You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969 | গণঅভ্যুত্থানের অগ্নি ও উত্তাপ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৫ মার্চ ১৯৮৯ - সংগ্রামের নোটবুক

গণঅভ্যুত্থানের অগ্নি ও উত্তাপ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৫ মার্চ ১৯৮৯

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

রিকেটি শরীরের তুলনায় ছেলেটির মাথাটা একটু বড়ো, পাটের আঁশের মতো লালচে ময়লা চুল ঘামে লেপ্টানো, হাঁটুর নিচে পর্যন্ত ঝুলে পড়া পোশাকটি যদি হাফপ্যান্ট হয় তো তার জন্য অনেক বড়ো, ফুলপ্যান্ট হলে বেশ খাটো, এটা তার জন্য তৈরী হয়নি, তার বাড়ি বাড়ি কাজ করা মা কোনো বিবি সায়েবের ঘর থেকে চেয়ে বা চুরি করে এনেছে কিংবা ঈদের আগে আগে সওয়াব-কাঙ্গাল কোনো মহাত্মার বাড়ির গেটে কিউ ধরে নিয়ে এসেছে। নোঙরা তালুতে কাঠির মত আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরা ছেলেটির হাত জোড়ার একটি বুকের নিচে ঠেকানো, আর একটি মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ঐ অপুষ্ট কালোকিষ্টি শরীরের চেয়ে অনেক ওপরে তুলবার চেষ্টায় তার বাহুমূল টান টান হয়ে উঠেছে, বুকের হাড্ডি বেরিয়ে আসছে চামড়া ফুড়ে, যে কোন সময় দেহ থেকে ছিঁড়ে তার মুষ্টিবদ্ধ হাত উড়াল দিতে পারে শত্রুর দুর্গ লক্ষ্য করে। কিন্তু এই রোগা রিকেটি শরীর বলো, বেখাপ্পা পোশাক বলো, পুলিশ, ইপিআর, মিলিটারী বলো, তার দিকে উদ্যোত বন্দুক মেশিনগান স্টেনগান বলো – সব, হ্যাঁ সব ছাপিয়ে উঠেছে তার অমসৃণ মুখের মস্ত বড় হাঁ। তার রোগা ও রুগ্ন, রিকেটি ও অপুষ্ট দেহের যতো শক্তি আছে তার প্রতিটি বিন্দু প্রয়োগ করে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাতে জানাতে সামনে পা ফেলছে, সে আছে মিছিলের পুরোভাগে, পেছনে বিশাল মিছিল। সামনের পায়ের পাতাটি তার এমনভাবে পাতা যে এর ভারে মাটিতে ধস নামতেরদ পারে, পেছনের পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে একটি পাখির উড়াল দেয়ার প্রস্তুতি। সত্যি সে উড়ে গেছে, পুলিশের গুলীতে চিরকালের জন্যে চলে গেছে। তবে সেই প্রতিবাদ মুখর মুখের হাসি গচ্ছিত রেখে গেছে দেশবাসীর কাছে। ১৯৬৯ সালের ঢাকার একটি মিছিলের ছবিতে ছেলেটি ধরা পড়েছে, কিন্তু সেই ছবিতেই আবার এই মহাসত্য উচ্চারিত হয়েছে যে কারো সাধ্যই নেই যে তাকে কোন কাঠামোর ভেতর বন্দী করে রাখে।

আদুল গায়ের অপুষ্ট বালকটির মুষ্টিবদ্ধ ঊর্ধ্ববাহু এবংুখের মস্ত বড়ো হাঁ হলো ১৯৬৯ সালের এই দেশের প্রতিবাদী মানুষের শক্তির চরম প্রকাশ। ১৯৬৯ সালের গনঅভ্যুত্থানের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ঢাকা নগর যাদুঘর আয়োজিত রশীদ তালুকদারের একক আলোকচিত্রীর প্রদর্শনীতে গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা শহরের ভূমিকা ও তৎপরতা লেখা হয়েছে ১২৩ টি ছবিতে। রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ ছবিগুলিতে নানা তৎপরতায় প্রকাশিত। কোনো বিশেষ শাসক বা দলের অপসারণ বা সাংস্কৃতিক স্বাধিকার অর্জন বা আর্থিক নিরাপত্তা কিংবা কেবল পতাকা বদলের কামনায় এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ নিজেদের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে রাস্তায় নামেনি। রক্তের উত্তাল তরঙ্গে মানুষ যা পায় তাই নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। (এক নম্বর ছবি), সশস্ত্র বাহিনীর সামনে ব্যরিকেড তৈরী ২২ ক নম্বর ছবি, শহীদের জামা নিয়ে ক্রুদ্ধ পদক্ষেপে শহর কাঁপায়, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কারফ্যু ভাঙ্গে। (৬০ নম্বর ছবি), সচিবালয় ও সরকারী ভবনে আক্রমণ করে (৭১, ৭২, ৭৩ নম্বর ছবি), মশাল হাতে নিজেরাই আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রাজপথে (৭৪, ৭৫ নম্বর ছবি) – এসবই সম্ভব হয়েছে শতাব্দীর পুঞ্জীভূত ক্রোধ ও বেদনার প্রচন্ড ধাক্কায়। গোটা ব্যবস্থাকে তছনছ করে ফেলবার তাগিদ না থাকলে সশস্ত্র পুলিশকে কেউ তাড়ারকরতে পারে? (২৮, ২৯, ৩০ নম্বর ছবি)। ছাত্র জনতার হাতে রাষ্ট্রের লাঠিয়াল বাহিনী নাজেহাল হয় ; কেবল চাকরির দাবী বা নির্বাচনের আশায় মানুষ কখনঁ এমন মরিয়া হয়ে ওঠে না। বরং গোটা ব্যবস্থাকে সরাসরি অস্বীকার করা হচ্ছে। কি ব্যবস্থা চাই সে সম্পর্কে উচ্চকণ্ঠ বা সুস্পষ্ট ঘোষণা না থাকলেও বর্তমান কাঠামোর সম্পূর্ণ বিলোপ সাধনের স্পৃহার মধ্যে শোষণমুক্ত এবং যথার্থ মানবিক, শ্রেণীহীন, মর্যাদাপূর্ণ ও সুস্থ সভ্যতা গঠনের সংকল্প প্রকাশিত হয়েছে। শহীদের লাশ মানুষের কোলে কোলে করে বুকে ওঠে, তারপর মাথায় করে রেখে মানুষ এগিয়ে চলে (২৫, ২৬, ২৭ নম্বর ছবি), আদর করে তুলে নেয় গুলিবিদ্ধ মতিউরের লাশ (৪৯ নম্বর ছবি), তৃষ্ণার্ত মিছিলকারীদের মুখে কাঁটাতারের ওপার থেকে পানি তুলে দেয় ইডেন কলেজের মেয়েরা (৩৭ – ৩৮ নম্বর ছবি) – এ থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, পাশবিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের প্রতি তীব্র ঘৃণা মানুষের সুকুমার ও প্রয়োজনীয় অনুভূতিগুলোতে এতটুকু চিড় ধরাতে তো পারেইনি, বরং তাকে আরো গভীর করে তুলেছে।

অভ্যুত্থানে আগুন জ্বালাবার জন্য সংগঠিত নেতৃত্ব ছিল না, মানুষ তার জন্য পরোয়াও করে নি৷ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে জ্বলে উঠেছিল সবাই, প্রধান ইন্ধন ছিলো শোষণ ও নির্যাতন। নেতারা বরং অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলেন মানুষকে, বেশির ভাগ সময়েই তাল মিলিয়ে চলতে পারেন নি। মওলানা ভাসানী ডাক দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার আহবানের চেয়ে মানুষের সাড়া ছিলো অনেক বড়ো, মানুষের বিপুল গতিতে তার ডাকও চাপা পড়ে গিয়েছিল। মওলানা ভাসানী কি এটা জানতেন না? বায়তুল মোকাররমের সামনের চত্বরে জায়নামাজে দাড়িয়ে তার চোখে তাই অলৌকিক শক্তির প্রতি গদগদ ভক্তির চেয়ে ক্রুদ্ধ মানুষের সংঘবদ্ধ বলের দিকেই মনযোগটা বেশী। (১৫ নম্বর ছবি)

ক্নোধ ঘৃণা এবং ভালবাসার সঙ্গে সংকল্প যুক্ত হয়ে বিস্ফোরণটি প্রবাহিত হচ্ছিল একটি সংগঠিত সংগ্রামের দিকে। আসাদুজ্জামান নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিংস্র শাসক যন্ত্রের একটি দাঁত তুলে ফেলার লক্ষ্যে তার নাম মুছে ফেলা হয় শহরের একটি তোরণ থেকে, সেখানে বড় বড় হরফের লেখা হয় ‘আসাদ গেট’ (৩৬ ক নম্বর ছবি)। একদিনে নাম উচ্ছেদ ও নামকরণ – এ জন্য নেতৃবৃন্দের কোনো জরুরী কি ঐতিহাসিক বৈঠকের সিদ্ধান্তের দরকার হয়নি। সংকল্প ছিলো দৃঢ়, গভীর প্রতিজ্ঞা ছিল – তাই একটি ব্যবস্থাকে উৎপাটনের সংগে সংগে আরেকটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও আসতে বাধ্য। লড়াই চললে, আগুনের শিখা লেলিহান থাকলে এর পরিণতিও যে যথাযথ ঘটতো তাতে কি আর সন্দেহ আছে?

২৫ শে মার্চ আইয়ুব খানের পতন ও সামরিক শাসন জারি করার খবর দিয়ে আলোকচিত্রমালা যেন মনে হয় শেষ হলো গণ অভ্যুত্থানের গাথা। গাথার নিটোল সমাপ্তি এখানে কোথায়? যে আগুন লকলক করে জ্বলে উঠেছিল তাকে দপ করে নিভিয়ে কি অভ্যুত্থানের গাথার নটে গাছটি মুড়িয়ে দেয়া যায়? নেভাবার আয়োজনটি চলছিলো যখন আগুন জ্বলছে দপদপ করে। প্রথম দিকে দেখি কেবল মানুষ, অজস্র মানুষ। ১ ও ২ নম্বর ছবিতে শিল্পীর নৈপুণ্যে সাদাকালো ছবিতে হাজার হাজার মানুষের প্রায় সবাইকে আলাদা করে বোঝা যায়, কিন্তু আলাদা কেউ নয়, কেন ব্যক্তি এখানে তার স্যাঁতস্যাঁতে দুঃখ কষ্ট নিয়ে হাজির নেই, সবাই এখানে বহুবচন। আস্তে আস্তে আসেন নেতারা। নেতাদের মধ্যে নরখাদক মৌলবাদী জানোয়ারও উঁকি দেয়৷ তারপর আইয়ুব খানের কাতর আহ্বানে সাড়া দিয়ে গোলটেবিলে যাওয়া, গোটা শোষণ ব্যবস্থা উৎখাতের লক্ষ্যে উচ্চারিত ‘জ্বালো, জ্বালো, আগুন জ্বালো’ সংকল্পকে এড়িয়ে এক ধরণের মধ্যবিত্ত জাতীয়তাবাদী স্লোগান সামনে নিয়ে আসা, এসব কী অভ্যুত্থানের সংগে কোন ভাবে খাপ খায়? মানুষের দৃপ্ত পদচারণায় বায়তুল মোকাররমের বিশাল সিঁড়ি সেখানে কেঁপে উঠেছিল আইজেনস্টাইনের ওডেসা স্টেয়ার্স হওয়ার সম্ভাবনায়, তা শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় মধ্যবিত্ত বিকাশের ধাপে।

ছবিগুলি নির্বাচন ও বিন্যাস একটি বিশাল জনসমষ্টির ক্রোধ, ঘৃণা, প্রতিশোধস্পৃহা এবং ভালোবাসা ও সংকল্পকে দীপ্ত করে তুলেছে, আবার এরই মধ্যে পাওয়া যায় এই আনুগকে চাঁপা দেওয়ার ষড়যন্ত্রের ইংগিত। ১৯৬৯ এর পর দুই দশকে ঢাকার রাজপথে কোটি কোটি মানুষ হেঁটে গেছে, কিন্তু শোষণের মাত্রা কি নির্যাতনের তীব্রতা এতোটুকু কমেনি। একটি ছবিতে দেখি রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের পরও আলোকচিত্র শিল্পী রশীদ তালুকদার পুলিশের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন। রাষ্ট্র আলাদা, কিন্তু পুলিশ একই, একই ইপিআর, একই মিলিটারী, অন্য নামে আসে, কিন্তু রাস্তায় নামলেই তাদের একই চেহারা একই স্বভাব ঠিকই বেরিয়ে পড়ে। যা নেই তা হলো সেই সময়কার প্রতিবাদের সমবেত কন্ঠস্বর, প্রতিবাদের কঠিন হাত, শোষনমুক্ত হওয়ার দৃঢ় সংকল্প। ছাইয়ের নীচে আগুন চাপা দেওয়া হয়েছে, আগুন এতোটাই চাপা পড়েছে তার ওপর দিয়ে রং-বেরঙের নাম দিয়ে, এ দলে ও দলে ভাগ হয়ে পাশবিক শক্তি আজ দিব্বি চরে বেড়ায়। গদগদ মুখ করে স্বৈরাচারী শক্তির সামনে নতজানু হওয়া (১১ নম্বর ছবি) আজও অব্যাহত রয়েছে।

মাত্র বিশ বছরেই এই শহরের মানুষের এমন লেলিহান গতি কি আজ কেবল স্মৃতিতে পরিণত হলো? তা কি সীমাবদ্ধ থাকবে কয়েকটি ছবি আর কবিতার মধ্যে? প্রদর্শনী থেকে কেউ কেউ মন খারাপ করে বেরিয়ে আসেঃ আমাদের এই পরিচিত শহরেই এমন প্রতিরোধের স্পৃহা লক লক করে জ্বলে উঠেছিল তার একটি ফুলকিও তো নজরে পড়ে না। কিন্তু আগুনের কথা মনে করে মন খারাপ করলেই তো বোঝা যায় এর তাপ এখনো রয়েছে। রশীদ তালুকদার সেই তাপ দিতে জানেন। সাদাকালোর এইসব ছবিকে ফটোগ্রাফির ভাষায় যাই বলা হোক, এগুলো স্থিরচিত্র নয়। রশীদ তালুকদারের প্রখর চোখে পড়ে তার শক্ত সামর্থ্য হাতের টিপে এরা কেবলি ‘পটে লিখা’ হয়ে থাকে না, কিংবা কেবল ইতিহাসের বিষয়বস্তু হয়ে গবেষকের খাতায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে না, বরং ইতিহাস তৈরী করার জন্য মানুষকে ধাক্কা দেয়। যে আগুন নিভে গেছে বলে হা-হুতাশ করি, এই ছবি গুলি দেখতে দেখতে অনেক দূর থেকে হলেও তাপ গায়ে লাগে।এরা জানিয়ে দেয়, ছাইচাপা আগুন এখনো কোথাও না কোথাও ধিকিধিকি জ্বলছে।

***