You dont have javascript enabled! Please enable it!

একজন মুক্তিযোদ্ধার চিঠি ও শাহপুরগড়ের যুদ্ধ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৫ মার্চ ১৯৮৯

– মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম, পিএসসি

আঠারো বছর আগে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে এমন এক মুক্তিযোদ্ধার চিঠি পেলাম। এই চিঠি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে অনেক মৃত মুখ, যারা আমার সাথে যুদ্ধ করেছেন এবং পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। একাত্তরে আমার সহযোদ্ধা আহমেদ রেজা লিখেছেন –

প্রিয় মহোদয়,
প্রীতি ও শুভেচ্ছা নিবেন। পর সংবাদ এই যে, আমি বড় দুঃখের সঙ্গে আপনার নিকট এই পত্র লিখলাম। আপনি কষ্ট করে পত্রখানা পড়বেন।
স্যার, ছয় সাত মাস আপনার সঙ্গে দলদলিতে ছিলাম। কিছুদিন রোহনপুরে ছিলাম, তার কিছুদিন পরে রাজশাহী দখলের পর সব মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হলাম। আপনি আমাকে চাকুরী করার জন্য বলেছিলেন। এজন্য বকাঝকাও করেছিলেন। আমি নিতান্তই হতভাগ্য, তাই সাত দিনের ছুটি নিয়ে আপনার সঙ্গ ছেড়ে বাড়ী ফিরে এলাম। বাড়ী এসে সংসারের ছেলে মেয়ের প্রতি ভালবাসায় আর ফিরে গেলাম না।
স্যার, গত আঠারো বৎসরের মধ্যে আপনাকে একবার চিঠি লিখেছিলাম আর আপনার নিকট দুইবার গিয়েছিলাম। এবারও আমার ইচ্ছা ছিল কিন্তু শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ায় এই পত্র লিখলাম।
স্যার, গত আঠারো বছরের মধ্যে আপনার নিকট কোন প্রকার দাবী করি নাই। আপনার সঙ্গ ছেড়ে এসে আজ পর্যন্ত একটি টাকাও অন্যায়ভাবে উপার্জন করি নাই৷ দেশ ও জনগণের প্রতি অন্যায় করি নাই। কারণ শাহপুরে চৌদ্দটি মুক্তিযোদ্ধা ভাই- এর লাশ আমি একাই দাফন করেছি।
বাহাত্তর সালে আমার মা জমি বিক্রয় করে টাকা দেন। সেই টাকা দিয়ে ডিলারি আরম্ভ করলাম। বছর খানেক পর আমার ডিলারী চলল না। আমার সংসারে সাত-আট জন লোক, উপার্জনকারী একমাত্র আমি। সংসারে অনটন অবস্থা দেখে আপনার সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে আসলাম ঢাকা, আপনার বাসায়।
আপনার বাসায় দুই একদিন থাকার পর আসার সময় আমার বড় ছেলের চাকুরীর জন্য আপনি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন। আমি সেই চিঠি নিয়ে দেখা করলাম। অফিস থেকে জানতে পারলাম, এক মণ পোলাও – এর চাউল, একটি বড় মাছ ও এক বোয়াম ঘি বড় সাহেবের বাসায় দিলে চাকুরী হবে। উত্তর দিলাম, একটি পয়সাও দিতে পারব না। যদি এই সব ঘুষ দিতাম তাহলে মেজর সাহেবের মাধ্যমে আসতাম না। এই বলে চলে আসলাম, আর যাইনি।
বর্তমানে আমার পাঁচ ছেলে, দুই মেয়ে। বড় ছেলে বেকার। মেজ ছেলেকে পনেরো বৎসর আগে ছোট থাকতেই এক সাইকেলের মেকারকে দিয়ে দিয়েছিলাম। সেই ছেলেকে গোলা বাড়ী রেল ইস্টিশনে একটি ঘর ভাড়া করে দোকান করে দিয়েছি। অন্যান্যরা এখনও ছোট। মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার দেহরক্ষী ছিলাম এই দাবী নিয়ে আমি লিখছি, আমার বড় ছেলের একটা চাকুরী ব্যবস্থা করে দিন। আমরা এখন অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছি। বড় ছেলেটার চাকুরী না হলে পরিবার পরিজন নিয়ে একেবারে না খেয়ে মারা যাবো। আর স্যার, আপনার অন্তরে যেন চিরকাল স্থান পাই। গত আঠারো বৎসরে আপনার নিকট কোন প্রকার দাবী করি নাই, এটাই আমার শেষ দাবী। বিশেষ আর কি। বাড়ীর সবাইকে আমার সালাম দিবেন।
আপনার এককালীন দেহরক্ষী
আহমেদ রেজা।

আহমেদ রেজা চিঠির পরতে পরতে তার দরিদ্রের কথা লিখেছেন, বেকার ছেলের চাকুরীর জন্য লিখেছেন, লিখেছেন শাহপুর গড়ের যুদ্ধে তিনি স্বয়ং চৌদ্দটি মুক্তিযোদ্ধার লাশ দাফন করেছেন। আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে সেই সব তরতাজা তরুণের মুখ, যে যে অবস্থায় যারা মরে পড়ে ছিল তাদের ঠিক সেই ভাবে কবর দেয়া হয়েছিল শাহপুর গড়ের জঙ্গলে। ওদের সবার নাম এতদিন পরে মনে পড়ে না, কোথায় বাড়ি তাও জানি না, কোন মায়ের বুকের ধন এভাবে যুদ্ধে এসে দেশের জন্য, আজকের বিজয় দিবসের জন্য প্রাণ দিয়েছিলো জানি না। ইতিহাসে বড় বড় লোকের স্থান হয়, কোন জেনারেল বা বড় অফিসাররা কোথায় যুদ্ধ করলেন তার বিশদ বিবরণ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে। শুধু দেশের স্বাধীনতার জন্য নিঃশব্দে ঝরে যাওয়া এইসব তাজা প্রাণ যুবক, দরিদ্র মানুষের কথা ইতিহাসে লেখা হয় না। ইতিহাসে এদের কোন স্থান হয় না, কোন উল্লেখ থাকে না কৃষক, শ্রমিক, ভুখা মানুষের কথা যারা অস্ত্র নিয়ে লড়াই করে জীবন দেয়। আহমেদ রেজার মতো লোকেরা বিস্তৃতির অতল ইতিহাসে হারিয়ে যায়।

দলদলি সাব-সেক্টর, রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত রোহনপুরের পশ্চিমে মহানন্দা নদীর অপর তীরের এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এই সাব সেক্টরটি লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী নুরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া ও দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে গঠিত সাত নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত। দলদলিতে এই সাব-সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। মহানন্দা নদীর দু’ পাশে আলীনগর – মকরমপুর থেকে শাহপুর গড় পর্যন্ত প্রায় সাত মাইল বিস্তৃত এলাকায় মুক্তি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। নদীর এক দিকে আলীনগর – মকরমপুর, এ পারে আলমপুর – কায়সাবাড়ী আম্রকানন, তারপরে শাহপুর গড়। পশ্চাতে ভোলাহাট সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ১০০ বর্গমাইল এলাকা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে লেঃ রফিকুল ইসলাম (বর্তমান নিবন্ধের লেখক) এই সাব সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। অপর পক্ষে মহানন্দা নদীর অপর তীরে শিবরামপুর থেকে রোহনপুর হয়ে বিষ্ণুপুর পর্যন্ত পাক সেনাদের কংক্রিট বাংকার সহ সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল।

একাত্তরের বাইশে নবেম্বর। পাক বাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট মুক্তিবাহিনীর এই প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর এই দিন ভোর রাতে আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল নিম্নরূপঃ
মহানন্দা নদীর অপর তীরে আলীনগর – মোকরমপুরে মুক্তিবাহিনীর দলটির অধিনায়ক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রায়হান। দলদলিতে ছিল সাব-সেক্টরের সদর দপ্তর, আলমপুর-কায়সাবাড়ী প্রতিরক্ষা অবস্থানের অধিনায়ক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম (বর্তমানে ঢাকা সেনানিবাসে মিলিটারী ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের স্টাফ অফিসার হিসেবে কর্মরত) ও আলতাফ হোসেন আর শাহজাদপুরের প্রতিরক্ষা অবস্থানের অধিনায়ক ছিলেন বিডিআর (প্রাক্তন ইপিআর) এর নায়েবে ওয়াশিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এম, এস, সি শেষ বর্ষের ছাত্র ছানোয়ারও এখানে অবস্থান করছিলেন।

আকস্মিক ভাবে পাক বাহিনীর গোলন্দাজ কামানের গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের সর্ব ডান দিকে (Right Flank) শাহপুর গড় এলাকা পাকসেনারা আক্রমণ করে। অন্ধকার রাতে এই অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভংগ হয়ে পড়ে। শাহপুর গড় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাৎপসরণ করে দলদলিতে চলে আসে। বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা নদী অতিক্রম করে আলীনগর চলে যায়। পাক সেনারা অতি সহজেই শাহপুর গড় দখল করে নেয়। আলমপুর-কায়সাবাড়ী প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পাক বাহিনীকে প্রতিহত করা হয়। মুক্তিবাহিনীর দুই টি ৮১ মিলিমিটার মর্টার ছিল – একটা আলীনগরে, অন্যটি কায়সাবাড়ীতে মোতায়েন করা হয়েছিল। মুক্তিবাহিনী সারাদিন মর্টারে গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অগ্রবর্তী দল আলমপুর আম্রকাননের পূর্ব প্রান্তে অবস্থান গ্রহণ করে পাক সেনার অগ্রাভিযান রোধ করে।

সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান আমার সাথে ওয়ারলেসে কথা বললেন। শাহপুর গড় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ করার জন্য তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত ছিলেন৷ তিনি অবিলম্বে পাল্টা আক্রমণ করে শাহপুর গড় পুনর্দখলের আদেশ দিলেন। সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল জামানের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঐদিনই রাত ১.৩০ মিনিটে পাল্টা আক্রমণ করা হয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মেহেদিপুর থেকে তার বাহিনী নিয়ে এলেন। নৌকাযোগে খাল অতিক্রম করে শাহপুর গড়ের পূর্ব কোণে অবস্থান নিলেন। ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণের আগে শিবরামপুর, রোহনপুর ও শাহপুর গড়ে একযোগে কামানের গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। আলীনগর – মকরমপুর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনীর ৮১ মিলিমিটার মর্টারও গর্জে ওঠে। এখান থেকে শিবরামপুর ব্রীজের অপর প্রান্তে অবস্থিত পাক অবস্থান ও রোহনপুরে অবস্থিত পাক সেনাদের উপর প্রচন্ড গোলাবর্ষণ অব্যাহত থাকে। মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল পাক বাহিনী যেন এই ধারণা করে যে, রোহনপুরে পাক বাহিনীর অবস্থানের উপর মুক্তিবাহিনীর মূল আক্রমণ হয়েছে। অল্পক্ষণ পরেই ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের বাহিনী পূর্ব কোণ থেকে শাহপুর গড় আক্রমণ করলেন। আমি, নজরুল, আলতাফ ও ওয়াশীলকে সঙ্গে করে শাহপুরের সম্মুখ ও পশ্চিম দিক থেকে একসঙ্গে আক্রমণ করি। প্রায় দেড় ঘন্টা প্রচন্ড যুদ্ধ চলার পরে পাক সেনারা শাহপুর গড় ছেড়ে বিষ্ণুপুর ও কসবা এলাকায় পালিয়ে যায়। সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল জামান এই যুদ্ধের সার্বিক নেতৃত্ব দেয়।

তখন ভোর হয়ে এসেছে। সফল পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করে আমরা ঢুকে দেখলাম সাথী মুক্তিযোদ্ধাদের মৃতদেহ পড়ে আছে বাংলার মাটিতে। বাংলার দামাল ছেলেদের রক্তে ভেজা বাংলার মাটি, ঘাস, বন। পাকসেনারা ওদের হাতের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গেছে কিন্তু ওদের প্রাণহীন শরীরে তখনও এমুনিশনের বান্দোলিয়ার বাঁধা আছে৷ ওদের চোখ, নাক, মুখ পোকায় কুরে খাচ্ছে। সাদা সাদা পোকা। আমার সঙ্গে যারা ছিলেন তাদেরকে এই শহীদ সূর্য সন্তানদের কবর দিতে বললাম। ওয়াশীল, জমির আলী, শামসুদ্দিন, গফুর ও পত্রলেখক আহমেদ রেজা যে যেখানে মৃত অবস্থায় পড়ে ছিলো সেখানেই তাদেরকে কবর দিলো।

আহমেদ রেজা শাহপুর গড়ের চৌদ্দটি তেজোদ্দীপ্ত তরুণ প্রাণের কথা লিখেছেন, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য বাংলার মাটিকে মুক্ত করার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে সেই স্বাধীন বাংলাদেশে আহমেদ রেজারা এখন অসহায়, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত, দূর্দশা ক্লিষ্ট মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অথচ ওরা স্বপ্ন দেখেছিলেন শোষনমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার, সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের, স্বপ্ন দেখেছিলেন সুন্দর ভবিষ্যতের। এ কথা দুঃখজনক হলেও সত্যি ওদের স্বপ্ন সফল হয় নি। বাংলাদেশের সমাজে ওরাই সবচেয়ে বেশী অসহায়।

শাহপুর গড়ের যুদ্ধ ও চৌদ্দটি মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণের জীবনদান মুক্তিযুদ্ধের একটি ক্ষুদ্র খন্ড চিত্র। সারা বাংলাদেশের রণাঙ্গনে এমন করে জীবন দিয়েছে অসংখ্য মানুষ। ওদের বিদেহী অতৃপ্ত আত্মা আজও বাংলাদেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজকের বাংলাদেশে যারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুরম্য বাসভবনে বাস করছেন, সর্বাধুনিক মডেলের গাড়ীতে চড়ছেন, প্রচুর অর্থসম্পদের মালিক হয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন এবং স্বাধীনতার আঠারো বছর পরে এই বিজয় দিবস তাদের। সমাজের দুর্নীতিবাজ, মাস্তান পালনকারী শক্তিধর টাউট ও বাটপার শোষক শ্রেণীর। বাংলাদেশের দারিদ্রক্লিষ্ট শোষিত জনপদের তথা মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যিকারের বিজয় দিবস আজও অর্জিত হয়নি।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/1989.03.15-bichitra.pdf” title=”1989.03.15 bichitra”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!