আজ থেকে মওলানা ভাসানীর অনশন শুরু
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির চেয়ারম্যান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী দলের ৩ দফা দাবির সমর্থনে আজ মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে আমরণ অনশন শুরু করবেন। সােমবার পল্টনের ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় মওলানা সাহেব এ কথা ঘােষণা করেন। উল্লেখ থাকে যে, মওলানা ভাসানী যে ৩ দফা দাবির জন্য অনশন শুরু করেছেন তা হচ্ছে, খাদ্য, বস্ত্র, অন্যান্য নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যমূল্য হ্রাস, দমন নীতি বন্ধ, চাকুরি ও শিক্ষাসহ জনজীবনের সর্বত্র বিরাজমান। অরাজকতার অবসান ও জানমালের নিরাপত্তা বিধান। ন্যাপের এই ৩ দফা দাবির ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে সকল দলের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য সভায় গৃহীত এক প্রস্তবে আহ্বান জানানাে হয়েছে। বক্তৃতাকালে মওলানা ভাসানী আজ মঙ্গলবার থেকে ৩ দফা দাবির ভিত্তিতে ভুখা মিছিল বের করার আবেদন জানিয়েছেন। উক্ত সভায় এ ছাড়াও বক্তৃতা করেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান ড. আলীম আল রাজী, সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমদ ও প্রচার সম্পাদক জনাব রাশেদ খান মেনন। মওলানা ভাসানী তার বক্তৃতায় ঘােষণা করেন, ৩ দফা দাবির ভিত্তিতে এখন থেকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন হবে। তিনি বলেন, বিরােধী দল কোনােদিন দেশে আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেনি। স্বাধীনতার পর ১শ ৩১টি জনসভায় বক্তৃতাকালে তিনি আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বলে মওলানা সাহেব উল্লেখ করেন। তিনি অভিযােগ করেন, আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে লালবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, রক্ষীবাহিনী। এছাড়াও সাবেক এমসিএরা দালাল আইনের ভয় দেখিয়ে ঘুষ নিয়েছেন এবং গত নির্বাচনে বিরােধী দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করা হয়েছে বলে তিনি অভিযােগ করেন। তিনি বলেন আইনের দোহাই দিয়ে মানুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা চলবে না। তিনি আরাে বলেন ২৫ বছর। আইন মেনেছি এরপর ব্যাপারটি বিবেচনা করে দেখতে হবে। মওলানা ভাসানী ভারতের সাথে বাংলাদেশের কথিত গােপন চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। মওলানা ভাসানী আরাে বলেন, কোনাে দেশই আমাদের চালক নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ ভারত, সােভিয়েত, মার্কিন কারাে গােলামি মানবে না। মওলানা ভাসানী আরাে বলেন, পল্টনে আগে একবার বলেছিলাম চীনে চলাে, এবারও বলি চীনে চলাে আমার সাথে, চীন থেকে চাউলও আনবাে, স্বীকৃতিও আনবাে।
রুটি খাওয়ার আহ্বান : খাদ্য সমস্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানুষ ভাতের জন্য পাগল হয়ে গেছে। সকলকে ৩ মাস যাবৎ রুটি খাবার বিধান করে একটি অর্ডিনেন্স জারি করার সুপারিশ করেন। তিনি যতদিন চাল সংগ্রহ করা না যায়, ততদিন মন্ত্রীসহ সকলকে রুটি খাবার আহ্বান জানান। পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ছেড়ে দেবার দাবি জানিয়ে তিনি ভুট্টোর নামােল্লেখ করে বলেন, আটক বাঙালিরা কোনাে অন্যায় করেনি, কারাে সতীত্ব হানি বা কাউকে হত্যা করেনি। দালাল আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বহু নিরপরাধ এখনও জেলে ঢুকছে। তিনি অভিযােগ করেন প্রকৃত দালালরা প্রমােশন পাচ্ছে, সরকারের বন্ধু সেজেছে। ন্যাপের ৮৫ নম্বর মতিঝিলস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তিনি অনশন শুরু করবেন। তার অনশনকে সার্থক করে তােলার জন্যে সকলের সাহায্য কামনা করে তিনি অতীতে তার সকল অনশনের কাহিনী বর্ণনা করেন।
ড. আলীম আল রাজী : ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী গ্রুপ) সহ-সভাপতি ড. আলীম আল রাজী তার বক্তৃতায় দেশে সংসদীয় রাজনীতির নামে স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করা হয়েছে বলে অভিযােগ করেন। তিনি বলেন যে, একচ্ছত্র ক্ষমতা একটি সরকারকে পুরােপুরিভাবে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করে। ড. রাজী বলেন, মানুষ কবর থেকে কাফন নিয়ে লজ্জা নিবারণ করছেন। আর ১৪০ টাকা মণ দরে চাউল কিনে খাচ্ছে। অথচ একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রচারণার জন্যে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে তিনি অভিযােগ করেন। তিনি আগামী কিছুদিনের মধ্যে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য একটি সরকার সমর্থিত সম্মেলনে পত্র পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যা বের করার জন্যে ৪৫ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করা হয়েছে বলেও অভিযােগ করেন। ড. রাজী সরকারকে দেউলিয়া বলেও আখ্যায়িত করে অভিযােগ করেন যে, গত দেড় বছরে দেশে কোনাে অডিটর জেনারেল ছিল না এবং সরকারি অর্থের হিসেব রাখা হয়নি। তিনি বলেন যে, সরকার ব্যর্থ হলে কর্মচারীরা দায়ী হয় না। সরকারের নীতি এর জন্য দায়ী।
কাজী জাফর আহমদ : ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমদ বলেন যে, বর্তমানে জাতীয় জীবনের আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দিয়েছে এবং সারা জাতি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। কাজী জাফর আহমদ বলেন, সারা দেশে চরম খাদ্য সংকট বিরাজ করছে। মানুষ অনাহারে আছে এটা তিনি বাস্তব সত্য বলে উল্লেখ করেন। গ্রামে সমস্যা জর্জরিত মানুষের বুকফাটা আর্তনাদে বাংলার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি অভিযােগ করেন যে, দেশের পাট শিল্প ও অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। কল কারখানায় উৎপাদন শূন্যের কোঠায় নেমেছে। তিনি লালবাহিনীর বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযােগ উত্থাপন করেন। তিনি বলেন যে, এরা কোনাে কাজ না করেই মাসে মাসে অন্যের চেয়ে বেশি বেতন নেয় এবং কুকর্ম চালিয়ে শিল্প উৎপাদন দারুণভাবে বিঘ্নিত করে তুলেছে। তিনি তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে বলেও অভিযােগ করেন। কাজী জাফর আহমদ বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্য সকল গণতান্ত্রিক বামপন্থী দলসমূহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণআন্দোলন গড়ে তােলার আহ্বান জানান।৫২
রেফারেন্স: ১৪ মে ১৯৭৩, দৈনিক পূর্বদেশ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ