1952 | সিলেটে ভাষা আন্দোলনঃ ‘নওবেলাল’ এর পাতায় | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হবার পর পূর্ব বাংলায় যেকটি গণআন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন অন্যতম প্রধান। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা বাংলার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব বাংলার মানুষ যে ইতিহাস রচনা করেছে তা অভূতপূর্ব।
ভাষা আন্দোলন মূলত দুটি পর্যায়ে হয়েছিল। প্রথম পর্যায় ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী-মার্চ এবং দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত পর্যায় ১৯৫২ সালের জানুয়ারী-মার্চ।
যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্বাধীন সংবাদপত্রের একটা ভূমিকা থাকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। স্বাধীন সংবাদপত্রের পাতায় প্রায় অবিকৃতভাবে ইতিহাস লিপিবদ্ধ থাকে। আজ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চা নতুন উদ্যমে আবার শুরু হয়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নানা ব্যক্তির খটিনাটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হচ্ছে। এই আলোকে সেকালের সংবাদপত্রের বিবরণী মূল্যবান বিবেচনা করে এখানে ‘নওবেলাল’ সাপ্তাহিকের কিছু সংবাদ বিবরণী ও মন্তব্য সংকলন করা হল।
‘নওবেলাল’ প্রকাশিত হত সিলেট থেকে। এই তথ্যটি তাৎপর্যমন্ডিত কারণ ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায়। কিন্তু তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। বিভিন্ন লেখায় ঢাকার আন্দোলনের খবর যেভাবে পাওয়া যায় অন্য জেলার খবর সেভাবে পাওয়া যায় না।
‘নওবেলাল’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালের জানুয়ারীতে। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায় শুরু হবার সামান্য আগে। এর প্রধান সম্পাদক জনাব মাহমুদ আলী মূলত একজন রাজনীতিক। অনুমান করতে কষ্ট হয়না, রাজনীতি চর্চার স্বার্থেই তিনি সিলেট থেকে এই পত্রিকাটি বের করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় জনাব মাহমুদ আলী পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের সভাপতি ছিলেন। যুবলীগ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। সেদিক থেকে বলা যায়, নওবেলাল ভাষা আন্দোলনের সোচ্চার সমর্থক একটি পত্রিকা।
‘নওবেলাল’ সম্পর্কে জনাব বদরুদ্দীন উমর তাঁর পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, গ্রন্থের ভূমিকায় (প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃঃ ৪) বলেছেনঃ ‘নওবেলাল’ পূর্ব বাংলার তৎকালীন পত্রপত্রিকার মধ্যে রাজনীতিগত ভাবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘নওবেলাল’ দেখার সুযোগ না পেলে তৎকালীন রাজনীতিতে বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিবরণ সংগ্রহ করা আরও কঠিন ব্যাপার হতো। নানারকম দুর্বলতা সত্বেও এ পত্রিকাটি সেদিক দিয়ে খুবই উল্লেখযোগ্য।
‘নওবেলাল’ পত্রিকায় যেভাবে কেন্দ্রীয় আন্দোলনের খবর ছাপা হয়েছে তেমনি আঞ্চলিক পত্রিকা হিসেবে সেখানে স্থান পেয়েছে সিলেটের বিভিন্ন এলাকার আন্দোলনের খবর।
আমরা এই লেখায় প্রধানত সিলেট ও তার বিভিন্ন এলাকার খবর সংকলন করেছি। সেই সঙ্গে নওবেলাল প্রতিনিধি ঢাকা থেকে কি খবর পাঠিয়েছেন তাও দুএকটা মুদ্রিত হল।
১৯৫২ সালের জানুয়ারী থেকে এপ্রিল পর্যন্ত নওবেলাল-এর প্রতিটি সংখ্যাই ভাষা-আন্দোলনের খবরে সমৃদ্ধ। স্থানীভাবে এই লেখায় সব খবর, সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ সংকলন করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু সিলেটে ছাত্র ধর্মঘট, শোভাযাত্রা, গণবিক্ষোভ, কিছু বিবৃতি এখানে সংকলন করছি। এতে ভাষা আন্দোলনের সময় সিলেটের ভূমিকা স্পষ্ট হবে। এই খবর শুধু সিলেট শহরেরই নয়, মৌলবীবাজার, শ্রীমঙ্গল, জাকিগঞ্জ, হবিগঞ্জ প্রভৃতি এলাকার খবরও রয়েছে।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় নওবেলাল-এর বয়স ছিল পাঁচ। পত্রিকাটি ট্যাবলয়েড সাইজের। প্রতি সংখ্যা দুই আনা।
১৪ই ফেব্রুয়ারী
রাজধানী ঢাকার চিঠি
ঢাকা ৯-২-৫২ঃ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগের সভাপতি জনাব আলহাজ খাজা নাজিমউদ্দিনের পল্টন ময়দানের ভাষণ শহরবাসীকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলেছে। লীগ সরকারের স্বেচ্ছাচারের ফলে যখন জনগণের দুঃখ দুর্দশা উত্তোরোত্তর বেড়ে চলেছে তখন প্রধানমন্ত্রী কোন আশার বাণী শোনাতেই পারেননি বরং উল্টো তিনি পূর্ববঙ্গের ভাষা ও কৃষ্টির উপর এক ফ্যাসিস্ট হামলার ইঙ্গিত করেছেন।
কিন্তু এ ধরনের হামলা আর জনগণ নীরবে সহ্য করতে রাজী নয়। ৩০ জানুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ধর্মঘট ও এক মাইল দীর্ঘ শোভাযাত্রা বের করে প্রতিবাদ জানায়। ঐ দিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে জগন্নাথ কলেজ ও স্থানীয় কয়েকটি স্কুলও ধর্মঘট ও শোভাযাত্রা করে।
এরপর ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ধর্মঘট ও শোভাযাত্রা। বেলা এগারটায় শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েক সহস্র ছাত্রছাত্রী সমবেত হল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। সভার কাজ শুরু হল। সভাপতির আসন গ্রহণ করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও যুবলীগ কর্মী জনাব গাজীউল হক।
সভার পূর্বে বিভিন্ন ছাত্র নেতার মধ্যে আলোচনা চলছিল শোভাযাত্রা হবে কিনা। পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্র লীগের একজন কর্মী আমাকে জানালেন যে, কেন্দ্রীয় কমিটি অব এ্যাকশন শোভাযাত্রা বের করার সিদ্ধান্ত করেনি। শোভাযাত্রা বের করায় পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্র লীগের বিশিষ্ট কয়েকজন নেতার আপত্তি ছিল। কিন্তু উপস্থিত অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই শোভাযাত্রার মারফত বিক্ষোভ প্রদর্শন করার পক্ষপাতি। তাই যখন জনাব আবদুল মতিন বক্তৃতা প্রসঙ্গে বললেন শোভাযাত্রা হবে কি হবে না তা আপনারা এখানে স্থির করবেন ।সহস্র কন্ঠ জানতে চাইল ‘হবে না’ কথাটা উঠলো কোথা থেকে। শোভাযাত্রা বিরোধী কোন নেতারই তখন সাহস হলো না শোভাযাত্রা রুখবার। সভায় বিরাট উত্তেজনা ‘শোভাযাত্রা চাই’—আর বক্তৃতায় কর্ণপাত করার ধৈর্যও ছিল না শ্রোতৃবর্গের। শ্লােগান উঠলো ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আরবী হরফে বাংলা চলবে না ‘বিশ্বাসঘাতক নাজিমউদ্দিন গদী ছাড়’।
প্রায় পাঁচ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর আড়াই মাইল দীর্ঘ শোভাযাত্রা বেরিয়ে এল শহরের পথে। বন্ধ হয়ে গেল যানবাহন, আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো তরুণ তরুণীদের বিপ্লবী শ্লোগান ধ্বনিতে। শহরের জনতা জানাল তাদের সাদর অভিবাদন।
এতবড় শোভাযাত্রা ঢাকায় পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। শোভা যাত্রার সঙ্গে জনাব খাজা নাজিমউদ্দিনের একটি প্রতিকৃতি সহ বহু কার্টুন ছিল। ঐ দিনের কার্টুন ও পোস্টার লেখাতেও বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। একটি পোস্টারে লিখা ছিলঃ
চালের বদলে খুদ খাইয়েছে
চিনির বদলে গুড়
লবণের কথা নাই বললাম
এবার সাড়ে চার কোটি লোকের
মুখের ভাষাটি কেড়ে নিতে
সাহস করো না।
১৯৪৮ সালে যা ছিল ছাত্র আন্দোলন এবার তা গণআন্দোলনে রূপান্তর হবার সম্ভাবনা রয়েছে প্রচুর। কেন্দ্রীয় কমিটি অব এ্যাকশন ২১ ফেব্রুয়ারী প্রদেশ ব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের যে আবেদন জানিয়েছে ইতিমধ্যেই শহরবাসী ঐ আহ্বানের প্রতি সক্রিয় সমর্থন জানাতে শুরু করেছে। মিথ্যা ভাওতায় তারা আর ভুলতে রাজী নয়। শহরের জনগণ বুঝতে পেরেছে তাদের ভাত কাপড়ের দাবি, মজুরীর দাবি ভাষা ও কৃষ্টি রক্ষার দাবি একসঙ্গে জড়িত। তাই শহরের পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছে কমিটি অব এ্যাকশন।
২১শে ফেব্রুয়ারী
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট
সিলেটে ছাত্রদের ধর্মঘট, শোভাযাত্রা ও বিরাট জনসভা
কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি অব এ্যাকশনের উদ্যোগে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ও আরবী অক্ষরে বাংলা ভাষা লিখন পদ্ধতি প্রচলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইয়া অদ্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট প্রতিপালন করিয়া স্থানে স্থানে সভা ও শোভাযাত্রা করা হইয়াছে। এতদিন যাহা একটি ছাত্র আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল আজ তাহা বিরাট গণ-আন্দোলনে রূপ গ্রহণ করিয়াছে।
১৯৪৮ সালেও তৎপরবর্তীযুগে সিলেটে বাংলা ভাষার আন্দোলনে পশ্চাৎপদ হইলেও অদ্যকার ছাত্র ধর্মঘট, শোভাযাত্রা ও জনসভা ইহাই প্রমাণ করিয়াছে যে, বাংলা ভাষার সমর্থনে সিলেটবাসী পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য জেলার পিছনে পড়িয়া থাকে নাই।
এখানে উল্লেখযোেগ্য যে, ১৯৪৮ ইং জনাব মাহমদ আলীর সভাপতিত্বে বাংলা ভাষার সমর্থনে গোবিন্দ পার্কে সভা করিলে স্থানীয় তথাকথিত নেতৃবৃন্দের সমর্থনে কতিপয় সমাজ বিরোধী লোক পশু শক্তির বলে সভা পণ্ড করিয়া দেয়। এবং মাইক্রোফোন চেয়ার টেবিল ইত্যাদি ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া দেয়। কিন্তু কালের গতিতে অবস্থান পরিবর্তন হইয়াছে।
অদ্যকার সভা সিলেট জেলা রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বানে অনুষ্ঠিত হয়। যুক্ত আসামের প্রাদেশিক মুসলীগের প্রাক্তন সম্পাদক জনাব মাহমুদ আলী সভায় সভাপতিত্ব করেন।
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দামের দাবি জানাইয়া এবং আরবী অক্ষরে বাংলা ভাষার লিখন পদ্ধতি প্রচলনের গোপন ষড়যন্ত্রের তীব্র নিন্দা করিয়া সভায় সর্বসম্মতি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
২৩ শে ফেব্রুয়ারী
জুলুম শাহীর বিরুদ্ধে সিলেটে ঐতিহাসিক গণবিক্ষোভ
ঢাকায় শান্তিপূর্ণ ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশ ও মিলিটারীর গুলি বর্ষণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে গতকল্য সিলেট জেলা বার এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী জনাব মোহাম্মদ আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে স্থানীয় গোবিন্দ পার্কে বিরাট জনসভা ও অধিবেশন হয়। সভায় মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি হইতে পরিষদ সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করা হয়। অদ্য সারা শহর ও শহরতলীর সমস্ত দোকান পাট স্কুল কলেজ পূর্ণ হরতাল পালন করে এমনকি সরকারি অফিস আদালতের কার্যাদিও কার্য্যতঃ বন্ধ থাকে।
অদ্য সকাল হইতে ছাত্র ও জনসাধারণের মিলিত যে শোভাযাত্রা শহর প্রদক্ষিণ করে, সিলেটের ইতিহাসে এত বড় শোভা যাত্রা আর কখনো সংঘটিত হয় নাই। শোভাযাত্রীগণ ‘নাই’ ও নুরুল আমীন সরকারের পদত্যাগ ও খুনীদের ফাঁসী দাবি করিয়া শ্লেগান দেন।
জোহরের নামাজের পর হযরত শাহজালালের দরগায় শহীদদের জন্য এবং জুলুম শাহীর অবসান কামনা করিয়া মোনজাত করা হয়। রাষ্ট্রভাষা দিবসে ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলী বর্ষণের সংবাদ পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে শহরের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারীর রাত্রে রেডিও পাকিস্তান হইতে এই মর্মে সংবাদ ঘোষণা করা হয় যে, রাষ্ট্রভাষা দিবসে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশ সমবেত ছাত্রদের উপর গুলি চালায়। এবং তার ফলে একজন ছাত্র নিহত ও তিনজন ছাত্র আহত হয়। ছাত্রদের উপর এইরূপ পৈশাচিক হামলার মর্মান্তিক সংবাদ ঘোষণার পরক্ষণেই জনসাধারণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দলে দলে পথচারী গণ এখানে সেখানে রেডিওর চারিধারে ভিড় করে দাঁড়ায় এবং বিস্তারিত ব্যাপার জানিবার জন্য রদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে। ছাত্র নিধনের মর্মান্তিক সংবাদ শুনার পর প্রত্যেকের মুখ হইতে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উচ্চারিত হইয়া থাকেঃ পাকিস্তানের পাক ভূমিতে ছাত্রদের উপর এরূপ ফেরাউনি জুলুম কেন? পরদিন সকাল হইতেই শহরের স্বাভাবিক জীবন যাত্রার এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে উত্তেজিত জনতার ভিড় জমিয়া উঠে এবং মহল্লায় ছাত্ররা প্রকৃত সংবাদ সংগ্রহের জন্য ছুটোছটি করিতে থাকে। প্রত্যেকের মুখে ফুটিয়া উঠে বিষাদের এক কালোছায়া। ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে সংবাদ পাওয়া যায় যে, এ পর্যন্ত ১৭ জন ছাত্র নিহত ও শতাধিক আহত হইয়াছে।
বেলা ১০ ঘটিকায় সিলেট রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সদস্যগণ এক জরুরী সভায় মিলিত হইয়া পরবর্তী কর্মপন্থী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বিকালে সভা ও শোভাযাত্রা করার কথা শহরময় ঘোষণা করিয়া দেয়া হয়। সরকারী কমপন্থা বিকালে সভা ও হয়। সরকারী জুলুমের প্রতিবাদমূলক পোষ্টারে শহরের দেয়ালসমূহ বেলা ১১ ঘটিকার পূর্বেই ছাইয়া যায়।
বিকাল ৩ ঘটিকার সময় বিক্ষুব্ধ জনতা দলে দলে গোবিন্দ পার্কে জমায়েত হইতে থাকে। স্কুল কলেজ বন্ধ থাকা সত্তেও শত শত ছাত্র জুলুমশাহীর বিরুদ্ধে ধ্বনি করিতে করিতে পার্কে আসিয়া জমায়েত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় বার এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী জনাব মোঃ আবদুল্লাহ বি, এ সাহেব। অগ্নিময়ী ভাষায় বক্তাগণ একের পর এক এইরুপ নারকীয় জুলুমের প্রতিবাদ করিয়া বক্তৃতা দেন। খুনীদের শাস্তি দাবি করিয়া এবং পরদিন পূর্ণ হরতাল পালন করিবার আহ্বান জানাইয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।
সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে একদল প্রতিনিধি অতঃপর এম, এল, এ এবং পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জনাব তাইমুর রেজা সাহেবের বাড়িতে গিয়া লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি হইতে তাহার পদত্যাগ দাবি করেন।
কিন্তু রেজা সাহেব সরাসরি প্রতিনিধিদের দাবির কোন উত্তর না দিয়া তাদের চিরাচরিত প্রথানুযায়ী জনতাকে এড়াইবার প্রয়াস পান। বিক্ষুব্ধ জনতা অতঃপর তাদের এবং তাদের সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলিতে তুলিতে ফিরিয়া আসে। এক সুদীর্ঘ শোভাযারায় রাত্রি সোয়া আট ঘটিকা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করিয়া জনসাধারণকে পরদিন পূর্ণ হরতাল পালনের আহ্বান জানায়।
২৮শে ফেব্রুয়ারী
জুলুম শাহীর বিরুদ্ধে সিলেটে ঐতিহাসিক গণবিক্ষোভ
ঢাকায় শান্তিপূর্ণ ছাত্র মিছিলের উপর সশস্ত্র পুলিশ ও মিলিটারীর নির্মম গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে শুক্রবার বিকাল ৪ ঘটিকার সময় স্থানীয় গোবিন্দ পার্কে এক বিরাট জনসভার অনুষ্ঠান হয়। সভাপতিত্ব করেন, স্থানীয় বার এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী জনাব মোঃ আবদুলাহ বি, এল। জুলুম শাহীর উচ্ছেদ এবং মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি হইতে সিলেটি এম, এল, এ, দের পদত্যাগ দাবি করিয়া কতগুলি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঐদিন সারা শহর ও শহরতলীর সমস্ত দোকান পাট, স্কুল কলেজ পূর্ণ হরতাল পালন করে এমনকি সরকারী অফিস আদালতের কার্যাদিও আংশিকভাবে বন্ধ থাকে।
ঐ দিন সকাল হইতে হাজার হাজার ছাত্র ও জনসাধারণের মিলিত শোভাযাত্রা সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করে সিলেটের ইতিহাসে তাহা অভূতপূর্ব। শোভাযাত্রীগণ নাজিম ও নুরুল আমিন সরকারের পদত্যাগ ও খুনীদের ফাঁসী দাবি করিয়া শ্লোগান দেন।
জোহরের নামাজের পর হযরত শাহজালালের দরগায় শহীদদের জন্য ও জুলুম শাহীর অবসান কামনা করিয়া মোনাজাত করা হয়।
রাষ্ট্রভাষা দিবসে ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুলিশ ও মিলিটারীর বেপরোয়া গুলি বর্ষণের মর্মান্তিক সংবাদ পৌছার সঙ্গে সঙ্গে শহরের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। দলে দলে পথচারীগণ এখানে সেখানে রেডিওর চারদিকে ভিড় করিয়া দাঁড়ায় এবং বিস্তারিত ব্যাপার জানিবার জন্য রদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করিতে থাকে। ছাত্র নিধনের মর্মান্তিক সংবাদ ঘোষিত হওয়ার পর প্রত্যেকের মুখে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উচ্চারিত হইতে থাকে পাকিস্তানে পাক ভূমিতে নিরীহ ছাত্রদের উপর এইরূপ ফেরাউনী জুলুম কেন?
পরদিন সকাল হইতেই শহরের স্বাভাবিক জীবন যাত্রার একা অস্বাভাবিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিক্ষুদ্ধ জনতার ভিড়। পথেপথে উদ্বিগ্ন ছাত্রদের ছুটাছুটি—সব মিলিয়ে শহরের প্রতিটি প্রান্তে এক শ্বাসরোধকারী উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ইতিমধ্যে ঢাকা হইতে সংবাদ আসে এ পর্যন্ত ১৭ জন নিহত ও শতাধিক ছাত্র মারাত্মক ভাবে আহত হইয়া হাসপাতালে অবস্থান করিতেছেন। বেলা ১০ ঘটিকার সময় সিলেট রাষ্ট্র ভাষা কর্ম পরিষদের এক জরুরী সভার সদস্যগণ মিলিত হইয়া পরবর্তী কর্ম পন্থা স্থির করেন।
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বিকেলে সভা শোভাযাত্রার কথা শহরময় ঘোষণা করিয়া দেয়া হয়। সরকারী জুলুমের প্রতিবাদমূলক পোস্টারে শহরের দেয়াল সমূহে বেলা ১১ ঘটিকার আগেই ছাইয়া যায়।
বিকাল ৩ ঘটিকার পূর্বেই বিক্ষুদ্ধ জনতা দলে দলে গোবিন্দ পার্কে ভাংগিয়া পড়ে—স্কুল কলেজে হরতাল সত্বেও হাজার হাজার ছাত্র শোভাযাত্রী জুলুম শাহীর বিরুদ্ধে ধ্বনিক করিতে করিতে আসিয়া পার্কে জমা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় বার এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী জনাব মোঃ আবদুল্লাহ বি এল। অগ্নীময় ভাষায় বক্তাগণ একের পর এক এরূপ নারকীয় জুলুমের প্রতিবাদ করিবা বক্তৃতা দেন । খুনীদের শাস্তি দাবী করিয়া এবং পরদিন পূর্ণ হরতাল পালন করিবার আহ্বান জানাইয়া কতকগুলি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভার পর এক সুদীর্ঘ শোভাযাত্রা স্থানীয় এম, এল, এদের লীগ দল হইতে পদত্যাগ এবং জালীম লীগ সরকারের উচ্ছেদ দাবী করিয়া শহরের বিভিন্ন মহল্লা পরিদর্শন করে।
শনিবার সকাল হইতেই শহরের মধ্যে এক অভূতপূর্ব অবস্থা বিরাজ করিতে থাকে, দোকান পাট সব বন্ধ রাস্তায় যানবাহনের নাম গন্ধ নাই। মাঝে মাঝে টহলদারী পুলিশ ভ্যান এদিক হইতে ওদিকে দ্রুত গতিতে চলিয়া যাইতেছিল। পথচারীদের চলাফেরার মধ্যে এক অদ্ভুত চাঞ্চল্য এক বিরাট দুঃস্বপ্ন যেন তাহাদের জীবনের সব কিছুকে একেবারে ওলোট পালোট করিয়া দিয়াছে। পোস্টারে শহরের দেয়ালগুলি ছাইয়া গিয়াছে— প্রতিটি পোস্টার বহন করিতেছে বিক্ষুদ্ধ জনতার রক্তাক্ত স্বাক্ষর লালকালির প্রতিটি আচড়ে ধরা পড়িয়াছে এক জলন্ত জিজ্ঞাসা—শহীদ ভাইদের প্রতিটি রক্তবিন্দু আমাদের মধ্যে কি লাখো লাখো রক্ত বীজ উপ্ত করবেনা ?
বেলা ১১ ঘটিকায় শোভাযাত্রী হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর বজ্র নির্ঘোষে স্তব্দ আকাশে জাগল এক অভূতপূর্ব মূর্ছনা। প্রায় দুমাইল দীর্ঘ শোভাযাত্রা রাস্তা পরিক্রম করিয়া গোবিন্দ পার্কে আসিয়া জমায়েত হয়—শোভামাত্রার অগ্রভাগে ছিল শহরের শত শত ছাত্রী। সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ উঠে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘নুরুল-নাজিম মুর্দাবাদ’ ‘শহীদদের খুন ভুলবোনা’ জুলুম বাজী চলবে না। ছাত্র ছাত্রীদের মিলিত সভায় সভাপতিত্ব করেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র, জনাব নওয়াব উদ্দীন। উল্লেখযোগ্য যে গণভোটের পর মহিলাদের শোভাযাত্রা সিলেটের ইতিহাসে এই প্রথম। বেগম হাজেরা মাহমুদ সভায় বক্তৃতা করেন।
বিকালে ৪ ঘটিকায় গোবিন্দ পার্কে আবার জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজ ভাংগিয়া পড়ে। সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় মহিলা কলেজের অধ্যাপক জনাব আঃ মালিক এম, এ। মুসলিম লীগ সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করিয়া এবং খুনীদের শাস্তি দাবী করিয়া সভায় প্রস্তাব গৃহীত হয়। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য ঐদিন ঘরে ঘরে পতাকা অর্ধনমিত করা হয়। অধিকাংশ লোক কালো ব্যাজ ধারণ করে।
ঐদিন একই সময় স্থানীয় জিন্নাহ হলে এক বিরাট মহিলা সভার অনুষ্ঠান হয়। ঢাকায় নৃশংস ছাত্র হত্যার তীব্র নিন্দা করিয়া এবং লীগ সরকারের পদত্যাগ দাবী করিয়া তাহারা সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের নিদর্শন স্বরূপ ঐদিন স্থানীয় সিনেমা কর্তৃপক্ষ উক্ত সিনেমা হলে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ রাখে।
রবিবার এবং সোমবারেও শহর ও শহরতলীর জীবন-যাত্রার স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় নাই। ঢাকার বুকে জালিয়ানওয়ালা বাগের পুনরাবৃত্তি সিলেট জনসাধারণের মনে যে তীব্র বিক্ষোভের সৃষ্টি করিয়াছে ক্রমে ক্রমে তাহা এক সুদূর প্রসারী রাজনৈতিক চেতনায় রুপান্তরিত হইতে চলিয়াছে। ভাষা আন্দোলনকে জয়যুক্ত করিবার জন্য জাগ্রত ছাত্র সমাজের মধ্যে জাগিয়াছে এক অটল সংকল্প। স্কুল কলেজ পূর্ণ হরতাল—শহরের বিরাট ছাত্র সমাজের জীবনে আসিয়াছে কর্মের উচ্ছল প্রবাহ। বেলা দশ ঘটিকা হইতে সুদীর্ঘ শোভাযাত্রাসমূহ শহরের প্রতিটি প্রান্তে এক নতুন প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিয়া তোলে। রবিবার বেলা ১২ ঘটিকার সময় শোভাযাত্রী ছাত্রগণ পার্কে এক সভায় সমবেত হয়—বিকাল ৪ ঘটিকা জনাব হাবিব উদ্দীনের সভাপতিত্বে পার্কে আবার বিপুল জন সমাবেশ হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরিয়া বিভিন্ন বক্তার মুখ হইতে জনসাধারণ রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শুনিতে থাকে ঢাকার বীর ছাত্রদের শাহাদত প্রাপ্তির মর্মভেদী কাহিনী। জনসাধারণের দাবী সত্বেও লীগ পালামেন্টারী পার্টি হইতে পদত্যাগ না করা এম, এল, এদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এবং পদত্যাগ করিয়া নুরুল আমিনের জালিম-শাহীর পতন ঘটাইবার জন্য তাহাদের পুনরায় আহ্বান জানাইয়া সভায় প্রস্তাব গৃহীত হয়।
সোমবার জনসভায় সভাপতিত্ব করেন সিলেট জেলার যুবলীগের সেক্রেটারী জনাব মনিরুদ্দীন এম, এ, এল, এল, বি সাহেব। প্রতিদিনের মত আজো সন্ধ্যা প্রায় ৮ ঘটিকা পর্যন্ত সভার কাজ চলিতে থাকে–ছাত্রদের সিদ্ধান্তক্রমে আরো তিন দিনের জন্য স্কুলে কলেজে হরতাল পালনের করার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সভায় বক্ততা প্রসঙ্গে ভূতপূর্বে লীগ নেতা আনসার সম্পাদক জনাব মওলানা সাখাওয়াতুন আম্বিয়া সাহেব আলেম সমাজকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবীতে আন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। ঢাকা হইতে আগত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জনাব জিয়াউদ্দীন সাহেব পরবর্তী ঘটনা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
শহীদদের প্রতি গভীর বেদনাবোধ এবং আন্দোলনের সংগ্রামী শপথ এই দুই এর সামঞ্জস্যমূলক কয়েকটি উৎকৃষ্ট গান গাহিয়া গায়ক লিয়াকত হোসেন সভায় এক বিচিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করে।
ঘটনার ষষ্ঠ দিনেও অর্থাৎ মঙ্গলবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়। সভা ও শোভাযাত্রা লাগিয়াই আছে। গোবিন্দ পার্কে আবার সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্রকর্মী জনাব আছুদ্দর আলী।
২৮শে ফেব্রুয়ারী
সোহরাওয়ার্দির বাংলা বিরোধী বিবৃতিদান
সিলেট জেলার আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি জনাব নুরুর রহমান, জনাব সোহরাওয়ার্দির বাংলা বিরোধী বিবৃতির প্রতিবাদ করিয়া নিম্নলিখিত বিবৃতি দিয়াছেন—
উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে উকালতি করিয়া জনাব সোহরাওয়ার্দী সাহেব যে বিভ্রান্তিক বিবৃতি দিয়াছেন তাহা পাঠ করিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছি। সাড়ে চারকোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সর্বাত্মক আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছে এবং যে সময় পশ্চিম পাকিস্তান হইতেও আমাদের দাবীর পক্ষে জোরাল সমর্থন আসিতেছে তখন সোহরাওয়ার্দি সাহেবের এইরূপ উদ্দেশ্যমূলক উত্তোক্তি শুধু অবান্ছিতই নয় উপরন্তু ঘৃণার্থ। কোন রাজনৈতিক মহলের অনুরাগ বিরাগের তোয়াক্কা না রাখিয়া জাগ্রত জনতা তাহাদের ন্যায়সংগত দাবী আদায়ের জন্য আন্দেলনের পথে পা বাড়াইয়াছে, আমরা সংকল্প নিয়াছি আমাদের এই আন্দোলনের পথে স্বার্থান্বেষী নেতৃত্বের কোন বিভ্রান্তিক ভূমিকা আমরা কোন মতেই বরদাস্ত করিব না। সোহরাওয়ার্দি সাহেব এই সত্যটুকু বিলম্বে উপলব্ধি করিলে মারাত্মক ভুল করিবেন। আমি স্পষ্টাক্ষরে ঘোষণা করিতেছিঃ এইরূপ জন ভাষা আন্দোলনের উপর নওবেলালের বিশেষ সংখ্যা (১০ ফাগুন ১৩৫৮)
স্বার্থ বিরোধী বিবৃতি ঝাড়িবার জন্য সোহরাওয়ার্দি সাহেবকে জাগ্রত জনমতের নিকট অবশ্যই জবাবদিহি করতেই হইবে।
মতলববাজরা সোহরাওয়ার্দির উক্তিকে আওয়ামী লীগের নীতির প্রতিধ্বনি হিসেবে অভিহিত করিয়া জনগণের মধ্যে ভ্রান্তধারনার সৃষ্টি করিবে, তাই আমি স্পষ্টাক্ষরে ঘোষণা করিতে চাই যে সোহরাওয়ার্দির উক্তির সহিত আওয়ামী লীগের নীতিগত কোন প্রশ্ন জড়িত নহে, অন্যদিকে সোহরাওয়াদি পরিচালিত জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগের কোন সম্বন্ধ নাই—ইহা সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান।
২৮শে ফেব্রুয়ারী
সিলেটে কর্মরত ঢাকার ছাত্রদল
ঢাকার ফজলুল হক হলের সহকারী সাধারণ সম্পাদক জনাব মোয়াল্লিম উদ্দীনের নেতৃত্বে ঢাকার কতিপয় ছাত্র ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বিগত ২০শে ফেব্রুয়ারী হইতে সিলেটে কর্মরত রহিয়াছেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে উদ্ভূত আন্দোলনকে মফস্বল অঞ্চলে শক্তিশালী ও সর্বাত্মক করিয়া তুলিবার জন্য জনাব মোয়াল্লিম উদ্দিন সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করিয়াছেন এবং সিলেট রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের কর্মসূচীর ভিত্তিতে তিনি ভাষা আন্দোলনকে আরো জোরদার করিবার প্রয়াস পাইতেছেন।
৬ই মার্চ
ছাত্র আন্দোলন নয় গণ আন্দোলনঃ
২৬শে ফেব্রুয়ারী সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষয়ীত্রিগণও কার্যে যোগদান হইতে বিরত থাকেন। বিকালে ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য জনাব মফিজ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয়। সভায় ঢাকা হইতে সদ্য আগত পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জনাব আবদুল খালেক ঢাকার মিথ্যা বিবরণ দিবার চেষ্টা করিলে জনসাধারণ তাহার তীব্র প্রতিবাদ করে ও নরুল আমিনের দালাল বলিয়া শ্লোগান দেয়। সভাপতি অতপর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে ছাত্র আন্দোলন বলিয়া উল্লেখ করিলে বিক্ষুদ্ধ জনতা তীব্র প্রতিবাদে জানাইয়া দেয়–’এই আন্দোলন ছাত্র আন্দোলন নয় গণ আন্দোলন। সাত কোটি পাকিস্তানীর সাড়ে চার কোটির আন্দোলন।’ সভা শেষ হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে জনসাধারণ এম, এল, এদের পদত্যাগ দাবী করে এবং এইমর্মে সভায় প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য জনসাধারণের পক্ষ হইতে প্রতিনিধি অগ্রসর হইলে সভাপতি তাহাকে বাধা দিয়া সভা ভংগ করিয়া পলায়ন করেন।
এই সভায় সুনামগঞ্জ মহকুমা লীগের সভাপতি জনাব মকবুল হোসেন লীগ সরকারের জুলুমের প্রতিবাদে ঐ প্রতিষ্ঠান হইতে পদত্যাগ ঘোষণা করিলে উপস্থিত জনতা তুমুল হর্ষধৰ্নী সহকারে তাহাকে অভিনন্দিত করে।
২৭শে ফেব্রুয়ারী ছাত্রগণ অফিস আদালতে পিকেটিং করে। ফলে, ঐ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে সেই দিন কোন কাজ হয় নাই। আমবাড়ী বাজারে ২৬শে ফেব্রুয়ারী পূর্ণদিবস হরতাল পালন করা হয়। শোভাযাত্রা সহকারে জনসাধারণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং সভা করিয়া নূরল আমিন সরকারের উচ্ছেদ দাবী করে। জয়কলস বাজারে ঐদিন হরতাল পালন করা হয়। জয়কলস মাদ্রাসা ও গোবিন্দপুর মাদ্রাসার ছাত্রগণ সভা শোভাযাত্রা হরতাল ইত্যাদি পরিচালনা করেন।
ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের সংবাদ জগন্নাথপুরে পৌছালে থানার সর্বত্র বাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হরতাল, সভা ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হইতে থাকে। ‘অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ ‘নুরুল আমিন গদি ছাড়ো’ প্রভৃতি ধ্বনি উঠিতে থাকে। ২৭শে ফেব্রুয়ারী থানার ছাত্র ও জনসাধারণের উদ্যোগে জগন্নাথপর বাজারে মৌলবী আজিজুল হক সাহেবের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয়। সভায় হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি দাবী করিয়া বর্তমান অযোগ্য মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবী করিয়া ও ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের দাবী জানাইয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।
মৌলবীবাজারঃ ২৫শে ফেব্রুয়ারী স্থানীয় মিউনিসি প্যাল পার্কে মৌলভী আবদুল আজিজ উকিল সাহেবের সভাপতিত্বে বিরাট এক জনসভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাবসমূহ গৃহীত হয়—
১। ঢাকার রাষ্ট্রভাষা দিবসে ছাত্রদের উপর ফ্যাসিস্ট নুরুল আমিন সরকারের পুলিশ ও মিলিটারী গুলী চালনা করে নিরীহ ছাত্রদের হত্যা করেছে ইহার প্রতিবাদে এসভা তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করিতেছে।
২। যে উদ্দেশ্যে ঢাকার নিরীহ ছাত্র ও জনসাধারণ শহীদ হইয়াছেন তাহা সফল করিবার নিমিত্ত ছাত্র ও জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালাইয়া যাইবার জন্য এই সভা সংকল্প করিতেছে।
৩। এই সভা খুনী নুরুল আমিন সরকার ও নাজিম সরকারের উপর গভীর অনাস্থা প্রকাশ করিয়া তাহাদের পদত্যাগ দাবী করিতেছে।
৪। ঢাকার এই অমানুষিক হত্যাকান্ডের পরেও যেসব এম, এল, এ-গণ এখনও আইন পরিষদের সদস্যপদ আকড়াইয়া ধরিয়া আছেন এই সভা তাহাদের পদত্যাগ দাবী করিতেছে ও মুসলিম লীগ ও পরিষদ পদত্যাগকারীদের মোবারকবাদ জানাইতেছে।
ঢাকায় সংঘটিত হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার দাবী করিয়া ও যেসব সংবাদপত্র সরকারের আশ্রয়ে মিথ্যা বিকৃত সংবাদ পরিবেশন করিতেছে তাহাদের বর্জনের দাবী জানাইয়া আরো কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
শ্রীমংগলের জনসভায় ও ঢাকায় নুরুল আমিন সরকার ও তাহার সাঙ্গপাঙ্গদের কার্যের প্রতিবাদে ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করিয়া উপরোক্ত মর্মে ১২টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন মৌলভী মোঃ ইসরাইল।
জাকিগঞ্জঃ ২২শে ফেব্রুয়ারী পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। এক শোভাযাত্রায় শোভাযাত্রীগণ এম, এল, এ নুরুল আমিন মন্ত্রী সভার পদত্যাগ দাবীসূচক শ্লোগান দিয়া বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করেন। তারপর এক বিরাট জনসভায় (১) অচিরেই নরুল আমিনের মন্ত্রীসভা ও এম, এল, এদের পদ ত্যাগ (২) ঢাকায় ছাত্রদের উপর অমানুষিক হত্যাকান্ডের বিহিত ব্যবস্থা (৩) বাংলাকে অবিলম্বে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা দাবী করিয়া সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
হবিগঞ্জঃ ২৩শে ফেব্রুয়ারী মহকুমা মুসলিম লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত লোকেল বোর্ড প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত এবং জন সভায় রাষ্ট্রভাষা দিবসে ঢাকায় গুলী চালনা সমন্ধে গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় এবং সরকারী ও বেসরকারী ব্যক্তিদের লইয়া অবিলম্বে এক তদন্ত কমিটি গঠন করিবার দাবী জানান হয়। অপর এক প্রস্তাব ২১ তারিখে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারীর নিন্দা করা হয় এবং অবিলম্বে তাহার প্রত্যাহার দাবী করা হয়। আর এক প্রস্তাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করিবার দাবী জানান হয় এবং আরবী হরফে বাংলা প্রবর্তনের চেষ্টাকে জনসাধারণের অর্থে অপব্যয় মনে করিয়া সরকারের ঐ অদ্ভুত অবান্তর পরিকল্পনার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।
উপরোক্ত বিভিন্ন প্রস্তাবের মর্মে বানিয়াচুংগ, বারহাল, জলঢুপ, ভাদেশ্বর, বাংলাগঞ্জ হাইস্কুল, আদমপুর, আপগ্রেইডেড হাইস্কুল ঝিংগাবাড়ি হাই মাদ্রাসা, বড়লেখা হাই স্কুল, সাবাজপুর তাজপুর, চুনারু ঘাট, ফেঞ্চগঞ্জ বরমচাল, বিশ্বনাথ ও মোগলা বাজার হাই স্কুলের ছাত্র ও জনসাধারণের বিরাট জন ও ছাত্র সভায় বিভিন্ন প্রস্তাব গৃহীত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। সভায় সরকারের প্রতি অনাস্থামূলক প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রতি সভায় শহীদদের আত্মীয় স্বজনকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দাবী ও নিরাপত্তা বন্দীদের অবিলম্বে বিনাশর্তে মুক্তি দাবী ও গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহারের দাবী জানান হয়।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
১। নুরুল হক, গ্রন্থাগারিক, সিলেট মুসলিম সাহিত সংসদ লাইব্রেরী
২। রোকেয়া খাতুন রুবী, সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়