শপথ দিবসের বিশাল জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রবিবার বিকালে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ঐতিহাসিক গণসমাবেশে বিপুল করতালির মধ্যে ঘােষণা করেন যে, ২০ মার্চের পর থেকে দুর্নীতি ও মুনাফাখােরদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালাননা হবে। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, ২০ মার্চের পর থেকে বাংলার মাটিতে তার পূর্বকথিত লাল ঘােড়া দাবড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী ২০ মার্চের মধ্যেই রাইফেল, বন্দুক, পিস্তলসহ অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র সরকারের কাছে জমা দানের জন্য সমাজ বিরােধীদের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী এই সব সমাজ বিরােধীদের খতম করার জন্য সরকারের সাথে জনগণের সহযােগিতা কামনা করে বলেন, গণআন্দোলনের মাধ্যমে এদের রুখে দাঁড়াতে হবে, খতম করতে হবে।
উৎপাদন বাড়ান : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তােলার জন্য ক্ষেতে খামারে উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে খাদ্য শস্যের যে ঘাটতি রয়েছে তা পূরণ করা না গেলে দেশের জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব হতে পারে না। তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, যে ভাবে পারেন ফসল উৎপাদন করতে হবে। তা না হলে বাংলার মানুষকে বাঁচানাে যাবে না। এই প্রসঙ্গে দেশের এক টুকরাে জমিও যেন অনাবাদী না থাকে তার প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিশ্বের খাদ্য ঘাটতি রয়েছে তাই কোথাও খাদ্য শস্য কেনার জন্য পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, দেশের মানুষকে যাতে খাদ্যের অভাবে অধিক পরিমাণ কষ্ট করতে না হয় তার জন্য ১০ লাখ টন গম কেনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কল কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বলেন, আগামী ২/১ মাসের মধ্যে পে’কমিশন রিপাের্ট প্রকাশিত হবে। তাতে শ্রমিকদের বাঁচার মতাে ন্যায্য বেতন দানের ব্যবস্থা থাকবে বলে তিনি জানান। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, আমি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। তিনি জোর দিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র বাংলার মাটিতে কায়েম হবে। এই সম্পত্তি নষ্ট করার কারাে সাধ্য নেই, কোনাে অধিকার নেই।
সাধারণ নির্বাচন : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবারের সাধারণ নির্বাচনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বলেন, নির্বাচনে বাংলার মানুষ আমার দলের প্রার্থীদের ভােট দিয়েছে- সােনার বাংলা গড়ার জন্য। জনগণ নির্বাচনে সুস্পষ্ট ভাবে রায় দিয়েছে দেশে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে এবং শােষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের ঘােষণা পত্রের প্রত্যেকটি ওয়াদা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী অভিযােগ করেন যে, বিগত সাধারণ নির্বাচনে কোন কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। দেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ানাের চেষ্টা করেছে। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, বাংলার মাটিতে চিরদিনের জন্য সাম্প্রদায়িকতার কবর হয়েছে।
অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, গত ৭ মার্চের নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন যে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে, তা দুনিয়ার মানুষ দেখেছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে হেরে গেলেই মানুষ নানা কথা বলে থাকে। তিনি বলেন, নির্বাচনে ভােট পেতে হলে মানুষকে ভালােবাসতে হয় এবং মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, জনগণের ভালােবাসা না পেলে এক মুহূর্তও ক্ষমতায় থাকতে চাই না। তিনি বলেন, জনগণই আমার রাজনীতির ক্ষমতার মূল শক্তি ।
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত চলছে : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা নস্যাতের চক্রান্ত চলছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কষ্টকর, তা রক্ষা করা আরও কষ্টকর।
যুদ্ধাপরাধী: প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে, কেউ তা রুখতে পারবে না বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা বাংলার মানুষকে হত্যা করেছে এবং নারী নির্যাতন করেছে তাদের ক্ষমা নেই।
জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, নির্বাচনে যে ভালােবাসা যে আস্থা আমাকে এবং আমার দলকে দেখিয়েছেন, তার জন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, নির্বাচনের এই বিজয় শেখ মুজিবুর রহমানের নয়, আওয়ামী লীগের নয়, এই বিজয় আদর্শ ও নীতির বিজয়- এই বিজয় বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়। পরিশেষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, জাতীয় সংসদ সদস্যের কোন রকম সুপারিশ চলবে না। তিনি বলেন, বাংলার মাটিতে স্বজনপ্রীতি চলতে দেয়া হবে না।৬৯
রেফারেন্স: ১৮ মার্চ ১৯৭৩, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ