গণতন্ত্র চাইলে জনগণের রায় গ্রহণ করুন- বঙ্গবন্ধু
বৃহস্পতিবার সকালে মানিকগঞ্জ ষ্টেডিয়ামে এবং মুন্সিগঞ্জ কলেজ ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর গণসংযােগে বৃক্ষ রােপণ উপলক্ষে আয়ােজিত দুটি বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কষ্টকর। বাংলার দুঃখী মানুষ দু’বেলা পেট ভরে ভাত খেতে না পেলে স্বাধীনতা ব্যর্থ। তিনি বলেন, কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হলে দেশের প্রতিটি মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে দেশ গড়ার কাজে ব্রতী হতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর হেলিকপ্টার যখন মানিকগঞ্জ ষ্টেডিয়ামের পাশে এক ঘণ্টা দেরীতে অবতরণ করে তখন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিকলীগ নেতৃবৃন্দসহ বিপুল জনতা উল্লাসে বঙ্গবন্ধুকে সম্বর্ধনা জানায়। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা মঞ্চে আরােহণ করলে তাকে মাল্য ভূষিত করা হয় এবং সমবেত জনতা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর পিছে বাঙালিরা আছে, জয় বাংলা, জয় মুজিববাদ ইত্যাদি শ্লোগানে ষ্টেডিয়াম ময়দান মুখরিত করে তােলে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করে সােনার বাংলায় পরিণত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশে সােনার মানুষ পয়দা না হলে আমি একা সােনার বাংলা গড়তে পারবাে না। বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘােষণা করেন যে, কৃষক শ্রমিকরাই দেশের প্রকৃত সােনার মানুষ। তিনি দেশের চোর, গুন্ডা, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখাের ও মুনাফাখােরদের নির্মূল করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জনান। তিনি বলেন, অস্ত্র যারা জমা দেয়নি, তারাই অবাধে চুরি ডাকাতি, রাহাজানি ও খুন খারাবি করে বেড়াচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি যেখানেই যাই, সেখানেই বাংলার মানুষের আর্ত হাহাকার শুনতে পাই। তিনি বলেন, বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য আমার প্রাণ কাঁদে। কোথায় ফসল হলাে না, কাদের রাতের ঘুম হয় না। তাও আমি জানি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখাের, চোর-ডাকাতকে নির্মূল করতে না পারলে দেশের মানুষের জীবনে শান্তি আসবে না। তিনি বলেন, শহরের দুরস্ত কাপড়চোপড় পরা ভদ্দর লোেকরাই দেশটাকে ডােবাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন শােষক বাংলার মাটি আঁকড়ে থাকতে পারবে না। দুঃখ কষ্ট যদি আরও ভােগ করতে হয়, তবুও করবাে। কিন্তু বাঙালি হিসাবে যেনাে আমরা দুনিয়ার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, সে প্রচেষ্টা আমি অব্যাহত রাখবই। তিনি বলেন, বাংলার মানুষকে আমি ভালােবাসি এবং এ ভালােবাসা সম্বল করেই আমি মরতে চাই। বঙ্গবন্ধু বলেন, দেশ চালাবার একটি পন্থা হিসাবে আমি নির্বাচন দিয়েছি। আমার লক্ষ্য বাংলার মানুষই যেন বাংলার সম্পদ ভােগ করে যেতে পারে।
জনগণের দলিল, সংবিধান : বঙ্গবন্ধু বলেন, কোন যুগে কোন দেশ ১১ মাসের মধ্যে সংবিধান দিতে পারেনি। আমি সংবিধান দিয়েছি। এবং এ সংবিধান হচ্ছে জনগণের রক্তে লেখা দলিল। চার রাষ্ট্রীয় আদর্শ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে, হিন্দুরা পালন করবে তাদের ধর্মীয় আদর্শ। ধর্ম নিয়ে বাংলাদেশে কাউকে ব্যবসা করতে দেয়া হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য যারা ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে, তাদের উদ্দেশ্যে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
বাংলাদেশ আছে, চিরকাল থাকবে : প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বর্বরতা উল্লেখ করে বলেন যে, পাকিস্তান হানাদার দস্যুরা স্বাধীনতা সংগ্রামকালে শুধু তিরিশ লাখ মানুষকে হত্যাই করেনি—তারা পরিকল্পিত উপায়ে বাংলার সর্বস্ব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। তিনি বলেন, বাঙালিরা যাতে কোনাে দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য বর্বর হানাদার বাহিনী অর্থনীতি এবং যােগাযােগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলেন, হানাদার বাহিনী আমাদের কলকারখানা ধ্বংস করে গেছে। ফলে দেশে বেকার সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, হানাদার বাহিনী আমাদের খাদ্য গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। রেল লাইন, সেতু এবং বন্দর ধ্বংস করেছে, স্বর্ণালংকার ও বৈদেশিক মুদ্রা লুণ্ঠন করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এখন স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের প্রতিটি সম্পদ এখন জনগণের। কাজেই বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে, বাংলার মানুষকে বাঁচাতে হবে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ আছে, বাংলাদেশ চিরকাল টিকে থাকবে। পৃথিবীর কোন শক্তিই বাংলার সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতে পারবে না।
ভিক্ষুকের ইজ্জত নেই : বঙ্গবন্ধু বলেন, দেশের মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেবার জন্য আমি বিদেশ থেকে সাহায্য এনেছি এবং খাদ্যদ্রব্য কিনছি। কিন্তু তাতেও মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, ভিক্ষুকের জাত কোন দিন ইজ্জত নিয়ে বাস করতে পারবে না। বাংলার মানুষ যাতে পেট ভরে খেতে পায়, সে জন্যে পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়ােগ করতে হবে। নইলে স্বাধীনতার মানে অর্থহীন হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু তার নেতৃত্ব এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার প্রতি জনগণের আস্থা আছে কি না জিজ্ঞাসা করলে সমবেত জনতা দুহাত তুলে তাঁর নেতৃত্ব এবং নৌকা প্রতীকের প্রতি গভীর আস্থা প্রকাশ করে।
দেশাত্মবােধক সংগীত : বঙ্গবন্ধুর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত মানিকগঞ্জের জনসভায় বিভিন্ন দেশাত্মবােধক সংগীত পরিবেশিত হয়। সংগীতাংশে অংশগ্রহণ করেন আরতি, সন্ধা, মিন্টু, শিউলি, শাম্মী, মেরী, আফরােজা, পিযূষ। সভাপতিত্ব করেন মানিকগঞ্জ আওয়ামী লীগ শাখার সভাপতি ও প্রাক্তন এমসিএ জনাব খন্দকার মাজহারুল হক ওরফে চান মিয়া।১
রেফারেন্স: ১ মার্চ ১৯৭৩, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ