এ বিজয় সমগ্র জাতির- সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেন যে, জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসার নিশ্চয়তা বিধানই হবে সরকারের আশু করণীয় কাজ। প্রধানমন্ত্রী গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে এক জনাকীর্ণ দেশি বিদেশি সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছিলেন। এক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তার দলের ঘােষণাপত্রে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কর্মসূচি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিদেশি শক্তিবর্গ দ্বারা বহু সমস্যা জাতি আজ মােকাবেলা করছে। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, আমাদেরকে অবশ্যই ক্ষুধা, ব্যাধি ও নিরক্ষরতা দূর করে লক্ষ লক্ষ দুঃখী মানুষের জীবন যন্ত্রণার মৌলিক সুযােগ সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ বিজয় সারা জাতির নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তার দলের বিজয় লাভ কোন ব্যক্তিগত দলের সাফল্য নয়। বরং এটা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়। তিনি বলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা চরম ত্যাগ স্বীকার করেছেন এ বিজয় তাদেরও জয়ের প্রতীক।
প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, জনগণ তার সরকারের গৃহীত ও ভবিষ্যতে গৃহীত নীতির প্রতি অভিনন্দন জানিয়েছে। তিনি বলেন, জনগণ চার রাষ্ট্রীয় নীতি, সংবিধান এবং তার অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতিকে অভিনন্দন করেছে। তিনি বলেন, জাতি পুনরায় তার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছে এবং নির্বাচনের ফলাফলের ভিতর দিয়ে জাতি তা প্রদর্শন করেছে।
নির্বাচন নিরপেক্ষ ও অবাধ হয়েছে : প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গত বলেন যে, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিরােধী দল সম্পর্কে : বিরােধী দল সম্পর্কে জনৈক সাংবাদিকের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, সবাইকে অবাধভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেয়া হয়েছে এবং ফলাফল সবারই জানা ছিল। তিনি প্রসঙ্গত বলেন, জনগণের আস্থা অর্জনের মধ্যে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। এই আস্থা অর্জনের জন্য ত্যাগ তিতিক্ষা, অধ্যবসায় এবং জনগণের প্রতি শুভেচ্ছা ও ভালােবাসা রাখা অপরিহার্য প্রয়ােজন। তিনি বলেন, আপনি একমাত্র ভালােবাসা ও ত্যাগের মাধ্যমে জনগণের হৃদয় জয় করতে পারেন।’ তিনি বলেন, তিনি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করেছেন এজন্য যে, তিনি সারাজীবন জনগণকে ভালােবেসে আসছেন। এবং তাদের জন্য দুঃখ নির্যাতন ভােগ। করে এসেছেন। বিনিময়ে তারা আমাকে ভালােবাসে’ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পর্কে: নির্বাচনে তার দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন যে, দুর্নীতিবাজ লোেকদের নির্মূল এবং সামাজিক অনাচার নিশ্চিহ্ন করার জন্যে সময় সময় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়ােজন।
বিশ্ব শান্তি চাই : বঙ্গবন্ধু জনৈক সাংবাদিকের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তিতে বিশ্বাসী এবং বিশেষ করে উপমহাদেশের দেশগুলাের মধ্যে শান্তি কামনা করেন। তার সরকারের কোন কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে এ মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, সেটা হলাে ক্ষুধা থেকে মুক্তি।
দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে : প্রধানমন্ত্রী নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য হ্রাসের জন্য জনগণের সহযােগিতা ও সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে এ সমস্যা সমাধান করি। অবশ্য তিনি বলেন, আমরা এ ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।
যুদ্ধবন্দী প্রসঙ্গে । অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা মানবতা বিরােধী অপরাধ করেছে, সে সব পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের বিচার শীঘ্রই বাংলাদেশের মাটিতে হবে। তিনি বলেন, পাকিস্তানে আটক চার লাখ বাঙালির সম্পর্কে আপনারা কিছু জিজ্ঞাসা করছেন না কেন? তিনি বলেন, কোন আন্তর্জাতিক সংস্থাই তাদের প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছে না। অথচ এসব আটক বাঙালিরা জেলে ও শিবিরে অমানবিক অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে যেসব অবাঙালি। পাকিস্তানে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, আন্তর্জাতিক রেডক্রস তাদের দেখাশুনা করছে।
মুজিববাদ প্রসঙ্গে : কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতার কথিত নির্বাচনে মুজিববাদের ম্যান্ডেট হবে এ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর মনােভাব জানতে চাইলে তিনি বলেন যে, চারটি নীতির জন্যে তিনি লড়াই করেছেন। সে চারনীতি (জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা) জনগণ গ্রহণ। করেছে এবং তার ভিত্তিতে অস্ত্রধারণ করে দেশকে মুক্ত করেছে। সংবিধানে সন্নিবেশিত এ চার নীতি অনুসারে দেশ শাসিত হবে। যে কেউ এর যেকোন নাম দিতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে মন্ত্রিসভার সদস্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, জনাব সােহরাব হােসেন, জনাব সামছুল হক, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান, আওয়ামী যুবলীগ প্রধান শেখ ফজলুল হক মণি, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব জনাব তােফায়েল আহমেদ ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতা উপস্থিত ছিলেন।৩০
রেফারেন্স: ৮ মার্চ ১৯৭৩, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ