You dont have javascript enabled! Please enable it!

জিয়া হত্যার পর সংসদ অধিবেশন, এরশাদের সাক্ষাৎকার, চট্টগ্রাম সেনানিবাস | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৯ জুন ১৯৮১

জাতীয় সংসদ

১১জুন জাতীয় সংসদের অধিবেশন চারদিন বিরতির পর আবার শুরু হয়।
বৈঠকের শুরুতে ১৯৮০-৮১ সালের সম্পূরক বাজেট পাস হয়। এরপর পরবর্তী বছরের রেল বাজেটের উপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়।
রেল বাজেটে প্রস্তাবিত ভাড়া ও মাশুল বৃদ্ধির প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করে বিরোধী দল তা প্রত্যাহারের দাবি জানান। তাছাড়া তারা যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সুবিধা বৃদ্ধিরও দাবি করেন। সরকারী দলের সদস্যেরা রেল বাজেটকে সমর্থন করে যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন রেলের উন্নতির ও জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ভাড়া ও মাশুল বাড়ানো দরকার।
১২ জুন রেল বাজেট পাস হয়। দু’দিনের আলোচনায় মোট ৪৮ জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। বিরোধী দলের সমালোচিনার জবাবে রেলমন্ত্রী আবদুল আলীম বলেন, রেল প্রশাসনকে দূর্নীতি মুক্ত করার বিভিন্ন পদক্ষেপ সরকার নিয়েছেন। এছাড়াও যাত্রীদের সুবিধা ও নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা জোরদার করার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
এছাড়াও সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিরোধী দলের নেতা আসাদুজ্জামান খান ও আওয়ামী লীগ (মীজান) সভাপতি মীজানুর রহমান চৌধুরীর বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দেন। সংসদ নেতা বলেন, দেশের নিরাপত্তা সার্বোভৌমত্ব ও শান্তি শৃঙ্খলা এই সংসদের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। তিনি বলেন সরকার আন্তরিকভাবে বিরোধী দলের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চায়। তিনি বলেন সরকার সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বিরোধী দলের সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধান চায়
১৫ জুন সংসদের অধিবেশনে আবার শুরু হয়। এদিন সম্পূরক বাজেটের মোট ৪৬টি খাতে ৪৪৮ কোটি ৫৯ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার বরাদ্দের দাবি গৃহীত হয়। মোট ২৬ জন সদস্য এদিন আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন।
সম্পূরক বাজেটের উপর আলোচনার আওয়ামী লীগ সদস্যরা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকারীদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচারের দাবি করেন।
তাদের জবাবে সরকার দলীয় সদস্যরা বিশেষ করে আশরাফ উদ্দিন ও নাজিমউদ্দিন আল-আজাদ তাদের বক্তব্যের জবাবে উল্লেখ করেন দেশে সুষ্ঠুভাবে আইনের শাসন চলছে। আগের সরকারের আমলের কথা উল্লেখ করে তারা বলেন— কোন মানুষের নিরাপত্তা সেদিন ছিল না। সিরাজ শিকদারের হত্যাকান্ড থেকে শুরু করে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের কথাও তারা উল্লেখ করেন।
মুজিব হত্যার বিচারের দাবির যৌক্তিকতা খন্ডন করে তারা বলেন, ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ৩ নবেম্বর অবধি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল কিন্তু তারা মুজিব হত্যার বিচার করেনি। বিএনপি সরকার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করার পথে এগিয়ে যাবে এবং তার হত্যাকারীদের বিচার করবে। শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে প্রাপ্ত সম্পদের কথা উল্লেখ করে নিজামুদ্দিন আল-আজাদ বলেন, শুধু ২৫ লাখ টাকার অলংকারই পাওয়া যায়নি বরং অবৈধ অস্ত্রশস্ত্রও পাওয়া গেছে। অথচ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স দূরের কথা তার ফেলে যাওয়া সম্পদের মাঝে পাওয়া গেছে টুপি জায়নামাজ আর ছেড়া গেঞ্জি।

সেনাবাহিনীর কখনো রাষ্ট্র-ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া উচিত নয়

বিচিত্রার সঙ্গে জেনারেল এরশাদের একান্ত সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকারের প্রেক্ষিত

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং পর্যায়ক্রমে সে শাসনের বেসামরিকীকরণ কোন নতুন ঘটনা নয়
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলোতে জনগণের প্রত্যাশা এবং সে প্রত্যাশা পূরণে জনপ্রতিনিধিদের ব্যর্থতাকে অনেকে এজন্যে দায়ী করেন। বাস্তবে অনেকগুলো দেশেই সেনাবাহিনী জনপ্রত্যাশার কাছাকাছি এসেছে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে বহুমুখী অন্তঃ প্রবণতা বিদ্যমান তার ভিত্তিতে অনেকে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রসঙ্গটিকে ফ্যাসিজমের সঙ্গে তুলনা করেন। এবং এই যুক্তির সমর্থনে হাজির করা হয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গত কয়েক দশকে সামাজিক মেরুকরণে কতগুলো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। এসবের মধ্যে সামাজিক অবস্থান ও সুবিধাদির মালিকানা পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান গতিশীলতা এবং নাগরিকদের সচেতনতা। তৃতীয় বিশ্বের সামরিকবাদও এই মেরুকরণের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।
কিন্তু সামরিক শাসনের যে সীমাবদ্ধতা নেই তা নয়। সামাজিক শ্রেণীগুলোর পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ক্ষমতারও সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক ক্ষেত্রে তাই গণতন্ত্রবিহীন উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে চিলি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। সেখানে সামরিক শাসনে অগ্রগতি হলেও, ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস বা সম্পদের পুনর্বণ্টন হয়নি।
১৯৬৪ সাল থেকে ব্রাজিলে অনেকবার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। কিন্তু সেখানেও সামরিক শাসনের সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়। আর্জেন্টিনাতেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু পেরুতে আবার ঘটেছে উল্টোটি। ষাটের দশকের শেষ দিকে এক অদ্ভুত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হুয়ান ভ্যালাসকো আল ভোরাডো ক্ষমতায় আসেন। এরপর সেখানে সম্ভব হয়েছে জাতীয় সংহতি অর্জন। বিদেশী পুঁজির জাতীয়করণ এবং প্রশাসনিক যৌক্তিকতা। এটা সম্ভব হয়েছিল ঘানায়— নক্রুমার সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পর, বা নাইজেরিয়ায় হাজী আবুবকর বেলওয়া তেফওয়ার সরকার উৎখাতের পর। সম্ভবতঃ একই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে লাইবেরিয়ায়— স্যামুয়েল ডো’র ক্ষমতা দখলের পর থেকে। প্রশাসনের সামরিকীকরণের খরচ সম্পর্কেও তাই প্রশ্ন উঠেছে, প্রশ্ন উঠেছে সামরিক শাসন য়হেকে গণতন্তত্র উওরণের ব্যাপারটি নিয়েও। এই গণতান্ত্রিকতা চীন যেমনি দাবি করে, তেমনি দাবি করে দক্ষিণ কোরিয়া বা ব্রাজিল। এখানে স্মর্তব্য, এই গণতান্ত্রিকতা প্রতিটি দেশের বিরাজমান বাস্তবতার ওপরই নির্ভরশীল। নিঃসন্দেহে এটা প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বের বাস্তবতার সঙ্গে তুলনীয় নয়।
একটি কথা অনস্বীকার্যঃ তৃতীয় বিশ্বের অনেকগুলো দেশেই মুক্তি সংগ্রাম বা স্বাধীনতার সংগ্রাম সংগঠিত করে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। পরবর্তী পর্যায়ে তা অর্পিত হয় অসামরিক নেতৃত্বের ওপর। এটা সম্ভব হয়েছে সেনাবাহিনীর চিন্তা ও চেতনার (অস্পষ্ট) ফলে। তাই কামাল আতার্তুক বলতে চেয়েছিলে সেনাবাহিনী হচ্ছে তুরস্কের আদর্শের রক্ষাকর্তা। আতাতুর্কের এই বক্তব্যেরই প্রতিফলন ঘটেছে তুরস্কের শাসনতন্ত্রে। ১৯৫২ সালে ক্ষমতা দখলের পর তাই জামাল নাসের মন্তব্য করেছিলেন ‘এর ফলেই মিশরবাসী নিজেদের শাসন করার ও তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় দেয়ার অধিকার লাভ করবে।’ রাজা ফারুক নয়, নাসের নিজেই তার জীবদ্দশায় প্রমাণ করেছিলেন— একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। রাজা ইদ্রিসকে সরিয়ে দিয়ে কর্নেল গাদ্দাফী একই বাস্তবতার রূপায়ন ঘটিয়েছিলেন লিবিয়ার অভ্যন্তরে। ব্যর্থতার কাহিনীও আছে। যেমনঃ বার্মা ও থাইল্যান্ড। দুটি ক্ষেত্রেই ব্যর্থতা ঘটেছে সেনাবাহিনী বিভিন্ন ইন্টারেস্ট গ্রুপের উর্ধ্বে উঠতে না পারায়। দ্বিতীয় কারণ এসব সেনাবাহিনীর উৎস। বার্মা ও থাইল্যান্ডের স্বাধীনতা বা মুক্তির সঙ্গে সেসব দেশের সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সামরিক ক্ষমতাকে অস্বীকার করা মানে সেসব দেশের স্বাতন্ত্র অস্বীকার করা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক উপাদান প্রতিটি সমাজেই বিদ্যমান। এর একেকটি প্রাধান্য লাভ করে একেক দেশে। সেটাও নির্ভর করে সে দেশে বিরাজমান বাস্তবতার ওপর। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা রাশিয়ায় প্রথমোক্ত দুটি উপাদানের ওপর সরকারীভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হলেও, শেষোক্তটির প্রধান ভূমিকার কথা আজ আর কারো অজানা নেই। কিন্তু প্রশ্ন আসে শক্তির উৎস সম্পর্কে নয়, একটি শ্রেণী হিসেবে সামরিক বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে?
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সেনাবাহিনীর উৎসের সন্ধান করলেই জবাব পাওয়া যাবে এ প্রশ্নের। জানা যাবে কোথায় এর শক্তি, কোথায় এর দূর্বলতা?

প্রচ্ছদ কাহিনী

এই প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশের বাস্তবতাকে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে এই সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। স্বাধীনতা পরবর্তীতে যারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন তারাও এই স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত। কিন্তু এই সামরিক বাহিনী আবার ‘সামরিক শাসন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী’ সম্ভবতঃ এই দুই বাস্তবতার প্রথম সাফল্যজনক সম্মিলন ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। জনচেতনায় সেদিন আঘাতের চেয়ে স্বস্তির প্রাধান্য ছিলো প্রবল। এবং প্রতিটি নাগরিকের মতই বাংলাদেশের সেনাবাহিনী জাতীয় চেতনা, আশা আকাঙ্ক্ষা সঙ্গে সম্পৃক্ত
ব্যারাকের বাইরে যে সামাজিক বা রাজনৈতিক মেরুকরণ হয়, তা থেকে সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্ন নয়। ১৫ আগস্টের ঘটনা প্রথম পর্যায়ে পূর্ণতা পায় ঐ বছরের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এদেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে তা ছিলো এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সেদিন প্রেসিডেন্ট জিয়া জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, যে সামরিক আইন জারীর ঘোষণা স্বাক্ষর করেছিলেন একজন অসামরিক প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বেই এই সামরিক বাহিনী জনগণকে দিয়েছে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের আশ্বাস যা ৭৫ পূর্ব বেসামরিক সরকার দিতে পারেনি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে, পাকিস্তান আমলে কোন সামরিক সরকার গণতান্ত্রিকতার মূল্যায়ন করেনি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিকীকরণের দাবি ছিল ব্যাপক। জন প্রত্যাশার সে সচেতনতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাই একটা নির্দিষ্ট সময়ে পরে ব্যারাকে ফিরে যায়।উ কিন্তু তুরস্কের ধাঁচে শাসনতন্ত্রের সংশোধন বা মিশরীয় ধাঁচে একদলীয় শাসন কায়েম করেনি। অথচ একদলীয় শাসন বাংলাদেশে কায়েম হয়েছিল বেসামরিক সরকারের আমলে। এই ব্যাতিক্রমের জন্যে সায়ী আমাদের সেনাবাহিনীর উৎস ও এর শ্রেণী চরিত্র।
এই প্রেক্ষাপটেই সেনাবাহিনীর একদল গণিতান্ত্রিকীকরণের সে প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু ৩০ মে-র ঘটনা জনপ্রত্যাশার অনেক দূরে। তাই সেনাবাহিনীর জওয়ানরা তাতে সায় দেয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের সামগ্রিক চরিত্রে রাজনীতি অনুপস্থিত একথা বলা চলে না।
পূর্ণাঙ্গ বিচারে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত জনপ্রত্যাশা কাছাকাছি থেকেছে। পরিচয় দিয়েছে একটি সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তির। সেনাবাহিনীর কারণেই শাসনতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিকীকরণের প্রক্রিয়া সমুন্নত রয়েছে। এবং সেনাবাহিনীর অঙ্গীকার— তা অব্যাহত থাকবে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর এই নতুন উপাদানটিও যুক্ত হয়েছে সেনাবাহিনীর চরিত্রে। আশা করা যায় তার অনুপ্রবেশ ঘটবে সেনাবাহিনীর সর্বস্তরে।
৩০ মে- ১লা জুনের ঘটনাবলীতে জনচক্ষুর আড়াল থেকে এই অঙ্গীকার নিয়ে জনসমক্ষে এসেছেন বিনয়ী, প্রচার বিমুখ সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ, এম এরশাদ। জেনারেল এরশাদ তাই জোর দিয়ে বলতে পেরেছেন শাসনতন্ত্র সংরক্ষণের কথা, সেনাবাহিনীর পেশাগত মানোন্নয়নের কথা। কিন্তু জনগণের সঙ্গে একটা যোগাযোগ ব্যবধান (‘কম্যুনিকেশন গ্যাপ’) রয়েছে। সেই ব্যবধান দূর করতে এ সাক্ষাৎকার বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

লেফটেনেন্ট জেনারেল হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারী রংপুরে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি কারমাইকেল কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীতে কমিশন পান। ১৯৬৭ সালে কোয়াটাস্থ স্টাফ কলেজে কোর্স করেন। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদে উন্নীত হন এবং তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল পদে যোগ দেন। এবং কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন।
১৯৭৫ সালে তিনি ভারতে জাতীয় প্রতিরক্ষা কোর্স প্রশিক্ষণ লাভ করেন এবং ঐ বছরের ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

সাক্ষাৎকার বিবরণ

প্রশ্নঃ একজন সৈনিকের জীবন কখন গৌরবময় হয়ে ওঠে?
উত্তরঃ নিজের জীবনের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার মাধ্যমে।

প্রশ্নঃ ৩০ মে প্রেসিডেন্ট নিহত হওয়ার পর থেকে দেশের জরুরী অবস্থায় সেনাবাহিনী যে ভূমিকা পালন করেছে তাতে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে আপনি কতখানি পরিতৃপ্ত?
উত্তরঃ ৩০ মের ঘটনাবলীতে দেশকে যে দুর্যোগময় পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল তাতে নিয়মতান্ত্রিক সরকার নির্দেশিত ভূমিকা পালনে সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে পারে সেনাবাহিনীর প্রধানরূপে পরিতৃপ্ত সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার পরিতৃপ্তির পূর্ণতা তখনই হবে যখন এদেশের মাটি থেকে এ জাতীয় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা চিরদিনের মতো রহিত হবে।

প্রশ্নঃ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে সেনাবাহিনী কোন ভূমিকা পালন করতে পারে কি?
উত্তরঃ দেশের স্বাধীনতা; সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষার মাধ্যমে জাতীয় গণতান্ত্রিক গতিধারার সুষ্ঠু বিকাশ ও সংরক্ষণে সেনাবাহিনী তাদের ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জাতির গর্বের বস্তু হিসেবে কিভাবে পরিনত হতে পারে?
উত্তরঃ দেশের দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে জনগণের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা এবং জাতীয় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা রক্ষার মাধ্যমে।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কেবলমাত্র ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ছাড়া আর কি কি কাজে ব্যবহৃত হতে পারে?
উত্তরঃ প্রশিক্ষণগত নিরবচ্ছিন ট্রেনিয়ের মাধ্যমে নিজেদের পেশাগত মান উন্নয়ন করে দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে জাতির সেবায় নিয়োজিত হয়ে।

প্রশ্নঃ ৩০ মে’র ঘটনার পর জনমনে সেনাবাহিনীর অটুট ‘ঐক্য সম্পর্কে যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে’ তা কিভাবে কাটিয়ে উঠে পূর্ণ আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে?
উত্তরঃ ৩০ মে’র ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যা সেনাবাহিনীর মুষ্টিমেয় উচ্চাভিলাসী কয়েকজনের ঘৃণ্য অপপ্র‍য়াস ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের দৃঢ় হস্তে সমূলে উৎখাতে সেনাবাহিনীর ঐক্য ও শৃঙ্খলা সম্বন্ধে কারো মনে কোন সংশয়ের অবকাশ থাকা উচিত নয়।

প্রশ্নঃ সৈনিকের জীবন জনচক্ষুর আড়ালে। এই দূরত্ব কি সংশয় সৃষ্টিতে সহায়তা করছে না?
উত্তরঃ পেশাগত কারণে সকল দেশের সশস্ত্র বাহিনীর জনচক্ষুর আড়ালেই অবস্থান করে। শুধুমাত্র জাতীয় দুর্যোগে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে দেশ রক্ষায় নিয়োজিত থাকাই সশস্ত্র বাহিনীর একমাত্র কর্তব্য বলে আমি মনে করি।

প্রশ্নঃ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কিভাবে ঘটতে পারে? উত্তরঃ জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব দেশের অখন্ডতা ও সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষার মাধ্যমে।

প্রশ্নঃ বর্তমানে বিশ্বের একজন সেনানায়ক হিসাবে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে আপনি কি আধুনিক বলে মনে করেন?
উওর না হলে এর আধুনিকীকরণের জন্যে অনতিবিলম্বে কি করা দরকার?
উওরঃ দেশের সীমিত সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আধুনিকীকরণে চিন্তা করা অবাস্তব। তবে আমরা দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক ধ্যান-ধারণার প্রতি দৃষ্টি রেখে সেনাবাহিনীকে সংগঠিত ও আধুনিকীকরণের সক্রিয় প্রয়াসে নিয়োজিত।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্র নীতি এবং বৈদেশিক সম্পর্ক অনুযায়ী বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে কিভাবে বিকশিত করা উচিত? উত্তরঃ জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ও পারিপার্শ্বিক ভৌগোলিক অবস্থানের পরিমণ্ডলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ধ্যানধারণার প্রতি দৃষ্টি রেখে বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীকে সংগঠিত ও বিকশিত করা উচিত।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সেনাবাহিনীর বিকাশের কোন প্রয়োজন আছে কি?
উত্তরঃ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ করে ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চল হিসাবে বর্তমান বিশ্বের বিরাজমান প্রতিকূল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাধ্যানুযায়ী আমাদের সামরিক বাহিনীর বিকাশ একান্ত প্রয়োজনীয় বলেই আমি মনে করি।

প্রশ্নঃ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন অত্যাধুনিক অস্ত্র শস্ত্র পরীক্ষা ও ব্যবহার করছে সেখানে একটি উন্নয়নশীল দেশের সেনাবাহিনী কি সফল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে?
উত্তরঃ আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নত করে সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রেরণার (মটিভেশন) মাধ্যম সৃষ্টি করা হয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ও দেশের সার্বিক প্রতিরক্ষার বীজ। বহিরাক্রমণজনিত দূর্যোগে সেনাবাহিনী শুধুমাত্র অগ্রণনায়কের ভূমিকায় জনগণের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় নিজেদের নিয়োজিত করতে পারে।

প্রশ্নঃ তৃতীয় বিশ্বের যে কোন দেশে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতার এক প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত। এই ধারণা আপনি কতখানি সঠিক বলে মনে করেন?
উত্তরঃ সেনাবাহিনীর কখনও রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া উচিত নয় বরং স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব দেশের অখন্ডতা

রক্ষার কবচ হিসাবে গরিগণিত হওয়া উচিত।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান সামরিক কৌশলের দিক থেকে পরাশক্তিগুলোর কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তরঃ ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী দেশ হিসাবে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেতুবন্ধ হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান পরাশক্তিগুলোর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বা ভৌগলিক স্বাধীনতা কোন আগ্রাসন বা সম্প্রসারণবাদী শক্তির হুমকীর সম্মুখীন বলে কি আপনি মনে করেন?
উত্তরঃ বৃহৎশক্তি এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলির নিজেদের সম্প্রসারণবাদী নীতির অংশ রূপে বাংলাদেশকে স্বীয় প্রভাব বলয়ে নেওয়ার চেষ্টাই আমাদের ভৌগলিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতি হুমকি স্বরূপ বলে মনে করি।

প্রশ্নঃ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের সেনাবাহিনীকে কি রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে গড়ে তোলা উচিত?
উত্তরঃ একজন সচেতন নাগরিকরূপে সেনাবাহিনীর একজন সদস্যের রাজনীতিতে সচেতনতা বাঞ্ছনীয় কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা নয়।

প্রশ্নঃ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল না হলে একটি দেশে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলা প্রয়োজন নেই। এ মতকে আপনি কতখানি সমর্থন করেন?
উওরঃ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনী দেশের আপামর জনসাধারণের প্রিয় সম্পদ। সে সম্পদ রক্ষার জন্য দেশের আপামর জনসাধারনের প্রয়োজনীয় ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকা উচিত। তাছাড়া যে সব দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে অসচ্ছ তাদের উচিত দেশের প্রতিটি মানুষ ও সম্পদ প্রয়োজন অনুযায়ী সামরিক বাহিনীর সম্পূরক হিসাবে কাজে লাগানো।

প্রশ্নঃ ‘বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা থাকা উচিত’ এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
উত্তরঃ শুধুমাত্র ছাত্র নয় দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রতিটি লোকের শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা উচিত। ছাত্র সমাজ সচেতন সমাজ, তাদের বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা নেওয়া উচিত।

প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন রাজনৈতিক দলসমূহের ব্যর্থতাই সামরিক অভ্যুত্থান ও সামরিক শাসনের জন্য দায়ী?
উত্তরঃ শত শত বৎসরের পরাধীনতা ও ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে দেশের যে কোন সংস্থারই একটি সুষ্ঠুবিকাশ ও সাংগঠনিক পরিপূর্ণতা লাভ করে নাই। গণতন্ত্রে শ্রদ্ধাশীল হয়ে এর প্রবহমান গতিধারাকে সমুন্নত রাখার জন্য সশস্ত্র বাহিনীসহ দেশের প্রতিটি নাগরিককে সচেষ্ট হওয়া উচিত। রাজনৈতিক দলসমূহের ব্যর্থতার চেয়েও আমি মনে করি সকল স্তরে বলিষ্ঠ ও স্বার্থহীন নেতৃত্বের অভাব এবং জাতীয় নৈতিক চরিত্র ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দরুনই এ ধরনের অগণতান্ত্রিক প্রচেষ্টার উৎপত্তি হয়।

প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন সামরিক বাহিনীর সবসময় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা উচিত?
উত্তরঃ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যবৃন্দ দেশীয় সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন অংশ নয়। সুনাগরিক হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের রাজনীতিতে সচেতনতা বাঞ্চনীয়— সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নয়।

প্রশ্নঃ কুমিল্লা সেনানিবাসে এক বক্তৃতায় আপনি সৈনিকদের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি আনুগত্যের জন্যে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আপনি কি আশা করেন ভবিষ্যতেও এ আনুগত্য বজায় থাকবে?
উত্তরঃ সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা ও দেশের নিয়মতান্ত্রিক সরকারের প্রতি অনুগত থাকাই আমি প্রতিটি সৈনিকের কর্তব্য বলে মনে করি।

প্রশ্নঃ প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যু সংবাদ কখন পান? সে সংবাদ পাওয়ার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল?
উত্তরঃ ৩০ মে ভোর চারটার দিকে আমি এ সংবাদ পাই। প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। তারপর আমি অফিসে আসি। সেখান থেকে আমি ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি যাত্তার যিনি সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের স্থলাভিষিক্ত তার কাছে যাই। তিনি তখন সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাকে আমি পরিস্থিতি জানাই এবং জানাই যে সেনাবাহিনী সংবিধান রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালন করবে। আমি জানতাম আমার ভূমিকাই সঠিক। এও জানতাম জওয়ানরা সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে এবং এ ধরনের কাজকে সমর্থন করবে না।

প্রশ্নঃ প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রতি সেনাবাহিনী জওয়ানদের আনুগত্যের কারণ কি?
উত্তরঃ আমাদের জওয়ানরা খুবই সরলমনা। তারা ঠিকই জানে কে হিপোক্রেট, কে সিনসিয়ার?তারাই উত্তম বিচারক। তারা প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ভালো করেই জানে, মরহুম প্রেসিডেন্টকে তারা সব সময় দেখেছে। তাঁর আত্মত্যাগ দেশপ্রেম ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তিনি ছিলেন আমাদের অনেক ঊর্ধ্বে।

প্রশ্নঃ দেশ শাসনের যিনি দায়িত্ব নেবেন তার গুণাবলী সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?
উত্তরঃ শাসন করার জন্য শুধু বুদ্ধিমত্তাই যথেষ্ট নয়। আরো অনেক কিছু প্রয়োজন। যেমন আন্তরিকতা, দেশের জন্য ভালোবাসা, আত্মত্যাগ। কঠোর পরিশ্রম করার ক্ষমতা ইত্যাদি।

প্রশ্নঃ এ প্রেক্ষিতে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট যদি সেনাবাহিনীর কাছে গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে?
উত্তরঃ সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হবে। সেনাবাহিনী রাজনীতিতে মাথা ঘামাবে না। আমি মনে করি সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় আসার মত দুঃখজনক ঘটনা ঘটা উচিত নয়।

প্রশ্নঃ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে যদি সুষ্ঠুভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে সংকট উত্তরণ সম্ভব না হয় তাহলে?
উত্তরঃ আমি নিশ্চিত দেশবাসী সংকট উত্তরণের পথ জানে। এবং দেশবাসী এ সংকট কাটিয়ে উঠবে।

প্রশ্নঃ ৩০ মে’র সঙ্গে জড়িতদের বিচার কখন শুরু হবে?
উওরঃ তদন্ত শেষ হতে আরো তিন/ চার দিন সময় নেবে। তদন্ত শেষে কোর্ট মার্শালের কাজ শুরু হবে। তদন্ত রিপোর্টই আমাদের বলে দেবে কে কতখানি দায়ী? সে ভাবেই দোষীদের বিচার হবে।

প্রশ্নঃ আপনাকে প্রেসিডেন্ট জিয়া অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন এর কারণ কি?
উওরঃ বাংলাদেশের কয়েকটি সংকটময় মুহূর্তে তিনি আমার ভূমিকা দেখেছেন, আমার পেশাগত যোগ্যতার প্রতি তার আস্থা ছিল এবং সংকটময় মুহূর্তে সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে আমার সক্ষমতা সম্বন্ধে তার বিশ্বাস ছিল। আমি সেনাবাহিনী প্রধানের পদ লাভ করেছি। একজন সৈনিকে জীবনে চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?

প্রশ্নঃ কোন কোন সংবাদপত্রে বলা হচ্ছে বেগম জিয়া গৃহবন্দী। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
উওরঃ এটা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর এবং দায়িত্বহীন প্রচারণা। সংবাদপত্রের এই ভূমিকা সম্পর্কে বলবো সংবাদপত্রের কাজ মানুষকে অবহিত করা, মানুষকে বিভ্রান্ত করা নয়। সংবাদপত্র দেশের জনগণের ন্যায্য অধিকারের জন্য মতামত সংবাদে তুলে ধরবে। অন্য কিছু নয়। অথচ কিছু সংবাদপত্র সে কাজ করছে না। বেগম জিয়ার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে যে মন্তব্য করা হচ্ছে তা একটা মিথ্যাচার। আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে বেগম জিয়ার সুখ সুবিধের ব্যবস্থা করছি।

প্রশ্নঃ জেনারেল মঞ্জুর কর্তৃক ৩০ মে’তে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটানোর কারণে সম্বন্ধে আপনার কি মন্তব্য?
উত্তরঃ মঞ্জুর সবসময়ই একজন উচ্চাভিলাষী অফিসার হিসেবে জ্ঞাত ছিলেন। দেশ শাসনের ব্যাপারে তার ধারণা ছিল যে সেই একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি। তিনি সবসময়েই মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়া সম্বন্ধে প্রকাশ্যে কটুক্তি করতেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া এ বিষয়ে অবহিত ছিলেন কিন্তু তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ উদার মনোবৃত্তির দরুন ভাবতেন যে সময়ের আবর্তনে মঞ্জুর তাঁর ভুল বুঝতে পারবে এবং নিজেকে সংশোধন করবে। মঞ্জুর তার একজন বন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের সাথী ছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া স্বপ্নেও ভাবতেন না যে মঞ্জুর ক্ষমতার লোভে এ ধরনের নৃশংস কাজে লিপ্ত হতে পারে।

প্রশ্নঃ যদি বলা হয় প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রাণরক্ষা সেনাবাহিনী ব্যর্থ হয়েছে তাহলে আপনি কি বলবেন?
উত্তরঃ প্রেসিডেন্টর অভ্যন্তরীণ সফরকালে যখনই তিনি ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে থাকতেন তখনই তার দেখাশোনা ও প্রাণ রক্ষার দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর ওপর ন্যস্ত থাকত। এক্ষেত্রে যদিও প্রেসিডেন্ট জিয়া ক্যান্টনমেন্টের বাইরে চিটাগাং সার্কিট হাউসে রাত্রিযাপন করছিলেন এবং চিটাগাং ডিভিশনের সর্বোচ্চ সামরিক অফিসার হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রাণরক্ষার নৈতিক দায়িত্ব মঞ্জুরের ওপরই বর্তায়। মঞ্জুর প্রেসিডেন্ট জিয়ার একজন বিশ্বস্ত লোক ছিলেন কিন্তু সে যেখানে মুষ্টিমেয় কিছু সেনাবাহিনীর সদস্যকে নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছে সেখানে প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রাণ রক্ষা করতে না পারায় সমস্ত সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করাটা আমার মতে কিছু অন্যায় হবে। এ প্রসঙ্গে আপনাদের ভুললে চলবে না যে মঞ্জুর ও তার বিপ্লবী সাথীদের দমন করতে সামরিক বাহিনীর বাকি সদস্যরা সমস্ত শক্তি ও ইচ্ছা দিয়ে নিয়োজিত ছিল। অবশ্য তাদের এ প্রচেষ্টায় দেশের সকলস্তরের লোকই অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন।

প্রশ্নঃ জেনারেল মঞ্জুরের মৃত্যু সম্বন্ধে আপনার মন্তব্য কি?
উওরঃ জেনারেল মঞ্জুরের মৃত্যু নিয়েও নানা রকম গুজব রটেছে। এ ব্যাপারে আমার এখন অফিশিয়ালি কোর্ট অব ইনকোয়ারী রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি। তবে মোটামুটি ঘটনাটি এ রকম। জেনারেল মঞ্জুর এবং তাঁর সমর্থনকারী তিনি ব্রিগ্রেড কমান্ডার প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছে জেনে সৈন্যগণ বিহ্বলিত এবং ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা বিপুল সংখ্যায় বিদ্রোহীদের দল ছেড়ে চলে আসে। সরকারের অবিচলিত মনোভাব এবং আসন্ন আক্রমণের সম্ভাবনা দেখে বিদ্রোহের নায়ক, তার ব্রিগ্রেড কমান্ডারগণ এবং অফিসারসহ পালিয়ে যান। এতে কমান্ড চ্যানেল একেবারে ভেঙে পড়ে। যে কোন সৈনিক পলায়নকারী কমান্ডারকে ঘৃণা করে বিশেষ করে যখন তাদেরকে অনিশ্চিত দুর্যোগের সামনে ঠেলে দিয়ে যান। গ্রেফতারের পর তাকে যখন ক্যান্টনমেন্ট আনা হয় তখন সৈনিকরা তাকে ঘিরে ফেলে।

প্রশ্নঃ বিচিত্রার পাঠকদের উদ্দেশ্যে আপনি কি কিছু বলবেন?
উওরঃ বর্তমান বিশ্বের বিরাজমান অশুভ পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল যে কোন দেশের মতো বিভিন্ন সমস্যার আবর্তে পতিত বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের বর্তমান সময়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া উচিত। সর্বশ্রেণীর জনগণ দল মত ও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রেখে শৃঙ্খলা ও ঐক্যের বলে বলিয়ান হয়ে দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়নতার পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখে দেশের সাধারণ জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে সহায়তা করবেন বিচিত্রা পাঠকদের কাছে এটাই আমি আশা করি।

সাক্ষাৎকার— শাহাদাত চৌধুরী/ মাহফুজউল্লাহ
আলোকচিত্র— মাহফুজউল্লাহ

সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রতি জেনারেল এরশাদের বিবৃতি ও ভাষণ

গত ৩০ মে যেদিন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলেন সেদিন সেনাবাহিনীর স্টাফপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ কোন রকম প্ররোচনায় বিভ্রান্ত না হয়ে, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে নিজ নিজ কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকার জন্যে গোটা দেশের সশস্ত্রবাহিনীর সকল সদস্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। জাতীয় বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারিত এক বিবৃতিতে জেনারেল এরশাদ বলেছিলেন, শনিবার জোরে চট্টগ্রামে কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী বাংলাদেশের মহামান্য প্রেসিডেন্ট জনাব জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছে। দুস্কৃতিকারীরা নিজেদের বিপ্লবী পরিষদ বলে চট্টগ্রাম বেতারে দাবী করছে। বিবৃতিতে জেনারেল এরশাদ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে মুষ্টিমেয় এই বিপথগামী দুষ্কৃতকারী ছাড়া দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সকল সদস্য সরকারের প্রতি অনুগত রয়েছেন এবং জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষায় তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
জেনারেল এরশাদ দুষ্কৃতিকারীদের অবিলম্বে সরকারের কাছে আত্মসমর্পনের নির্দেশ প্রদান করেন এবং বলেন, আমি এই সঙ্গে আত্মসমর্পণকারীদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সহায় হোন। ৩১ মে সেনাবাহিনীর স্টাফপ্রধান লেঃ জেনারেল এইচ এম এরশাদ এক চূড়ান্ত নির্দেশ জারী করেন। এ নির্দেশে তিনি সোমবার ১ জুন, সকাল ৬টার মধ্যে মেজর জেনারেল মঞ্জুরসহ চট্টগ্রামের সকল দুষ্কৃতিকারী ও তাদের কমান্ডিং অফিসারদের আত্মসমর্পণ করতে বলেন।
জেনারেল এরশাদ বলেন, অনুগত বিপুল সংখ্যক অফিসার ও সৈন্য আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে বলে এই সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, বিপুল সংখ্যক অনুগত অফিসার ও সৈন্য তার আহ্বানে সাড়া দিতে শুরু করেছে। জেনারেল এরশাদ চূড়ান্ত সময়সীমার মধ্যে আত্মসমর্পণ করে সাধারন ক্ষমার সুযোগ গ্রহণের জন্য চট্টগ্রামের বিপথগামী অফিসার ও সৈন্যদের প্রতি আহ্বান জানান। যারা তাঁর নির্দেশ মানবে তিনি তাদের পূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন যে ইতিমধ্যেই ৩০৫ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার্স, ৬ষ্ঠ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমগ্র ব্যাটেলিয়ন, কমান্ডারসহ সমগ্র দ্বাদশ ফিল্ড রেজিমেন্ট, একাদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিকাংশ সৈন্য, ২৮ তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বিভিন্ন ইউনিটের বিভিন্ন পদমর্যাদার বহু সৈনিক তাদের ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ করেছে। তিনি সশস্ত্রবাহিনীর দেশপ্রেমিক ও অনুগত অফিসার এবং সদস্যদের মুষ্টিমেয় বিপথগামী অফিসার ও সৈন্যকে নিরস্ত্র করার নির্দেশ দেন।
লেঃ জেনারেল এরশাদ সেনাবাহিনীর অনুগত অফিসার ও জওয়ানদেরকে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রটিকে তাদের নিয়ন্ত্রণে এনে রেডিও বাংলাদেশের ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠানসূচী সম্প্রসারণের নির্দেশ দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর প্রধান বলেন যে সশস্ত্রবাহিনীর অনুগত সকল সদস্য দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর আহবানে সাড়া দেবেন বলে তিনি দৃঢ়রূপে বিশ্বাস করেন।
মেজর জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বে সশস্ত্রবাহিনীর মুষ্টিমেয় বিপথগামী সদস্যের তথাকথিত বিদ্রোহ দমনের জন্যে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ও সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বিচারপতি জনাব আব্দুস সাত্তার লেঃ জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতা দেয়ার পরই তিনি উপরোক্ত নির্দেশ দান করেন। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বলেন, সেনাবাহিনী প্রধান তাঁর পক্ষে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
৫ই জুন সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ সকালে কুমিল্লা সেনানিবাস পরিদর্শন করেন। সৈন্যদের উদ্দেশে ভাষণদানকালে তিনি দেখতে পান তারা সুশৃঙ্খল ও ঐক্যবদ্ধ এবং কায়েমী স্বার্থের যে কোন অশুভ ষড়যন্ত্র ও হঠাকারিতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দূর্ভেদ্য দূর্গ গড়ে তুলতে প্রস্তুত।
আইএসপিআর- এর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মুষ্টিমেয় দুষ্কৃতকারীর ঘৃণ্য অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়ার সময় সৈনিকরা ঐক্য, শৃংখলা এবং গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি আনুগত্যের যে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন তার জন্য অভিনন্দন জানিযয়ে সেনাবাহিনী প্রধান আশ্বাস দেন যে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নৃশংস হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচার করে শাস্তি দেয়া হবে।
এর আগে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং তার সঙ্গে শাহাদৎ বরণকারী অন্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সেনাবাহিনী প্রধান মরহুম নায়েক মোহম্মদ আবু তাহেরের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার থানার বরোরাতেও যান। তিনি মরহুমের পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে দেখা করেন এবং ২২ হাজার ৫শ টাকার একটি চেক স্ত্রীর হাতে দেন। তিনি ঘোষণা করেন যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নায়েক আবু তাহেরের সন্তানদের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করবে। পরে গ্রামবাসীর সঙ্গে আলাপকালে জেনারেল এরশাদ বলেন, নায়েক আবু তাহের আমাদের প্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রাণরক্ষার চেষ্টায় কর্তব্যপরায়ণতা আনুগত্য ও সাহসিকতার দূর্লভ দৃষ্টান্ত রেখে যে গৌরবময় মৃত্যুকে বরণ করেছেন তার জন্য তাদের গর্ববোধ করা উচিত। সেনাবাহিনী প্রধান গ্রামবাসীদের সঙ্গে শহীদানের রুহের মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করেন। গত ৬ জুন সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান লেঃ জেনারেল এইচ এম এরশাদ সকালে যশোর সেনানিবাস পরিদর্শনে যান। আইএসপিআর-এর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে একথা বলা হয়।
তিনি যশোর গ্যারিসনের অফিসার ও জোয়ানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং তাদেরকে আগের মতই জাতীয় সংহতি,
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখতে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। কতিপয় বিপথগামীর উচ্চাভিলাসী উদ্যোগের নিন্দা করে জেনারেল এরশাদ আশা প্রকাশ করেন যে, তারা বিবেক, যুক্তি, দায়িত্ববোধ ও আনুগত্যকে সব রকম ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে যাবেন। দুষ্কৃতিকারীদের ঘৃণ্য অপরাধের উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান বিশেষ গুরুত্বসহকারে বলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত অপরাপর অফিসার ও জওয়ানরা শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারবে না।
জাতি তাদেরকে ক্ষমা করবে না। প্রেসিডেন্ট জিয়ার জীবন রক্ষার চেষ্টায় যারা তাদের জীবন বিসর্জন দেন, সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বলেন তাদের ভূমিকা শুধুমাত্র সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদাই সমুন্নত করেনি, অধিকন্তু সামগ্রিকভাবে জাতির মর্যাদাও সমুন্নত করেছে। জেনারেল এরশাদ আরও বলেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাকের দোয়ায় জাতি সংকটজনক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠেছে।
সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান সৈনিকদেরকে বেগম জিয়াউর রহমানের কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও সৈনিকদেরকে খুবই ভালবাসতেন।

চট্টগ্রাম সেনানিবাস

৮ জুন সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান লেঃ জেনারেল এইচ এম এরশাদ সকালে চট্টগ্রাম সেনানিবাস পরিদর্শন করেন বলে আইএসপিআরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার প্যারেড ময়দানে সেনানিবাসের অফিসার ও জোয়ানদের উদ্দেশ্যে ভাষণদানকালে জেনারেল এরশাদ বলেন যে মুষ্টিমেয় বিপথগামীর অপরাধের জন্য গোটা সেনাবাহিনীর উপর দোষারোপ করা যায় না। তিনি বলেন যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৎ ও দেশপ্রেমিক সদস্যদের সময়োচিত প্রতিরোধের জন্যেই জাতি একটি বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যারা শাহাদাৎ বরণ করেন তাঁদের সাহসিকতার উল্লেখ করে জেনারেল এরশাদ তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক শোক জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, অর্থ দিয়ে তাঁদের ক্ষতিপূরণ করা যাবে না। যে উদ্দেশ্যে তাঁরা তাঁদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন তা সমুন্নত রেখেই কেবল তাঁদের আত্মদান স্মরণীয় করে রাখা সম্ভব। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পটভূমির উল্লেখ করে সেনাবাহিনী স্টাফ প্রধান বলেন যে দেশের সীমিত সম্পদ থেকে সশস্ত্র বাহিনীর বর্তমান পর্যায়ে উন্নীর করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়া বিরাট ভূমিকা পালন করে গেছেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে যাঁরা নিহত হন তাঁদের পরিবারের জন্য বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ৬০ হাজার টাকা দানের উল্লেখ করে জেনারেল এরশাদক একে ভ্রাতৃসুলভ শুভেচ্ছা বলে বর্ণনা করেন এবং বলেন যে সকল প্রচেষ্টা যাতে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পরিচালিত হয় সেজন্য আন্তঃসার্ভিস মৈত্রী ও ঐক্য অবশ্যই বজায় রাখতে হবে।
৯ জুন সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ সকালে ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন ইউনিট পরিদর্শন করেন। তিনি সেনাবাহিনীর অফিসার ও জওয়ানদের উদ্দেশে ভাষণদানকালে বলেন দেশ এক সংকটজনক অবস্থা অতিক্রম করেছে, সুতরাং তাদের আগের চেয়েও ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃংখল হতে হবে। তিনি বলেন যে তাঁদের এখন সাহস কর্তব্যনিষ্ঠা ও আনুগত্যের মাধ্যমে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
বক্তৃতার আগে সবখানে প্রেসিডেন্ট ও তার সঙ্গে নিহতদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। জেনারেল এরশাদ পরে শেরে বাংলা নগরে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণ অনুষ্ঠানে নবম পদাতিক বাহিনীর জিওসি, সেনাবাহিনীর সদর দফতরের প্রধান স্টাফ অফিসার ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। সে সময় মরহুম প্রেসিডেন্টেত প্রতি সম্মান জানাতে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটও উপস্থিত ছিল।
১০ জুন সেনাবাহিনী স্টাফ প্রধান লেঃ জেনারেল এইচভেম এরশাদ বগুড়া ও রংপুর সেনানিবাস পরিদর্শন করেন বলে আইএসপিআরের এক প্রেস বিজ্ঞাপ্তিতে জানা গেছে।
এ দুটো স্থানে অফিসার ও জোয়ানদের উদ্দেশে ভাষণদানকালে জেনারেল এরশাদ সুস্পষ্টভাবে বলেন যে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব দেশকে রক্ষা করা। এবং সংবিধানকে সমুন্নত রাখা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে কোন মূল্যে আরো ঐক্য, শৃখংলা ও আনুগত্যের সঙ্গে এ পবিত্র দায়িত্ব পালন করবে।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রাণরক্ষার প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে যারা আত্মদান করেন তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে জেনারেল এরশাদ বলেন যে তারা তাদের জীবনের বিনিময়ে সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা সমুন্নত রেখেছেন। তিনি তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সম্ভাব্য সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দেন। যেসব সৈন্য সাহসের সঙ্গে দুষ্কৃতিকারীদের নির্মূল করেন, জেনারেল এরশাদ তাদের অভিনন্দন জানান। আমাদের প্রিয় প্রেসিডেন্টকে যারা হত্যা করেছে তাদের নিন্দা করে সেনাবাহিনী স্টাফ প্রধান বলেন যে তারা শুধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নয়, জাতির ইতিহাসকেও কলংকিত করেছে। তিনি পুনরুল্লেখ করেন যে রেহাই দেওয়া হবে না।
বগুড়া সেনানিবাসে স্থানীয় আর্মি ডিভিশনের অস্থায়ী কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মোঃ আনোয়ার হোসেন সেনাবাহিনী স্টাফ প্রধানকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি তাঁর সঙ্গে সৈয়দপুর ও রংপুর সেনানিবাসে গমন করেন।
১৩ জুন সাভার সেনানিবাসের অফিসার ও জওয়ানদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ একটি সংকটময় মুহূর্তে কিছু বিপথগামী সদস্যের উস্কানির মুখে সেনাবাহিনীর সদস্যগণ সংহতি, ঐক্য ও শৃংখলার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যে কঠোর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, তার জন্য তাদের অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান সংরক্ষণ সেনাবাহিনীর পবিত্র কর্তব্য এবং তারা তা সঠিকভাবেই পালন করেছেন। তিনি ভবিষ্যতে এরূপ ঘৃণ্য তৎপরতা ভন্ডুল করে দিতে সেনাবাহিনীকে সদা প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। জেনারেল এরশাদ আরও উল্লেখ করেন যে সশস্ত্র বাহিনীর ভ্রাতৃপ্রতিম অন্য দুটো বাহিনীও জাতীয় সংকট অতিক্রমণে অবদান রেখেছেন। তিনি দৃঢ় আস্থা ব্যক্ত করেন যে আন্তবাহিনী সম্প্রীতি ও ঐক্য জনগণ ও সরকারের প্রতি ভবিষ্যতের যে কোন হুমকিও ব্যর্থ করে দেবে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জীবন রক্ষার চেষ্টায় যারা শাহাদত বরণ করেন, জেনারেল এরশাদ তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। তিনি পুনরায় বলেন যে শহীদদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের কল্যাণে সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। তিনি সেনাবাহিনীর প্রতি বেগম জিয়াউর রহমাদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন পৌঁছে দেন। তার স্বামীর হত্যাকারীদের ধ্বংস করে দেবার জন্য বেগম জিয়া তাদের অভিনন্দন জানান। শহীদদের আত্নার মাগফেরাত কামনায় ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এর আগে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
অর্থনীতি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!