অটোয়ায় উচ্চারিত বঙ্গবন্ধুর শান্তির কণ্ঠ আবার আলজিয়ার্সে প্রতিধ্বনিত হবে
আলজিয়ার্সে আজ ৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপুঞ্জের চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলন। ২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল সম্মেলনের সূচনা পর্ব। আজ থেকে শুরু হচ্ছে সম্মেলনের শিখর পর্যায়ে চলবে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বিশ্বের জোটনিরপেক্ষ ৭০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্রনায়কদের কণ্ঠ এই সম্মেলনে প্রতিধ্বনিত হবে। ২৫০ কোটিরও বেশি বিশ্ববাসীর অনুভূতি জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপুঞ্জের গােষ্ঠীতে বাংলাদেশ সদস্যপদ লাভ করছে। সদস্য হয়েছে ভুটান, মাল্টা, ওমান, কাতার ও পেরু। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শান্তিবাদী বিশ্বের অন্যতম অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলনে যােগদানের জন্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার আলজিয়ার্সের পথে ঢাকা ত্যাগ করছেন। শান্তি ও সমৃদ্ধির অন্বেষায় বঙ্গবন্ধু যাচ্ছেন আলজিয়ার্সে। গত আগস্টে যুগােস্লাভিয়া সফরকালে এবং অটোয়ায় কমনওয়েলথ সম্মেলনে শান্তিবাদী জোট নিরপেক্ষ আদর্শের যে বলিষ্ঠ উচ্চারণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর আলজিয়ার্স সম্মেলনে তা প্রতিধ্বনিত হবে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে সমভাবে বাংলাদেশের কণ্ঠে উচ্চারিত হবে অবিমিশ্র নিরঙ্কুশ জোট নিরপেক্ষতা। শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান-সার্বভৌমত্বের প্রতি অটুট মর্যাদাবােধ, আক্রমণ, স্নায়ুযুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযােগিতার অবসান। একের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অপরের হস্তক্ষেপের অবসান। বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ চেতনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, যৌথ ও দ্বিপাক্ষিক সহযােগিতার মাধ্যমে সমৃদ্ধি এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সমঝােতার নবতর অগ্রগতির জন্য ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ। আলজিয়ার্স সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যােগদানের প্রতি বিশ্বের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল যথেষ্ট গুরুত্ব আরােপ করেছেন। এদিকে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার খবরে জানা গেছে, আলজিয়ার্স সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ও বক্তব্য শ্রবণের জন্য জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রনায়করা উন্মুখ রয়েছেন। সম্মেলন উপলক্ষে আলজিয়ার্স উৎসবের বেশ ধারণ করেছে। সম্মেলনে মূল ভবন, গ্রান্ড প্যালেস দ্য ন্যাশনস -এর প্রবেশ পথে আলজিয়ার্স প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিনের প্রতিকৃতির পাশে শােভা পাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর এক বিশাল প্রতিকৃতি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেনও সম্মেলনে যােগদান করছেন। জনাব শামসুল হকের নেতৃত্বে একটি অগ্রবর্তী দল আগস্টের শেষ থেকেই আলজিয়ার্সে রয়েছেন। ১৯৫৫ সালে বান্দুনে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন। অনুষ্ঠিত হয়। এর আঠারাে বছর পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলন। তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে তিন বছর আগে লুসাকায়। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গত তিন বছরে আমরা বিভিন্নমুখী উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখ্য বিষয় হলাে গত তিন বছরে বিশ্বের রাজনীতিতে জোট নিরপেক্ষতায় গভীর চেতনার ছাপ ফেলেছে এবং এর ফলে শীর্ষ শক্তিগুলাের মনােভাবেরও পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। শীর্ষ দেশসমূহের মনােভাবে পরিবর্তন- দুই শীর্ষ শক্তি সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সমঝাতা- পুঁজিবাদী বিশ্ব ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের চিন্তাভাবনায় নবতর হওয়া-সাম্রাজ্যবাদের নবতর স্ট্রাটেজি; প্রাচ্য-প্রতীচ্যের বর্তমান সমঝােতার রূপরেখা ও সম্ভাবনা; বিভিন্ন সামরিক চুক্তি ও তার বিভিন্ন সামরিক কৌশল ও সম্প্রসারণবাদের নয়া কূটকৌশলের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির পটভূমিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের সম্মেলন। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যবদ্ধ চেতনা এমনকি সম্ভাবনা কর্মসূচি গ্রহণের উদ্দেশ্যে এবারের সম্মেলনে নবতর অবদান রাখবে। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, এবারের আলজিয়ার্স সম্মেলনে (১) আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, বাংলাদেশ- ভারত পাকিস্তান উপমহাদেশ, ভিয়েতনাম, লাউসসহ অনেক অমীমাংসিত সমস্যার প্রশ্নে একটি সাধারণ কর্মসূচি গ্রহণ অথবা এ সম্পর্কে ঐক্যবদ্ধ চেতনা সৃষ্টির প্রচেষ্টা, (২) জোট নিরপেক্ষ বিভিন্ন দেশগুলাের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযােগিতা ঘনিষ্ঠ করে তােলা এবং (৩) অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলােতে জোট নিরপেক্ষ উন্নত দেশ কতখানি সাহায্য সহযােগিতা করতে পারে সে ব্যাপারে বাস্তব কার্যক্রম গ্রহণ যথেষ্ট গুরুত্ব পাবে। সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করা হবে বিশ্ব শান্তি ও নিরস্ত্রীকরণের সপক্ষে। সামাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও বর্ণবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা ও সাধারণ। কার্যক্রম গ্রহণের প্রতি। আলজিয়ার্স সম্মেলনে শান্তিবাদী জোট নিরপেক্ষ বিশ্বে আদর্শ উচ্চারণকারী কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা যুগােস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, ভারতের শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একত্রে মিলিত হওয়ার আবার সুযােগ পাচ্ছেন। অনুমান করা যাচ্ছে, পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নেতৃবৃন্দ আলােচনা বৈঠকে বসতে পারেন। বিশেষ করে দিল্লিতে ভারত পাকিস্তান চুক্তি সম্পাদনের পর বঙ্গবন্ধু এবং শ্রীমতি গান্ধী এই সম্মেলনে যােগদান করছেন। চুক্তি ও তার পরবর্তী বিষয়াবলি নিয়ে আলােচনার জন্য সম্ভবত তারা বৈঠকে মিলিত হবেন। উল্লেখ্য আলজিয়ার্স সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি দলে মি. পরমেশ্বর নাথ হাকসার ও সাথে রয়েছেন। সম্মেলনে যােগদানের জন্যে নয়াদিল্লি ত্যাগের সময় সাংবাদিকদের কাছে শ্রীমতি গান্ধী বলেছিলেন, এই সম্মেলন অন্যান্য দেশের নেতাদের দেখা করার সুযােগ এনে দেবে। কিছু মূল্যবােধ ও বিশ্বাসের। পূর্ণ মূল্যায়ন এবং নীতি ও কর্মসূচি উদ্ভাবন করতেও এই সম্মেলন সুযােগ এনে দিবে। এবারের সম্মেলনে কম্বােডিয়ার প্রিন্স নরদম সিহানুক যােগদান করেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো সম্মেলনে যােগদান করছেন না। উল্লেখ্য জর্জ টাউনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সম্মেলনের কার্যক্রম থেকে ইন্দোনেশিয়া, লাউস প্রভৃতি দেশ ওয়াকআউট করে। সম্মেলনের কিছু কিছু কার্যকারণ সম্পর্কে অসন্তুষ্টি ছিল এর কারণ। বিশ্বের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল এবারের আলজিয়ার্স সম্মেলন সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কোনাে কোনাে মহল এর সাফল্য সম্পর্কে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। কোনাে কোনাে মহল সন্দেহ পােষণ করে বলেছেন, লুসাখায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনে উচ্চারিত গালভরা করা মহৎ ও গৃহীত মহােৎসবের প্রস্তাবের নিষ্ফল বাস্তবায়নের কি পুনরাবৃত্তি ঘটবে?
আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ : বার্তা সংস্থা জানাচ্ছেন, আলজিয়ার্স সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুরােধ জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছে। পররাষ্ট্র অফিসের জনৈক মুখপাত্র সূত্রে একথা বলা হয়। গতকাল রাতে জোটনিরপেক্ষ গ্রুপে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির পর এ আমন্ত্রণ জানানাে হয়। জোট নিরপেক্ষ নীতির প্রতি গভীরভাবে আস্থাশীল প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলনে সম্ভবত একথাই ঘােষণা করবেন যে, তার দেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং বৃহৎ শক্তি দণ্ড থেকে দূরে থেকে একটি বাস্তব নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং আদর্শগত পার্থক্য নির্বিশেষে বাংলাদেশ বিশ্বের ছােট বড় সব দেশের সাথে আন্তরিক সহযােগিতা ও সমঝােতা কামনা করে।১২
রেফারেন্স: ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩, দৈনিক পূর্বদেশ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ