দেশের উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করা হবে- বঙ্গবন্ধু
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৃহস্পতিবার ঘােষণা করেন যে, ঘূর্ণিঝড়ে গাের্কীর ধ্বংসযজ্ঞ রােধের জন্য উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করা হবে। বঙ্গবন্ধু সকালে বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বরগুনা, খেপুপাড়া, চর কুকরীমুকরী এবং চর ফ্যাশন পরিদর্শন করেন এবং এই সব এলাকার বিরাট গণসমাবেশে ভাষণদান করেন বলে জানা গেছে। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গত আরাে বলেন যে, প্রকৃতির রুদ্ররােষ প্রতিরােধের জন্য এখনাে কোনাে উপযুক্ত ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়নি। তবে আমরা এ ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতা রােধের জন্য বিভিন্ন নদী বরাবর বাঁধ নির্মাণ করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাপারে আরও বলেন যে, যেখানেই প্রয়ােজন এবং সম্ভব এবং সেই সব স্থানে বাঁধ নির্মাণের জন্য স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও কর্তৃপক্ষের উচিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে অর্থের কোনাে অভাব হবে না। তবে সবচেয়ে যেটা বড় প্রয়ােজন সেটা হলাে আপনাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। বঙ্গবন্ধু আরাে বেশি করে গাছ লাগানাের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে আপনাদের রক্ষা করবে সাহায্য করবে। প্রত্যেকের উচিত একটি করে গাছ লাগানাে, কারণ উপকূলীয় বাঁধ এলাকায় বন সৃষ্টি করা হলে ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলােচ্ছ্বাস থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব হবে।
শীতকালীন চাষাবাদের আহ্বান : বঙ্গবন্ধু ব্যাপকভাবে শীতকালীন চাষাবাদ শুরু করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এক খণ্ড জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না। দুর্গত এলাকায় শীতকালীন ফসল বৃদ্ধির জন্য পাওয়ার পাম্প, গভীর নলকূপ, বীজ ও সার সরবরাহের জন্য সবরকম ব্যবস্থার চেষ্টা হবে। প্রধানমন্ত্রী যেখানে বক্তৃতা করেছেন সেখানেই জনগণ কৃষি উৎপাদনে সহায়ক সাহায্য দেয়ার পক্ষে সুপারিশ করেছেন। তারা এই মর্মে নিশ্চয়তা দান করেছেন যে, পর্যাপ্ত কৃষি সাহায্য দেয়া হলে তারা শীতকালে খাদ্যশস্য ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে। প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে খাদ্যশস্যের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন যে, এই ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের খাদ্যশস্যের এক বিরাট অংশ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, খােদা চায় তাে আমরা এর চেয়ে বেশি খাদ্য শস্যের অধিকারী হবাে। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গত আরাে বলেন, জনগণ দুঃখ দুর্দশার মধ্যে কালাতিপাত করছে তা তিনি জানেন। তারা দু’মুঠো অন্ন ও পরার জন্য পর্যাপ্ত কাপড়ও পাচ্ছে না বলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু সরকার জনগণের এই দুঃখ-দৈন্য মােচনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। গত দু’বছর বন্ধু দেশগুলাের কাছ থেকে পাওয়া দুইশত কোটি টাকার সাহায্য যােগ্য দেশবাসীর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। ভিক্ষা করে কোনাে জাতিই বেশিদিন বাঁচতে পারে না বলে তিনি মন্তব্য প্রকাশ করেন। নিজ পায়ে দাঁড়ানাের জন্য আপনাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
দুর্নীতি প্রসঙ্গে : প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে আরাে বলেন যে, এক শ্রেণির লােক দুর্নীতি, দুষ্কৃতিকারী, ঘুষ এবং চোরাচালানী কাজে লিপ্ত রয়েছে। বার বার আবেদন নিবেদন সত্ত্বেও তারা নিজেদের সংশােধন না করে জনগণের দুঃখ দুদর্শার সুযােগ গ্রহণ করছে বলে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
ওদের নির্মূল করুন : তিনি এ সব দুর্নীতিপরায়ণ লােকদের বের করে চিরতরে নির্মূল করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এ সব সমাজ বিরােধীদের নির্মূল করা হলে জনগণের দুঃখ দুর্দশা অর্ধেক লাঘব হবে এবং দুর্নীতিপরায়ণ ও সমাজবিরােধীদের শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
সরকারি অফিসারদের প্রতি : প্রধানমন্ত্রী উৎসর্গকৃত মনােভাব নিয়ে জনগণের সেবা করার জন্য সরকারি কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি প্রসঙ্গত আরও বলেন যে, অফিসারদের মনে করা উচিত যে, তারা আর কোনাে বিদেশি শক্তির গােলাম নয়। তিনি ত্রাণ কাজে রেডক্রস কর্মীদের তৎপরতায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। ইতােমধ্যেই ত্রাণ দ্রব্য বিমানযােগে দুর্গত এলাকাসমূহে পাঠানাে হয়েছে এবং প্রয়ােজনে আরাে সাহায্য দেয়া হবে বলে তিনি ঘােষণা করেন। বঙ্গবন্ধু প্রকৃত দরকার যাদের তাদেরকে সাহায্য সামগ্রী দেয়ার জন্য সরকারি অফিসার ও নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান। কেউ সাহায্য দ্রব্য চুরি করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি ঘােষণা করেন।
চর ফ্যাশনে বক্তৃতা : বঙ্গবন্ধু চর ফ্যাশনে এক বিরাট জনসভায় ভাষণদান কালে বলেন যে, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ঔপনিবেশিক শাসকদের যাতাকলে পিষ্ট হয়েছি। আমরা শােষিত হয়েছি, তাই জানি অত্যাচারিতদের দুঃখ দুর্দশা কী? তিনি ঘােষণা করেন যে, আমরা আরব দেশগুলাের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দান করেছি। বাংলাদেশ সিরিয়ায় মেডিকেল টিম প্রেরণ করেছে এবং প্রয়ােজনে আরব ভাইদেরকে বৈষয়িক সাহায্য দেয়া হবে।
বঙ্গবন্ধুর ঢাকা প্রত্যাবর্তন : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বরিশাল ও পটুয়াখালীর ঘূর্ণিবিধ্বস্ত এলাকায় ৬ ঘণ্টাব্যাপী এক ঝটিকা সফর শেষে অপরাহ্নে ঢাকায় ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারযােগে অত্যন্ত নিচু দিয়ে দুর্গত এলাকাসমূহের অবস্থা স্বচক্ষে দেখেন।৩৬
রেফারেন্স: ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭৩, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ