You dont have javascript enabled! Please enable it! 1981.11.13 | সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী ও গণতন্ত্র | ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত নির্বাচিত না হয়েও বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের বৈধতা | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৩ নভেম্বর ১৯৮১ - সংগ্রামের নোটবুক

সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী ও গণতন্ত্র

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত নির্বাচিত না হয়েও বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের বৈধতা

সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৩ নভেম্বর ১৯৮১

অভিমত

সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী ও গণতন্ত্র

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহ সারা দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। সরকারকে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী করা হয় এবং দেশবাসীকে আশ্বাস দেয়া হয় দূর্নীতি উচ্ছেদের। এর পর পরেই ৩ জানুয়ারী’ ৭৫ জনগণ জানতে পারেন পুলিশের কাছ থেকে পালানোর সময় সিরাজ শিকদার পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী শনিবার সকালের সংসদ অধিবেশনে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের জন্য মনোরঞ্জন ধর সরকারের পক্ষ থেকে একদিন উত্থাপন করেন। ৩৫টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত এই বিলে সংবিধানের একশোর অধিক সংশোধনীর সুপারিশ করা হয়। এই চতুর্থ সংশোধনী সংসদে পেশ করার পর সংসদ সদস্যরা পক্ষে বা বিপক্ষে তাদের বক্তব্য রাখবেন।তারপর সংশোধনী প্রস্তাব ভোটে দেওয়া হবে ও তার ফলাফল অনুযায়ী স্থির হবে সংসদে তা গৃহীত হল কি না। সংসদের নীতি অনুযায়ী সেটাই হবার কথা। কিন্তু সংসদ সদস্য জনাব আতাউর রহমান খান চতুর্থ সংশোধনী সম্পর্কে তার বক্তব্য রাখতে জন্য যখন দাঁড়ালেন তখন ‘আমাকে স্পীকার বললেন যে আপনি কিছু বলতে পারবেন না। যে ধারামতে বলার কথা সে ধারা রদ করে দেওয়া হয়েছে আগে।’ (বিচিত্রার সঙ্গে সাক্ষাৎকার ১৮ মে ৭৯ সংখ্যা)। অর্থাৎ শাসনতন্ত্র ১০০ টির অধিক ধারা ও উপধারা সংশোধিত হয়ে গেল কোন রকম আলাপ-আলোচনা ছাড়াই। তাও আবার ৩০ মিনিটের মধ্যে।
৪র্থ সংশোধনী বিল পাশ হবার আগেই স্পীকার কর্তৃক যে ধারা রদ করে দেওয়া হয়েছে’— যার জন্য সংসদ সদস্যগণ সংসদে শাসনতন্ত্রের সংশোধন বিষয়ে কোন বক্তব্য রাখতেই পারলেন না— স্পীকারের সেই নির্দেশটি সংবিধানের ৩৯ (১) (ক) অনুযায়ী ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং (খ)…. নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
আবার সংবিধানের ২৬ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী— রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে। ‘
সংবিধানে যখন প্রত্যেক নাগরিকের ‘বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকৃত এবং ৩৯ (২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত কারণগুলি ছাড়া সে অধিকার খর্ব করে কোন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাষ্ট্রকেও দেওয়া হয়নি তখন জনগণ নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ‘বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা’ কেন থাকবে না? কেন তারা শাসনতন্ত্র সংশোধনের বিল নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে পারবেন না? তাও আবার সংসদের মধ্যে এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার দায়িত্ব কার?
৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের কাঠামোর সম্পূর্ণ পরিবর্তন হোল সে সংবিধান প্রণয়নের জন্যে ১০ এপ্রিল ৭২ গণ-পরিষদের অধিবেশন বসে। খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্যে একটি স্থায়ী কমিটি গঠন করে গণপরিষদ মুলতবী হয়ে যায়। ৬ মাস পর ১২ অক্টোবর ৭২ গণপরিষদের সামনে খসড়া শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়। এরপর শুরু হয় খসড়া শাসনতন্ত্রের উপর বিতর্ক। বিতর্ক শেষে স্থির হলো খসড়া শাসনতন্ত্র ৪ নভেম্বর ‘৭২ ভোটে দেওয়া হবে। আইনমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন দফাওয়ারী পড়ে যাওয়া শাসনতন্ত্রটি পরিষদ অনুমোদন করে যেতে লাগলেন একটার পর একটা। এইভাবেই বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের সংবিধান পাশ হয়।
সরকারী গেজেট অনুযায়ী ৪র্থ সংশোধনীর রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে ২৫ জানুয়ারী ‘৭৫। সেদিন থেকে আমাদের শাসনতন্ত্রের পরিবর্তিত রূপ— একদলীয় হুকুমতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান।
৪র্থ সংশোধনী বিলের ৩৪ অনুচ্ছেদ হচ্ছে ‘রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিশেষ বিধান’ সেখানে বলা হয়েছে ‘সংবিধানে যাহা বলা হয়েছে তাহা সত্ত্বেও এই আইন প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে (ক) এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকিবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে ;

এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ সাহেব। তিনি ২৪ জনুয়ারি ১৯৭৪ তারিখে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তাঁর নির্বাচন হয়েছিল সংবিধানের ‘দ্বিতীয় তফসিলে বর্ণিত বিধানাবলী অনুযায়ী সংসদ সদস্যগণ কর্তৃক।’ সংবিধানের ৫০ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রপতি কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে পাঁচ বৎসরের মেয়াদে তাঁহার পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।’ এক্ষেত্রে জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ ২৭ জানুয়ারী ১৯৭৪ রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ করেন। সুতরাং ২৬ জানুয়ারী ১৯৭৯ পর্যন্ত জনাব মোহাম্মদ উল্লাহর বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি থাকার কথা। সংবিধানের ৫০ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি স্পীকারের উদ্দেশ্যে ‘স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে প্রয়োজনে পদত্যাগ করতে পারেন অথবা সংবিধানের ৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই সংবিধান লংঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসেত করা যাইতে পারে।অথবা ৫৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইতে পারিবে।’ সুতরাং সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে অপসারিত করতে হলে ৫২ অনুচ্ছেদ ও ৫৩ অনুচ্ছেদের মাধ্যমেই করতে হবে। অভিযুক্ত রাষ্ট্রপতিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কি কি ব্যবস্থা নিতে হবে কি কি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে অনুচ্ছেদ দু’টিতে তা পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে। শেষে সংসদ সদস্যগণ স্থির করবেন রাষ্ট্রপতি অপসারিত হবেন কি না?
৪র্থ সংশোধনী বিলে শুধু বলা হলো ৩৫ জানুয়ারী ১৯৭৫ সালে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আছেন; ‘তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকিবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে।’ সুতরাং বিলটিতে রাষ্ট্রপতির সম্মতির সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেই বরখাস্ত হয়ে গেলেন। ৪র্থ সংশোধনীর ৫০ নং ৫২ নং ও ৫৩ নং অনুচ্ছেদ কোনরকম পরিবর্তন না করার ফলে ৪র্থ সংশোধনী বিলের ৩৪ নং অনুচ্ছেদ (যেখানে রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিশেষ বিধানের কথা বলা হয়েছে) কতটুকু ন্যায়সঙ্গত তাও চিন্তা করা দরকার।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদের অধিকারী রাষ্ট্রপতি। যিনি সংবিধান অনুযায়ী পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত। তাকে এক বছরের মাথায় বিনা দোষে বিনা কারণে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণ করা ‘এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে’ বলে ঘোষণা দেয়া সে সময়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সংবিধান সংসদ ও রাষ্ট্রপতির পদকে কতখানি সম্মান করতেন তাই প্রমাণ করে।
সংশোধনী বিলের ৩৪ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত আরেকটি বিশেষ বিধান হলো—
(খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।’
৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের চতুর্থ ভাগের রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত ৪৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেঃ ‘বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন যিনি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত হইবেন’। এই সংশোধনীর পূর্বে রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত ৪৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকবেন যিনি দ্বিতীয় তফসিলে বর্ণিত বিধানাবলী অনুযায়ী সংসদ সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন।
সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ‘সংসদ সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন’ যখন পরিবর্তিত হয়ে ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত হইবেন’ এর অর্থ দাঁড়ালো সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁদের নিজেদের ক্ষমতা বাতিল করে দিয়েছেন। আর সেজন্যে ‘সংবিধানের দ্বিতীয় তফসিল বিলুপ্ত হইবে’ বলে ৪র্থ সংশোধনীর ৩০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। এরপর সংসদ দেশের রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কিনা সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। আর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকলে সেটা আইনসঙ্গত হলো কিনা তাও পর্যালোচনা করা দরকার। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় ৪র্থ সংশোধনীর ৩৪ নং অনুচ্ছেদ সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদ বা দফার সংশোধন পরিবর্তন করছে না। এর মধ্যে ‘রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিশেষ বিধান থাকা সত্ত্বেও ঐ বিশেষ বিধানকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সেজন্য সংবিধানের মধ্যে ৪র্থ সংশোধনীর ৩৪ নং অনুচ্ছেদ পাওয়া যায় না।
৪র্থ সংশোধনীর ৩৪ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত আইন যদি সংবিধান বিরোধী হয় তবে সে আইন বাতিল হয়ে যাবে। কারণ সংবিধানের ৭ (২) অনুচ্ছেদ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করছে ‘এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয় তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইবে। ‘
সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর পর ৫৫ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘কোন সময়ে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি উভয়ের পদ শূন্য হইলে…. ক্ষেত্রমতে শূন্যপদে নির্বাচিত নতুন রাষ্ট্রপতি কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পীকার রাষ্ট্রপতি রূপে কার্য করিবেন। ‘৪র্থ সংশোধনী আইন প্রবর্তন হওয়ার ফলে রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হইবে’ এই সংশোধনীর ৩৪ নং অনুচ্ছেদে সেকথা বলা হয়েছে। সুতরাং আইন অনুযায়ী ২৫ জানুয়ারী ‘৭৫ রাষ্ট্রপতির পদ শূণ্য হয়ে পড়ে। সংবিধান অনুযায়ী ঐদিন থেকে স্পীকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করার কথা।
(অস্পষ্ট) উপরাষ্ট্রপতির পদও শূন্য। আর ৪র্থ সংশোধনীর আগে সংবিধানে ‘উপরাষ্ট্রপতি’ বলে কোন পদ ছিল না। সংবিধানের ১২৩ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘…..রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইলে পদটি শূন্য হইবার পর একশত আশি দিনের মধ্যে তাহা পূর্ণ করিবার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ অর্থাৎ ২৪ জুলাই ৭৫ এর মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতেই হবে। সংশোধিত ৪৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন যিনি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত হইবেন।’ সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্রপতি অর্থ এই সংবিধানের অধীন নির্বাচিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কিংবা সাময়িক ভাবে উক্তপদে কর্মরত কোন ব্যক্তি অর্থাৎ রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত হতেই হবে। সেজন্য ১৮০ দিনের বেশী কেউ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি থাকতে পারবেন না।
৩৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধানে যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি তা হলো ‘সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও এই প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেঃ
(ক)….. ……….
(খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন যেন তিনি এই ‘আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।’
কিন্তু সংবিধানের যাই থাকুক না কেন তা উপেক্ষা করে ২৫ জানুয়ারী ‘৭৫ সংশোধনীর ৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেন স্পীকার জনাব আব্দুল মালেক উকিলের কাছে। এই অনুচ্ছেদে আরো পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হলো ‘তিনি রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।’ অর্থাৎ বাস্তবে সংবিধান অনুযায়ী ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে’ শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হলেও ধরে নিতে হবে ‘যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।’ কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়া ছাড়া শুধুমাত্র সংসদীয় এক আইনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা সংবিধান বহির্ভূত কাজ। কারণঃ

১) সংবিধান অনুযায়ী সংসদের শুধুমাত্র একটা আইনের বলে প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি বলে ঘোষণা করা যায় না।
২) ৪র্থ সংশোধনীর আগে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার। সংবিধানের দ্বিতীয় তফসিলে নির্বাচন পদ্ধতি সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। সে পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছে দু’বার। কিন্তু ৪র্থ সংশোধনী পাশ হওয়ার ফলে স্থির হলো জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন; রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দায়িত্ব আর সংসদ সদস্যদের হাতে থাকলো না এবং অপ্রয়োজনীয় হিসেবে সংবিধানের দ্বিতীয় তফসিল বিলুপ্ত করে দেওয়া হলো। সংসদের কাছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও সংসদের এক আইনের বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়।
৩) সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হওয়ার দিন থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে হবে। এক্ষেত্রে স্পীকার সাহেব সংবিধানের ৫৫ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিজে রাষ্ট্রপতি দায়িত্বভার গ্রহণ না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করালেন। কিন্তু সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়।
৪) রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতির ও তাঁর অবর্তমানে সংসদের স্পীকার সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচিত না হয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এ সময়ে তার প্রধান কাজ হবে ১৮০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেরও ব্যবস্থা করা। ৪র্থ সংশোধনীর ৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি (শেখ মুজিবর রহমান) বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন। অর্থাৎ নির্বাচন না করলেও ধরে নিতে হবে শেখ মুজিবর রহমান সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন ও সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পাঁচ বছরের জন্যে সে পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। নির্বাচন না হলেও ধরে নিতে হবে যে তিনি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্যে এধরনের কোন সুব্যবস্থা নেই।
৫) ৪র্থ সংশোধনীত ৩৪ (ক) অনুচ্ছেদ দ্বারা ‘ রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে’— ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারীতে এই বলে এক ঘোষণা করা হয়।সুতরাং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হয়ে পড়ে। সংবিধান অনুযায়ী ২৫ জানুয়ারী ‘৭৫ থেকে ১৮০ দিন অর্থাৎ ২৪ জুলাই ৭৫ পর্যন্ত সংসদ স্পীকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে সংসদ স্পীকারের দায়িত্ব পালন করে গেছেন ২৫ জানুয়ারী ‘৭৫ থেকে ২৪ জুলাই ৭৫ পর্যন্ত। আবার ১৮০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্যে কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। যার জন্যে ১৮০ দিন পর বা ১৯৭৫ সালের ২৪ জুলাই তারিখের পর সংসদ স্পীকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের আর কোন সুযোগ থাকলো না। কাজেই সংবিধান অনুযায়ী ৭৫ সালের ২৪ জুলাই- এর পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য থাকার কথা।
৬) ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নির্বাচিত না হয়েও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করে যান। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নির্ধারিত সব রকম পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল কি?

আবদুল আজীম
৩৫ পাঁচ ভাই ঘাট লেন; ঢাকা-১

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1981.11.13-bichitra.pdf” title=”1981.11.13 bichitra”]