You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.04 | দিল্লির দরবার ইঙ্গমার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের মুখােশ খুলে গেছে | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

দিল্লির দরবার ইঙ্গমার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের মুখােশ খুলে গেছে
সাত্যকি চক্রবর্তী

নিকসন ও হীথ সরকারের মুখােশ পুরােপুরি খুলে গেছে। ব্রিটিশ সরকার প্রথম থেকেই লুকোচুরির ধার ধারেননি। কিছু কিছু উদারনৈতিক পার্লামেন্ট সদস্য বাঙলাদেশে পাক শাসকচক্রের গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সােচ্চার হয়েছেন, কিন্তু ব্রিটিশ সাংবাদিক বাঙলাদেশে ইয়াহিয়া চক্রের গণহত্যার স্বরূপ তাদের রিপাের্টে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে ব্রিটিশ সরকার এবং ব্রিটিশ জনমত পাকিস্তানেরই পক্ষে। ইংরেজরা প্রধানত বেনিয়ার জাত আর এই ব্যাবসা পুরাে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে। সুতরাং প্রথম থেকেই ব্রিটিশ সরকার বলে আসছেন বাঙলাদেশের ঘটনা পাকিস্তানের আভ্যন্তরিক ব্যাপার। গণহত্যায় তারা দুঃখিত তবে কিছু সাহায্য দেওয়া ছাড়া বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে তাঁদের করণীয় কিছু নেই। বাঙলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোন প্রশ্ন তাে আসছেই না।
মার্কিন সরকার কিন্তু ব্রিটিশদের মতাে এত খােলাখুলিভাবে কিছু বলেননি। বরং প্রথম দিকে এমন একটা ভাব দেখাচ্ছিলেন যেন মার্কিন সরকার পাকিস্তান সরকারের এই বর্বরতা পছন্দ করছেন না। মার্কিন সাংবাদিকরা ইয়াহিয়া চক্রের গণহত্যার বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে মার্কিন জনগণের চোখ খুলে দিতে সাহায্য করেছিলেন। ভিয়েতনাম, লাওস ও কাম্বােডিয়ার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের যুদ্ধবিরােধী মিছিলের রেশ এখনও মিলিয়ে যায়নি। মাত্র কয়েকদিন আগে তনুণ জঙ্গী ছাত্রদের যুদ্ধবিরােধী মিছিলকে প্রতিহত করতে গিয়ে মার্কিন পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়েছে, গ্রেপ্তার করেছে প্রায় সাত হাজার বিক্ষোভকারীকে। সুতরাং মার্কিন জনগণের যুদ্ধবিরােধী মনােভাবের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন সরকার খােলাখুলি পাকিস্তান সরকারের পৈশাচিক আক্রমণের সমর্থনে এগিয়ে এলেন না। একদিকে ভাব দেখানাে হলাে। পাকিস্তানের সংকটের সমাধানে মার্কিন সরকার যথাসাধ্য সাহায্য করবে। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রকে পুরােপুরি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দওয়া হলাে যাতে তারা দেউলিয়া হয়ে না যায়। পাকিস্তানের বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবার জন্য পুরাে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিল ব্রিটিশ ও মার্কিন সরকার উভয়ই।
রাজধানীর রাজনৈতিক মহলের কাছে খবর আছে, ওয়ার্ড ব্যাঙ্কের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান পিটার কারগিল সম্প্রতি যখন ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন পাক শাসকচক্রের সঙ্গে আলােচনার জন্য, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কারগিলকে স্পষ্টই বলেছিলেন যদি ওয়ার্লড ব্যাঙ্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য না দেয় পাক সরকার জুলাই মাসে সরকারি কর্মচারীদের মাইনে দিতে পারবে না। জুন মাসে ব্যাঙ্কের ধার শােধ দেওয়া শুরু হবার কথা। ইয়াহিয়া স্পষ্টই বলেছেন এখন দরকার আরও অধিক সাহায্য—ঋণ শােধ দেবার কোন প্রশ্ন ওঠে না।
পিটার কারগিল ওয়াশিংটনে ফিরে গেছেন। এবং ইতিমধ্যেই খবর এসেছে মার্কিনদের পাকিস্তানের সঙ্কটের মীমাংসার উপর জোর দেবার সব খবর নেহাতই লােকদেখানাে—কোন শর্ত ছাড়াই বিশ্বব্যাঙ্ক পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য দেবে এবং জুন মাসে ওয়ার্লড ব্যাঙ্ক ও ইনটারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের এক প্রতিনিধিদল পাক সরকারের সঙ্গে আলােচনার জন্য ইসলামাবাদ আসবেন।
অর্থাৎ এক কথায় মার্কিন করকার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন সরকারি ভাবে সাহায্যের যে ব্যাখ্যাই দেওয়া হােক না কেন। বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের গত দু-মাস পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের ব্যয় হয়েছে কম করে ১২০ কোটি টাকা। বাঙলাদেশের বাজার পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতিদের কাছে এখন বন্ধ। বিদেশে পাট রপ্তানি করবার মতও পরিস্থিতি নেই। পিপলস পার্টির নেতা শ্রী ভুট্টোরই নিজের কথায় পূর্ব-বঙ্গকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে ছ-মাস চলাও অসম্ভব। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া চক্রের নিজ ক্ষমতার জোরে আরও এক মাস যুদ্ধ চালানােও পাকিস্তানের অর্থনীতির দিক থেকে বিপজ্জনক হবে।
এই পরিস্থিতিতে মার্কিন সাহায্যের এই আশ্বাস পাকিস্তান শাসকচক্রকে মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে আক্রমণকে আরও সংহত করতেই সাহায্য করবে। বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা ধরে নিতে পারেন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সরকারি কোন সাহায্য পাবার আশা আর তাদের নেই। বেসরকারি বা সরকারি সূত্রে শরণার্থীদের জন্য কিছু সাহায্য আসতে পারে মাত্র।
রাজধানীর ওয়াকিবহাল মহলের কাছে যে খবর এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, বাঙলাদেশে তথাকথিত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রস্তাবে মার্কিনরা সায় দিয়েছে। এই স্বাভাবিক অবস্থার প্রথম ধাপ হবে আওয়ামী লীগের যে কয়জন জাতীয় পরিষদের সদস্য আটক আছেন তাদের ছলেবলে কৌশলে পাক শাসকচক্রের সঙ্গে মীমাংসায় আসতে বাধ্য করা এবং তারপর তাদের দিয়েই অস্থায়ী মন্ত্রিসভা গঠনের প্রচেষ্টা চালানাে। আরাে কয়েক ডিভিশন পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য বাঙলাদেশে এনে তারপর সামরিক আইন প্রত্যাহারের ঘােষণা করা ।
ইসলামাবাদ সরকার যে কিছু কুইসলিং পাবেনই এমন ভরসা তাদের নেই। তবু সাহায্য পাবার তাগিদে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বিশেষ দূত মুজফফর আমেদ মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে বলেছেন তাঁদের ধারণা প্রায় ২০০ আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের সদস্যকে তারা তাদের সঙ্গে পাবেন এবং নভেম্বরের মধ্যেই বাঙলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা তারা ফিরিয়ে আনতে পারবেন। নিকসন নাকি বলেছেন, রাজনৈতিক মীমাংসা যদি সম্ভব হয় তবে যুক্তরাষ্ট খুশি হবে এবং সাহায্যের ব্যাপারে কোন আপত্তি থাকবে না। ইয়াহিয়ার এই দূত নাকি আরও বলেছেন যুক্তরাষ্ট্র এই বিপদের মুহূর্তে যদি পাক সরকারকে সাহায্য না দেয় তবে তাদের পিকিং সরকারের কাছে যেতে হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই তার ফল যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সুখকর হবে না। সুতরাং চীনকে ঠেকাবার স্বার্থেও যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পাকিস্তান সরকারকে সর্বপ্রকার সাহায্য দেওয়া। ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দপ্তর ও প্রতিরক্ষা বিভাগের এক প্রভাবশালী অংশেরও অভিমত পাক সরকারকে যথাসাধ্য সাহায্য দেওয়া উচিত যাতে চীন এই সুযােগে সাহায্য দিয়ে পাক সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার না করতে পারে।
* * * আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকার যখন বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিকৃত চেহারা জোরের সঙ্গে উপস্থাপিত করছে অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার যে আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তর ততােধিক দ্রুততার সঙ্গে পাক প্রচারের জবাব দিতে পারেনি।
রাজধানীর দায়িত্বশীল রাজণৈতিক মহল যথেষ্ট ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে, ২৫ মার্চের পর প্রথম পনেরাে দিন পাকিস্তানি প্রচারকে নস্যাৎ করতে পারেনি। একমাত্র যখন দলে দলে আশ্রয়প্রার্থী ভারতীয় সীমানায় প্রবেশ করতে শুরু করল, আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের টনক নড়ল এবং গত একমাসে মােটামুটিভাবে বাঙলাদেশ সরকার এবং ভারত সরকারের বক্তব্য বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের জ্ঞাত করানাে হলাে।
এখন পর্যন্ত যা খবর তাতে পশ্চিম এশিয়ার কোন দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। পররাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারি শ্রীটি এন কাউল সম্প্রতি ইরান গিয়েছিলেন ভারত সরকারের বক্তব্য জানাবার জন্য। খুব সফল হয়েছেন বলে মনে হয় না। ইরান ইয়াহিয়া সরকারকে পুরােপুরি মদত দিচ্ছে এবং আরাে দেবে বলেই মনে হচ্ছে।
আগামী কয়েক সপ্তাহে পররাষ্ট্র দপ্তরকে আবার পুরাে পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখতে হবে। বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রেক্ষাপট, বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভারতীয় বক্তব্য আবার নতুন করে পৌছে দিতে হবে প্রতিটি রাষ্ট্রনায়কের কাছে। বিশেষ করে আফ্রিকা এবং এশিয়ার দেশগুলােতে পাকিস্তানের মিথ্যা অপপ্রচারের স্বরূপ তুলে ধরতে না পারলে কূটনৈতিক দিক থেকে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করা যাবে না ।

সূত্র: সপ্তাহ, ৪ জুন ১৯৭১