখানা

২৫- শ্রমিক দের সুযোগ সুবিধা ও উন্নয়ন; শ্রমিকদের অবস্থা, ফাণ্ড, কাজদাতার দায়িত্ব ও ক্ষতিপূরণ, স্বাস্থ্য বীমা্, অক্ষমতা ভাতা ও বয়স্ক ভাতা।

<001.046.203>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

২৬। বেকারত্ব ও সামাজিক বীমা২৭। ব্যবসায়িক ঐক্য; শিল্প ও শ্রম বিরোধ.২৮। সংক্রমন ও সংক্রামক ব্যাধি বা অন্য যেকোনো কিছু যা মানুষ, প্রানী বা উদ্ভিদকে সংক্রামিত করে তা এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে ছড়ানোকে প্রতিরোধ করা। ২৯। বিদ্যুৎ ৩০। রপ্তানি এবং অন্তর্দেশীয় জলপথে পরিবহন যেমন যান্ত্রিক জাহাজ, এবং নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের নিয়ম ৩১। সেই সব নিতিমালা যার আলোকে ফেডারেশন অথবা প্রদেশের জন্য অধিগ্রহনকৃত অথবা রিকুজিশনে নেওয়া সম্পত্তির ক্ষতিপূরণনির্ধারন করা। ৩২। এই তালিকার যে কোন বিষয়ে উদ্দেশ্যে তদন্ত এবং পরিসংখ্যান৩৩। এই তালিকার যে কোন বিষয়ের জন্য ফি৩৪। সূদ ৩৫। উচ্চ কারিগরি শিক্ষা.৩৬। বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা.৩৭। মুসলিম ধর্মীয় সমাজ (মসজিদ ও ওয়াকফ ব্যতীত)

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ
মূলনীতি সমিতির অন্তর্বতীকালীন রিপোর্ট বিবেচনা স্থগিত রাখা প্রসঙ্গে পাকিস্তান গণপরিষদ ২১ নভেম্বর, ১৯৫০

 মূলনীতি সমিতির অন্তর্বতীকালীন প্রতিবেদনবিবেচনা স্থগিত রাখা প্রসঙ্গে মাননীয় জনাব লিয়াকত আলী খান (পূর্ব বাংলা: মুসলিম)স্যার, আমার প্রার্থনা                    “গণপরিষদ এই অধিবেশনেমূলনীতি কমিটির অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন বিবেচনায় না নিতে,যাতে আগ্রহী পরামর্শদাতারা  কমিটি রেজুলেশনের  সাথে সংগতিপূর্ণ  কোন স্থায়ী এবং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বিবেচনা করতে পারে, যা১৯৫১সালের ৩১ জানুয়ারি গণপরিষদের অফিস কর্তৃক গৃহীত হতে পারে এবং  যাতে প্রয়োজনবোধে এই ধরনের আরও সুপারিশ করতে পারে।”                     মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহোদয়, মূলনীতি কমিটির উপস্থাপনা এবং প্রকাশনা কালে বহুসংখক মন্তব্য প্রেস এবং প্লাটফর্ম থেকে এসেছে। এই মন্তব্যগুলো“তিন” শ্রেণীভুক্ত হতে পারে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞতা ও অপর্যাপ্ত  সুপারিশের উপরে ভিত্তি করে মন্তব্য করেছেন। কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে  এবং বিভ্রান্তি তৈরি করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। আর কিছু করা হয়েছে আমাদের সংবিধান সত্যিকারের ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠা কিনা তা জানার প্রকৃত ইচ্ছা থেকে । স্যার ,যখন এই সভাকক্ষে উদ্দেশ্য সমুহের রেজুলেশন গৃহীত হয়, আমি কোন দ্বিধা ছাড়াই খোলা মনে তা গ্রহন করেছিলাম।  এটা আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা যে এই অব্জেক্টিভ রেজুলেশনের উপরে আমাদের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচনা করাহোক।                      জনাবপ্রেসিডেন্ট,এই স্থগিতের কারণ,বেসিক প্রিন্সিপাল কমিটিকে সংবিধানের মৌলিক নীতির ব্যাপারে মানুষের পাঠানো স্থায়ী এবং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাগুলোকে নিরীক্ষা এবং বিবেচনা করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। এ কারণে হওয়া কিছু বিলম্বের ব্যাপারে আমি পরিপূর্ন ভাবে অবহিত, কিন্তু যদি আমরা আমাদের সর্বচ্চ চেষ্টা করার ব্যাপারে সত্যি উদ্বিগ্ন এবং অভিলাষী হয়ে থাকি তাহলে আমাদের অন্য কোনো বিকল্প নেই।                      স্যার, অনেকে রিপোর্টের সমালোচনায় বলেছে যে এটি অব্জেক্টিভ রেজুলেশন অনুযায়ী নয় এবং বেশ কিছু সংখক নীতি রিপোর্ট অঙ্গীভূত করা উচিত। এটি সেই সব মানুষের জন্য একটি আমন্ত্রণ এবং সুযোগ যেন তাঁরা রিপোর্টের ব্যাপারে স্থায়ী এবং সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিতে পারেন যেখানে এই রিপোর্টের নীতিগুলো অব্জেক্টিভ রেজুলেশনের সাথে সংগতিপূর্ন নয়। একইভাবে, এটা মানুষকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ যে, অব্জেক্টিভ রেজুলেশনের সাথে সংগতিপূর্ণ কোন কোন নীতি বাদ পরেছে এবং কোন কোন নীতি রিপোর্টে অবশ্যই অন্তর্ভূক্ত করতে হবে অথবা করা যেতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচনায়।

<001.047.205>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

আমি আশা রাখি যারা সত্যি সত্যি এবং সততার সাথে,  আমরা সকলে যে ধরনের সংবিধান প্রণয়নে সচেষ্ট তার সাথে কাজ করতে চায় তাঁরা এই সুযোগটি গ্রহণ করবেন।  এটা একটি চ্যালেঞ্জ নয় যে আমি এই প্রস্তাবটি সচল করেছি, বরং এটি সকলের সহযোগিতা চাওয়ার একটি উপায় যারা ভাবে আমাদের একটি ভাল সংবিধান থাকতে হবে।  জনাব শাহুদুল হক (পূর্ব বাংলা: মুসলিম): জনাব প্রেসিডেন্ট, স্যার, আমি এই ব্যাপারে আমার সর্বান্তঃকরণের সমর্থন জানাচ্ছি এবং কায়মনোবাক্যে জনাব লিয়াকত আলী খানকে এই ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অভিনন্দন জানাই যেখানে তার প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা শুধু এই হাউস নয় বরং বাইরেও স্বাগত জানানো হবে, যদিও যারা মতভেদ তৈরি করতে,  ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে ও ক্ষমতা পাবার স্বপ্ন দেখেছিলো এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বেসিক প্রিন্সিপল কমিটির বিরুদ্ধে অসন্তোষ ব্যাপক ঝড়কে কাজে লাগিয়ে এর সুবিধা গ্রহণ করতে চাইবে। এই বাপারে এই হাউজ শুধুমাত্র আইনি প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের উপরে কিংবা বেসিক প্রন্সিপাল কমিটির সদস্যদের নয় বরং এটি সত্যিকারের সুযোগ সকল জনগণ বা বিচারক সবার কাছে এবং প্রকৃত উলামাগনের জন্য মৌলিক নীতিগুলোর সাথে সংগতিপূর্ন প্রস্তাব উপস্থাপনের জন্য যা এই হাউজ দ্বারা গৃহীত হবে। আমরা আশা করি  তারা সব এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে. জনাব নূর আহমেদ (পূর্ব বাংলা: মুসলিম): স্যার, আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই হাউজ নেতাকে এই প্রস্তাব আনার জন্যে। পাকিস্তানের মহান নেতা, যাকে আমি নিয়তির মানুষ বলি, আরো একবার নিজেকে তিনি মানবাতার সত্যিকারে মহান নেতা হিসেবে প্রমান করেছেন।  দুর্ভাগ্যবশত,বেসিক কমিটির অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পরে, তার বিরুদ্ধে অনেক নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে এমকি পাকিস্তানের মহান নেতাকে নিয়ে কটুক্তিও করা হয়েছে। স্যার, কিছু এলাকার মাঝে প্রতিবেদনের নীতিগুলো সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক অনৈসলামিক এবং সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হিসাবে আরোপিত হবে। বলা হচ্ছে এই সংবিধান এমন এক ছবি প্রকাশ করছে যাতে পাকিস্তানে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। স্যার, এটা কিছু অংশে বলা হয়েছে যে এই নীতিগুলো যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে পাকিস্তানে কোনো গণতন্ত্র ও কোন ইসলামী সংবিধান থাকবে না। এছাড়াও বলা হয়েছে যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন অদৃশ্য হবে এবং সেখানে হবে এককেন্দ্রিক পাকিস্তান সরকার।   স্যার, পূর্ববাংলায়  এখন ক্রমবর্ধমান বিশ্বাস- আমি অবশ্যই বলব যে, এটা ভুল ধারণা যে প্রতিবেদন নীতিগুলো যা, যদি গৃহীত হয় তাহলে পূর্ববাংলার সংখ্যাগুরুরাসংখ্যালঘুতে রুপান্তর  হবে এবং পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিনত করবে।  স্যার, আমাকে বলতেই হবে, এই সমালোচনা ভূল ধারনার উপরে ভিত্তি করে করা এবং যারা মনোযোগ দিয়ে নীতিমালাগুলো অনুধাবন করে নি। তারা শুধুমাত্র সংবাদপত্রের প্রতিবেদন পড়েছে এবং মন্তব্য করেছে।

<001.047.206>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

এবং দুর্ভাগ্যবশত কিছু সংবাদপত্র এমন কিছু মন্তব্য করে যা প্রতিবেদনেই ছিল না। এরকম মন্তব্য  পাকিস্তানে বিভেদ তৈরির উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। স্যার, আমি কি পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে যতটুকু জানি, যে প্রায় সবাই বলেছে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বিলুপ্ত করতে হবে এবং এর স্থলে পাকিস্তানের উপনিবেশ তৈরি করা হবে। আমি তাদের মন থেকেএই অনুভূতি দূর করার চেষ্টা করেছি।পূর্ব পাকিস্তান ও তাদের জনগণকে বলেছি গণপরিষদের এই ধরনের কোন উদ্দেশ্যই নেইএবং এটি মূলনীতি কমিটির বেসিক সদস্যদের উদ্দেশ্য ছিলো না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের একটি সংবিধান আঁকা, যা হবে ইসলামী,যাতে বর্ণ,ধর্মমত ও জাতি নির্বিশেষে সবাই একটি স্বাধীন নাগরিক হবে।ইহার কেন্দ্র হবে শুধুমাত্র একটি পথনির্দেশকের মাধ্যম; কেন্দ্র সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করবে তাও জরুরি প্রয়োজনে, দেশের জন্য যেকোনো ক্ষেত্রে এবং সময়ে স্বার্থবিরোধী কাজ করবে।

স্যার, সংবিধান যখন প্রণীত হবে তখন এটিই হবে বিশ্বের সেরা সংবিধান।স্যার,মাননীয় নেতার দ্বারা যে আন্দোলন তোলা হয়েছে তা শীঘ্রই অদৃশ্য হয়ে যাবে।আমার মনে হয় বাই আমাদের স্বাগতই জানাবে এবং এটি হবে পাকিস্তানের জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য যারা সমালোচনা এবং আন্দোলনরত তাদের ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা। স্যার, এই প্রস্তাবের মাধ্যমে তাদেরকে পরামর্শ দিতে বলা হচ্ছে যাতে তারা ব্যর্থ হলে তারা আমাদের দোষারোপ করতে সক্ষম হবে না। স্যার, আমি বিবেচনাধীন যে প্রস্তাব আছে তাকে জোরালোভাবে  সমর্থন করছি।

সাইয়েদ আবুল বাশার মাহমুদ হুসেন: (পূর্ব বাংলা: মুসলিম): স্যার, আমি  এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই এবং আমি আত্মবিশ্বাসী যে পাকিস্তানের মানুষের শুধুমাত্র একে স্বাগতই জানাবে না বরং সংবর্ধিত করবেজনাব লিয়াকত আলী খানকে তাদের মতামত প্রকাশের ব্যবস্থা করার জন্য।

পাকিস্তান, যার মৌলিক ভিত্তি ইসলাম,সেখানে অবশ্যই জনগণের মতামতের একটাবিবেচনা থাকা দরকার বিশেষ করে তখন যখন তার জনপ্রতিনিধিদের উপর একটা কাজের দায়িত্ব দেন। এটা চাওয়া ছিল এমন একটি সুস্থ পদক্ষেপ যা সম্ভবত আগ্রহী দলগুলোর দ্বারা তৈরি করা যায় এবং এই অবশ্যই একটি গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ।এটা প্রতিয়মান হয় যে, কিছু বিশ্বস্ত সমর্থক যারা নিজেদের সাড়ে চার কোটি পাকিস্তানীদের মুখপাত্র হিসেবে বিবেচনা করেন, তারা ঘোষণা দিয়েছেন যে  সংবিধানের মূলনীতির যেই আকারই গৃহীত হোক সেটা নিয়ে কোন আন্দলোন হবে না।

আমি ভয় পাচ্ছি যদি পাকিস্তানের জনসংখ্যা সমস্যার বিষয়ে জরুরী ভিত্তিতে তটস্থ না হয়, কোন সমাধানই মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনবে ন..এটা শুধুমাত্র একটি অধ্যায়ের জন্য ভাল হতে পারে কিন্তু অধিকাংশই বিপর্যয়মূলক হবে।

যখন সংবিধানের একটিমূলনীতি সংক্রান্ত পরামর্শ প্রদানের জন্য সুযোগ দেওয়া হয়, আমি যারা পরামর্শ দেওয়ার জন্য আগ্রহী,তাদের অনুরোধ জানাবো এগিয়ে আসতে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গঠনমূলক পরামর্শ বের করার জন্য আহবান করবো….

 

 

<001.049.214>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ বাংলা ভাষার বিভিন্ন সরলীকরণ প্রচেষ্টার__নও বাহার (সাপ্তাহিক)__মার্চ, ১৯৫১ একটি নমুনা ও তার প্রতিক্রিয়া সম্পাদকীয়ঃ গণ-শীকখা পরীশদঃ* আর কিছু হউক না হউক দুনীতি দমন বিভাগের ডি,আই,জি জনাব আবুল হাসানাৎ সাহেবের কল্যাণে পূর্বপাকিস্তানে ভাষা, হরফ এবং বানানের সংস্কার খুব দ্রুত গতিতে অগ্রসর হইতেছে। উশ্রী জলপ্রপাতের মতই এই সংস্কারের ধারা গৈরিক নিস্রাবে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য ও সংস্কৃতির শ্যামল ক্ষেত্রের উপর দিয়া বহিয়া চলিয়াছে। উশ্রীরৎ পাদদেশই সম্প্রতি “গণ-শীকখা পরীশদ” স্থাপিত হইয়াছে। ভাষা, হরফ এবং বানানের সংস্কার শেষ হইয়া যাওয়ার পর জনাব আবুল হাসানাৎ সাহেব এখন “গণ-শীকখা” লইয়া মাতিয়া উঠিয়াছেন। এই পরীশদ হইতে তিনি নিম্নলিখিত এশতেহার জারী করিয়াছেন।

প্রতি                                                                                                                                                          উশ্রী ,রমনা, ঢাকা

ম্যানেজার

প্রেসিডেন্সি প্রিন্টিং ওয়ার্কস

ঢাকা ।

জনাব ,

অনুগ্রহ করে ৩জন অথবা ৪জন মেধাবী কম্পজিটর(যে ব্যক্তি ছাপার অক্ষর সাজায়)সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টার মধ্যে সান্ধ্য ক্লাসে অংশগ্রহনের জন্য গণশিক্ষা পরিষদের প্রধান কার্যালয়ে পাঠান আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যে কিভাবে উন্নত বাংলা কাগজপত্র/ ফর্দ লিখতে হয়।আশা করছি যে তারা এই ক্লাসগুলিতে তিনদিন অংশগ্রহণ করলেই কম্পজিটররা নিজেরাই যে কোনো বিষয়েই তারা পুরাতন বাংলা অক্ষরগুলো সঠিকভাবে সুবিন্যস্ত ভাবে সাজাতে সক্ষম হবে।

ইহা খুব জরুরী আপনার প্রকাশনার জন্য এবং পাক্ষিক পত্রিকার কাজের জন্য কাজের কথা তৎক্ষণাৎ শুরু করতে পারবেন।

আপনার বিশ্বস্ত

আবুল হাসনাৎ

যুগ্ম সচিব

গণশিক্ষা পরিষদ

<001.049.215>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

আপনার রেফারেন্সে “নাও বাহার”এর সম্পাদকের কাছে অনুলিপি পাঠানো হয়েছিলো ৭-৩-৫১ তারিখের স্মারকলিপি সহ এবংসভার আলোচনায় অন্ততপক্ষে কিছু বিষয় তাদের পত্রিকা অথবা সাময়িক পত্রিকায় প্রতিদিন ছাপানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। এটাও অনুরোধ করা হলো যে তারা যেনো তাদের কম্পজিটরদেরকে পাঠায় যাতে করে কাগজপত্র এবং সংবাদপত্রের কিছু কলামগুলোতে তাদের শিক্ষানুযায়ী সংশোধন করে সুবিন্যস্ত করতে পারে।

আবুল হাসনাৎ

যুগ্ম সচিব

গণশিক্ষা পরিষদ

অন্য আর একটি এশতেহারে তিনি বলিতেছেন:

১৫-৩-১৯৫১

জনাব,

আমি আপনার অধীনে নেতৃত্বদানকারী বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের দুটি সভা এবং তাদের দ্বারা গৃহীত প্রস্তাবের একটি অনুলিপি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি।সম্ভাব্য সকল উপায়ে একটি মহৎ কারণে ঋণ সহায়তার জন্য আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

নতুন পান্ডুলিপিটি পত্রিকা, জার্নাল ইত্যাদির কলামে পরীক্ষামূলকভাবে মালিকানাধীন,সম্পাদিত বা প্রস্তাব নং ২ অনুযায়ী আপনারসমর্থিত কল্যাণকর কাজ হিসেবে দেয়া যেতে পারে। তাছাড়া আমাদের কার্যক্রম সাহিত্যকে ঘিরেই থাকবে।

আপনার বিশ্বস্ত

আবুল হাসনাৎ

৭-৩-১৯৫১

পূর্ব পাকিস্তানে কে রাজা, কে প্রজা, কে শাসক, কে শাসিত- কিছুই বুঝা যায় না। গত ১৯৪৯ সালে গভর্ণমেন্ট একটি ভাষা-কমিটি (লেংগুয়েজ কমিটি) নিযুক্ত করেন, প্রায় দেড় বৎসর পর এই কমিটি নাকি তাঁদের রিপোর্ট দাখিল করিয়াছেন। জনাব আবুল হাসানাৎ সাহেব সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। কমিটির রিপোর্ট এখনো সরকারের বিবেচনাধীন। কাজেই এই সম্বন্ধে এখনও কোন স্থির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নাই। দেশের কবিসাহিত্যিক এবং অন্যান্য চিন্তাশীল মনীষীরাও কমিটির সুপারিশগুলি সম্বন্ধে একমত নহেন। অথচ এই অবস্থায় জনাব আবুল হাসানাৎ সাহেব তাঁর এই খেয়ালী ভাষা, হরফ এবং নূতন বানান চালু করিয়া দিতেছেন এবং সরকারী হুকুমের ঢং-এ সমস্ত পত্রিকা ও প্রেসকে নূতন হরফে এবং নূতন বানান পদ্ধতিতে ছাপা শুরু করিতে আদেশ দিতেছেন। ভাষা-সংস্কার কমিটির সুপারিশ সরকার কর্তৃক গৃহীত হইলে সরকারই তখন তাহা চালু করিবার জন্য চেষ্টিত হইবেন। তাহার আগেই কোন ব্যক্তিবিশেষ এরূপ নির্দেশ দিতে পারেন, ইহা আমাদের জানা ছিল না। এরূপ কাৰ্য্য শাসনতন্ত্রের নিয়মানুবর্তিতার বরখেলাফ রিপোর্ট দাখিল করিবার সংগে সংগে ভাষাকমিটির মেম্বারদিগের কার্য্য খতম হইয়াছে। বাকী কাজ গভর্ণমেন্টের। জনাব আবুল হাসানাৎ সাহেবের এইসব নিৰ্দ্দেশের পিছনে গভর্ণমেন্টের কোন সম্মতি আছে কিনা, আমরা জানিতে চাই। যদি না থাকে, তবে আমরা ইহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি।

<001.049.216>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

জনাব আবুল হাসানাৎ সাহেব কলিকাতা এবং ঢাকার প্রেসিডেন্সী লাইব্রেরীর সহিত সংশ্লিষ্ট আছেন। সেই লাইব্রেরী হইতে নাকি পাক্ষিক পত্র “কাজের কথা’ বাহির হইবে। এই সব কর্ম-তৎপরতার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কি, বুঝা যাইতেছে না। একটা খামখেয়ালীর ভাব সর্বত্র বিরাজমান। উপরের উদ্ধৃত ইংরেজী অংশগুলির ভাষা, শব্দ-বিন্যাস এবং ব্যাকরণ রীতির মধ্যেও যথেষ্ট চন্দ্রালোকের ছাপ পড়িয়াছে। আবুল হাসানাৎ সাহেব বাংলা ব্যাকরণকে মানেন না বলিয়া ইংরাজী ব্যাকরণকেও বৃদ্ধাংগুলি দেখাইয়াছেন দেখিতেছি, প্রথম চিঠির শেষোক্ত প্যারাই তার প্রমাণ। তাঁর মত বিচক্ষণ ব্যক্তির নিকট হইতে আমরা অধিকতর শালীনতা আশা করি। এই প্রসংগে পূর্ব-পাক গভর্ণমেন্টের নিকটও আমাদের আরজ, জনাব আবুল হাসানাৎ সাহেবকে পুলিশের ডিআইজি, পদ হইতে অপসারিত করিয়া ভাষা সংস্কারে ও গণশিক্ষার ডি,আই,জি, পদে নিযুক্ত করুন। তাঁহার স্বাভাবিক প্রতিভা যখন এই দিকেই রহিয়াছে, তখন তাঁহাকে কেন অনর্থক ডি,আই,জি পদের গুরুদায়িত্ব দিয়ো আটক রাখা হয়? ইহার ফলে তাঁহার নিজের সরকারী কাজও তিনি ভালভাবে করিতে পারেন না। তবে গভর্ণমেন্টের পলিসী যদি এমন হয় যে, এক পদে থাকিয়া অন্য পদের কাজ যিনি যত করিতে পরিবেন, তিনি ততই সুযোগ্য কৰ্ম্মচারী বলিয়া বিবেচিত হইবেন, তাহা হইলে আমাদের আর কোন আপত্তির কারণ রহিবে না। তখন শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টর হইবেন এমন ব্যক্তি যিনি লেখাপড়া জানেন না। শিক্ষা বিভাগের সেক্রেটারীর কাজ হইবে নাটক লেখা, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাজ হইবে সাহিত্য ও কাব্য লইয়া রসালাপ করা, ইনকামট্যাক্স অফিসারের কাজ হইবে মাসিক পত্র বাহির করা, আর পুলিশের কাজ হইবে ভাষা সংস্কার করা। সেই রূপ পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টএর কাজ হইবে কোন কিছু পাবলিশ না করা। এরূপ হইরে আমাদের কিছুই বলিবার নাই। গভর্ণমেন্টের নিকট আমরা জানিতে চাই জনাব আবুল হাসানাৎ সাহেবের এই সব কার্য্যের পশ্চাতে তাঁহাদের কোন সম্মতি (চেংসান) আছে কিনা। যদি থাকে, তবে নিশ্চয়ই আমরা জনাব হাসানাৎ সাহেবের নির্দেশ মানিয়া চলিব এবং অচিরেই ২-৪ জন কম্পোজিটার পাঠাইয়া দিব- যাহাতে নূতন হরফে ও বানান অনুযায়ী মাত্র তিন দিন কম্পোজিং শিখিয়া আসিয়াই নির্ভুলভাবে পুরাতন রীতি অনুসারেই তাহারা কম্পোজ করিতে পারে। কি অপূর্ব তেলেছমাৎ, কিন্তু আমাদের মনে হয়, কম্পোজিটারেরা ইহাতে রাজী হইবে না। ভুল বানান নির্ভুলভাবে শিখিবার ভুল তাহারা কেন করিবে?

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা ভাষার উপর বিভিন্ন ধরনের আঘাত হানা হয়। ভাষাকে সরলীকরণ বা আরবী হরফে বাংলা পরিবর্তনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে। এখানে এই প্রচেষ্টাটিকে নমুনা হিসেবে দেওয়া হয়েছে।

<001.050.217>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ উর্দু ভাষাকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার পক্ষে মাহে নও জুলাই, ১৯৫১ বক্তব্য উর্দুর ভূমিকা ফজলুর রহমান উর্দু বিভিন্ন ভাষার উপাদানের একটা সংমিশ্রণ এবং যারা উর্দুকে মাতৃভাষা বলে দাবী করেননি তাঁরাও উর্দুর তরান্ধীর পথে অনেক খোরাক জুগিয়েছেন। পাক-ভারত উপমহাদেশের ভাষার ক্ষেত্রে উর্দু বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগণকে এক গ্রন্থিতে সংযুক্ত করেছে। বিরোধী সমালোচকরা যাই বলুক না কেন প্রথম উর্দুর মধ্যেই এই উপমহাদেশের আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা সমস্যার সমাধান সম্ভবপর হয়েছিল। বিভিন্ন ভাষা দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে যে উর্দু তার সার্বজনীন গ্রহণ ক্ষমতা দ্বারাই ইহা সম্ভবপর হয়েছে। উর্দু সাহিত্যে যদিও কিছুটা আভিজাত্যের ছাপ আছে, তবু উর্দু ভাষার দেশের জনগণের সংগে অতি নিকট সম্পর্ক রয়েছে। তার জন্যই উর্দু কৃতিত্বের সংগে ও হিন্দু শাসকদের মারাত্মক আক্রমণের মোকাবেলা বৃটিশ ও জনগণের মনে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। আমাদের এই গোলযোগপূর্ণ ঝড়-ঝঞ্চ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর আমাদের ভাবী বংশধরগণ কতকগুলো অপূর্ব অবদানের জন্য পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের এই মুসলমান যুগটিকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে। প্রথমতঃ- স্থায়ী কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার জন্য দায়ী এই আদর্শ শাসন ব্যবস্থার ফলে দেশের পৃথক পৃথক অংশগুলো একই গ্রন্থিতে সংযোজিত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ- দুনিয়ার কতকগুলো অতি সুন্দর স্থপতি শিল্পের জন্য। তৃতীয়তঃ- উর্দু ভাষার ক্রমবিকাশের জন্য এই ভাষা আঞ্চলিক বাধা বিদূরিত করে দূর-দূরান্তের জনগণের নৈকট্য সাধন করেছে ও স্বাধীনভাবে আলাপ-আলোচনা ও ভাবের আদান-প্রদান করার সুযোগ দিয়েছে। শেষোক্ত দানটি প্রথমোক্ত দুইটার চাইতে অধিক স্থায়ী, কারণ শেষ পর্যন্ত বস্তুগত অলংকার অপেক্ষা সাহিত্য এবং কৃষ্টিই মনুষ্যজীবনে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়। বস্তুগত অলংকার ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায়; কিন্তু আদর্শ ও ভাবধারা বেঁচে থাকে। ভাষা স্বতন্ত্রভাবে সমৃদ্ধশালী হয় না। ব্যবহারকারী জনগণের বাণীই ভাষা। কাজেই মুসলমানদিগকে একটা জাতি হিসাবে টিকে থাকার সংগ্রাম আর উর্দুকে জিইয়ে রাখার সংগ্রাম একই কথা। লক্ষ লক্ষ অমুসলমানের ভাষা ছিল এই উর্দু কিন্তু দেশ বিভাগের পূর্বে তারা উর্দুর দাবীকে প্রকাশ্যভাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা করতে থাকে ও ইহার মর্যাদাহীন করতে প্রবৃত্ত হয়। এই সংগ্রামে উর্দুই এই উপমহাদেশের মুসলিম তমদ্দুন ও তাহজীবের সাহিত্য ভাণ্ডাররূপে পরিগণিত হয়েছিল। যে সকল মুসলমান উর্দুকে তাদের মাতৃভাষা বলে দাবী করেননি, তাঁরাও এ বিষয়টা উপলব্ধি করেছিলেন এবং উর্দুই তাঁদের জাতিত্ববোধের অন্যতম সহায়ক হয়েছিল। ইতিহাস আজ উর্দুকে বিবিধ ভূমিকায় গ্রহণের ইশারা দিচ্ছে। উর্দু আজ পাকিস্তান ভারতের মধ্যে মৈত্রী বন্ধনের সেতু নির্মাণ করছে এবং পাকিস্তান তার নিজের তরফ থেকেও এই সেতু অটুট রাখার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমরা আশা করি, অপর দিক থেকে শুভেচ্ছাকারীরাও উর্দুর ঐতিহাসিক ও তামুদুনিক বিশেষত্বের প্রশংসা করবেন। পাকিস্তানে উর্দুর মাধ্যমেই আন্তঃপ্রাদেশিক আলাপ-আলোচনা ও সংবাদাদি আদান-প্রদান চলবে। উর্দু যদিও এদেশের লোকের মাতৃভাষা নয়; তথাপি ইহা তাঁদের মৌলিক ভাবধারার উপরই প্রতিষ্ঠিত এক দলের মতে পাঞ্জাব এবং অন্য দলের মতে সিন্ধু উর্দুর উৎপত্তি স্থান। সে যাই হোক, উর্দু সর্বদাই আমাদের দেশের শিক্ষিত

<001.050.218>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

খন্ড লোকদের নিকট নিজ ভাষারূপে প্রিয় হয়ে রয়েছে। যুগ যুগ ধরে লাহোর ও ঢাকা উর্দুকে সমৃদ্ধিশালী করে শিক্ষার বাহনরূপে গ্রহণ করা হয়েছে। সিন্ধু প্রদেশেও উত্তরোত্তর উর্দুর জনপ্রিয়তা বেড়ে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে তাদের দ্বিতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছে এবং আমি নিঃসংশয়ে বলতে পারি যে, উর্দু এবং বাংলা পরস্পরের সংমিশ্রণে উভয় ভাষাকেই সমৃদ্ধিশালী করবে। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার অব্যবহিত পরে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে করাচীতে পাকিস্তান এডুকেশনাল কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে উর্দুকেই আমাদের দেশের জাতীয় ভাষা বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৪৮ সালের প্রথম ভাগে বাবায়ে মিল্লাৎ মরহুম কায়েদে আজম পূর্ব বংগে শুভাগমন করেন এবং তিনিও এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। পাকিস্তান এডুকশেনাল কনফারেন্স এবং এডুকেশন এডভাইজারী বোর্ড আরো সুপারিশ করেন যে, যে সকল এলাকায় উর্দুকে অবশ্য পঠনীয় বিষয়রপে গ্রহণ করতে হবে। পূর্ব বংগ ও সিন্ধু প্রাদেশিক সরকার এই সুপারিশ গ্রহণ করেছেন এবং ইহা কাৰ্য্যে পরিণত করার কাজও আরম্ভ করে দিয়েছেন। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বোর্ডের সমর্থনানুসারে শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ইংরেজীর পরিবর্তে উর্দুকে শিক্ষার বাহন করার জন্যও সুপারিশ করেছন। এ প্রসংগে আমি এ কথা বলতে চাই যে, প্রত্যেক ভাষাই তার নিজস্ব গতিশীলতা দ্বারা পরিচালিত হয় এবং প্রত্যক ভাষার মান নিণীত হয় সাহিত্য এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে তার অবদান দ্বারা। সাহিত্যের প্রসার বিরাট হলেই চলবে না। মানুষের আত্মার সংগে সংযোগ স্থাপনের জন্য তার গভীরতার প্রয়োজন আছে। তাছাড়া বিশ্ব সভ্যতার উন্নয়নের জন্য তার দান থাকা উচিত। আমাদের আজাদী লাভের পর থেকেই উর্দুর উপর নতুন দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। উর্দুকে এই চ্যালেঞ্জ’ গ্রহণ করতেই হবে। সর্বকালে গ্রহণীয় প্রাচীন উর্দু সাহিত্য রক্ষার্থে আমাদের অনতিবিলম্বে যত্নবান হওয়া উচিত। পাকিস্তানেই প্রাচীন সাহিত্য পর্যায়ক্রমে মুদ্রিত হওয়া উচিত। আমার বিশ্বাস যে, আমাদের সাহিত্য প্রতিষ্ঠানগুলো এবং প্রকাশকগণ এই মহৎ কার্য্যে সহযোগিতা করবেন। বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মাপকাঠি দিয়েই অতীতের রূপ নির্ণয় করতে হবে। সাহিত্যকেও ঐতিহ্যপূর্ণ হতে হলে তা পারিপার্শ্বিকতাকে এবং বর্তমানকালকে অতিক্রম করে বহু উর্ধ্বে উঠতে হবে অথচ তাদের সংগে সম্বন্ধও পেয়েছে গোটা পাক-ভারত উপমহাদেশের একাধিক ভাষা থেকে শব্দ সঞ্চয়নের দ্বারা। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, উর্দুর মাধ্যমে পাকিস্তানের জনশিক্ষা প্রসারের সংগে সংগে তাতে বাংলা, সিন্ধি ও পোশত ভাষার শব্দেরও ছাপ থাকবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যারা উর্দুর শুভাকাঙ্খী তারা উর্দুর এই সার্বজনীনতাকে সম্ভাষণই জানাবেন। আমি আশা করি, আমাদের দেশের লেখক এবং বুদ্ধিজীবীগণ পাকিস্তানের বিভিন্ন আশা-আকাঙ্খা এবং সমস্যা দ্বারা প্রভাবান্বিত হবেন এবং উর্দু সাহিত্যের তরক্কী সাধনে ব্রত হবেন। আঞ্জুমানে তরক্কীয় উর্দু ও ইহার অধ্যবসায়ী সভাপতি মৌলবী আবদুল হক সাহেবকে শুকরিয়া আদায় করে কথিত আছে যে, কোন একটা প্রতিষ্ঠান একটি ব্যক্তিত্বের প্রতিবিম্বস্বরূপ। আঞ্জুমান ও মৌলবী আবদুল হক সাহেবের মধ্যে যে সম্পর্ক সে সম্পর্ক এই স্বতঃসিদ্ধ পুরোপুরিভাবেই প্রযোজ্য। এই আঞ্জুমানের মারফত উর্দুর তরকীর জন্য তিনি আজীবন যে সেবা করেছেন, তা আমাদের সাহিত্য ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, তার যোগ্য পরিচালনায় উর্দু কনফারেন্স উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের তরকীর জন্য নতুন পথের সন্ধান দেবে। ১৯৫১ সালের ১৫ই এপ্রিল করাচীতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান উর্দু কনফারেন্সে পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্য ও শিক্ষাসচিব মাননীয় ফজলুর রহমানের উদ্বোধনী বক্তৃতা।

 

 

<001.051.219>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

 

<001.053.230>

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ একুশে ফেব্রুয়ারী:আন্দোলনের একুশে ফেব্রুয়ার (সংকলন) ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ ঘটনাপঞ্জী একুশের ইতিহাস কবির উদ্দিন আহমদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে ১৯৪৮ সনে ঢাকার অগ্রণী ছাত্রসমাজ ও সংস্কৃতিবান বুদ্ধিজীবীরা প্রথম আওয়াজ তুলেছিল। তখন থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। সেদিনও ছাত্র সমাজ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রচণ্ড আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, সরকারের চূড়ান্ত দমননীতি নেমে এসেছিল তাদের উপর। ছাত্র জনতার দুর্বার শক্তির সন্মুখে বিশ্বাসঘাতক নাজিমুদ্দিন সরকার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীকে স্বীকার করে প্রস্তাব পাশ করেছিলেন ও গণপরিষদের কাছে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা আন্দোলনে ধৃত সকল বন্দীদের মুক্তি দিয়ে এবং অন্যতম কর্মী ও নেতৃবৃন্দের উপর থেকে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা প্রত্যাহার করে ঢাকার অবাঞ্চিত পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সনের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের পর প্রায় চার-চার বছর (১৯৫২) কেটে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষার দাবীকে সম্পূর্ণ ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, নাজিমুউদ্দিন সরকার তার নিজের প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করেছে। লীগ সরকারের এমনি বিশ্বাসঘাতকতাই জনসাধারণের মনে পুঞ্জীভূত অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল। ২৬ শে জানুয়ারী পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবর্তের প্রবাহচক্রে নাজিমুউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন। ১৯৫২ সনে পূর্ববঙ্গ সফরকালে ২৬শে জানুয়ারী পল্টন, ময়দানে এক জনসভায় তিনি পুনরায় নির্লজের মত “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র-ভাষা হবে” বলে ঘোষণা করলেন। এই বক্তৃতা প্রদেশের অসন্তোষ-ভরা জনমনকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ঢাকায় এবং প্রদেশের সর্বত্র তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। সভা-সমিতির মধ্য দিয়ে সংঘটিত প্রতিবাদ উঠতে লাগলো দিকে দিকে। ৩০শে জানুয়ারী নাজিমুদিনের স্বৈরাচারী ঘোষণার প্রতিবাদে ঢাকার ছাত্র-সমাজ সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলবার সংকল্প গ্রহণ করলো। ৩০শে জানুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পূর্ণ ধর্মঘট ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র সভা করে রাষ্ট্রভাষা বাঙলার দাবীকে সামগ্রিক কষ্ঠে পুনরুত্থান করল। এই পুনরুত্থাপনের নেতৃত্ব গ্রহণ করল “ বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র-ভাষা কমিটি”। ১৯৪৮ সনের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের নির্যাতিত ছাত্র-কর্মীরা নাজিমুদিনের বিশ্বাসঘাতকতার স্বরূপ উপলদ্ধি করতে পেরে ভাষা আন্দোলনকে জীইয়ে রাখার জন্যে জনাব আবদুল মতিনকে আহবায়ক করে “বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি” গঠন করে। এই রাষ্ট্রভাষা কমিটিই প্রতি বৎসর ১১ই মার্চ “রাষ্ট্রভাষা দিবস’ উদযাপন করতে এবং এই কমিটিই ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলনকে প্রথম সংগঠিত রূপ দেয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ সেই ৩০শে জানুয়ারী বৈকালে বার লাইব্রেরী হলে ঢাকার ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিবিদ ও রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক নিযুক্ত করে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন করা হয়।

<001.053.231>

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

 

৪ঠা ফেব্রুয়ারী এই সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হবার পর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে প্রায় ৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর এক সুদীর্ঘ মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। বৈকালে কর্মপরিষদের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জননেতা মওলানা ভাসানী, আবুল হাশেম ও অন্যান্য রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা লীগ সরকারের জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র নিন্দা করেন এবং বাংলা ভাষার দাবী সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সেই দিনই, ২১শে ফেব্রুয়ারী অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার দাবীতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহবান দেওয়া হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রস্তুতি ৪ঠা ফেব্রুয়ারী থেকে ২০শে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সাধারণ ধর্মঘটের জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রচার প্রস্তুতি চলতে থাকে। ঢাকার রাজনৈতিক আবহাওয়াকে কেন্দ্র করে সমগ্র প্রদেশের জনমনে তখন বিক্ষোভের আগুন জুলতে থাকে। স্বরাজোত্তর কালে সরকার বিভিন্ন উৎপীড়নমূলক নীতির মধ্য দিয়ে জাতীয় জীবনে যে প্রাণধ্বংসী ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছিল, তারই প্রত্যক্ষ আঘাতের ফলে জনসাধারণে সৃষ্টি খুলে গেছে, অন্ধ মোহ কেটে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে ভাষার কণ্ঠরোধ করার নতুন ষড়যন্ত্র তাদের অসন্তোষকে দ্বিগুণতর করে দিয়েছে। সমগ্র প্রদেশ তখন প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। দিন দিন অবস্থার দ্রুত পরিবর্তনও পরিলক্ষিত হচ্ছে। একদিকে ২১শে ফেব্রুয়ারীর জন্য জনসাধারণের ধর্মঘটের প্রস্তুতি অন্যদিকে ঐদিনই পূর্ববঙ্গ সরকারের বাজেট অধিবেশন উপলক্ষে গণ-শক্তির ভয়ে ভীত সরকার নিজেদের অসহায় মনে করে ২০শে ফেব্রুয়ারী রাত্রি থেকে ক্রমাগত এক মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র ধর্মঘট, সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারী করল। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরের আবহাওয়ার অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা দিল। রিক্সাওয়ালা, গাড়ীওয়ালা, দোকানদার থেকে শুরু করে ছাত্র, কেরাণী, অফিসার ও রাজনৈতিক মহল পর্যন্ত সর্বত্র প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার হলো। সকল মহলেই ১৪৪ ধারার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল, সারা শহরময় একটা থমথমে ভাব বিদ্যমান থাকে। একদিকে চূড়ান্ত সরকারী দমননীতি অন্যদিকে জনসাধারণের তীব্র অসন্তোষ-এমতাবস্থায় কর্তব্য নির্ধারণের জন্য “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের” এর জরুরী সভা আহবান করা হল। সঙ্গে সঙ্গে সলিমুল্লাহ হলের ছাত্ররাও এক জরুরী বৈঠক সমবেত হয়ে পরিস্থিতির ব্যাপক পর্যালোচনা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সংগ্রামের কৌশল নিৰ্দ্ধারণ করতে গিয়ে সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সদস্যদের মধ্যে তুমুল বিতণ্ডর সৃষ্টি হয়। জনাব ওলী আহাদ পরিস্থিতির সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিলেন যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলনে অগ্রসর না হলে ভাষা আন্দোলনের এখানেই অনিবার্য মৃত্যু ঘটবে, আর সরকারী দমননীতির নিকটও বশ্যতা স্বীকার করা হবে, সর্বোপরি জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। ইতিমধ্যেই সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রদের সভা থেকে দুইজন প্রতিনিধি সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সভায় এসে উক্ত হলের ছাত্রসাধারণের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সর্বসম্মত অভিমত জানিয়ে দেয়। এতদসত্ত্বেও উক্ত সভার অধিকাংশ সদস্যই সরকারী দমননীতিকে মেনে নেওয়ার পক্ষে মন্তব্য করেন এবং অবশেষে ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সঙ্গে সঙ্গে আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, যদি ছাত্র ও জনসাধারণের কোন অংশ সর্বদলীয় কর্মপরিষদের এই সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন চালিয়ে যায় তবে স্বাভাবিকভাবেই এই সর্বদলীয় কর্মপরিষদ বাতিল হয়ে যাবে বলে ধরে নেওয়া হবে।

 

 

<001.053.232>

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

২১শে ফেব্রুয়ারী এই দিন সকাল থেকেই শহরের সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটা চরম ঘৃণা ও ত্রাসের সঞ্চার হয়েছে। কর্মীদের প্রবল প্রচারকার্যের ফলে জনসাধারণের মধ্যে আগে থেকেই ধর্মঘটের অনুকূলে মনোভাব সৃষ্টি হয়ে রয়েছে। কর্মীদের প্রচেষ্টায় শহরের সকল অঞ্চলের দোকান-পাট, গাড়ী-ঘোড়া, যানবাহন ও স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। বেলা ১২টার মধ্যে সকল স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে এসে হাজির হলো। প্রায় সাড়ে ১২টার সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জনাব গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠত হল। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহবায়ক জনাব আবদুল মতিন আন্দোলনের পূর্বাপর পর্যায়ও ১৪৪ ধারা প্রবর্তনের ফলে উদ্ভূত বিশেষ সঙ্কটজনক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলেন এবং সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মতামতের উপরই ১৪৪ ধারা সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন। তখনই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে জনাব শাসমলুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে শান্তি পূর্ণভাবে আন্দোলন চালাবার জন্য বৃক্ততা দিলেন। কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলন সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখে বিপর্যন্ত হয়ে তিনি তাঁর সহকর্মীগণসহ সভা থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। অতঃপর ব্যাপকতম পর্যালোচনার পর ভাষার দাবীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য পরিস্থিতির মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ছাত্ররা সৃদৃঢ় আত্মচেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে সংহত অভিমত ঘোষণা করল। সঙ্গে সঙ্গে সভা ভঙ্গ করে “দশজনী মিছিল” বের করার জন্য ছাত্ররা শ্লোগন দিতে দিতে গেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। গেটের বাইরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল আইবি ও পুলিশ বাহিনী। ছাত্রদের প্রথম দশজনী মিশিল’ শ্লোগান দিয়ে বের হতেই পুলিশ এসে গ্রেফতার করে তাদের ট্রাকে ভর্তি করে। দেখতে দেখতেই অসংখ্য ছাত্রকে গ্রেফতার করে অনেকগুলি ট্রাকে ভরে তাদের লালবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এত গ্রেফতারের পরও ছাত্রদের দমন করতে না পেরে তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ তখন কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ল রাস্তার পাশে আর বিশ্ববিদ্যায়ের প্রাঙ্গণে। উপর্যুপরি কয়েকবার কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ার পর ছাত্ররা যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরে ঝাঁপ দিতে থাকে। অনেকেই আবার কাঁদুনে গ্যাসে আহত হয়ে পড়ে রইল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। ছাত্ররা তখন উত্তেজনা আর যন্ত্রণায় অধিকতর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। প্রায় বেলা ২টা পর্যন্ত মিছিল করে ছাত্ররা বীরত্বের সঙ্গে গ্রেফতারী বরণ করতে থাকে, আর ধীরে ধীরে তারা মেডিকেল কলেজ হোষ্টেল, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেটে গিয়ে জমায়েত হতে থাকে। দলবদ্ধ হয়ে শ্লোগান দিয়ে বের হতেই উদ্ধত পুলিশ বাহিনী এসে তাড়া করে। বেলা প্রায় সোয়া তিনটি সময় এম,এল,এ ও মন্ত্রীরা মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে পরিষদ ভবনে আসতে থাকে। ছাত্ররা যতই শ্লোগান দেয় আর মিছিলে একত্রিত হয় ততই পুলিশ তাদের ওপর বেপরোয়া হানা দিতে থাকে। কয়েকবার ছাত্রদের উপর কাঁদুনে উপর আক্রমণ করায় এরপর ছাত্ররা বাধ্য হয়ে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। একদিকে ইট-পাটকেল আর অন্যদিক থেকে তার পরিবর্তে কাঁদুনে গ্যাস আর লাঠিচার্জ আসে। পুলিশ তখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছাত্রদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই আবদুল জববার ও রফিকউদ্দিন আহম্মদ শহীদ হন, আর ১৭ জনের মত গুরুততভাবে আহত হন। তাঁদের হাসপাতালে সরানো হয়। তাঁদের মধ্যে রাত আটটায় সময় আবুল বরকত শহীদ श्ना। গুলীচালনার সাথে সাথেই পরিস্থিতির অচিন্তানীয় পরিবর্তন সাধিত হয়। তখন ছাত্র-ছাত্রীদের চোখে-মুখে যেন ক্রোধ আর প্রতিহিংসার আগুন ঝরতে থাকে। মেডিক্যাল হোষ্টেলের মাইক দিয়ে তখন পুলিশী হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। আইন পরিষদের সদস্যের প্রতি ছাত্রদের উপর গুলী চালাবার প্রতিবাদে অধিবেশন বর্জন করার দাবীও জানান হয়। ১৪৪ ধারার নাম-নিশানাও তখন আর পরিলক্ষিত হয় না। গুলীচালনার সংবাদ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে শহরের প্রান্তে প্রান্তে। তখনই অফিস-আদালত, সেক্রেটারিয়েট ও বেতার কেন্দ্রের

 

 

<001.053.233>

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

কর্মচারীরা অফিস বর্জন করে বেরিয়ে আসে। শহরে সমস্ত লোক তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে মেডিক্যাল হোষ্টেল প্রাঙ্গণে এসে হাজির হতে থাকে। রাস্তায় আর অলিতে-গলিতে যেন ঢাকার বিক্ষুব্ধ মানুষের ঝড় বয়ে চলে প্রবল বেগে। মেডিক্যাল হোষ্টেলের ব্যারাকে ব্যারাকে শহীদদের রক্তরঞ্জিত বস্ত্রের পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। মাইক দিয়ে যখন শহীদানের নাম-ঠিকানা ঘোষণা করা হচ্ছিল তখন সমস্ত মানুষের মন থেকে যেন সমস্ত ভয়-ত্ৰাস মুছে গেছে, চোখে-মুখে সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়ে বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিরোধের দুর্জয় শপথ প্রকাশিত হয়ে উঠেছে প্রতিটি মুখের রেখায় রেখায়। বাইরের এমনি তুমুল পরিস্থিতির ঢেউ এসে লেগেছে পরিষদ কক্ষে। পরিষদের বিরোধী দলের সদস্যরা নুরুল আমিনের কাছে ছাত্রদের উপর গুলীচালনার কৈফিয়ৎ দাবী করেন এবং পরিষদ মুলতুবি রাখার দাবী জানান। নুরুল আমিন সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, “কয়েকজন ছাত্র গুরুতররূপে আহত হয়েছে শুনে আমি ব্যথিত হয়েছি, তাই বলে আমাদেরকে ভাবাবেগে চালিত হলে চলবে না।” পরিষদ কক্ষেই এমনি জঘন্য মনোবৃত্তির তীব্র প্রতিবাদ উঠলো। লীগ পরিষদ দলের জনাব তর্কবাগীশ বলে উঠলেন, “আমাদের ছাত্ৰগণ যখন শাহাদাত বরণ করেছেন তখন আমরা আরামে পাখার হাওয়া খেতে থাকব তা আমি বরদাশত করব না।” -এই বলেই তিনি পরিষদ কক্ষ বর্জন করে এসে ছাত্রদের মাইকে পুলিশী বর্বরতার প্রতিবাদে ও আন্দোলনের সপক্ষে বক্তৃতা করলেন। রাত্রে পূর্ব হতে জারীকৃত সান্ধ্য আইন আর ১৪৪ ধারার বিন্দুমাত্র চিহ্নও কোথাও রইল না। শহর আর হল যারা শহীদ হলো তারা যেন মৃত্যুহীন, তারা যেন বাংলার সকল ধর্মের সকল মতের মানুষের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত করেছে এই বধ্যভূমিকে। ২২শে ফেব্রুয়ারী এই দিন ভোর থেকেই সলিমুল্লাহ হল, মেডিক্যাল কলেজ, ফজলুল হক হল, মিটফোর্ড মেডিক্যাল স্কুল, জগন্নাথ কলেজের মাইকগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সকল কর্মী আর ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ সাধনের জন্য আহবান জানান হয়। সকাল বেলা সংবাদপত্রে দেখা গেল মাত্র ৩ জন নিহত, ৩০০ জন আহত ও ১৮০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ছাত্রদের উপর গুলীচালনার সংবাদ শুধু শহরেই নয়, দূর-দূরান্তের গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের সমস্ত দোকান-পাট, গাড়ী-ঘোড়া, অফিস-আদালত, যান-বাহন বন্ধ করে শ্রমিক-মজুর-কেরানী ও কর্মচারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘটে এগিয়ে এসেছে। শহীদদের লাশগুলিকে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মেডিক্যাল হোষ্টেলের ভেতর গায়েবী জানাজা’ পড়া হলো। এদিন সমস্ত শহর মিলিটারীর হাতে দেয়া হয়েছে। তবুও দেখতে দেখতে অসংখ্য মানুষ জানাজায় এসে শরিক হলেন। ইমাম সাহেব মোনাজাত করলেন, “হে আল্লাহ, আমাদের অতি প্রিয় শহীদানের আত্মা যেন চিরশান্তি পায়। আর যে জালিমরা আমাদের প্রাণের প্রিয় ছেলেদের খুন করেছে তারা যেন ধ্বংস হয়ে যায় তোমার দেওয়া এই দুনিয়ার বুক থেকে।” জানাজা শেষে জনসাধারণকে নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। জনাব ওলী আহাদ পরিস্থিতির সামগ্রিক গুরুত্ব বিচার ও কর্মপন্থা ঘোষণা করে বস্তৃতা করলেন। তাঁর মুখ থেকে এক-একটি কথা যেন আগুনের ফুলকির মত বেরুল। সভা শেষ করেই লক্ষাধিক জনতার বিশাল মিছিল বেরোয়। এই শোভাযাত্রার মধ্যখানে হঠাৎ লাঠিচার্জ করার পরও জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে না পেরে গুলী চালায়। এখানে হাইকোর্টের কেরানী সফিউর রহমান শহীদ হন। ছত্রভঙ্গ জনতা তখন হাইকোর্ট আর কার্জন হলের চত্বরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। শোভাযাত্রার প্রথম অংশ তবুও ষ্টেশন ও নবাবপুর হয়ে এগুতে থাকে। শোভাযাত্রার এই অংশ সদরঘাট এলে পুনরায় তাদের

<001.053.234>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

উপর লাঠিচার্জ করা হয়। অনেকেই আহত হয়ে পড়ে রইলো রাস্তায় দু’পাশে। মিছিলটি মিটফোর্ড হয়ে চকবাজার দিকে মেডিক্যাল হোষ্টেলে গিয়ে শেষ হয়। অন্যদিকে সকাল ৯টায় জনসাধারণের এক বিরাট অংশ মর্নিং নিউজ অফিস জুলিয়ে দেয় এবং সংবাদ অফিসের দিকে যেতে থাকে। সংবাদ অফিসের সম্মুখে মিছিলের উপর মিলিটারী বেপরোয়া গুলী চালায়। অনেকেই হতাহত হয় এখানে। এইদিন জনসাধারণের বিভিন্ন অংশ শহরের বিভিন্ন অঞ্চলেও দলবদ্ধ হয়ে শোভাযাত্রা বের করে, আর ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। গ্রাম থেকে গাড়ীওয়ালা, মাঝি-মাল্লা, আর কৃষক-মজুর ছাত্র-শিক্ষকের এসে শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এইদিন সমস্ত অফিস-আদালত, কারখানা, স্কুল-কলেজ, দোকান-পাট, যানবাহন বন্ধ করে তারা মিছিলে যোগ দিয়েছে। শহরের সকল প্রান্ত থেকে জনসাধারণ নিজেরাই মিছিল সংগঠিত করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের রেলওয়ে কারখানায় ধর্মঘট ঘোষিত হয়েছে। কারখানার শ্রমিকরাই রেলের চাকা বন্ধ করতে এগিয়ে এসেছে। প্রায় ১১টা পৰ্য্যন্ত রেল চলাচল একদম বন্ধ থাকে। সবদিক থেকে ব্যাপকতম ধর্মঘটের চাপে সরকার সেদিন বিকল হয়ে পড়েছিল। তারই চাপে পড়ে সেদিন পরিষদে লীগ সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার এবং তার জন্য গণপরিষদের কাছে সুপারিশ করার প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন গুলীচালনার প্রতিবাদে লীগ পার্লামেন্টারী দল বর্জন করেন। ২৩শে ফেব্রুয়ারী গত দুই দিন ধরে পুলিশ-মিলিটারী নিরস্ত্র জনতার উপর বেপরোয়া গুলী চালিয়েছে। শহীদদের লাশগুলি নিয়ে পর্যন্ত সরকার ছিনিমিনি খেলেছে। লাশগুলি কোথায় নিয়ে গেছে তার কোন হদিসই মেলেনি। জনসাধারণের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে- তাদের মনের ক্ষত আরো দ্বিগুণতর হয়ে গেল। শহীদদের লাশ নিয়ে এ অতি পবিত্র এবং অত্যন্ত তাজিমের সহিত দাফন কার্য সম্পন্ন করা বিধেয়। কিন্তু দুই দিনের পুলিশ জুলুমের ফলে শাহাদাতপ্রাপ্ত লাশগুলি ইহাদের অভিভাবকদের ফেরত দেওয়া হয় নাই। শরিয়ত মোতাবেক তাহদের শেষকৃত্য যদি সমাপন না করা হইয়া থাকে তাহা হইলে সরকারকে গোনাহের ভাগী হইতে হইবে। ইসলামী রাষ্ট্র বলিয়া জাহির করার পরও পাকিস্তানে এইরূপ ঘটিতে দেওয়া অত্যন্ত আপত্তিকর। মুসলমান জনসাধারণের মনের ক্ষতে ইহার দ্বারা লবণের ছিটা দেওয়া হইয়াছে বলা যাইতে পারে।” সকাল বেলা সংবাদপত্রে দেখা গেল ৫ জন নিহত, ১৫০ জন আহত ও ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রদেশের সর্বত্র ঢাকার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সকল শ্রেণীর জনসাধারণের সংগঠিত বিক্ষোভ প্রদর্শিত হচ্ছে। ধর্মঘট-শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে সর্বত্র গণ-আন্দোলনের সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকায় পূর্ণ ধর্মঘট প্রতিপালিত হয়েছে এদিনও নিরস্ত্র জনতার উপর নাজিরাবাজার ও রেল ষ্টেশনে লাঠিচার্জ করা হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলের মাইকটি মিলিটারী এসে জোরপূর্বক দখল করে নিয়ে যায়। রহমানের পিতা এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেন। এইদিন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদকে আন্দোলন চালানোর জন্য আবার পূর্ণ কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। সভায় ৯ দফা দাবী স্থিরীকৃত হয় এবং নূরুল আমীনের জঘন্য মিথ্যা বিবৃতির প্রতিবাদে পাল্টা বিবৃতি দেওয়া হয় আর প্রদেশের ও কেন্দ্রের আন্দোলনে যোগসাধনের জন্য সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণ করা হয়।

 

<001.053.235>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

ঢাকার শত সহস্র মানুষকে এক একটি মাইকের সম্মুখে বসে বসে সারা দিন বক্তৃতা শুনতে দেখা যায়। রাত্রে আজিমপুর কলোনীর মেয়েরা এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। সেই সভায় যোগদানের জন্য সেই আমলের সুদূর কমলাপুর থেকেও মেয়েরা আসেন। কয়েক হাজার মহিলা এই প্রতিবাদ সভায় একত্রিত হয়ে সরকারের বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানান। ২৪শে ফেব্রুয়ারী যতই সরকার দমননীতি চালাচ্ছিল ততই জনসাধারণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংগঠিত হচ্ছিল। একটানা ৪ দিন তুমুল আন্দোলন চলেছে ঢাকা শহরে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের সকল শ্রেণীর মানুষ এসে যোগ দিয়েছে সেই প্রতিরোধ আন্দোলনে। সমস্ত অফিস-আদালত, কল-কারখানা, যানবাহন, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। এক মিলিটারী ছাড়া আর কোন শক্তিই তখন সরকারের হাতে ছিল না। প্রত্যেকটি মুহুর্তেই সরকারের পতনের আশঙ্কা ছিলো। এমনি পরিস্থিতি দেখে গভর্নর অনন্যোপায় হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য আইন পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের উপর গুলী চালানোর জন্য তীব্র নিন্দা করেন এবং তারই প্রতিবাদে ২৫শে ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেন। সলিমুল্লাহ হলের মাইকগুলি জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সলিমুল্লাহ হলের পশ্চিম দিকস্থ দরজা ভেঙ্গে মিলিটারী বাহিনী প্রায় ৮০ জনের মত কর্মীকে গ্রেপ্তার করে এবং সলিমুল্লাহ হলের ভিতরে আন্দোলনকারীদের যে সেক্রটারিয়েট বসেছিল তার সমস্ত কাগজপত্র হস্তগত করে নেয়। সন্ধ্যাবেলা মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলের স্মৃতিস্তম্ভটি মিলিটারী এসে ভেঙ্গে ফেলে। জটিলতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে সর্বদলীয় কর্মপরিষদ আবার সভা আহবান করে। সরকারকে ৭৫ ঘন্টার চরমপত্র দেয়া হয় এবং ৫ই মার্চ প্রদেশব্যপী “শহীদ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়; আর আন্দোলনে সর্বমোট ৩৯ জন শহীদ হয়েছেন বলে দাবী করা হয়। ৯ দফা দাবীর ভিত্তিতে সরকারের নিকট নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন দাবী করা হয়। ২৫ শে ফেব্রুয়ারী আন্দোলনের চাপে পড়ে কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেন এবং ছাত্রছাত্রীদের হল আন্দোলনকারীদের উপর একপক্ষীয় আক্রমণের ফলে চরম সন্ত্রাসের ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল সারা শহরময়। দেখতে দেখতেই আন্দোলনের মূল ৯ জন কর্মকর্তার উপর গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়ে গেল। সরকার যথেচ্ছ গ্রেফতার শুরু করল ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংবাদপত্রগুলিও সম্পূর্ণরুপে সুর বদলিয়ে আন্দোলনকারীদের রাষ্ট্রের শত্রু বলে আখ্যা দিতে লাগল। শহরে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। ফলে আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই আপাতত স্তব্ধ হয়ে গেল। ২৭শে ফেব্রুয়ারী রাত্রে পুলিশ এক বাড়ীতে হানা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ৯ জন আত্মগোপনকারী নেতার মধ্যে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে নেয়। ৫ই মার্চ ঢাকা শহরে শহীদ দিবস সাফল্যমণ্ডিত হয়নি। অসংখ্য মিলিটারী সারা শহরের অলি-গলি বেষ্টন করে রেখেছিল। তবে মফস্বলে ৫ মার্চ শহীদ দিবস পূর্ণ সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল।

 

<001.053.236>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

সরকার সারা প্রদেশের দাবীকে অস্বীকার করতে না পেরে এক ভূয়া তদন্ত কমিশন বসান। কিন্তু যেহেতু আন্দোলনের নেতাদের বন্দী করে রেখে সরকারী লোক দিয়েই সে কমিশন গঠিত হয়েছিল, সে জন্য সর্বদলীয় কর্মপরিষদ তা বর্জন করে। ভাষা আন্দোলন এমনি চূড়ান্ত সরকারী দমননীতি চাপে আপাততঃ স্তব্ধ হয়ে গেলেও প্রদেশের জনসাধারণ তাকে ভোলেনি। তার প্রমাণ ১৯৫৩ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঐতিহাসিক সাফল্য। সারা প্রদেশের মানুষ এই দিন শান্তিপূর্ণ ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে ১৯৫২ সনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসছে। ১৯৬৩ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী এবং তৎপরবর্তী গণ-আন্দোলনের ধারা তারই সাক্ষ্য বহন করে আসছে। ভাষা আন্দোলনের ধৃত সকল রাজবন্দীকে অবিলম্বে ছেড়ে দেবেন বলে সরকার কর্তৃক বার বার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, জনাব ওলী আহাদ, জনাব তোয়াহা, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও অধ্যাপক অজিত গুহকে দীর্ঘদিন কারাভোগ করতে হয়। একুশে ফেব্রুয়ারী ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জনসাধারণ তাদের শক্ৰগোষ্ঠীর চেহারা চিনে নিয়েছে। আর অমর বীর শহীদরা প্রত্যেকটি মানুষের মনে এক একটি স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে রয়েছে চিরকালের জন্য। এই স্মৃতিস্তম্ভই সকল প্রতিবন্ধকতার প্রচীর ধ্বংস করে নতুন জীবন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এদেশের মানুষের মনে দুর্জয় প্রেরণার সঞ্চার করে চলেছে।*

মার্চ ১৯৫৩

<001.054.237>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

  শিরোনাম সূত্র তারিখ আবুল কালাম শামসুদ্দীন কর্তৃক লিখিত দৈনিক আজদ ২তশে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ “গত দুই দিন ধরিয়া ঢাকা শহরের বুকে যেসব কাণ্ড ঘটিয়াছে, সেসবকে শুধু শোকাবহই নয়, বর্বরোচিতও বলা চলে। জনাব নূরুল আমিন পুলিশি জুলুম সম্বন্ধে তদন্তের কথা বলিয়াছিলেন এবং ১৪৪ ধারা জারির যৌক্তিকতা সম্বন্ধেও ইতস্ততার ভাব প্রকাশ করিয়ছিলেন। কিন্তু সে তদন্তের কোন ব্যবস্থা হইল না এবং ১৪৪ ধারাও বলবৎ রহিয়াছে। ফলে গুলীতে মানুষ হতাহত হইতেছে এবং মানুষের রক্তে পথ রঞ্জিত হইতেছে। নূরুল আমিন মন্ত্রীসভার ব্যর্থতা চরমভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। আমরা এই মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবী করিতেছি।… ছাত্রেরা বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানাইয়াছে, এ দাবী জানাইবার তাদের পূর্ণ অধিকার আছে। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু।… এই গণতান্ত্রিক দাবী অস্বীকার করার ক্ষমতা কারো নাই। পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভার সদস্যগণকে তাঁহাদের কর্তব্য পালন করিতে হইবে। এবং তাঁহাদের সিদ্ধান্ত যুক্তভাবে জানাইয়া দিয়া বাংলার দাবী প্রতিষ্ঠা করার ভার তাঁহাদিগকে গ্রহণ করিতে হইবে। গভর্ণরের কাছে প্রদত্ত তাঁর পদত্যাগপত্র গভর্ণর ও পরিষদের স্পীকারের কাছে পাঠানো পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেনঃ “বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করায় ছাত্রদের উপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়াছে, তাহার প্রতিবাদে আমি পরিষদের আমার সদস্যপদ হইতে পদত্যাগ করিতেছি। যে নুরুল আমিন সরকারের আমিও একজন সমর্থক- এ ব্যাপারে তাহদের ভূমিকা এতদূর লজ্জাজনক যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিতে এবং পরিষদের সদস্য হিসাবে বহাল থাকিতে আমি লজ্জাবোধ করিতেছি।

<001.055.238>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

ভাষা বিতকের ওপর লেখা তৎকালীন সময় নও বাহার ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ প্রচারিত প্রবন্ধ সকল ভাষার সমান মর্যাদা আলী আশরাফ ভাষা আন্দোলন কিভাবে লক্ষ্যহারা হইয়া নানা পথে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এই প্রবন্ধে তাহার সুন্দর প্রমাণ মিলিবে। প্রবন্ধটি ২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখের “নও বেলাল” নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। পরে ইহা “পূর্ববাংলা” নামক সাপ্তাহিক পত্রের ১৩ই ফাল্গুন সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত হইয়ছে। “নও বেলাল” ও “পূর্ব-বাংলা” প্রগতিশীল তরুণ দলের মুখপাত্র। বাংলা ভাষার ইহারা পূর্ণ সমর্থক। কাজেই এই দুইখানি সংবাদপত্রে নূতন কথা শুনায় আমরা সত্যই বিস্মিত হইয়াছি। লেখক যে গতানুগতিক চিন্তা-ধারায় ভাসিয়া যান নাই এবং সমস্যাটির উপর যে কিছুটা নূতন আলোকপাত করিতে পারিয়াছেন, তজ্জন্য আমরা প্রবন্ধটির অংশবিশেষ সংকলিত করিয়া দিলাম। …পাকিস্তানের “রাষ্ট্রভাষা” হবে বাংলা ও উর্দু- এ মতই বর্তমানে প্রগতিশীল মহলে প্রচলিত। এবং এ মতবাদ থেকেই দাবীও জানানো হচ্ছে যে (যেমন আওয়ামী লীগ নেতারা জানাচ্ছেন) পূর্ববঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ভাবে উর্দুকে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, সেভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠানগুলিতে বাংলাভাষাকে বাধ্যতামূলক করা হোক। “অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই দ্ব্যর্থবোধক আওয়াজই আজ বিকশিত হয়ে “বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা চাই”-এই সুস্পষ্ট আওয়াজেরই রূপ ধারণ করেছে। প্রগতিশীল মহল সাধারণভাবে ভাবছেন যে, এটাই হলো পাকিস্তানের “রাষ্ট্রভাষার” সমস্যা সমাধানের পথ। কিন্তু সত্যই কি তাতে সমস্যার পরিপূর্ণ ও গণতন্ত্রসম্মত সমাধান হবে? ২১শে ফেব্রুয়ারী যে গৌরবময় সংগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়েছিল, বাংলা ও উর্দু এ দুটি ভাষা পাকিস্তানের “রাষ্ট্রভাষা” হলেই কি সে সংগ্রামের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল হবে এটাই কি গণতন্ত্র? না, এতে সমস্যার সমাধান হবে না, এটা গণতন্ত্রও নয়। কারণ, যে নীতি অনুসারে আমরা আমাদের মাতৃভাষার অধিকার চাইছি, সে নীতি অনুসারেই অন্যান্যকেও তাঁদের ভাষার অধিকার দিতে হবে। পাকিস্তানের জনগণ শুধু বাংলা ও উর্দু এ দুটি ভাষায় কথা বলে না। পাকিস্তানে শুধু যে বাংলা ভাষাভাষী জনগণই রয়েছে তা নয়, এ রাষ্ট্রের অধীনে আরো রয়েছে সিদ্ধি ভাষাভাষী, পাঞ্জাবী ভাষাভাষী, পুস্তু ভাষাভাষী, বেলুচ ভাষাভাষী ও গুজরাটী ভাষাভাষী জনগণ। এছাড়া রয়েছে কয়েকটি উপজাতি- যাদের রয়েছে স্থানীয় ডায়লেক্ট, মুসলিম লীগ সরকারও বাংলা, উর্দু, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, পুস্তু, বেলুচী ও গুজরাটী- এই সাতটি ভাষাকে পাকিস্তানের জনগণের ভাষা বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। বস্তুতঃ পাকিস্তানের রয়েছে পাঁচটি প্রধান প্রধান জাতি- বাঙালী, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, পাঠান ও বেলুচী। এদের প্রত্যেকের মানসিক গঠন ও কৃষ্টি রয়েছে এবং প্রত্যেকের রয়েছে নিজ নিজ মাতৃভাষা। মুসলিম লীগ এই বাস্তব সত্য অস্বীকার করে এক জাতি, এক তমদ্দুন, এক ভাষার প্রতিক্রিয়াশীল যুক্তির অবতারণা করে উর্দুকে “রাষ্ট্রভাষা’ করতে চাইছেন। এই পরিস্থিতিতে যদি গণতন্ত্রী কর্মীরাও শুধু বাংলা ও উর্দুকে “রাষ্ট্রভাষা” করতে চান, তাহলে সিন্ধিভাষী পুস্তুভাষী, পাঞ্জাবীভাষী, বেলুচীভাষী ও গুজরাটীভাষী জনগণের উপর ঐ দুটাে ভাষা চালিয়ে দেয়া হবে। এটাও স্বৈরাচার ও গণতন্ত্রবিরোধী কাজেই “বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা হোক”- এ দাবী কখনোই পরিপূর্ণ গণতন্ত্রসম্মত নয়। “অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”- এই দ্ব্যর্থবোধক আওয়াজ, যে আওয়াজ থেকেই শুধু বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী এসেছে, সেই আওয়াজ

<001.055.239>

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

আজ পরিত্যাজ্য আন্দোলনের প্রথমস্তরে জনগনের সে আওয়াজ প্রচলিত হয়েছিল। কিন্তু মহান একুশে ফেব্রুয়ারীর এক বৎসর পর যখন জনগনের অভিজ্ঞতা ও গনতান্ত্রিক চেতনা আরও বেড়ে গেছে, তখন আন্দোলনের মূল দাবীরুপে ঐ দ্ব্যর্থবোধক আওয়াজের কোন আন্দোলনের ব্যপকতা বৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে বাধা হচ্ছে। তার প্রমাণ হলো, সে আওয়াজ সিন্ধিভাষী, প্রভৃতি জাতির গণতান্ত্রিক দাবীকে আমল না দিয়ে শুধু বাংলা ও উর্দুকে “রাষ্ট্রভাষা”র আসনে বসাতে চাইছে এতে ভাষা আন্দোলনের পিছনে সিন্ধিভাষী, পুস্তুভাষী, বেলুচীভাষী, পাঞ্জাবীভাষী প্রভৃতি সারা পাকিস্তানের সাধারন জনতাকে সমাবেশ করা যাচ্ছে না। বরং তারা এর বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠবে। উর্দুকে পূর্ববঙ্গে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলাকে বাধ্যতামূলক করার দাবীও অগণতান্ত্রিক। কোন ভাষাভাষী জনগনের উপর অন্য ভাষাকে বাধ্যতামূলক ভাবে চাপিয়ে দেওয়াটা স্বৈরাচারের অভিব্যক্তি। এভাবে, এক ভাষা অপরের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করলে জনগনের শিক্ষা ব্যাহত হয় ও জাতিগত বিরোধ সৃষ্টি হয়। পূর্ববঙ্গে উর্দু ও পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা বাধ্যতামূলক করার আওয়াজ দিয়ে প্রকৃতপক্ষে জাতিগত বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। কাজেই, এ আওয়াজ পরিত্যাজ্য। বহু ভাষাভাষী জনগণের অর্থাৎ বহু জাতির মিলনক্ষেত্র পাকিস্তানের ভাষা সমস্যার গণতন্ত্রসন্মত সমাধানের জন্য আমাদের আন্দোলনের মূলনীতি হবেঃ ছোট-বড় প্রত্যেকটি ভাষাভাষী জনগণের প্রত্যেকটি ভাষাকে সমান মৰ্য্যাদা ও সমান অধিকার দেয়া। বিভিন্ন ভাষাভাষী সাধারণ জনগণ যাতে রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে ও শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ পায়, তার জন্য এ আন্দোলনের দাবী হবে নিম্নরূপঃ (ক) কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের সমস্ত আইন, ঘোষণা, দলিল, প্রভৃতি বাংলা, উর্দু, সিন্ধি পাঞ্জাবী, পুস্তু ও বেলুচী ভাষায় প্রকাশ করতে হবে। গুজরাটী ভাষাভাষী জনসংখ্যা যদি যথেষ্টসংখ্যক হয়ে থাকে তবে সে ভাষায়ও প্রকাশ করতে হবে। (খ) কেন্দ্রীয় আইন সভায় প্রত্যেক সভ্য নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজ বক্তব্য বলতে পারবেন ও দোভাষীরা সেগুলি বিভিন্ন ভাষায় তর্জমা করে দেবেন। (জাতিসংঘে ও সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রে এ ব্যবস্থা সাফল্যের সঙ্গে চলছে।) (গ) প্রত্যেক ভাষাভাষী জনগণের নিজ নিজ বাসভূমির (অর্থাৎ বিভিন্ন প্রদেশের) রাষ্ট্রকাৰ্য্য, আইন আদালতের কার্য্য সে প্রদেশের ভাষায় চলবে। বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থিত অন্য ভাষাভাষীরা ( যেমন পূর্ববঙ্গের উর্দুভাষীরা বা পাঞ্জাবের বাঙালীরা) সে সব প্রদেশের আইন- আদালতে নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজ বক্তব্য বলতে পারবে। (ঘ) বিভিন্ন উপজাতি আধুষিত অঞ্চলে সেসব উপজাতীয় ভাষায় আইন-আদালতের কাজ চলবে। (ঙ) ছোটু বড় প্রত্যেক ভাষাভাষী জনসমষ্টি ও বিভিন্ন প্রদেশে সংখ্যালঘুরাও নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করার অধিকার ভোগ করবে। এই সমস্ত দাবীগুলির সারমর্ম নিয়ে আমাদের আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত অভিব্যক্তিরূপে মূল শ্লোগান বা আওয়াজ হবে। “সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই” আলী আশরাফ নামটি ছদ্মনাম। লেখকের আসল নাম খোকা রায়। তিনি তৎকালীন কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য ছিলেন।

<001.056.240>

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ আন্দোলনে সরকারী আচরণ সমর্থন করে পাকিস্তান প্রচার বিভাগ ৩রা মার্চ, ১৯৫২ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ভাষা আন্দোলনের অন্তরালে নূরুল আমীন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করার জন্য জনসাধারণের নিয়মতান্ত্রিক দাবী দমাইয়া রাখার প্রশ্নই উঠে না। ২১শে ফেব্রুয়ারীর মাত্র এক পক্ষকাল পূর্বে এই সম্পর্কে ঢাকায় এবং প্রদেশের অন্যান্য স্থানে সভা ও শোভাযাত্রা করা হয়; স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাহাতে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেন নাই। কিন্তু রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি আসল প্রশ্ন নয়, ইহার পশ্চাতে সরকারকে বানচাল করার জন্য বিদেশী দালাল ও অন্যান্যদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ব্যবস্থা পরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গণপরিষদের নিকট সুপারিশ করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হওয়াতেই তাহারা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হইত। কিন্তু আমরা কি দেখিলাম…। গত ৩রা মার্চ রাত্রে পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা হইতে জনসাধারণের উদ্দেশে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমীনের বেতার বস্তৃতাঃ দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজ আপনাদের উদ্দেশে কয়েকটি কথা বলিতেছি। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় যেসব ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহাতে আমি অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত হইয়াছি। আমি আপনাদেরই একজন, আপনারাই আমাকে একজন খাদেম হিসাবে আপনাদের খেদমত করার সুযোগ ও গৌরব দিয়াছেন। আমার বিবেকবুদ্ধি মতে আমার সাধ্যমত আপনাদের খেদমত করাই আমার কর্তব্য। এই কথা হয়তো না বলিলেও চলে যে, প্রত্যেক পাকিস্তানীর জীবন- সে ছাত্রই হউক বা অন্য অন্য কেউ হউক- আপনাদের কাছে যেমন প্রিয় আমার কাছে ঠিক তেমনি প্রিয়। প্রত্যেকটি পাকিস্তানীর জীবন পাকিস্তানের জাতীয় সম্পদ, তাই ঢাকায় দুর্ঘটনায় যে সাম্প্রতিক দূর্ঘটনায় যাহারা ভুক্তভোগী তাহদের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছি। আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে, ঢাকার গুলী চালানো সংক্রান্ত ঘটনাবলী যথাসময়ে প্রকাশিত হইবে এবং এ সম্পর্কে কেহ দোষী সাব্যস্ত হইলে তাহার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইবে। যেহেতু অবস্থা ক্রমেই স্বাভাবিক হইয়া আসিতেছে এবং গত কয়দিনের ঘটনার স্থানে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল তাহা ক্রমেই প্রকাশিত হইতেছে, এখন এ বিষয়ে ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করিবার সময় আসিয়াছে। রাষ্ট্রের স্বার্থে আমার আগের বক্তৃতায় আপনাদের কাছে অনেক কিছুই খুলিয়া বলিতে পারি নাই। এখন আরও কিছু তথ্য প্রকাশ করিতে চাই এবং তাহা হইতে আপনারা সহজেই বুঝিতে পারিবেন যে, সরকার এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হইয়াছিলেন যেখানে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা ছাড়া আর গত্যন্তর ছিল না। কমু্যনিষ্ট, বিদেশী চর এবং হতাশ রাজনৈতিকদের ধ্বংসাত্মক চক্রান্ত অংকুরেই বিনষ্ট হইয়াছে। এই চক্রান্তের পটভূমি, স্বরূপ এবং চক্রান্তকারীদের পন্থা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখন আপনাদিগকে অবগত করান আমার কর্তব্য। এ সমস্ত ব্যাপারে পর্দার আড়ালে থাকিয়া যে সকল শক্তি কাজ করিতেছিল তৎসম্পর্কে আমার পূর্ব বক্তৃতায় কিছু কিছু ইংগিত করিয়াছিলাম।

 

<001.056.241>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

২১ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে ঢাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব হইতেই সরকার সংবাদ পাইতেছিলেন যে, যাহারা পাকিস্তান পরিকল্পনাকে একটি অভিসম্পাত বলিয়া বিবেচনা করিত, পাকিস্তান অস্তিত্বকে যাহারা পথের কাঁটা বলিয়া মনে করিত এবং পাকিস্তান ধ্বংস করার চিন্তা যাহারা কখনও ত্যাগ করে নাই তাহারা পুনরায় তৎপর হইয়া উঠিয়াছে । এই দল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও কাজ করিতেছিল এবং কিছুসংখ্যক ছাত্রকে ভুল পথে পরিচালিত করিতেছিল। দেশে উচ্ছৃঙ্খলার সৃষ্টি করিয়া শাসনব্যবস্থাকে জবরদস্তিক্রমে বানচাল করিয়া দিবার জন্য ইহারা ব্যাপক পরিকল্পনা করিতেছিল। তাহারা শধু সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিল। কায়েদে আজম ও কায়েদে মিল্লাতের জীবদ্দশায় ধ্বংসাত্মক কাৰ্যকলাপে লিপ্ত এই সকল লোক নীরব ছিল। কায়েদে মিল্লাতের শাহাদাতের পর তাহারা সুযোগের সন্ধান পায়। বাংলাভাষা প্রশ্নটি স্বভাবতঃই সকলের ভাবাবেগ আকর্ষণ করে বলিয়া উহার আড়ালে এই সকল লোক তাহদের হীন প্রচেষ্টা লুক্কায়িত রাখিবার সুযোগ পায়। সবদিক বিবেচনা করিয়া দেখিলে এই কথাই সুস্পষ্ট হইয়া ওঠে যে, প্রাদেশিক আইন সভার অধিবেশনের প্রথম দিন হইতে আরম্ভ করিয়া যত দিন দরকার হয় তত দিন গোলমাল বাধাইয়া রাখিবার পরিকল্পনা করা হইয়াছিল। সরকার খবর পাইয়া সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারী করেন। বাংলাকে ইহার মধ্যে ছিল না। ঘটনার মাত্র পক্ষকাল পূর্বেও ঢাকায় এবং অন্যান্য জায়গায় এই সম্পর্কে সভার অনুষ্ঠান ও শোভাযাত্রা বাহির করা হইয়াছিল। কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কোথাও কোন হস্তক্ষেপ করেন নাই। ১৪৪ ধারা জারি করিয়া এ ধরনের সভা ও শোভাযাত্রা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয় নাই। জেলা কর্তৃপক্ষের অনুমতি লইয়া উহ্য করা যাইত। কিন্তু কেহ এইরুপ কোন অনুমতি চান নাই। ইহার পরবর্তী ঘটনাবলী হইতে সরকারের প্রাপ্ত সংবাদেরই সুস্পষ্ট সমর্থন পাওয়া যায় যে, যে সকল লোক গোলযোগ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করিতেছিল, রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি তাদের এই হীন ষড়যন্ত্রের প্রতি জনসাধারণের সমর্থন লাভের একটি হাতিয়ার ব্যতীত আর কিছুই নহে। ভাষা-বিতর্ক পাকিস্তানের অন্যান্য শুভাকাঙ্খীদের মত আমিও আশা করিয়াছিলাম যে আমাদের দেশবাসী তাহাদের জ্ঞানবুদ্ধি, ইসলাম-প্রীতি ও পাকিস্তানের প্রতি দরদবোধে নিজেদের আভ্যন্তরীণ বাদ-বিসম্বাদ ভুলিয়া যাইবেন এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসাবে ঐক্যবদ্ধ ঢাকায় সাম্প্রতিক গোলযোগের মত জাতীয় বিপদের প্রতিরোধ করিতে প্রস্তুত হইবেন। ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্ররা সাময়িকভাবে হইলেও কিছুটা সাফল্য লাভ করিয়াছে এবং আমাদের কোমলমতি যুবক ও জনসাধারণের মধ্যে কিছু লোককে বিভ্রান্ত করিতে পারিয়াছে দেখিয়া আমি দুঃখিত। ঢাকার সাম্প্রতিক গোলযোগের পিছনে যাহারা আছে তাহদের কর্মপদ্ধতি ও তাহারা যেভাবে নিজেদের ইচ্ছা জনগণের উপর চাপাইয়া দিতে চাহিয়াছিল, তাহা হইতে অতি সহজেই বুঝা যায় তাহদের উদ্দেশ্য কি ছিল। মৰ্মাহত হইয়াছি। আরো বহুদিন পর্যন্ত ইংরেজী ভাষা পাকিস্তানে চালু থাকিতে বাধ্য বলিয়া রাষ্ট্রভাষায় আশু মীমাংসা অত্যাবশ্যকীয় মনে করা হয় নাই। এই অবস্থায় যথা সময়ে স্বাভাবিক অবস্থা বিবর্তনের ভিতর দিয়া এই সমস্যা সমাধান করাই সংগত বিবেচিত হইয়াছিল। আপনারা জানেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ায় আমাদের জাতীয় জীবনে নবীন প্রাণধারা ও নুতন অবস্থার সঞ্চার হইয়াছে এবং ফলে উর্দু বাংলা উভয় ভাষারই নিত্যপরিবর্তন ঘটিতেছে। উর্দুভাষী ও বাংলাভাষী লোকদের পারস্পরিক মিলনের ফলে দুইটি ভাষার সমৃদ্ধ হইতে এবং এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় ব্যবহৃত হইতে থাকায় দুই ভাষাভাষী নাগরিকদের ব্যবধান ক্রমেই দূর হইতেছে। এই জন্যই মরহুম কায়েদে আজম এবং কায়েদে মিল্লাত অযথা তাড়াতাড়ি করিয়া এ সম্পর্কে গণপরিষদের নিকট হইতে কোন সিদ্ধান্ত করানের প্রয়োজন মনে করেন নাই। বাংলাভাষা যথাসময়ে এই প্রদেশের সরকারী ভাষা হইবে, ইত্যবসরে ইহা স্বীকার করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিভা ও সংস্কৃতির উপযোগী করিয়া তোলার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টাকে সরকার উৎসাহ প্রদান করেন।

 

<001.056.242>

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

যাহা হউক, গত ২১ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্বব হয় তৎপ্রতি লক্ষ রাখিয়া আমি ভাষা বিতর্ককে রাজনীতি হইতে পৃথকভাবে বিবেচনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবং আমার ধারণা অনুযায়ী প্রমাণ করিতে চাই যে ভাষার প্রশ্নটা মোটেই আসল প্রশ্ন নয়, বরং ভাষা বিতর্কের অন্তরালে একটি নিগূঢ় দুরভিসন্ধি রহিয়াছে। অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়া সরকারকে ধ্বংস করার জন্য শত্রর চর এবং দুশমনেরা একটি পরিকল্পনা করিয়াছিল। ২২শে ফেব্রুয়ারী তারিখেই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গণপরিষদের নিকট সোপারেশ করিয়া আমি ব্যবস্থা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করি। আমার প্রস্তাব পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। যাহারা আইন অমান্যের ষড়যন্ত্র করিয়াছিল ভাষা সমস্যা ছাড়া অন্য কোন বিশেষ মতলব তাহদের যদি না থাকিত তাহা হইলে এ ব্যবস্থায় তাহারা নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হইত। ভীতি প্রদর্শন ও উচ্ছঙ্খলতা কিন্তু আমি দেখিলাম, যাহারা হাংগামার সূত্রপাত করিয়াছিল তাহারা উক্ত প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার সংগে সংগেই অন্যান্য দাবী উত্থাপন করিতে শুরু করিল। ক্রমে ইহা সবারই নিকট পরিষ্কার হইয়া উঠিল (অবশ্য ইহা শুরু হইতেই সরকারের জানা ছিল) যে, ক্ষমতায় সমাসীন সরকারকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, ভীতি প্রদর্শন ও ষড়যন্ত্র দ্বারা বানচাল করা ব্যতীত হাংগামাকারীদের আর কোন উদ্দেশ্য থাকিতে পারে না। উপরন্তু সরকারকে হিংসাত্মক উপায়ে ধ্বংস করিয়া তৎস্থলে নিজেদের মতলব হাসিলের উপযোগী একটি তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠিত করিতে চক্রান্তকারীরা চাহিয়াছিল। ইহা উল্লেখযোগ্য যে, গোলযোগের সময় নারায়ণগঞ্জে একটি শোভাযাত্রায় বিক্ষোভকারীরা খোলাখুলি যুক্ত বাংলা চাই বলিয়া ধ্বনি তুলিয়াছিল। দেশ বিভাগের পর এই সর্বপ্রথম অকস্মাৎ তাহারা এইরুপ ধ্বনি উত্থাপন করিতে সাহসী হইল, ইহা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। সরকারের নিকট চক্রান্তকারীদের পরিকল্পনা সংক্রান্ত যেসব তথ্য আছে সেইগুলির সংগে ইহাদের পূর্ণ সামঞ্জস্য রহিয়াছে। নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাহারা অভিনব পন্থা গ্রহণ করে। ইহা সকলেই জানেন যে, তাহারা ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যগণকে ভীতি প্রদর্শন করে এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে দৈহিক নির্যাতনের ভয় দেখাইয়া কিছুসংখ্যক সদস্যকে মুসলিম লীগ পার্টি হইতে পদত্যাগ করিতে বাধ্য করা হয়। নিজেদের কার্যকলাপের সমর্থনের জন্য স্থানীয় সংবাদপত্রগুলির প্রতিও অনুরুপ ভীতি প্রদর্শন করা হয়। অন্যান্য সংবাদপত্রগুলিকে ভয় দেখাইবার জন্য পরিকল্পনানুযায়ী “মর্নিং নিউজ’ পতিকার ছাপাখানা সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত করা হয়। শাসনব্যবস্থা ব্যাহত করিবার জন্য অনেক সরকারী কর্মচারীকেও অনুরূপভাবে ভয় দেখাইয়া কাজে যোগদানে বিরত করা হয়। হুমকি প্রদর্শন দ্বারা অথবা বলপূর্বক সাধারণ যানবাহন ও দোকান-পাট প্রায় তিনদিন বন্ধ করিতে বাধ্য করা হয়। রেডিও পাকিস্তানের কাজকর্ম বন্ধ করিয়া দেওয়ার চেষ্টা চলে। টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা এবং ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়। পরিশেষে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে বাধ্য হইয়া সরকার কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে বদ্ধপরিকর হন। সুতরাং বিত্তশীল ব্যক্তিগণের নিকট ইহা সুস্পষ্ট হইয়া উঠে যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা প্রকৃত প্রশ্ন মোটেই ঠিল না, বরং সরকার একদল লোককে দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা বিপন্ন করিতে দিবেন কিনা তাহাই ছিল সত্যিকারের প্রশ্ন। এমতাবস্থায় সরকারের কি করা উচিত ছিল তাহাই বিবেচ্য। এইরূপ হীন ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হইয়া পৃথিবীর কোন দায়িত্বশীল সরকার কি ব্যবস্থা অবলম্বন করিতেন? অতি নগণ্যসংখ্যক লোক জনগণের প্রতিনিধি ব্যবস্থা পরিষদের মুসলিম সদস্যদিগকে ভয় দেখাইয়া বাধ্য করা এবং এইভাবে মুসলিম লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া নিজেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইবার জন্য চেষ্টায় অবতীর্ণ হইয়াছিল। ইহা ঘটিতে দিলে আমরা জনসাধারণের নিকট বিশ্বাস ভংগের অপরাধে দোষী হইতাম। যদি দৃঢ়তার সংগে এই অরাজকতা দমনে আমি ও আমার সহকর্মীগণ অগ্রসর হইতে না পারিতাম, তাহা হইলে জনগণও ইসলামের প্রতি কর্তব্য সম্পাদনের আমরা আপনাদের সামনেও আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের সামনে নিশ্চয়ই অপরাধী সাব্যস্ত হইতাম। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের পতন ঘটান যাইতে পারে। কেবলমাত্র আইনসভার সদস্যগণই নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছায় ভোট দিয়া সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করিতে পারেন। আইনসভার সদস্যগণ যাহাতে ধীরস্থির ও স্বাধীনভাবে এই ব্যাপারে নিজেদের মতামত প্রকাশ

 

<001.056.243>

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

করিতে পারেন, তাহার জন্য এমন পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজন যেন সর্বপ্রকার ভয়ভীতির বাহিরে থাকায়া তাহারা কাজ করিতে পারেন। এই রূপ পরিবেশ সৃষ্টি না হইলে গণতান্ত্রিকতার বিলোপ হইয়া উচ্ছঙ্খল জনতার শাসনই কায়েম হয়। ভয় দেখাইয়া ও উচ্ছঙ্খলতার সৃষ্টি করিয়া দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিপন্ন করিবার এই যে ষড়যন্ত্র হইয়াছিল, সরকারের অবলম্বিত ব্যবস্থা ফলে যদিও সাময়িকভাবে সে বিপদের অবসান হইয়াছে তথাপি আমাদের আজাদীর বিরুদ্ধে যে বিপদ দেখা দিয়াছিল এখনও তাহা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয় নাই। প্রদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা যেমন করিয়াই হউক আমাদিগকে রক্ষা করিতে হইবে। আমি আশা করি এই ব্যাপারে সরকার দেশপ্রেমিক সকল পাকিস্তানীরই পূর্ণ সমর্থন পাইবেন। আমি সকল পাকিস্তানীর কাছে আবেদন করিতেছি, সাহায্য করুন- দৃস্কৃতকারীদের আতংক সৃষ্টি, মিথ্যা গুজব প্রচারণা এবং জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির প্রয়াস ব্যর্থ করুন। ইসলামের আদর্শ দেশবাসীর খেদমতে আমার আরও আরজ, আপনারা সীমান্তের ওপারে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন, উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করুন বর্তমানে আমরা কি সংকটের সম্মুখীন হইয়াছি। শুধু পাকিস্তান নয়-বরং ইসলামই আজ নিদারুণ সংকটের সম্মুখীন। আমরা দাবী করিয়া থাকি, জাতিগত, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত ব্যবধান দূর করিয়া ইসলাম একদিন যে স্বর্ণযুগের সূচনা করিয়াছিল, বর্তমানেও ইসলাম তাহা করিতে সক্ষমযাহার ফলে মানব জাতির জীবনে আসিবে অশেষ সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তি। আমরা পাকিস্তানে ইসলামের এই আদৰ্শই বাস্তবে রূপায়িত করতে চাই। লক্ষ লক্ষ লোকের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাকিস্তান হাসিল করিয়াছি শুধুমাত্র ইসলামকে কায়েম রাখিবার জন্যই। বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন ভাষাভাষী লোক অদ্যাবধি ভৌগোলিক বৈচিত্র্যপূর্ণ আমাদের এই পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশকে ইসলাম এক সূত্রে গ্রথিত করিয়া রাখিয়াছে। আমাদের সংহতি ও সংঘবদ্ধতা শক্ৰমিত্র সকলকেই বিস্মিত করিয়াছে। পাকিস্তান সমগ্র মুসলিম জাহানে নবজীবন আনয়ন করিয়াছে এবং সর্বত্রই ইসলামের এই নবজীবন স্পন্দন অনুভূত হইতেছে। দুনিয়ার নিকট আমাদিগকে প্রতিপন্ন করিতে হইবে যে, যদিও আমাদের পথ প্রদর্শন করার জন্য কায়েদে আজম ও কায়েদে মিল্লাত আজ আর নাই, তথাপি ইসলাম আমাদের ঐক্যবদ্ধ রাখিয়া আমাদিগকে সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করিতে সক্ষম। এই ব্যাপারে আমাদের দায়িত্বই বেশী। কারণ, এখানে যত মুসলমানের বাস দুনিয়ার আর কোথাও এক জায়গায় এত মুসলমান বাস করে না। সুতরাং বিশ্ব মুসলিমের সংহতি রাখার দায়িত্ব বিশেষভাবে আমাদেরই। মুসলিম জাহানের এই সংকট মুহুর্তে আমরা কি পাকিস্তান ও ইসলামের প্রতি এই গুরুদায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইব? পাকিস্তানের ও মুসলিম জাহানের প্রতি আমাদের পবিত্র কর্তব্য সম্পাদনে আমরা কোন দিনই পশ্চাৎপদ হইব না। किट्ठांना द्धि (পূর্ব পাকিস্তানের উজীরে আলা জনাব নূরুল আমীনের বেতার বক্তৃতা। ৩রা মার্চ ১৯৫২) *

ভাষণটি মাহে নও”-এর ৪র্থ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, এপ্রিল, ১৯৫২ থেকে উদ্ধৃত।

 

<001.057.244>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

যুব দাবী দিবস উপলক্ষে পূর্ব পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ২৭শে মার্চ, ১৯৫২ যুবলীগের রাজনৈতিক ঘোষণা “যুব দাবী দিবসে’ পূর্ব পাক যুবলীগের ঘোষণা কায়েম হইবার পর আমরা পাকিস্তানের সকল শ্রেণী যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী আশা করিয়াছিলাম যে, ইংরেজ আজ সাড়ে চারি বৎসরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখিতেছি সে আশা সম্পূর্ণ ধুলিসাৎ হইয়াছে। এই সঙ্কটময় জীবনের অবসানকল্পে সমাজের সকল শ্রেণীর যুবক-যুবতীদের নিম্নলিখিত ১৪ দফা দাবীর ভিত্তিতে পূর্ব-পাক যুবলীগ ঐক্যবদ্ধ করার সঙ্কল্প নিয়াছে। ঠিক এক বৎসর পূর্বে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের যুবসমাজকে এক সংস্থায় সংঘবদ্ধ করার আহবান নিয়া যুবলীগের জন্ম হয়। আজিকার “যুব দাবী দিবসে’ আমরা যুবলীগের সেই ১৪ দফা দাবীগুলিই জনসম্মুখে পেশ করিতেছিঃ ১। সর্বপ্রথম আমরা দুনিয়ার যুবসমাজের সহিত কণ্ঠ মিলাইয়া ঘোষণা করিতেছি, আমরা মানবতাবিরোধী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ চাই না; এবং সকল প্রকার মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের ধ্বংস দাবী করি। আমাদের সাধের পাকিস্তানকে শান্তির মধ্যেই উন্নত করিতে পারিব। তাই দুনিয়ার মানুষের উন্নতিকে ব্যাহত করিবার ও তাহদের দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করিবার যে সাম্রাজবাদী চক্রান্ত তাহাকে আমরা যে কোন মূল্যেই প্রতিহত করার শপথ লইতেছি। ২। আমরা চাই পাকিস্তান বৃটিশ কমনওয়েলথ হইতে মুক্ত হইয়া একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে পরিণত হউক এবং প্রত্যেকটি ভাষাভাষী প্রদেশের অধিবাসীদের স্বায়ত্তশাসন এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা কায়েম হউক এবং বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দেওয়া হউক। ৩। আমরা চাই, বেকারীর অবসান, এবং প্রত্যেকের সৎভাবে জীবিকার্জনের নিশ্চয়তা। ৪। আমরা চাই, প্রাপ্তবয়স্কের সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং যুক্ত নির্বাচন। ৫। আমরা চাই, সমস্ত নারী ও পুরুষের নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং যুদ্ধ খাতে ব্যয় কমাইয়া শিক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধিকরণ। ৬। আমরা চাই যুবসমাজের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মান উন্নয়ন এবং যুবক-যুবতীদের জন্য প্রচুর ক্লাব, লাইব্রেরী ও খেলাধুলার সুবন্দোবস্ত। ৭। আমরা চাই জনসাধারণের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সরকার কর্তৃক প্রচুর ব্যয় বরাদ ও যথেষ্ট চিকিৎসালয় ও ব্যায়মাগার নির্মাণ। ৮। আমরা চাই বিনা খেসারতে জমিদার, জায়গীরদার প্রথার উচ্ছেদ ও কৃষকের হাতে জমি। ৯। আমরা চাই শ্রমিকের জীবিকা ধারণের উপযুক্ত মজুরী ও ৮ ঘন্টা হিসাবে সপ্তাহে ৪৪ ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণ। ১০। আমরা চাই সমস্ত বিদেশী মূলধন বাজেয়াপ্ত ও বড় শিল্পগুলির জাতীয়করণ।

 

<001.057.245>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

১১। আমরা চাই যুবসমাজের জন্য সামরিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও অস্ত্র রাখার অধিকার। ১২। আমরা চাই সমস্ত দাসত্বমূলক আইনের প্রত্যাহার, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি এবং সকল শ্রেণীর জনসাধারণের সভাসমিতি ও মতামত ব্যক্ত করার ভিত্তিতে ব্যক্তির পূর্ণ স্বাধিকার। ১৩। আমরা চাই, সকলের নিজ নিজ ধর্ম পালন করার পূর্ণ অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা। ১৪। আমরা চাই, পাকিস্তান হইতে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা ও প্রাদেশিকতার অবসান। উপরোক্ত দাবীগুলি পাকিস্তানের দলমত নির্বিশেসে প্রত্যেকটি যুবক-যুবতীর দাবী। উপরোক্ত মৌলিক দাবীগুলি কায়েম করিতে পারিলেই দেশের সকল প্রকার যুবসমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির নিশ্চয়তা হইবে এবং পূর্ববঙ্গ তথা সারা পাকিস্তান ধনে, জনে, শিল্পে ও শিক্ষায় সমৃদ্ধ হইয়া উঠিবে। ৪৬/১, যুগীনগর লেন, ঢাকা। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ তারিখ: ২৭শে মার্চ, ১৯৫২।

<001.058.246>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

 

<001.060.265>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

বাংলাভাষার পক্ষে ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের ইসলাম ভ্রাতৃসংঘ ঘোষণা ইসলাম, ভাষা সমস্যা ও আমরা ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের প্রচার দপ্ত ৬নং নয়া পল্টন, ঢাকা হইতে প্রকাশিত “আমাদের প্রেস’ ১৯নং আজিমপুর রোড হইতে মুদ্রিত। ২১শে ফেব্রুয়ারী পূর্ব পাকিস্তানের গণজাগরণের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় দিন। পূর্ব বাংলার সাড়ে চার কোটি অধিবাসী এইদিন দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেছে: বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই হবে। কিন্তু কেন এই দাবী? সাড়ে চার কোটি অধিবাসীর প্রাণের পরতে পরতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল কোন যুক্তির ভিত্তিতে? সে যুক্তি একটি নয়, দুটি নয়, অগণিত। ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ বিশ্বাস করে, জনসাধারণের সেই সব যুক্ত ইসলামের আলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রতিটি নাগরিকের দেহ এবং মনের সর্বাংগীণ বিকাশ ইসলামী রাষ্ট্রে সর্বপ্রধান লক্ষ্য। ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, মাতৃভাষার সাহায্য ছাড়া এ বিকাশ সাধন করা একেবারেই অসম্ভব। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে জাতীয় উন্নয়নের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে মাতৃভাষার উন্নতিসাধনের মধ্যদিয়ে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (দঃ) আবির্ভাবের সময় হিব্রু ভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী ভাষা হিসেবে পরিগণিত হতো; কিন্তু সাধারণ মানুষের বোধগম্য হওয়ার জন্যই অপেক্ষাকৃত সহজ ভাষা আরবীতে পবিত্র কোরান শরীফ নাজেল হয়। আরবীর পরিবর্তে সেদিন যদি অন্য কোন ভাষায় কোরান শরীফ নাজেল হতো তবে আরববাসীদের পক্ষে ইসলামের বাণী অতি অল্প সময়ে গ্রহণ করা সম্ভব হতো না। পূর্ব পাকিস্তানে সত্যিকার ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে ঠিক তেমনি করে মাতৃভাষার মাধ্যমে আজ ইসলামী সমাজবাদের বাণী পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষার মাধ্যমে এ চেষ্টা করার অর্থ হবে আমাদের অগ্রগতি ব্যাহত করা। ইংরেজ আমলে বাংলাদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন হিন্দুদের তুলনায় ঘোর পশ্চাৎপদ ছিল। এর একমাত্র কারণ, ইংরেজ বাংলায় শাসন-বিস্তারের সাথে সাথেই মুসলমানদের মধ্যে ভাষা-সংকট সৃষ্টি করে। রাজভাষা ফারাসীকে বিতাড়িত করে ইংরেজরা সেখানে নিয়ে এল ইংরেজী। সদ্য আজাদীহারা মুসলমানদের ইংরেজী ভাষার প্রতি অবহেলা এবং সর্বব্যাপী অসহযোগিতা ও অজ্ঞানতার সুযোগ

<001.060.266>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

নিয়ে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজ স্বাভাবিকভাবেই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষা-সংস্কৃতিতে মুসলমান সম্প্রদায়কে অতিক্রম করে গেলেন। এদিকে মুসলমানদের অবস্থা কি? তাঁরা হয়ে রইলেন না ঘরকা না ঘটকা। বাংলাভাষাও ভাল করে চর্চা করলেন না, ইংরেজীকেও বয়কট করলেন। ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বিরাট মুসলিম জাতি অশিক্ষিত মৎসজীবীর পর্যায়ে নেমে আসতে বাধ্য হলেন। অন্যদিকে একদল “শেরিফ” সম্পূর্ণভাবে বাংলাভাষাকে বর্জন করবার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। একদিকে ইংরেজী বর্জন, অন্যদিকে “শেরিফ’ দের বাংলা বর্জন করে উর্দু প্রচলিত করার প্রচেষ্টায় যে বিপর্যয় দেখা দেয় তাতে সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। কিন্তু আস্তে আস্তে অবস্থার পরিবর্তন সূচিত হলো। বিশেষ করে গত ত্রিশ বছর ধরে এই অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষিত মুসলিম সমাজ ধীরে ধীরে মাতৃভাষার কদর বুঝতে শিখেছেন এবং ক্রমে ক্রমে বাংলা সাহিত্যের সাধনায় মুসলমানদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ নিশ্চিত পথে অগ্রসর হচ্ছিল। বাংলা-ভাষাভিত্তিক একটি মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজও বাংলাদেশে গড়ে উঠল। সরকারী চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কৃষি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই বাংগালী মুসলমানের ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করা গেল এবং বলাই বাহুল্য, এই নবগঠিত মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-সভ্যতার বাহন হল বাংলা-উর্দু বা ইংরাজী নয়। এরপর এল দেশ বিভাগ। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এদেশের সাড়ে চার কোটি জনসাধারণ আশা করে যে, স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সাথে সাথে বাংলা ভাষার মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানের উন্নয়ন আরও ব্যাপক ও সর্বাত্মক হয়ে উঠবে। যে ভাষার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই একটি মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছে, সেই ভাষাকে কেন্দ্র করেই পূর্ব পাকিস্তানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন চলবে, এটা অত্যন্ত ন্যায়সংগত ও স্বাভাবিক কথা; কিন্তু এখানেও একটা সংকটের সৃষ্টি করা হয়েছে। ইংরেজ সরকার বাংলাদেশের শাসন হাতে নেবার সাথে সাথেই যেভাবে ভাষাসংকটের সৃষ্টি করে, এবারেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ইংরেজ ফারসী তাড়িয়ে আমদানী করেছিল ইংরেজী, এবার বাংলাকে হটিয়ে দিয়ে আমদানী করার কথা চলছে উর্দু। পৃথিবীর কোন দেশের ইতিহাসে বহিরাগত রাষ্ট্রভাষার স্থায়িত্বের নজীর নেই। ইরান ও তুরস্কের ইতিহাসে এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এই ভারত ও পাকিস্তানেও ইংরেজী শিখে বহু ভারতীয় যশের শিখরে আরোহণ করেছেন সত্যি কথা, কিন্তু ইংরেজ চলে যাবার সাথে সাথে ইংরেজী ভাষাকেও এদেশ থেকে পাততাড়ি গুটাতে হচ্ছে। তার স্থান দখল করতে যাচ্ছে ভারতে হিন্দী এবং পাকিস্তানে বাংলা ও উর্দু। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে একশ্রেণীর লোকের কাছে একটা সস্তা যুক্তি প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে এই যে, বাংলা সংস্কৃতি ভাষা থেকে উৎপন্ন ও হিন্দু সাহিত্যিকদের দ্বারা পরিপুষ্ট বলে এই ভাষা ইসলামী ভাবধারা প্রচারের উপযোগী নয়। যাঁরা এই যুক্তি দেখিয়ে থাকেন, তাঁদের জানা আছে (এবং না জানলে জানা উচিত) যে ভারত ও পাকিস্তানের প্রায় প্রত্যেকটি প্রধান ভাষা অল্পবিস্তর সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপন্ন। উর্দু ভাষায় অজস্র সংস্কৃত শব্দের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কারুর কোন সন্দেহ আছে কি? যদি না থাকে তাহলে কি উর্দু ভাষার জাত খোয়া গেছে বলতে হবে? আমাদের প্রশ্ন, পবিত্র কোরান শরীফ যে সময় অবর্তীণ হয়, সে সময় আরবী ভাষা কাদের ভাষা ছিল? পুতুল-পূজারী পৌত্তলিক নাসারাদের নয় কি? যদি তাই হয়, তাহলে আরবী ভাষাকে পবিত্র ভাষায় মর্যাদা দেওয়া হয় কেন? আসলে, ভাষা ভাবপ্রকাশের বাহন মাত্র। ভাব যদি সমৃদ্ধ হয় এবং ভাষা যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে যে কোন সমৃদ্ধ ভাবধারা যে কোন শক্তিশালী ভাষায় প্রকাশ করা চলবে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ ভাষা- এই ভাষায় যদি ইসলামী ভাবধারার প্রচার ও প্রসার ঘটা অসম্ভব হয়, তাহলে বুঝতে হবে, হয় বাংলা ভাষা দুর্বল, নয় ইসলামী ভাবধারারই দুর্বলতা রয়েছে; কিন্তু এ দুয়ের যে কোন একটি স্বীকার করে নেবার প্রগলভতা কারুর আছে কি?

<001.060.267>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

ভাষাতেই নিরীশ্বরবাদী কমু্যনিষ্ট কাব্য সাহিত্যের প্রচার সম্ভব হচ্ছে কি করে? উর্দু ভাষা যদি এতই সাফ-সুতরা ও পাক-পবিত্র হবে, তাহলে সে ভাষায় কমু্যনিষ্ট সাহিত্য রচনা করা হচ্ছে কেন? বস্তুতঃ বাংলা ইসলামী ভাবধারা নিজস্ব আদর্শের দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল। পৃথিবীর যে কোন ভাষায় যে কোন যুগে সার্থক রূপায়ণ চলতে পারে। বাংলাভাষার ইতিহাস আলোচনা করলে এ সত্য পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। বাংলাভাষার প্রাথমিক বিস্তারের মূলে ছিলেন মুসলমান, হিন্দুরা নয়। তৎকালীন বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবী-ফারসী শব্দের অস্তিত্ব ছিল। নবাব হোসেন শাহের আমলে প্রধানতঃ মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সংস্কৃত-ঘেঁষা রূপ অতি অল্পদিনের ঘটনা। বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা ভাষা থেকে আরবী ফারসী শব্দের প্রায় বিলোপ সাধন করেন এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের উপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপ দেন। বলা বাহুল্য, বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত সাধন-ঘেষা বাংলা আজ হিন্দুসমাজও ব্যবহার করেন না। ভাব ও সংস্কৃতির বিবর্তনের সাথে সাথে বাংলা ভাষায়ও বিবর্তন এসেছে- এই বিবর্তনের মুখে কাজী নজরুল ইসলামের আরবী-ফারসী মধুর আমেজ দেওয়া কাব্য ও ছন্দের রাজা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের আরবী-ফারসী শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগবিশিষ্ট কবিতা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা পূর্ববাংলার মুসলমানদের মনোজগতে এক বিরাট ভাববিপ্লবের সৃষ্টি করেছে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি যদি না করা হয় এবং উপর থেকে কোন কিছু চাপিয়ে দেবার কোন চেষ্টা যদি না হয়, তাহলে বাংলা ভাষা উর্দু ভাষা থেকেও তার আহরণী-প্রতিভার পরিচয় দেবে, নিঃসেন্দেহে এ আশা আমরা করতে পারি। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবী করতে গিয়ে আমরা হীন প্রাদেশিকতার মনোভাবকে প্রশ্রয় দিচ্ছি না। আমরা বিশ্বাস করি, গোষ্ঠীগত ও দেশগত রূপ ছাড়াও প্রত্যেক মুসলমানের একটি বিশ্বজনীন রূপ আছে- প্রাদেশিকতার পঙ্কিলতায় নিমগ্ন হয়ে আমরা ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ দৃষ্টভংগীর পরিপোষকতা করার বিরোধী। সাথে সাথে একথাও বলে রাখা দরকার যে উর্দুকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে আমাদের কোন বক্তব্য নেই। বরং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ভাববিনিময়ের প্রয়োজনে আমাদের উর্দু শিখতে হবে। তাই অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর দাবীও আমরা সমর্থন করি। ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে একের বেশী দুইটি রাষ্ট্রভাষার অস্তিত্ব থাকলে জাতির ঐক্যে ফাটল ধরবে, কেউ কেউ এই অভিমতও পোষণ করে থাকেন। বলা বাহুল্য, এ যুক্তিও ইসলামের আলোকে মেনে নেওয়া চলে না। ঐক্য হৈরঃ) ও সমতা (হরভড়ৎসরঃ) এক হবে, একই ভাষায় কাজ-কারবার করতে হবে, একই ধারায় চিন্তা করতে হবেথ-এ যুক্তি ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অচল। বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলন- ইংরেজীতে যাকে বলা হয়, হরঃ রহ ফরাবৎংরঃ-সেই লক্ষ্যে পৌছানোই ইসলামের আদর্শ। একমাত্র সাধারণ আদর্শ ও জীবন-নীতির মাধ্যমেই একটি জাতিকে একতাসূত্রে আবদ্ধ করা যেতে পারে। পাকিস্তানের সংগ্রামে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বহু ভাষা-ভাষী মুসলমানের এগিয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশে লীগ ও পাকিস্তানের প্রচার চলেছিল বাংলা ভাষাতেই, মাদ্রাজে মাদ্রাজীতে, উড়িষ্যায় উড়িয়াতে। এতে পাকিস্তানের দাবী দূর্বল না হয়ে বরং জোরালোই হয়েছিল। পাকিস্তান সংগ্রামের অভাবিতপূর্ব সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল এই যে, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মুসলমানেরা আকৃতিগত, প্রকৃতিগত এবং ভাষাগত বিভেদ সত্ত্বেও একই আদর্শের পতাকাতলে সমবেত হতে পেরেছিলেন। আজ পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর বাংলা-পাঞ্জাব-সিন্ধু-বেলুচিস্তান-সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানেরা যদি সমান প্রেরণা নিয়ে হুকুমাতে রববানিয়াৎ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এগিয়ে আসেন, তাহলে ভাষার বিভিন্নতা, প্রাকৃতিক দূরত্ব এবং অন্যান্য অসুবিধা কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারবে না। তা-ছাড়া আমরা বিশ্বাস করি আজকের যুগের ভাষার মাধ্যমে নয় বরং একমাত্র আদেশের মাধ্যমেই পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দুনিয়ার বুকে বেঁচে থাকতে পারবে। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইরা যদি বাংলা শেখেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ

<001.060.268>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

উর্দু শেখেন তাহলে উভয় অংশের জনগণ একে অপরের ভাবধারা, সুখ-দুঃখ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংগে পরিচিত হতে পারবেন এবং উভয় অংশের জনসাধারণের মধ্যে ঐক্য সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত হবে। তাই উপসংহারে এ কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমরা ঘোষণা করতে চাই যে, বাংলাভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের ঐক্যে ফাটল ধরায়নি বরং এক ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথে এ আন্দোলন আমাদের এগিয়ে দয়েছে। ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে উপরে যেসব যুক্তি দেওয়া গেল, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের কর্মীবৃন্দ মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করে বলেই সাংগঠনিক সমস্ত অসুবিধা অপেক্ষা করেও কর্মীরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলো। এই আন্দোলনে কারাবরণ ও নির্যাতনের সম্মুখীন হতে তারা মোটেই দ্বিধাবোধ করেনি। আমরা বিশ্বাস করি, প্রাদেশিকতার সংকীর্ণ মনোবৃত্তি বা উর্দু ভাষাভাষীদের প্রতি কোনরকম বিদ্বেষের মনোভাব ভাষা আন্দোলনের জন্মদান করেনি। গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই পূর্ব-পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি জনসাধারণ বাংলাকে আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সংগ্রাম আরম্ভ করেছেন। মহান উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে যে আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে তাকে পাটিগত বা ব্যক্তিগত স্বার্থের কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ রুখে দাঁড়াবে। ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ বিশ্বাস করে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে যারা রাষ্ট্রভাসানো আন্দোলনে পরিণত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে সদাজাগ্রত প্রহরীরূপে কাজ করে যাবেন পূর্ব-বাঙ্গলার প্রতিটি সন্তান। তাই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার কাজে সহায়তা করার জন্য পাকিস্তানের প্রতিটি কল্যাণকামী সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবীকে আমরা উদাত্ত আহবান জানাই।

<001.061.269>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!