You dont have javascript enabled! Please enable it!

একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের বিচার | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৫ মার্চ ১৯৮৯

মোস্তাক হোসেন

প্রতিটি যুদ্ধই জন্ম দেয় ‘দালাল’ নামধারী একদল লোকের। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে কিছু লোক জাতীয় চেতনা বিরোধী কর্মকাণ্ডে অবতীর্ন হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘দালাল’ দের উপস্থিতি পাওয়া যায়। একাত্তরের বাংলাদেশেও খুব স্বল্প সংখ্যক কিছু লোক অবতীর্ণ হয়েছিল আমাদের জাতীয় চেতনা বিরোধী কর্মকাণ্ডে৷ হাত মিলিয়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে নিজের দেশ আর জাতিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দালালদের বিচার করেছিল তদানিন্তন আওয়ামী লীগ সরকার – যেমনটি হয়েছিল বিশ্বের অন্যান্য দেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় চেতনা বিরোধী দালালদের বিরুদ্ধে। আজও পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে খুঁজে খুঁজে বিচার করা হচ্ছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার ফ্যাসী ও নাজিবাহিনীর দালালদের। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর পর বাংলাদেশ সরকারও প্রচলিত ও আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত নীতিমালার আলোকে বিচার করেছিল পাক বাহিনীর দালাল এবং সহযোগিতাকারীদের।

বর্তমান প্রতিবেদনে একাত্তরের দালালদের বিচার ও বিচারের রায় থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য দালালের বিচারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রকাশ করা হলো। বিচার সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাবলী সংগৃহীত হয়েছে ১৯৭২ এর দৈনিক বাংলা এবং দৈনিক ইত্তেফাকের ফাইল থেকে। ‘৭২ এর জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বৎসরের পত্রিকার ফাইল থেকে এই তথ্যাবলী সংগ্রহ করা হয়েছে।

জনতার আক্রোশ

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে পরিচালিত গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, লুটপাট ও নারী নির্যাতনে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য করেছিল ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম এবং তাদের সৃষ্ট রাজাকার, আল-বদর, আল শামস নামধারী কয়েকটি ফ্যাসিস্ট বাহিনী। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর থেকেই বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা এবং সারা বাংলার মুক্তিকামী জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পাক হানাদারদের দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। জনগণ এবং বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান টার্গেট আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তান বাহিনীর সদস্যদের হাতের কাছে না পাওয়ার ফলে রাজাকার – আলবদর ও অন্যান্য দালালদের বিরুদ্ধে গণরোষের তীব্রতা ব্যাপক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে মারমুখী জনতা নিজেদের উদ্যোগেই পাক বাহিনীর দালালদের নাজেহাল ও আক্রমণ করতে শুরু করে। এর ফলে অরাজকতা দেখা দিতে থাকে। কিন্তু তখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন পুরোপুরি কাজ শুরু করে নি। জনগণের তীব্র আক্রোশ থেকে দালালদেরকে সাময়িক ভাবে নিরাপদ এবং প্রকৃত দোষীদের শাস্তির জন্য তখন সংশ্লিষ্ট এলাকার বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড দালালদেরকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ঢাকায় আসার পর পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা নেয়া হয়৷ মুক্তির আনন্দে উদ্বেল ও স্বজন হারানোর বেদনায় বিধ্বস্ত জনগণের মধ্যে পাক বাহিনীর দালালদের বিরুদ্ধে পরিচালিত আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে যাতে কোন নিরপরাধ ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেয়া হয়৷ বিজয়ের এক মাস পর ১৬ জানুয়ারী, ‘৭২ এ পাক হানাদারদের দালালদের সম্পর্কে প্রথম সরকারী প্রেসনোট প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়ঃ ‘সরকার দালাল অথবা এ ধরণের অপরাধীদের দেখা পেলে তাদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে অসামরিক পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে এবং জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পুলিশকে দালালদের খবর প্রদানের জন্য।’ দালাল ও অপরাধীদের বিচারের দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারী সংস্থা সমূহকে ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে বলে এই প্রেসনোটে জানানো হয়।

দালাল অধ্যাদেশ ‘৭২

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফেরার ১৪ দিন পর ‘দালাল অধ্যাদেশ ‘ নামে একটি আইন জারীর মাধ্যমে পাক হানাদারদের এ দেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে বিচারের আনুষ্ঠানিক পর্ব শুরু হয়। ২৪ জানুয়ারী ‘৭২ এ ঘোষিত এই অধ্যাদেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি দেশে গণহত্যায় লিপ্ত দখলদার পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনীর সহযোগী দালালদের দ্রুত বিচার করার জন্য বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠনের কথা ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপতির এই বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ ১৯৭২ ‘ নামে অভিহিত করা হয় এবং তা অবিলম্বে কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হয়। একজন সেশন জজ বা একজন অতিরিক্ত সেশন জজকে নিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালই কেবল দালালদের বিচার করতে পারবে বলে উক্ত ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়। সরকার এই অধ্যাদেশে প্রতিটি অপরাধের বিচার ও অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলা অথবা এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনেরও এখতিয়ার রাখে। এই আইনে পাক বাহিনীর দালালদের সংজ্ঞা দেয়া হয় এভাবেঃ
(ক)পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশে তাদের অবৈধ দখল টিকিয়ে রাখার জন্য যারা সাহায্য সহযোগিতা বা সমর্থন প্রদান করেছে।
(খ) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে সব ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গ বা দল দখলদার পাক বাহিনীকে বস্তুগত সহযোগিতা প্রদান করেছে অথবা কোন কথা, চুক্তি বা কার্যাবলীর মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে সমর্থন যুগিয়েছে।
(গ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বা যুদ্ধের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা।
(ঘ) মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে এবং মুক্তিকামী জনগণের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যে সব ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে অথবা ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে।
(ঙ) পাক বাহিনীর গণহত্যা, অবৈধ দখলের অনুকূলে কোন বিবৃতি প্রদান বা প্রচারণায় অংশ নেয়া এবং হানাদার বাহিনীর কোন প্রতিনিধি দল বা কমিটির সদস্য হওয়া।
(চ) পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আয়োজিত তথাকথিত উপনির্বাচনে অংশ নেয়া।

৭৩ টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল

২৯ মার্চ ‘৭২ এক ঘোষণায় সরকার জল্লাদ বাহিনীর দালালদের বিচারের জন্য ৭৩ টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ঘোষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর কাজে পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর সাথে যারা সহযোগিতা করেছে তাদের বিচার তরান্বিত করা এবং সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এই বিশেষ ট্রাইব্যুনালগুলো গঠন করা হয়েছে। ২৫ জানুয়ারী, ১৯৭২ এর বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ অনুসারেই গঠিত হয় এই ৭৩ টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। তৎকালীন সকল জেলাতেই ট্রাইব্যুনালগুলো গঠন করা হয়েছিল। জেলাওয়ারী গঠিত ট্রাইব্যুনালের তালিকা ছিল এরকমঃ
(১) ঢাকা – ১১ টি, (২) ময়মনসিংহ – ৭ টি, (৩) টাঙ্গাইল – ২ টি, (৪) ফরিদপুর – ৩ টি, (৫) চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম – ৬ টি, (৬) সিলেট – ৫ টি, (৭) কুমিল্লা – ২ টি, (৮) নোয়াখালী – ৩ টি, (৯) রাজশাহী – ২ টি, (১০) দিনাজপুর – ২ টি, (১১) রংপুর – ৪ টি, (১২) বগুড়া – ২ টি, (১৩) পাবনা – ৪ টি, (১৪) যশোর – ৪ টি, (১৫) কুষ্টিয়া – ২ টি, (১৬) বাকেরগঞ্জ – ৬ টি, (১৭)পটুয়াখালী – ২ টি।

প্রাথমিক গ্রেফতারঃ গ্রেফতারকৃত দালালদের তালিকা

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর থেকে সারা বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীর দালালদেরকে গ্রেফতার করা শুরু হয়। ১৬ ডিসেম্বরের আগে যে সব এলাকা শত্রুমুক্ত হয়েছিল সেসব এলাকায় তখন থেকেই দালালদের ব্যাপক গ্রেফতার শুরু হয়। একাত্তরের ডিসেম্বরের শুরু থেকে ‘৭২ এর এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় ১২,৮৩৫ জন ব্যক্তিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দালালীর অভিযোগে বিভিন্ন পর্যায়ে আটক করা হয়। এখানে বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রেফতারকৃত দালালদের মধ্যে কিছু দালালের নাম প্রকাশ করা হলো।

৬ জানুয়ারী ‘৭২ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত গ্রেফতারকৃত দালালদের তালিকা থেকেঃ
(১) রাশিদুল হাসান, সাবেক ডেপুটি কমিশনার, খুলনা, (২) মওলানা মাসুম, সদস্য – ঢাকা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি, (৩) ডাঃ আব্দুর রহমান (জামায়াতে ইসলামী), বাগাবাড়ী, ফরিদপুর, (৪) মোহাম্মদ আলী, ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য, জয়দেবপুর, ঢাকা, (৫) আব্দুল হাকিম মোল্লা – সাবেক সি, আই – মাগুরা, যশোর, (৬) এ, এফ, এম শফিউজ্জামান খান – সাবেক গভর্ণর মোনায়েম খানের পুত্র, (৭) এ কে এম খালেকুজ্জামান খান – সাবেক গভর্ণর মোনায়েম খানের পুত্র, (৮) এস, আই কাজী আনোয়ার হোসেন, সাবেক ও, সি – মাগুরা থানা।

৭ ই জানুয়ারী ‘৭২ এর দৈনিক বাংলায় ২৭ জন দালাল গ্রেফতার করার খবর প্রকাশিত হয়। এখান থেকে কয়েকজনের নাম প্রকাশিত হলো –
(১) অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামী, শেরপুর, ময়মনসিংহ, (২) তাসলিমউদ্দিন আহমদ, সাবেক এস, ডি, ও, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, (৩)আব্দুল ওহাব উকিল, পি, ডি, বি ‘ র সেক্রেটারী, নোয়াখালী।

১৩ জানুয়ারী ‘৭২ এর দৈনিক বাংলায় ১২৮ জন দালাল গ্রেফতারের খবর প্রকাশিত তালিকা থেকে –
(১) এস, এম, সোলায়মান, চট্টগ্রাম রেলওয়ের সাবেক সিনিয়র পার্সোনেল অফিসার, (২) অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ, (৩) খন্দকার আব্দুল বারী – এস, আই, পুলিশ, বাকের গঞ্জ।

১৪ জানুয়ারী ‘৭২ এর দৈনিক বাংলায় ৩৭ জন দালাল গ্রেফতারের সংবাদ প্রকাশিত হয়। এখান থেকে কয়েকজনের নাম –
(১) সৈয়দ ইকবাল আহমেদ, ঢাকা রেডিওর সাবেক সহকারী আঞ্চলিক ডিরেক্টর, (২) এ, আর, এম ফজলুর রহমান – সাবেক ডেপুটি সেক্রেটারি, সিভিল এ্যাফেয়ার্স, বড় মগবাজার, ঢাকা, (৩) গোলাম রাব্বানী খান, রাজশাহী বেতারের সাবেক আঞ্চলিক ডিরেক্টর, (৫) মুজাফফর ইসলাম – সাবেক ও, সি, জয়দেবপুর, ঢাকা, (৬) এস, এম, রিজভী – সাবেক ও, সি কোতয়ালী, ময়মনসিংহ।

১৫ জানুয়ারী ‘৭২ এর দৈনিক বাংলায় ৩৮ জন রাজাকার দালাল গ্রেফতারের তালিকা থেকে –
(১) হাফিজুল ইসলাম, ডি, জি, এম ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ঢাকা, (২) নূর হোসেন (অবঃ) পুলিশ ইন্সপেক্টর, (৩) আলী হায়দার মোল্লা, পুলিশ ইন্সপেক্টর – বিশেষ ব্রাঞ্চ, (৪) ডঃ মোহর আলী, রীডার, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

গভর্ণর মোনায়েম খানের ভাগ্নের গ্রেফতারের খবর প্রকাশিত হয়। এতে লেখা হয়েছিলঃ ‘আওয়ামী লীগের সেচ্ছাসেবক বাহিনী গত বুধবার পাক হানাদারদের দালাল মনসুর রহমান তালুকদারকে গ্রেফতার করে রমনা থানায় সোপর্দ করেছে। মনসুর রহমান প্রাক্তন গভর্ণর মোনেম খাঁর ভাগ্নে বলে পরিচিত। উক্ত মনসুরের সহায়তায় পাক বাহিনী ময়মনসিংহের বহু গ্রাম ও ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং লুন্ঠন ও নারী নির্যাতন চালিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন শিক্ষকের গ্রেফতার

১৭ মে ‘৭২ – এর দৈনিক বাংলায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন শিক্ষকের পাক বাহিনীর দালালী সংক্রান্ত অভিযোগে গ্রেফতার হবার খবর প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়ঃ ‘হানাদার পাক বাহিনীর দালালী করার অভিযোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন শিক্ষককে সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত শিক্ষকরা হচ্ছেনঃ বানিজ্য বিভাগের প্রধান জনাব মকবুল আহমেদ, ভূগোল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আহমদ মোহাম্মদ প্যাটেল, অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোলায়মান মন্ডল, মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ওয়াসিম বারী বাঘী, আইন বিভাগের রীডার ডঃ গোলাম সাকলায়েন, একই বিভাগের অধ্যাপক আজিজুল হক ও শেখ আতাউর রহমান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়েছে।

নুরুল আমিন, হামিদুল হক, সবুর গং ফেরার ঘোষিত

১০ ফেব্রুয়ারী ‘৭২ এর দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় নুরুল আমিন, সবুর গংয়ের ফেরার ঘোষিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। এতে লেখা হয়ঃ ‘বিষয় সম্পত্তি ক্রোক – অধুনালুপ্ত কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাকে গতকাল সরকার ২২ শে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে স্ব স্ব এলাকায় মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির হতে বলেছে। তাদের নামে যে সব বিষয় – স্থাবর সম্পত্তি আছে তা এবং তাদের বেনামে বিষয় সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। ‘

ফেরার ঘোষিতদের তালিকাঃ (১) নুরুল আমিন, পিতা মরহুম জহীরুদ্দীন, সাকিন – আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টারস, ২০ নং ইস্কাটন রোড, রমনা থানা, জেলা – ঢাকা।
(২) হামিদুল হক চৌধুরী, পিতা – আক্কাস আলী চৌধুরী, গ্রাম – রামনগর, থানা – ফেনী, জেলা – নোয়াখালী,
নিরালা গার্ডেন, গ্রীন রোড, তেজগাঁ – ঢাকা।
(৩) খান, এ সবুর, পিতা – মরহুম নজমুল খান, সৈয়দ মহল্লা, থানা – ফকির হাট, জেলা – খুলনা, যশোর রোড, থানা – কোতোয়ালী, জেলা – খুলনা ও প্লট নং -২৮- ১, ধানমন্ডী আবাসিক এলাকা, রোড নং – ২৫।
(৪) মাহমুদ আলী, পিতা – মরহুম মুজাহিদ আলী, সুনামগঞ্জ শহর, থানা – সুনামগঞ্জ, সিলেট, ১৮০ ধানমন্ডী আবাসিক এলাকা, রোড নং -১৯, থানা – লালবাগ, ঢাকা।
(৫) ওয়াহিদুজ্জামান ওরফে ঠান্ডা মিয়া, পিতা – মরহুম আবদুল কাদের। গোপালগঞ্জ শহর, থানা – গোপালগঞ্জ, জেলা – ফরিদপুর। ১০/১ টয়েনবী সার্কুলার রোড, থানা – রমনা, জেলা – ঢাকা।
(৬) খাজা খয়েরুদ্দিন, পিতা – খাজা আলাউদ্দিন, ১৫ আহসান মঞ্জিল, থানা – কোতয়ালী, জেলা – ঢাকা।
(৭) কাজী আব্দুল কাদের, পিতা – কাজী এল আবেদউদ্দিন আহমদ। গ্রাম – সোয়ালমনি। থানা – জলঢাকা, জেলা – রংপুর। ৮ নং গুলশান, তেহগাঁও, জেলা – ঢাকা। ১১ নং হাটখোলা, সূত্রাপুর, ঢাকা।
(৮) রাজা ত্রিদিব রায়, পিতা – মৃত মীনাক্ষ রায়। রাজবাড়ী – রাঙ্গামাটি শহর, থানা – কোতোয়ালী, জেলা – পার্বত্য চট্টগ্রাম।
(৯) আউং শু প্রু, পিতা – সেই আউং প্রু। গ্রাম – বান্দরবান, থানা – বান্দরবান, জেলা – পার্বত্য চট্টগ্রাম।
(১০) অধ্যাপক গোলাম আজম, পিতা – মাওলানা গোলাম কিবরিয়া, গ্রাম – বীরনগর, থানা – নবীনগর, জেলা – কুমিল্লা। ৩৮ নং এলিফ্যান্ট রোড, রমনা, ঢাকা।
(১১) শাহ আজিজুর রহমান, পিতা – শাহ মোহাম্মদ সিদ্দিক, গ্রাম – থানাপাড়া, থানা – কোতয়ালী, জেলা – কুষ্টিয়া। ২২ ইস্কাটন রোড, রমনা, ঢাকা।
(১২) এ জব্বার খদ্দর, পিতা – আব্দুল হামিদ চৌকিদার। গ্রাম – গনক। থানা – সোনাগাজী, জেলা – ফেনী।

সবুর খানের গ্রেফতার

২৪ ফেব্রুয়ারী ‘৭২ এর দৈনিক বাংলায় কুখ্যাত দালাল সবুর খানের গ্রেফতারের খবর প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়ঃ ‘দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম বড় দালাল খান, এ, সবুর খানকে পুলিশ গত মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারী) ঢাকায় গ্রেফতার করে। খান সবুর তার প্রভুদের নির্দেশে খুলনা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার বাঙ্গালীকে হত্যা করার ব্যাপারে ব্যক্তিগত ভাবে পরিকল্পনা করার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে।

খান, এ, সবুর ছিল কুখ্যাত কায়ুম লীগের সেক্রেটারী জেনারেল। এ ছাড়াও পাকিস্তানী শাসকদের খুবই পেয়ারের লোক। তাই সরকারের বড় বড় পদেও আসীন থাকতো। ঘুণিত আইয়ুব খানের আমলে খান, এ, সবুর ছিল তথাকথিত জাতীয় দলের নেতা ও মন্ত্রী পরিষদের প্রবীণতম সদস্য। পাক সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী থাকাকালে তার বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ পাওয়া যায়। ‘

৫৪ জন দালালের সম্পত্তি ক্রোক

১৮ ফেব্রুয়ারী ‘৭২ এ দালাল অধ্যাদেশ ঘোষণা ও ১৯ মার্চ ‘৭২ এ ৭৩ টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পাক বাহিনীর দালালদের বিচার পর্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এবং বিচারের পদ্ধতি অনুসারে দালাল আইনে আটককৃত ব্যক্তিরা আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ লাভ করে নিজ নিজ উকিল নিয়োগের মাধ্যমে। বিচার পর্ব গণতান্ত্রিক ভাবে পরিচালনা করার জন্য এ ছাড়াও গ্রেফতারকৃতদের সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয় এবং বিচারের নিরপেক্ষতা ও সার্বজনীনতা বজায় রাখা হয়। দালালদের বিচারের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয় প্রচলিত পেনাল কোড এবং মানবতা ও মানুষের জান, মাল ও সম্মানহানীকর অপকর্মের বিরুদ্ধে গৃহীত প্রচলিত ব্যবস্থা অনুযায়ী। শাস্তির বিধানের মধ্যে ছিল মৃত্যুদণ্ড এবং বিভিন্ন মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ড। কারাদন্ডের ন্যুনতম সময়সীমা নির্ধারিত করা হয় তিন বৎসর। কেবল মাত্র নির্দিষ্ট অপরাধীকেই বিচার করা হয়েছিল। এখানে পাক বাহিনীর দালালদের বিচারের বিভিন্ন পর্যায়ের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে দেয়া হলঃ

বুদ্ধিজীবী ডঃ আজাদ হত্যা মামলার বিচারঃ ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড

ঢাকার উচ্চতর বিজ্ঞান ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডঃ এম, এ, কে আজাদ ১৫ ডিসেম্বর ‘৭১ এ আল বদর বাহিনীর হাতে শহীদ হন। ডঃ আজাদ হত্যার মামলার বিচার শুরু হয় জুন মাসে। ১৩ জুন ‘৭২ এর দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় ডঃ আজাদ হত্যা মামলার চার্জশিট প্রদানের রিপোর্টে লেখা হয়ঃ আল বদর বাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় ঢাকার উচ্চতর বিজ্ঞান ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডঃ এম এ কে আজাদ পি, এইচ, ডি হত্যা মামলায় গোয়েন্দা বিভাগ দুই জনের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যা ও দালাল অধ্যাদেশের কতিপয় ধারা মোতাবেক চার্জশীট দাখিল করেছে। অভিযোগের বিবরণে প্রকাশ, ঢাকার ইভিনিং পোস্ট পত্রিকার সম্পাদক জনাব হাবিবুল বাশার গত ২৪ শে জানুয়ারী লালবাগ থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করে উল্লেখ করেন যে, ১৯৭১ সালের ১৫ ই ডিসেম্বর সকাল সাড়ে আটটার সময় আল বদর বাহিনীর পাঁচজন লোক শাহসাহেব বাড়ীর জনৈক শাহ ওয়ালিউল্লাহ – এর পুত্র জুবায়ের – এর সাথে ডঃ আজাদের আজিমপুরের দায়রা শরীফস্ত বাড়ীতে হানা দেয় এবং ডঃ আজাদকে অপহরণ করে।

বাদী তার অভিযোগে আরও বলেন যে, তিনি আজাদের বড় ভাই এবং অপহরণের খবর পেয়ে তিনি বাড়ী ছুটে আসেন। ঘটনার সময় সেই বাড়ীতে তাদের ভাই আবুল খায়ের, জাকির হোসেন, বোন সালমা ও সেলিনা উপস্থিত ছিল এবং তাদের মাও ছিলেন। সেলিনা বাদীকে বলেন যে, একজন বদর বাহিনীর লোককে তিনি চিনতে পেরেছেন এবং দেখলে শনাক্ত করতে পারবেন। বদর বাহিনীর লোকেরা মুখোশ পরে এসেছিল। জুবায়ের বাদীকে জানায় যে, ডঃ আজাদকে আজিমপুরের রাজাকার ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের বাড়ী নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান হাজী কাশেমের বাড়ীতে খোঁজ করে ডঃ আজাদকে না পাওয়ার পর লালবাগ থানায় যোগাযোগ করলে ও, সি সাহেব বলেন যে, ডঃ আজাদকে বদর বাহিনীর লোক ধরে নিয়ে গেছে এবং তাকে উদ্ধার করা তাদের পক্ষে সম্ভব না।

বাদী এজহারে বলেন যে, ১৭ ই ডিসেম্বর রায়ের বাজার ডোবা থেকে মিত্র বাহিনীর সহায়তায় ডঃ আজাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তার শরীরে এবং বুকে, মাথায় গুলির দাগ এবং বেয়নেটের খোঁচা ছিল। জনাব হাবিবুল বাশারের এজহার দাখিলের পর লালবাগ থানায় একটি মামলা রুজু করা হয়। ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ মামলাটি নিয়ে তদন্ত করে আসামী মকবুল হোসেন ও আয়ুব আলীর বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে উল্লেখ করেন যে ডঃ আজাদকে অপহরণ করার পর দুষ্কৃতকারীরা আজিমপুর মহল্লার কাজী মন্টু, কাজী মতিউর রহমান এবং ভুলু ওরফে বদরউদ্দীনকে অপহরণ করে এবং যে মাইক্রোবাসে ডঃ আজাদকে নিয়ে যাওয়া হয় সেই একই বাসে সবাইকে নিয়ে যায়। – আসামী মকবুল হোসেন ১৫ ই ডিসেম্বর অপরাধ সংগঠনের সময় যে কাল চশমা পরেছিল তাকে আটক করার সময়ও তার চোখে সেই কাল চশমা লাগানো ছিল। পুলিশ চশমাটি আটক করে। ‘

১২ জুন ‘৭২ এ চার্জশীট প্রদানের পর বিভিন্ন পর্যায়ে ডঃ আজাদ হত্যা মামলার সাক্ষ্য ও জেরা পর্ব চলে এবং পর্যায়ক্রমিক ভাবে বাদী ও বিবাদীদের সাক্ষ্য গৃহীত হয়। ৫ অক্টোবর ‘৭২ এই মামলার রায় প্রদান করা হয়। এ সম্পর্কে ৬ অক্টোবর ‘৭২ এর দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্টে লেখা হয়ঃ ‘গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সদস্য সৈয়দ সিরাজুদ্দিন আহমদ অংকশাস্ত্রের প্রখ্যাত পন্ডিত ডঃ আজাদকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মকবুল, আয়ুব আলী ও জুবায়েরকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়াছেন।

এই তিনজন যুবককে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩০২ ধারা এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের ২ (খ) অনুচ্ছেদ বলে দন্ডিত করা হইয়াছে।

আসামী জুবায়ের ওরফে আহমদউল্লাহ আজিমপুর শাহ সাহেব বাড়ীর ছেলে ও ডঃ আজাদের ভাড়াটে বাড়ির অন্যতম মালিক। অপর দুইজন আসামী ময়মনসিংহের লোক। – প্রকাশ দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার আগের দিন অর্থাৎ ১৫ ই ডিসেম্বর সকাল ৮ টার সময় খাকী পোশাক পরিহিত ৫ জন আল বদরের লোক ডঃ আজাদকে তাহার ৪৪ নং আজিমপুরের বাসা হইতে বলপূর্বক অপহরণ করে। ডঃ আজাদের মা, ভাইবোন ও অন্যান্য লোক ডঃ আজাদকে অপহরণ করার সময় উপস্থিত ছিলেন এবং আসামী জুবায়ের আল বদর সদস্যদিগকে ডঃ আজাদের বাসা দেখাইয়া দিয়াছিল। ডঃ আজাদকে বলপূর্বক নেওয়ার সময় তাহার মা ও বোন বাঁধা দিতে গেলে তাহাদেরকে দুষ্কৃতকারীরা ধাক্কা দিয়া সরাইয়া দেয়৷ দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার দুইদিন পর রায়ের বাজারের একটি গর্ত হইতে ডঃ আজাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। – সরকার পক্ষে স্পেশাল পি, পি আব্দুর রাজ্জাক খান ও আসামী জুবায়ের, মকবুল ও আইয়ুব আলীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন যথাক্রমে মেসার্স মোঃ আজম, জোয়ারদার, ফয়জুদ্দিন ভুঁইয়া। ‘

শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যা মামলাঃ খালেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যা মামলাটির চার্জশীট প্রদান করা হয় ১৯ মে ‘৭২ এবং এর রায় প্রদান করা হয় ১৮ জুলাই। ২০ মে ‘৭২ এর দৈনিক বাংলায় শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যা মামলার চার্জশিট প্রদান সম্পর্কিত রিপোর্টে লেখা হয়ঃ ‘গতকাল ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে শহীদুল্লাহ কায়সার অপহরণ ও হত্যা মামলান শুনানী ১৯ শে জুন পর্যন্ত মুলতবী রাখেন। এই মামলায় বর্তমানে বিলুপ্ত জামাতে ইসলামীর ঢাকা শহর শাখার সেক্রেটারী আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩৬৪ ধারা মোতাবেক চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার মধ্যে জনাব শহীদুল্লাহ কায়সারের অপহরণ ও হত্যা মামলার শুনানী সর্বপ্রথম দায়রা আদালতে শুরু হয়েছে। জনাব শহীদুল্লাহ কায়সার একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন এবং তিনি বর্তমানে নিখোঁজ জনাব জহির রায়হানের জ্যেষ্ঠ সহোদর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বক্ষণে পাক বাহিনীর দোসর আল বদর দুষ্কৃতকারীরা তাকে অপহরণ করে। এই হত্যা মামলার শুনানীর প্রথম দিন সম্পর্কে ৪ জুলাই ‘৭২ এর দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় প্রকাশিত রিপোর্টে লেখা হয়ঃ ‘গতকাল ৩ রা জুলাই ঢাকার পঞ্চম স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে স্পেশাল জজ জনাব এফ, রহমানের এজলাসে শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যা মামলার শুনানীর প্রথম দিনে বাদী পক্ষের একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা সমাপ্ত হয়।

নিহত শহীদুল্লাহ কায়সারের ভগ্নিপতি এবং এই মামলার অভিযোগ প্রদানকারী জনাব নাসির আহমদ তার সাক্ষ্য প্রদানকালে উল্লেখ করেন যে, জনাব শহীদুল্লাহ কায়সার মুক্তি সংগ্রামের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ও কর্মী ছিলেন। গত সালের ১৪ ই ডিসেম্বর সন্ধার পর সাত আটজন লোক তাদের কায়েতটুলির বাসভবনে দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করে। তাদের কাছে স্টেনগান, রাইফেল ও রিভলভার ছিল। তাদের পরনে ছাই রঙের পোশাক ছিল। আমি তাদের আল বদর বাহিনীর লোক বলে বুঝতে পারি। তারা শহীদুল্লাহ কায়সারকে ধরে নিয়ে যায়। তার স্ত্রী পুত্র পথরোধ করে দাড়ালে তাদের স্টেনের বাট দিয়ে ধাক্কা দেয়া হয়। – দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে বহু বুদ্ধিজীবীর লাশ পাওয়া যায় কিন্তু তার লাশ পাওয়া যায় নি। পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেব বলেন যে, আসামী খালেক ঘটনার দিন শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজ করছিল এবং আসামী একজন জামাত কর্মী এবং আল বদর বাহিনীর লোক।

বাদী আসামীকে কাঠগড়ায় সনাক্ত করে বলেন যে, তিনি ও মামলার অপর সাক্ষী জাকারিয়া হাবিব আসামীর বাড়ী যান। তার বাড়ী তল্লাশী করা হয় এবং মিলিটারীর সাথে যোগাযোগ সম্বলিত কিছু কাগজপত্র ও কয়েকটি ফটো উদ্ধার করেন। – প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যা মামলার দায়ে গোয়েন্দা পুলিশ ঢাকা শহর জামাতে ইসলামীর আব্দুল খালেক মজুমদারের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩৬৪ ধারা ও দালাল আদেশের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের ‘খ’ ধারা মোতাবেক চার্জশীট দাখিল করেছে।’

১৮ জুলাই ‘৭২ এর দৈনিক বাংলায় শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যা মামলার রায়ের রিপোর্টটি প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়। এতে লেখা হয়ঃ গতকাল ১৭ ই জুলাই ঢাকার পঞ্চম স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল পাক দখলদার বাহিনীর দোসর আল বদর বাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী নিধন মামলায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যা মামলার রায় প্রদান করে। বেআইনী জামাতে ইসলামীর বেতনভূক দফতর সম্পাদক এ, বি, এম আব্দুল খালেককে দোষী সাব্যস্ত করে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও দশ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দান করেন। মাননীয় স্পেশাল জজ জনাব এফ, রহমান আসামীকে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১৬৪ নং ধারা ও দালাল আদেশের দ্বিতীয় তফসীলের কতিপয় অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করে দন্ড প্রদান করে বলেন যে, আসামী হত্যা করার অভিপ্রায়ে পাক বাহিনীর দালাল হিসেবে শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরণ করে।’

গভর্ণর ডাঃ মালেকের বিচার ৭ অক্টোবর ‘৭২ এ দখলদার আমলের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শেষ গভর্ণর ডাঃ আব্দুল মোতালিব মালেকের বিচার শুরু হয়। সেদিন তাকে কোর্টে হাজির করা হয়। ৮ অক্টোবর ‘৭২ এর দৈনিক ইত্তেফাকে এ সম্পর্কিত রিপোর্টে লেখা হয়ঃ ‘বাংলাদেশে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় ইয়াহিয়া – টিক্কা – নিয়াজীর তদানীন্তন গভর্ণর দালাল আইনে আটক ডাঃ আবদুল মোতালিব মালেককে বিচারের জন্য গতকাল সকালে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তারার হাজিরার পর আসামীর আবেদনক্রমে মামলার শুনানি মুলতুবী রাখা হয় এবং আগামী ১৩ ই নভেম্বর মামলার শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়। ঢাকার দায়রা জজ আদালতে অনুষ্ঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালের এই অধিবেশনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান জনাব এ, এইচ, চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন। – ডাঃ মালেকের মামলার মুলতবী ঘোষণার পর একই ট্রাইব্যুনালে ডাঃ মালেক মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য সাবেক তথ্য ও বেতার মন্ত্রী কুমিল্লার জনাব মুজিবুর রহমানকেও হাজির করা হয়। – প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ডাঃ মালেককে ঢাকার দায়রা জজকোর্টে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সম্মুখে হাজির করা উপলক্ষে আদালত এলাকা লোকে লোকারণ্য হইয়া উঠে। – সরকার পক্ষ হইতে তাহার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সরকার ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও দখলীকৃত বাংলাদেশে গণহত্যা, গৃহদাহ এবং নারী নির্যাতনের ব্যাপারে দখলদার বাহিনীর সহিত সহযোগিতা করার অভিযোগ উথ্বাপন করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হইতে ঢাকার সি, আই, ডি পুলিশের ইন্সপেক্টর জনাব আব্দুর রাজ্জাক গত ৩১-৩-৭২ তারিখে এই মামলা দায়ের করেন। অভিযোগে বলা হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চের পর হইতে দখলদার বাহিনীর আমলে ডাঃ মালেক বাংলাদেশের নিরস্ত্র ও অসহায় মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র বাঙ্গালীকে হত্যা, বাড়ীঘর পোড়াইয়া দেওয়া এবং গণহত্যার ব্যাপারে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর সহিত সহযোগিতা করেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দালাল আইনের ১১ (ক) আর্টিকেলের ১২১ এবং ১২৯ (ক) ধারামতে তাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ উথ্বাপন করা হইয়াছে। ‘ পর্যায়ক্রমিক সাক্ষ্য গ্রহণ ও সওয়াল জবাব শেষে ২০ নভেম্বর ‘৭২ এ ডাঃ মালেকের বিচারের রায় প্রদান করা হয়। ২১ নভেম্বর ‘৭২ এ দৈনিক ইত্তেফাকে গভর্ণর মালেকের বিচারের রায় সম্পর্কিত রিপোর্টে লেখা হয়ঃ ‘গতকাল (সোমবার) ঢাকার এক নম্বর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর আমলে বাংলাদেশে জঙ্গী ইয়াহিয়া শাহীর সর্বশেষ গভর্ণর ডাঃ আবদুল মোতালিব মালেককে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, গণহত্যা, নারী নির্যাতন, গৃহদাহ, লুটতরাজ চালানো এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম বানচাল করিয়া দেওয়ার ব্যাপারে দখলদার পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর সহিত সরাসরি সহযোগিতা করার দায়ে অভিযুক্ত এবং বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১২১ ধারা মতে তাহাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করিয়াছেন৷

গতকাল বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারক আব্দুল হান্নান চৌধুরী রায় দান প্রসঙ্গে বলেন যে, ডাঃ এ, এম, মালেকের বয়স ৭০ বৎসর। তাহার এই বার্ধক্য এবং তদুপরি অতীতে তাহার রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে তাহাকে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১২১ ধারামতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হইল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে মাননীয় বিচারক তাহাকে দোষী সাব্যস্ত এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দান করিয়া রায় ঘোষণার সময় দখলদার আমলে বাংলাদেশে জঙ্গী ইয়াহিয়ার সর্বশেষ তাবেদার গভর্ণর ডাঃ এ, এম মালেকের মুখে ম্লান হাসি পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু তাহার চক্ষু দুইটি অশ্রু সজল হইয়া উঠে। ইহা ছাড়া মাননীয় বিচারক সুদীর্ঘ সাড়ে ৩ ঘন্টাব্যাপী তাহার লিখিত ২১ পৃষ্ঠার রায় পাঠ করিয়া শোনাইবার সময় আসামীর কাঠগড়ায় কড়া পুলিশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় উপবিষ্ট ডাঃ মালেককে সর্বক্ষণই খুবই বিষন্ন দেখাইতেছিল। – মাননীয় বিচারক তাহার রায়ে বলেন যে, বাংলাদেশ দালাল অর্ডার (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) ১৯৭২ এর ১২১ এবং ১২৪ (ক) ধারানুযায়ী বর্ণিত সকল অভিযোগে ডাঃ মালেক দোষী সাব্যস্ত হইয়াছেন। তাই তাহাকে ১২১ দন্ডবিধির মতে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হইল। ১ নং তফসিলে বর্ণিত ১২৪ (ক) দন্ডবিধি অথবা দালাল আইনের ৪ (খ) ধারা অনুযায়ী তাহাকে পৃথক কোন দন্ড প্রদান করিলাম না। – মাননীয় বিচারক তাহার রায়ে আরও বলেন, মৌখিক প্রামাণ্য সাক্ষ্য হইতে ইহা সুস্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ হইতে দখলদার পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতেছিল এবং অভিযুক্ত ডাঃ এ এম মালেক গভর্ণরের পদ গ্রহণ করিয়া দখলদার বাহিনীকে সরাসরি ভাবে সাহায্য করিয়াছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষ হইতে মত প্রকাশ করা হইয়াছে যে, বাংলাদেশের জনসাধারণের কল্যাণের জন্য তিনি এই পদ গ্রহণ করিয়াছিলেন কিন্তু তিনি জনগণের কল্যাণ করিয়াছেন এমন কোন প্রমাণ এই মামলায় উপস্থাপন করা হয় নাই। পক্ষান্তরে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ হইতে ইহা সুস্পষ্ট ভাবে পরিলক্ষিত হয় যে, তিনি বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীকে ধ্বংস করার ব্যাপারে দখলদার বাহিনীর হস্ত শক্তিশালী করার জন্য জনসাধারণকে উস্কানী দিয়াছিলেন। – উল্লেখযোগ্য যে, এই মামলায় সরকার পক্ষের মোট ২৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। – এই মামলায় সরকার পক্ষে ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধ অপরাধী মামলার প্রধান কৌসুলী খোন্দকার মাহবুব হোসেন এবং আব্দুর রাজ্জাক। বিবাদী পক্ষে ছিলেন মেসার্স আতাউর রহমান খান, খান বাহাদুর নাজিরউদ্দিন আহমদ, আমজাদ আলী, মনসুরুর রহমান, হাবিবুর রহমান এবং কাজী সাহাদত হোসেন। ‘

জামাত নেতা মওলানা এ, কে, এম ইউসুফের বিচারঃ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

৫ অক্টোবর ‘৭২ – এ দৈনিক ইত্তেফাকে মওলানা ইউসুফের বিচার পর্বের সূচনার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে লেখা হয়ঃ ‘গত মঙ্গলবার ৩ অক্টোবর ‘৭২ সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব মন্ত্রী জনাব মওলানা এ, কে, এম, ইউসুফকে এক নম্বর স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের জজ জনাব আব্দুল হান্নান চৌধুরীর কোর্টে হাজির করা হয়। আসামী মওলানা ইউসুফ ১৯৭১ সালের ১৭ ই সেপ্টেম্বর সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ডাঃ মালেক পরিষদে রাজস্ব মন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেন। তাহার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতামূলক কার্যকলাপের অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রকাশ, আসামী ১৯৭১ সালের তথাকথিত উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়া দখলদার বাহিনীর দালালী করেন। ইয়াহিয়ার পুতুল সরকারকে বাংলাদেশে টিকাইয়া রাখার জন্য তিনি নানাস্থানে সভা করিয়া মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের খতম করিয়া পাক বাহিনী, রাজাকার ও বদর বাহিনীকে সহযোগিতা করার আবেদন জানান। ‘

১৬ ডিসেম্বর ‘৭২ এর দৈনিক ইত্তেফাকে শেষ পাতায় মওলানা ইউসুফের বিচারের রায় সম্পর্কিত রিপোর্টে লেখা হয়ঃ ‘গতকাল (শুক্রবার) ঢাকার তিন নম্বর স্পেশাল জজ মিঃ এস, বি, বড়ুয়া বেআইনী ঘোষিত জামাতে ইসলামী নেতা ও ডাঃ মালেক মন্ত্রী পরিষদের সাবেক রাজস্ব মন্ত্রী মওলানা এ, কে, এম ইউসুফকে দখলদার বাহিনীর সহিত সহযোগিতার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করিয়াছেন। ‘

দখলদার আমলের মন্ত্রী জসিমউদ্দিনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

২৬ নভেম্বর ‘৭২ এর দৈনিক ইত্তেফাকে মন্ত্রী জসিমউদ্দিনের বিচারের রায় সম্পর্কিত রিপোর্টে লেখা হয়ঃ ‘গতকাল (শনিবার) ঢাকায় দুই নম্বর বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক সৈয়দ সিরাজুদ্দিন আহমেদ ডাঃ মালেক মন্ত্রীসভার আইন ও পার্লামেন্ট দফতরের মন্ত্রী জনাব জসিমউদ্দিন আহমদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করিয়াছেন। বিচারক তাহার রায়ে বলেন, অভিযুক্ত জনাব জসিমউদ্দিন আহমদ মনে প্রাণে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করিতেন। তিনি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, তা ছাড়া তিনি সিলেট বারের একজন সিনিয়র আইনজীবী। তাহার অতীত রাজনৈতিক কার্যকলাপের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া তাহার জীবন রক্ষা প্রয়োজন বিধায় আমি তাহাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করিলাম। প্রকাশ, পাকিস্তানের স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ চালানোর সময় তাহারা এই দেশের কিছু সংখ্যক লোকের সহায়তা চায়। আসামী এই দেশকে পাকিস্তানের শাসনাধীন রাখার জন্য বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য ও সহায়তা প্রদান করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের ক্ষেপাইয়া তুলিবার ও সেই সংগ্রামকে নস্যাৎ করিবার জন্য বিভিন্ন স্থানে সভা-সমিতি করিয়াছেন এবং বক্তৃতা দিয়া বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ঘৃণার সঞ্চার করেন। আসামী মন্ত্রীসভার বৈঠক করিয়া বাংলাদেশ সমর্থক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিবার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং রাজাকারের সংখ্যা ১০ লক্ষ্যে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেন। – বিচারক তাহার রায়ে উল্লেখ করেন সাক্ষ্য প্রমাণদৃষ্টে ইহাই প্রমাণ করে আসামী ইচ্ছাকৃতভাবে মালেক মন্ত্রী পরিষদে যোগদান করিয়া দখলদার বাহিনীকে সাহায্য করেন ও নানাস্থানে সভা-সমিতি করিয়া বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ঘৃণার সঞ্চার করেন।

রাজাকার চিকন আলীর মৃত্যুদণ্ড

কুষ্টিয়ার রাজাকার চিকন আলীর মৃত্যুদণ্ড ছিল দালালদের বিচারের রায়ের মধ্যে প্রদত্ত প্রথম মৃত্যুদণ্ডাদেশ। ১১ জুন ‘৭২ এর দৈনিক বাংলায় এ সম্পর্কিত রিপোর্টে লেখা হয়ঃ ‘কুষ্টিয়ার দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সদস্য শ্রী আর কে বিশ্বাস গত বৃহস্পতিবার রাজাকার চিকন আলীকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন। বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩০২ ধারা এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের ১১(ক) ধারা বলে চিকন আলীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দালাল আদেশের অধীনে এই প্রথম একজনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হলো। মামলার বিবরণে প্রকাশ, বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর শাসনামলে মীরপুর গ্রামের চিকন আলী রাজাকার তালিকাভুক্ত হয়। সে হত্যা, লুঠতরাজ, ঘর জ্বালানী এবং মেয়েদের মর্যাদা হানির কাজে অংশগ্রহণ করে। – ১৯৭১ সালের ১৯ শে অক্টোবর অভিযুক্ত চিকন আলী তার গ্রামের বাড়ীতে কামালউদ্দিন মন্ডল নামক এক ব্যক্তিকে বলে যে সে জনৈক ইয়াজউদ্দিনের বাড়ী থেকে দুলালী বেগমকে বের করে আনতে ইচ্ছুক। পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজকারদের হামলা থেকে রক্ষার জন্য আব্দুল গফুরের মেয়ে দুলালী বেগমকে ইয়াজউদ্দিনের বাড়ীতে রাখা হয়। এর পরই চিকন আলী ইয়াজউদ্দিনের বাড়িতে যায়। মেয়েটি তখন তার বাড়ীতেই ছিল। সে ইয়াজউদ্দিনের কাছে দুলালী বেগমকে দাবী করে। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন দুলালী বেগমকে দিতে অস্বীকার করায় চিকন আলী রাইফেলের সাহায্যে গুলি করে ইয়াজউদ্দিনকে হত্যা করে। ‘

রাজাকার চিকন আলী পরবর্তীতে হাইকোর্টে আপীলের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে রেহাই পেয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদকাল শেষে এখন নিজগ্রাম মিরপুরে বসবাস করছে।

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ডেপুটি স্পীকার আসগর হোসেনের বিচার

২০ ই জুন ‘৭২ এর দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় আসগর হোসেনের বিচার পর্বের সূচনা সংক্রান্ত রিপোর্টে লেখা হয়ঃ ‘গতকাল সোমবার দালালী মামলায় অভিযুক্ত সাবেক পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের ডেপুটি স্পীকার আসগর হোসেনের বিচার ঢাকার ৯ নম্বর স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে জনাব এম, খোরশেদের এজলাসে অনুষ্ঠিত হয়। অভিযুক্ত আসগর হোসেনের বিরুদ্ধে দালাল আদেশের কতিপয় ধারা মোতাবেক অভিযোগ এসে বাদীপক্ষের তরফ থেকে বলা হয় যে, প্রথমতঃ আসামী দখলদার পাক-বাহিনী কর্তৃক অনুষ্ঠিত ও নিয়ন্ত্রিত ১৯৭১ সালের উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দখলদার বাহিনীর অবৈধ দখল কায়েম রাখতে সাহায্য করেছে। দ্বিতীয়তঃ আসামী গত ১৯৭১ সালের ১৯ শে এপ্রিল খবরের কাগজে একটি বিবৃতি দিয়ে বলে সে পাক সেনাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলেিয়ে সংগ্রাম করতে হবে এবং পাকিস্তানের অখন্ডতা ও নিরাপত্তার জন্য শেষ রক্তবিন্দু দান করতে হবে।

পিডিবি নেতা নূরুল ইসলাম চৌধুরীর কারাদণ্ড

৫ জুলাই ‘৭২ এর দৈনিক বাংলার রিপোর্ট থেকেঃ ‘গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার দশম স্পেশাল জজ জনাব মাহমুদুল্লা একটি দালালী মামলার রায় প্রদান করে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের পিডিবি দলের সহ-সভাপতি নূরুল ইসলাম চৌধুরীকে দালাল আদেশের চতুর্থ অনুচ্ছেদের ‘খ’ ধারা মোতাবেক ২ মাস সশ্রম কারাদণ্ড ও ২ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ১ মাস কারাদণ্ড দান করেন। মামলার বিবরণে প্রকাশ আসামী নূরুল ইসলাম চৌধুরী পাক দখলদার আমলে উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এম, পি এ নির্বাচিত হন। বাদীপক্ষে এ সম্পর্কে তার বিরুদ্ধে দালাল আদেশ মোতাবেক অভিযোগ আনা হয়।

ফকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে চার্জশীট

৭ জুলাই ‘৭২ এর দৈনিক বাংলার রিপোর্ট থেকেঃ ‘পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর সাথে হত্যাযজ্ঞ, বিনাদোষে আটক প্রভৃতি কাজে সহযোগিতা করার দায়ে কনভেনশনাল মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে দালাল আদেশের বলে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ওয়াকিবহাল মহলসূত্রে জানা যায় যে, জনাব চৌধুরীর ২১ জন সহকর্মী এখনো আত্মগোপন করে রয়েছেন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!