You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.02.17 | সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ - সংগ্রামের নোটবুক

সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ 

আমাদের দুর্ভাগ্য ছিল ২৫টি বছর পাকিস্তানের বর্বর শােষকরা আমার বাংলার সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে। ২৫ বছর পূর্বে ২০০ বছর পর্যন্ত ইংরেজরা এই বাংলার সম্পদ লুট করে নেয় কিন্তু ২৫ বছরে পাকিস্তানের শােষকরা না হলেও ৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বাংলা থেকে লুট করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয় বারবার আমরা যুদ্ধ করেছি। মােকাবেলা করেছি। বারবার আমাদের কারাবরণ করতে হয়েছে। অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। বাংলার মাটিতে অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। আপনারা জানেন, ২৫ হাজার সেনাবাহিনী বিদেশি অস্ত্র নিয়ে আমার বাংলার নিরস্ত্র জনগণের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা হত্যা করে ৩০ লক্ষ এ দেশের জনসাধারণকে। যত লােক মারা গেছে শহীদ হয়েছে তাদের ফ্যামেলি না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। প্রাইম মিনিষ্টার রিলিফ ফান্ড করে দুই হাজার টাকা করে মাথা প্রতি এ পর্যন্ত ৫ কোটি টাকা দিয়েছি। অন্ধ হয়ে গেছে আমার মুক্তিযােদ্ধা, তাদের জন্য কী করা যাবে তারা দেশ মাতৃভূমির জন্য সংগ্রাম। করে আজ জীবনের সব কিছু দিয়ে দিয়েছে। আমাদের মুক্তিফোর্স ট্রাস্ট করতে হয়েছে ৪ কোটি ৫ কোটি টাকা দিয়ে। নমরুদ, ফিরাউনের দল শুধু যে বাংলার মাটি থেকে চলে গেছে তা নয়, যাবার বেলায় ইচ্ছা করে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেছে। হত্যা করেছে আমার বুদ্ধিজীবীদের। আপনারা জানেন যে যুদ্ধে পদানত হওয়ার ৩ দিন আগে বড় বড় শহরে কাফু দিয়ে আমার ভালাে ভালাে ডাক্তার, ভালাে ভালাে প্রফেসর, ভালাে ভালাে ইঞ্জিনিয়ার, ভালাে ভালাে সাইন্টিষ্টদের হত্যা করে যায়। দুনিয়ায় কোথাও এ রকম দেখা যায় না। ৯৭ টা দেশ, ৯৮ টা দেশ বাংলাদেশকে Recognition করেছে। এর মধ্যে শাসনতন্ত্র দিয়েছি, এর মধ্যে ভােটও দিয়েছি। এর মধ্যে রাস্তা করা আরম্ভ করেছি। জিজ্ঞাসা করতে পারেন পয়সা পাই কোথা থেকে? আমি বলি পয়সা আনছি। বিদেশ থেকে আনছি। বন্ধু রাষ্ট্র সাহায্য করেছে। সবই কিনতে হবে কারণ পাকিস্তানের ২৫ বছরেও বাংলাতে কিছু করে নাই। ওই জায়গা থেকে মাল এনে দেশে বিক্রি করে পশ্চিম পাকিস্তানে পয়সা নিয়ে গেছে। যার জন্য সংগ্রাম করেছিলাম। আজকে শাসনতন্ত্র দিয়েছি চারটা স্তম্ভের উপরে। এর বিরুদ্ধে কথা বলা চলবে না। এটা আমার জাতের চারটা স্তম্ভ সেটা হল আমি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলা আমার ভাষা। বাংলা আমার সভ্যতা। যার উপর ভিত্তি করে এই দেশ স্বাধীন করেছি আমরা রক্ত দিয়ে। গণতন্ত্র দিয়েছি আমরা দেশের মানুষ ভােট দিয়ে প্রতিনিধি করবে। তারাই দেশ চালাবে। কোন একনায়কতন্ত্র এই বাংলাদেশে হতে পারবে না। আজ আমরা সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চাই। যেখানে ভুড়িওয়ালা আর বাংলার গরীবদের লুট করে খেতে না পারে সে শাসনতন্ত্র, আইন পাশ করে দেওয়া হয়েছে এবং শােষণহীন সমাজ হবে। যেখানে সুষম বণ্টন হবে। তারপরে ধর্মনিরপেক্ষতা। এখানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান তার ধর্মকর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। খ্রিষ্টান তার ধর্মকর্ম পালন করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম পালন করবে। কেউ বাধা দিতে পারবে না। ধর্মের নামে ব্যবসা বাংলার মাটিতে আর হবে না। ভােট আমি গতবার পেয়েছিলাম। আপনারা নৌকায় ভােট দিয়েছিলেন। ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারতাম। কিন্তু চাই নাই। কারণ চাই না এই জন্য জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফেরত দাও। এটাই হল আমার জীবনের সংগ্রাম জনগণকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। জনগণ যাদের ভােট দেবে তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। যদি ভালাে কাজ না করে ৫ বছর পরে ওদের তাড়িয়ে দিয়ে অন্য দলকে বসায় দেবে। এটাই তাে হবে গণতন্ত্র। এই তাে হবে মানুষের মূল কথা। এদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান আপনারা সুখে বাস করবেন, পাশাপাশি বাস করবেন, ভাই ভাই বাস করবেন। কোন মতে যেন সাম্প্রদায়িকতা বাংলার মাটিতে না হয়। সাম্প্রদায়িক বীজ যেন বাংলার মাটিতে বপন না করে, তাহলে ৩০ লক্ষ যে শহীদ হয়েছে ওদের আত্মা শান্তি পাবে না। স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কষ্টকর। আমি চাই সােনার বাংলা। আমার সােনার মানুষ আর আমার সােনার বাংলা। আমার সােনার মানুষ যেন সােনার বাংলায় পয়দা হয়। সােনার মানুষ না হলে সােনার বাংলা আমি গড়তে পারবাে না। মানুষকে যে মানুষ ভালােবাসে এবং মানুষের ভালােবাসার মতাে এত বড় জিনিস আর দুনিয়ার কিছুই হয় না। মরার আগে যেন দেখতে পারি যে আমার সােনার বাংলা সােনার বাংলা হয়েছে। আমার মানুষ সুখী হয়েছে। আমার মানুষ অত্যাচার অবিচারের হাত থেকে বেঁচেছে। আমার মানুষের দেশে শােষণহীন সমাজ হয়েছে। আমার সম্পদের সুষম বণ্টন হচ্ছে। আমার সােনার ছেলেরা যেন মানুষের মতাে গর্ব করে দুনিয়ায় দাঁড়াতে পারে। এইটুকু দেখে যেন মরতে পারি। এর বেশি কিছু চাই না।৬৪

রেফারেন্স: দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ