শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দাবী সম্বলিত সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ গণতান্ত্রিক যুবলীগের পুস্তিকা | পূর্ব পাকিস্থান গণতান্ত্রিক যুবলীগ | সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ |
গোড়ার কথা
গত ১৯৪৭ সালে ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার এক মাস পরে সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনে মিলিত হইয়া পাকিস্তান সংগ্রামে যাহারা পুরোভাগে ছিল সেই যুব সমাজ গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন করিয়া পাকিস্তানকে স্বাধীন, সুখী এবং সমৃদ্ধিশালী করিয়া গড়িয়া তুলিবার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। যুবসমাজ দাবী করে সুখী ও স্বাধীন পাকিস্তান গঠনের জন্য বৃটিশ কমনওয়েলথের বাহিরে আসিয়া পূর্ণ আজাদী ঘোষণা করিতে হইবে, পূর্ণ ব্যক্তিস্বাধীনতা, রাজনৈতিক এবং আর্থিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে এবং জনগণের সহযোগিতাতেই পাকিস্তান গড়িয়া তুলিতে হইবে। যুবলীগ সরকারের সহযোগিতায় কাজে ঝাঁপাইয়া পড়ে। বিগত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও খাদ্যসংকট সমাধান আন্দোলনে যুবলীগের নেতৃত্বে যুবসমাজ বিপুলভাবে সাড়া দিয়াছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যুবসমাজ পুরোভাগে আগাইয়া আসিয়াছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার পর এক বছর পার হইয়া গিয়াছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের ৭ কোটি জনসাধারণের উন্নতির জন্য যুবসমাজ কতটুকু করিতে পারিয়াছে এবং স্বাধীন সুখী পাকিস্তান গঠনের প্রতিজ্ঞা কতখানি সফল হইয়াছে যুবসমাজ তাহা আজ খতাইয়া দেখিবে।
পাকিস্তান আজও বৃটিশ কমনওয়েলথের বাহিরে আসিয়া পূর্ণ আজাদী ঘোষনা করে নাই। পাকিস্তানে ব্যক্তিস্বাধীনতার কবর দেওয়া হইয়াছে। সভা সমিতির অধিকার হরণ, বিনা বিচারে আটক, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ এবং অর্ডিন্যান্স রাজের ষ্টীমরোলার আজ পাকিস্তানে বিভীষিকার সৃষ্টি করিয়াছে। রাজনৈতিক এবং আর্থিক গণতন্ত্র অর্থহীন হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কৃষকের ভাগ্যে জমি মিলে নাই। মজুরের মজুরী বাড়ে নাই। ছাঁটাইয়ের কবলে পড়িয়া লক্ষ লক্ষ লোক জীবিকাহীন হইয়া পড়িয়াছে। খাদ্য সংকট গভীর হইয়া দেখা দিয়াছে। কৃষক, মজুর, মধ্যবিত্ত সকলের জীবনেই সংকট গভীর হইয়া দেখা দিয়াছে। স্বাধীন পাকিস্তানে খাইয়া পরিয়া বাঁচিবার আকাঙ্খা ধূলিসাৎ হইয়া গিয়াছে, পূর্ণ আজাদী, গণতন্ত্র এবং সুখী জীবনের পরিবৰ্ত্তে নূতন দাসত্ব এবং অনাহারের শৃংখলে জনগণ শৃংখলিত হইতেছে।
মুষ্টিমেয় লোক অগণিত জনসাধারণকে অস্বীকার করিয়া নিজেদের ভোগ বিলাসের জন্য পাকিস্তানকে ব্যবহার করিতেছে। মুষ্টিমেয় কায়েমী স্বার্থবাদীর স্বার্থকে পাকিস্তান এবং ইসলামের স্বাৰ্থ বলিয়া সরকারী নীতি নির্ধারণ করা হইতেছে। পাকিস্তানের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি আজ মেহনতকারী মানুষের বিরুদ্ধে নির্ধারিত হইতেছে। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পরিবৰ্ত্তে ধনিক দাসত্বই জনগণের জীবনে চরম সত্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সুখী পাকিস্তান গঠনের জন্য জনগণের সহযোগিতার আকাঙ্খা এবং যুবসমাজের পবিত্র প্রতিক্ষা আজ আখ্যা দেওয়া হইতেছে। কিন্তু যুবসমাজ তাহদের পবিত্র প্রতিজ্ঞা কার্যকরী করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যুবসমাজ জানে কোন একজন ব্যক্তির কৃতিত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। লক্ষ লক্ষ জনসাধারণের সংগ্রামেই এই পাকিস্তান আসিয়াছে এবং সুখী পাকিস্তান গঠনের অধিকার তাহাদেরই, কোন শক্তিই জনসাধারণের পথ রোধ করিতে পরিবে না। জনসাধারণের শক্তিতে অটল বিশ্বাস লইয়াই যুবসমাজ অগ্রসর হইবে।
<001.033.095>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – প্রথম খণ্ড
ঢাকায় প্রতিজ্ঞা লইবার এক বছর পরে রাজশাহী বিভাগের যুবকেরা ঈশ্বরদীতে বিভাগীয় সম্মেলনে মিলিত হইয়া সমস্ত অবস্থার পর্য্যালোচনা করিয়াছে। ধনিক শ্রেণীর ষড়যন্ত্রকে বানচাল করিয়া সুখী পাকিস্তান গঠনের জন্য নুতনভাবে প্রতিজ্ঞা লইয়াছে। সম্মেলনে আন্দোলনের জন্য একটা ইস্তাহার এবং কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে। কৃষক-মজুরকে তাহদের শ্রেণী সংগঠন সংঘবদ্ধ করিয়া জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করিবার জন্য যুবসমাজ প্রতিজ্ঞা লইয়াছে। খাদ্য সংকট প্রতিরোধ, ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, ছাঁটাই বন্ধ, জমিদার উচ্ছেদ, চিকিৎসার পূর্ণ ব্যবস্থা এবং সংকটের হাত হইতে শিক্ষাব্যবস্থা রক্ষা করিবার জন্য প্রস্তাব লওয়া হইয়াছে। সম্মেলনে গৃহীত ইস্তাহার এবং প্রস্তাবাদী কাৰ্য্যে পরিণত করিতে যুবসমাজ আপোষহীন সংগ্রাম করিবে। পূর্ণ আজাদী এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করিতে যুবলীগ যুবসমাজকে আহবান জানাইতেছে। দিকে দিকে যুব সংগঠন করিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুবসমাজকে সংঘবদ্ধ হইবার জন্য যুবলীগ আবেদন জানাইতেছে।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ হয় নাই। জনগণের মুক্তি জন্য আমরা বৃটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছি। বৃটিশের শোষণের বিরুদ্ধেই ছিল আমাদের সংগ্রাম। আজও শোষণ বন্ধ হয় নাই। নূতনভাবে শোষণ আরম্ভ হইয়াছে। দেশী বিদেশী কোন শোসককেই আমরা বরদাস্ত করিব না। সমস্ত রকমের শোষণ ধ্বংস করিয়া গণআজাদী প্রতিষ্ঠার জন্যই যুবসমাজ সংগ্রাম করিয়াছে। গণআজাদী প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত যুবসমাজ থামিবে না। পূর্ণ আজাদী এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুবসমাজ যে প্রতিজ্ঞা নিয়াছিল সে প্রতিজ্ঞা পূর্ণভাবে পালনে করিবেই। কোটি কোটি মজলুম মানুষের জন্য পূর্ণ আজাদী হাসিল করিবেই। গণতান্ত্রিক যুবলীগ তাই এই পবিত্র প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য যুবসমাজকে উদাত্ত আহবান জানাইতেছে।
মোঃ একরামুল হক
প্রকাশ<001.033.096>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – প্রথম খণ্ড
ইস্তাহার
গত বৎসর পূর্ব পাকিস্তানের সাতশত যুবক কর্মীর সহযোগিতা ও চেষ্টার মধ্য দিয়া গণতান্ত্রিক “যুবলীগ’ জন্মলাভ করে। যুবলীগের গঠনের পিছনে মূল প্রেরণা ছিল পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন, সুখী ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে গড়িয়া তোলা। সেই জন্য গত যুব সম্মেলনে প্রগতিশীল আদর্শের উপর ভিত্তি করিয়া একটি “গণদাবীর সনদ’ রচিত ও গৃহীত হয়, সেই আদর্শের উপর ভিত্তি করিয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রকে গড়িয়া তুলিবার জন্য যুবশক্তির নিকট আহবান জানান হয় এবং এই পথে রাষ্ট্রকে গড়িয়া তুলিবার কাজে সরকারকে সকল রকম সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
যুবলীগ প্রতিষ্ঠার পরে পুরা এক বছর চলিয়া গিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানের মজুর কৃষক, মধ্যবিত্ত প্রভৃতি সকল শ্রেণীর যুবকদের মধ্যে আজ প্রশ্ন জাগিয়াছে গত যুব সম্মেলনে যে গণদাবীর সনদ রচিত হইয়াছিল, যে প্রেরণা ও চেতনা লইয়া যুবকগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রকে গড়িয়া তুলিবার স্বপ্ন দেখিয়াছিল গত এক বছরে তাহার কতটুকু সফলতা লাভ করিয়াছে? আমরা কি পূর্ণ স্বাধীনতা, সুখ ও গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হইতেছি, না ক্রমেই সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের পাকে জড়াইয়া পড়িতেছি, দেশবাসীর জীবনে দুঃখ-দুর্দশা কমিতেছে না আরও বাড়িয়া চলিয়াছে।
আমাদের বর্তমান দুঃখ-দুর্দশা, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও বৃটিশ আধিপত্যের জন্য দায়ী কে এবং কোন পথেই বা ইহার আবসান হইতে পারে, ইহাই আজ প্রত্যেক গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন যুবকের মনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যে “গণদাবীর সনদ’ আমরা গত ঢাকা সম্মেলনে গ্রহণ কায়িছিলাম তাহা কোন অবস্থার মধ্যে কার্যকরী হওয়া সম্ভব, বৰ্ত্তমান সরকার দ্বারা ঐ সনদকে কার্য্যে পরিণত করা সম্ভব কিনা এবং তাহা সম্ভব না হইলে কোন কৰ্ম্মপন্থার ভিত্তিতে আমরা অগ্রসর হইব এই সকল মূল প্রশ্ন এড়াইয়া যাওয়ার ফলেই আমাদের “গণদাবীর সনদ’ একটি আদর্শ পরিকল্পনাই মাত্র রহিয়া গিয়াছে, ইহাকে কার্য্যে পরিণত করিবার সংগ্রাম আজও গড়িয়া উঠে নাই। ইহার ফলে প্রথম কিছুটা কৰ্ম্মচাঞ্চল্যের পরেই যুবলীগ ঝিমাইয়া পড়িয়াছে। আমাদের এই ঝিমাইয়া পড়া অবস্থার কারণ ইহাই নয় যে পাকিস্তানের যুবলীগ আজ নিজীব ও অকৰ্ম্মণ্য বরং একথা খুব জোরের সাথেই বলা চলে যে বৰ্ত্তমান দুঃখ-দুর্দশা আজ কৃষক, মজুর ও মধ্যবিত্ত যুবককে যত বেশী চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে, যত বেশী কৰ্ম্মপ্রেরনা সৃষ্টি করিয়াছে অতীতে কোনদিনই এরূপ হয় নাই। যুবকগণ আজ একথা বুঝিয়াছে যে শুধুমাত্র একটা আদর্শ প্রোগ্রাম হাজির করিলে বা তাহাকে প্রচার করিলেই চলিবে না। তাহাকে কার্যকরী করিবার জন্য সক্রিয় কৰ্ম্মপস্থাও গ্রহণ করিতে হইবে। আমাদের গত সম্মেলন সে সম্বন্ধে কোনও নির্দেশ দিতে পারে নাই সে জন্যই আজ পাকিস্তানের যুবশক্তি বিপুল কৰ্ম্মক্ষমতা লইয়াও বৰ্ত্তমান অবস্থার নিরপেক্ষ দর্শকমাত্র হইয়া রহিয়াছে। অতীতে দেখা গিয়াছে যখনই তাহদের কাছে সংগ্রামের আহবান আসিয়াছে তখন তাহাতে সাড়া দিতে একটুকুও দ্বিধাবোধ করে নাই।
গত বাংলা ভাষা আন্দোলন দুটি সত্য আমাদের সম্মুখে খুলিয়া ধরে। প্রথমতঃ একথা পরিষ্কার ধরা পড়ে যে আমাদের গণদাবীর সনদের সব্বনিম্ন দাবী বাংলা ভাষার অধিকার অর্জন করিতেও যুবশক্তি বৰ্ত্তমান শাসক শ্রেণীর কাছ হইতে লাঠি, গুলি, কাঁদুনে গ্যাস ও জেল পাইয়াছে। ইহাতেই দেখা যায় আমাদের সনদের অন্যান্য মূলদাবী আদায় করিতে হইলে আমাদিগকে কি বিরাট বাধার সম্মুখীন হইতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ ইহাও দেখা যায় যে, পাকিস্তানের যুবশক্তি বৰ্ত্তমান শাসক শ্রেণীর সকল আঘাত উপেক্ষা করিয়াও আন্দোলনের আহবানে কিভাবে সাড়া দিয়াছে।
“বাংলা ভাষা আন্দোলনের” শিক্ষা আমরা ঠিকমত বুঝিয়া সময়মত নেতৃত্ব না দিবার ফলেই বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের যুব আন্দোলনে ভাটা পড়িয়াছে। আমাদের গণদাবীর সনদ শুধুমাত্র কাগজপত্রের থাকিয়া গিয়াছে।
<001.033.097>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – প্রথম খণ্ড
যুব আন্দোলনকে নূতন ও উচ্চস্তরে আগাইয়া লইয়া যাইতে হইলে অবিলম্বে প্রয়োজন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর গত এক বছরের রাজনৈতকি ও অর্থনৈতিক অবস্থা ভালভাবে পর্যালোচনা করিয়া নূতন কৰ্ম্মপদ্ধতি গ্রহণ করা। সামান্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করিলেই “গণদাবীর সনদই’ যুব আন্দোলনের মূল প্রোগ্রাম হিসাবে এখনও গ্রহণ করা যাইতে পারে বটে কিন্তু মুহুৰ্ত্তের প্রয়োজন হইল উক্ত প্রোগ্রামকে কার্যকরী করিবার আন্দোলন গড়িয়া তোলার সম্বন্ধে কৰ্ম্মপন্থা নির্ধারণ করা।
১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭ হইতে ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৮–আমরা কি চাহিয়াছিলাম এবং কি পাইয়াছি
গত ঢাকা সম্মেলনে যে “গণদাবীর সনদ’ গৃহীত হয় তাহাতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার, গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, আর্থিক গণতন্ত্র, কৃষি পুনর্গঠন, শিল্প বিপ্লব প্রভৃতি মূলদাবীর কথা বলা হইয়াছে। এই সনদের অর্থই হইল পরাধীন দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া নূতন বুনিয়াদের উপর দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপন করা। কিন্তু বৰ্ত্তমান সরকার পুরাতন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই কায়েম রাখিতে যে বদ্ধপরিকর গত এক বছরের কার্য্যাবলী লক্ষ্য করিলেই তাহা ধরা পড়ে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র?
আমাদের দাবী ছিল পাকিস্তান বৃটিশ সাম্রাজের বাহিরে একটি স্বাধীন ও সাৰ্ব্বভৌম গণরাষ্ট্র হোক অথচ ১৯৪৮ সালের জুন মাসে বৰ্ত্তমান শাসকমণ্ডলী সার্বভৌম ঘোষণা না করিয়া ইংরাজ রাজার জন্ম দিবস পালন করিল। কায়েদ-এ-আজম পূৰ্ব্বেই ঘোষণা করিয়াছেন যে বৃটিশ কমনওয়েলথের ভিতরে থাকাই তাঁহার ব্যক্তিগত মত। এখনও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কার্য্যে ইংরাজ গভর্ণর, উপদেষ্টা ও বড় বড় অফিসার নিযুক্ত থাকিয়া গরীব দেশের কোটি কোটি টাকা লুটিতেছে, আমাদের রাষ্ট্রের উপর তাহদের প্রভাব বজায় রাখিতেছে। ইহাই কি স্বাধীনতা? এই সকল ঘটনা হইতেই পরিস্কার বোঝা যায় বৰ্ত্তমান প্রকৃত স্বাধীনতা নয়, মেকি স্বাধীনতা মাত্র।
আমরা দাবী করিয়াছিলাম পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী প্রদেশকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার দেওয়া হউক। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব জনগণের উপর ন্যস্ত থাকিবে। অথচ বৰ্ত্তমান শাসক শ্রেণী আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বদলে সমগ্র ক্ষমতা কেন্দ্রীয়করণের উপর জোর দিতেছে। খুশীমত যে কোন প্রদেশের অধিকার হরণ করিতেছে (সিন্ধু হইতে করাচীকে বিচ্ছিন্ন করা) সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা হরণ করিবার এমন কি প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইন সভার হাত হইতেও ক্ষমতা কাড়িয়া সমস্ত ক্ষমতা বড় লাটের হাতে কেন্দ্রীভূত করিতেছ। ইহাই কি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নমুনা?
মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার?
আমাদের সনদে দাবী করা হইয়াছিল প্রত্যেক বয়স্ক লোকের ভোটাধিকার চাই কিন্তু এখন পর্যন্ত সকল নিৰ্ব্বাচনই ইংরাজ মার্কা পদ্ধতিতেই চলিয়াছে। অর্ডিন্যান্স করিয়া জনগণের অধিকার হরণ করা চলে কিন্তু অধিকার দান করা চলে না।
আমরা দাবী করিয়াছিলাম ব্যক্তিস্বাধীনতা চাই অর্থাৎ মতামত প্রকাশের, সভা ও সমিতি, শোভাযাত্রা, সংগঠন গঠনের, পত্রিকা ও প্রকাশের, বিক্ষোভ ও প্রদর্শন ও ধৰ্ম্মঘটের, বিনা বিচারে আটক না রাখার স্বাধীনতা চাই। কিন্তু গত এক বছরের অভিজ্ঞতার ফলে একথা জোরের সাথেই বলা যায় যে, আজ যেভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করা হইতেছে এবং সকল রকমের বিরোধিতা ও সমালোচনার টুটি টিপিয়া বন্ধ করা হইতেছে, ইংরাজ আমলেও ইহার চাইতে বেশী কিছু করা সম্ভব হয় নাই। পুলিশ, গোয়েন্দা ও কায়েমী স্বার্থের দল হাত ধরাধরি
<001.033.098>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – প্রথম খণ্ড
করিয়া আজ সকল রকম প্রগতিশীল আন্দোলন ধ্বংস করিতেছে এবং তাহারাই পাইতেছে শাসকমণ্ডলীর পূর্ণ সমর্থন। খুশীমত ১৪৪ ধারা জারী করিয়া সভা সমিতি বন্ধ করা, যে কোন রকম মজুর কৃষক আন্দোলনকেই বে-আইনী কাজ হিসাবে দমন করা, যথেচ্ছাভাবে খানাতল্লাশী চালানো, গোয়োন্দা বিভাগের অঙ্গুলী হেলনে যে কোন ব্যক্তিকে যত দিন খুশী বিনা বিচারে আটক রাখা বা প্রদেশ হইতে বহিস্কৃত করা আজ প্রতিদিনের ঘটনা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। শত শত বৎসরের লড়াই ও ত্যাগের মধ্য দিয়া যতটুকু ব্যক্তিস্বাধীনতা আমরা অর্জন করিয়াছি বৰ্ত্তমান শাসকমণ্ডলীর হাতে তাহাও বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছে। “পঞ্চম বাহিনী”, “রাষ্ট্রের শক্র”, “কমিউনিষ্ট” প্রভৃতি মামুলী আখ্যা দিয়া চরম দমননীতি প্রয়োগ করিয়া বৰ্ত্তমানে মন্ত্রীসভা সমস্ত ক্ষমতা নিজের মুষ্ঠির মধ্যে আনিয়া পুলিশ, গোয়েন্দা ও ধনিক শ্রেণীর খেয়ালের উপর পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের পৌনে পাঁচ কোটি লোকের ভাগ্য ছাড়িয়া দিয়াছে। জমিদার, জোতদার, মিল মালিক প্রভৃতি ধনিক গোষ্ঠীর স্বার্থে আঘাত লাগে এরূপ যে কোন আন্দোলনকেই দমন করা ও রাষ্ট্রের শক্র আখ্যা দেওয়ার মধ্য দিয়াই রাষ্ট্রের বর্তমান কর্ণধারগণের স্বরূপ ধরা পড়ে। বাংলা ভাষা আন্দোলনের উপর নিৰ্ম্মম আঘাত হানার মধ্যে দিয়া ইহাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারবিরোধী মনোভাবও প্রকাশ পাইয়াছে।
এক কথায় বলিতে গেলে যে মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার আমরা দাবী করিয়াছিলাম বৰ্ত্তমান শাসকমণ্ডলী তাহার কোন মর্য্যাদাই দেয়া নাই।
আর্থিক গণতন্ত্র?
কোন দেশের রাজনৈতিক কাঠামো কিরূপ তাহা ভালবাবে বুঝিতে হইলে সেই দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রথমে লক্ষ্য করিতে হয়। যে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শোষণ ও জুলুমের ভিত্তিতে গঠিত অর্থাৎ দেশের শতকরা ৯৫ জন লোককে শতকরা মাত্র ৫ জন লোকের স্বার্থেই খাটিয়া মরিতে হয়, যে দেশে বড় বড় মোটা বেতনের আমলা পুষিয়া গরীব কেরানী ও মজুরকে ছাঁটাই করা হয়- এ কথায় বলিতে গেলে যে দেশে অর্থনৈতিক সাম্য বলিয়া কোন জিনিষ নাই সে দেশে রাজনৈতিক গণতন্ত্র বলিয়াও কিছু থাকিতে পারে না। ইংরাজ সরকার তাহার শোষণ ও শাসন বজায় রাখিবার জন্য আমাদের দেশে একদিকে জমির উপর একদল পরগাছা সৃষ্টি করিয়াছে অপর দিকে শিল্পের দিক দিয়া আমাদের দেশকে অনগ্রসর করিয়া রাখিয়াছে। মুষ্টিমেয় জমিদারের স্বার্থে কোটি কোটি কৃষককে শোষণ করা হইতেছে এবং অপর দিকে বেকারের দল সৃষ্টি হইয়াছে। করিয়া সেই স্থলে নূতন গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরী করা। আমাদের নূতন অর্থনৈতিক কাঠামোর মূল ভিত্তিই হইবে বিনা খেশারতে জমিদার প্রথা ধ্বংস করিয়া কৃষককে জমির মালিক বলিয়া ঘোষণা করা এবং যে সকল ক্ষেত্রে একজন লোকের হাতে অধিক পরিমাণে আবাদী জমি একীভূত হইয়াছে সে সকল ক্ষেত্রে সমস্ত প্রয়োজনাতিরিক্ত জমি বাজেয়াপ্ত করিয়া তাহা গরীব কৃষক ও দিনমজুরদের মধ্যে বিতরণ করা। যাহারা চাষের হাল-বলদ কিনিতে পারিতেছে না, জমিতে সার দিতে পারিতেছে না তাহাদিগকে সরকার হইতে সাহায্য করা। অথচ বর্তমান সরকার জমিদারী উচ্ছেদের যে বিল আনিয়াছে তাহাতে “শিশু রাষ্ট্রের” পকেট হইতে ৪০ কোটি টাকা খেসারত ব্যবস্থা হইয়াছে, জোতদারকে ২০০ শত বিঘা জমি রাখিতে দেওয়া হইয়াছে, জমিদারের ঋণ লাঘবের ব্যবস্থা হইয়াছে, জমিদার জোতদারের জন্য সকল রকমেরই রক্ষাকবচের ব্যবস্থা হইয়াছে কিন্তু এই বিলের ফলে কৃষক কি পাইবে, আধিয়ার ও দিনমজুরের ভাগ্যের কি পরিবর্তন হইবে শুধু সেইটাই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। এক কথায় বলিতে গেলে এই বিল কৃষকের স্বার্থে রচিত হয় নই-জমিদারের স্বার্থেই রচিত।
কৰ্মচারী, কেরানী, শিক্ষক প্রভৃতি সম্বন্ধে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নীতির অর্থ এই যে, যে দেশের কোটি কোটি লোকের পেটে ভাত নাই, পরনে কাপড় নাই, ঘরে বাতি নাই সে দেশের মন্ত্রী বা উচ্চ অফিসারদের কখনও মাহিনা, ভাতা প্রভৃতি দিয়া চার-পাঁচ হাজার টাকা মাসিক আয় বরদাশত করা চলে না। যাহারা একজন রেলমজুরকে ও একজন প্রাইমারী শিক্ষককে ১৫/২০ টাকা মাহিনা দিতে লজ্জা বোধ করে না তাহারা নিজেরাই বা
<001.033.099>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – প্রথম খণ্ড
পাঁচ হাজার টাকা লয় কিভাবে ও ইংরাজ আমলের অত্যাচারী ও দুনীতিপরায়ণ আমলাদের হাজার হাজার টাকা বেতন দিয়া পুষিতেছে কিভাবে? বৰ্ত্তমান অবস্থায় কোন মজুর ও কৰ্ম্মচারীর বেতন ও ভাতা ১০০ টাকার কম হইতে পারে না এবং কোন উচ্চপদস্থ কর্মচারীই বেতন ৫০০ টাকার বেশী হওয়া উচিত নয়। অথচ আমাদের সরকার মুখে ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলিয়া কাৰ্য্যক্ষেত্রে ইংরাজ আমলের শোষণ ও অসাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই কায়েম রাখিতেছে। ঘুষ, দুনীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বৃটিশ আমলকেও লজ্জা দেয়।
শিল্প বিস্তারের ব্যাপারে সরকার মজুর ও জনসাধারণের সক্রিয় সহযোগিতা লাভ করিয়াছে, অপরদিকে তেমনি মুষ্টিমেয় ধনিকের হাতে না জমিয়া কোটি কোটি টাকা সরকারের হস্তগত হইয়াছে, যাহা দিয়া নূতন শিল্প গড়িয়া তোলা, পুরাতন শিল্পকে প্রসার করার সুযোগ পাওয়া গিয়াছে। এই পথেই তাহারা জনসাধারণের আয় বাড়াইয়াছে, জিনিষের দর কমাইয়াছে এবং বেকার সমস্যার সমাধান করিয়াছে। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে মুষ্টিমেয় ধনিক, রাজা, জমিদার ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী তাহদের শক্র হইয়াছে বটে কিন্তু দেশের কোটি কোটি মজুর, কৃষক ও মধ্যবিত্ত রাশিয়া রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ভার গ্রহণ করিয়াছে, রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছে। সেই জন্যই দেখা যায় যুদ্ধের নিদারুন ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করা সত্ত্বেও সোভিয়েট রাশিয়া ও নয়া গণতান্ত্রিক দেশসমূহ কেবলমাত্র নিজ শক্তির উপর ভরসা করিয়াও পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করিয়া অতি দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির পথে অগ্রসর হইতেছে। আর মার্কিন ধনকুবেরগণের সাহায্য লাভ করিয়া পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহ, চিয়াংকাইশেকের চীন প্রভৃতি কেবল সম্মেলন করিয়া বেড়াইতেছে ও অর্থনৈতিক সংকটে হাবুডুবু খাইতেছে।
যাহারা নিজের দেশের ধনিকদের তোষণ ও লালপালন করে অর্থের জন্য তাদেরই বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে হাত পাতিতে হয় এবং তদ্বারা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও বিদেশী প্ৰভুদের হস্তক্ষেপ ডাকিয়া আনিতে হয়। এইভাবেই অর্থনৈতিক গোলামী হইতে রাজনৈতিক গোলামীর সৃষ্টি হয়।
সেইজন্য পাকিস্তান সরকার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ধনিক তোষণ ও কৃষক মজুর আন্দোলনে ধ্বংসের পথ গ্রহণ করিয়াও আন্তর্জাতিক ব্যাপারে বৃটিশ ও আমেরিকার লেজুড়ে পরিণত হইয়াছে। ইহার ফলেই নেতারা বৃটিশ সম্পর্কোচ্ছেদের বদলে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকিবার কথা বলিতেছেন, রাজার জন্মদিবস পালন করিতেছেন। ইহা আজাদীর পথ নয়, গোলামীর পথ, শিল্প বিস্তারের পথ নয়, বিদেশী পুঁজিপতিদের স্বার্থে দেশের শিল্পবিস্তার বন্ধ রাখার পথ ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বদলে অর্থনৈতিক দাসত্বের পথ।
সত্যিকারে, আজাদীর শিল্প বিস্তার ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পথে বর্তমানে শাসকমণ্ডলী অগ্রসর হইতে পারেন না, কারণ তাহা হইলে কৃষক, মজুর ও গরীব মধ্যবিত্তের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা না করিয়া মিল মালিক, জমিদার, জোতদার, বিদেশী পুঁজিপতি, মুনাফাখোর, বড় ব্যবসায়ী ও মোটা বেতনের দেশী-বিদেশী অফিসারদের বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষণা করিতে হইবে। দুই নৌকায় পা দিয়া চলা আজ অসম্ভব। হয় ধনিকের শাসন ধ্বংস করিয়া মেহনতকারী জনসাধারণকে বাঁচাইতে হইবে আর না হয় মেহনতকারী জনসাধারণকে বুভূক্ষু রাখিয়া ধনিকের ধন-দৌলত বাড়াইতে হইবে। কোন দেশ কোন পথে যাইবে তাহা নির্ভর করে সেই দেশের শাসক শ্রেণী কোন দলের প্রতিনিধি তাহার উপর। সোভিয়েট রাশিয়া ও নয়া গণতান্ত্রিক দেশসমূহে কৃষক, মজুর ও গরীব মধ্যবিত্ত রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করিয়াছে সেই জন্যই সেখানকার জনগণ আজ খাঁটি আজাদী গণতন্ত্র ও সুখ ভোগ করিয়াছে, আর উন্নতির পথে আগাইয়া চলিয়াছে। গত এক বৎসরের কার্যকলাপের ফলে একথা ক্রমেই স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে যে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবেই কাজ করিতেছে এবং সেই জন্যই দেশবাসীর জীবনে দুঃখ-দুর্দশা নামিয়া আসিয়াছে। সরকার বলে “সময় দাও” কিন্তু আমাদের প্রশ্ন যে এক বৎসর সময় আমরা দিলাম তাহা কাহার স্বার্থে কিভাবে ব্যবহার করা হইল? এই এক বৎসরে কি তাহারা বৃটিশ সম্পর্কোচ্ছেদ, ধনিক শ্রেণীর উচ্ছেদ, চোরাকারবারী ও মুনাফাখোর ধ্বংস ও কৃষক মজুর মধ্যবিত্তের উন্নতির
<001.033.100>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – প্রথম খণ্ড
কাজে ব্যয় করিয়াছে, না দেশী বিদেশী ধনিক তোষণ ও গরীব হত্যার কাজে ব্যয় করিয়াছে? সময় পাইলেই যদি ধনিক শ্রেণীর উচ্ছেদ হইত, জনসাধারণ পেটে ভাত, পরনে কাপড় পাইত তাহা হইলে আমেরিকা ও ইংলেণ্ডে আজ কোটিপতিরা দেশের মালিক কেন? সেখানকার মজুরদেরও মজুরী বৃদ্ধির জন্য ধর্মঘট করিতে হয় কেন? আর মাত্র ২/৩ বৎসর সময়ের মধ্যে আলবেনিয়া, হাঙ্গেরী, পোলাও প্রভৃতি দেশ তাহাদের ভাগ্য পরিবর্তন করিতে পারিল কেন?
সময় পাইলেই সব ঠিক হইবে একথা সম্পূর্ণ মিথ্যা, সরকারী কর্তৃপক্ষ কাহার স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করিতেছে-ধনিকের না গরীবের? এটাই হইল আসল প্রশ্ন। যে সরকার ধনিকের স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করে তাহাকে সময় দেওয়ার অর্থ ধনিকের শক্তিবৃদ্ধি করিতে সুযোগ দেওয়া মাত্র।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা
যে রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গণতন্ত্রের স্থান নাই; সেই রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আশা করা বৃথা। আমরা দাবী করিয়াচিলাম সকলের কাজ করিবার অধিকার চাই, গ্রামে গারমে বিনা বেতনে শিক্ষা দেবার স্কুল চাই, প্রতি ইউনিয়নে সরকারী ডাক্তার চাই। বলা বাহুল্য যে, ইহার কোনটাই আমরা পাইতেছি না এবং পাইবার কোন সম্ভাবনাও দেখিতেছি না। প্রত্যেকের কাজের অধিকারের বদলে পাইতেছি বেকার সমস্যা; গ্রামে গ্রামে স্কুলের পরিবৰ্ত্তে বৰ্ত্তমানে সামান্য কয়টি স্কুল ও সরকারী শিক্ষা বিভাগের খেয়ালমত ভাঙ্গা গড়া ইত্যাদি। স্বাস্থ্যের উন্নতি দূরের কথা সরকারী খরচে মাত্র যে কয়জন Health Assistant টিকা, ইনজেকশন দিবার জন্য রাখা হইয়াছে তাহদেরও বরখাস্তের বন্দোবস্ত হইতেছে। শ্রমিক, কৃষক, নারী জাতি প্রভৃতির জন্য আমরা যে সকল অধিকার দাবী করিয়াছিলাম, একটি সুখী সমাজ ব্যবস্থা গড়িবার যে আর্দশ, যে কর্মপন্থা আমরা গ্রহণ করিয়াছিলাম বর্তমান শাসকমণ্ডলীর দ্বারা তাহা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হইয়াছে। গত এক বছরে নূতন সমাজ ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা দূরে থাকুক পুরাতন জরাজীর্ণ ব্যবস্থাও ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীকে নূতন অধিকার দানের বদলে পুরাতন অধিকার কাড়িয়া লওয়া হইয়াছে।
বৰ্ত্তমান শাসক শ্রেণী খাদ্য সমস্যার সমাধান করিতে পারিতেছে না অথচ খবরের কাগজে বিবৃতি দিতেছে যে দেশে খাদ্য সমস্যা নাই। কোন জিনিষেরই দর কমাইতে পারিতেছে না। সকল রকমের কুটির শিল্প ধ্বংস হইয়া যাইতেছে। ছাঁটাই প্রভৃতির ফলে বিরাট আকারে বেকার সমস্যা দেখা দিয়াছে। এক কথায় বলিতে গেলে লোকের আয় ক্রমেই কমিতেছে আর ব্যয় বহুলাংশে বাড়িয়া চলিয়াছে, অথচ সরকারী কর্তৃপক্ষ ইহার বিরুদ্ধে নেতাদের গ্রেপ্তার, বরখাস্ত, বদলী, ১৪৪ ধারা জারী প্রভৃতি দ্বারা ইহার জবাব দেয়। কাপড় ও চিনির কলের মালিকরা যখন উৎপাদক মজুর শ্রেণী, ক্রেতা ও মধ্যবিত্ত ও কৃষক শ্রেণীকে শোষণ করিয়া কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুট করে তখন সরকার নিরপেক্ষ দর্শকের ন্যায় সবই মুখ বুজিয়া সহ্য করে। অথচ মজদুর শ্রেণী যখন বাধ্য হইয়া জীবন ধারণের উপযোগী মজুরী, ছুটি প্রভৃতির দাবী লইয়া আন্দোলন ও ধর্মঘটের পথে অগ্রসর হয় তখন সরকার মিল মালিকের পক্ষেই হস্তক্ষেপ করাকে পবিত্র কৰ্ত্তব্য বলিয়া মনে করে। আমরা আজাদী পাইয়াছি, কিন্তু এখনও রেল শ্রমিক ও যাত্রীদের শোষণ করিয়া কোটি কোটি টাকা ইংরাজ পুঁজিপতিদের জন্য বিলাতে পাঠাইতে হয়। যে সকল ইংরাজ অফিসার আমাদের দেশে চাকুরী করার নামে শোষণ ও শাসনের যন্ত্র হিসাবে কাজ করিয়াছে, আমাদের দেশের স্বাধীনতাকামী জনসাধারণের বুকের রক্ত দিয়া হাত রাঙ্গাইয়াছে, সেলামীস্বরূপ তাহাদের পেনসনের টাকা বিলাতে পাঠাইতে হয়। অথচ আমাদের দেশেরই গরীব মজুর ও শিক্ষকের দল না খাইয়া থাকে।
<001.033.101>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
আমরা দাবী করিয়াছিলাম অর্থনৈতিক গণতন্ত্র, শোষণমূলক ব্যবস্থার অবসান। অথচ আমরা পাইতেছি একদিকে মুষ্টিমেয় কায়েমী স্বার্থের অর্থনৈতিক একাধিপত্য, মোটা বেতনভোগী, ভোগ-বিলাস ও অপরদিকে অন্নহীন, বস্ত্রহীন কঙ্কালসার দরিদ্র জনসাধারণ- ইহাই কি ইসলামী সমাজতন্ত্র? না সমাজতন্ত্রের নামে প্রবঞ্চনা?
শিল্প বিপ্লব
গত এক বছর হইল সরকারীমহল হইতে আশার বাণী শুনান হইতেছে যে পাকিস্তানে শিল্প বিস্তারের সম্ভাবনা প্রচুর। এক বিশেষ কমিটি গঠিত হইতেছে, ইংরাজ বিশেষজ্ঞদিগকেও মোটা টাকা দিয়া পরামর্শ দিবার জন্য আনা হইতেছে, কিন্তু অবস্থার একচুলও পরিবর্তন হয়নি। বাস্তব কর্মপন্থা ভিত্তিতে একটি কাজও শুরু হয়নি। আমাদের সরকার যতদিন বৃটিশ ও আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদীদের তোষণ করিয়া পাকিস্তানের শিল্প বিস্তারের চেষ্টা করিবে ততদিন পর্যন্ত বৰ্ত্তমান অবস্থাই চলিতে থাকিবে। কারণ সাম্রাজ্যবাদীরা নিজ স্বার্থে যতটুকু প্রয়োজন তার চাইতে একধাপও অগ্রসর হইবে না। পাকিস্তানের জনসাধারণের প্রয়োজনের চেয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রয়োজনই তাহাদের কাছে ঢের বড় কথা এবং এইদিকে নজর রাখিয়াই তাহারা সব কিছু করিবে। মার্শাল পরিকল্পনা মারফৎ পশ্চিম ইউরোপের শিল্পপ্রধান দেশগুলিকে যেভাবে পদানত করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহাতে বেশ বুঝা যায় যে এই সাম্রাজ্যবাদী ধুরন্ধরেরা পাকিস্তানের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করিতে মোটেই ছাড়িবে না। অথচ আমাদের কর্তৃপক্ষ তাহদেরই দুয়ারে ধর্ণা দিতেছে। আমেরিকার কাছ হইতে তাহদের শৰ্ত্তে টাকা ধার করা বা আমেরিকার পুঁজিপতিগণকে দেশে শিল্প বিস্তারের জন্য আমন্ত্রণ জানানো যে খাল কাটিয়া কুমীর আনিবারই শামিল হইবে একথা যে কোন সাধারণ লোকেই বুঝিতে পারে। অথচ চোখের উপরই দেখিতেছি পূৰ্ব্ব ইউরোপের নয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ সাম্রাজ্যবাদীদের দাসত্বসুলভ শর্তে দেওয়া ঋণ ঘৃণায় প্রত্যাখান করিয়া নিজ শক্তির উপর নির্ভর করিয়াই অনেক দ্রুতগতিতে শিল্প বিস্তার করিতেছে। ১৯৭১ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে সোভিয়েট রাশিয়া আমাদের দেশের মত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়িয়াও সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে মাথা বিকাইয়া না দিয়া নিজ শক্তির উপর ভরসা করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাহারা যদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরোধিতা সত্ত্বেও অতি দ্রুত শিল্প বিস্তার করিতে পারে তাহা হইলে আমাদের সরকার সাম্রাজ্যবাদীদের তোষণ করিয়াও গত এক বছরে এক ধাপও অগ্রসর হইতে পারেন নাই কেন? সোভিয়েট রাশিয়া পরাধীন দেশ শোষণ করিয়া বা সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ হইতে ঋণ করিয়া শিল্প ও আভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য ধনিক শ্রেণীর হাত হইতে দখল করিয়া রাষ্ট্রের হাতে আনিয়া জারের আমলের সকল ধার-দেনা অস্বীকার করিয়া। দেশী ও বিদেশী ধনিকদের হাতে মুঠা হইতে অর্থনৈতিক আধিপত্র কাড়িয়া লওয়ার ফলে একদিকে যেমন শ্রমিক শ্রেণীর মজুরী বাড়িয়াছে ও জিনিষের দর কমিয়াছে- এককথায় বলিতে গেলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সকল দিক দিয়াই আমরা যেন আরও পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ হইতেছি। অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাসমূহ জোর করিয়া আমাদের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইতেছে- ইহাই হইল আমাদের গত এক বছরের অভিজ্ঞতা।
গণপরিষদ
স্বাধীন দেশের গঠনতন্ত্র রচনার ফলে যে মুষ্টিমেয় লোকের ভোটে এবং পরোক্ত নির্বাচন দ্বারা গণপরিষদ গঠিত হইয়াছিল এক বছরে একমাত্র পতাকা নির্ধারণ ছাড়া তাহা কোন কাজই করে নাই। জনসাধারণকে ভুলাইবার জন্য নামেমাত্র একটি গণপরিষদ খাড়া করিয়া রাখা হইয়াছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস আলোচনা করিলে আমাদের গণপরিষদের অগণতান্ত্রিক ভিত্তি ও স্থবিরতা একটি লজ্জার বিষয় হইয়াছে। এইরূপ একটি গণপরিষদের কাছ হইতে আমরা বিপ্লবী পরিবর্তন আশা করিতে পারি কিভাবে? সকলের মনেই আজ এ প্রশ্ন জাগিতেছে বৰ্ত্তমান পরিষদ কি কালের দাবীর সহিত তাল মিলাইয়া পুরাতন বৃটিশ
<001.033.102>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
রচিত সমাজব্যবস্থা ধ্বংস করিয়া আমাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে বিপ্লবী পরিবর্তন আনিতে পারিবে? একথা আজ লজ্জার সাথে স্বীকার করিতেই হইবে যে বৰ্ত্তমান গণপরিষদ পাকিস্তানবাসীকে সকল দিক হইতেই নিরাশ করিয়াছে।
আমাদের ভবিষ্যৎ
গত এক বছরের অভিজ্ঞতা আগামীকালের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মোটেই আশাম্বিত করিয়া তুলিতেছে না। বরং এই আশংকাই আমাদের মধ্যে প্রবল যে, বর্তমান অবস্থার গতিরোধ করিতে না পারিলে আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এক ঘোরতর বিপর্যয় দেখা দিবে। মাত্র কয়েকজন লোকের স্বার্থে পাকিস্তানের কোটি কোটি জনসাধারণের সকল অধিকার হরণ করিয়া একটিমাত্র গোষ্ঠীর একনায়কত্ব জাকিয়া বসিবে। ইহাদেরই স্বার্থে এবং খেয়াল চরিতার্থ করিবার জন্য আমাদের সকলের স্বার্থ ত্যাগ করিতে হইবে। ইহাদেরই সুখ বৃদ্ধির জন্য আমাদের সকলের সুখ বিসর্জন দিতে হইবে। ইহাদের অধিকার কায়েম রাখিতে আমাদের সকলের অধিকার হরণ করা হইবে। পাকিস্তানের যুবসমাজ শাসকমন্ডলীর এই গণবিরোধী নীতি, গণতন্ত্রের প্রতি উপেক্ষা ও শোষকমুলক ব্যবস্থা কখনো মুখ বুজিয়া মানিয়া লইতে পারে না। সরকার যদি মনে করিয়া থাকে একমাত্র দমন নীতির সাহায্যে ত্রাসের সঞ্চার করিয়া সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলন স্তব্ধ করিয়া দিব, কৃষক, মজুর, ছাত্র ও যুব সংগঠন ধ্বংস করিয়া দিব, তাহা হইলে তাহারা চরম ভুল করিয়াছে; ইতিহাস হইতে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করে নাই। লাঠি ও জেলখানার সাহায্যে কখনও গণআন্দোলন ধ্বংস করা যায় নাই। হিটলার-মুসোলিনী হইতে শুরু করিয়া পৃথিবীর কোন দেশের শাসক শ্রেণীই যে কাজে কৃতকাৰ্য হইতে পারে নাই পাকিস্তান সরকারের সেই চেষ্টা করা বৃথা। পাকিস্তান সরকার যেন এ কথা না ভুলে যে, আজ যাহারা গণআন্দোলন গড়িয়া তুলিতেছে তাহাদেরই এক বিরাট অংশ বৰ্ত্তমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য দায়ী। শুধুমাত্র পঞ্চম বাহিনী’, ‘রাষ্ট্রের শক্র প্রভৃতি আখ্যা দিয়া লোক চক্ষে তাহদের হেয় করিবার চেষ্টা বৃথা। যে প্রেরণা জন্য দ্বিগুণ উৎসাহ লইয়াই বৰ্ত্তমান শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে পাকিস্তানের যুবশক্তি ঝাঁপাইয়া পড়িবে। সরকারের কোন হুমকি তাহাকে সফলচু্যত করিতে পারিবে না।
যুবসমাজের প্রতি
বৰ্ত্তমান সরকারের সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা নীতি, ব্যক্তি-স্বাধীনতা হরণ, কৃষক-মজুর আন্দোলন ও তাহদের সংগঠন ধ্বংস করা ও জমিদার, মিল মালিক তোষণ, ছাঁটাই ও বেতন বৃদ্ধি না করা প্রভৃতি কার্যের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন করিবার জন্য আমরা পাকিস্তানের যুব সমাজের কাছে উদাত্ত আহবান জানাইতেছি, এমন আন্দোলন সৃষ্টি করিতে হইবে যাহার ফলে সরকার তাহার গণবিরোধী নীতি পরিবর্তন করিতে বাধ্য হইবে। না হয় মজুর, কৃষক, গরীব, মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্বমূলক নুতন সরকার বর্তমান সরকারের স্থান গ্রহণ করিবে। যে সরকার গণবিরোধী কার্য্যের দ্বারা আস্থা হারাইয়া ফেলে যে সরকার দেশের লোকের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা না করিয়া শুধু লাঠি ও জেলখানার সাহায্যে দেশ শাসন করে গণতান্ত্রিক নীতি অনুযায়ী তাহার একদিনও টিকিয়া থাকিবার অধিকার নাই। যুবসমাজই জাতির মেরুদন্ড। সেইজন্য তাহাদের কাছে আমাদের আহবান আপনারাই আগাইয়া আসিয়া আন্দোলনে নেতৃত্ব দিন। কৃষক, মজুর, ছাত্র, কৰ্ম্মচারী প্রভৃতির যে সকল নিজস্ব শ্রেণী, প্রতিষ্ঠান তাহার সাথে যুবলীগের কোন বিরোধিতা নাই বরং তাহদের সহযোগিতাতেই একমাত্র প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়িয়া উঠিতে পারে। যুবলীগের মধ্যে থাকিয়াও যেন কৃষক সমিতি ও মজুর ইউনিয়নের সভ্যভূক্ত হন এবং কৃষক সমিতি ও মজুর ইউনিয়নের সংগে সহযোগিতা করেন। তাহদের দাবী-দাওয়া লড়াই করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কৃষকমজুরের আন্দোলনকে বাদ দিয়া কোন সত্যিকারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনই গড়িয়া উঠিতে পারে না। কোন
<001.033.103>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
দেশ কতটা গণতান্ত্রিক তাহার প্রকৃত প্রমাণ মিলে সেই দেশের শাসক শ্রেণীর কৃষক-মজুরের দাবী-দাওয়া ও তাহাদের আন্দোলনের প্রতি মনোভাবের মধ্য দিয়া। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের ন্যায় মুখে গণতন্ত্রের বুলি ও কার্যে নিগ্রো নির্যাতন ও কৃষক-মজুর শোষণ কখনো গণতন্ত্রের নীতি হইতে পারে না। পাকিস্তানে এমন শক্তিশালী গণতান্ত্রিক যুব আন্দোলন গড়িয়া উঠুক যাহা দুনিয়ার প্রগতিশীল যুব আন্দোলনের পাশে সমমর্যাদা লইয়া দাঁড়াইতে পারে। সেই উদ্দেশ্যে প্রতি গ্রাম, বন্দর ও কলকারখানায় যুবলীগের শাখা গঠন করিতে হইবে। তাহদের দাবী-দাওয়া লইয়া আন্দোলন করিতে হইবে। নিম্নলিখিত কার্যসূচীর ভিত্তিতে আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার জন্য যুব সমাজের প্রতি আহবান জানানো যাইতেছেঃ ১। অবলিম্বে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া পূর্ণ আজাদী ঘোষণা করিতে হইবে। আগামী অক্টোবরের বৃটিশ উপনিবেশ সম্মেলনে যোগদান করা চলিবে না। বৃটিশ আমলের কোন ইংরাজ অফিসারের পেনসনের খরচ পাকিস্তান সরকার বহন করিতে পারিবে না। ১৯৪৮ সালের মধ্যেই পাকিস্তানের ষ্ট্রালিং পাওনা কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়া লইতে হইবে- কোন রকম দীর্ঘ-মেয়াদী চুক্তি করা চলিবে না। ২। প্রাপ্ত বয়স্কদের সাৰ্ব্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অবিলম্বে নুতন গণপরিষদ মারফৎ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন করিতে হইবে। ৩। ভাষার ভিত্তিতে স্বয়ং শাসন অধিকার সম্পন্ন প্রদেশ গড়িবার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানিয়া লইতে হইবে। ৪। সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকারর স্বীকার করিতে হইবে। ৫। জনগণের স্বার্থে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য এবং সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক দেশগুলির সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করিতে হইবে। ৬। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদার প্রথার উচ্ছেদ করিয়া কৃষককে জমির মালিক করিতে হইবে। কৃষকের ঋণ মকুব করিতে হইবে। ক্ষেত-মজুরদের ন্যায্য মজুরী দিতে হইবে। ৭। বড় বড় শিল্প, বড় ব্যাঙ্ক, ইনসিওরেন্স কোম্পানীগুলি জাতীয়করণ করিতে হইবে। শ্রমিকদের খাটুনির সময় আট ঘন্টা বধিয়া দিতে হইবে এবং বাঁচার মত মজুরীর ব্যবস্থা করিতে হইবে। ৮। ব্যাঙ্ক, চা বাগান, খনি ইত্যাদি বড় বড় ব্যবসায় নিয়োজিত বিদেশী মূলধন বাজেয়াপ্ত করিতে হইবে। মার্শাল প্লান অথবা অন্য কোন বিদেশী মূলধন জাতীয় স্বার্থবিরোধী শর্তে গ্রহণ করা চলিবে না। ৯। বিনা ব্যয়ে শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও সাৰ্ব্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা চালু করিতে হইবে। ১০। রাষ্ট্রের খরচে স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে। ১১। জনগণকে সামরিক শিক্ষা দিতে হইবে এবং জনগণের সামরিক বাহিনী গড়িয়া তুলিতে হইবে। ১২। নারীদের সমান গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করিতে হইবে। পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটির সেক্রেটারী মোহাম্মদ একরামূল হক কর্তৃক এই ইস্তাহার উত্থাপিত হয় এবং উপস্থিত প্রতিনিধিগণ কর্তৃক সৰ্ব্বসম্মতি ক্রমে গৃহীত হয়।
<001.033.104>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
১। খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াও
আমলাতান্ত্রিক গাফিলতির মুখোশ খুলিয়া দাও
জনগণের প্রতিরোধ গড়িয়া তোল
পূর্বপাকিস্তানে খাদ্যসমস্যা প্রকট হইয়া উঠিয়া যশোহর জেলায় ৪০ টাকা, খুলনায় ৩৮ টাকা, পাবনা নদীয়ায় ৩৫ টাকার উপরে চাউলের দর চলিতেছে। ২২/২৪ টাকার নীচে কোন জেলাতেই চাউল পাওয়া সম্ভব নয়। এক কথায় বলিতে গেলে পূৰ্ব্ব পাকিস্তানে খাদ্যের মূল্য জনসাধারণের নাগালে বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইহা দ্বিতীয় খাদ্য সংকট। এই সংকট সমাধানে সরকারের তরফ হইতে এক বিবৃতি দেওয়া ছাড়া অন্য কোনই চেষ্টা হইতেছে না। খাদ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ সম্পর্কে সরকারী নীতি খাদ্য সংকটকে আরও প্রকট করিয়া তুলিতেছে। এখন পর্যন্ত খাদ্য সংগ্রহের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা হয় নাই। বড় জোতদার ও মজুতদারদের স্পর্শ না করিয়া সাধারণ কৃষকের নিকট হইতে ধান চাউল সংগ্রহ করাই সরকারের নীতি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মজুতদার ও জোতদারকে তোষণ করিয়া কৃষকের ধান সীজ করিবার নীতিতে খাদ্য সংগ্ৰহ হইতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানীরও কোন ব্যবস্থা হইতেছে না। যে খাদ্য বৰ্ত্তমানে সরকার সংগ্ৰহ করিয়াছেন তাহাও সঠিকভাবে সরবরাহ হইতেছে না। খাদ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ এইরূপ চলিতে থাকায় ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোকের পূর্ব পাকিস্তান আজ এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সামনে উপস্থিত হইয়াছে। রাজশাহী বিভাগীয় যুব সম্মেলন ভয়াবহ উদ্বেগের সঙ্গে এই পরিস্থিতি লক্ষ করিতেছে। খাদ্য সমস্যার আশু সমাধানের জন্য অবিলম্বে নিলিখিত কৰ্ম্মপদ্ধতি গ্রহণ করিবার জন্য এই সম্মেলন সরকারের নিকট দাবী করিতেছেঃ ১। কৃষকদের নিকট হইতে জবরদস্তিমূলকভাবে ধান কাড়িয়া লওয়া চলিবে না। অবিলম্বে সমস্ত জোতদার ও মজুতদারদের বাড়তি খাদ্য বাজেয়াপ্ত করিয়া লইতে হইবে। ২। ভারত ও পাকিস্তানের বাহিরে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমঝোতা করিয়া খাদ্য আমদানীর ব্যবস্থা করিতে হইবে। ৩। সরকার কর্তৃক সংগৃহীত খাদ্য কালবিলম্ব না করিয়া ঘাটতি এলাকায় সস্তা দরে সরবরাহ করিতে হইবে। ৪। প্রত্যেক শহরে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করিতে হইবে এবং রেশনিং এলাকায় নিয়মিতভাবে সস্তা দরে খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করিতে হইবে। ৫। যে সমস্ত লোক দুস্থ হইয়া পড়িয়াছে এবং খাদ্যক্রয়ে অক্ষম তাহদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য বিলির ব্যবস্থা করিতে হইবে। বন্যাপীড়িত অঞ্চলে দ্রুত সরবরাহ পাঠাইতে হইবে। ৬। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের মূল্য কমাইইতে হইবে।
<001.033.105>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৭। কৃষকের ক্রয় শক্তি বৃদ্ধির জন্য অর্থকারী ফসল যেমন পাট ইত্যাদির মূল্য বৃদ্ধি করিয়া সর্বনিম্ন দর বাঁধিয়া দিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন দর মণ প্রতি ৪০ টাকা বধিয়া দিতে হইবে। ৮। মজুর ও মধ্যবিত্ত কর্মচারীদের মাহিনা বৃদ্ধি করিতে হইবে। ৯। জিন্নাহ তহবিল হইতে দুই-তৃতীয়াংশ অর্থ পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষ ও বন্যাপীড়িতদের সাহায্যের জন্য বরাদ্দ করিতে হইবে। উপরোক্ত পদ্ধতি যাহাতে অবিলম্বে কার্যকরী করা হয় তজ্জন্য আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার জন্য পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের যুব সমাজ ও জনসাধারণের নিকট এই সম্মেলন আহবান জানাইতেছে। ২। জমিদারী উচ্ছেদের ভাঁওতা দিয়া কৃষক উচ্ছেদ চলিবে না। বিনা খেসাতে জমিদারী উচ্ছেদ ও কৃষককে জমির মালিক করিতে হইবে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী নিজের শাসন ও শোষণ কায়েম করিবার জন্য জমিদারী প্রথার সৃষ্টি করিয়া আমাদের দেশের জনসাধারণের অর্থননিতক জীবন পঙ্গু করিয়া দিয়াছে। দেশে চিরস্থায়ী খাদ্যসমস্যার সৃষ্টি করিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট এই ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে কৃষকের আন্দোলন বহুদিনের আন্দোলন। আজাদী পাইলে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করিয়া কৃষককে জমির মালিক করা হইবে-ইহাই ছিল নেতাদের ওয়াদা। আজাদ পূৰ্ব্ব পাকিস্তান সরকার জমিদারী উচ্ছেদের এক বিলও উত্থাপন করিয়াছে। কিন্তু এই বিলে যে সমস্ত ধারা রহিয়াছে তাহা সমস্তই কৃষক স্বার্থের বিরোধী। এই বিলের মূলধারাগুলি হইতেছেঃ (১) জমিদারদের জন্য ৪০ কোটি টাকারও অধিক ক্ষতিপূরণ। (২) জোতদারদের জন্য জমি। (৩) জমিদারদের ঋণ মকুব। (৪) ওয়াকফ ও দেবোত্তর সম্পত্তির সুবিধা ইত্যাদি। এই সম্মেলনের মতে উপরোক্ত সমস্ত ধারাগুলি কৃষক স্বার্থবিরোধী এবং বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করিয়া কৃষককে জমির মালিক করিবার মূল দাবী গৃহীত হয় নাই। এই বিল পাশ হইলে জমিদারী উচ্ছেদের পরিবৰ্ত্তে কৃষক উচ্ছেদেরই ব্যবস্থা হইবে। জমিদারী উচ্ছেদের নামে এইরূপ কৃষক বিরোধী বিল উত্থাপন করিয়া সরকার পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের জনমতের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে। এই সম্মেলনে প্রস্তাবিত বিলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করিতেছে এবং অবিলম্বে এই বিল প্রত্যাহার করিয়া বিনা ক্ষতিপূরণে ও “কৃষকই জমির মালিক” এই নীতির ভিত্তিতে জমিদারী উচ্ছেদের দাবী জানাইতেছে। এই সম্মেলন মনে করে যে তুমুল আন্দোল ব্যতীত সরকার কৃষকের দাবী অনুযায়ী জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করিবে না। কৃষকের শ্রেণী সংগঠনকে জোরদার করিয়াই এই অন্দোলন সফল হইতে পারে। এই সম্মেলন পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের যুব সমাজকে কৃষকের শ্রেণী সংগঠনকে সৰ্ব্বতোভাবে সাহায্য করিয়া জমিদারী উচ্ছেদকে সফল করিবার জন্য আহবান জানাইতেছে। ৩। রেল শ্রমিকের বাঁচিবার লড়াইয়ে সাহায্য করিব। আসন্ন রেল ধর্মঘটকে কামিয়াব করেত সর্বপ্রকার সহযোগিতা দিব। পাকিস্তান সরকারের শ্রমনীতি পাকিস্তানের রেল মজুরদের ধ্বংসের মুখে ঠেলিয়া দিতেছে। পাকিস্তান রেলওয়েতে প্রায় ১৬,০০০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মুখে। পে কমিশনের রায় চালু, গ্রেনশপের পাকা ব্যবস্থা,
<001.033.106>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
বাসস্থান ইত্যাদি শ্রমিকদের কোন দাবীই সরকার পূরণ করে নাই উপরন্তু রেল শ্রমিক আন্দোলনের উপর ব্যাপক দমননীতি প্রয়োগ করা হইতেছে। তাই রেলশ্রমিকরা বাধ্য হইয়া নিৰ্ম্মলিখিত পাঁচটি মূল দাবীর ভিত্তিতে সাধারণ ধৰ্ম্মঘটের প্রস্তুতির জন্য ষ্ট্ৰাইক ব্যালট গ্রহণ করিতেছেঃ (১) পুরাতন পে কশিশনের রায় চালু করিতে হইবে। (২) ছাঁটাই বন্ধ করিতে হইবে। (৩) গ্রেনশপের তালিকাভূক্ত দ্রব্য পূর্ণ সরবরাহের ব্যবস্থা করিতে হইবে। (৪) বাসস্থানের ব্যবস্থা করিতে হইবে। (৫) দমননীতি বন্ধ করিতে হইবে এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হইবে। এই সম্মেলন রেল শ্রমিকদের দাবী-দাওয়া ন্যায্য বলিয়া মনে করে এবং দাবী আদায়ের জন্য শ্রমিকদের ধৰ্ম্মঘটের সিদ্ধান্তকে পূর্ণভাবে সমর্থন করিতেছে এবং তাহাদের সংগ্রাম সৰ্ব্বপ্রকার সাহায্য ও সহানুভূতির প্রতিশ্রুতি দিতেছে। রেল ধৰ্ম্মঘটকে সাফল্যমন্ডিত করিবার জন্য এই সম্মেলন বিভিন্ন রেলশ্রমিক প্রতিষ্ঠানকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করিবার আহবান জানাইতেছে। ৪। ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য লড়ো আজাদ পাকিস্তানে ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ চরম পর্যায়ে উঠিয়াছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণে পাকিস্তান সরকার সাম্রাজ্যবাদীদেরও ছাপাইয়া উঠিয়াছে। সভা, শোভাযাত্রা করিবার অধিকার ব্যাপকভাবে খৰ্ব্ব করা হইতেছে। ১৪৪ ধারার যথেচ্ছ প্রয়োগ, বিনা বিচারে আটক, অন্তরীণ ও বহিস্কার আদেশ, গ্রেপ্তারী পরওয়ানা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। দমননীতি, পুলিশ জুলুম ও অর্ডিন্যান্স-রাজ পাকিস্তানবাসী জনসাধারণের জীবনে বিভীষিকা সৃষ্টি করিয়াছে। এই সম্মেলন ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর সরকারী আক্রমণ এবং দমননীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করিতেছে এবং অবিলম্বে সমস্ত বিনা বিচারে আটক বন্দীদের মুক্তি, ১৪৪ ধারা, গ্রেপ্তারী পরোয়ানা, অন্তরীণ ও বহিস্কার আদেশের আশু প্রত্যাহার দাবী করিতেছে। দমননীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়িয়া তুলিয়া ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য এই সম্মেলন দলমত নিৰ্ব্বিশেষে সমস্ত যুবক ও জনসাধারণকে আহবান জানাইতেছে। ৫। যুব আন্দোলনের উপর হামলা বরদাস্ত করা হইবে না। এই সম্মেলন গভীর উৎকণ্ঠার সহিত লক্ষ্য করিতেছে যে, পাকিস্তান সরকার গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ প্রতিষ্ঠিত হইবার পর হইতে ইহার উপর হামলা শুরু করিয়াছে। সম্প্রতি ঢাকায় যুবলীগের কেন্দ্রীয় অফিস খানাতল্লাশী করা হইয়াছে। যুবলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত মিঃ আতাউর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারী করা হইয়াছে এবং প্রাদেশিক কমিটির সদস্য মিঃ আবদুল আওয়ালের উপর ময়মনসিংহ জিলা হইতে বহিস্কার আদেশ জারী করা হইয়াছে। এই সম্মেলন, যুবলীগের প্রতি সরকারী দমননীতির তীব্র প্রতিবাদ করিতেছে এবং অবিলম্বে মিঃ আতাউর রহমানের উপর হইতে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা প্রত্যাহার এবং মিঃ আব্দুল আউয়ালের উপর হইতে বহিস্কার আদেশ উঠাইয়া লইবার দাবী জানাইতেছে।
<001.033.107>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৬। ব্যাপক ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াও এই সম্মেলন বিশেষ উৎকণ্ঠার সহিত লক্ষ্য করিতেছে যে, পাকিস্তান সরকারের ছাঁটাই-নীতি দেশের মধ্যে এক ভয়ানক বিভীষিকার সৃষ্টি করিয়াছে। ছাঁটাই নীতির কবলে পড়িয়া হাজার হাজার দরিদ্র কৰ্ম্মচারী ও মজুরের সংসার ছারখার হইয়া যাইতেছে। এই সম্মেলন সরকারের এই ছাঁটাই নীতির তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছে এবং সম্মেলন মনে করে যে, এইরূপে সমস্যা বাড়িবে কিন্তু কমিবে না। সুতরাং সম্মেলনের দাবী যে, ছাঁটাই নীতি অবিলম্বে বন্ধ করিতে হইবে এবং যাহাদিগকে ছাঁটাই করা হইয়াছে তাহাদিগকে পুনর্নিয়োগ করিতে হইবে। ৭। ধ্বংসমুখী শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচাও পূর্বপাকিস্তানে শিক্ষা ব্যবস্থায় ভীষণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইয়াছে। চট্টগ্রাম, ঢাকা, রংপুর প্রভৃতি জেলায় বিদ্যালয়ে সরকারী দপ্তর স্থাপন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল কিন্তু সংঘবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন দ্বারাই সরকারী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। পাকিস্তান লাভের আগে রাজশাহী জেলায় প্রাইমারী স্কুল ছিল ১২০০ শত, বৰ্ত্তমান সরকার তাহাকে ৮০০ শতে নামাইবার ব্যবস্থা করিয়াছেন। প্রাইমারী শিক্ষকগণের মাহিনা প্রয়োজনের তুলনায় অকিঞ্চিঃৎকর কিন্তু তাহাও নিয়মিত পাইতেছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নূতন সিলেবাস অনুযায়ী নূতন পুস্তক এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণে বাজারে বাহির না হওয়ার জন্য ছাত্রদের পড়াশুনা ভয়ানক ক্ষতি হইতেছে এবং বিভিন্ন সাময়িক পরীক্ষাগুলি বন্ধ রহিয়াছে। ছাত্রদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য খাতা, পেন্সিল, কাপড়, কেরোসিন প্রভৃতির অভাবে ছাত্র জীবন বিপন্ন কিন্তু সরকারের তরফ হইতে কোন প্রকার সাহায্য তো করা হয় নাই বরং যাহারা নিত্য প্রয়োজনীয় দাবী লইয়া আন্দোলন করিতেছে তাহাদের উপর সরকারী দমননীতি নগ্নরূপে প্রকাশ পাইতেছে। আজ শিক্ষা জীবনে যে সংকট দেখা দিয়াছে তাহা রোধ করিবার জন্য অবিলম্বে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলি কার্যকরী করিবার জন্য এই সম্মেলন সরকারের নিকট দাবী জানাইতেছে; এবং এই সমস্ত দাবী সরকার যাহাতে কার্যকরী করেন তাহার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার জন্য ছাত্রসমাজকে আহবান জানান যাইতেছেঃ (১) কোন প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা হাই স্কুল তুলিয়া দেওয়া চলিবে না। (২) শিক্ষকগণকে মানুষের মত বাঁচিবার উপযোগী বেতন দিতে হইবে। (৩) বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমরূপে চালু করিতে হইবে। (৪) বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবৰ্ত্তন করিতে হইবে। (৫) ছাত্রদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস খাতা, পেন্সিল, বই, কেরোসিন ইত্যাদি নিয়মিত সরবরাহের ব্যবস্থা করিতে হইবে। (৬) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য কলেজে বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষকের যে সমস্ত পদ খালি রহিয়াছে তাহার পূরণ করিতে হইবে। (৭) শিক্ষালয়ে পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে ইউনিয়ন চালু করিতে হইবে। ৮। জনস্বাস্থ্যের প্রতি সরকারী উদাসীনতার প্রতিকার চাই পূর্বপাকিস্তানে জনস্বাস্থ্য বিপন্ন হইয়াছে। জনসংখ্যার তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা নগণ্য। ঔষধপত্র বাজারে দুষ্প্রাপ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। যাহাও আসিতেছে অগ্নিমূল্যের জন্য জনসাধারণের আয়ত্তের বাহিরে। ঔষধপত্র
<001.033.108>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
আমদানীর কোন ব্যবস্থা হইতেছে না। ডাক্তারী শিক্ষার জন্য মেডিক্যাল স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। স্বাধীন পাকিস্তানে জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য নূতন ব্যবস্থা হওয়া দূরের কথা যেটুকু ব্যবস্থা আছে সরকারের অবহেলায় তাহাও বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছে। সরকারী হাসপাতালগুলিতে ঔষধ নাই, দুনীতিতে পূর্ণ। পল্লীর জনস্বাস্থ্য রক্ষার যেটুকু ব্যবস্থা ছিল তাহাও জনস্বাস্থ্য কৰ্ম্মচারীদের ছাঁটাই করিয়া ধ্বংস করিবার পরিকল্পনা চলিতেছে। এই সম্মেলন সরকারের জনস্বাস্থ্যবিরোধী মনোভাবের তীব্র নিন্দা করিতেছে এবং অবিলম্বে জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলি কার্যকরী করিবার দাবী জানাইতেছে এবং এই ব্যবস্থাগুলি যাহাতে সরকার কার্যকরী করেন তার জন্য আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে এই সম্মেলন জনসাধারণ এবং যুবসমাজকে আহবান জানাইতেছেঃ (১) হাসপাতালগুলিতে ঔষধ সরবরাহ করিয়া সক্রিয় ও দুনীতিমুক্ত করিতে হইবে। (২) প্রতি ইউনিয়নে হাসপাতাল খুলিয়া বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে। এ, জি, হাসপাতালগুলিকে পুনজীবিত করিতে হইবে। (৩) মেডিক্যাল স্কুল-কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে হইবে। (৪) জনস্বাস্থ্য বিভাগকে রাষ্ট্ৰীয়করণ করিতে হইবে এবং ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ড হেলথ এ্যাসিসটেন্টদের চাকুরী স্থায়ী করিতে হইবে। সাংগঠনিক প্রস্তাবাবলী উপরোক্ত প্রস্তাবগুলি ছাড়া সম্মেলনে নিম্নলিখিত বিষয়ে চারিটি সাংগঠনিক প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছেঃ • রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটি গঠন। রাজশাহী শহরে আঞ্চলিক অফিস স্থাপন। আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ হইতে যুব অভিযান’ নামে পাক্ষিক প্রচারপত্র প্রকাশ। প্রাদেশিক যুবলীগ সম্মেলন আহবানের জন্য প্রাদেশিক কমিটিকে অনুরোধ। যুব অভিযান গণতান্ত্রিক যুবলীগের রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটির তরফ হইতে যুব অভিযান’ নামে একখানা পাক্ষিক প্রচারপত্র বাহির করিবার সিদ্ধান্ত লওয়া হইয়াছে। এই প্রচার পত্রিকার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। রাজশাহী বিভাগের প্রত্যেক জেলা, মহকুমা এবং প্রাথমিক যুবলীগ কমিটিগুলিকে অর্থ সংগ্ৰহ করিয়া পাঠাইবার জন্য আবেদন করা যাইতেছে। কেহ সরাসরি সাহায্য পাঠাইলেও সাদরে গৃহীত হইবে। যুব আন্দোলনকে বেগবান করিতে হইলে প্রচারপত্রের প্রয়োজনীয়তা কতখানি তাহা বলা বাহুল্য। বিভিন্ন যুবলীগ কমিটি কতখানি “যুব অভিযান লইতে চান তাহা অবিলম্বে জানাইবেন। যেখানে যুবলীগ গঠিত হয় নাই সেখানকার কোন যুবকর্মী ব্যক্তিগতভাবে “যুব অভিযান লইতে ইচ্ছুক থাকিলে বিভাগীয় অর্থ পাঠাইবার ঠিকানাঃ মাহবুব আহম্মদ খান (কোষাধ্যক্ষ), পোঃ ঈশ্বরদী, পাবনা।
১৯৪৭ সনে পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই ঢাকা রাজশাহী ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় এর শাখা খোলা হয়, কিন্তু তীব্র পুলিশী নির্যাতন ও ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের গুন্ডাদের অত্যাচারের ফলে ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে এই সংগঠনের বিলুপ্তি ঘটে।