১৫ জুলাইয়ের মধ্যে দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান- মওলানা ভাসানী
মওলানা ভাসানী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে তার তিন দফা দাবি মেনে নেয়ার জন্যে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যদি মেনে নিতে ব্যর্থ হন তাহলে জনগণ বৃহত্তম সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হবে। মওলানা ভাসানী গতকাল রােববার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ন্যাপ আয়ােজিত এক জনসমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি ভারতের সাথে বাংলাদেশের চুক্তি বাতিলের জন্য এবং ভারত থেকে কাপড় না এনে সুতা আনার জন্যে সরকারের কাছে দাবি করেছেন। তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, তা না হলে আগামী জুলাই মাস থেকে জনগণ সে কাপড় বর্জন করবে। তিনি আন্দোলনে উচ্ছঙ্খল না হবার জন্য, সম্পদ না নষ্ট করার জন্য এবং আইন মেনে চলার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। মওলানা ভাসানী তার সাম্প্রদায়িক মনােভাবের কথা অস্বীকার করে বলেন, আমি কোনােদিন সাম্প্রদায়িক ছিলাম না, আজও নই এবং ভবিষ্যতেও হবে না। তিনি বলেন, ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের পর যারা আমাকে হিন্দুস্থানের দালাল বলেছিল আজ তারাই আমাকে সাম্প্রদায়িক বলছে। তিনি আরাে বলেন, ব্রিটিশ আমলে ১৭ বছর কংগ্রেস করেছি, গান্ধীর সাথে একই মঞ্চে নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবার বলেছি। কিন্তু কেউ কোনােদিন সাম্প্রদায়িক বলেনি। কোনাে কোনাে লােক তাকে মুসলিম বাংলার নেতা বলে প্রচার করছেন বলে মওলানা ভাসানী অভিযােগ করেন। তিনি প্রশ্ন করেন, সরকারের গােয়েন্দা বিভাগ রয়েছে। সরকার কেন মুসলিম বাংলাওলাদের গ্রেফতার করছে না এবং জেলে আটক করছে না। মওলানা ভাসানী দেশের এক শ্রেণির কমিউনিস্টদের উল্লেখ করে বলেন যে, তারা মওলানা ভাসানীকে সাম্প্রদায়িক বলছেন। তিনি বলেন, আমি কোনােদিন কমিউনিস্ট ছিলাম না। আজও নই। তিনি আরাে বলেন, আমি মাও-সে-তুংয়ের সাথে ৪৮ ঘণ্টা কথা বলার পরও বলেছি আমি মুসলমান। রাশিয়ার কমিউনিস্ট নেতাদের সাথে কথা বলার পরও আমি বলেছি আমি মুসলমান। তিনি ভারতের এক শ্রেণির পত্র-পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযােগ এনে বলেন যে, এসব পত্রিকা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাম্প্রদায়িকতার কথা প্রচার করে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি দিচ্ছে। তিনি এই উস্কানি বন্ধের জন্য ভারতীয় পত্র-পত্রিকার প্রতি পুনরায় আহ্বান জানান। ভারতের কোনাে কোনাে কমিউনিস্ট নেতা বাংলাদেশে এসে তার বিরুদ্ধে প্রচার করে গেছেন বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি সমাবেশে আজাদ বাংলা জিন্দাবাদ, হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই স্লোগান দেন। তিনি বলেছেন যে, যদি জেলে যেতে হয় তাহলে এই সরকারের জেলেই যাবাে। আর যদি ফাসিতে যেতে হয়, তাহলে এই সরকারের হাতেই যাবাে, বিদেশি কোনাে দেশের হাতে নয়। তবে তিনি এও উল্লেখ করেন, যদি সত্যি কোনাে বিদেশি রাষ্ট্র আমাদের সার্বভৌমত্বে হামলা করে এবং যদি আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয় তাহলে আমাদেরও এমন দেশের সাথে যােগাযােগ আছে, যাদের দ্বারা তা প্রতিহত করা যাবে।
ড. আলীম-আল-রাজী : ন্যাপের (ভাসানী গ্রুপ) ভাইস চেয়ারম্যান ড. আলীম আল রাজী তার বক্তৃতায় দেশের ১৯৭৩-৭৪ সালের বাজেটের তীব্র সমালােচনা করেন। তিনি বলেন যে, বাজেটে যে বিদেশি ঋণের আশা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেশের সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হবার আশংকা আছে। তিনি ঋণদানকারী দেশের নাম এবং কবে পর্যন্ত কোন দেশ হতে কত ঋণ পাওয়া যাবে ঘােষণা করার আহ্বান জানান। ড. রাজী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেও অভিযােগ করেন যে, গত ১৬ মাসে ভারত বাংলাদেশের যৌথ ঘােষণা ছাড়া কিছুই করা হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের জন্য বাজেটে কোনাে অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি বলেও উল্লেখ করেন। তিনি পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালিদের ব্যাপারে বলেন যে, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কোনাে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। এবং ফিরে এলে পুনর্বাসনের জন্য বাজেটে কোনাে বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়নি। ন্যাপ নেতা দেশের প্রতিরক্ষার জন্য বাজেটে মাত্র ৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দের উল্লেখ করে বলেন যে, এই অর্থ প্রয়ােজনের তুলনায় অপ্রতুল হয়েছে। তিনি পুলিশ ও বিডিআর বাহিনীর জন্য অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। বলে উল্লেখ করে অভিযােগ করে বলেন যে, অথচ রক্ষী বাহিনীর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। ড. রাজী রেশনের চাল ও গমের মূল্য বৃদ্ধির তীব্র সমালােচনা করেন। তিনি বলেন যে, অথচ সরকার এসবের দাম কমানাের জন্য দেশবাসীর নিকট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। তিনি রাষ্ট্রপতির ৫০ নম্বর আদেশের সাহায্যে দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে বলে অভিযােগ করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির ৯ নম্বর আদেশে কর্মচারিদের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং ৫০ নম্বর আদেশের বলে সারাদেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি দালাল আইনের অপপ্রয়ােগ এবং এতে নিরপরাধ ব্যক্তিদের আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযােগ করেন। ড. রাজী সংবিধানের সমালােচনা করেন। তিনি বলেন, সংবিধান পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে এতে কৌশলে আইয়ুব আমলের প্রায় সবগুলাে আইনকে বলবৎ রাখা হয়েছে।
কাজী জাফর : ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমদ তার বক্তৃতায় অভিযােগ করেন যে, সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন এবং মওলানা ভাসানী সেই শূন্যতা পূরণের জন্য আন্দোলনে নেমেছেন। তিনি বলেন যে, মওলানা ভাসানী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পিতা এবং কিছুদিন পূর্বে ন্যাপ আহূত হরতালে জনগণ তাকে সমর্থন দিয়েছেন। সরকার মওলানা ভাসানীর ৩ দফা দাবি মেনে না নেয়ার কারণ হিসেবে তিনে বলেন যে, বর্তমান সরকার স্বাধীন সরকার নয় এবং ন্যাপ জানত তারা এ দাবি মেনে নিবেন না।
কামরুল ইসলাম সালেহউদ্দিন : জাতীয় সংসদের ন্যাপের (ভাসানী গ্রুপ) একমাত্র সদস্য জনাব কামরুল ইসলাম সালেহ উদ্দিন তার বক্তৃতায় বলেন যে, ভারতের বিরুদ্ধে বলা সাম্প্রদায়িকতা হতে পারে না। এটা সাম্প্রদায়িকতা বলে ধরা হলে আমরা সবাই সাম্প্রদায়িক। তিনি ন্যাপ (ভাসানী গ্রুপ) সহ অন্যান্য বিরােধী দলীয় কর্মীদের ওপর অত্যাচার চালানাে হয়েছে বলে অভিযােগ করেন। তিনি বলেন যে, আমরা রামকৃষ্ণ মিশন খুলি নি। আমাদের বাঁচার অধিকার রয়েছে। আমাদের ওপর আঘাত করা হলে আমরা তা প্রতিহত করব। এক চোখের বিনিময়ে দুচোখ কেড়ে নেব। তিনি ১৯৭৩-৭৪ সনের সাধারণ বাজেট এবং রেলওয়ে বাজেটের সমালােচনা করেন।
রাশেদ খান মেনন : ন্যাপের (ভাসানী গ্রুপ) প্রচার সম্পাদক জনাব রাশেদ খান মেনন সরকার ও লাল নীল স্বেচ্ছাসেবক ও রক্ষী বাহিনী দিয়ে দেশের মানুষের অপর অত্যাচার চালাচ্ছে বলেও অভিযােগ করেন। তিনি অভিযােগ করেন যে, সরকার তার কার্যক্রমে প্রমাণ করে দিয়েছেন তারা দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করতে চায়। তিনি বলেন যে, ন্যাপের ৩ দফা আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠছে এবং এতে সরকার অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। তিনি একদল লােক গুজব ছড়িয়ে ৩ দফা আন্দোলন বানচাল ও জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছেন বলে অভিযােগ করেন। তিনি বিভ্রান্তকারীদের অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, জনতার ঐক্য সূচিত হতে যাচ্ছে এবং বিভ্রান্তির বিষবাষ্প ছড়িয়ে তাতে ফাটল ধরানাে যাবে না।৬৫
রেফারেন্স: ১৭ জুন ১৯৭৩, দৈনিক পূর্বদেশ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ