সােনার বাংলা গড়ার জন্যে ম্যান্ডেট দিন- বঙ্গবন্ধু
দিরাই। আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে আমাকে এবং আমার দলের পক্ষে কেবল ভােট দিলেই আমি সন্তুষ্ট হব না। ভােটের সাথে সাথে একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী সােনার বাংলা গঠনে এই দেশের জনগণ কঠোর পরিশ্রম করুক—এটাও আমি চাই। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুনামগঞ্জ মহকুমার সুদুর পল্লীর এই হাওর এলাকায় এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দানকালে আজ উপরােক্ত । কথা ঘােষণা করেন। তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলেন যে, জনগণ তার দলীয় প্রতীক নৌকায় ভােট দেবেন। এই মর্মে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে, আমি এই দেশের মানুষকে জানি। বঙ্গবন্ধু বলেন, তিনি স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং বিশ্বে ৯৯ টি দেশ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি বলেন, তার স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। কিন্তু সােনার বাংলার স্বপ্ন এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী এই মর্মে উল্লেখ করেন যে, এদেশের মানুষের অন্নের ও বস্ত্রের অভাব থাকবে না এবং বেকার সমস্যার যখন সমাধান হবে, তখনই তার সােনার বাংলা গড়া বাস্তবে রূপ নেবে। আসন্ন নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ হবে— একথা উদাত্ত কণ্ঠে ঘােষণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণ তাদের পছন্দ অনুযায়ী যে কোন ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে ভােট দিতে পারবে। নির্বাচনের আগে এটাই তার শেষ সভা বলে উল্লেখ করে তিনি আগামী নির্বাচনে ভােট দেয়ার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু যে পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ বিদেশি শক্তির ফলে এক কালে সােনার বাংলা শােষণে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষকে আর কেউ শােষণ করতে পারবে না বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, জনগণ দেশের সম্পদ উপভােগ করবে। তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে ক্ষেতে খামারে এবং শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। ঔপনিবেশিক শাসকদের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, গত ২৫ বছরে তারা এই দেশে কৃষি উন্নতির কোন চেষ্টাই করেনি। প্রধানমন্ত্রী এই মর্মে উল্লেখ করেন যে, সার, সেচ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সুযােগ সুবিধার ব্যবস্থা করতে পারলে বাংলাদেশের উর্বর মাটিতে সােনা ফলতে পারে। কিন্তু রাতারাতি কোনাে কিছু অর্জন করা সম্ভব নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সােনার মানুষ অন্ন ও বস্ত্র চায়। তাছাড়া তাদের অন্য কোনাে দাবি চাওয়ার নেই। বঙ্গবন্ধু এই মর্মে উল্লেখ করেন যে, কেবলমাত্র বড় বড় শহরের কতিপয় সচ্ছল ব্যক্তি উচ্চাশা পােষণ করছে এবং তারা আরও গাড়ি-বাড়ি চায় এবং তাদের ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, এ দেশের সাধারণ মানুষকে সুখী রাখার উদ্দেশ্যে তাদের অন্ন, বস্ত্র এবং অন্যান্য। মৌলিক সুযােগ সুবিধা নিশ্চিত করাই তার লক্ষ্য। শাসনতন্ত্রের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় চার নীতির উপর ভিত্তি করে রচিত শাসনতন্ত্রের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এদের সম্পদের মালিক হওয়ার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সংক্ষেপে রাষ্ট্রীয় চার নীতির ব্যাখ্যা করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। বঙ্গবন্ধু জোর দিয়ে ঘােষণা করেন যে, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে কেউ ধর্মকে ব্যবহার করতে পারবে না। বক্তৃতার এক পর্যায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জনগণের আস্থা আছে কি না এবং আসন্ন নির্বাচনে তারা তার দলের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা মার্কায় ভােট দেবে কি না জানতে চাইলে, সমাবেশের জনতা হাত তুলে সম্মতি জানায়। তিনি সমাবেশে জনতার উদ্দেশ্যে বলেন যে, তাদের নির্বাচনী এলাকায় তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুস সামাদকে মনােনীত করেছেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে আটক নিরপরাধ বাঙালিদের কথা উল্লেখ করে বলেন, কোন আইনে তাদের আটক রাখা হয়েছে, তা তিনি বিশ্ব বিবেকের কাছ থেকে জানতে চান। আটকে পড়া বাঙালিদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি না খেলে ভুট্টো নিজের দেশকে রক্ষা করার জন্য তিনি তার প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানে যেসব বাঙালি আটক রয়েছে, তারা স্বদেশে ফিরে আসবে। পাকিস্তান তাদের আটকিয়ে রাখতে পারবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। বঙ্গবন্ধু এই মর্মে উল্লেখ করেন যে, তারা কেবল এই দেশের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেনি এই সমস্ত নরপশুরা অবুঝ শিশুদেরকেও টুকরােটুকরাে করে কেটেছিল। তিনি যেসমস্ত লােকেরা লুটতরাজ ও ডাকাতি করে এদেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট বাড়িয়ে তুলেছে তাদের কঠোর হস্তে দমন করার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।৯
রেফারেন্স: ৩ মার্চ ১৯৭৩, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ