You dont have javascript enabled! Please enable it! 1948.03.21 | জাতীয় সংহতি সম্পর্কে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্য - সংগ্রামের নোটবুক

শিরোনামঃ জাতীয় সংহতি সম্পর্কে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্য

সুত্রঃ কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহঃ  স্পিচেস এ্যাজ গভর্নর জেনারেল অব পাকিস্তান- ১৯৪৭-১৯৪৮ পৃষ্ঠা-৮২

তারিখঃ ২১শে মার্চ, ১৯৪৮

জাতীয় সংহতি

ঢাকায় তিন লাখের অধিক জনতার সম্মেলনে ভাষণ

২১ মার্চ, ১৯৪৮

  আসসালাম-উ-আলাইকুম!  আসসালাম-উ-আলাইকুম!! আসসালাম-উ-আলাইকুম!!!

প্রদেশের সব জনতা, অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান, ঢাকার বাসিন্দা সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ এই উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য। পূর্ব পাকিস্তানে আসাটা আমার জন্য কতটা আনন্দের তা আর বলার প্রয়োজন রাখেনা। পূর্ব বাংলা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা যা পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমি এখানে আসার জন্য উদগ্রীব ছিলাম, কিন্তু দুঃখজনক হল অন্যান্য ব্যস্ততার কারনে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করা হয়ে ওঠেনি।

এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যপারের কিছু কিছু আপনারা অবশ্যই জানেন। আপনারা জানেন, ভাগের পর পরই পাঞ্জাবে প্লাবন হানে যার ফলে যে মুসলিমরা তাদের ঘরবাড়ি পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লী এবং প্রতিবেশী যে জেলা সমূহে সরিয়ে নেয় পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের নিরাপত্তা, আশ্রয়, খাদ্য এবং পুনর্বাসনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। নতুন গড়ে ওঠা কোন প্রদেশে এমন মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হবার ঘটনা ইতিহাসে নেই। এমনকি ইতিহাসে কোন নতুন প্রদেশের এমন ধৈর্য ও সাহসের সাথে তা মোকাবেলার ঘটনাও নেই। আমাদের শত্রুরা পাকিস্তানকে এর উত্থানের সাথেই খতম করতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান আগের থেকেও শক্তিধর হয়ে তা জয়যুক্ত করে। পাকিস্তান যার জন্য সৃষ্টি হয়েছে তা ই করে দেখিয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে।

   আপনাদের স্বাগত বক্তব্যে আপনারা এই প্রদেশের কৃষি এবং শিল্পখাতের উন্নয়ন, প্রদেশের তরুন-তরুণীদের পাকিস্তানি আর্মিতে প্রশিক্ষণের সুবিধা প্রদান, চিটাগাং বন্দরের উন্নয়ন এবং পাকিস্তানের অন্যান্য অংশের সাথে প্রদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, শিক্ষাগত সুবিধা এবং ফাইনালি সরকারের সব ধরনের কাজে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের বকেয়া এবং বৈধ ভাগ নিশ্চিত করার ব্যপারে জোর দিয়েছেন। আপনাদের আশ্বস্ত করছি, আমার সরকার আপনাদের সব দাবিকে গুরুত্ত্বের সাথে নিয়েছে এবং সর্বোচ্চ গতিতে পূর্ব পাকিস্তানকে এর উচ্চতায় নেয়ার ব্যপারে উৎকণ্ঠিত। এই প্রদেশের সামরিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ইতিহাস সাক্ষী হবে। ইতিমধ্যেই সরকার তরুন-তরুণীদের পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্যে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে। আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন, প্রদেশের সব তরুণদের প্রতিরক্ষক হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

এবার প্রাদেশিক অন্যান্য সাধারণ ব্যপারে আসা যাক। সেক্ষেত্রে প্রথমেই আপনাদের জনগন এবং সরকারকে অভ্যর্থনা জানাই এই কষ্টকর সাত মাস যেভাবে মোকাবেলা করেছেন। বিভাগের পর আপনাদের সরকার যে নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সকল সমস্যা ও দ্বন্দের মোকাবেলা করে প্রশাসনকে সমৃদ্ধ করেছে তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। ১৫ই আগস্টের পর প্রাদেশিক সরকার ঢাকায় এর নিজের ঘরেই পালাতক ছিল বলা যায়। বিভাগের আগে যা ছিল ছোট একটা মফস্বল শহর তার পক্ষে হাজারো সরকারী কর্মীদের তাৎক্ষনিক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা কষ্টকর ছিল। বিভাগের পর ভারত থেকে বিতাড়িত সত্তর হাজার রেলওয়ে ও অন্যান্য কর্মীদের পরিবার সহ এখানে যোগ হওয়ায় সরকার কঠিন প্রশাসনিক সমস্যায় পড়ে। তাছাড়া হিন্দুদের প্রস্থানের সাথে সাথে তাদের মালিকাধিন প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা অসংগঠিত হয়ে পড়ে। এইসব সমস্যার সমাধানের জন্য এবং আসন্ন প্রশাসনিক ভাঙ্গন রোধে সরকার তাৎক্ষনিক ভাবে প্রশাসন পুনর্গঠন এবং এর বাহিনীকে নতুন করে গঠন করে।

 সরকার অত্যন্ত দ্রুত ও দক্ষতার সাথে এসব করেছে। প্রশাসন ও সাম্প্রদায়িক জীবন শান্তিপূর্ণ ভাবে চলতে শুরু করে। দ্রুত প্রশাসনিক পুনর্গঠনই শুধু নয় অন্যান্য অভাবও কাঁটিয়ে ওঠে যা প্রদেশের শান্তির সাথে আসন্ন দুর্ভিক্ষ কাঁটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন ছিল। পরের কৃতজ্ঞতা এখানের জনগনের প্রতি বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে যারা বিভাগের পরবর্তী মাস জুড়ে মুসলিমদের উপর ভারতীয় রাজত্ব, গনহত্যা ও নিপীড়নের পরেও দৃষ্টান্তমূলক শান্ত থেকেছে ও শান্তি বজায় রাখাতে একাগ্র থেকেছে। এইসব ভয়ংকর ঘটনার পরেও গত পূজায় প্রায় চল্লিশ হাজারের মত হিন্দুরা এই প্রদেশে মিছিল করে, যেখানে এখানকার মুসলিমরা শান্তি ভঙ্গ করেনি এবং বিরক্তিও প্রকাশ করেনি।

  যে কোন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক আমার সাথে একমত হবেন, পাকিস্তান যেভাবে সংখ্যালঘুদের দেখাশোনা ও আশ্রয় দিয়েছে তা ভারতের কোথাও দেয়া হয়নি। আপনারা একমত হবেন যে পাকিস্তান আইন শৃঙ্খলার মাধ্যমে শান্তি বজায় রাখতে সক্ষম; এবং বলে রাখি শুধু ঢাকাতেই নয়, পাকিস্তানের সবখানেই সংখ্যালঘুরা অন্য সব জায়গা থেকে নিরাপদ। আমরা এটা স্পষ্ট করেছি যে পাকিস্তানী সরকার শান্তি বিঘ্নিত হতে দেবেনা; পাকিস্তান যে কোন মুল্যেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করবে; কোন প্রকার হাঙ্গামা প্রশ্রয় দেবেনা। কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া জরুরি যথা, একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে, যাতে আসন্ন দুর্ভিক্ষ এড়িয়ে প্রদেশের চার কোটি মানুষের খাদ্য সরবরাহ ঠিক রাখা যায়, যে কোন খাদ্য ঘাটতি ও প্রশাসনিক অসুবিধা দূর করা যায়, এবং শান্তি বজায়ে রাখা যায় কারন সরকারের এই সব অর্জনকে অগ্রাহ্য করার করার এবং এসবের অনুমোদন দেয়ার প্রবণতা রয়েছে।

 সমালোচনা করা সবসময় সহজ; ভুল ধরাও সহজ, কিন্তু মানুষ ভুলে যায় তাদের জন্য কি করা হয়েছে এবং কি করা হবে, এবং স্বভাবতই পাকিস্তান জন্মের সময় আমাদের যে দুখ, ক্লেশ, সমস্যা ও বিপদের মোকাবেলা করতে হয়েছে তারা তা অনুধাবনই করবে না। আপনাদের প্রশাসন নির্ভুল তা আমি মনে করিনা; এর সাথে আমি এও বলি নাই যে উন্নতির কোন সুযোগ নেই; আমি বলি নাই যে সত্যিকারের পাস্তানিদের সৎ সমালোচনা গ্রহন করা হবেনা। সবসময়ই স্বাগতম। কিন্তু কাওকে যখন সরকার ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তা ও কর্মীদের দিনরাত ধরে আপনাদের জন্য করে যাওয়া কাজ অস্বীকার করে শুধু অভিযোগ ও ভুল ধরতে দেখি, তা স্বাভাবিকই আমাকে কষ্ট দেয়। কমপক্ষে ভাল কাজের জন্য কিছু ভাল কথা বলে পড়ে অভিযোগ এবং সমালোচনা করুন। বড় প্রশাসনে ভুল হবেই, নির্ভুল আশা করা যায়না; পৃথিবীর কোন দেশেই তা সম্ভব না। আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষা হল এটাকে যতটা সম্ভব কম করা যায়। আমাদের ইচ্ছা এটাকে কতটা পর্যাপ্ত, উপকারী ও কর্মোপযোগী করে তোলা যায়। কিসের জন্য? সরকার এর থেকে কি পাবে? সরকারের একটাই উদ্দেশ্য- কিভাবে জনগনের সেবা করা যায়, কিসে তাদের কল্যান হয়, কিসে তাদের আরো ভাল হয়। সরকারের আর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে, এখন এটা আপনাদের হাতে সরকারের হাতে ক্ষমতা দেবেন নাকি সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাবেন কিন্তু অবশ্যই কোন হাঙ্গামা করবেন না। আপনাদের ক্ষমতা আছে, এর ব্যবহার জানতে হবে; আপনাদের এর কলকব্জা বুঝতে হবে। সাংবিধানিকভাবে, আপনারা অসন্তুষ্ট হলে এক সরকারের বদলে অন্য সরকারকে ক্ষমতায় আনতে পারেন।

 অতএব, পুরোটাই আপনাদের হাতে, কিন্তু আপনাদের প্রতি আমার উপদেশ হচ্ছে ধৈর্য ধরুন এবং তাদের সমর্থন দিন যারা সরকারের হাল ধরে আছে, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন, তাদের অসুবিধা ও সমস্যা বোঝার চেষ্টা করুন যেমনটা তাদেরও উচিত আপনাদের ক্ষোভ, অভিযোগ এবং ভোগান্তি বোঝার চেষ্টা করা। এই পারস্পরিক সহযোগিতা, উদ্যম এবং সুনাম পাকিস্তানকে শুধু রক্ষাই করবেনা, পৃথিবীর মধ্যে একটি একটি মহান রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবে। আপনারা কি এখন এই অর্জিত পাকিস্তানকে আপনাদের মূর্খতার জন্য ধ্বংস করবেন? আপনারা কি এর ভাল চান না? সেইক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে- নিজেদের মধ্যে একতা ও সংহতি গড়ে তুলুন।

  কিন্তু আমি আপনাদের বলতে চাই, আমাদের মধ্যে কিছু লোক বিদেশী সংস্থার অর্থায়নে ভাঙ্গন সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তাদের উদ্দেশ্য পাকিস্তানের ভাঙ্গন এবং অনিষ্টসাধন। আমি চাই আপনারা সুরক্ষিত থাকুন, সজাগ থাকুন এবং কোন শ্লোগান ও বাঁধা বুলিতে আকৃষ্ট হবেন না। তারা বলছে পাকিস্তানী সরকার এবং পূর্ব বাংলা সরকার আপনাদের ভাষা নষ্ট করবে। এর থেকে বড় মিথ্যাচার কোন মানুষের থেকে এখন পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি। অনেকটা সরাসরি ও খোলামেলা ভাবে আপনাদের বলছি, আপনাদের মধ্যে কিছু কম্যুনিস্ট ও বিদেশী সাহায্যের প্রতিনিধির ব্যপারে যদি সাবধান না থাকেন তাহলে আপনারা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবেন। পূর্ব বাংলাকে ভারতীয় ইউনিয়নে ফিরিয়ে নেয়ার ধারনা এখনো তাদের ছাড়েনি, এবং এটাই তাদের উদ্দেশ্য। আমি নিশ্চিত- আমি ভীত নই কিন্তু সতর্ক থাকা জরুরী- যারা ভারতীয় ইউনিয়নে পূর্ব বাংলাকে ফিরিয়ে নেবার চিন্তা করছে তারা স্বপ্নরাজ্যের বাসিন্দা। 

 আমাকে বলা হয়েছে কিছু হিন্দু সম্প্রদায় দলবদ্ধ হয়ে এই প্রদেশ ছেড়েছে। এই প্রস্থানে ভারতীয় পত্রিকায় দারুন প্রভাব পড়েছে এবং সংখ্যা প্রায় লাখের কাছাকাছি। সরকারি হিসেবে এই সংখ্যা দুই লাখের উপর ছাড়িয়েছে। সেক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের সাথে কোন দুর্ব্যবহার না করে এদের প্রস্থানে আমি খুশি হয়েছি। অন্যদিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বৃহত্তর স্বাধীনতা উপভোগ করছে এবং ভারতীয় অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রভুত্ব থেকে নিজেদের কল্যাণের ব্যাপারে তারা উৎকণ্ঠিত।

   এই দেশান্তরের কারন হিসেবে ভারতীয় রাজ্যে যুদ্ধনেতাদের পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে অবশ্যসম্ভাবি যুদ্ধের আভাষ পাওয়া যাচ্ছে; ভারতের কিছু প্রদেশে সংখ্যালঘুদের সাথে দুর্ব্যবহার ও ভয় সৃষ্টির প্রতিক্রিয়া হিসেবে এখানেও তাই করা হচ্ছে, এবং ভারতীয় পত্রিকার একটা অংশে হিন্দুদের এই প্রদেশ ছাড়ার জন্য খোলাখুলি ভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে, যা পাকিস্তানী সংখ্যালঘুদের মধ্যে হিন্দু মহাসভা দ্বারা কাল্পনিক এক দুর্দশার আহ্বান করছে। সংখ্যালঘুদের সাথে দুর্ব্যবহারের এই অভিযোগ এবং প্রচারণা মানে, বার মিলিয়নেরও বেশি অমুসলিম যারা এই প্রদেশে শান্তির সাথে বাস করছে এবং এখান থেকে চলে যাওয়াকে অস্বীকার করেছে  তাদের সাথে মিথ্যাচার করা।

   যা বলেছি তা আমাকে পুনরায় বলার সুযোগ দিনঃ আমরা পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের সাথে নিরপেক্ষ ও যথাযথ আচরন করবো। পাকিস্তানে তাদের জীবন ও সম্পত্তি ভারত থেকে সুরক্ষিত এবং আমরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আইন শৃঙ্খলা ও শান্তি বজায়ে রেখে সকলকে রক্ষা ও হেফাজত করবো।

 এই পর্যন্ত ঠিক আছে। এবার প্রদেশের কিছু অসন্তোষজনক ব্যাপারে আসা যাক। এখানকার অমুসলিমদের বিপক্ষে আমি যা বলেছি তা কিছু নির্দিষ্ট ভাবনা মাত্র। ইদানিং এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তান ও এই প্রদেশের ভাষা বাংলা হবে নাকি উর্দু হবে এই নিয়ে। আমি শুনেছি কিছু রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধানীরা ঢাকায় ছাত্র সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোর চেষ্টা চালিয়ে প্রশাসনকে অস্বস্তিতে ফেলছে।

  আমার তরুন বন্ধুরা যারা এখানে উপস্থিত আছেন তাদের বলছি, আপনাদের প্রতি যার সবসময়য়ই মায়া ভালবাসা রয়েছে, যে আপনাকে দশ বছর ধরে বিশ্বাস ও ভরসার সাথে দেখে আসছে, আমি সতর্ক করছি- যদি কোন রাজনৈতিক দলের স্বীকার হন তবে সেটা হবে সবচেয়ে বড় ভুল। মনে রাখবেন একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। এটা আমাদের নিজস্ব সরকার। আমরা মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি। আমাদের আচরন ও সম্পর্ক হবে মুক্তঃ বিদেশী শাসন আমাদের আর দমন ও নিপীড়ন করতে পারবেনা; আমরা সেই শৃঙ্খল ও হাতকড়া ভেঙ্গেছি। আমার তরুন বন্ধুরা, আপনারাই পাকিস্তানকে প্রস্তুত করবেন, ধ্বংস ও বিপথে যেতে দেবেন না। আপনাদের মধ্যে পরিপূর্ণ একতা ও সংহতি গড়ে তুলুন। দেখিয়ে দিন আপনারা কি করতে পারেন। আপনাদের বড় কাজ হচ্ছে নিজের কাছে সৎ থাকা, মা-বাবার কাছে সৎ থাকা, দেশের কাছে সৎ থাকা- পড়ালেখায় মনযোগী হওয়া। আপনারা যদি এখনি শক্তি অপচয় করেন, পরে পস্তাবেন। আপনাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট শেষ করে আপনারা স্বাধীন ভাবে নিজের ও দেশের কাজে লাগতে পারেন। পাকিস্তান এবং আপনার প্রদেশ এখনো বিপদে আছে সে ব্যপারে আপনাদের সতর্ক করছি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে, হতাশা ও ব্যর্থতার দায় নিয়ে পাকিস্তানের শত্রুদের এখন প্রধান মনোযোগ হচ্ছে পাকিস্তানের মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। এই প্রচেষ্টা প্রধানত প্রাদেশিকতাকে উৎসাহিত করছে।

যতদিন না পর্যন্ত রাজনীতি থেকে এই বিষ ঝেড়ে ফেলা হবে, আপনারা নিজেদের সংযুক্ত করতে পারবেন না, নিজেদের তৈরি করতে পারবেন না এবং নিজেদেরকে সত্যিকারের জাতি হিসেবে গঠন করতে পারবেন না। বাঙ্গালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, বালুচি, পাঠান ও অন্যান্য যে ভাষা আছে আমরা তাতে কথা বলতে চাইনা। এগুলো একেকটা কোর্স ইউনিট। কিন্তু আপনাদের কাছে জানতে চাই, ত্রিশ বছর আগে শেখানো বিদ্যা কি আপনারা ভুলে গিয়েছেন? যদি আমি বলি, এখানে সবাই বহিরাগত। বাংলার আসল বাসিন্দা কারা- যারা এখন বাস করছে তারা কি? তাহলে আমরা বাঙ্গালী, সিন্ধী, পাঠান বা পাঞ্জাবী এগুলো বলার অর্থ কি। এখন আমরা সবাই মুসলিম।

  ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, এবং আপনারা সবাই একমত হবেন যে আপনি যে ই হোন, আপনি একজন মুসলিম। আপনারা এখন একটি জাতির অন্তর্ভুক্ত, একটি এলাকা দ্বারা বেষ্টিত, একটি বিস্তীর্ণ এলাকা যা এখন আপনাদের; যা কোন পাঞ্জাবী, সিন্ধী, পাঠান বা বাঙ্গালীর নয়; এটা আপনাদের। যদি নিজেদের একটি জাতি হিসেবে গড়তে চান তাহলে ঈশ্বরের দোহাই, এই প্রাদেশিকতা ছাড়ুন। শিয়া, সুন্নি ইত্যাদি বিভক্তির মতোই প্রাদেশিকতা একটি অভিশাপ।

এতে আমাদের পূর্বসূরি সরকারের কোন উদ্বেগ ছিলোনা, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারন ছিলোনা; তারা শুধু এখানে প্রশাসন চালাত, আইন শৃঙ্খলা মেনে চলে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতো এবং যতটা সম্ভব ভারতে কাজে লাগাত। কিন্তু এখন আমরা সবাই আলাদা অবস্থায় আছি। আপনাদের একটা উদাহরণ দেই। ধরুন আমেরিকা। যখন তারা ব্রিটিশ শাসন ত্যাগ করে নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা দিল, তখন সেখানে কয়টি জাতি ছিল? অনেকেই ছিল- স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইটালিয়ান, ইংরেজ, ডাচ আরো অনেকে। যাই হোক, তারা ছিল। তাদের অনেক সমস্যাও ছিল। কিন্তু মনে করিয়ে দেই, তাদের অস্তিত্ব টিকে ছিল এবং তারা আসলেই মহান জাতি। যেখানে আপনাদের কিছুই নেই। আপনাদের এখন শুধু পাকিস্তান আছে। সেখানে যদি কোন ফ্রেঞ্চ বলতো, ‘আমি একজন ফ্রেঞ্চ এবং আমি একটি মহান জাতির অন্তর্ভুক্ত’ এবং আরো অনেক কিছু। কিন্তু হয়েছিল কি? তারা তাদের সমস্যা অনুধাবন করেছিল এবং বুঝেছিল কারন তাদের জ্ঞান ছিল, খুব অল্প সময়ে তারা তাদের সমস্যার সমাধান করে এবং এই গোষ্ঠীতন্ত্রকে বিনষ্ট করে যেখানে নিজেদের জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইংরেজ বা স্প্যানিশ না বলে একজন আমেরিকান বলে। তারা শৌর্যের সাথে বলতঃ ‘আমি একজন আমেরিকান’ এবং ‘আমরা আমেরিকান’। সুতরাং আপনাদেরও এভাবে ভাবতে হবে যে আপনাদের দেশ পাকিস্তান এবং আপনারা পাকিস্তানি।

 আপনাদেরকে এই প্রাদেশিকতা থেকে বের হতে হবে, কারন যতক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই বিষ থাকবে, বিশ্বাস করুন, আপনারা শক্তিশালী জাতি হতে পারবেন না, যা চান তা অর্জন করতে পারবেন না। এটা ভাববেন না যে আমি এই অবস্থান মেনে নেইনি। খুব জলদি এটা একটা দুষ্টচক্র হবে। যখন আপনারা বাংলায় কথা বলবেন, তারা বলবে, ‘হ্যাঁ আপনিই ঠিক কিন্তু পাঞ্জাবীরা খুব অহংকারী’। যখন আপনি পাঞ্জাবী বা অন্য কোন ভাষায় কথা বলবেন, তারা বলবে, ‘হ্যাঁ, কিন্তু এরা আমাদের এখানে চায়না, বের করে দিতে চায়’। এখন এটা একটা দুষ্টচক্র হয়ে গেছে এবং আমার মনে হয়না কেউ এই চাইনিজ ধাঁধার সমাধান করতে পারবে। প্রশ্ন হচ্ছে কে বেশি সদয়, বেশি কাজের এবং অন্যান্য রাজ্যের মতো কে পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি সেবা করবে? সুতরাং মন ঠিক করেন এবং এই গোষ্ঠীতন্ত্রকে আজই খতম করেন।

ভাষার ব্যাপারে আমি ইতোমধ্যেই বলেছি, মুসলমানদের মধ্যে সংহতি নাশের চেষ্টা চলছে। আপনাদের প্রধানমন্ত্রী সঠিকভাবেই সম্প্রতি বিবৃতি দিয়েছেন এবং আমি খুশি এই সরকার তাদের কোন প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রদেশের শান্তি বিনষ্ট না হওয়ার ব্যাপারে অনড়। প্রদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিই ঠিক করবে এখানের সরকারি ভাষা বাংলা হবে কিনা। এই ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই যে এই প্রশ্নের জবাব সঠিক সময়ে এখানকার বাসিন্দাদের আশানুরূপ ভাবেই ঠিক করা হবে।

 আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, বাংলা ভাষার বিষয় নিয়ে আপনাদের সাধারণ জীবনযাত্রা অনুভূত বা বিঘ্নিত হচ্ছে এটা সত্য নয়। কিন্তু এটাই চূড়ান্ত, আপনাদের প্রদেশের ভাষা আপনাদের জনগন দ্বারাই স্থির করা হবে। কিন্তু এটা পুরোপুরি নিশ্চিত যে, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে উর্দু, অন্য কিছু নয়। পাকিস্তানের শত্রু হবার জন্য যারা আপনাদের বিপথে চালিত করছে। একটি জাতীয় ভাষা ছাড়া কোন জাতিই নিজেদের একতা ও ক্রিয়াকলাপ ধরে রাখতে পারেনা। অন্যান্য দেশের ইতিহাস দেখুন। অতএব, জাতীয় ভাষার প্রসঙ্গ আসলে, পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু। কিন্তু এটা সময় মতো হবে।

 আপনাদের আবারো বলছি, পাকিস্তানের শত্রুদের ফাঁদে পা দেবেন না। দুঃখজনকভাবে, আপনারা পঞ্চ-শ্রেণীভুক্ত- এবং আমি দুঃখের সাথে বলছি যারা বাইরে থেকে অর্থায়ন পাচ্ছে, তারা মুসলিম। কিন্তু তারা অনেক বড় ভুল করছে। আমরা আর কোন অন্তর্ঘাত সহ্য করবোনা; পাকিস্তানের শত্রুদের আর সহ্য করবোনা; আমাদের দেশে কোন দেশদ্রোহিতা ও পাঁচ-কলামিস্ট সহ্য করবোনা, এবং এসব যদি বন্ধ না হয়, তাহলে আমি নিশ্চিত আপনাদের ও পাকিস্তান সরকার খুব নিষ্ঠুর ভাবে এর মোকাবেলা করবে, কারন এরা একধরনের বিষ। আমি এই উদ্দেশ্য ঠিকই বুঝতে পারছি। প্রায় বলা হয়, ‘ কেন আমরা এই দলে বা ওই দলে’? এখন আপনাদের বলি, আশা করি আপনারা আমার সাথে একমত হবেন; আমাদের এই ক্রমাগত প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের ফল হিসেবে দশ বছর পরে পাকিস্তান অর্জন করেছি। মুসলিম লীগের দ্বারা এটা হয়েছে। সেখানে অবশ্যই কিছু মুসলমান নিরপেক্ষ ছিল; কিছু ভীত ছিল, কারন তারা ভিতরে ভয় পাচ্ছিলো তারা হয়তো হেরে যাবে; কিছু শত্রুদের কাছে বিক্রি হয়ে আমাদের বিপক্ষে কাজ করছিল, কিন্তু সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে সৃষ্টিকর্তার দোয়া ও সাহায্যে আমরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছি যা বিশ্বকে স্তব্ধ করেছে।

এই পবিত্র বিশ্বাস এখন আপনাদের হাতে; মুসলিম লিগ। আমাদের দেশ ও দেশের জনগণের মঙ্গলে আমাদেরই অবিভাবক হয়ে এই পবিত্র বিশ্বাস রক্ষা করতে হবে, নয়তো? আমরা যা অর্জন করেছি তা কি এইসব অতিতের সন্দিহান মানুষদের নিয়ে গঠিত ছত্রাক দল গুলো ধ্বংস করবে বা আমাদের নিরাপত্তাকে রোধ করবে? আপনাদের কাছে জানতে চাই, আপনারা কি পাকিস্তান বিশ্বাস করেন? ( হ্যাঁ, হ্যাঁ আওয়াজ)। পাকিস্তান অর্জন করে আপনারা খুশি? (হ্যাঁ, হ্যাঁ আওয়াজ)। পূর্ব বাংলা বা পাকিস্তানের কোন অংশ ভারত ইউনিয়নে যাক, সেটা কি আপনারা চান? (না, না)। তাহলে যদি পাকিস্তানের ভালো চান, গড়ে তুলতে চান, পুনর্গঠন করতে চান, তাহলে আমি বলবো প্রতিটি মুসলমানের সৎ দায়িত্ব হবে মুসলিম লীগে যোগ দেয়া এবং সর্বত ভাবে পাকিস্তানের সেবা করা। অন্য যেসব ছত্রাক দল আজকাল দেখা যাচ্ছে তাদের অতীতের কারনে তারা অবিশ্বাস্য; ঈর্ষা, বৈরিতা বা বদলার জন্য নয়। সৎ পরিবর্তনকে স্বাগতম কিন্তু বর্তমান জরুরী অবস্থায় সব মুসলমানদের মুসলিম লীগের ব্যানারে আসা উচিত, যা পাকিস্তানের সত্যিকারের অবিভাবক, এবং একটি মহান জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে নিজেদের দল গুলোকে পরে সুন্দর ও সুস্থ ভাবে গড়ে তোলার আগেই।

আরেকটি ব্যাপার। বিচ্ছিন্নতা বোধ করবেন না। অনেকেই আমাকে বলেছে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করে। কোন সন্দেহ নাই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার দুরত্ত্ব অনেক; সন্দেহ নেই যে অনেক সমস্যা রয়েছে, কিন্তু আপনারা জেনে রাখুন আমরা পূর্ব বাংলা ও ঢাকার গুরুত্ব জানি ও অনুধাবন করেছি।

 এবার আমি শুধু এক সপ্তাহ বা দশ দিনের জন্য আসছি, দেশের প্রধানের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে অনেক দিনের জন্য আসতে হতে পারে এবং থাকতে হতে পারে, বা সপ্তাহের জন্য, একই ভাবে পাকিস্তানের মন্ত্রীদেরও কাছের যোগাযোগ তৈরি করতে হবে। তাদের এখানে আসা উচিত এবং আপনাদের নেতা ও সরকারের সদস্যদেরও পাকিস্তানের রাজধানী করাচী যাওয়া উচিত। আপনাদের ধৈর্য ধরতে হবে। আপনাদের সাহায্য সহযোগিতায় আমরা পাকিস্তানকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো।

 অবশেষে, আমি আপনাদের একসাথে থাকার অনুরোধ করছি, আমাদের জনগনের ভালোর জন্য সকল অসুবিধা, দুর্ভোগ উৎসর্গ করুন। যে কোন মাপের যন্ত্রণা, কঠোর পরিশ্রম, স্বার্থ ত্যাগ কম হবে যদি আপনি আপনার নিজের, জাতির ও দেশের ভালোর জন্য অবদান রাখতে চান। এভাবেই আপনারা পাকিস্তানকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন শুধুমাত্র জনসংখ্যার দিক দিয়েই নয়, শক্তির দিক দিয়েও, এবং বিশ্বের অন্যসব জাতির নেতৃত্ব হিসেবে। এরই সাথে উপরওয়ালা আপনাদের মঙ্গল করুন। *

  পাকিস্তান জিন্দাবাদ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।