রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮-৫২ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫
মুহাম্মদ একরামুল হক
গত বছর বিচিত্রার একুশে ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় জনাব গাজিউল হক এবং জনাব এম আর আখতার মুকুল তাদের প্রবন্ধে মরহুম মোহাম্মদ সুলতান এবং রাজশাহীর কথা লিখেছেন। তাদের প্রবন্ধ পড়ে আমি দেখেছি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে যারা ঢাকায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের অনেকেরই রাজনৈতিক জীবনের শুরু রাজশাহী কলেজে। যেমন, মোহাম্মদ সুলতান, হাবিবুর রহমান শৈলী (হাইকোর্টের বিচারপতি), সৈয়দ মোহাম্মদ (সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারপতি), এস এ বারী এ টি, গোলাম তোয়াব (প্রাক্তন এয়ার ভাইস মার্শাল), তোফাজ্জল হোসেন প্রধান তুফুল প্রমখ। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৪৭-৪৮ সালে ঢাকার পরে রাজশাহী কলেজ এবং রাজশাহীর অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ ১৯৪৬-এর ১৬ই আগস্ট কলকাতায় রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার পরে প্রেসিডেন্সী ও ইসলামিয়া কলেজ থেকে বহু ছাত্র রাজশাহী কলেজে চলে এসেছিল। তাছাড়া, রাজশাহী বিভাগের একমাত্র সরকারী কলেজ হিসেবে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, পাবনা কুষ্টিয়া, যশোর থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা রাজশাহী কলেজেই পড়তে আসতো।
ভাষা আন্দোলনে রাজশাহী কলেজ এবং রাজশাহীর যে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, তা সংক্ষিপ্ত হলেও সঠিকভাবে কিছুটা লিখেছেন গবেষক-লেখক বদরুদ্দিন উমর। কিন্তু আমার মনে হয়, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতি এবং ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীর ভূমিকা লিপিবদ্ধ হওয়া উচিত। কারণ সেকালের রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে আমি ছাড়া আর হয়ত দুএকজন এখনও বেচে থাকতে পারেন, বাকি সকলে ইন্তেকাল করেছেন।
১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্ট আমি রাজশাহী কলেজে দ্বিতীয় বর্ষ বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। সম্ভবতঃ তখনও আতাউর রহমানে নাম কলেজের খাতায়। আতাউর রহমানকে বাদ দিয়ে রাজশাহীতে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল আন্দোলনের ইতিহাস লিখিত হতে পারে না। অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ, রাজশাহী জেলা শাখার আমি ছিলাম সভাপতি। দেশ বিভাগের সময় মুসলমান ছাত্রদের তখন ওই একটিমাত্র রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ছিল। তখন রাজশাহী জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন মরহুম আবদুল হামিদ মিয়া (১৯৭৫-এ নিহত আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামানের পিতা) এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মরহুম মাদার বকশ (উকিল) তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে প্রভাবখালী ছিলেন মরহুম আজিজুল আলম, মরহুম কছিরউদ্দিন মৃধা, মরহুম আবদুস সামাদ। তারা সকলেই ছিলেন আইনজীবী। অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে ছিলেন মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের জেলা প্রধান এমরান আলী সরকার। ক্যাপ্টেন শামসুল হক ও মোছাদ্দারুল হক। কিন্তু মুসলিম লীগের ছদ্মাবরণে যাবতীয় রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সক্রিয় যুবনেতা ছিলেন মরহুম আতাউর রহমান, যাঁকে বলা যায় রাজশাহীর প্রথম ও তৎকালীন একমাত্র অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা। নেতারা সাজানো সভায় বক্তৃতা করতেন, কিন্তু সাংগঠনিক তৎপরতার মূলে সমগ্র জেলায় প্রাণবিন্দু ছিলেন আতাউর রহমান। আমি স্কুল জীবনেই তাঁর সংস্পর্শে আসি এবং ধীরে ধীরে গোপনে ১৯৪৭ সালের মধ্যেই কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ি।
১৯৪৬-এর ১৬ই আগস্ট কলকাতা ও অন্যান্য স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে কলকাতা থেকে বহু ছাত্র এবং অধ্যাপক রাজশাহী কলেজে চলে আসেন। এদের মধ্যে বহু ছত্র ও অধ্যাপক ছিলেন মার্কসবাদী। কিন্তু রাজশাহীতে এসে তারা নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রাখেন।
স্থানীয় হিন্দু এবং নবাগতদের মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যায় প্রগতিশীল কর্মী থাকলেও, তখন স্থানীয় মুসলমান প্রগতিশীল কর্মীর সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য। কিন্তু ১৯৪৭ সালেই আতাউর রহমানের প্রভাবে দেখা দেন আবুল কাশেম চৌধুরী (বর্তমানে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), তার ছোট ভাই আবুল কালাম চৌধুরী (পরে রাজশাহী জেলা বিএনপির সভাপতি, বিশিষ্ট আইনজীবী, গত ১২ই জুলাই ১৯৮৪ ক্যান্সারে মৃত), নুরুল ইসলাম, কসিমুদ্দিন আহমদ। আরও দুচারজনের নাম এখন মনে নেই। তখন প্রকাশ্যে ছাত্র ফেডারেশন করতেন আবদুল লতিফ (এখন হোমিও ডাক্তার) এবং ডঃ এবনে গোলাম সামাদ (এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)। নবাগত ছাত্রদের মধ্যে যারা পরিচিত হয়ে উঠলেন তাদের মধ্যে মোহাম্মদ সুলতান, গেলাম রহমান (সুলতান ভাইয়ের বড় ভাই), হাবিবুর রহমান শেলী, জিল্লুর রহীম (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কিছুদিন পূর্বে মরা গেছেন), গোলাম তোয়াব (প্রাক্তন এয়ার ভাইস মার্শাল), ওয়াজেদ আলী (পরে সিএসপি), মতিউর রহমান (রংপুর), তোফাজ্জল হোসেন প্রধান (রংপুর), হাসনা বেগম (বগুড়া) প্রমুখ।
১৯৪৮-এর মার্চে উর্দু ভাষার পক্ষে খাজা নাজিমুদ্দিনের উক্তির পরে ঢাকায় যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, তার প্রতিক্রিয়া রাজশাহীতেও প্রবলভাবে দেখা দেয়। আমরা রাজশাহী কলেজে এবং শহরের স্কুলসমূহে হরতালের ডাক দেই। কলেজ গেটে আমরা ‘পিকেটিং’ করছিলাম। মনে পড়ছে, আমি গেটে শুয়ে পড়ে ‘পিকেট’ করার সময় সুরাইয়া নামে একটি ছাত্রী আমার বুকের ওপর দিয়ে ডিঙ্গিয়ে কলেজে প্রবেশ করায় ছাত্রদের হাতে নাজে হাল হয়। কলেজের শতকরা ৭০ ভাগ ছাত্র হরতালে সাড়া দেয়। তখন পড়ুয়া ছাত্র ক্লাশ নষ্ট করতে চাইতো না। এরপর আমি মিছিল বের করি। কিন্তু দরগাপাড়া ফায়ার ব্রিগেডের মোড়ে আমাদেরকে ভারতের চর এবং কম্যুনিস্ট আখ্যা দিয়ে গুন্ডারা আক্রমণ করে এবং মিছিল ভেঙ্গে দেয়।
লক্ষণীয় ব্যাপার, তখন যারা ভাষা আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা নিয়েছিলেন তারা বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারীতে অনেকেই ভাষা অন্দোলনের পক্ষে চলে এসেছিলে। এদের কথা পরে বলছি।
মিছিলে মার খাওয়ার পরে আমরা স্থানীয় ভূবন মোহন পার্কে জনসভা আহ্বান করলাম। তারিখ আজ মনে নেই।। মুসলিম লীগ নেতৃবন্দ আমাদেরকে হিন্দুদের ক্রীড়নক হিসেবে অভিযুক্ত করে সাবধান করে দিলেন। ক্যাপ্টেন শামসুল হক (সম্পর্কে আমার মামা) আমার মায়ের কাছে বলে গেলেন, আজকের জনসভা করলে একরামূলের লাশ ফিরে আসবে। স্থানীয় গুন্ডারাও আমাদের কর্মীদের ভীতি প্রদর্শন করল। জনসভায় দেখলাম প্রচুর জনসমাগম হয়েছে। কিন্তু পার্কের পূর্ব দেয়ালে কম্যুনিস্ট পার্টি পূর্ব-রাত্রেই গোপনে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান লিখে প্রচুর পোস্টার সেটে দিয়েছে।
কলকাতা থেকে আগত রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক জামান। এবং অর্থনীতির অধ্যাপক সফিউর রহমান আমাকে বলেছিলেন, জনসভা করতেই হবে। আতাউর রহমান সাহেব আন্ডার গ্রাউন্ড কে বিস্তৃত নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। জনসভায় সভাপতিত্ব করলেন মোহাম্মদ সুলতান। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন গোলাম রহমান, গোলাম তোয়াব, কশেম চৌধুরী এবং আরও অনেকে। আমি সভা পরিচালনা করছিলাম। আক্রমণের আশঙ্কায় তুফুলের নেতৃত্বে একদল ছাত্র শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তারা অধিকাংশই স্থানীয় ছাত্র নয়। ক্যাপ্টেন শামসুল হক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন আশঙ্কায় আমি কৌশলে আমার বক্তৃতার আগে তাকেই বক্তৃতা দেবার জন্য আহ্বান জানালাম। তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির পোস্টারগুলোর দিকে আঙুল তুলে বললেন, বাংলা ভাষার আন্দোলন যারা করছে তারা ভারতের চর। সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিল। ক্যাপ্টেন শামসুল হকের পরে আমি বক্তব্য রাখলাম। তখন আমি তরুণ বক্তা হিসেবে নাম ছিল। আমার যুক্তি, বিশ্লেষণ, বাগধারা জনগণকে অভিভূত করল। বোধহয় সেদিন আমার জীবনের একটি সার্থক বক্তৃতা ছিল। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের চেষ্টা ব্যর্থ হলো।
১৯৪৮-এর মাঝামাঝি রাজশাহী কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন হলো। নির্বাচনে আমাদেরকে কম্যুনিস্ট আখ্যায়িত করা হলো। কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ডঃ মমতাজউদ্দিন আহমদ এবং ছাত্র সংসদের দায়িত্বে নিয়োজিত অধ্যাপক ডঃ এ আর মল্লিক সরকারী নীতি অনুযায়ী আমাদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করে প্রকাশ্যে প্রচারণা করলেন। ভাষা আন্দোলনের যারা বিরোধিতা করছিল তারা পাকিস্তানের অস্তিত্বের জিগির তুললো। অবাঙালী ছাত্রনেতা কুখ্যাত আখতার আহাদ আমার বিরুদ্ধে নির্বাচন প্রার্থী হয়েছিল, সে বিপুল ভোটে পরাজিত হলো। সুলতান ভাই এবং হাসনা বেগম জিতলেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমাদের দল ২১টি আসনের মধ্যে মাত্র ৩টি আসনে জয়ী হলো।
নির্বাচিত ছাত্র সংসদের প্রথম সভায় সুলতান ভাই প্রস্তাব তুললেন বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে এবং এই প্রস্তাব ছাত্র সংসদের কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ করতে হবে। প্রস্তাবটি আমি এবং হাসনা বেগম সমর্থন করলাম। অন্যান্য সদস্যরা সাধারণ ছাত্রদের ভয়ে নীরব রইল। কিন্তু ডঃ মমতাঙ্গউদ্দিন আহমদ প্রস্তাবটি সংসদের কার্যবিবরণীতে রেকর্ড করতে রাজী হলেন না। অবশ্য ইতিমধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার বিখ্যাত ঘোষণা দিয়েছেন—উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।
উপরোক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিছিল এবং হরতাল প্রায় প্রতিদিনকার ঘটনায় পরিণত হলো। কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের দলের ১৫/১৬ জন ছাত্রকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করলেন। এর প্রতিবাদে আমরা ৩৬ জন ছাত্র কলেজের প্রশাসন ভবনে ঢুকে আমরণ অনশন ধর্মঘট ঘোষণা করলাম। রাজশাহী শহরে বিশেষ করে রাজশাহী কলেজে এই অভূতপূর্ব অনশন শহরের সকল শ্রেণীর মানুষের সহানুভূতি আকর্ষণ করল। ক্ৰমশঃ ভীড় বাড়তে আরম্ভ করলো। ঘন্টায় ঘন্টায় মাইকে অনশনকারীদের অবস্থা ঘোষণা করা আরম্ভ হলো। এভাবে ৫০ ঘন্টা অতিক্রান্ত হলে ডাক্তার আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলেন। আমি অস্বীকার করলাম। স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতারা এলেন। বোঝলেন। কিন্তু আমরা অবিচল। অবশেষে ৬০ ঘন্টা অতিক্রান্ত হলে মরহুম মাদার বকশ সাহেব অধ্যক্ষের ঘর থেকে ফোনে খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে কথা বললেন। খাজা নাজিমুদ্দিন আমাদের দাবীসমূহ মেনে নিলেন এবং বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করবার স্বপক্ষে থাকবেন বলে কথা দিলেন। এভাবেই রাজশাহীতে প্রগতিশীল আন্দোলন বিজয়ের পথে অগ্রসর হলো।
এর কিছুদিন পরেই আমাদের দলের ছাত্র নেতাদের কলেজ থেকে বহিষ্কার এবং পুলিশ দিয়ে শহরের বাইরে ফেলে দিয়ে আসা হয়। আমি তখন আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে গিয়েছি এবং রেল শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে ব্যক্ত করছি। বলা বাহুল্য, এ সময়টা আমি আতাউর রহমানের সঙ্গে থাকতাম। কিন্তু আতাউর রহমান শহরে সরকারী কর্মচারী সমিতির গোপন সভায় যোগদান করতে এসে গ্রেফতার হন। তাকে গ্রেফতারে পুলিশকে সহায়তা করেছিল মোছাদ্দারুল হক। তিনি তখন ‘নয়াজামানা’ নামে একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদক। পরে এই ভদ্রলোকের রাজনৈতিক মতবাদ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ওঠে। উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালে চরম সাম্প্রদায়িক ছাত্রনেতা ছিলেন জহিরুল হক (কুষ্টিয়া), আখতার আহাদ (অবাঙালী, ইনি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জঘন্য ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত হন এবং ১৯৭১-এ রাজশাহী গিয়ে বহু পরিবারের সর্বনাশ করেন।) বদিউজ্জামান টুনু (পরে আওয়ামী লীগ এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা), রুহুল আমীন, এস এম গাফফার (পরে ভাষা আন্দোলনের নেতা), অ-ছাত্র নেতাদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টিকারী ছিলেন মোছাদ্দারুল হক ,ক্যাপ্টেন শামসুল হক এবং আরো অনেকে।
১৯৪৯-এ আতাউর রহমান গ্রেফতার হবার তিন মাস পরে আমি পুলিশের হাতে ধরা পড়লাম। জেল গেটে অফিসে ঢুকে দেখি আতাউর রহমান মুক্তি পাচ্ছেন আর আমি ঢুকছি। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু দেখলাম আতাউর রহমান জেলগেট থেকে বের হয়েই পুনঃগ্রেফতার এবং পুনঃপ্রবেশ করে বললেন আকরাম সাহেব ৩০ দিন পর পর কয়েক মিনিটের জন্য আমি মুক্তি পাই। এটা তাই পুনরাভিনয়। রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে বিখ্যাত খাপড়া ওয়ার্ডে আমি পরিচিত হই হাজী দানেশ এবং দিনাজপুর তেভাগা আন্দোলনের বিখ্যাত নেতাদের সঙ্গে।
ছ’মাস পরে ছাড়া পাবার পর আমি কলকাতা পালাতে বাধ্য হই এবং ১৯৫০-এর দাঙ্গার সময় ঢাকা থেকে রাজশাহী ফিরে আসি। মাদার বকশ সাহেবের প্রচেষ্টায় এবং ডক্টর জুবেরীর সম্মতির ফলে পুলিশের বাধা সত্ত্বেও আমি আবার রাজশাহী কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে পারি।১৯৪৭—৪৮ এর সহকর্মী সুলতান ভাইয়েরা তখন ঢাকার ছাত্রনেতা। কিন্তু নিয়মিত যোগাযোগ থাকত।
গতবছর একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় বিখ্যাত সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাংগঠনিক কাজে তিনি উত্তরবঙ্গে গিয়ে রাজশাহীতে আতাউর রহমান ও আমাকে পাননি, অর্থাৎ ইউজি ছিলাম। তারিখ আমারও মনে নেই। কিন্তু মনে আছে ইউজি যাবার আগে গণতান্ত্রিক যুব লীগ গঠন করে রাজশাহী বিভাগের কনভেনর হিসেবে আমি ঈশ্বরদীতে সম্মেলন ডেকেছিলাম। প্রস্তুতি হিসেবে সম্মেলনের পূর্বদিন ঈশ্বরদী বাজারের কাছে আমরা জনসভা করছিলাম। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল চক্র আক্রমণ করে সভা ভেঙ্গে দেয়। পরদিন হাইস্কুল প্রাঙ্গনে রেল শ্রমিকদের প্রহরায় সম্মেলন করেছিলাম। ঈশ্বরদীর জনাব মাহবুব এবং শ্রমিক নেতা জসীমউদ্দিন এ-কাজে সক্রিয় সহায়তা করেছিলেন।
জনাব আখতার মুকুল এ প্রসঙ্গে এস এ বারীর কথা উল্লেখ করায় মনে পড়ছে। ১৯৪৯ সালে জেল থেকে ছাড়া পাবার পর পরই এস এ বারী (তিনি তখন রাজশাহী কলেজের ছাত্রদের কাছে এসে বললেন, মার্কসবাদ সম্পকে বুঝতে চান। আমি তাকে প্রথমে সরকারী চর মনে করে এড়িয়ে যাই। পরে পরিচয় পেয়ে আলোচনা করি এবং বই দেই।
আরও একটি রাজনৈতিক ঘটনা উল্লেখযোগ্য, ১৯৪৮-এর জানুয়ারী মাসে কলকাতায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলন হচ্ছিল। সঙ্গতি রেখে আমরাও রাজশাহীতে একটি যুব সম্মেলন আহ্বান করি। এখানেও সুলতান ভাই, কাশেম চৌধুরী এবং আমরা ছাড়াও ছাত্র ফেডারেশনের প্রণব চক্রবর্তী, গীতা চক্রবর্তী , অরুণ মুন্সী প্রমুখ এর সাংগঠনিক কাজে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু প্রকাশ্য অধিবেশনের দিন অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সামনে পার্কে প্রকাশ্য অধিবেশন কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ ভিয়েতনামের সংগ্রামী গেরিলা নেতা মাই থে চাউ সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য এসে গেছেন। এই পরিস্থিতির মধ্যে হঠাৎ খবর এলো যে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছে। অবস্থার পরিবর্তন হলো। আমরা পরদিন শোকসভা এবং প্রকাশ্য অধিবেশন করলাম ভুবন মোহন পার্কে এবং মাই-থে-চাউকে দিয়ে বক্তৃতা করালাম। বক্তৃতার অনুবাদ করলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী, ১৯৭১-এ পাক-বাহিনীর হাতে নিহত এ্যাডভোকেট বীরেন্দ্রনাথ সরকার।
এখন ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের বর্ণনা দেব। ১৯৫২ তে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ছাত্র এবং রাজনৈতিক কর্মীর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। একটির পর একটি আন্দোলন গণতান্ত্রিক শক্তিকে আরও শক্তিশালী করেছে। ১৯৪৭–৪৮-এর সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল বহু ছাত্র ও স্থানীয় নেতারা অনেকেই তখন বাংলা ভাষার দাবীতে সোচ্চার এবং ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে কথা বলার শক্তি তখন দুর্বল। আমার তখনকার কাজ ছিল মূলত ক্যাডার তৈরি করা। আতাউর রহমান ও কাশেম চৌধুরী মাঝখানে ছাড়া পেয়ে আবার জেলে রয়েছে। ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে ঢাকা থেকে সংগ্রাম পরিষদ একুশে ফেব্রুয়ারী সারা দেশ ব্যাপী হরতালের ডাক দিয়েছিল। মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্র এস এম গাফফারের নেতৃত্বে তখন একুশের হরতাল সার্থক করে তুলবার জন্য শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং মফস্বলে ছাত্র কর্মীদের পাঠিয়ে প্রচার কাজ তীব্র থেকে তীব্রতর করা হচ্ছিল। মেডিক্যাল স্কুলের মোহসেনা বেগম, রাজশাহী কলেজের হাবিবুর রহমান, জড়ান্দন আহমদ (এখন অধ্যাপক এবং নাট্যকার), আবদুর লতিফুর রহমান মল্লিক, আবুল কালাম চৌধুরী, সাঈদ আহমদ, আবু সাঈদ, আবুল হোসেন ইত্যাদির নাম মনে পড়ছে। আন্দোলনের প্রধান-কেন্দ্র ছিল রাজশাহী কলেজ হোস্টেল থেকে কর্মীরা প্রতিদিন বিভিন্ন স্কুলে এবং মফস্বলের স্কুলগুলোতে ছাড়িয়ে পড়তো। পোস্টারে পোস্টারে এই প্রথম শহরের রাস্তার দেয়াল ভরে উঠলো। তখন দেয়ালে লেখা হতো না। খবরের কাগজে লিখে দেয়ালে লাগানো হতো। কিন্তু তখনও বহু ছাত্র ও জনসাধারণের মধ্যে অনেকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবী সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিল। একুশে ফেব্রুয়ারী যতই এগিয়ে ছাত্র মিছিল এবং প্রচার ততই তীব্র হচ্ছিল। একুশে ফেব্রুয়ারী রাজশাহী শহরে শিক্ষাঙ্গনে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। মিছিলে কোন বাধার সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু সন্ধ্যার মূহুর্তে খবর প্রচারিত হলো রাজধানী ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহত হয়েছে। খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র শহর হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। দোকানপাট বন্ধ হলো। কলেজ হেস্টেলে ছাত্র নেতৃবন্দের সভা হলো। স্থির হলো পরবর্তী কর্মসূচী। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দেয়া হলো এস এম গাফফার ও হাবিবুর রহমানের ওপর। পরদিন জনসভা ও মিছিল। হরতাল চলবেই। পরদিন বিকেলে জনসভায় হাজির হলেন মুসলিম লীগের নেতা ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য মাদার বকশ, জননেতা ক্যাপ্টেন শামসুল হক এবং আরও অনেকে। জনসভায় অনেকেই বক্তৃতা করলেন। সভায় তিল ধারণের জায়গা নেই। উল্লেখ্য, পৌরসভার একজন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক আবদুস সাত্তার বক্তৃতা মঞ্চে উঠে আবেগ শিহরিত কণ্ঠে বললেন, নুরুল আমিন, তুমি কত রক্ত চাও? দরকার হলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আমরা গ্যালনে গ্যালনে রক্ত দেব।
২২শে ফেব্রুয়ারী রাজশাহী শহরে সর্বপ্রথম কেবলমাত্র মুসলমান ছাত্রীদের এক দীর্ঘ মিছিল বের হলো। নেতৃত্ব দিলেন মেডিক্যাল স্কুলের মোহসেনা বেগম। সেদিন বিকেলের জনসভায় কালো শাড়ি পরে অগ্নি-খরা ভাষায় বক্তৃতা দিলেন রাজশাহীর ইতিহাসে প্রথম মহিলা-বক্তা মেহেসেনা বেগম। ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো গ্রামে-গঞ্জে-হাটে। দলে দলে ছাত্ররা গ্রামের দিকে যেতে আরম্ভ করল। ভাষা আন্দোলন তখন এত তীব্র হয়ে উঠতে পেরেছিল মাত্র একটি কারণে—একুশে ফেব্রুয়ারী গুলিতে ছাত্র হত্যার জন্য।
২৯শে ফেব্রুয়ারী খুব সকালে আমি গ্রেফতার হলাম। পুলিশ লাইনে গিয়ে দেখলাম এমএলএ মাদার বকশ, ক্যাপ্টেন শামসুল হক, পৌর কর্মচারী আবদুস সাত্তার, ছাত্রনেতা এস এম গাফফার, হাবিবুর রহমান, আবুল হোসেন এবং আরো জনাত্রিশেক ছাত্র। আরও ছিলেন জননেতা মজিবর রহমান (বর্তমানে পৌরসভার চেয়ারম্যান)। পুলিশ লাইনে চা খেতে খেতে বললাম, জেলখানায় এবার জমবে ভাল। কিন্তু আইন সভার সদস্য মাদার বকশকে দেখলাম গম্ভীর, মুখের চেহরা অপমানে ক্রোধে লাল। আমার কথায় সবাই হেসে উঠলো। কিন্তু তিনি নীরব রইলেন।