বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – প্রথম খণ্ড
শিরোনামঃ মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদায়-পূর্ব ভাষণ
সুত্রঃ কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ; স্পিচেজ এ্যাজ গভর্নর জেনারেল অব পাকিস্তান, ১৯৪৭-৪৮। পৃষ্ঠা – ১০৭
তারিখঃ ২৮শে মার্চ ১৯৪৮
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিদায়ী ভাষণ
রেডিও পাকিস্তান থেকে সম্প্রচারিত,
২৮ শে মার্চ, ১৯৪৮, ঢাকা
বিগত নয় দিন আপনাদের প্রদেশে অবস্থানের প্রাক্কালে আমি আপনাদের স্থানীয় অবস্থা এবং কিছু সমস্যা পর্যেবেক্ষ্ণ করছিলাম, যা পূর্ব বাংলা সম্মুখিন হয়েছে। আজরাতে, আমার বিদায়ের প্রাক্কালে, আমি আমার কিছু অনুভূতির কথা আপনাদের বলতে চাই। এটা করার আগে, যাইহোক, আমি আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ দিতে চাই আপনাদের মাঝে আমাকে উষ্ণ এবং সাদর ভাবে গ্রহণ করার জন্য, আমার পুরো অবস্থানকালে।
প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে, পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্য যে কোন প্রদেশ থেকে সম্ভবত বেশি সমস্যার মুখোমুখি দেশ ভাগের কারণে। ১৫ আগস্টের পূর্বে, এই প্রদেশ ছিল কলকাতার পশ্চাৎ প্রদেশরূপে। যার (কলকাতার) উন্নয়নে এর (ঢাকা) অবদান থাকলেও সেটা ভাগাভাগির ছিল না। ১৫ আগস্টে, ঢাকা ছিল নিছক একটি মফস্বল শহর, যার মাঝে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা/ সরকারের আবশ্যকীয় সুবিধা- বন্দোবস্তের কিছুই ছিল না। আরো বলা যায়, দেশ বিভাগের পরে, এই প্রদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং প্রশাসনিক কাঠামো সাংঘাতিকভাবে বিশৃঙ্খল ছিল যখন দেশে খাদ্যের সংকট চলছিল। এভাবে নব্য প্রদেশ পূর্ব বাংলা চরমতম প্রতিকূল অবস্থার মাঝে পরে, যা দুর্বল সংকল্পের এবং স্বল্প দৃঢ়তার মানুষদের জন্য মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রতিকূল অবস্থায় প্রশাসন শুধু বেঁচেই থাকেনি বরং চট্টগ্রামের সাইক্লোনের মত দূর্যোগের মাঝেও আরো উজ্জ্বল ভাবে জ্বলে উঠেছে, যা জনসাধারণের অসাধারণ চরিত্র এবং প্রদেশ সরকারের দূর্দমনীয় তেজ- উভয়ের জ্বলন্ত সম্মাননার চিহ্ন। এখন অবস্থা এমন যে, প্রারম্ভিক সমস্যাগুলির বড় দিক অতিক্রম করতে হবে এবং এখানে আরামের কোন সুযোগ নেই, এরপরেও অন্তত ভবিষ্যতের জন্য পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী হবার কারণ রয়েছে। যদিও এখনো অনুন্নত, পূর্ব বাংলার রয়েছে কাঁচামাল এবং পানিবিদ্যুতের অফুরান সম্ভাবনা। চট্টগ্রামে আপনাদের রয়েছে প্রথম শ্রেণীর বন্দরের উপাদান, যা পৃথিবীর সব থেকে সেরা বন্দরগুলির একটি হওয়া উচিৎ সময়ের সাথে সাথে। শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি এবং সব শ্রেণির জনসাধারণের সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিয়ে, আমরা এই প্রদেশকে পাকিস্তানের সব থেকে সমৃদ্ধ প্রদেশে পরিণত করব।
এটা অভিনন্দনের যোগ্য যে, দেশ ভাগের পরবর্তী মাসগুলিতে ভারত রাজত্বে মুসলিম গণহত্যা এবং নিপীড়নের পরেও এই প্রদেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিরাজ করছে এবং আমি দেখেছি যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পরিপূর্ণ নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের দৈনন্দিন কাজ করছেন। ভারত অঞ্চলের দিকে কিছু দূর্ভাগ্যজনক হিন্দু-দেশান্তরের ঘটনা ঘটেছে যদিও, তবে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের দেয়া হিসাব হাস্যকর। যে কোন হিসাবে আমি সন্তুষ্ট যে, যা-ই দেশান্তরের ঘটনা ঘটুক না কেন, তা এখানে তাঁদের প্রতি ব্যবহারের কারণে ঘটেনি, এই অবস্থায় যা আদর্শনীয়, তবে তা মানসিক এবং বহিরাগত চাপে নয়।
<001.032.092>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – প্রথম খণ্ড
ভারতের নেতারা এবং সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ মুক্তভাবে যুদ্ধাংদেহী প্রচারকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ভারতে জনগনসাধারণের বিনিময়/প্রতিস্থাপন এবং বিশৃঙ্খলার জন্য হিন্দু মহাসভার মত দলের অবিরাম হীন প্রপাগাণ্ডা, যাতে মুসলিমরা নিধন হচ্ছেন, যাতে পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মত ভয়ের উদ্রেক ঘটেছে
এরকিছুর পরে, সাম্প্রতিক ভারত সরকার দ্বারা শুল্ক বিভাগে পাকিস্তানকে বিদেশী রাষ্ট্র ঘোষণা এবং অন্য পদক্ষেপগুলি হিন্দু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে চরম আর্থিক সমস্যায় ফেলেছে এবং তাদের ব্যবসা ভারতে সরিয়ে নিতে চাপ তৈরি করেছে। আমি দেখেছি প্রাদেশিক সরকার বারবার আশ্বস্ত করেছেন এবং সবসময় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং কল্যাণের জন্য দরকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন যতদূর সম্ভব এবং তাঁদের সর্বোচ্চ নিরস্ত করার চেষ্টা করছেন যাতে তাঁরা তাঁদের পৈত্রিক আবাস ছেড়ে ভারতে অনিশ্চিত যাত্রা না করেন।
আমি এখন আপনাদের কিছু উপদেশ/পরামর্শ দিতে চাই সবিনয়ে। আমি দেখেছি যে একশ্রেণীর মানুষের মাঝে কিছু অপ্রত্যাশিত দৃষ্টিকোণের প্রবণতা রয়েছে তাদের সদ্য উপার্জিত স্বাধীনতা নিয়ে, এটা স্বাধীনতায় উন্মুক্ত বিশাল সুযোগ এবং তাদের উপরে আরোপিত দায়িত্ব হিসাবে নয়, বরং তাঁরা একে অনুমতিপত্র হিসাবে দেখছেন। এটা সত্য যে, বৈদেশিক কর্তৃত্ব দূর হওয়ার সাথে সাথে জনসাধারণ এখন তাদের নিয়তির চূড়ান্ত বিচারক। তাদের যথাযোগ্য স্বাধীনতা রয়েছে আইনগতভাবে যে কোন সরকার বেছে নেওয়ার। এর মানে যাই হোক এটা নয় যে, কোন সম্প্রদায় বেআইনীভাবে কোন পদক্ষেপ আরোপিত করবে জনপ্রিয়ভাবে নির্বাচিত কোন সরকাররের উপরে। সরকার এবং এর নিয়মনীতি ভোট নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে পরিবর্তিত হতে পারে প্রাদেশিক আইনগত সভায়। শুধু তাই নয়, কোন সরকারই কোন অপরিণামদর্শী এবং দায়িত্বহীন মানুষের কোন গুণ্ডামি- ডাকাতি আইন এক মুহূর্তের জন্য সহ্য করবে না এবং তা ধূলিসাৎ করতে কঠোর ব্যবস্থা অবশ্যই নিবে। আমি বিশেষ করে চিন্তা করছি ভাষা- বিতর্ক নিয়ে যা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা এবং সমস্যা তৈরি করছে প্রদেশের একটি অংশে এবং যদি এটা বন্ধ করা না যায় তবে তা চরম পরিণতির দিকে যাবে। এই প্রদেশের সরকারী ভাষা/ রাষ্ট্রীয় ভাষা কী হবে তা আপনাদের প্রতিনিধিরাই নির্ধারণ করবেন।
তবে এই ভাষা-সমস্যা প্রাদেশিকতার বড় সমস্যার একটি দিক। আমি নিশ্চিত যে আপনারা অবশ্যই বুঝতে পারছেন, পাকিস্তানের মত নব্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের, যা আবার দুইটি বিশালভাবে বিভক্ত অংশ, উন্নতি এবং সেই সাথে এর টিকে থাকার জন্য সর্ব সাধারণ জনগণের, তাঁরা যে অঞ্চলেরই হোন না কেন, একাত্মতা এবং ঐক্যের একান্ত দরকার। পাকিস্তান মুসলিম ভ্রাতিত্ব এর একটি নিদর্শন এবং অবশ্যই একে বেঁচে থাকতে হবে। এই ঐক্য আমরা, সত্যিকারের মুসলিম হিসাবে সর্বোচ্চভাবে প্রহরায় রাখব এবং রক্ষা করব। যদি আমরা আমাদের বাঙ্গালী,পাঞ্জাবী, সিন্ধী ইত্যাদি পরিচয়কে মূখ্য হিসাবে ভাবতে শুরু করি এবং এর মুসলিম ও পাকিস্তানী পরিচয়কে ঘটনাক্রমে পাওয়া বলে ধরে নেই, তাহলে পাকিস্তান খণ্ড-বিখণ্ড হতে বাধ্য। ভাববেন না যে এটি কিছু অস্বচ্ছ সিদ্ধান্তের ফসল। আমাদের শত্রু পরিপূর্ণভাবে সক্রিয় আছে যে কোন সুযোগের অপেক্ষায় , যেটা আমি আপনাদের সতর্ক করে দিতে চাই যে তারা এর মাঝেই চক্রান্তে মেতে আছে। আমি আপনাদের পরিষ্কারভাবে অনুরোধ করছি, ভারত সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং অঙ্গগুলি, যারা সর্বোতভাবে চেষ্টা করেছিল পাকিস্তান সৃষ্টির বিরুদ্ধে, হঠাৎ করে সংবেদনশীল সুযোগ পেয়ে গিয়েছে,যাতে তারা দাবী করছে পূর্ব বাংলার মুসলিদের, আপনারা কি একে চরম অশুভ সংকেত হিসেবে দেখছেন না ? এটা কি পূর্ণভাবে পরিষ্কার নয় যে, মুসলিমদের পাকিস্তান গঠনে বাঁধাদানে ব্যর্থ হয়ে এই চক্রগুলি এখন চেষ্টা করছে হীন প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে মুসলিম ভাইয়ের বিরুদ্ধে মুসলিম ভাইকে দাড়া করিয়ে পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দিতে ? এই কারণে আমি প্রাদেশিকতা নামের বিষের বিরুদ্ধে আপনাদের রক্ষক হতে চাই, যা আমাদের শত্রুরা প্রোথিত করতে /অনুপ্রবেশ করতে ইচ্ছুক আমাদের রাষ্ট্রে । অনেক মহান কাজ করতে বাকী এবং অনেক বিপদ অতিক্রম করতে হবে, আমরা তা করবোই নিশ্চিতভাবে। কিন্তু আমরা দ্রুততরভাবে এটা করতে পারবো যদি আমাদের ঐক্য অক্ষত থাকে এবং একক জাতি হিসাবে সামনে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় অকম্পিত থাকে। এটাই পাকিস্তানকে জাগিয়ে তোলার একমাত্র উপায় এবং নিশ্চিতভাবে উন্নতি করার, সভ্য জগতে সম্মান জনক স্থান পাওয়ার।
<001.032.093>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – প্রথম খণ্ড
এখানে আমি পূর্ব পাকিস্তানের মহিলাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই। জাতি গঠনের বিশাল কার্যে এবং এর ঐক্য বজায় রাখতে, মহিলাদের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার আছে। জাতির মেরুদণ্ড গঠনকারী যুব সম্প্রদায়ের চরিত্রের মূল স্থপতি হিসাবে শুধু মাত্র নিজ গৃহে নয়, তারা যেন তাদের দূর্ভাগা/ কম ভাগ্যবান বোনদেরও এই মহান কাজের সাথে সাহায্য করেন। আমি জানি পাকিস্তান অর্জনের সুদীর্ঘ সংগ্রামে, মুসলিম মহিলাগণ তাদের পুরুষদের পিছনে দৃঢ়ভাবে দাড়িয়েছেন। এরথেকেও বড় সংগ্রাম পাকিস্তান বিনির্মাণে, যা সামনে পরে আছে, এটা যেন না বলা হয় পাকিস্তানের মহিলারা পিছনে পরে আছেন কিংবা তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।
পরিশেষে, আমি সরকারী কর্মচারীদের, কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক- যা অগ্রগতির মহান অংশ, উদ্দেশ্য করে কিছু বিশেষ কথা বলতে চাই, যাদের অনেকেই এই প্রদেশে কঠিন অবস্থায় কাজ করে যাচ্ছেন। আপনাদেরই রয়েছে মহান দায়িত্ব। আপনাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, এই প্রদত্ত প্রদেশে, শুধু মাত্র করতে বাধ্য দৈনন্দিন কার্যাবলীয় নয়, আপনাদের সক্ষমতার নিঃস্বার্থতার চূড়ান্ত শ্রম দিতে হবে এই রাজ্যের জন্য। এই জাতি নির্মাণের মহান যজ্ঞে, আপনাদের সামনে রয়েছে অপূর্ব সুযোগ। আপনারা এর মাঝে যে সাহস, বিশ্বাস এবং সংকল্প দেখিয়েছেন তা বজায় রাখতে হবে ভবিষ্যত মোকাবেলায় এবং আপনাদের কাজ সম্পাদনে।
এই সব কিছুর উপরে, আপনারা নিজেদের, হীন প্রচারণাকারী এবং স্বার্থবাজ আন্দোলনকারীদের হাতের পুতুল বানাবেন না যারা বাইরে আছে আপনাকে কলুষিত করতে এবং সেই সাথে একটি নতুন রাষ্ট্রের অবশ্যম্ভাবী সমস্যাগুলিকে কলুষিত করতে। পাকিস্তান সরকার এবং প্রাদেশিক সরকার গুরুত্বের সাথে পরিকল্পনা করে যাচ্ছেন উপায় এবং পথ খুঁজতে যাতে আপনারা আবাস এবং অন্য সমস্যাবলী, যা এই সন্ধিক্ষণে অবশ্যম্ভাবী, থেকে উত্তরণ পেতে পারেন এবং আমি বিশ্বাস করি এইসব সমস্যা অতি দ্রুতই কেটে যাবে। এই মহান রাষ্ট্র আপনারা যার অন্তর্ভুক্ত, আপনাদের থেকে দাবি করে, সেই জনসাধারণ তাঁদের আপনারা সেবা দেন এবং অবশ্যই আপনাদের নিজেদের, যাতে কোন সমস্যা আপনাদের থমকে না দেয় বরং সজাগ রাখে এবং সামনে এগিয়ে যায় এবং একাগ্রচিত্তে একান্ত প্রচেষ্টা বজায় রাখে। পাকিস্তানের সামনে অসাধারাণ ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে। এখন আমাদের কাজ প্রকৃতি আমাদের অফুরন্তভাবে যেইসব সুবিধা দিয়েছে তার সর্বোচ্চ সুবিধা নেয়া এবং একটি গর্বিত ও শক্তিমান জাতি তৈরি করা। পাকিস্তান জিন্দাবাদ !