নির্বাচনের প্রস্তুতি | | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৩ নভেম্বর ১৯৮১
প্রচ্ছদ কাহিনী
এখনই সিদ্ধান্ত
এখনই সিদ্ধান্তের সময়। শ্লোগানের উল্লাস, মাইকের বাচালতা, জনসভার উত্তাল তরঙ্গ সবকিছুই শেষ হয়ে আসছে। একইসঙ্গে কমে এসেছে পছন্দের তালিকা। আর আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ভোটারদের বেছে নিতে হবে একজনকে, ৩১ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে। সম্ভবতঃ এই বাছাইয়ের তালিকা সীমাবদ্ধ থাকবে তিন জন অথবা পাঁচ জনের মধ্যে। এবং শেষোক্ত ক্ষেত্রে, চারজনই দেশের ইতিহাসে পেশাদার রাজনীতিবিদ।
ভোটারদের নির্বাচনে বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হবেন বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার; অথবা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওসমানী, অথবা অক্সফোর্ড শিক্ষায় শিক্ষিত প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন, অথবা লালবাগের ‘পীর সাহেব’ ৮৩ বৎসর বয়স্ক মওলানা মোহাম্মদুল্লাহ ( হাফেজজী হুজুর) অথবা মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম এ জলিল।
এদের ব্যক্তিত্ব এবং কর্মসূচীর ভিন্নতা যেমনি, তেমনি ভিন্ন এদের সততা, গুণাবলী; দক্ষতা সম্পর্কে মূল্যায়ন। রাজনৈতিক বিশ্বাসে এদের অবস্থান বিভিন্ন মেরুতে। কারো কর্মসূচী বৈপ্লবিক, কারো সংস্কারবাদী কারো পুনরুত্থানবাদী কারো ধর্মভিত্তিক। যে জাতি বৃহৎ প্রতিবেশীর ভয়ে ভীত; অর্থনৈতিক সংকটে পতিত; বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরশীল; তাকে তারা বিভিন্ন আশ্বাস শুনিয়েছেন।
সন্দেহ প্রবণ এবং অনির্ণেয় ভোটারদের দিয়েছেন এক উজ্জ্বল ভবিতব্যের গ্যারান্টি। সম্ভবতঃ এ সময়টাতেই ক্ষমতার ভেতরে এবং বাইরে সর্বত্র এদের অবস্থান একই প্লাটফর্মে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া এই প্রথম বয়সে নবীণরা সক্রিয়। পুরনো ঢংয়ের রাজনীতি এখন অচল। রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রক্রিয়ায় চিরাচরিত রাজনৈতিক কর্মকান্ড এখন অর্থহীন।
মনোনয়নের ব্যাপারে বিচারপতি সাত্তার এগিয়ে থাকলেও দলীয় সংহতি ও আনুগত্যের ব্যাপারে ছিলেন পিছিয়ে। জেনারেল ওসমানীর মনোনয়নকে জাতীয় ভিত্তিতে বিরোধিতার রূপ দেয়ার চেষ্টা হলেও ডঃ কামাল হোসেন ও মেজর জলিল তাতে সায় দেয়নি। এই তিনজনের মনোনয়ন প্রক্রিয়া দীর্ঘ আলোচনা পরেও শেষ পর্যন্ত একই কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। হাফেজজী হুজুরের মনোনয়ন বহু গুজবের শিকার হলেও তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াননি। এদের বাইরে; ‘স্বপ্ন বিলাসী’ প্রার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো রয়েছেন নির্বাচনী লড়াইয়ে। দেশের চৌদ্দটি দলের ন্যাশনাল ফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করে শিকার হয়েছেন জনবিচ্ছিন্নতার। নির্বাচনী বিতর্কে সবাই ব্যস্ত কিন্তু ক্ষমতাসীন বি এন পি যতখানি আত্মপক্ষ সমর্থনকারী অন্যেরা তা নয়।
ক্ষমতাসীন দলের মূল্যায়ন অতীত ও ভবিষ্যৎ নির্ভর। অর্থাৎ অতীত সম্পর্কে ভোটারদের মতামত যাচাই এবং ভবিষ্যতে তারা ধরে রাখা। অন্যদের ক্ষেত্রে; প্রচারণার ভিত্তি মূলতঃ ও ভবিষ্যতের আশ্বাস। নির্বাচিত হলে সকল সমস্যা সমাধানের আশ্বাস এবং ক্ষমতাসীন দলের অতীতের সমালোচনা ও সে সম্পর্কে ভোটারদের অনাস্থা যাচাই।
এ পর্যন্ত ছিটেফোটা যে জরীপ হয়েছে তাতে কোন না কোনভাবে সবাই পরাজিত। কিন্তু নির্বাচনী বিতর্কে প্রশ্নগুলো অনেক তীক্ষ্ণ জবাবগুলো নয়। এবং এদের তিনজন বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হলেও তৎকালীন ভূমিকার ব্যাপারে কোন শক্তিশালী যুক্তি বা বক্তব্য উত্থাপন করেন নি। মনে হচ্ছে এরা অতীতের সঙ্গে মানসিক ও ভূমিকাগতভাবে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু বাস্তবটা কি তাই? আমাদের রাজনীতিতে আত্নসমালোচনা অনুপস্থিত এবং সমালোচনা ও তথ্যানুসন্ধানী রিপোর্ট অসহনীয় বলেই সবাই এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন।
তাই নির্বাচনী জোয়ারে প্রায় শেষ পর্যন্ত ভোটাররা মনঃস্থির করতে পারেন না। কারচুপি; জনজোয়ার ; অর্থব্যয়; সংগঠন সব মিলিয়ে নির্বাচনী ফলাফলের অনুপাত এত অসম হয় যে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রার্থীরা কোন ঝুঁকি নিতে রাজি হননা। নির্বাচনী প্রক্রিয়া নির্ধারিত সময়ে আশা করা যায় না বলে এবং রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও সংগঠন গড়ে ওঠেনি বলে নির্বাচনী ফলাফল এখানে প্রায়শ অনিশ্চিত।
কিন্তু অনস্বীকার্য হলেও ১৯৭৮ এর নির্বাচনের মতই ধীরে ধীরে নির্বাচনী প্রচারণাকে প্রভাবিত করছে বাকশাল ও বাকশাল বিরোধী মানসিকতা। কিন্তু সর্বত্র কাজ করছে এক ধরনের আস্থাহীনতা। এই আস্থাহীনতায় যেমনি রয়েছে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পর্কে সন্দেহ তেমনি ফলাফল সম্পর্কে।
যে চারজন রাজনৈতিক প্রার্থী সিদ্ধান্ত তালিকায় রয়েছেন, সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে মূল্যায়নের আলোকে তাদের দু’ভাগে ভাগ করা যায়। বিচারপতি সাত্তার রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশ সময় প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারের সঙ্গেই কাজ করেছেন। ডঃ কামাল হোসেন এক সময় একদলীয় শাসন কায়েম ও অন্য দলের বিলুপ্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হলেও, এখন পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের কথাও বলছেন। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওসমানী ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জলিল জলিল পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও, তাতে আংশিক সংশোধনের প্রস্তাব রেখেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন এদের বিপরীতমুখী হলেও, অনেক ব্যাপারে অন্ততঃ লিখিত কর্মসূচী একই। এবং ডঃ কামাল হোসেনকে বাদ দিয়ে অন্য কারো পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারেই ভোটাররা ভীত নন। কেননা ডঃ কামাল হোসেনের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে ‘নতজানু’ শব্দটি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। অবশ্য একই সঙ্গে যুক্ত দেশরক্ষা ও অর্থনীতির প্রশ্ন। জেনারেল ওসমানী যেখানে শক্তিশালী দেশরক্ষা বাহিনী ও স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতির প্রবক্তা, ডঃ কামাল হোসেন সেখানে নিশ্চুপ। বরং বলা চলে ক্ষমতাসীন হবার আগে মনস্থির করতে পারেন না। ভারতের বৃহৎ প্রতিবেশীসুলভ মানসিকতা সম্পর্কে বিচারপতি সাত্তার, জেনারেল ওসমানী, মেজর জলিল সন্দেহপ্রবণ হলেও ডঃ কামাল হোসেন নন।
তবুও; এই প্রথম বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই প্রশ্নটা অনুপস্থিত। ‘৭৮ এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দল এ ব্যাপারে কূটনৈতিক ভাষার মারপ্যাচে যতখানি সোচ্চার ছিল এবার ততখানি নয়। নির্বাচনী প্রচারণায় ভোটারদের একটি অন্তর্নিহিত মানসিকতা কাজ করছে। দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার ব্যাপারে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা।
এখন পর্যন্ত কেউই জনতার স্বতঃস্ফূর্ততা দিয়ে প্রমাণ করতে পারেনি তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে উদ্দীপ্ত করতে পারেন। জাতীয় উদ্দীপনার আবেগও তারা সৃষ্টি করতে পারেননি। রাজনৈতিক চমক এরা দিতে পারেননি, দেখাতে পেরেছেন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে জনতার ঢেউ।
সিদ্ধান্ত তালিকার পাঁচজন প্রার্থী-র ব্যক্তিগত জীবন, মন; মানসিকতা একেবারেই আলোচনার বাইরে। এদের যে কোন একজন নির্বাচিত হলে, পাশাপাশি নতুন ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠবে, যা আশাব্যঞ্জক। এবং এদের প্রত্যেকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সহকর্মীদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ওপর প্রাধান্য দেয়া সত্বেও। ব্যাক্তিত্ব তালিকায় এরা ভিন্ন। বিচারপতি সাত্তার অনেকবেশী গোছানো মানুষ সংগঠিত আমলাতন্ত্র উপর নির্ভরশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণে উল্টোভাবে যেতে চাইবেন না। জেনারেল ওসমানী সৎ, গোছানো ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং নিজস্ব মূল্যায়নের ব্যাপারে মনোযোগী। ডঃ কামাল হোসেন কেতাদুরস্ত, এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের উপর আস্থাশীল। হাফেজজী হুজুর প্রচারবিমুখা এবং সহকর্মী নির্ভর। মেজর জলিল আত্নাকেন্দ্রিক রাজনীতির বিপজ্জনক সরলীকরণে বিশ্বাসী। মূল্যায়নের ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাইরে। ব্যাক্তিত্বের এই বৈচিত্র্য ভোটারদের কতখানি প্রভাবিত করবে বলা শক্ত।
বিচারপতি সাত্তার ও ডঃ কামাল হোসেনের ক্ষেত্রে দুই প্রয়াত ব্যক্তিত্বের মহিমা প্রভাব বিস্তার করলেও অন্যদের ক্ষেত্রে তা নয়। জেনারেল ওসমানী নিজেই এক গৌরবজনক ব্যক্তিত্ব। এর মাঝে মোহিনী ব্যক্তিত্বের চমক সৃষ্টি করেছিলেন হাফেজজী হুজুর। বিচারপতি সাত্তার ও জেনারেল ওসমানী যতখানি আবেগ বিবর্জিত, ডঃ কামাল হোসেন ততখানি নন।
মেজর জলিল দল গঠনের পর্যায়ে যে চমক দিয়েছিলেন দলের ভাঙ্গাগড়ায় এবং সংগঠন বিহীন দুটি দলের সমর্থন সত্ত্বেও সে চমক ফিরিয়ে আনতে পারেননি পারেননি। পারেননি ভোটারদের আবেগ আপ্লুত করতে। নির্বাচিত হলে, ডঃ কামাল হোসেন ও মেজর জলিলকে যতখানি দলীয় আনুগত্য দাবী করতে হবে, বিচারপতি সাত্তার বা জেনারেল ওসমানীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বিচারপতি সাত্তারের ক্ষেত্রে বি,এন;পির অন্তর্দলীয় বিরোধ আনুগত্যের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করবেনা। জেনারেল ওসমানীকে সমর্থনকারীরা ভিন্ন মতাবলম্বী হলেও, আনুগত্যের প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করেন না ।
সম্ভবত এই নির্বাচনী প্রচারণায় এরা কেউই জনতার রায় একক যোগ্য প্রার্থী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে পার্থক্য যথেষ্ট পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছেন, যাতে ভোটাররা ১৫ নভেম্বর উৎসাহ উদ্দীপনা ও আস্থার সঙ্গে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। মনে করতে হবে, তারা জানেন সে রায় তাদের কোথায় নিয়ে যাবে?
নির্বাচনে কারচুপির প্রশ্নটি কিছুটা অবান্তর। এদেশে যারা অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের সম্মুখীন, কারচুপি তাদের পক্ষেই হয় এবং সেখানে ভোটারদের ইতিবাচক না হোক, নেতিবাচক সমর্থন থাকে। নির্বাচনে জয় পরাজয় আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে অনিশ্চিত থাকলেও, নির্বাচনী সাজসজ্জায় বি এন পি ও আওয়ামী লীগ কোটি টাকার কোঠায়। কিন্তু সেটা পাল্টে দেবে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি-প্রার্থীর প্রতি সমর্থনের ভিত্তিতে। অতীতের ভিত্তিতে এবার সে সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী সম্ভব নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, ভোটাররা কি নির্বাচনে উৎসাহী না বাছাইয়ে উৎসাহী। সম্ভবতঃ ভোটাররা নির্বাচনেই উৎসাহী। কেননা সে প্রক্রিয়াই জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে। তাদের মুক্তি দিতে পারে অনাকাংখিত কোন পরিণতি থেকে।
ভোটারদের এক বিরাট অংশ নির্বাচনে অনুৎসাহী। কেননা অতীতের প্রতিশ্রুতি নির্ভর নির্বাচনগুলো তাদের জীবনে ব্যাপক কোন পরিবর্তন আনেনি। চূড়ান্ত সময় ভোটাররা মন ঠিক করবেন। কিন্তু তাই বলে শেষ মুহূর্তে, বিশেষ করে ভোটের শেষ মিনিট পর্যন্ত প্রচারণা কেউ বন্ধ করতে পারবেন না। কেননা অনুচ্চারিত এবং অপ্রকাশিত ভোটার মানসিকতাই ঠিক করবে কে জিতে নেবেন বঙ্গভবন?
মাহফুজউল্লাহ
নির্বাচনী শ্লোগান
ধানের শীষে কুড়া
সাত্তার মিয়া বুড়া।
ধানের শীষে পোকা
জিয়া দিলো ধোঁকা।
দিল্লী থেকে এলো গাই;
সঙ্গে বলদ কামাল ভাই।
হাসিনার অপর নাম
হরে কৃষ্ণ হরে রাম।
কৃষক শ্রমিক বাধ জোঁট
মশাল মার্কায় দাও ভোট।
মই মার্কায় দিলে ভোট
শান্তি পাবে দেশের লোক।
বাকশালের পথ ধর
স্বৈরাচার খতম কর।
হাসিনা বলে কামাল ভাই
নৌকায় চড়ে দিল্লী যাই।
নৌকা ধরে মারো টান
বাকশাল হবে খান খান।
অন্নবস্ত্র বাসস্থান
বাকশাল দেবে সমাধান।
সিরাজ থেকে ওসমানী
বঙ্গবীরের কাহিনী।
‘৭৪ এর দূর্ভিক্ষ
ভুলি নাই, ভুলবোনা।
কম্বল কাটা মুজিব কোট
আর দিবনা নৌকায় ভোট।
ক্ষেতের শান পোকায় খায়
সাত্তার করে হায় হায়।
আসুন সবাই দলে দলে
বটগাছের ছায়াতলে।
ডিসকো জুতা ডিসকো প্যান্ট
ধানের শীষে ভোট দেন।
লাইলাহা ইল্লালল্লাহ
ধানের শীষে বিসমিল্লাহ্।
ফ্যাসিবাদ রুখতে হলে
ওসমানীকে জিততে হবে।
বাকশালের অপর নাম;
৫০০ টাকা চাউলের দাম।
বাকশালের মূলমন্ত্র
লুট খুন গুমতন্ত্র।
দিল্লী থেকে এলো গাই,
সঙ্গে তাহার দামড়া নাই।
হাসিনারে হাসিনা
তোর কথা নাচিনা,
তোর বাপের কথায় নাইচ্যা
দেশ দিচ্ছি বেইচ্যা।
(নির্বাচনে বিভিন্ন দল তাদের প্রার্থীর পক্ষে ও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেসমস্ত শ্লোগান ব্যবহার করছে তার মধ্যে যেগুলো সংগ্রহ করা গেছে; তা এখানে প্রকাশিত হলো।)
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি
প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীই নির্বাচনী অভিযান শুরু করার আগে নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনী কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। এমনকি নির্দলীয় প্রার্থীরাও। কিন্তু এই কর্মসূচীতে সাধারণতঃ জাতীয় সদস্যগুলোর ওপর আলোকপাত করা হয় বলে, আঞ্চলিক ও গোষ্ঠীগত অনেক সমস্যার সমাধান থাকে না। বলা বাহুল্য প্রতিটি নির্বাচনেই প্রার্থীদের বহুলভাবে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিতে দেখা যায়। পরবর্তীকালে এ সমস্ত প্রতিশ্রুতি কতটুকু পালিত হয়, তা বিচার করতে গেলে যথেষ্ট অপ্রিয় প্রসঙ্গের অবতারণা ঘটে।
নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবদুস সাত্তার ঠাকুরগাঁওয়ে বলেছেন, ঠাকুরগাঁ ও পঞ্চগড় মহকুমা নিয়ে ঠাকুরগাঁও নামে নতুন জেলা সদর প্রতিষ্ঠা করা হবে। এছাড়া তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে একটি প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় স্থাপনের কথাও বিবেচনাধীন রয়েছে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। খুলনার সাতক্ষীরা মহকুমায় নির্বাচনী জনসভায় তিনি সাতক্ষীরাকে পূর্ণ জেলায় পরিণত করা হবে বলে ঘোষণা করেছেন। একইভাবে সিরাজগঞ্জের জনসভায় তিনি বলেছেন সিরাজগঞ্জকে আলাদা জেলার মর্যাদা দেয়া হবে। ঢাকায় কোর্ট ভবনে একটি সম্মেলন উদ্বোধনের প্রাক্কালে তিনি জজকোর্ট ভবন পরিপূর্ণভাবে সংস্কার হবে বলে ঘোষণা করেন ও এব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। ঢাকার বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে ইসলামী মহাসম্মেলন উদ্বোধন করার সময় বিচারপতি সাত্তার বলেন, সমাজ থেকে মদ, জুয়া,ঘুষসহ সকল প্রকার অসামাজিক কার্যকলাপ চিরতরে নির্মূল করা হবে। ময়মনসিংহের জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন, চলতি বছরে সারাদেশে ৬০০ খাল খনন করা হবে। পাবনার এক জনসভায় বিচারপতি সাত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, জয়লাভের পর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অনার্সে ও এমএ ক্লাস খোলা হবে এবং পাবনার শহীদ বুলবুল কলেজকে সরাসরি সরকারী তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা হবে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডঃ কামাল জয়পুরহাটের জনসভায় বলেছেন মণপ্রতি পাটের মূল্য ২০০ টাকায় স্থির করা হবে। সৈয়দপুরের জনসভায় তিনি ১৯৭৪ সালের সীমানা চুক্তি বাস্তবায়ন করবেন বলে ঘোষণা করেছেন। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিদানের বেলায় তিনি বিচারপতি সাত্তারকেও অতিক্রম করে গেছেন। সিলেটের হবিগঞ্জ মহাকুমার প্রদত্ত ভাষণে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের প্রতিটি মহকুমাকেই জেলায় পরিণত করবেন।
তবে ডঃ কামাল তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে যে সমস্ত ওয়াদা করেছেন, সেগুলোর অধিকাংশই মুজিব আমলের ৪ বছরের শাসন বিবেচনা করলে অবাস্তব বলে ধারণা হয়। নীলফামারীর জনসভায় তিনি বলেছেন, নির্বাচিত হলে জাতীয় সম্পদ অপচয়ের হিসাব নেয়া হবে। পটুয়াখালীর জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছেন, তিনি নির্বাচিত হবার পর বর্তমান সরকারের লুটেরাদের গণআদালতে বিচার করা হবে। ঠাকুরগাঁওয়ের জনসভায় তিনি বলেন, বিদেশের ব্যাংকে যারা টাকা জমিয়েছে তাদের প্রতিটি পাইয়ের হিসাব নেয়া হবে। এক্ষেত্রে স্ববিরোধিতার প্রশ্ন আসে এজন্য যে, আওয়ামী আমলে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাসীন নেতার দুষ্কর্মের জন্যই বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি। সরকারী দূর্নীতির কারণেই ১৯৭৪ সালে দেশে সৃষ্টি হয়েছে দূর্ভিক্ষ।
ভোলায় প্রদত্ত জনসভায় ডঃ কামাল বাকশালের প্রশাসনিক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মসূচী থাকে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং প্রশাসনিক উপরিকাঠামো সরকারী দলের রাজনৈতিক কাঠামোকে বহুলভাবে প্রভাবান্বিত করে।
ঠাকুরগাঁওয়ের জনসভায় ডঃ কামাল বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে ছাঁটাইকৃত ব্যাংক কর্মচারীদের চাকরিতে পুনর্বহাল করা হবে। একইভাবে সিলেটের জনসভায় তিনি ব্যাংক কর্মচারীদের ছাটাইয়ের বিষয়টি নিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে তার প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করার কথা ঘোষণা করেছেন। (অস্পষ্ট) আওয়ামী আমলে ১৯৭৩-এর নির্বাচনের মাত্র দুই মাস আগে শ্রমিক অসন্তোষকে চাপা দেয়ার জন্য চট্টগ্রামের কালুরঘাট এবং বাড়বকুণ্ড ও খুলনার শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে প্রায় ২৫০ জন শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের ঘরবাড়ী।
বাজাদল এবং হাসিনাপন্থী আওয়ামী লীগের মত জাসদের প্রার্থী মেজর (অব) এম এ জলিলও তার তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নানা রকমের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। ঠাকুরগাঁওয়ের জনসভায় তিনি বলেছেন, নির্বাচিত হলে বিগত দশ বছরের সমস্ত রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক হত্যার প্রকাশ্য বিচার করা হবে। সরকারের খাস জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বন্টন করা হবে এবং গ্রামে গ্রামে যৌথ খামার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। একই জনসভায় তিনি শত্রু সম্পত্তি অর্জন বাতিল করবেন বলেও ওয়াদা করেছেন।
সৈয়দপুরের জনসভায় তিনি বলেছেন, নির্বাচিত হলে তিনি সৈয়দপুর মহকুমাকে রেশনিং এলাকার অন্তর্ভুক্ত করবেন ও সৈয়দপুরসহ দেশের অন্যান্য স্থানের অবাঙালীদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করবেন। মানিকগঞ্জের জনসভায় তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের সমস্ত বিদেশী কোম্পানী বাজেয়াপ্ত করে তাদের শতকরা ৫০ ভাগ অংশ শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করবেন।
উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলির উন্নয়নে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে সিরাজগঞ্জের জনসভায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নাগরিক কমিটির মনোনীত জাতীয় প্রার্থী অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এম এ জি ওসমানী। দিনাজপুরের এক জনসভায় তিনি বলেন, নির্বাচিত হলে কৃষকদের শ্রমশক্তিকে ব্যবহার করে দেশের ১৮ শত মাইল নদীপথ পুনঃখনন করে নাব্য করে তুলবেন। যশোরের এক জনসভায়ও তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্প গ্রহণ ও নৌ-চলাচলের সুবিধার গ্রহণের ওয়াদা করেছেন। ঝালকাঠিতে তিনি বলেন, নির্বাচিত হলে দেশে নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটিয়ে কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্প সম্প্রসারণের ব্যাপক স্কীম গ্রহণ করবেন। মুন্সীগঞ্জের জনসভায় তিনি গরীব লোকদের জন্য ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা বিধান করার জন্য বিচার ব্যবস্থা ঢেলে সাজাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই জনসভায় তিনি দেশ ও বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ওয়াদা করেন। এবং আমদানী নীতির ওপর যথাযথ কড়াকড়ি আরোপ করে সকল বিলাসদ্রব্য আমদানী নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেন।
কুষ্টিয়ার জনসভায় হাফেজজী হুজুর বলেন, তিনি নির্বাচিত হলে আয়কর ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করবেন। ঢাকার জনসভায় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নির্বাচিত হবার পর বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির আমল সংস্কার সাধন করবেন। ইসলামী ব্যবস্থা অনুযায়ী আইন করে তিনি বাংলাদেশে অবস্থানরত অবাঙালীদের জন্য সুস্পষ্টনীতি ঘোষণা করবেন বলেও কথা দিয়েছেন। মুন্সীগঞ্জের এক জনসভায় মওলানা হুজুর বলেছেন, কওমী মাদ্রাসাসহ সকল মাদ্রাসা সরকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে। নারায়ণগঞ্জের জনসভায় তিনি অস্ত্র উৎপাদনসহ কতিপয় মৌলিক শিল্প উৎপাদন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে রেখে শিল্প ও বাণিজ্যের সকল শাখায় বেসরকারী খাতকে প্রাধান্য দেয়ার কথা ঘোষণা করেছেন।
জগলুল আলম