You dont have javascript enabled! Please enable it!

উদ্বাস্তুদের মধ্যে এডওয়ার্ড কেনেডি

আমেরিকার কেনেডি বংশের সন্তানরা জনসম্বর্ধনা লাভে অভ্যস্ত। নিউ ইংল্যাণ্ডের কুলগৌরব, অগাধ বিত্ত, দুর্দমনীয় রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, উচ্ছল প্রাণচাঞ্চল্য, পারিবারিক সম্প্রীতি, দুর্ঘটনায় ও আততায়ীর অস্ত্রাঘাতে আকস্মিক মৃত্যু প্রভৃিতি এই পরিবারকে ঘিরে এমন একটা জাদু সৃষ্টি করেছে যা ‘কেনেডি’ নামের অধিকারী মাত্রকেই আমেরিকার মানুষের চোখের সামনে নিয়ে আসে। কেনেডি নামের সেই জাদু দেশের সীমানা পার হয়ে অন্যান্য দেশেও যদি কিছুটা ছড়িয়ে থাকে তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সেনেটর এডওয়ার্ড মুর ওরফে ‘টেডি কেনেডি মঙ্গলবার সল্ট লেকে ও সীমান্ত অঞ্চলে বাংলাদেশ থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থীদের দেখতে গিয়ে যে সম্বর্ধনা লাভ করেছেন সেটা কি তার প্রত্যাশার মধ্যে ছিল? যদি না থেকে থাকে তাহলেও বিস্ময়ের কিছুই নেই। বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নীতি যে বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষগুলির মনে ও ভারতবর্ষে গভীর হতাশা ও বিক্ষোভ সৃষ্টি করেছে সেটা এডওয়ার্ড কেনেডির নিশ্চয় অজানা নেই। যাদের দেখতে তিনি এসেছেন তারা অবশ্য জানেন যে, তার দেশের সরকারি নীতির দায়িত্ব তার নয়, সে দেশের সরকারি নীতি যে দলের দ্বারা পরিচালিত সেই দলেরও তিনি কেউ নন। কিন্তু সেই কারণেই আশ্রয়প্রার্থীদের বা ভারতবর্ষের তাঁর কাছে বড় কোন প্রত্যাশাও থাকতে পারে না। তিনি সিনেটের একজন সদস্য এবং সিনেটের অনেকগুলি সাব-কমিটির একটির চেয়ারম্যান। শুধু সিনেটর হিসাবে ও একটি সাব কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নীতির উপর তার প্রভাব নিশ্চয়ই এমন কিছু নয় যে জন্য তার মারফৎ নিকসন সরকারকে প্রভাবিত করা যাবে বলে আশা করা যেতে পারে। এমন কি, আশ্রয়প্রার্থীদের দরুন মার্কিন সরকারি সাহায্য বাড়িয়ে দেওয়ারও প্রত্যক্ষ ক্ষমতাও তার নেই।
কিন্তু তবু যে টেডি কেনেডির সফরের মধ্যে আশ্রয় প্রার্থীরা তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিয়েছেন, তাঁর কাছে খােলাখুলিভাবে নিজেদের সব কথা বলেছেন এবং ভারত সরকার যে তাঁকে আমন্ত্রণ করে এনেছেন তার কারণ ভিন্ন। সবচেয়ে বড় কারণ হল এই যে, গত কয়েক মাস যাবৎ এডওয়ার্ড কেনেডি ক্রমাগত ও অত্যন্ত জোরালােভাবে তার নিজের দেশের সরকারের পাকিস্তান নীতির সমালােচনা করে আসছিলেন। ইয়াহিয়া সরকারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন রকম সাহায্য দেওয়া উচিত নয়, ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক মহলে একথা তার চেয়ে বেশী জোরে সম্ভবত আর কেউ বলেন নি। বাংলাদেশ থেকে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে যারা ভারতে চলে আসছেন তাদের জন্য সাহায্য পাঠাবার কথাটাও তিনি প্রথম থেকেই বলে আসছেন। এ জন্য তাঁকে তাঁর সরকারের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘর্ষে নামতে হয়েছে। তাঁর এই সহানুভূমিশীল দৃষ্টিভঙ্গীই আগে থেকে তার জন্য জন্য এদেশে স্বাগত সম্বর্ধনার দ্বিতীয় আরও একটা কারণ ছিল। সেটা হচ্ছে এই যে, আমেরিকায় এডওয়ার্ডের পদ-মর্যাদা যাই হােক না কেন, সেখানকার সংবিধান ও সরকারি কার্যবিধি অনুসারে তার ক্ষমতা যতই সীমাবদ্ধ হােক না কেন, তিনি একজন কেনেডি এবং সকলেই জানেন, আমেরিকায় জনমত গঠনে একজন কেনেডির কথার দাম অনেকখানি। বাংলাদেশের আশ্রয়প্রার্থীরা এবং ভারতবর্ষের সরকার ও জনসাধারণ তাঁর কাছে আশা করবেন যে, এখান থেকে তিনি যে অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরবেন তার ভিত্তিতে তিনি তার প্রভাব সাধ্যমত প্রয়ােগ করবেন। ইতিমধ্যেই শরণার্থীদের মধ্যে গিয়ে তিনি তাদের দুঃখ দুর্দশার প্রতি যে আন্তরিক সহানুভূতির পরিচয় দিয়েছেন এবং তাঁদের সেই দুঃখ দুর্দশা লাঘবের জন্য যে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছেন তা মানুষকে অভিভূত করেছে। কিন্তু এই মানুষগুলি আশা করবেন যে ৭৫ লক্ষ আশ্রয়প্রার্থীর দুঃখ বিচলিত হয়ে তিনি শুধু মানবিক কর্তব্যটাই দেখবেন না, এই দুঃসহ অবস্থার রাজনৈতিক প্রতিকারের দিকটাও বিবেচনা করবেন এবং নিকসন সরকারের সামনে সেই দিকটাও তুলে ধরবেন।
পাকিস্তান সরকার যে তার সহকারীদের ও তাকে সে দেশ সফর করার অনুমতি দেন নি, এই ঘটনা থেকেও টেডি কেনেডিকে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশিত। কেনেডিকে দেখবার মতাে কিছুই তাদের নেই, বরং অনেক কিছু লুকোবার আছে। পাকিস্তান যদি কেনেডির তােয়া না করে তাহলে পাকিস্তান সম্পর্কে তারও কোন দায় থাকতে পারে না।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১২ আগস্ট ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!