ভাষা আন্দোলনের প্রথম অধ্যায়: পাবনা | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫
মাহমুদ আলম খান
১৯৪৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী।
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে এই দিন পাবনা শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ভাষা-আন্দোলনকে করার দমন জন্য ২৮ ফেব্রুয়ারী পাবনা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ছাত্র ও যুবকদের এক মাইল দীর্ঘ এক জঙ্গী মিছিল পাবনা শহর প্রদক্ষিণ করে। পুলিশ মিছিলের মধ্যভাগে আক্রমণ চালিয়ে মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এই আক্রমণের পর মিছিল দুটি ভাগে বিভক্ত হয় এবং পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে পাবনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিছিলকারীদের সিদ্ধান্ত ছিল উর্দু নয়, পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা বাংলাকেই পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চায়, এই দাবি স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারকে অবহিত করা।
বিভক্ত মিছিলের প্রথম অংশ পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র, মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগের পাবনা জেলা শাখার সম্পাদক মাহবুবর রহমান খানের (বর্তমানে ঢাকায় পাট মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী) নেতৃত্বে প্রধান সড়ক দিয়ে ডাকঘরের সামনে এসে উপস্থিত হলে পুলিশ বাধা দেয়। মিছিলকারীরা এই বাধা অতিক্রম করে এগতে চেষ্টা করলে পুলিশ ও ছাত্রদের মধ্যে সামান্য সংঘর্ষ হয়। মিছিলের সামনে একজন স্কুল ছাত্রের (তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য আবদুল হামিদ কোরাইশীর পুত্র আতা কোরাইশী) হাত থেকে পাকিস্তানের পতাকা পুলিশ ছিনিয়ে নিয়ে ফেলে দেয়। এই ঘটনায় আতা কোরাইশী উক্ত পুলিশকে পাকিস্তানী পতাকার অবমাননার অভিযোগে প্রহার করতে উদ্যত হলে ছাত্র নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে সে নিবৃত্ত হয়।
মিছিলটি আবারও অগ্রসর হতে চেষ্ট করলে প্রথম অংশের অনেককেই গ্রেফতার করা হয়।
মিছিলের দ্বিতীয় অংশটি জি, সি ইন্সটিটিউশনের ছাত্রদের পাবনা জেলার শাখার সম্পাদক এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য আমিনুল ইসলাম বাদশার (বর্তমানে ব্যবসায়ী এবং মোজাফফর ন্যাপের নেতা) নেতৃত্বে ঐ স্থানে উপস্থিত হলে পুলিশ তাদেরও অনেককে গ্রেফতার করে। এই ঘটনার পর অফিস আদালতের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। সমস্ত কর্মচারী অফিসত্যাগ করে বাড়ি চলে যান।
উভয় মিছিলের গ্রেফতারকৃতদেরকে প্রথমে পাবনা জেলা কারাগার ও পুলিশ লাইনের মধ্যবর্তী মাঠে বসিয়ে রাখা হয়। পরে তাদের সকলকেই থানায় পাঠানো হয়। গ্রেফতারকৃতদের প্রহরার জন্য থানায় পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ ছিল না। এখান থেকে চলে যাবারও সহজ সুযোগ ছিল। কিন্তু ও গ্রেফতার বরণকারীদের সকলেই থানা প্রাঙ্গণের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত অবস্থান করেন। দুপুরের পর গ্রেফতারকৃতদের খাবারের জন্য তৎকালীন তরুণ মুসলিম লীগ নেতা আমজাদ হোসেন। (পরে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং সত্তরের নির্বাচনে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন ও পরে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়) এবং রাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা রওশনজান চৌধুরী (বর্তমানে মুসলিম লীগ করেন) এক বস্তা মুড়ি ও গুড়ের মোয়া থানায় প্রেরণ করেন। এই সময় একজন গোয়ালী ঝাঁকায় ভর্তি দই নিয়ে থানার পাশ দিয়ে বিক্রি করার জন্য যাচ্ছিল ওসি সাহেব গোয়ালার সমস্ত দই কিনে আমাদেরকে খেতে দেন। তার বাসা থেকে খাবার পানি আনা হয়। এই সহমর্মিতার ঘটনায় সকলেই আরও উৎসাহিত হন। আশপাশের বাড়ি থেকে থালা ও গ্লাস আসে। সবাই মুড়ি দই খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি করে।
বিকালে গ্রেফতারকৃতদের কোর্টে পাঠান হয়। এই সময় এস, ডি, ও কোর্টে কোর্ট ইন্সপেক্টর এবং কয়েকজন পুলিশ ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না।
আস্তে আস্তে অভিভাবক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত হন। উকিল মোক্তারদেরও অনেকেই উপস্থিত হন। এর পরপরই হোসিয়ারী শিল্পের ও বিড়ি কারখানার শ্রমিক ও ছাত্ররা দলে দলে উপস্থিত হলে কোর্ট প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।
কিছু অভিভাবক জামিনের জন্য আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। পাবনা কোর্টের প্রভাবশালী আইনজীবী ও মুসলিম লীগ নেতা এ্যাডভোকেট তোরাব আলী অভিভাবকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ দাবি করেন। কয়েকজন অভিভাবক পারিশ্রমিকের অর্থ এবং জামিন নামায় গোপনে স্বাক্ষরও দেন।
এই সংবাদ পেয়ে মোক্তার বারের সদস্য মোসলেমউদ্দিন ও বজলুর রহমান আলমাজী ছাত্রদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে জামিন দেবার প্রস্তাব করেন। (উভয়েই মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। মোসলেমউদ্দিন মোক্তার পরে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু বজলুর রহমান সাহেব মৃত্যুকাল পর্যন্ত মুসলিম লীগ করেছেন)।
গোপনে জামিনের ব্যবস্থা গ্রহণের এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে উপস্থিত সকলেই, প্রতিবাদ করেন এবং প্রত্যেকের বিনাশর্তে মুক্তি দাবি করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন ম্যাজিস্ট্রেট এজলাসে উপস্থিত না হওয়ায় কোর্ট ইন্সপেক্টর মাহবুবর রহমান খান ও আমিনুল ইসলাম বাদশা ব্যতিত আর সকলকেই চলে যেতে নির্দেশ দেন। এবারেও তার নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করা হয়।
সন্ধ্যার পরেও ম্যাজিস্ট্রেটের আসার জন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হয়। ইতিমধ্যে মাহবুবর রহমান খান অসুস্থ হয়ে পড়েন। আশপাশের বাড়ির সবাই কোর্ট প্রাঙ্গণের ঘটনার সংবাদ উৎসাহের সঙ্গে লক্ষ্য করছিলেন। কোন অনুরোধের পূর্বেই এক বাড়ি থেকে পানি আসে। অসুস্থ মাহবুবর রহমানকে সুস্থ করে তোলার পরপরই আদালতের একজন চাপড়াশী এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। তিনি জানানঃ জেলা জজের স্ত্রী অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে এই দুধসহ তাকে পাঠিয়েছেন। প্রয়োজনে আরও দুধ তিনি পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছেন।
সন্ধ্যার পরই একজন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে উপস্থিত হন। তিনি চেম্বারে বসে কোর্ট ইন্সপেক্টরকে ডেকে সকলকেই বিনাশর্তে ছেড়ে দেবার নির্দেশ দান করেন।
পুনরায় গ্রেফতার ও ১১ মার্চ পালন
১ মার্চ ভোর রাতে মাহবুবর রহমান খানকে তার বাড়ি থেকে পুনরায় গ্রেফতার করে পাবনা জেলা কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ২ মার্চ পর্যন্ত আর কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
৩ মার্চ ছাত্র কংগ্রেসের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র লুৎফুর রহমান (বর্তমানে পাবনার একটি তেলের পাম্পে চাকরি করেন) ও আমিনুল ইসলাম বাদশা আটক মাহবুবুর রহমান খানের জামিনের বিষয়ে আইজীবীদের পরামর্শের জন্য কোর্টে উপস্থিত হলে সেখান থেকে তাদের দু’জনকেই গ্রেফতার করা হয়। এর পরপরই গ্রেফতার হন ছাত্র কংগ্রেসের পাবনা শাখার সম্পাদক শ্রী প্রণতি কুমার রায় (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পানিহাটি পৌরসভার চেয়ারম্যান)। এই তিনজনকেই ঐদিনই পাবনা জেলা কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
৪ অথবা ৫ মার্চ আমজাদ হোসেন ও রওশন জান চৌধুরী দিলালপুরের ফিরোজা মহলে রাজনৈতিক নেতাদের এক বৈঠক ডাকেন। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিতব্য এই বৈঠকে অন্যান্যদের মধ্যে মুসলিম লীগের ডাক্তার তোফাজ্জল হোসেন, বজলুর রহমান আলমাজী ও মোসলেম উদ্দিন মোক্তার এবং র্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ডাক্তার মনীন্দ্রনাথ মজুমদার (পরবর্তীকালে পশ্চিম বঙ্গে চলে যান) যোগদান করেন। এই বৈঠকে পাবনার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল।
এই আলোচনা বৈঠক শুরু হওয়ার প্রাক্কালেই সেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেট এসে উপস্থিত হন। তার উপস্থিতিতে সকলেই শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এবং কোন আলোচনা না করেই সকলে স্থান ত্যাগ করেন।
পরদিন পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে ডাক্তার তোফাজ্জল হোসেন গ্রামাঞ্চলে এবং বজলুর রহমান আলমাজী পাবনা থেকে রাজশাহী চলে যান।
এই পরিস্থিতিতে শহরের বিভিন্ন ছাত্রাবাসে এবং মহল্লাতে গোপন বৈঠকে আলোচনা চলতে থাকে। এই সমস্ত বৈঠকে আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করার পক্ষে মত প্রকাশ করা হয়।
ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে ১১ মার্চ পূর্ববঙ্গব্যাপী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানানো হয়।
কলিকাতার সংবাদপত্রে এই কর্মসূচী প্রকাশিত হওয়ার পর পাবনার ছাত্রদের মাঝে নতুন করে উৎসাহের সৃষ্টি করে। নিজেদের মধ্যে আলোচনার পর ১১ই মার্চ সাধারণ, ধর্মঘট পালনের কর্মসূচীর সঙ্গে বন্দী মুক্তির দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে প্রস্তুতি ও প্রচারের কাজ চলতে থাকে। একটি প্রচারপত্র তৈরি করা হয় বা এবং কোহিনূর প্রিন্টিং প্রেসে ছাপতে দেয়া হয়।
১০ মার্চ বিকালে আমজাদ হোসেন ও রওশনজান চোধুরী প্রচারপত্রটি দেখার জন্য প্রেসে উপস্থিত হলে সেখান থেকেই এই দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রচারপত্রটি প্রেসের মালিক পরে ছাপতে অস্বীকার করেন।
একই দিনে কমিউনিস্ট পার্টির পাবনা জেলা কমিটির সদস্য প্রদীপ কুমার রায় (পূর্বে গ্রেফতারকৃত প্রণতি কুমার রায়ের ভাই) এবং মোসলেমউদ্দিন মোক্তার গ্রেফতার হন। (প্রদীপ কুমার রায় পরে ভারতে চলে যান এবং বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন। মোসলেমউদ্দিন মোক্তার বর্তমানে বেচে নেই) এই চারজনকে গ্রেফতারের পর পাবনার ভাষা আন্দোলনে গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা ৮ জনে উন্নীত হয়।
সরকারী দমননীতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের মধ্যেও প্রস্তুতি বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য সবাই গ্রেফতার এড়ানোর জন্য রাতে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রচারের চাইতে ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় বেশি।
১১ মার্চ সকালে ছাত্র কর্মীদেরকে কলেজ এবং স্কুলগুলিতে পাঠানো হয়। নির্দেশ দেয়া হয় মিছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে এসে উপস্থিত হলে সকলেই ক্লাস বর্জন করে মিছিলে যোগ দেবে।
এডওয়ার্ড কলেজের মাঠে ২০/২৫ জন ছাত্র শ্লোগান দেয়ার পর সমস্ত ক্লাস থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা বেরিয়ে আসে। ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল কম। তবু তাদেরকে মিছিলে আসতে নিষেধ করা হয়। এডওয়ার্ড কলেজ থেকে সকাল এগারটায় মিছিল বের হয়। এই মিছিলটি বিভিন্ন স্কুলের সামনে দিয়ে এগুতে থাকলে স্কুল ছাত্ররা পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী মত ক্লাস বর্জন করে মিছিলে যোগ দেয়। শেষ পর্যন্ত এক বিরাট মিছিল কোর্ট এলাকা হয়ে পাবনা জেলখানার পাশ দিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করার পর টাউন হলে এসে শেষ হয়।
মিছিলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই এবং পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এই তিনটি মাত্র লোগান দেয়া হয়। ১১ মার্চের কর্মসূচীতে প্রশাসন ও মুসলিম লীগ থেকে কোন বাধা দেয়া হয় না।
পাবনার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি
ভারত বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে পাবনার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি দ্রুত একটি আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
পাবনার অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি ছিল কৃষি। এর পাশাপাশি ইংরেজ শাসনামল থেকেই এখানে হোসিয়ারী শিল্প গড়ে ওঠে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে এই শিল্পের প্রভাব উল্লেখযোগ্য না হলেও শহরবাসীর এক বিরাট অংশ এই শিল্পের উপর নিভরশীল ছিলেন। হোসিয়ারী শিল্পের পণ্যের প্রধান বাজার ছিল ভারতের বাংলা, বিহার এবং আসাম প্রদেশ। পক্ষান্তরে এই শিল্পের তেমন কোন প্রতিযোগী ছিল না। ফলে পাবনা শহরে এই শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। পাবনার হোঁসিয়ারী শিল্পের মালিকেরা তাদের পণ্যের বাজার ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তারের জন্য চেষ্টা করেন। এই উদ্দেশ্যে প্যারিসে তারা একবার প্রদর্শনীরও আয়োজন করেন।
হোসিয়ারী শিল্পের পাশাপাশি এখানে অনেক বড় বিড়ি কারখানা গড়ে ওঠে। এই শিল্পের কাঁচা মালের সরবরাহের উৎসস্থল ছিল বর্তমান ভারত। ভারত বিভাগের ঘোষণার সঙ্গে বাংলা বিভাগের ঘোষণায় এই দুই শিল্পের বাজার এবং কাঁচামালের সরবরাহ কেন্দ্র ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল মালিক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা অর্থিক দিক থেকে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হন।
১৯৪৫ সালের নবেম্বর মাসের নির্বাচনের পূর্বে মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করে ছিলেনঃ “যে সমস্ত অঞ্চলে মুসলিম লীগ প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হবে, সেই সমস্ত অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট গঠিত হবে।”
তাঁর এই ঘোষণা এবং নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১৩টি আসনে মুসলিম লীগ অনোনীত প্রার্থীদের বিজয়ের পর সকলেই বাংলা প্রদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের বাংলা বিভাগের স্বীকৃতির পর পাবনার সকল মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
কলিকাতার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল উন্নত। পক্ষান্তরে ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে এই অঞ্চলের ব্যবসায়ী। চাকরিজীবী এবং ছাত্র সমাজের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল ছিল কলিকাতা। বাংলা বিভাগকে মেনে নিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনের ঢাকায় এসে ক্ষমতা গ্রহণের ঘটনায় অনেককেই দ্রুত নাজিমুদ্দিন বিরোধী করে তোলে।
ভারত বিভাগের পূর্বে এবং পরে পাবনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুন্ন ছিল। ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই জেলায় কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি।
নতুন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া
বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পরিষদের নেতা নির্বাচিত করেন। এই প্রদেশের প্রধান মন্ত্রী নিযুক্ত হন। উত্তরবঙ্গে পাকিস্তান আন্দোলন প্রধানতঃ তারই নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। বাংলা বিভাগের ঘটনায় প্রাদেশিক মুসলিম লীগেও বিরোধ সৃষ্টি করে। তৈরি হয় নাজিমুদ্দিন ও সোহরাওয়াদী গ্রুপ। মুসলিম ছাত্রলীগের মধ্যেও এই বিভক্তির প্রভাব পড়ে। পাবনা শহরেও মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়।
১৯৪৫ সালের নির্বাচনের পর অধিকাংশ কংগ্রেস নেতা ছেড়ে চলে যান। এক সময় এখানে এম, এন, রায়ের পার্টির প্রভাব ছিল। এই দল পাকিস্তান আন্দোলন করে। নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের সংগঠন তপশীলী ফেডারেশনও পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করে। দলের কয়েকজন সদস্যছাড়া পাবনা জেলায় তাদের কোন প্রভাব ছিল না। র্যাডিক্যাল পার্টিও শেষ পর্যন্ত হিউম্যানিস্ট পার্টিতে পরিবর্তিত হয়। এই সমস্ত কারণে প্রভাবশালী নেতাদের অধিকাংশই ছিলেন নিষ্ক্রিয়। তাদের মধ্যে ননী রায়, অবনী চৌধুরী ও নিতাই বিশ্বাসের নাম উল্লেখ করা যায়।
পাবনা জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির কিছুটা সাংগঠনিক শক্তি ছিল। স্বাধীনতার প্রশ্নে এই পার্টির মধ্যেও মত বিরোধ শুরু হয়। নতুন পরিস্থিতি এবং মতবিরোধের কারণে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকে।
এই পরিস্থিতিতে পাবনা শহরে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে অবস্থান করলেও এই দলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রভাব ছিল বেশী। তদুপরি মুসলিম লীগ ছিল সাংগঠনিকভাবে ছাত্র সমাজের ওপর নিভরশীল। ছাত্রদের প্রতি সাধারণ মানুষের ছিল অপরিসীম আস্থা। ফলে এখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাত্ররাই নিয়ন্ত্রণ করতেন।
এই পরিবেশে রাজশাহীর আতাউর রহমান ১৯৪৭ সালের শেষার্ধে (সম্ভবতঃ ৪ঠা নবেম্বর) ঈশ্বরদীতে এক যুব সম্মেলন আহ্বান করেন। প্রগতিশীল চিন্তার মুসলিম ছাত্ররাই ছিলেন এই যুব সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা। মুসলিম ছাত্রলীগের একাংশ এবং কমিউনিস্ট পার্টির কিছু সদস্য যুব সম্মেলনের উদ্যোগকে সমর্থন করেন। এরা বিশ্বাস করতেন নতুন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে প্রগতিশীল আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে প্রগতিশীল চিন্তার মুসলিম কর্মীদেরকেই নেতৃত্বে এগিয়ে আসতে হবে।
যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঈশ্বরদীতে মাড়োয়ারীদের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে। পাবনার মীর্জা আবদুল আউয়াল (বর্তমানে বি এন পি করেন) সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হন। সম্মেলনে দেড়শতাধিক যুব কর্মী যোগ দেন। ঈশ্বরদী থানা মুসলিম লীগের সম্পাদক মাহবুব আহম্মদ খান স্থানীয় ভাবে সম্মেলনের প্রস্তুতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আতাউর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা থাকায় তিনি ঈশ্বরদীতে অবস্থান করেও সম্মেলনে যোগ দিতে পারেন না।
এই সম্মেলনেই মুসলিম লীগ বিরোধী একটি গণতাগ্রিক যুব সংগঠনের জন্ম হয়। সংগঠনের নাম দেয়া হয় গণতান্ত্রিক যুব লীগ।
জনাব শামসুল হক (আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক), আতাউর রহমান (জীবিত নেই)ও মাহবুব আহম্মদ খান (পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং এবং ন্যাপে যোগ দেন) নব গঠিত গণতান্ত্রিক যুবলীগের যথাক্রমে সভাপতি সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন।
যুব সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতৃত্বের মধ্যে গাজীউল (বগুড়া), একরামুল হক (রাজশাহী), মঞ্জরুল হক ও মোহাম্মদ ইব্রাহিম (নওগাঁ), মমিনুল হক (ফরিদপুর). মোসাদ্দেক হোসেন (সিলেট), সয়েরউদ্দিন (দিনাজপুর অথবা রংপুর), আমিনুল ইসলাম বাদশা (পাবনা) ও মাহবুবুল হক এবং মোজাম্মেল হকের (কলিকাতা) নাম উল্লেখযোগ্য।
কলিকাতা থেকে দুজন শিল্পী যুব সম্মেলনে যোগদান করেন। তার মধ্যে রাজিয়া বেগমের গাওয়া, নাকের বদলে নয়ুন পেলাম ডাকডুমাডুম ডুম গান দিয়ে সম্মেলন উদ্বোধন করা হয়।
ঈশ্বরদী বাজারে প্রকাশ্য অধিবেশন শুরু হয়। মোমিনল হক উদ্বোধনী বক্তৃতা করার পরই গ্রেফতার হন। এর পর পরই ঈশ্বরদীর আহম্মদ মোল্লার নেতৃত্বে মুসলিম লীগের কর্মীরা সভায় হামলা করে ও সবকিছু ভেঙ্গে দেয়। পরদিন ঈশ্বরদীর যুব কর্মী সাজেদুর রহমান ডোরাকেও গ্রেফতার করা হয়। পরে উভয়েই জামিনে মুক্তি লাভ করেন।
কিছুদিন পর আতাউর রহমানের উপস্থিতিতে গণতান্ত্রিক যুবলীগের পাবনা শাখা গঠিত হয়। মাহবুবর রহমান খান পাবনা শাখার সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ভাষা প্রশ্নে দেশবিভাগপূর্ব বিতর্ক
ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ শাসনের আনুষ্ঠানিক অবসানের পর্বেই ভাষা প্রশ্নে বিতর্ক শুরু হয়।
ভারতীয় গণ-পরিষদের কংগ্রেস দলীয় সদস্যগণ ভারতীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দীকে গ্রহণের পরামর্শ দেন। মহাত্মাগান্ধী এবং কয়েকজন নেতা উর্দু এবং দেবনাগরী অক্ষরে নতুন ভারতীয় ভাষা প্রচলনের পক্ষে মতামত দেন। পাকিস্তান ডোমিনিয়নে কি রাষ্ট্রভাষা হবে সে সম্পর্কে মুসলিম লীগ নেতারাও গোপনে পরামর্শ করেন।
কিন্তু প্রকাশ্যভাবে ডঃ জিয়াউদ্দিন আহম্মদ পাকিস্তান ডোমিনিয়নের প্রত্যেক প্রদেশের বিদ্যালয়ে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দুকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করার পরামর্শ দেন।
ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেই পাকিস্তান ডোমিনিয়নের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে গ্রহণের অনুরোধ জানান।
দুই নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে এই বিতর্ক বেশীদিন স্থায়ী হয় না। তবু বাংলার প্রশ্নটি বাংলা ভাষাভাষী সকল সম্প্রদায়ের মনে দানা বাঁধতে শুরু করে। পাকিস্তান এবং ভারত কোন রাষ্ট্রেরই নেতৃবন্দ বাংলাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় বাঙ্গালী জাতি সত্বার প্রশ্নটি আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়।
পাবনার ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক প্রস্তুতি
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী তারিখে পাকিস্তান গণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বিতর্ক হয়। কংগ্রেস গণপরিষদ সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজী ভাষার সঙ্গে বাংলাকেও অন্যতম ভাষা হিসাবে গ্রহণের প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন পূর্ব বঙ্গেরই খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি বলেনঃ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসী উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চায়। তার এই উক্তির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
পারস্পরিক আলোচনার পর ছাত্র নেতৃবন্দ পাবনা জেলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান লুৎফর রহমানের বাসায় ২৬শে ফেব্রুয়ারী তারিখে এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে ২৯শে ফেব্রুয়ারী তারিখে খাজা নাজিমুদ্দিনের উক্তির প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়। স্থির করা হয় ২৭শে ফেব্রুয়ারী তারিখে অর্থাৎ পরদিন টাউন হলে সবাইকে ডেকে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত এবং কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে।
পরদিন টাউন হলে দেওয়ান লুৎফর রহমান সাহেবের সভাপতিত্বে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক যুব লীগ, মুসলিম ছাত্রলীগ, ছাত্র ফেডারেশন ও ছাত্র কংগ্রেস এই বৈঠকে সংগঠনগতভাবে যোগ দেয়। রাজনৈতিক দলের মধ্যে মুসলিম লীগ কমিউনিস্ট পার্টি এবং র্যাডিকেল ডেমোক্রেটিক পার্টির কিছু সদস্য এই বৈঠকে যোগ দেন।
সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। মাহবুবর রহমান খান এবং আমিনুল ইসলাম বাদশা এই কমিটির যুগ্মআহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ২৯শে ফেব্রুয়ারী তারিখের প্রতিবাদ দিবসে হরতাল, মিছিল ও জনসভা অনুষ্ঠানের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়।
রাষ্ট্রভাষা দাবীর প্রকাশ্য বিরোধিতা
নাজিমুদ্দিন সমর্থক মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
পাবনা শহরের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা মাওলানা আবদুল্লাহেল কাফী সাহেব বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীর প্রকাশ্য বিরোধীতা করেন। তিনি তার সকল অনুগামীদেরকে হরতাল পালন না করার নির্দেশ জারী করে এক প্রচারপত্র বিলি করেন। এই প্রচারপত্রে তিনি আরবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণের দাবী জানান।
ইতিমধ্যে মুসলিম হাই কমান্ড থেকে প্রতিবাদ দিবস পালনের বিরোধিতা করার নির্দেশ আসে। পাবনা জেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়।
২৮শে ফেব্রুয়ারী সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়কদ্বয়কে ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট তার বাসায় ডেকে পাঠান। ঢাকা থেকে নির্দেশিত হয়ে মুসলিম লীগ নেতৃবন্দ পূর্বাহ্নেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট এমদাদ সাহেব সংগ্রাম পরিষদ নেতৃ বন্দকে প্রতিবাদ দিবস পালনের কর্মসূচী প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেন। দেওয়ান লুৎফর রহমান সাহেবও পরিষদ নেতৃদ্বয়কে একই অনুরোধ করেন। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কদ্বয় তাদের পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দও তাদের ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করেন। তাদের কয়েকজন উর্ধ্বতন মহলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নটি উত্থাপন করবেন বলেও আশ্বাস দেন। জেলা প্রশাসক ও মুসলিম লীগ নেতাদের এই প্রস্তাব নিজেদের মধ্যে আলোচনার আশ্বাস প্রদানের পর বৈঠক শেষ হয়।
বৈঠক থেকে ফিরে আসার পর পরই শহরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। প্রশাসনের এই আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডে ছাত্ররা বিক্ষুদ্ধ হন এবং দেওয়ান লৎফর রহমানের বাড়ীতে উপস্থিত হয়ে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের দাবী জানান। ছাত্রদের এই দাবী প্রত্যাখান করা হয়।
২৯ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে পাবনা শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এই শহরের সকল যান বাহন, শিল্প কল-কারখানা দোকান পাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অফিস আদালত বন্ধ থাকে। মওলানা আবদুল্লাহেল কাফী সাহেবের মাত্র তিনজন অনুগামী তাদের দোকান খোলা রাখেন। এই দিন শহরে সাইকেল পর্যন্ত চলেনি।
সকালে ছাত্ররা এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে সমবেত হন। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে মিছিল করা উচিৎ কিনা এই প্রশ্নে ছাত্র নেতাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের কয়েকজন মিছিল না করার পক্ষে মত দেন। মাহবুবর রহমান খান মিছিল করার পক্ষে এবং মিছিলে যোগদান করার জন্য ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানান। মুসলিম ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা ফজলুল আজীম (বি এ পাস করার জন্য লণ্ডনে ব্যারিস্টারী পড়তে যান এবং এখনও বিদেশে অবস্থান করছেন) মাহবুবর রহমানকে সমর্থন জানানোর পর চারজনের এক একটি দলে মিছিল বের হয়। মিছিল আস্তে আস্তে বড় হয়। মিছিলকারীদের সমবেত কণ্ঠে প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়।
বন্দীমুক্তি ও অভ্যুর্থনা
১৯শে মার্চ ৮ জন রাজবন্দী কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। পাবনা টাউন হলে তাদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কেবলমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদেরকে মাল্য ভূষিত করা হয়। এই ঘটনায় উপস্থিত সকলের মধ্যে বিক্ষোভের সৃষ্টি করে। সদ্য কারামুক্ত অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এই আচরণের প্রতিবাদে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ত্যাগ করে চলে যান।
এভাবেই সাফল্য ও সংকীর্ণতার মধ্যদিয়ে এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের সাময়িক সমাপ্তি ঘটে।