সিরাজ সিকদার হত্যার নেপথ্য কাহিনী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৬ জানুয়ারি ১৯৮১
————————–
কে, এ, কবীর
সিরাজ সিকদারের রাজনীতির মূল্যায়ন এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু। তবে নিঃসন্দেহে বলা চলে সিরাজ সিকদার এদেশের জনগণের অন্তরের গোপনতম সেল্গারে পাকাপোক্ত আসন করে নিয়েছেন। যা শুধু দেশের নয়, উপমহাদেশের অনেক বামপন্থী নেতা ঈর্ষার কারণ ঘজাতে পারে। সিরাজ সিকদার এখন একটি নাম নয়। এ উপমহাদেশে সিরাজ সিকদার বিপ্লবের প্রতীক, শহীদ দেশপ্রেমিকের প্রতীক।
দেশের ব্যাপক জনগণ বন্দী অবস্থায় তার নির্মমভাবে হত্যা হওয়াটাকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। পারেনি বলেই ‘৭৫-এর ওলট-পালটের পর প্রতিটি সভা-সমিতিতে, পরবর্তীতে প্রেসিডেনশিয়াল ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে সিরাজ সিকদার হত্যার শাস্তি দাবি ছিল একটা প্রধান ইস্যু। এখনো প্রতিবছর বিভিন্ন দল ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ২রা জানুয়ারি সিরাজ সিকদারের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে।
ভবিষ্যতে এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের কোন প্রতিকার হবে আপাতঃ তেমন কোন ভরসাও কোন পক্ষ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, তার ধরা পড়ার রহস্যেরও কোন সুরাহা এখনো হয়নি। এই দুর্ঘটনার জন্য শুধুমাত্র সিরাজ সিকদারের পার্টি পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির অভ্যন্তরে বিশ্বাসঘাতক অস্তিত্বকে ভাসা ভাসা ভাবে দায়ী করা হয় । এটা একটা ধারণা। এমন অনেক ধারণা গুজব হিসেবে শোনা যায়। প্রকৃত দায়ী কে, সেটা এখনো সিরাজ সিকদারের গোপন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মতো গোপনই রয়ে গেছে। সিরাজ শিকদারের প্রাক্তন সহকর্মীদের থেকে এবং তার মৃত্যুর পরে দলের দলিলে প্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট সমস্ত তথ্য এই প্রতিবেদনের সন্নিবেশিত করে সম্ভাব্য দায়ী ব্যক্তিকে ট্রেস করতে চেষ্টা করা হয়েছে তবে তথ্যগুলি অনেক জায়গায় দুঃখজনকভাবে পরস্পরবিরোধী।
শুরু করার আগেই উল্লেখ করা প্রয়োজন, সিরাজ সিকদার বুলেটের আঘাতে নিহত হননি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, চরম দৈহিক নির্যাতনের ফলে তৎকালীন রক্ষীবাহিনীর হাতে তিনি নিহত হন। নির্যাতনের ফলে মৃত্যুর সময় সিরাজ সিকদারের শরীরের চামড়া মাংস থেকে আলাদা হয়ে যায়। একটি সংশ্লিষ্ট ডাক্তার অত্যাচারের বীভৎসতা দেখে রক্ষী বাহিনীর হাত থেকে সিরাজ সিকদারের মৃতদেহ পোস্টমর্টেমের জন্য গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। প্রাপ্ত তথ্য থেকে ধারণা করা যায়, তার মৃতদেহের উপরই গুলি চালানো হয়েছিল।
শৃঙ্খলা
সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর প্রাক্কালে তার দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ছিল এক সদস্য বিশিষ্ট। ৭১ সনের পার্টি কংগ্রেসের নির্বাচিত পাঁচ সদস্যের মাঝে দুজন সদস্য উপদলীয় কার্যকলাপের জন্য বহিস্কৃত হয়। একজন কারাবরণ করে এবং অন্য জনের অযোগ্যতার জন্য পদাবনতি ঘটে। তাই পার্টির সভাপতি সিরাজ একাই ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটি। ‘৭৪-এ প্রায় কংগ্রেস সমমানের গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের অধিবেশনে কেন্দ্রীয় কমিটিকে বর্ধিত করা না হলেও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সভাপতির একটা সাহায্যকারী দল বানানো হয়। ছয় জন সাহায্যকারীর দল ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। তিনজন ছিল সামরিক সাহায্যকারী এবং বাকি তিনজন ছিল রাজনৈতিক সাহায্যকারী। সাহায্যকারীর ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। তাদের পরামর্শ সভাপতি গ্রহণ করতে পারতেন আবার নাও করতে পারতেন। সিরাজ সিকদারের বিস্তর লেখাপড়া এবং প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব তার সহকর্মী থেকে তাকে অনেক উপরে নিয়ে যায়। পক্ষান্তরে পার্টির নিচের স্তরে তাঁর অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তার কারণে তিনি বৈধ পদ্ধতিতে পার্টির সব ক্ষমতা এবং একটি শক্তিশালী সভাপতির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সিরাজ সিকদারের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে ‘৭১-এর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ফ……তার নিজের পরিচালনাধীন কর্মীর হাতে সিরাজ শিকদারের অনুমতি ব্যতীত নিহত হন। এই ঘটনা থেকে ধারণা করা যায়, পার্টিতে সিরাজ সিকদার এর প্রভাব কত প্রবল ছিল? সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও সিরাজ সিকদার কিছুটা উন্নাসিক হয়ে উঠেছিলেন। নিচের স্তরের কর্মীদের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আরোপ করতে তাঁর কার্যকলাপ অনেকসময় স্বৈরাচারী হয়ে উঠতো। উন্নাসিকতার জন্য তিনি প্রায় উচ্চস্তরের অনেকের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করেছিলেন। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, ব্যক্তিগতভাবে সিরাজ সিকদারের ব্যবহার ছিল আন্তরিক এবং প্রাণবন্ত। সব কর্মীদের তার সঙ্গ বিশেষ প্রিয় ছিল। তাঁর প্রাণখোলা ব্যবহারে কর্মীরা অনেকে চিনতে পারতো না প্রতাপশালী সভাপতি সিরাজ সিকদারকে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি যেই হোন না সাংগঠনিকভাবে উল্লেখিত জটিলতার জন্য উচ্চ স্তরের কর্মীদের মাঝে কিছুটা অসন্তোষ দানা বাঁধে।
‘৭৩, ‘৭৪-এর জোয়ারের যুগে আরও কিছু সচেতন কর্মী সর্বহারা পার্টিতে যোগ দেয়ার ফলে অসন্তুষ্টির দলটা ভারী হয়। এই সচেতন কর্মীদের অসন্তোষের একটি প্রধান কারণ ছিল তিনি তাত্ত্বিক মানের চাইতে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সামরিক মানটাকে প্রাধান্য দিতেন। মোটকথা, যেসব কর্মীরা দলকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এবং টাকা-পয়সা উপায় করে দিতে পারতেন, তারা সিরাজ সিকদারের উপর সহজে প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন। এক্ষেত্রে সিরাজ সিকদার প্রায়শ ভুলে যেতেন এই অস্ত্র এবং সম্পদ দখল করতে গিয়ে কোনো না কোনো পক্ষ থেকে জনগণ নির্যাতিত হয়েছে কিনা? অথবা এর পেছনের জনসমর্থন ছিল কিনা? তাই শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, সিরাজ সিকদারের দলের পেছনে জনসমর্থনের ঘাটতি না থাকলেও আন্দোলনমুখী সংঘটিত জনগণের ঘাটতি ছিল। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, রাজনীতি সচেতন হয়েও সিরাজ সিকদারের এধরনের ভ্রান্তিমূলকঃ তাড়াহুড়ার প্রবণতা থেকেই এসেছে। সিরাজ শিকদারের এ প্রবণতা সমগ্র পার্টিতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাই পার্টিতে রাজনৈতিক কাজের চাইতে মূখ্যত সামরিক কাজেই প্রাধান্য পেয়েছিল। এই ধারার কারণে সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর রাজনৈতিক সাহায্যকারীদের দাবিয়ে রেখে সামরিক সাহায্য (অস্পষ্ট) ১নং সদস্য মতিন সর্বোচ্চ বিপ্লবী পরিষদের প্রধান হতে পেরেছিল।
উচ্চাভিলাষের কারণে মতিন অনেক সময় উশৃংখল হয়ে উঠতেন। এ সব জেনেশুনেও সিরাজ সিকদার তাকে প্রশ্রয় দিতেন। ‘৭৩-এর মাঝামাঝি সময়ে ‘জিয়াউদ্দিনের পার্টিতে যোগ দেয়াটা সিরাজ সিকদার প্রথমত সামরিক কারণেই খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। স্বভাবতঃই অন্যান্যদের মত তিনিও আশা করেছিলেন, এই সকল সামরিক ব্যক্তিত্ব পার্টিতে আসার ফলে পার্টির সামরিক মান দ্রুত বাড়বে। কিন্তু পরে সম্ভবত সিরাজ সিকদার আহত হয়েছিলেন। কারণ জিয়াউদ্দিন অস্ত্রের চাইতে তত্ত্ব এবং বই নিয়ে নড়াচড়া করতে বেশি পছন্দ করতেন।
সামরিক কর্মীদের প্রতি সিরাজ শিকদারের বিবেচনাহীন পক্ষপাত তাত্ত্বিক কর্মীদের ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ ঘটে। পার্টি’র মধ্যকার এই মতাদর্শগত সংগ্রামের কারণে অবশ্য সিরাজ সিকদারের দুর্ঘটনাটা ঘটেনি। এই মতাদর্শ গত দ্বন্দ্ব দুর্ঘটনার সময় তীব্র ছিল না। হয়তো আরও পরে ধীরে সুস্থে এটা পরিণত হতো। যতগুলি তথ্য হাতে আছে তা বিশ্লেষণ করলে পার্টির নিচুস্তরে শৃঙ্খলা আরোপের ক্ষেত্রে কড়াকড়ির কারণে ‘৭৫-এর পহেলা জানুয়ারি দুর্ঘটনা ঘটে, এই যুক্তিটাই প্রবল। সংশ্লিষ্টদের মতে সিরাজ সিকদার পার্টির নিম্নস্তরে শৃঙ্খলা আরোপ করতে গিয়ে অনেক সময় নিষ্ঠুর হয়ে উঠতেন কিন্তু তার সমসাময়িক প্রিয়ভাজন দের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ততটা শক্ত ভাবে কার্যকর করতেন না।
১লা জানুয়ারি সিরাজ সিকদার নিজেই শৃঙ্খলা লংঘন করেছিলেন। তার লেখা পার্টির সাংগঠনিক দলিলে উল্লেখ ছিল, কোনমতেই দিনের বেলা কোন গুরুত্বপূর্ণ কর্মী প্রোগ্রাম করতে পারবে না। এ শৃঙ্খলা সিরাজ সিকদারের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য ছিল।’ ৭৪-এর ১৬ ডিসেম্বর সফল হরতালের পর সরকারি বাহিনী হন্যে হয়ে উঠেছিল, তখন সমগ্র পার্টির কর্মীরা সিরাজ সিকদারের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিল। স্ব-আরোপিত শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে তিনি পহেলা জানুয়ারি ম….. এর সঙ্গে বৈঠকে দিনের বেলায় উপস্থিত ছিলেন। দিনের বেলায় ঐ বৈঠকে যদি না যেতেন, তাহলে সরকারি বাহিনীর পক্ষে তাকে ট্টেস করা দুঃসাধ্য ছিল।
বিশ্বাস হন্তা চিঠি
সিরাজ সিকদারের গ্রেপ্তারের প্রচলিত ধারণার মাঝে একটি বিশ্বাস হন্তা চিঠির অস্থিত্ব ঘুরে ফিরে এসে পড়ে। সিরাজ সিকদারের গ্রেপ্তারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনৈক ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার বিভিন্ন জায়গায় গল্পচ্ছলে এরকম একটি চিঠির ধারণা দিয়েছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, স্বাক্ষর বিনে চিঠির প্রেরক পার্টির ভেতরের লোক। চিঠির হাতের লেখা মেয়েলি ধাঁচের। পার্টি’র অভ্যন্তরের লোক না হয়ে সিরাজ সিকদারকে ধরিয়ে দেয়া সহজ নয়, এটা বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু প্রেরক মেয়ে এই যুক্তি অনেকাংশে টেকে না।
এ ধরনের প্রচারণা খুবই স্বাভাবিক। তবে একটা বিশ্বাস হন্তা চিঠি সিরাজ সিকদারের গ্রেপ্তারের জন্য দায়ী, তা আরো অনেক সূত্র সমর্থন করে।
চিঠির প্রকৃত ভাষাটা কি তা জানা না গেলেও বিষয়বস্তু বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য থেকে কিছুটা আঁচ করা যায়। সম্বোধন এবং স্বাক্ষরবিহীন চিঠিটা ৭৪-এর ৩০ ডিসেম্বর নাকি পুলিশের হাতে আসে। যতটুকু জানা যায়, চিঠিতে সিরাজ সিকদারের গোপন শেল্টার এবং বৈঠকের জায়গার আশেপাশের রাস্তার উল্লেখ ছিল। তাছাড়া প্রেরক সিরাজ সিকদারের শারীরিক বর্ণনারও উল্লেখ রয়েছে। এমনকি তার সামনের দাঁতের মাঝখানের ফাক, হাতের এটাচি এবং পোশাক-পরিচ্ছদের ধরনও উল্লেখ রয়েছে। চিঠির শেষ দিকে সিরাজ শিকদারের নাম উল্লেখ না করে প্রেরক জানিয়েছে এই লোক একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক। পাওয়া যাবার সময়ও চিঠিতে উল্লেখ ছিল। একজন প্রভাবশালী আমলা দাবি করেছেন, তিনি চিঠিটি নিজের চোখে দেখেছেন। তাঁর মতে চিঠির প্রেরক মহিলা না পুরুষ এ ধারণা করতে পারেনি তবে প্রেরক রাজনৈতিক কর্মী। কারণ হস্তাক্ষর পোস্টার লিখিয়েদের মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
এ চিঠির অস্তিত্ব যদি বাস্তবে থেকে থাকে তাহলে বিনা দ্বিধায় ধরে নিতে হবে চিঠির প্রেরক সিরাজ সিকদারের ঘনিষ্ঠ এবং পার্টির উচ্চপদস্থ কর্মী। কারণ নিচের স্তরের কর্মীর পক্ষে সিরাজ সিকদারের বৈঠকের সময়, তাঁর শারীরিক বর্ণনা এবং শেল্টার চেনা কোন মতেই সম্ভব ছিল না। সিরাজ শিকদারের সঙ্গে শেল্টারে অবস্থানকারী কয়েকজন এবং শেল্টারের বাইরের স্বল্পসংখ্যক কর্মীরাই শুধু বৈঠকের খবর জানতো। সংগত কারণেই এরাই শুধু সন্দেহের আওতায় পড়ে। সিরাজ শিকদারের শেল্টার তখন কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তার সঙ্গে থাকত কেন্দ্র হিসাবরক্ষক আ..আ… সিরাজ সিকদারের সঙ্গেই গ্রেপ্তার হন। সে জীবিত না মৃত আজ পর্যন্ত কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি। তবে এটা সঠিক, সে জেলে নেই।
আ….. ছাড়া ছিল চার মহিলা। তারমধ্যে সিরাজ শিকদারের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী জাহানারা হাকিম এবং সদ্য বিবাহিত তিন নম্বর স্ত্রী ও অন্য দুইজন মহিলা কর্মী। এই দুই কর্মী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অনুবাদ, কপি এবং ফাইল সংরক্ষণের কাজ করতেন। এছাড়া পহেলা জানুয়ারির বৈঠকের সময়সূচী এবং স্থান জানতো ম… ,খ….এবং ই…….। চিঠিটা কে সত্য ধরে নিলে এরা প্রায় সবাই সন্দেহভাজন ব্যক্তি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন চিঠিটা সঙ্ঘবদ্ধ কোন কাজ নয়, এটার প্রেরক একজনই। উল্লেখিত সন্দেহভাজনদের প্রায় প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ভাবে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ ছিল। তাদের সঙ্গবদ্ধ হয়ে এমন মারাত্মক আত্মঘাতী কাজ করার কোন কারন ঘটেনি এবং এটা ছিল রিস্কি গেম।
কবিতা’র স্বীকারোক্তি
১লা জানুয়ারির বৈঠক থেকে ম….ই মাঝখানে উঠে গিয়েছিলেন। এ বৈঠকে কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই সিরাজ সিকদারকে প্ররোচিত করে ম….ময়মনসিংহ অঞ্চলের দায়িত্ব নেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি তে ময়মনসিংহ অঞ্চল ছিল সামরিক এবং আর্থিক দিক দিয়ে শক্তিশালী। পার্টির এক তৃতীয়াংশ কর্মী ছিল ময়মনসিংহের। তখন পার্টিতে একটা প্রবাদ প্রচলন ছিল, ‘চিটাগাং ধারোপতি ময়মনসিংহ লাখোপতি। এ দুটি সন্দেহজনক ঘটনা ছাড়াও ম…. এর সন্দেহভাজনদের তালিকায় পড়ার আরো কিছু কারণ রয়েছে।
১৯৬৯ সনে ম…. হাফ প্যান্ট পড়ে পার্টিতে এসেছিলেন। অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে সে পার্টিতে লেগেছিল। ‘৭১ সনে সে চাটগাঁয় খেলা চালিয়ে ভরণপোষণ করে পার্টিতে সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত থেকে ছিল। ম …. যেমন বলতো একটা দুটো ভালো কাজ করা সম্ভব কিন্তু সারা জীবন ভালো কাজ করা ছিল অসম্ভব। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর ম…..এর কার্যকলাপ আসলে তাই প্রমাণ করে। ‘দ্রুত নিষ্পত্তির লড়াইয়ের সফল প্রণেতা হিসেবে ম… খুব অল্প সময়ে সিরাজ সিকদারের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠে। এবং রাতারাতি পার্টির উচ্চস্তরে উঠে আসে। তাঁর অল্প বয়সে এবং তাদের কারণে সে অহংকারীও ছিল। এই কারনে তার অধিনস্ত ও সমসাময়িক কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায়শঃ সে নষ্ট করে ফেলত। তাই পার্টির মধ্যে ম….বন্ধুর চাইতে শত্রুভাবাপন্ন সংখ্যাই বেশি ছিল।
সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর তাঁর উচ্চাভিলাষী প্রবণতা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। সে সাহায্যকারী গ্রুপের দুজনকে না জানিয়ে অন্য তিনজনকে ভয় দেখিয়ে পার্টি সংবিধান উপেক্ষা করে সর্বোচ্চ বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে এবং সে পরিষদের প্রধানের পদ দখল করে। পরে পার্টির অভ্যন্তরে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে সে বিরুদ্ধবাদীদের নির্মমভাবে হত্যা করতে আরম্ভ করে।তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক সাহায্যকারী গ্রুপের ১ নং সদস্য র…..(ঢাকা), ময়মনসিংহ অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঝি…. কুমিল্লার বি…. এবং সিলেটের ম…অল্প সময়ের ব্যবধানে হত্যা করে। উচ্চাভিলাষী রাতে আরো কত নাম না-জানা নিবেদিত প্রাণ হারিয়েছে, তার কোন ইয়াত্তা নেই।
গ্রামবাসীর মধ্যে ময়মনসিংহ জেলার ভাল্লুকা থানার একটি গ্রামে নাকি এক রাতে তার উপস্থিতিতে আটজন কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এর পরও যখন সে দেখল, পার্টিতে তার বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়ে উঠছে, তখন সে মরিয়া হয়ে পার্টি শৃঙ্খলা লংঘন করেও শেষ চেষ্টা করেছিল। সে জানতো পার্টি ভেঙে যাবে। এই ভাঙ্গার প্রক্রিয়াতে তাঁর হাতকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজন টাকার। কার হজকারী কার্যকলাপের জন্য এর আগেই সে ময়মনসিংহ এলাকা প্রায় হারিয়ে ফেলেছিল। ওখানকার স্থানীয় জনমত প্রার্থীর বিপক্ষে তীব্র হয়ে ওঠে।’ ৭৫-এর ওলট পালট এরপর ম…. নিজেই এক সার্কুলারে জানায় আপাততঃ পার্টির সব ধরনের সামরিক অপারেশন বন্ধ থাকবে। অন্যথায় জনগণ পার্টিকে বাকশালের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে পারে। টাকার প্রয়োজনে সে পার্টির নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একটি ব্যাংক ও থানা লুট করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফিরবার পথে পুলিশের একজন বাকশাল বাকশাল চিৎকার করে জনগণ জড়ো করে এবং নদীপথেই সে ধরা পড়ে। ধরা পড়ার পরও তার উচ্চাভিলাষের ইতি হয়নি। সে জেলেই সর্বহারা পার্টির একটা তৃতীয় ধারার জন্ম দেয়। আত্ম সমালোচনা করে কামাল হায়দার গ্রুপের সঙ্গে যোগ দেয়।
ম… এর পহেলা জানুয়ারি বৈঠকের মাঝখানে উঠে যাওয়া, প্ররোচিত করে ময়মনসিংহের দায়িত্ব নেয়া, তৃতীয় সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর তার উচ্চাভিলাষী তৎপরতা এবং নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের মাঝে একটা যোগ খুঁজে নেওয়া কঠিন নয়। তদুপরি সিরাজ শিকদারের জীবিতকালের আরেকটি ঘটনা তার বিপক্ষের যুক্তিকে আরো শক্তিশালী করে। ম… এর উশৃংখলতা এবং কর্মীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতির কারণে সিরাজ সিকদার ‘৭৪-এর মাঝামাঝিতে একবার ম.. এর সামনে জিয়াউদ্দিনকে বলেছিলেন ১ নং সামরিক সদস্য পদ গ্রহণ করতে। উচ্চাভিলাষী ম..এর এটা সহ্য না করার কথা। কারণ জিয়াউদ্দিনদিন ছিল এমনিতেই সর্বহারা পার্টিতে ভূত। উচ্চস্তরের অনেক কর্মী তার ব্যক্তিত্ব এবং ব্যাপক তাত্ত্বিক জ্ঞান এর জন্য ম… এর মতোই ঈর্ষান্বিত ছিল। পক্ষান্তরে পার্টিতে তখন মারমুখী হঠকারী ফাইটারদের বিরুদ্ধে একটি তাত্ত্বিক গ্রুপ জিয়াউদ্দিনকে ঘিরে শক্তিশালী হচ্ছিল। এ সমস্ত কারণে ম…এর আত্মঘাতী কিছু করে বসা অসম্ভব ছিল না।
তবে বৈঠকের মাঝখানে ম….এর উঠে যাওয়া এবং ৩০ ডিসেম্বর পুলিশ প্রাপ্ত চিঠি কিছুটা অস্বাভাবিক ঠেকে। তদুপরি ম… এর লেখা গোছানো এবং সুন্দর নয়।তবু ম..কে সন্দেহের বাইরে রাখা যায় না কারণ সিরাজ শিকদারের শেল্টারে অবস্থানকারী দুই মহিলা কর্মীর একজন অর্থাৎ ঝুমার সঙ্গে ম…এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। গভীর মতআদর্শহীন রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত কোন মহিলাকে আত্মঘাতী কাজে প্রলুব্ধ করা আসলে কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। যদি পুলিশ অফিসারের বক্তব্য অনুযায়ী প্রেরক যদি আসলে মহিলা হয়, তাহলে এটা যুক্তিসংগত হয়ে ওঠে।
ম… এর পক্ষে আছে শুধু একটা কবিতা। সে মাঝে মধ্যে কবিতা লিখতো। একটা কবিতায় সে নিহত সভাপতির জন্য হাপিত্তেস করেছে। সঙ্গে সঙ্গে বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি ক্ষোভও প্রকাশ করেছে। কবিদের মতে কবিতা নাকি কবিদের নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি। তাই যদি হয় ধরে নিতে হবে ম…নির্দোষ। কাকতালীয়ভাবে তার বিরুদ্ধে যুক্তিগুলি মিলে গেছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়, কবিতা উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে না?
আরো একটি রহস্য
সিরাজ সিকদার এর সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কেন্দ্রিয় হিসাবরক্ষক আকবর। গ্রেপ্তারের পর এ পর্যন্ত তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। অনেকের ধারণা, আকবরই বিশ্বাসঘাতক। সে যোগসাজশ করে এ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। পরে রক্ষীবাহিনী এটা ধামাচাপা দিতে গিয়ে তাকেও মেরে ফেলেছে। সর্বহারা পার্টির অনেক কর্মীর ধারণা, আকবর বেঁচে আছে। সে মোটা চাকরি নিয়ে বিদেশে অবস্থান করছে। আকবরের পদ ছিল প্রায় সাহায্যকারীদের সমপর্যায়ের। আবার সে ছিল সিরাজ সিকদারের প্রিয়ভাজন ব্যক্তি। সে কেন এমন দুর্ঘটনা ঘটাবে তার মোটিভ সম্পর্কে তেমন যুক্তিসঙ্গতঃ কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে সরকারি প্রস্তাবে প্রলুব্ধ হয়ে কিছু করা বিচিত্র কিছু নয়।
তার বিপক্ষে সন্দেহ দৃঢ় হওয়ার মতই আরো কিছু কারণ রয়েছে। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর বরিশালের সর্বহারা পার্টির এক নেতৃস্থানীয় কর্মীর কাছে আকবরের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় রিপোর্ট করে রাতে আকবরের লাশ কে বা কারা আকবরের ঘরের সামনে ফেলে রেখে গিয়েছিল। সকালে রক্ষীবাহিনী সে লাশ নিয়ে যায়। উক্ত কর্মীর সন্দেহ হওয়ায় সে রিপোর্টের সত্যতা যাচাই করতে চেষ্টা করে। তবে এই রিপোর্টের পক্ষে কারো কাছ থেকে সমর্থন পাওয়া যায়নি। আকবরের আত্মীয় যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আকবরের মৃত্যুর খবর প্রচার করে, তাহলে ধরে নেয়া যায় আকবর দোষী।
কিন্তু আকবরের বিপক্ষ থেকে পক্ষেই যুক্তি বেশি। আকবর যদি যোগসাজশ করে, তাহলে চিঠি আসে কোথা থেকে? আর চিঠির প্রেরক যদি সে হয়, তাহলে সে ঘটনার সময় সিরাজ সিকদারের সঙ্গে ছিল কেন? যোগসাজশ করলে আর একটা প্রশ্ন থাকে। পুলিশ শুধু সিরাজ সিকদারকে পেয়ে সন্তুষ্ট থাকত না। সিরাজ সিকদারের লেটার এবং আকবরের জানা সব তথ্য বের করে নিত। স্পষ্টতই বোঝা যায়, এরকম হয়নি। কারণ এখন পর্যন্ত পুলিশ ট্রেস করতে পারেনি সিরাজ সিকদারের বৈঠক কোন বাড়িতে ছিল অথবা শেল্টার কোনটা ছিল? আকবর বেঁচে আছে কি নেই এই রহস্য টা বের করতে পারলে সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর রহস্য টা অনেক সহজ হয়ে উঠবে।
মানসিক রোগী
জাহানারা হাকিম ছিল সিরাজ সিকদারের দ্বিতীয় স্ত্রী। ‘৭৪-এর অধিবেশনে সাহায্যকারী গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত হতে না পেরে তার রোমান্টিক মোহ অনেকটা ফর্সা হয়ে যায়। অতীত জীবনের কারণে পার্টির কঠোর নিয়ম শৃংখলার মধ্যে তার বিতৃষ্ণা বেড়ে গিয়েছিল। তদুপরি পার্টির গ্ল্যামারহীন জীবন সে সহজভাবে নিতেও পারেনি। সিরাজ শিকদারকে একবার পিস্তল দিয়ে তারা করেছিল। এ কাহিনী কতটুকু সত্য, তা জানা যায়নি। তবে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ছিলেন, এটা সঠিক। একজন মানসিক রোগীর পক্ষে বলা সম্ভব, তিনি ক্যান্সারের কারণ এবং ঔষধ আবিষ্কার করেছেন। এজন্য আরো বিস্তারিত গবেষণার জন্য তিনি সিরাজ সিকদার থেকে আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছিলেন। এরপরই সিরাজ সিকদারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয় এবং সিরাজ সিকদার তৃতীয় বিয়ে করেন। ফলে জাহানারা হাকিমের পক্ষে ঈর্ষাকাতর হওয়া স্বাভাবিক ছিল। ঈর্ষাকাতর একজন মানসিক রোগী দুর্ঘটনা ঘটাতে দ্বিধা করার কথা নয় । পুলিশ অফিসারের বক্তব্য অনুযায়ী প্রেরক যদি মহিলা হয়, জাহানারা হাকিমের বিপক্ষে যুক্তি ধোপে টেকার কথা।
বলা হয় জাহানারা হাকিমের সঙ্গে বর্তমানে সিরাজ সিকদারের পরিবারের সম্পর্ক ভালো। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে সিরাজ সিকদারের সন্তান জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও তাকে বাদ দিয়ে জাহানারা হাকিমকে পুত্রবধূ হিসেবেই তারা স্বীকৃতি দিয়েছে। সিরাজ সিকদারের জীবিত কালে তার পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত। বলতে গেলে কোন যোগাযোগই ছিল না।
সিরাজ সিকদার তার পরিবারের নিষ্ঠুর সমালোচনা করতেন। তাই ধারণা করতে হয় পূর্বে পরিচিত ছাড়া জাহানারা হাকিমের সঙ্গে সিরাজ সিকদারের পরিবারের কোনো সম্পর্ক সিরাজ সিকদারের জীবিত অবস্থায় সম্ভব ছিল না। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর জাহানারা হাকিমের পুলিশের যাওয়া এবং রাতারাতি শ্বশুরপক্ষের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠা কিছুটা দৃষ্টিকটু ঠেকে।
বাচাল
সিরাজ সিকদার এর মৃত্যুর পর পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির অধিকাংশ কর্মী খ.., আ…, ই…. চক্রকেই দায়ী করত। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির দু’অংশের একাংশ এখনো তাই মনে করে। এই তিন জনের মাঝে তারা খ…কে বেশি দায়ী মনে করে। খ…এর বিপক্ষে তাকে দায়ী করার যুক্তিই বেশি। যেহেতু সে ছিল সিরাজ সিকদারের প্রায় একান্ত সচিবের মত। বাইরের কর্মীদের সঙ্গে সভাপতির যোগাযোগ এবং বৈঠকের ব্যবস্থা করাই তার দায়িত্ব। এ কারণে সে সভাপতির শেল্টার চিনত এবং পহেলা জানুয়ারির বৈঠকের খবরও জানতো। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর সে তার সম্পর্কে আজেবাজে মন্তব্য করেছে, এথেকেই প্রমাণ হয়, সে সিরাজ সিকদারেরর প্রতি ক্রুদ্ধ ছিল। থাকাটা স্বাভাবিক, কারণ এর আগে পার্টিতে বিভিন্ন কারণে তার দু’বার পদাবনতি ঘটে। তার বিপক্ষে তৃতীয় শক্তিশালী প্রমাণ হচ্ছে প্রভাবশালী আমলার বর্ণিত চিঠির হস্তাক্ষরের মত তার লেখা গোছানো ও পরিষ্কার। এতগুলো শক্তিশালী যুক্তি তার বিপক্ষে থাকলেও তাকে সন্দেহের আওতামুক্ত করা যায় শুধুমাত্র সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর তার ভূমিকার জন্য। বিশ্বাসঘাতকের জঘন্য অপবাদ এবং মৃত্যুর মতো চরম শাস্তি মাথায় নিয়ে সে অনেকদিন পর্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পার্টিতে লেগে থেকেছিল। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, নিরাপরাধ না হলে মৃত্যুভীতি উপেক্ষা করে এরকম দৃঢ়তা দেখানো কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তদুপরি সিরাজ সিকদারের প্রতি তারা যত বিতৃষ্ণায় থাকুক না কেন, তার সমমানের কোন কর্মী সিরাজ সিকদার বিহীন সর্বহারা পার্টি কল্পনা করতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ পার্টিতে আরো অনেকের মতো খ…এর নাম্বার ওয়ান শ্রেনী শত্রু ছিল ম…। সিরাজ শিকদারের গ্রেফতারের জন্য খ…যদি তাই হতো তাহলে ম… কোনমতেই রেহাই পেত না। তবে এটা ঠিক, সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর পর সে নানা জায়গায় তার স্বভাবসুলভ বাচালতায় সিরাজ সিকদার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছে। এই যুক্তিও তার বিপক্ষে টেকে না। কারণ দোষ হলে অত সহজে সে মুখের লাগাম ছাড়তে পারতো না।
আরো একটি চিঠি
অবৈধ প্রস্তাব বিস্তার করে একক কেন্দ্রীয় কমিটি বানানোকে অনেক সচেতন কর্মীদের কাছে দৃষ্টিকটু ঠেকেছে। এছাড়া পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে অনেক কর্মী সিরাজ সিকদারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। সিলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত ম…এবং চট্টগ্রামের ই… ও ছিল এ দলে। দু’জনে গোপনে সিদ্ধান্ত নেয় যে এক সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির পরিবর্তে বর্ধিত এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে পার্টিতে জনমত গঠন করবে এবং পরবর্তী অধিবেশনে ব্যাপারে সভাপতি সিরাজ সিকদারকে চাপ করবে। কিছুদিন পরে এ কাজের কি ধরনের অগ্রগতি হচ্ছে, তা জানতে চেয়ে ই ..ম-এর কাছে চিঠি লেখে। চিঠিটা পড়ার পর ম…. তা হারিয়ে ফেলে। চিঠিটা হারানোর ফলে তার বদ্ধমূল ধারণা হয়, তার পাঠানো মাসিক রিপোর্টের সঙ্গে চিঠিটা ভুলক্রমে সিরাজ সিকদারের কাছে চলে গিয়েছে। সে দারুণভাবে ঘাবড়ে যায়। কারন সে জানে, চিঠিটা সভাপতির হস্তগত হলে উভয়ের মৃত্যুদণ্ডই পাওনা হবে। এমনিতেই তারা দু’জন সভাপতির বিরাগভাজন ব্যক্তি।
সঙ্গে সঙ্গে সে এর পরামর্শের জন্য চট্টগ্রাম চলে আসে। দু’দিন খোঁজাখুঁজির পর ই…কে বের করে। আরো দু’দিন তারা পরামর্শ করে। ম… সিলেট ছেড়ে চট্টগ্রাম এসেছে, পার্টির আর কেউ তা জানতো না। চট্টগ্রামের পরিচালক হিসেবে দুর্ভাগ্যক্রমে ই… সভাপতির ১ জানুয়ারির বৈঠকের খবর জানতো। তাই তারা দু’জনে প্রথমে সভাপতি সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। তবে এ পরিকল্পনা যে কার্যকর করা যাবে না, তা তারা দু’জনেই ভালো করে জানতো। কারণ প্রচন্ড ব্যক্তিত্ববান সিরাজ সিকদারের দিকে পিস্তল উচু করা তার পার্টির কোনো কর্মীর জন্য প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল। দুশ্চিন্তা এবং নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়েই তাদের দুর্বিষহ প্রহরগুলো কাটছিল। পরিশেষে তারা সিদ্ধান্ত আসে ভারত হয়ে তারা বাইরে কোথাও পালিয়ে যাবে। কিন্তু এরই মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
দুর্ঘটনার দিন রাতে এসে ম.. ই… কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে বাচ্চা ছেলের মত কেঁদে উঠে বলে, তাকে দিয়ে বিপ্লব হবে না। সে জঘন্য কাজ করেছে, সভাপতিকে ধরিয়ে দিয়েছে। এই কাহিনী জেলে একজন সহকর্মীর কাছে ই…বলেছে।
এই কাহিনী অনেকাংশে বিশ্বাসযোগ্য। ব্যাপারটা চিঠির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। চিঠিতে সিরাজ সিকদারের শেল্টারের উল্লেখ না করে বৈঠকের আশে-পাশের রাস্তার উল্লেখ থাকায়ও ধারণা করা যায় প্রেরক ম….। সে সিরাজ সিকদারের শেল্টার চিনতো না। ই… থেকে বৈঠকের এবং শেল্টারের আশে-পাশের জায়গা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে। আবার ই….এর কাহিনী পুরোপুরি বিশ্বাসও করা যায় না কারণ জেলে যাওয়ার আগেও সে দুর্ঘটনা সম্পর্কে নাকি নানা ধরনের কাহিনী ফেঁদেছে। তবে হতে পারে নানা ধরনের গাল-গল্প, তার বিবেকের যন্ত্রণার প্রলাপ। ম…. বেঁচে থাকলে হয়তো ই…. কে যাচাই করে নেওয়া যেত।
উপসংহার
সিরাজ সিকদার আজ দল-মত-নির্বিশেষে কাছে একজন শহীদ দেশ প্রেমিক নেতা। সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব দলের মৃত্যুবার্ষিকীতে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করে। তাই সভাপতি দেশের আপামর জনসাধারণ একজন দেশ প্রেমিক মৃত্যুর প্রকৃত রহস্যটা জানতে চাইবে। এ ব্যাপারে সরকার এগিয়ে না আসা পর্যন্ত প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
(এ প্রতিবেদনের মতামত সম্পূর্ণভাবে লেখকের। তিনি নিজ উদ্যোগে, প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। কেননা ব্যক্তির পক্ষে এককভাবে এ রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া একটি সক্রিয় পক্ষের মতামত এখনো পাওয়া যায়নি। তবে আমরা আশা করব একদিনে রহস্যের জটিলতা উন্মোচিত হবে। -লেখাটি আকর্ষণীয় বলেই প্রকাশ করা হলো।
-সম্পাদক বিচিত্রা)