ওরা আলােকবর্তিকা হিসেবে চিরদিন বেঁচে থাকবে—রাষ্ট্রপতি
রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত এক বাণীতে বলেছেন, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে উপনিবেশবাদী হামলা থেকে রক্ষা করার জন্যে যারা নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন তারা স্বাধিকার সংগ্রামের পথ নির্দেশক এক উজ্জ্বল আলােকবর্তিকা হিসেবে বেঁচে থাকবেন। তাদের সেই মহান ঐতিহ্যকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য রাষ্ট্রপতি তরুণ সমাজের প্রতি গােষ্ঠী ও আঞ্চলিক স্বার্থের উর্ধ্বে জাতীয় চেতনার আদর্শকে সমুন্নত রেখে অক্লান্ত কর্মসাধনের দৃষ্টান্ত স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির বাণীর পূর্ণ বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলাে :
প্রিয় দেশবাসী,
অমর একুশে ফেব্রুয়ারির এই পূণ্য লগ্নে আমি মরণ জয়ী শহীদদের স্মৃতির প্রতি আমার অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তারা সর্বোচ্চ আত্ম ত্যাগ করেছিলেন বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি তথা জাতীয় অস্তিত্বের উপর উপনিবেশবাদী হামলাকে প্রতিহত করার মহান উদ্দেশ্যে। এটা ছিল বাঙালি জাতির জাতীয় চেতনার উন্মেষ। তার স্বাধিকার সংগ্রামের পথ নির্দেশক এক উজ্জ্বল আলােকবর্তিকা। তারপর সুদীর্ঘ ২০টি বছর তাদের প্রদর্শিত সেই ত্যাগ ও সংগ্রামের পথে জাতি অগ্রসর হয়েছে। কোটি কোটি বাঙালি স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নজিরবিহীন ত্যাগ, তিতিক্ষা ও নিগ্রহ-যন্ত্রণা বরণ করেছেন। লক্ষ লক্ষ নর-নারী হয়েছেন শহীদ। তারই ফলশ্রুতি আমাদের বিজয়দীপ্ত স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। কিন্তু বিজাতীয় শাসন-শােষণের বিরুদ্ধে গৌরবােজ্জ্বল বিজয়ের পরেই আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি। দেশ গড়ার আরাে কঠিন সংগ্রাম আমাদের সম্মুখে। এ সংগ্রামের লক্ষ্য ও তার সঠিক পথ সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার দৃষ্টি ও ধ্যান ধারণা প্রয়ােজন। ২১ ফেব্রুয়ারি এসেছে আমাদের জন্য পথের নির্দেশ নিয়ে। শহীদ স্মৃতির ধ্রুবতারার দিকে তার স্থির, অবিচল অঙ্গুলিসংকেত। জাতীয় মুক্তির সেই অগ্রসৈনিকদের স্মৃতিচারণ ও তাদের প্রতি আমাদের। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন আজ যেন অনুষ্ঠান সর্বস্ব না হয়ে পড়ে। আবেগভরা গান ও পুষ্পাঞ্জলিতেই যেন সীমিত না হয়ে যায়। তাদের চরম কোরবানীতে আমাদের সার্থক করে তুলতে হবে। তারা যে মহান উদ্দেশ্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে চরম আত্মদান করেছিলেন তাকে সফল করতে হবে। দেশের সকল মানুষের জন্য শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধি অর্জন করেই শুধু আমরা তা করতে পারি। আর তার জন্য দেশের প্রত্যেকটি পুরুষ ও নারীকে শহীদের ত্যাগের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে নিজেদের অন্তরে। অন্যায়, দুর্নীতি, লােভ, ভােগ-বিলাস ও স্বার্থপরতার কলুষ থেকে মুক্ত হতে হবে। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ত্যাগ ও সহিষ্ণুতার সাথে করতে হবে কঠোর পরিশ্রম। অসাধুতা ও কর্ম বিমুখতায় ভ্রান্ত পথে স্থিতিশীল উন্নতি আসতে পারে না। সে পথ পরিত্যাগ করতে হবে। আজ বিশেষ করে বাংলার তরুণ সমাজকে সম্বিত ফিরে পেতে হবে। আমার অতি স্নেহের শিক্ষার্থী ভাইবােনেরা তােমরা সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের উত্তরসুরী। যুগে যুগে বিশেষত আমাদের জাতীয়। সংগ্রামে তােমরা নিঃস্বার্থ আদর্শের পতাকা বহন করেছ। তারুণ্যের মহান ঐতিহ্যকে তােমাদের অম্লান অক্ষুন্ন রাখতে হবে। তােমাদের নিজেদেরকে অসাধুতার মহামারী-মুক্ত হতে হবে। সমাজকে দিতে হবে অক্লান্ত কর্ম সাধনার দৃষ্টান্ত, গােষ্ঠী ও আঞ্চলিক স্বার্থে জাতীয় চেতনার আদর্শ। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রত্যেকের জন্য আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মসংশােধনের দিন। শহীদের ত্যাগের দৃষ্টান্তকে নিজেদের প্রতিদিনের কাজে ও চিন্তায় বাস্তবায়িত করেই শুধু আমরা তাদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারি। তবেই অমর ২১ স্মৃতি উদযাপন হবে সার্থক। আসুন, আজ আমরা সারা অন্তর দিয়ে সেই শপথ গ্রহণ করি। জয় বাংলা।৮০
রেফারেন্স: ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩, বাংলার বাণী
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ