You dont have javascript enabled! Please enable it! 1989.03.15 | ভয়াবহ নির্যাতনের স্মৃতিঃ ১৯৭১ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৫ মার্চ ১৯৮৯ - সংগ্রামের নোটবুক

ভয়াবহ নির্যাতনের স্মৃতিঃ ১৯৭১ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৫ মার্চ ১৯৮৯

নাসির আহমেদ

“হাসপাতালের – ওয়ার্ডে ঢুকে আমার ওপর হঠাৎ এসে আক্রমণ করলো। উপর্যুপরি ঘুষি থাপ্পর মেরে মেরে আমার নাক দিয়ে রক্ত ঝরালো। সে আমাকে চুল ধরে টেনে বালিশ থেকে উপরে তুলে ধরলো। — পকেট থেকে বেয়নেট বের করে পর পর তিনবার আমার বুকের ওপর আঘাত করে বলতে লাগলো – আই উইল টেক ইউর সাইড আউট। সে যখন আমার চোখে আঘাত করার জন্য বেয়নেট উদ্যত করলো, আমি তখন হাত দিয়ে ঠেকালাম। হাতে বেয়নেটের আঘাত লাগলো। একজন সিন্ধী নার্সিং সৈনিক সেই বর্বর মেজরের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেছিলো….” – শামসের মোবিন চৌধুরী, বীর বিক্রম।

“….. কর্ণেল বেত হাতে বেরিয়ে এসেই জিজ্ঞেস করেছিলো, এখনো বলুন, মুক্তিরা আপনার বাড়িতে ছিল কিনা? আরজ ভাই দৃঢ়কণ্ঠে বললো, জানিনা। আমি দার্শনিক জিসি দেবের ছাত্র, মিথ্যা বলতে শিখিনি। মুহূর্তে কঠিন হয়ে গেল কর্ণেলের মুখ। গর্জে উঠলো মেশিন গান। দু’ জন সৈনিক এসে আরজ ভাইর লাশটি সোমেশ্বরীর খরস্রোতে ফেলে দিল…..” – আরশেদা বেগম রীনা, শহীন আরজ আলীর বোন।

“…. ঐ অবস্থায় বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। পিছন দিক থেকে তাকে ছুরি মারা হয়েছে, রক্তে আমার দু’ হাত ভিজে যাচ্ছে। অন্যরা ছুটে আসছে দেখে বাবা বললেন, আমি তো মরেই যাচ্ছি। তুই বাঁচ। শিঘ্রী পালা….” – সাদি মহম্মদ, শহীদ সলিমুল্লাহর পুত্র।

ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। ১৯৭১ – এর ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত ন’ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যে পৈশাচিক তান্ডবলীলা বইয়ে দিয়েছে হানাদার বাহিনী, সেই নৃশংসতার নজীর ইতিহাসে বিরল। ৬৪ হাজার গ্রামের এই বাংলাদেশে প্রিয়জন হারানো থেকে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি পর্যন্ত নানা বিপর্যয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে সেই ভয়াবহ ন’ মাস অতিক্রম করেছেন এদেশের প্রতিটি নাগরিক। এই সর্বগ্রাসী ক্ষতির শিকার হয়নি এমন একটি পরিবারও হয়ত এ দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ন’ মাসের ভয়াবহ যুদ্ধকালীন সময়ে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল এ দেশেরই কতিপয় মীরজাফর। এসব রাজাকার, আলবদর, আল শামস প্রভৃতি বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মুহূর্তে ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে এ দেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে। ধর্ষিতা হয়েছেন অসংখ্য মা-বোন।

এত বড় একটি যুদ্ধের পর আমাদের সাহিত্য ক্ষেত্রে আমরা পাইনি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক আশানুরূপ প্রকাশনা। বিচ্ছিন্নভাবে গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছে ঠিকই, তবে বড় ধরণের উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি খুব একটা। প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যে পরিমাণ উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম – চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে এই দুটি যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যক্তিগত ডাইরী, স্মৃতিচারণা, ইতিহাস, মৌলিক সাহিত্যকর্ম ইত্যাদি নানামুখী রচনা আছে বিশ্ব সাহিত্য ভান্ডারে। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে শৌর্যবীর্য, যে অসম সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছে বাঙালী জাতি, যে ত্যাগ তিতিক্ষার পরিচয় রেখেছেন দেশবাসী, তা নিয়ে সাড়াজাগানো সাহিত্যকর্ম, স্মৃতিচারণ, চলচ্চিত্র ইত্যাদি নির্মিত হওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক রচনার সংখ্যা আরও কম। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত মেজর রফিকুল ইসলামের ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ‘ (মুক্তধারা প্রকাশিত) যার ইংরেজী ভার্সনের নাম ‘এ টেল অব মিলিয়নস’ ; গ্রন্থটি যুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক প্রথম বৃহদাকার গ্রন্থ। এরপর বিক্ষিপ্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তবে সে সব গ্রন্থের কলেবর এবং গুণগত মান খুব উল্লেখযোগ্য নয়, এবং এসব গ্রন্থে যতখানি উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধের বর্ণনা, ততখানিই নীরবতা পালিত হয়েছে হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের ভয়াবহ নির্যাতন এবং গণহত্যা প্রসঙ্গ। অবশ্য মুক্তধারা প্রকাশিত ‘জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ ‘ গ্রন্থে গণহত্যার বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় গণহত্যার বিবরণ, হানাদার বাহিনীর বন্দী শিবিরগুলোতে নির্যাতনের বিবরণমূলক গ্রন্থ প্রায় অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে বলা যায়। এ ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমী প্রকাশনা জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’। প্রতিদিনের দিনলিপির ভিত্তিতে লেখা এই হৃদয়স্পর্শী বইটি বলা যায় একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলির স্মৃতিচারণমূলক রচনার উৎসমুখ খুলে দেয়।

তাজুল ইসলামের লেখা ‘সিলেটে গণহত্যা ‘ অঞ্চল ভিত্তিক রচনা হলেও হানাদার বাহিনীর ভয়াবহতার আংশিক চিত্র এ গ্রন্থে পাওয়া যায়। ‘আমরা স্বাধীন হলাম’ শীর্ষক কাজী শামসুজ্জামানের বইটির একটি অধ্যায়ে মাত্র হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের বর্ণনা পাওয়া যায়। বইটির অন্যান্য অংশে কেমন করে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তারই বর্ণনা। এই বইটিরও প্রকাশক মুক্তধারা।

এ বছর মার্চ মাসে বজলুল মজিদ খসরু এবং রেহান আহমেদ রাজু সম্পাদিত একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র সুনামগঞ্জ থেকে। সংকলনের নাম ‘একাত্তরের সুনামগঞ্জ ‘। এই সংকলনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কর্ণেল (অবঃ) শাফায়েত জামিল, কর্ণেল (অবঃ) আকবর হোসেন বীর প্রতীক, লেঃ কর্ণেল (অবঃ) এ এস হেলাল উদ্দীন, সালেহ চৌধুরী, মেজর (অবঃ) তাহের উদ্দিন আখঞ্জি, মোহাম্মদ আবদুল হাই, বজলুল মজিদ খসরু, গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেশী, মতিউর রহমান প্রমুখ সুনামগঞ্জ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিতকরণ ও বিভিন্ন যুদ্ধের বর্ণনামূলক স্মৃতিচারণ করেছেন। একটি অঞ্চলের মধ্যেই এই আলোচনা সীমিত। তবে ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এসব বিচ্ছিন্ন প্রকাশনারও একটি গুরুত্ব আছে সন্দেহ নেই।

তবে এ ক্ষেত্রে ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ শীর্ষক গ্রন্থটি এ পর্যায়ের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ এবং উল্লেখিত বইগুলির মধ্যে ব্যতিক্রমীও ঘটে। কেননা ১৯৮৭ সালে ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ গ্রন্থের মাধ্যমেই প্রথম দেশবাসী গ্রন্থাকারে পেলো ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর দোসরদের ভয়াবহ নির্যাতন এবং গণহত্যায় নারকীয় ভূমিকার বিপুল পরিমাণ তথ্য। ২৫ শে মার্চ থেকে শুরু করে ১৪ ও ১৫ ই ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যা পর্যন্ত রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি দালাল সংগঠন কী নৃশংস ভূমিকা পালন করেছে তা এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

আহমেদ শরীফ, কাজী নুরুজ্জামান এবং শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত এই গ্রন্থটির প্রকাশক মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র। ১৯৮৭ সালের বই মেলার ৭ দিনে ৫ হাজার কপি বই নিঃশেষের মত ব্যতিক্রমী জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘ একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’। মাত্র দু’ বছরে চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এই গ্রন্থের। সম্প্রতি এর পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত ইংরেজী সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ‘জেনোসাইড সেভেনটি ওয়ানঃ এ্যান একাউন্ট অব কিলারস এ্যান্ড কোলাবরেটরস’ এই শিরোনামে।

এ ছাড়া এ ধরণের আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার তথ্য হচ্ছে ‘ঢাকা ৭১’ নির্যাতনের দলিল চিত্র। ঢাকা নগর যাদুঘর গ্রন্থিত বাংলা একাডেমী প্রকাশিত এই এ্যালবামে ১৯৭১ এর নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্রসমূহ সংকলিত হয়েছে।

কিন্তু যে কথা আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধ কালীন হানাদার বাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের যে বীভৎস স্মৃতি বয়ে এখনো অনেকে বেঁচে আছেন, চোখের সামনে দেখেছেন পিতা, পুত্র, কন্যা কিংবা স্বামীকে নির্মমভাবে নির্যাতিত হতে, হানাদারদের হাতে পৈশাচিক নির্যাতনের পর শহীদ হতে, তাদের স্মৃতি নিয়ে কোন গ্রন্থ স্বাধীনতার প্রায় দেড়যুগ অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশিত হয় নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধে যে বিপুল শৌর্যবীর্য আর বীরত্বের প্রমাণ রেখেছেন এদেশ বাসী, যে পরিমাণ ত্যাগ তিতিক্ষার পরিচয় দিয়েছেন, তার চেয়ে কোন অংশেই কম উল্লেখযোগ্য নয় সেই ভয়াবহ নির্যাতনের স্মৃতি।

দীর্ঘকাল পর হলেও ১৯৮৮ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে গোটা দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত, এবং নির্মমভাবে নিহতদের আত্মীয় পরিজনের স্মৃতিচারণমূলক ‘স্মৃতি ১৯৭১’ নামের একটি উল্লেখযোগ্য সংকলন গ্রন্থ।

এই গ্রন্থে দেশের বিশিষ্ট ৩৯ জন শহীদ ব্যক্তিত্বের স্মৃতিচারণ করেছেন তাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোনসহ বিভিন্ন স্তরের আত্মীয় পরিজন বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ীবর্গ। আলোচিত শহীদদের মধ্যে রয়েছেন – বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কলেজের অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, আইনজীবী, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, স্কুল শিক্ষক, পুলিশ অফিসার, এক কথায় এই সমাজকে যারা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন আরও বহুদূর, সে রকম প্রাজ্ঞ ও প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্ববর্গ। এদের মধ্যে সর্বজন পরিচিত কিছু নাম – মুনীর চৌধুরী, ডঃ জিসি দেব, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, এস এম রাশীদুল হাসান, ডঃ ফজলুর রহমান খান, মীর আবদুল কাইয়ুম প্রমুখ স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বুদ্ধিজীবী শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক হিসাবে যাদের নাম আজও সবার মুখে মুখেঃ তারা হচ্ছেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, নিজাম উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজমুল হক প্রমুখ। ডাঃ আলীম চৌধুরী, ডাঃ মোহাম্মদ মোর্তজা, ডাঃ মোহাম্মদ শফী, ডাঃ জিকরুল হক, ডাঃ রাখাল চন্দ্র দাস সহ বহু শহীদ চিকিৎসক, সিএসপি অফিসার ও অন্যান্য পেশার শহীদদের প্রত্যেকেরই সামাজিক অবস্থান এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য। দেশের এই কৃতি সন্তানদের ঘাতকরা দেশের বিভিন্ন স্থানে কি নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে তিলে তিলে নিঃশেষ করেছে, কী পৈশাচিক উল্লাসে ধরে নিয়ে গেছে, প্রিয়জনের চোখের সামনে কী নৃশংস ভাবে তাদের হত্যা করেছে তারই মর্মস্পর্শী বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে এই গ্রন্থে। এই শহীদদের অনেকের লাশও পাওয়া যায় নি।

কিশোর পুত্রের চোখের সামনে পিতাকে বেয়নেটের আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে খুন করেছে ঘাতকরা। সেই মর্মছেঁড়া বেদনার স্মৃতি নিয়ে আজও সেই পুত্র বেঁচে আছেন, এমনই এক হৃদয়বিদারক স্মৃতিচারণ রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সাদি মোহাম্মদ এর। তিনি লিখেছেন, ‘ আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। সন ১৯৭১, ২৬ শে মার্চ।…. বাবা মাত্র জুম্মার নামাজ পড়ে ঘরে ফিরে এসেছেন। খাবার টেবিলে ভাত সবাই এক সাথে খেতে বসব। ঠিক এই সময় অবাঙ্গালীরা আমাদের বাড়ি আক্রমণ করল। লক্ষ্য আমার বাবা ও আমাদের পরিবারের সবাই।…. আমরা চারতলায় থাকতাম। চারতলা লক্ষ্য করে গুলি, পরে আগুন ধরিয়ে দিল নীচের তলায়।… আগুনের ধোঁয়ায় এবং পুড়ে মরবার ভয়ে সবাই ছিটকে এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়লাম। দশ ভাই বোন কে কোথায় আশ্রয় নিলো জানিনা। বাবা আর আমি পাশের এক বাড়ির বাথরুমে আশ্রয় নিলাম।…. খোলা ছুরি হাতে একজন ছুটে এলো বাথরুমের মধ্যেই। বাবা ফোকড় দিয়ে বাইরে লক্ষ্য করছিলেন। চিৎকার করে বাবাকে যে জানাব, গলা দিয়ে শব্দ বের হলো না।… চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে এলো।… চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে এলো। ঐ অবস্থায় বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। পেছন দিক থেকে তাকে ছুরি মারা হয়েছে, রক্তে আমার দু’ হাত ভিজে যাচ্ছে। অন্যরা ছুটে আসছে দেখে বাবা আমাকে বললেন, “আমি তো মরেই যাচ্ছি। তুই বাঁচ। শীঘ্রি পালা।” বাবাকে ঐ অবস্থায় রেখে আমি ছুটলাম। রক্তে ভেজা হাত দুটো পকেটের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে ছুটতে থাকি জ্ঞানশুন্য হয়ে।’ (পৃঃ ১৩১)

উল্লেখিত, ঘটনাটি ঘটে ছিল ঢাকার মোহাম্মদপুরে। মোহাম্মদপুরের তৎকালীন বিশিষ্ট সংস্কৃতি ও সমাজ সেবী ব্যক্তিত্ব হিসাবে মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ ছিলেন সুপরিচিত। শহীদ মোহাম্মদ সলিমুল্লাহর নামেই বর্তমান সলিমুল্লাহ রোড। এ রকম হৃদয়বিদারক করুণ স্মৃতির ঝাপি বলা যায় ‘স্মৃতি ১৯৭১’ গ্রন্থটিকে। কথা সাহিত্যিক রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘স্মৃতি ৭১’ গ্রন্থে অনেক প্রিয়জন প্রশ্ন রেখেছেন এই সমাজের কাছে। প্রিয়জন হারানোর বেদনার স্মৃতি মন্থন করতে গিয়ে কেউ কেউ আবার নতুন করে গভীর বেদনায় নিমজ্জিত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শহীদ এস এম এ রাশীদুল হাসানের পুত্র এস এ মাহমুদ হাসান বাবার সঙ্গে সম্পর্ক থেকে শুরু করে তার আদর, স্নেহ আচরণ, বৈশিষ্ট্য সবই উল্লেখ করেছেন। ১৪ ই ডিসেম্বর ঘাতকরা তাকে বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার থেকে ধরে নিয়ে যায়।

এস এ মাহমুদ হাসান স্মৃতিচারণ শেষ করেছেন এভাবে – বাবার অভাব আমাদের কোনদিনই পূরণ হবে না জানি, কিন্তু তার আত্মত্যাগের জন্য আমরা গর্বিত। শুধু দুঃখ এই যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৭ বছর পরেও মুখচেনা ঘাতকদের বিচার হল না। (পৃঃ ১৩৪) তৎকালীন কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব ‘সি এস পি’ শহীদ নূরুল আমিন খানের স্ত্রী হুমায়রা আমিন গোটা পরিবারের বন্দীদশা, হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের করুণ স্মৃতি তুলে ধরেছেন এবং সর্বশেষ ঘাতকদের হাতে স্বামীর নিখোঁজ হবার তথ্য। তিনি লিখেছেন, ‘দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম উনি ফিরে আসবেনই, গত পাঁচ ছয় বছর থেকে আমার বিশ্বাসে ভাঙন ধরেছে। মনে হয় আর আশা করে লাভ নেই।” এ রকম হৃদয়স্পর্শী দীর্ঘশ্বাস আছে অধিকাংশ রচনায়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী শহীদ মোহাম্মদ শামসুজ্জামানের কন্যা সালমা চৌধুরী জলিও একই আশায় বুক বেঁধে আছেন। পিতার সঙ্গে তাদের মধুর সম্পর্ক, তার জীবনাচরণ আদর্শ ইত্যাদি স্মৃতিচারণ এবং হানাদার বাহিনীর হাতে ২১ মে ‘৭১ বন্দী হবার পর নিখোঁজ – এই তথ্য নিয়ে একটি করুণ স্মৃতি আলেখ্য রচনা করেছেন তিনি। শেষ করেছেন এভাবে – “অবশ্য এখনও মাঝে মধ্যে হঠাৎ করেই ক্ষীণ আশা জাগে, হয়তো চলে আসবেন তিনি। জড়িয়ে ধরে বলবেন, কি রে মা জলি, কেমন আছিস?”

ভাই হারানোর বেদনামথিত স্মৃতি কবীর চৌধুরীর। লিখেছেন মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে তার সম্পর্কের খুটিনাটি এবং অন্তরঙ্গতার এক চমৎকার স্মৃতিচিত্র। কিন্তু শেষাংশ বড় করুণ – ‘স্বাধীনতার মাত্র ৪৮ ঘন্টা আগে, আমাদের ধানমন্ডী সেন্ট্রাল রোডের পৈত্রিক বাড়িতে মুনীর স্নান শেষ করে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন। মা তার খাবার বেড়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময়ে দখলদার পাক সেনাবাহিনীর বর্বর ফ্যাসিস্ট সহযোগী আলবদরের লোকেরা গাড়ি নিয়ে এসে মুনীরকে বললো যে, ওকে তাদের সঙ্গে একটু যেতে হবে। মা মুনীরকে কিছু খেয়ে নিতে বলেছিলেন, মুনীর বলেছিল ফিরে এসে খাবে। আর সে ফিরে আসেনি। তার মৃত দেহও আমরা খুঁজে পাইনি। (পৃঃ ১৮)

হৃদয় বিদারক স্মৃতিচারণ করেছেন ডাঃ আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী চৌধুরীও। স্বামী বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক শহীদ ডাঃ আলীম চৌধুরীর স্ত্রী মৌলানা আবদুল মান্নানকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বাড়িতে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ১৯৭১ এর জুলাই এর মাঝামাঝি। আর সেই হলো তার জন্য কাল। স্বাধীনতা অর্জনের অন্তিম মুহূর্তে ১৫ ডিসেম্বর আলবদররা তাকে নিয়ে হত্যা করলো রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে। মিসেস শ্যামলী চৌধুরী স্বামীর অন্তিম বর্ণনা দিয়েছেন – ‘গায়ের শার্টটি গায়েই ছিল। হাত দুটো, দড়ি দিয়ে পেছনে বাঁধা। চোখ বাঁধার গামছাটা গলায় এসে ঠেকেছে। বুকটা গুলিতে ঝাঝরা হয়ে গেছে। তল পেটের ও কপালের বাঁ দিকে বেয়নেটের আঘাত।’ (পৃঃ ১৭৭)

“স্বাধীনতার আর বেশী দেরী নেই, দেখছো না প্লেনগুলো কেমন নীচ দিয়ে উড়ে গিয়ে বোমা ফেলছে – ২৪ ঘন্টার মধ্যেই স্বাধীন হয়ে যাবো আমরা, ওরা আর ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।” ১৯৭১ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর এ উক্তি করেছিলেন পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে শিক্ষাবিদ শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। তার পুত্র সুমন হায়দার চৌধুরী তার ৭ বছর বয়সে দেখা পিতার স্মৃতি আজও উজ্জল ভাবে ধরে রেখেছেন চেতনায়। দুঃখ করে তিনি লিখেছেন – স্বাধীনতা এসেছিল ঠিকই – তিনি তা দেখে যেতে পারেননি।’ ক্ষোভের সঙ্গে আরও লিখেছেন – ‘কি পেয়েছি আমরা যারা চরম ত্যাগ স্বীকার করেছি?…. নিজের জীবন দিয়ে যারা স্বাধীনতার আলো দেখিয়েছেন সেই মুনীর কাকা, আনোয়ার পাশা কাকা, মূর্তজা কাকা, রাশীদুল হাসান কাকা, বাপী (মানে তার পিতা) এবং আরো অনেকের কথা কদিন মনে রাখে দেশবাসী? আর যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এতগুলো শিক্ষককে নিয়ে গিয়ে অকথ্য নির্যাতন করে মারা হয়েছিল যে দিনে, সে দিনটির স্মরণে কি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ? যে দিনটি জাতীয় শোক দিবস হওয়ার কথা ছিল, সেই দিনে অফিস-আদালত তো দূরের কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই বন্ধ থাকে না কেন? কেন ১৪ ই ডিসেম্বর জাতীয় ছুটির দিন হয় না? (পৃঃ ৪৯)

এমনি অনেক বাস্তব জিজ্ঞাসার মুখোমুখি করেছেন আমাদেরকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্বজনেরা।

কথা শিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তার শহীদ পিতা তৎকালীন পুলিশের এসডিপিও জনাব ফয়জুর রহমান আহমেদ এর স্মৃতিচারণের এক পর্যায়ে লিখেছেন, দেশে প্রেমের অপরাধে ৫ ই মে ১৯৭১ সালে তার প্রিয় নদীর তীরে তাকে হত্যা করা হল। তার লাশ নদীতে ভাসতে লাগল। সেই নদীতে যেখানে তার পুত্র কন্যা এবং মমতাময়ী স্ত্রীকে নিয়ে কত না রজনী কাটিয়েছেন…. তার অপরাধ ছিল পিরোজপুর মহকুমা পুলিশ প্রধান হিসাবে তিনি অস্ত্রাগারের সব অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, সংগঠিত করেছিলেন প্রতিরোধ বাহিনী।

গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি রচনা উদ্ধৃতি যোগ্য। এ আলোচনার কলেবর একটি বিশালাকার গ্রন্থের পরিধি পেয়ে যাবে যদি তা উদ্ধৃত করতে যাই। অন্যান্যের মধ্যে যারা সেই ভয়াবহ দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছেন তারা হলেন কবি আসাদ চৌধুরী, পান্না কায়সার, হাশোম খান, জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, জেবউন নেসা জামাল, সারা আরা মাহমুদ, ঝর্ণা জাহাঙ্গীর এবং আরও অনেকে। এক কথায় এ এক মহা কাব্যিক শোকগাথা যেন। বাংলা একাডেমী ‘স্মৃতি ৭১’ এর দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশ করেছে বুদ্ধিজীবী দিবস ১৯৮৯ উপলক্ষে। দ্বিতীয় খন্ডেও রয়েছে ৩৯ জন শহীদের স্মৃতি। এই খন্ডে যাদের স্মৃতিচারণ থাকছে তাদের মধ্যে আছেন, শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, মতিউর রহমান বীর শ্রেষ্ঠ, ডাঃ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, ডাঃ আবদুল জব্বার, ডঃ আবুল খায়ের, জহির রায়হান, শহীদ সাবের, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ডাঃ আজহারুল হক, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমদ প্রমুখ ৩৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব৷ দ্বিতীয় খন্ডে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী – যারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রিয়জনদের কাছ থেকে স্মৃতিচারণ সংগৃহীত হয়েছে। প্রথম খন্ডের মতই অধিকাংশ রচনা প্রিয়জন হারানোর বেদনায় যেমন ভারাক্রান্ত, তেমনি এসব রচনায় ফুটে উঠেছে আলোচিত শহীদদের গভীর দেশপ্রেম এবং নিজের জীবনের চেয়ে দেশের স্বাধীনতাকে বড় করে দেখার মহৎ আকাংক্ষা। এই গ্রন্থে যারা শহীদ আত্মীয় পরিজনের স্মৃতিচারণ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন – ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম, সানজিদা খাতুন, বাসন্তীগুহ ঠাকুরতা, রশীদ হায়দার, হাজেরা নজরুল, মকবুলা মনজুর, বেগম নূরজাহান সেরাজী, মিলি রহমান, ফজলে হোসেন, জাকারিয়া হাবিব, কাজী তামান্না, বীনা চৌধুরী, ডাঃ জাহানারা রাব্বী, শামসুন্নাহার চৌধুরী প্রমুখ ৩৯ জন স্বজন আত্মীয়। ‘স্মৃতিঃ ১৯৭১’ দ্বিতীয় খন্ডেরও সম্পাদক রশীদ হায়দার। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত বইটির সর্বশেষ ফর্মার ছাপা এবং বাঁধাই কাজ চলছিল। বইটি প্রকাশিত হবে ১৪ ডিসেম্বর।

রশীদ হায়দার সম্পাদিত বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ’ ও একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা। এই গ্রন্থে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিমূলক তালিকা প্রকাশিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, এবার ১৬ ডিসেম্বর আরও একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘ভয়াবহ অভিজ্ঞতাঃ ১৯৭১’ প্রকাশিত হচ্ছে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা থেকে। এই বইটিরও সম্পাদক রশীদ হায়দার। এতে সংকলিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ন’ মাসে বিভিন্ন বন্দী শিবিরে এবং দেশের অন্যান্য স্থানে যারা হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন কিংবা চোখের সামনে দেখেছেন অন্য কাউকে নির্যাতিত হতে তারই লোমহর্ষক বর্ণনা। এই নির্যাতনের স্মৃতিচারণ করেছেন ৫০ জন ভুক্তভোগী।

মার্চ থেকে ডিসেম্বরের ১৯৭১ পর্যন্ত সময়ের মাস ভিত্তিক নির্যাতনের স্মৃতিচারণ রয়েছে নয়টি অধ্যায়ের এই গ্রন্থে। ২৫ শে মার্চ রাতে জগন্নাথ হলের মাঠে দাড় করিয়ে ছাত্রদের নৃশংস ভাবে হানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। এই লোমহর্ষক দৃশ্যের সাক্ষী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নূরুল উলা। তিনি একটি মুভি ক্যামেরায় ধরে রেখেছিলেন এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের চিত্র। তারই বিশদ স্মৃতিচারণা দিয়ে শুরু হয়েছে ‘ভয়াবহ অভিজ্ঞতাঃ ১৯৭১’ গ্রন্থটি। শেষে হয়েছে মধ্যভূমিতে ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম কর্তৃক তিনজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর লাশ সনাক্ত করণের বেদনাদায়ক স্মৃতিচারণ দিয়ে।

দেশের বিভিন্ন স্থানের ৫০ জন ভুক্তভোগীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার এই স্মৃতিচারণ গ্রন্থে অলৌকিক ভাবে বেঁচে যাওয়া অনেকের স্মৃতি রয়েছে। নজরুল বারিকে ঘাতকরা অন্যান্য বন্দীর সঙ্গে হত্যা করতে নিয়ে যাচ্ছিল। ৬০ মাইল বেগে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়েও বেঁচে আছেন তিনি। মাত্র এক গজ দূর থেকে মেজর জেনারেল (অবঃ) কে এম শফিউল্লাহ (বীর উত্তম) কে গুলী করা হয়েছিল৷ গুলী তার কোমরে পিস্তলের বাটে লেগে ফিরে আসে। বেঁচে যান তিনি। ৯৬ জনকে হত্যা করতে দেখেছেন জিল্লুর রহমান ; গুলীবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় ফয়েজ লেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেঁচে রয়েছেন আবদুস গোফরান। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে পদ্মায় ফেলে দেয়া পাবনার আবদুল লতিফ সেলিম বেঁচে আছেন আজো, এ কে এম আফসার উদ্দিন দেখেছেন ১০৮২ জন ধর্ষিতা এবং অন্তঃসত্ত্বা মহিলার লাশ চট্টগ্রামে। ঠাকুরগাঁওয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় হানাদার বাহিনী চারটি বাঘের মুখে ছেড়ে দিয়েছিল শফিকুল আলম চৌধুরীকে। সেই বাঘের খাঁচা থেকে ফিরে এসেছেন তিনি প্রাণ নিয়ে। ৪০০ জনকে ট্রেনে করে নিয়ে দাড় করিয়ে গুলি করার পর ৩৩৮ জন নিহত হয় সৈয়দপুরে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে আছেন দ্বারকা প্রসাদ সিংহানীয়া। জহুরুল হক হলে অসংখ্য লাশ নিজের চোখে দেখেছিলেন সেলিনা হোসেন ২৭ শে মার্চ। ঢাকার একটি বন্দী শিবিরে নির্যাতনের নির্মম নিরীক্ষা চালিয়েছে হানাদাররা জনাব মন্টু খানের ওপর। তার পরও বেঁচে আছেন তিনি। বন্দী শিবিরে ছিলেন শিল্পী আবুল বারক আলভী। আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে একই দিন বন্দী হন তিনি। নিজের জীবন বিপন্ন করে কিভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ তাকে, তার আলেখ্য আবুল বারক আলভী তুলে ধরেছেন। এমনি অসংখ্য স্মৃতির এক রুঢ় বাস্তবতা ‘ভয়াবহ অভিজ্ঞতাঃ ১৯৭১’।

৪ টি সংকলনের সম্পাদক রশীদ হায়দারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম স্মৃতি একাত্তর দুটি খন্ডে মাত্র ৭৮ জন শহীদের স্মৃতি সংকলিত হয়েছে। এই গ্রন্থের আরও কোন খন্ড প্রকাশিত হবে কিনা। তিনি জানালেন, এ ধরণের স্মৃতি গ্রন্থ সম্পাদনার ইচ্ছা আছে তার, তবে সব কিছু নির্ভর করছে একাডেমীর কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার ওপর। অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে এসব সংকলন গ্রন্থ সম্পাদনার ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে রশীদ হায়দার বললেন, “শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক গ্রন্থ ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ স্মৃতিঃ ১৯৭১ (১ম ও ২য় খন্ড) এবং ভয়াবহ অভিজ্ঞতাঃ ১৯৭১ সম্পাদনা সূত্রে আমি সমগ্র বিষয়টিকে একজন কথাশিল্পীর দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছি। আমি সবিনয়ে বলতে চাই, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানুষ যে সব মর্মান্তিক ও ভয়াবহ অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তার বিশ্বস্ত বিবরণ এসেছে ‘অ-লেখক’ দের কাছ থেকেই, পক্ষান্তরে লেখকরা অবস্থান করেছেন যোজন যোজন দূরে। ‘লেখকদের’ রচনা পড়ে আমি শিহরিত হয়েছি ঠিকই, কিন্তু ‘অ-লেখকদের’ রচনা আমাকে ফালাফালা করেছে, মনে হয়েছে এইসব অনভিজ্ঞ লেখক লিখেছেন নিজের রক্তে কলম ডুবিয়ে “।

তিনি আরও বলেন – ” আজ স্পষ্ট উচ্চারণে বলা যায় – ‘আমরাই স্বাধীনতা এনেছি’ ‘আমরাই স্বাধীনতার ঘোষক’, ‘আমরাই স্বাধীনতার ধারক, বাহক, পৃষ্ঠপোষক ইত্যাদি বাক-সর্বস্ব প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা যুদ্ধের বিকৃত ও বিক্রিত মূল্যায়ন করে জাতির এই বেদনা ও গৌরবময় অধ্যায়টিকে অর্থহীন করেছে সবচেয়ে বেশী। স্বাধীনতা বিরোধীরা ক্ষমা পায়, স্বাধীনতা বিরোধীরা ক্ষমতা লাভ করে, বাংলাদেশের আদর্শ ও চেতনা বিরোধীরা দেশবাসীর মাথার ওপর ডান্ডা ঘোরায়, আমরা বলি, বেশ। বেশ। আমি আগেই যেহেতু একজন কথাশিল্পীর দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখার চেষ্টা করেছি, বলেছি, সে জন্য আমার মনে হয় সমস্ত সংকলনে রাজনৈতিক দলসমূহ ও ‘লেখকদের’ ও ‘অ-লেখকরাই’ ‘চোখে আঙ্গুল দিয়ে কলমের খোঁচা মেরে মেরে বলেছে, ‘দ্যাখো, এই হচ্ছে ১৯৭১। বাংলা একাডেমী এবং জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী আমাকে সংকলনগুলো সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছেন বলে আমি উভয় প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।”

‘ভয়াবহ অভিজ্ঞতাঃ ১৯৭১’ এর মতো একই চরিত্রের আর একটি সংকলনের পরিচিতি দিয়ে শেষ করবো এ আলোচনা। এই সংকলনের নাম ‘একাত্তরের পাক বাহিনীর বন্দী শিবিরে ‘। গ্রন্থনা করেছে মোস্তাক হোসেন। দিনরাত্রি প্রকাশনীর পক্ষে আহসান হাবীব কর্তৃক প্রকাশিত ২০ জন প্রতিনিধিত্বশীল বন্দী ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে মোস্তাক হোসেন রচনা করেছেন এই গ্রন্থ। উল্লেখ্য এই গ্রন্থের মূল প্রেরণা সাপ্তাহিক বিচিত্রা। বিচিত্রায় এ বিষয়ে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখেছিলেন মোস্তাক হোসেন।

যে ২০ জন ব্যক্তিত্ব বন্দী শিবিরের ভয়াবহ নির্যাতনের স্মৃতিচারণমূলক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এই গ্রন্থে তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, শিল্পী সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, সামরিক কর্মকর্তা, পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা। নিজেরা দিনের পর দিন নির্যাতিত হয়েছেন বিভিন্ন বন্দী শিবিরে। চোখের সামনে দেখেছেন অনেক সহবন্দীকে নির্মম নির্যাতনের পর খুন করতে। এই গ্রন্থে যে সব বন্দী শিবিরের লোমহর্ষক বর্ণনা রয়েছে সেগুলো হচ্ছে ঢাকা ক্যান্টঃ এয়ার ফোর্স এমিউনেশন গোডাউন, শেরে বাংলা নগর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, খুলনা নেভাল হেড কোয়ার্টার, যশোর ক্যান্টঃ বন্দী শিবির, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জোহা হল কসাইখানা, ওয়াপদা কলোনী বরিশালের বন্দী শিবির। নির্যাতিত বন্দীরা হচ্ছেন আহমেদ ফজলুর রহমান (সিএসপি), বিগ্রেডিয়ার (অবঃ) মাহমুদুর রহমান মজুমদার, শামসের মোবিন চৌধুরী, বীর বিক্রম, মহীউদ্দীন আহমেদ, প্রফেসর কে এম সাদ উদ্দীন, প্রফেসর রফিকুল ইসলাম, কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ, আবুল বারক আলভী, মাসুদ সাদেক চুলু, লেঃ (অবঃ) নাসির আহমেদ, আবদুস সামাদ বীর প্রতীক, মাকসুদ আলী বাদল, আজিজুল সামাদ, এম রেজাউল মল্লিক, মাহফুজুর রহমান টুলু, ক্যাপ্টেন (অবঃ) সৈয়দ সুজাউদ্দীন আহমেদ, নজরুল ইসলাম খান, বেলায়েত হোসেন চৌধুরী এবং নূরুল আনোয়ার।

বইটির ভূমিকা লিখছেন মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার কবির। ‘তার সেই ভূমিকায় লেখা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য দিয়েই শেষ করবো এই আলোচনাঃ ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অর্ধশতাব্দী অতিক্রমের মুহূর্তেও পশ্চিমা দেশগুলোতে ফ্যাসি ও নাজি বাহিনীর বর্বরোচিত নির্যাতনের, হত্যাযজ্ঞের নতুন নতুন তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, রচিত হচ্ছে অসংখ্য গ্রন্থ, নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্র। মানব সভ্যতার এই গভীর কলংকজনক অধ্যায়ের উন্মোচন এই কারণেই প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে, যাতে এই ঘৃণ্য মতবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কালো অধ্যায়টিও এ কারণেই উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন। যে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ক্ষমা করবে না ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিদেহী আত্মা, ক্ষমা করবেনা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। “

দীর্ঘকাল পরে হলেও এ ধরণের প্রকাশনাকে আমরা স্বাগত জানাই।