You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামঃ যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালীদের অবদান | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৫ মার্চ ১৯৮৩
আবদুর রহমান খান /শাহীন সুলতানা

নিউইয়র্কে তখন গভীর রাত। ঢাকায় পরবর্তী রাত আসতে তখনো কয়েক ঘন্টা বাকী। নিউইয়র্কের একজন বাঙ্গালী কূটনীতিকের বাড়িতে তিনজন মহিলা কাঁচি আর সুই সুতো নিয়ে ব্যস্ত। তীব্র উত্তেজনা আর অজানা আশংকায় ডক্টর রোকেয়া আলমগীরের হাতের কাঁচিটা একটু কেপে উঠলো। মিসেস মাহমুদ আলী এবং মিসেস পুষ্প বসর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো বার দুই। মুহূর্ত বিরতি।
তারপর একটা প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে চাঁদ-তারা মার্কা পাকিস্তানী পতাকাটি কেটে ফেলা হলো। সাদা অংশগুলো ছুড়ে ফেলে সবুজের মাঝে বসিয়ে দেয়া হলো একটি টকটকে লাল সূর্য। তার উপর সোনালী রংয়ের বাংলাদেশের মানচিত্র। জন্ম নিলো একটি নতুন পতাকা।
১৯৭১ এর ৬ মার্চ। পরদিন ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেবেন। নিউইয়র্কের বাঙ্গালীদের মধ্যে এরকম একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল যে ঐদিনই স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হবে। আর স্বাধীনতার সেই কাক্ষিত সকালকে নতুন পতাকা দিয়ে বরণ করার প্রস্তুতি চলছে। নিউইয়র্কের পাকিস্তান কনস্যুলেটের ভাইস কনসাল এ এইচ মাহমুদ আলীর বাসভবনে।
পূর্ব প্রস্তুতি
ঘটনার শুরু আরো আগে। পূর্ব বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তান নাম দিয়ে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ২৪ বছরের শোষণের বিরদ্ধে বাংগালীদের প্রতিবাদ ধীরে ধীরে প্রতিরোধে রূপ নিচ্ছিল। সংগ্রাম ধুমায়িত হচ্ছিল ক্রমশ।
৫২র ভাষা আন্দোলন। ৬২র ছাত্র আন্দোলন। ৬৬তে ছয় দফার আন্দোলন। ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান। এশিয়ার লৌহ মানব বলে কথিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন। ইয়াহিয়ার সামরিক আইন। ১৯৭০ এ সাধারণ নির্বাচন।
পৃথিবীর অপরপিঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাঙালীদের মনে শেষের এসব ঘটনা স্বভাবতঃই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যেমন বিশ্বের সকল বাঙ্গালীর মনেই তা করেছিল।
১৯৭০-এর নভেম্বরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কয়েকটি জেলায়। এক প্রলয়ংকরী দুর্যোগ ঘটে। ঘূর্ণিঝড় আর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের শিকার হয়ে কয়েক লক্ষ লোক প্রাণ হারায়। হাজার হাজার ও মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। খাদ্য আর পানীয় জলের তীব্র সংকট ও চলছে। জীবিত মানুষের সামনে মহামারীর আতংক।
এই দুর্যোগের ঘটনাকে পাকিস্তানী সামরিক সরকার তেমন কোনো আমলই দিলোনা। বিদেশী পত্র-পত্রিকা আর সংবাদ মাধ্যম সমূহ এ ঘটনার সচিত্র বিবরণ বহিঃবিশ্বে প্রচার করে এবং এতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
৭০ এর এই মহাঘুর্ণি ঝড় এবং পাকিস্তান সরকারের নিস্ক্রিয়তা নিউইয়র্ক প্রবাসী বাঙ্গালীদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এরই পরিণতিতে প্রবাসী বাঙালীদের সংগঠন ‘পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকা’ র নাম বদলে নতুন নাম দেয়া হয় ইস্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকা। এরা নিউইয়র্ক ও অন্যান্য শহরে বিভিন্ন প্রােগ্রাম করে আমেরিকাবাসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং অর্থ কাপড়-চোপড় ওষধপত্র সংগ্রহ করে রেডক্রসের মাধ্যমে দূর্গত মানষের জন্য দেশে সাহায্য পাঠায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখন হাজারেরও বেশী বাঙ্গালী থাকতেন, যাদের ছ’সাতশ বাস করতেন নিউইয়র্কে। এদের মধ্যে বাগালী কূটনীতিক ও তাদের পরিবারবর্গ ছাড়াও ছিলেন চাকুরিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী ও অধ্যয়নরত ছাত্র। নিউইয়র্কের প্রায় সব বাঙ্গালীই ইস্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। লীগ তখনো কোনোরকম রাজনীতিতে জড়িত ছিল না। এদের কাজ ছিল মূলতঃ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা এবং এভাবে প্রবাসীদের মধ্যে একটা যোগাযোগ ও সম্প্রীতি বজায় রাখা।
কাজী সামসুদ্দিন নামের একজন বাঙ্গালী ভদ্রলোক ছিলেন লীগ অব আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। ম্যানহাটানের ওয়েস্ট সাইডে ‘বিট অব বেঙ্গল’ নামে তাঁর রেস্তোঁরায় লীগের বেশীরভাগ সভা অনুষ্ঠিত হতো। ৭০ এর নবেম্বরের পর লীগ ঘন ঘন মিটিং-এ মিলিত হতে থাকে।
ইতোমধ্যে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়েছে। সামরিক সরকার নানা ষড়যন্ত্র করছে। পার্লামেন্ট অধিবেশন বসা নিয়ে টালবাহানা চলছে। ঢাকায় শুরু হয়ে গেছে অসহযোগ আন্দোলন। দেশের এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রবাসী বাঙ্গালীরাও নিউইয়র্কে পাকিস্তান মিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
এর মাঝে এসে পড়ে ২১ শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারী নিউইয়র্কবাসী বাঙ্গালীদের কাছে বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে আসে।
এ, এইচ, মাহমুদ আলী তখন নিউইয়র্কে পাকিস্তানী কনস্যুলেটের ভাইস কনসাল। তাঁরই বিশেষ উদ্যোগ লীগের ২১ শে ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠানটি কনস্যুলেটের মিলনায়তনে করার ব্যবস্থা হয়। নিউইয়র্কের পাকিস্তানী কনস্যুলেট এবং জাতিসংঘ মিশন একই বাড়ীতে ছিল। ম্যাডিসন এবং ফিফথ এ্যাভেন্যুর মাঝামাঝি ৬৫ নম্বর রোডে অবস্থিত এ বাড়িতে একটা সুন্দর ও বড় মিলনায়তন ছিল। এটি সরকারী অনুষ্ঠান ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানীদের ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের জন্যেও ব্যবহার করা হোতো।
প্রায় একমাস আগে থেকে চেষ্টা করেও এ মিলনায়তনে ২১ শের অনুষ্ঠাত করা গেল না। পাকিস্তানী মিশনের প্রধান আগাশাহী এতে তীব্র বাধা দেন। অগত্যা কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল এম, এল, আই চৌধুরীর বাসভবনে অনুষ্ঠানটির ব্যবস্থা করা হয়।
যদিও এটা ছিল একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তবুও তৎকালীন পরিস্থিতিতে এর ভেতর দিয়ে একটা সম্পষ্ট রাজনৈতিক ধারা ফুটে উঠেছিল।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানটি দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হয়। হাতে লেখা স্ক্রিপ্ট থেকে ধারা বিবরণী এবং তার মাঝে আবৃত্তি আর সংঙ্গীতের এক চমৎকার আবেগময় পরিবেশনা। শুধু ভাষার বন্দনা নয়, সেদিনের অনুষ্ঠানে ভাষার সাথে স্বাধিকার আর স্বাধীনতার সম্পর্ক মিলিয়ে এক স্পষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য সেদিন তুলে ধরা হয়েছিল। এম, এন, আই চৌধুরী, খন্দকার আলমগীর সহ আরো দু একজন সেদিনের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। খন্দকার আলমগীর ৫২ র ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি এখনো নিউইয়কে ডাক্তারী করছেন। সেদিনের ২১শের অনুষ্ঠানে ২/৩শ বাঙালী এমন একটা মানসিক প্রেরণা লাভ করেছিল যা পরবর্তীতে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় করেছিল।
২৭ ফেব্রুয়ারী। লীগের ভেতরকার অধিকতর সচেতন বাঙালীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। তারা লীগের ভেতরে সক্রিয়ভাবে কাজ করার জন্য একটি কেন্দ্রের জন্ম দেয়।
পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী যে সব অন্যায় অত্যাচার চালাচ্ছে তার সঠিক চিত্র তুলে ধরে বাঙালীদের পক্ষে জনমত সংগঠিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানে পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এগিয়ে চলছে—এ বক্তব্য নিয়ে সাইক্লো করা স্মারকলিপি জাতিসংঘের সকল বিদেশী মিশনে পৌছানো হতে থাকে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন মিশনের দায়িত্ব নিয়ে মার্চের প্রথম সপ্তাহে প্রায় সবগুলো মিশনে এ স্মারকলিপি পৌছে দেন। এভাবে বিদেশী সরকার সমূহের নিকট পাকিস্তানী নির্যাতন ও বর্বরতার চিত্র তুলে ধরা হয় এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করার কাজ এগিয়ে চলে।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের জাতিসংঘ মিশন ও কনস্যুলেট অফিসের সামনে প্রবাসী বাঙালীরা এক বিক্ষোভের আয়োজন করেন। বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে নির্বিচারে গুলির প্রতিবাদে এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও অবিলম্বে পালামেন্ট অধিবেশনের দাবি জানিয়ে সেদিনের বিক্ষোভকারীরা প্ল্যাকার্ড বহন করেন। নিউইয়র্ক পুলিশ সেদিন আশপাশের রাস্তা বন্ধ করে বাঙালীদের ইংরেজী লেখা প্ল্যাকার্ডের দাবি পড়ছিল।
সাতই মার্চ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ মানুষের সমুদ্র। পূর্ববঙ্গ তখন তীব্র উত্তেজনা। মিছিল আর মিছিলে উত্তোলিত বাহু গগনবিদারী শ্লোগানে ফেটে পড়ছে। শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ অসংখ্য লাউড স্পীকারে ধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে।
নিউইয়র্কে তখনো দিন। রাত আসতে আরো ১১ ঘন্টা দেরী। আর এই সময়ের ব্যবধানে শেখ মুজিবের টেপ করা ভাষণ ঐদিনই পৌছে গেছে নিউইয়র্কে। ওয়াপদার একজন, ইঞ্জিনিয়ার এদিন সন্ধ্যায় বিমান পথে নিউইয়র্ক বয়ে নিয়ে যান এই গুরুত্বপূর্ণ টেপটি। কে, এই ভদ্রলোক, কে তাকে টেপটি দিয়েছে বা কেনই বা তিনি তা বয়ে এনেছেন তা অজ্ঞাতই থেকে গেছে আজ পর্যন্ত।
কে আনলেন, কেন আনলেন—এসব অনুসন্ধানের চেয়ে তখন জরুরী হলো এর কথাগুলো শোনা আর তা প্রচার করা। হাতের কাছে যাদের পাওয়া গেলে তাদের নিয়ে খন্দকার আলমগীরের বাসায় শোনা হলো এই রেকর্ড কৃত ভাষণটি। কিছুক্ষণ পরে এটি চলে এলো এ, এইচ, মাহমুদ আলীর বাসায়।
খন্দকার আলমগীর, ডক্টর ইউনুস, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র মাহবুব হোসেন চাকরিজীবী ফারকুল ইসলাম এবং আরো কয়েকজন মিলে টেপটি বাজিয়ে শোনেন। জাক্তিসংঘে চাকরিরত একজন ভারতীয় সাংবাদিক ডঃ ব্যানার্জীও এখানে তখন উপস্থিত ছিলেন।
উপস্থিত সবাই খুব মনোযোগ সহকারে শেখ মুজিবের এই ঐতিহাসিক ভাষণটি বার বার বাজিয়ে শুনলেন। রেসকোর্সে সেদিনকার জনতার শ্লোগানও তারা টেপে শুনতে পান। ‘পাঞ্জাবীদের খতম করো বাংলাদেশ স্বাধীন করো স্বাধীন করো’ এসব শ্লোগান নিউইয়র্কে বসেই তারা পরিষ্কার শুনতে পারছিলেন। তারা খুব মনোযোগ দিয়েও ৬ দফা, ১১ দফার কোনো শ্লোগান আর শুনতে পাননি। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা তারা নিউইয়র্কে বসেই পরিষ্কার টের পাচ্ছিলেন। শেখ মুজিবের ভাষণটি কপি করে অন্যান্য বাঙালীদের কাছে পৌছনো হলো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তখন এমন অনেকে ছিলেন যারা বাংলাদেশের এ সময়কার আন্দোলনকে ভারতের উস্কানী বলে ব্যাখ্যা করেছেন এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে যেমন মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন তেমনি বামপন্থী রাজনীতির সমর্থকরাও ছিলেন। যাই হোক ঘটনাবলী তখন দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে।
জনমত আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে নিউইয়র্কের কনসাল অফিস দখল করা ও আটকে রাখার কর্মসূচী গৃহীত হয়। ছাত্র ও যুব-কর্মীদের একটা সাহসী দল সেদিন কনসাল অফিসে ঢুকে পড়ে এবং তা সারারাত আটকে রাখে। কারো কারো পকেটে সেদিন ছিল মোহাম্মদ আলী আর জো ফ্লেজিয়ারের মুষ্টিযুদ্ধের দামী টিকেট। ওরা কনসাল অফিসের ভেতরে বসে টিভিতে সেদিন মোহাম্মদ আলীর পরাজয় দেখছিলেন। নিউইয়র্ক পুলিশ এটাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে কোনো রকম নাক গলায়নি।
২৫শে মার্চ এবং পরের দিনগুলো
২৫শে মার্চ। পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো। ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস পুলিশ লাইন, ইপিআর ক্যাম্প, কমলাপুর স্টেশন, রাস্তার ফুটপাথ সর্বত্রই রক্তের স্রোত বইলো।
ট্যাঙ্ক; কামান; মেশিনগান সজ্জিত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তার অঘোষিত যুদ্ধ চাপিয়ে দিলো সাতকোটি নিরস্ত্র বাঙালীর উপর। প্রাণ দিলো অসংখ্য মানুষ। লুণ্ঠিত হলো মা-বোনের ইজ্জত। পুড়িয়ে ছারখার করা হলো বাস্তুভিটা । চমকে উঠলো বিশ্ববিবেক। থমকে দাঁড়ালো শান্তির শ্বেত কপোত।
এবার সশস্ত্র প্রতিরোধের পালা। প্রতিরোধ গড়ে উঠলো শহরে গ্রামে সর্বত্র। প্রতিরোধ গড়ে উঠলো দেশের বাইরে বিদেশেও। ঢাকা তখন সারা বিশ্বের সংবাদ শিরোনাম।
নিউইয়র্কের লীগ অব আমেরিকার কর্মীরা জাতিসংঘের বিদেশী মিশনে আবার যোগাযোগ করতে শুরু করেন। এর আগে সে সব মিশন বাঙ্গালীদের তেমন পাত্তা দেয়নি তারাই এবার সমবেদনা প্রকাশ করলো। কিন্তু কেউই প্রকাশ্যে কোনো ভূমিকা রাখতে রাজী হলো না। আলজেরিয়া আর কিউবার মতো দেশও সেদিন পরমার্শ দিল—আমরা তোমাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। পাকিস্তানী সরকার, তোমাদের ওপর যা করছে আমরা তার বিরোধিতা করি। কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে তোমাদের লড়াই নিজেদেরই করতে হবে।
নিজেদের লড়াই ওরা নিজেরাই শুরু করলো।
৭ই মার্চের পর থেকে বিক্ষোভ মিছিলের যে কর্মসূচী চলছিল ২৫ শের ঘটনার পর তা আরো ব্যাপক রুপ লাভ করে।
পঁচিশে মার্চের পর বাংলাদেশে শুরু হয় প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রাম। পুলিশ, ইপিআর আর সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক বাঙ্গালীরা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নামে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়।
পঁচিশে মার্চের পর নিউইয়র্কের পাকিস্তান কনস্যুলেট ভবনে ইস্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকার বেশ কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহীর আপত্তি এবং বিরোধিতার মুখেও সেখানে সভা অনুষ্ঠান সম্ভব হয়েছিল কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল এম এন আই চৌধুরী এবং ভাইস কনসাল এ এইচ মাহমুদ আলীর জন্যে।
কনস্যুলেট ভবনে লীগের বেশ কয়েকটি সভা হয়। এর মধ্যে স্বাধিকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রবাসী বাঙ্গালীদের বৃহত্তম সমাবেশটি হয়েছিল এপ্রিল মাসে। আগা শাহী কোনমতেই কনস্যুলেট ভবনে সভা করার অনুমতি দেবেন না। সভায় কোন গোলযোগ বা সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হবে না— এম এন আই চৌধুরী এবং এ এইচ মাহমুদ আলী এই মর্মে দায়িত্ব নেয়ার পর আগা শাহী সভা অনুষ্ঠানের অনুমতি দেন। এর পাশাপাশি ছিল নিউইয়র্ক প্রবাসী বাঙ্গালীদের চাপও।
আগা শাহী কখনো নিজেই উপস্থিত থেকে কনস্যুলেট ভবনে অনুষ্ঠিত এসব সভার পুরো খোঁজ-খবর রাখতেন এবং ওয়াশিংটনে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগা হিলালীকে (যিনি তার সহোদরও) এ সম্পর্কে অবহিত করতেন।
এসব সভায় গৃহীত প্রস্তাবসমূহ স্থানীয় সংবাদপত্র এবং মুজিব নগরে জানানো হতো।
কোলকাতার পাকিস্তানী হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার এম হোসেন আলী তখন ভেতরে ভেতরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করছেন। নিউইয়র্ক থেকে মার্চের শেষ সপ্তাহে একটি বার্তা আসে কোলকাতায়। এ বর্তার জবাবে এম হোসেন আলী এবং আনোয়ারুল করিম চৌধুরী নিউইয়র্কে একটি টেলিগ্রাম পাঠান। মার্চের ২৮ বা ২৯ তারিখে এ টেলিগ্রাম নিউইয়র্কে বাঙ্গালীদের কাছে পৌছায়। শেখ মুজিবর রহমানের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত এই টেলিগ্রামটি পেয়ে নিউইয়র্কের বাঙ্গালীরা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। টেলিগ্রামটি প্রচুর সংখ্যায় কপি করে বাঙ্গালীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এবং এর কপি বিভিন্ন দূতাবাসে পৌছানো হয়।
বাঙ্গালীদের মধ্যে তখনো অনেকে ইতস্ততঃ করছিলেন। অনেকের মধ্যে ভারত ও হিন্দুদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা ছিল।
২৭ মার্চের পর লীগের এক সাধারণ সভা ডাকা হয়। এখানে সিদ্ধান্ত হয় যে কোলকাতার মাধ্যমে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। নিউইয়র্কের ঘটনাবলী দেশে জানানো এবং পরবর্তী করণীয় ঠিক করার জন্য এ যোগাযোগ জরুরী হয়ে পড়ে। মাহবুব হোসেন এবং ফারুকুল ইসলামকে প্রতিনিধি করে কোলকতা পাঠাবার ব্যবস্থা হয়।
প্রবাসীদের লীগ অব আমেরিকার সেই সভায় কানাডায় প্রবাসী বাঙ্গালীদের কিছু লোকও উপস্থিত ছিলেন। তারা কানাডীয় গ্রুপের পক্ষ থেকেও মাহবুব ও ফারুককে প্রতিনিধিত্ব করার অনুরোধ করেন।
এ দুজনকে নিউইয়র্ক ত্যাগের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে দেন পাকিস্তান কনস্যুলেটের বাঙ্গালী অফিসাররা অন্যদিকে ভারতে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহের ব্যাপারে সাহায্য করেন নিউইয়র্কে নিযুক্ত ভারতীয় কূটনীতিক সমর সেন। ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী সমর সেনের সঙ্গে প্রবাসী বাঙ্গালীদের অনেকের ভালো জানাশোনা ছিল। সমর সেন পরবর্তীতে বাংলাদেশে প্রথম ভারতীয় হাইকমিশনার হন।
নিউইয়র্ক ও কানাডার বাঙ্গালীদের পক্ষ থেকে পাঠানো দুজন প্রতিনিধি কোলকাতার পথে রওয়ানা হয়ে ৩০ মার্চ এসে পৌছান লন্ডনে। লন্ডনে একদিন অবস্থানকালে বাঙ্গালী ছাত্রদের অনুরোধে তাদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। ছাত্রলীগের লন্ডন শাখা ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওরা কথা বলেন। লন্ডনের ব্যাঙ্গালী ছাত্ররা ওদের দুজনকে তাদের খবরা-খবরও বাংলাদেশে পৌছানোর অনুরোধ করেন। সময়াভাবে কোনো স্মারকপত্র ওরা দিতে পারেননি।
এপ্রিলের তিন তারিখে ওরা দুজন এসে পৌছন কোলকাতায়। তিন দিনের মধ্যে ওরা আওয়ামী লীগের গুরত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে মিলিত হন। লর্ড সিনহা রোডে অবস্থিত বিএসএফ-এর দফতরে তখন আওয়ামী লীগের গুরত্বপূর্ণ নেতারা আশ্রয় নিয়েছেন। মাহবুব এবং ফারুক এখানে যেসব নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন তারা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজুদ্দীন আহমেদ, খন্দকার মোশতাক, মিজানুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী প্রমুখ। নেতাদের কাছে নিউইয়র্কের বাঙ্গালীদের আন্দোলনের খবরাখবর ব্যক্ত করা হয়। নেতারা এতে যথেষ্ট উৎসাহ প্রকাশ করেন।
ওরা দুজন কোলকাতায় আশ্রয় গ্রহণকারী ছাত্রনেতাদের সাথেও কথা বলেন। ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ, স, স আবদুর রব সিরাজুল আলম খান, এবং মেনন গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নের আতিকুর রহমান সালু এদের সাথে সাক্ষাত দেন।
কোলকাতায় আশ্রয় গ্রহণকারী নেতাদের সাথে এদের যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশী বিতর্ক হয় তা হচ্ছে জাতীয় সরকার প্রসঙ্গ। ওরা দু জন নিউইয়র্ক এবং লণ্ডন থেকে এরকম একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন যে, বাংলাদেশের নতুন সরকারে স্বাধীনতার সমর্থক সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং এতে সেনাবাহিনীরও প্রতিনিধিত্ব থাকবে। মওলানা ভাসানী ও জেনারেল ওসমানীকেও এতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব ছিল।
কিন্তু ভারতে আশ্রিত আওয়ামী লীগের নেত্রবৃন্দ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তারা নিজেদেরকেই এককভাবে জাতীয় সরকার বলে দাবী করেন। ৬ দফার ভিত্তিতে এবং পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে তারা কি করে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার হতে পারেন সে প্রশ্নে যথেষ্ট উত্তপ্ত বিতর্কও হয়।
ছাত্রলীগ নেতাদের দু একজন জাতীয় সরকার প্রশ্নে নমনীয় মনোভাব দেখালেও আওয়ামী লীগ এতে কোন সমর্থন দেয়নি।
মাহবুব হোসেন প্রায় তিন সপ্তাহ এবং ফারুকুল ইসলাম প্রায় ৬ সপতাহ কোলকাতায় অবস্থান করেন। এসময়ে তারা শরনার্থী শিবিরে গিয়ে খবরাখবর নেন। মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং এদের অস্ত্র, রসদ এসব বিষয়ে খবর নেন। এসময়ে তারা চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে মুজিব নগরের আশে পাশে ঘুরে আসেন। কুষ্টিয়ার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ডাক্তার আসহাবুল হকের সাথেও এরা দেখা করেন। আসহাবুল হক তখন ও এলাকার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
মাহবুব এবং ফারুক ভারতীয় সাংবাদিক এবং কোলকাতার রাজনীতিকদের সাথেও দেখা করেন। এরা ভারতে অবস্থানকালে নিয়মিত চিঠিপত্র দিয়ে নিউইয়র্কে সাংকেতিক বার্তা পাঠাতেন। এভাবে নিউইয়র্ক প্রবাসীরা বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখেন।
৬ই এপ্রিল। বাংলাদেশের কূটনৈতিক ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। এই দিন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি প্রথম কূটনৈতিক আনুগত্য ঘোষিত হয়। দিল্লীর পাকিস্তান হাই কমিশনের বাঙ্গালী অফিসার কে, এস, শেহাবান্দিন এবং প্রেস এ্যটাশে আমজাদুল হক বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করেন ৬ই এপ্রিল, ১৯৭১ সাল।
১৮ই এপ্রিল এম, হোসেন আলীর নেতৃত্বে কোলকাতার পাকিস্তান মিশনের সবাই একযোগে বাংলাদেশের পক্ষে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন।
এসব খবর নিউইয়র্কে আরো উৎসাহের সৃষ্টি করে। ইতোমধ্যে নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে কোলকাতা থেকে খবর পাঠানো হয়, আপনারাও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণা করুন।
মাহবুব হোসেন এবং ফারুক নিউইয়র্ক ফেরার পূর্বেই নিউইয়র্কে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। ২৬শে নিউইয়র্কের পাকিস্তান এপ্রিল কনস্যুলেটের ভাইস কনসাল এ, এইচ, মাহমুদ আলী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণা করেন। ভারতের বাইরে এবং পশ্চিমী দুনিয়ায় এই প্রথম কূটনৈতিক আনুগত্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আরো একধাপ এগিয়ে নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপরাপর বাঙ্গালী কূটনীতিকগণ তখনও ইতস্তত করছিলেন। কেউ কেউ নিজেদের চাকুরী হারানো এবং পরবর্তী অনিশ্চয়তার কথা ভেবে শংকিত ছিলেন। এরকম অবস্থায় মার্কিন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয় এ, এইচ মাহমুদ আলীর বক্তব্য ।
“আজ আমি নিঃশর্তভাবে স্বার্বভৌম বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের সরকারের প্রতি আমার আনুগত্য ঘোষণা করছি। আমি সেই সরকারের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করছি যে এই মূহুর্তে বিদেশী হানাদারদের রক্ত থাবা থেকে মাতৃভূমি মুক্ত করার জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত।…………কোলকাতায় তাদের দায়িত্ব শেষ করে মাহবুব এবং ফারুক নিউইয়র্কে ফিয়ে আসেন। মাহবুব ফিরে আসেন এপ্রিলের শেষ নাগাদ। লীগের সাধারন সভা ডাকা হয় এবং সেখানে বাংলাদেশের বিস্তারিত খবর এবং সফর অভিজ্ঞতা বর্ণণা করেন মাহবুব হোসেন। মাহবুবকে ফিরে পেয়ে বাঙ্গালীরা ধারুণ খুশী। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে খুটিয়ে খুটিয়ে সব খবর শুনছিলেন তারা। এদিকে ওয়াশিংটন থেকে ও ডাক পড়লো মাহবুবের। ওখানেও বাঙ্গালীরা একইভাবে বিস্তারিত বিবরণ শুনলেন।
প্রবাসী বাঙ্গালীরা আমেরিকার বিভিন্ন শহরে তাদের সংগঠন গড়ে তুলতে থাকেন। এভাবে আমেরিকা ও কানাডার বিভিন্ন শহর বন্টন লসএঞ্জেলেস, সানফ্রানসিসকো, পিটবসবার্গ ডেটন সংম অটোয়া টরেন্টো মন্ট্রিয়ল প্রভৃতি স্থানে বাঙ্গালীদের সংগঠন গড়ে ওঠে।
শিকাগোতে তখন থাকতেন প্রখ্যাত স্থপতি ডঃ এফ, আর, খান। তাঁর নেতৃত্বে ওখানকার বাঙ্গালীরা সংগঠিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ’। নিউইয়র্কস্হ লীগ অব আমেরিকার সাথে মধ্যপন্থী ও উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা কাজ করতে পারছিলেন না বলে এই সংগঠনটি গড়ে ওঠে। সামসুল বারী এবং অধ্যাপক জিল্লুর রহমান তখন ওখানে ছিলেন।
প্রবাসী সকল বাঙ্গালীকে স্বাধীনতার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনমতকে প্রভাবিত করার কাজে আমেরিকার বাঙ্গালীরা এভাবে এগিয়ে আসেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দালনে মার্কিন জনগণের ভূমিকা সম্পর্কে সবাই অবগত। মার্কিন সরকারের ভিয়েতনামের যুদ্ধনীতি জনগণের চাপের কাছে হার মেনেছিল। এ অভিজ্ঞতার আলোকে প্রবাসী বাঙ্গালীরাও মার্কিন জনমতকে গুরুত্ব দিয়ে সংগঠিত করার উদ্যোগ দেয়।
বাংলাদেশের শহরে-গ্রামে যখন মুক্তিবাহিনী তৎপরতা চালাচ্ছিল তখন আমেরিকায় প্রবাসীরা বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে ব্যস্ত। নিউইয়র্কে প্রবাসী বাঙ্গালীদের এ আন্দোলনে যে সব বিদেশী এগিয়ে আসেন তাদের মধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা ডক্টর ইকবাল আহমদ ছিলেন। আরো ছিলেন পাকিস্তানী ছাত্রনেতা ফিরোজ আহমদ এবং ভারতীয় সাংবাদিক ডঃ জে কে ব্যানার্জী। প্রবাসীদের এ আন্দোলন ডঃ ব্যানার্জীর কাছে বিশেষভাবে ঋণী। ডঃ ব্যানার্জী ছিলেন কয়েকটি ভাষায় পারদর্শী। জাতিসংঘে কর্মরত একজন সাংবাদিক হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও রাজনীতিকদের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল। এই পন্ডিত ব্যক্তি নিজ দেশে একসময় সুভাষ বসুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। একজন বিজ্ঞ সাংবাদিক ডঃ ব্যানার্জীর লেখনী সেদিন মার্কিন প্রেস এবং বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে গুরত্বপর্ণ অবদান রাখে।
২৫ মার্চের পর থেকে নিউইয়র্কের লীগ মার্কিন সংবাদ সংস্থার কাছ থেকে প্রতিদিনের খবর সংগ্রহ করতে থাকে। মাহবুব হোসেনের প্রতিদিনের কাজের মধ্যে টেলিফোন করে এসব খবর সংগ্রহ করাও ছিল একটা দায়িত্ব। যেখানে যেসব খবর এবং কাগজ পত্র পাওয়া যেতো তা কপি করে সবাইকে পৌছানো হতো এবং এসব আবার নিজ নিজ এলাকার প্রশাসনের মাধ্যমে মার্কিন সরকারকে পাঠানো হতো। এভাবে একদিকে যেমন মার্কিন জনগণ তেমনি মার্কিন সরকারকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা চলতে থাকে ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসন ও তার সহযোগী হেনরী কিসিঞ্জার পুরোপুরি পাকিস্তানের পক্ষে। পাকিস্তান সরকারকে বন্ধু হিসেবে অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর এসব ব্যবহীত হচ্ছে বাঙ্গালী নিধনে। প্রবাসী বাঙ্গালীরা একথাগুলো বারবার এবং বিভিন্নভাবে মার্কিন জনণের সামনে তুলে ধরার ব্যবস্থা করেন। ওদিকে ঢাকা থেকে যেসব মার্কিন নাগরিক দেশে ফিরে গেছেন তারাও পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পাকিস্তানী গণহত্যার বিবরণ প্রচার করছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাঙ্গালীরা ওখানকার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভা সমাবেশ করে প্রচার তৎপরতা চালাতে থাকে।
ইতোমধ্যে বাঙ্গালী ছাত্রদের মার্কিন সহপাঠী এবং শিক্ষকদের অনেকে এ আন্দোলনে এগিয়ে আসেন। এভাবে এগিয়ে আসেন হ্যারী চ্যাপিন এবং জর্জ হ্যারিসনের মতো নামী গণসংগীত শিল্পীরা। এরা বিভিন্ন স্থানে গানের আসর করে বাংলাদেশে জন্য লক্ষ লক্ষ ডলার সংগ্রহ করতে থাকেন।
গণশিল্পী, ছাত্র শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং সধারণ মার্কিন নাগরিক যখন প্রবাসী বাঙ্গালীদের সঙ্গে রাস্তায় নামেন তখন অন্যদিকে এগিয়ে চলছে মার্কিন প্রেস এবং রাজনৈতিক নেতৃবর্গ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বামপন্থী কমিউনিস্ট ঘেষা রাজনৈতিক শক্তি যেমন এ আন্দোলনে এগিয়ে আসে তেমনি এগিয়ে আসেন সিনেটর কেনেডি, সিনেটর হ্যারিস, সিনেটর স্যাকসবী কংগ্রেসম্যান পিট মেকলসকী, থিওডর লরেন্স, পল ও ডোয়ার এইসব প্রভাবশালী মার্কিন নেতৃবর্গ।
৭১ এর ১ এপ্রিল। দুজন মার্কিন সিনেট সদস্য সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এবং সিনেটর হ্যারিস মার্কিন সিনেটে বাংলাদেশের উপর তাদের বিবৃতি পেশ করেন। তারা পাকিস্তান সরকারের গণহত্যার নিন্দা করে মার্কিন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারা এও তুলে ধরেন যে পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন সরকারের সাহায্য ও সমর্থন পূর্ব বাংলায় ধ্বংস ও নিধনযজ্ঞে লিপ্ত। তারা এর অবসান দাবী করেন সরকার ও দায়িত্বশীল নাগরিকদের প্রতি আবেদন রাখেন।
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি তার বিবৃতিতে বলেন যে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা বন্দুক, ট্যাঙ্ক আর বিমান পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ নাগরিকদের ধ্বংস করছে। এটা আমেরিকাবাসীদের জন্যে বিশেষভাবে মর্মান্তিক ব্যাপার।’
সিনেটর হ্যারিস উপস্থিত সিনেটরদের উদ্দেশে বলেন, যে মূহুর্তে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্বকারী গোটা সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে তখন আমরা চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারিনা। আসুন আমরা মার্কিন প্রশাসনকে বলি, যাতে তারা পাকিস্তানের ঘটনাবলী সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে।
ইতোমধ্যে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এসে পৌছেছেন নিউইয়র্কে। জেনেভায় এক সম্মেলনে যোগদানের জন্য বিচারপতি চৌধরী ২৫ মার্চের আগেই লন্ডন এসেছিলেন।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে থাকতেই ঢাকার খবরাখবর পান।
১লা মার্চ ইয়াহিয়ার পার্লামেন্ট অধিবেশন বাতিলের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেছে। মশাল মিছিল, বাঁশের লাঠির মিছিল, বিক্ষোভ ও আইন অমান্য আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছে। ছাত্র-শ্রমিক বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কৃষক ঢাকা রেডিও সবাই এ আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এ অবস্থায় ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গুলি চলে। হতাহতের সঠিক খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। শুরু হয়ে গেছে গণহত্যা। জ্বলছে গোটা পূর্ব বাংলা।
এরকম অবস্থায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লণ্ডনে বসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। লন্ডনে তিনি বাঙ্গালীদের সংগঠিত করবে কাজে জড়িয়ে পড়েন। অন্যদিকে তাঁর পরিচিত বৃটিশ রাজনীতিবিদ, পার্লামেন্ট সদস্য এবং সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে পূর্ব বাংলার ঘটনাবলী ব্যাখ্যা করেন।
ইতোমধ্যে ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার তার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শেষ করেছেন। লণ্ডনে ট্রাঙ্ককল করে বিচারপতি চৌধুরীকে অস্থায়ী সরকারের বিশেষ বিদেশ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করা হয়। তিনি দায়িত্ব নিলেন। বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধির দায়িত্ব নিয়ে বিচারপতি চৌধুরী নিউইয়র্কে আসেন ।
এ, এইচ, মাহমুদ আলী বিচারপতি চৌধুরীকে নিয়ে জাতিসংঘ মিশনের বিভিন্ন বৈদেশিক কূটনৈতিক ও মার্কিন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিয়মিত প্রােগ্রাম করেন। মিসেস মাহমুদ আলী বিভিন্ন দূতাবাসে টেলিফোন করে ওদের সঙ্গে আলাপআলোচনার প্রােগ্রাম ঠিক করে রাখেন। সারাদিন ঘুরে ঘুরে প্রােগ্রাম শেষ করে বিচারপতি চৌধুরীকে তাঁর রুমে পৌছে দিয়ে সবকিছু ভালোভাবে দেখে এ, এইচ মাহমুদ আলী বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে যেতেন। আবার পরদিন এভাবে কাজ শুরু হতো। নিউইয়র্কে সপ্তাহ খানেক এভাবে ব্যস্ততায় কাটিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ফিরে আসেন লন্ডনে।
ওদিকে মাহবুব হোসেন; ফারকুল ইসলাম, শহীদুল আলম ডঃ খন্দকার আলমগীর এর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রােগ্রাম করে চলেছেন। শহীদুল ইসলাম তখন ওখানে এম, বি, এ-র ছাত্র এবং একজন ভালো এ্যাথলেট হিসেবে পরিচিত। মাহবুব ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। ফারুক চাকুরীরত।
এদের সঙ্গে যেসব মার্কিন ছাত্র ও শিক্ষকরা অংশ নেন তাদের মধ্যে দু জন ছাত্র মার্শাল বেয়ার এবং এডওয়ার্ড সুইটের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মার্শাল বেয়ার পরে অক্সফামের চাকুরী নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন।
কয়েকজন মার্কিন শিক্ষারত্রীর অবদান ছিলো উল্লেখ করার মতো। এদের মধ্যে লুইস কাসলার, মারজী সিংগার, ইলেন রেজনিকের নাম উল্লেখযোগ্য। এরা সবাই ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষিকা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালীদের কর্মকাণ্ডের ফলে মার্কিন জনমত ধীরে ধীরে বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে আসতে শুরু করে। পাকিস্তানের বন্ধু মার্কিন সরকারের ওপর ক্রমশঃ চাপ বাড়তে থাকলো।
প্রবাসীদের এসব আন্দোলন সব সময়ই যে ভালোভাবে চলতে পেরেছে তা নয়। পাকিস্তানীদের সবরকম কূটনৈতিক তৎপরতা তো ছিলই তারপরও পাকিস্তানীরা দু একটি ঘটনায় বাঙালীদের ওপর হামলারও চেষ্টা করেছে।
একবার জাতিসংঘ অফিস এলাকায় এক বিক্ষোভ শেষে কয়েকজন বাঙালী নিকট কফি হাউজের দিকে যাচ্ছিলেন। ক’জন পাকিস্তানী ছাত্র তখন ওদের দিকে ইটপাটকেল ছোঁড়ে। ইতোমধ্যে অন্যান্য বাঙালীরা ছুটে আসে এবং পুলিশ হস্তক্ষেপ করে। এসব ঘটনায় পাকিস্তানীদের অসুবিধা ছিল এই যে, বাঙালীদের পক্ষে অনেক বেশি মার্কিন জনসমর্থন ছিল।
যাই হোক, প্রবাসীদের সংগ্রাম এগিয়ে চলছিল কূটনৈতিক ফ্রন্টে এবং অর্থ সংগ্রহের কাজে নিজেরা চাঁদা দিতে বাঙালীরা কোনো কোনো গৃহিণীকে সংসার চালানোর জন্য চাকুরী নিতেও হয়েছে। উদ্যোক্তাদের কয়েকজন চাকুরী নিতেও হয়েছে। উদ্যোক্তাদের কয়েকজন চাকুরী ছেড়ে কষ্টকর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। কারো পড়াশুনা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
এলো ৪ঠা আগস্ট। ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের ৮ জন বাঙ্গালী একযোগে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন আজকের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী জনাব এ, এম, এ, মুহিত ; এনায়েত করিম ; এস : এ; এম, এস, কিবরিয়া, মতিউদ্দিন; সাঈদ মুয়াজ্জেম আলী; এ ; আর চৌধুরী; শেখ রুস্তম আলী এবং এ; এম; এস ; আলম ।
একই দিনে নিউইয়কের মিশন থেকে এস, এ, করিম ও বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। ইতোমধ্যে ১ আগস্ট লন্ডন থেকে মহিউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছেন।
কূটনীতিক দুনিয়ায় এটা ছিল পাকিস্তান সরকারের এক বিরাট পরাজয়। এর পরের মাসগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিকগণ আনুগত্য ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকারকে ঘায়েল করে ফেলেন। প্রবাসী বাঙালীরা সভাসমাবেশ চালিয়ে যেতে থাকেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা, মার্কিন রেডিও, টিভি সংবাদ পত্রে সাক্ষাৎকার দেয়া চলতে থাকে, জাতিসংঘ এবং ওয়াশিংটনের বিদেশী মিশনগুলি বাঙালীদের প্রচারাভিমানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন শুরু হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদল এ অধিবেশনে যোগ দিতে আমেরিকা পৌছায়। এবারের প্রতিনিধি দলে ছিলেন একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি, আটজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য, দু জন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, দু জন ভাইস চ্যান্সেলর, একজন অর্থনীতিবিদ ও সিনিয়র কূটনীতিক। মুজিবনগর থেকে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এ প্রতিনিধি দলটি পাঠান। এক মাস অবস্থানকালে প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন দান এবং নির্বিচার গণহত্যা বন্ধ করার জন্যে বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন জানায়।
প্রতিনিধি দলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, ডঃ এ, আর, মল্লিক; সৈয়দ আবদুস সুলতান ডঃ রেহমান সোবহান, ফকির শাহাবুদ্দীন, ফণিভূষণ মজুমদার, আবুল ফাহে প্রমুখ। কয়েকজন মার্কিন জনপ্রতিনিধির পরামর্শ অনুযায়ী এম, এন এ সৈয়দ আবদুস সুলতান সেখানে থেকে যান। পরামর্শদাতাদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা ম্যালকম ফ্রেজার বিশ্ব শান্তি পরিষদের সভাপতি ডঃ হোমার জ্যাকও ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টি ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অনেক প্রভাবশালী সদস্য যখন বাংলাদেশের সমর্থনে এগিয়ে আসেন তখন মার্কিন কংগ্রেস পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়া পড়ে এবং এদের কার্যকর ভূমিকার কারণে অচিরেই পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য এবং পরে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়।
পাকিস্তানীদের পরাজয় ঘনিয়ে আসে। বিশ্বে বাংলাদেশের এই মানচিত্র ভোরের সূর্যের মতো আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠতে থাকে। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর একটি নতুন দেশ বাংলাদেশের জন্ম হয়।
দেশগড়ার পালা
দেশগড় পালা এবার নতুন দেশগড়ার পালা। যুদ্ধবিধস্ত একটি দেশ। দেশের সম্পদ বলতে শুধু অবশিষ্ট কয়েক কোটি স্বজনহারা গৃহহারা মানুষ। এদেয়কে উঠে দাঁড়াতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে সামনে।
মার্কিন প্রবাসীদের কাজ তখনো শেষ হয়নি। নিউইয়র্কের মেট্রো মিড়িকা বলে পরিচিত চানেল—৫ থেকে টিভি প্রোগ্রামের আয়োজন করা হলো। বিখ্যাত সাংবাদিক ডেইিড ফস্ট আয়োজন করেন এক কথিকা শো এর। শেখ মুজিবের সঙ্গে ৯০ মিনিট নামের এই প্রোগ্রামে বাংলাদেশের ওপর এক প্রামান্য চিত্র এতে দেখানো হয়। এবং তার শেষ পর্যায়ে নিউইয়র্কস্থ কূটনীতিক এ, এইচ, মাহমুদ আলীর এক সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়।
এ প্রােগ্রামে মার্কিন জনগণের ভূমিকার কথাও তুলে ধরা হয়। বলা হয়, মার্কিন জনগণ যেমন অতীতে হিটলারের ইহুদি এক নিধনের বিরোধিতা করেছে তেমনি বাংলাদেশের নির্বিচার গণ হত্যার বিরুদ্ধেও তারা প্রতিবাদ তুলেছে। মার্কিন সরকারের যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে ভিয়েতনমের পক্ষে সমর্থন গড়ে তুলেছে যে মার্কিন জনতা তারাই পারে মার্কিন সরকারের পাকিস্তান সমর্থক নীতি বদলাতে।
এ টিভি প্রোগ্রামে মার্কিন নাগরিকদের সাহায্য প্রার্থনা করে যে বক্তব্য প্রচারিত হয়, তাতে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে শিশু, বৃদ্ধ, বিভিন্ন বয়স ও পেশার মার্কিন নাগরিক। তারা নিজেরা এসে বাংলাদেশ মিশনে সাহায্য দিয়ে যান। শিশুরা তাদের স্কুলে ডেকে নিয়ে বাংলাদেশের কথা শুনে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে সাহায্য তুলে দেয়। এভাবে প্রবাসী বাঙালী ও মার্কিন জনগণ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ গড়ে তুলতেও গুরত্বপূর্ণ আর্থিক অবদান রাখে।
এবং তারপর
সাহায্যদাতা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শুধি সাহায্য দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। এগুলো ঠিকমতো পৌছালো কিনা বা তা কিভাবে ব্যয় করা হচ্ছে সে নিয়েও তারা খোঁজ খবর রাখতো। বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না বা তা নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে এ মর্মে যখন খবর বের হতে থাকে তখন এরাই আবার নিউইয়র্ক ওয়াশিংটনের পূর্বোক্ত বাঙালী উদ্যোক্তাদের ডেকে নিয়ে গেছে এবং বাংলাদেশে কি ঘটছে তা জানতে চেয়েছে।
প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে যারা ওসব জায়গায় এর আগে আবেদনময়ী বক্তৃতা দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছিল তারা এবারে এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং অনেক সময় নিজেদের ত্রুটির কথা স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে এসেছে। অনেকে পরবর্তী আহ্বানে সাড়া দিয়ে দ্বিতীয়বার ওমুখো হয়নি। ও সময় আসলে কিই বা জবাব দেবার থাকতে পারে ?
বাংলাদেশ নামক কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার এক যুগে পা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাঙালী ও সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকদের আমরা যখন প্রশ্ন করি—আপনাদের আকাঙ্ক্ষা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে—তখন তাদের অনেকেই কয়েক মূহুর্ত চুপচাপ থেকেছেন। হয়তো ভেবেছেন কিভাবে জবাবটা দেবেন। তাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের বাস্তব চিত্রের তফাৎ লক্ষ্য করে তাদের কেউ কেউ নীরব থেকেছেন। কেউ বা ভুলে যেতে চেয়েছেন পুরনো প্রসঙ্গ। আর কেউ ক্ষোভ চেপে গেছেন মনে মনে নিজের ভেতরেই।
কেন এমন হলো? কোথায় এর সমাধান ? এ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা এখন এরা এড়িয়ে যেতে চান।
পাদটীকা
সময়ের স্বল্পতা ও অনান্য অসুবিধের জন্যে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশিষ্ট অবদান রেখেছেন এমন অনেক প্রবাসী বাঙালী এবং বিদেশী নাগরিক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তাঁদের অনেকেই আজ প্রয়াত, অনেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম ও তাদের ভূমিকার বিবরণ বিচিত্রাকে জানানোর জন্যে অনুরোধ করা হচ্ছে।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/1983.03.25-bichitra.pdf” title=”1983.03.25 bichitra”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!