You dont have javascript enabled! Please enable it!

খুনী ডাকাতদের বাংলাদেশ থেকে উৎখাত করতে হবে- বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে বলেন, সমাজ বিরােধী, বিদেশি শক্তির দালাল, স্বাধীনতার শত্রু তথা খুনী ডাকাতদের, হাইজ্যাকারদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করাে। রবিবার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়ােজিত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম জাতীয় মহা সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণদানকালে তিনি উপরােক্ত নির্দেশ দেন। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় ২ লক্ষাধিক মুক্তিযােদ্ধাদের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে সজাগ থাকার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সমাজ বিরােধীরা সমাজের বুকে মুক্তিযােদ্ধাদের ইমেজ নষ্ট করছে। কাজেই এদের উৎখাত করার জন্য সত্যিকার মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপর হতে হবে।
প্রতিদান পাওয়ার আশায় যুদ্ধ করােনি : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, আমি তােমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে পারিনি তবুও তােমরা মরণ পণ যুদ্ধ করেছ। এই যুদ্ধ সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পাক বর্বরতার হাত থেকে বাঁচানাের জন্যে কোন প্রতিদান পাওয়ার জন্য নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এবং বাংলার মানুষ যত দিন থাকবে মুক্তিযােদ্ধাদের ত্যাগের ইতিহাস ততদিন অমলিন থাকবে। বিপুল সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধার সঙ্গে দেখা হওয়াতে তিনি গর্ব প্রকাশ করে বলেন যে, মুক্তিযােদ্ধাদের অমিত বিক্রমে বাংলার মানুষ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে।
তােমাদের প্রতি নজর দিতে পারিনি : মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, তােমরা এদেশেরই ছেলে তােমরা জানাে পাক দস্যুরা কীভাবে বাংলার ঘরবাড়ি, কলকারখানা, রাস্তাঘাট, শস্যক্ষেত, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করে গেছে। হানাদার বাহিনী টাকা পুড়িয়ে গেছে। শত শত দুধের শিশুকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, তােমরা যুদ্ধের ময়দানে ছিলে, তােমরা সবই জানাে। তিনি বলেন, তবুও আমি তােমাদের প্রতি নজর দিতে পারিনি। কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র দিয়েছি কিন্তু স্বাধীনতা নস্যাকারীরা এখনও বসে নেই। তারা বিদেশি শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, স্বাধীনতার সময় যে ভাবে সগ্রাম করেছ ঠিক সেই ভাবে ষড়যন্ত্রকারীদের বাংলার মাটি থেকে চিরতরে উৎখাত করতে হবে।
যারা রক্ত দিয়েছে তারা লুট হাইজ্যাক করে না : প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বলেন, তােমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছ, অথচ এক শ্রেণির দৃষ্কৃতিকারী তােমাদের মুখে চুনকালি মেখে দিচ্ছে। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, যারা ব্যাংক ডাকাতি করে, লুটতরাজ চালায় এবং হাইজ্যাক গাড়ীতে চড়ে হাওয়া খায় তারা প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধা নয়—তারা রাজাকার আলবদর। তিনি বলেন, যারা স্বাধীনতার জন্যে রক্ত দিতে কুণ্ঠিত হয়নি তারা দেশে এই ধরনের হীনতম কাজ করতে পারে না। তিনি বলেন, মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত এধরনের কাজ করতে পারে। একটি সংসারের সকল সদস্য তাে আর ভালাে হয় না। সে জন্যে সমস্ত মুক্তিযােদ্ধাদের দায়ী করা উচিত নয়। তিনি বলেন, মুক্তিযােদ্ধাদের ঠান্ডা মাথায় ধীর স্থির হয়ে থাকতে হবে এবং যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় তাদের কঠোরভাবে মােকাবেলা করতে হবে।
বাংলাদেশ কারাে পকেটে যাবে না : বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আবার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, বাংলাদেশ বিশ্বের কোন দেশের পকেটে যাবে না। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই, শত্রুতা নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হবে স্বাধীন এবং জোটনিরপেক্ষ।
চীনের শিক্ষা নেওয়া উচিত : জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে চীনের ভেটো সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত না হােক বাংলাদেশ স্বাধীন আছে, স্বাধীন থাকবেও।
তিনি বলেন, চীনও দীর্ঘদিন জাতিসংঘের সদস্যপদ পায়নি। কিন্তু সেই জন্য চীনের অস্তিত্ব বিলােপ হয়ে যায়নি। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চীনের উচিত ইতিহাসের শিক্ষা নেওয়া।
আমি বিপদে আছি : বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি একটা বিপদের মধ্যে আছি। তিনি এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য মুক্তিযােদ্ধা সংসদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যারা সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তাদের মধ্যে ১ লক্ষ যােদ্ধার চাকরি দিয়েছি। ১৭০ জন পঙ্গু মুক্তিযােদ্ধাকে চিকিৎসার জন্যে বিদেশ পাঠিয়েছি। মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট করেছি। তিনি বলেন, সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা এত যে, এখন কে আসল কে নকল এই নিয়েই বিপদে পড়েছি। তিনি বলেন, সীলমােহর চুরি এবং জেনারেল ওসমানীর স্বাক্ষর নকল করে রাজাকার-আলবদররাও মুক্তিযােদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়েছে। সত্যিকার মুক্তিযােদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার জন্য তিনি মুক্তিযােদ্ধা সংসদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তােমরা যুদ্ধ করেছ, তােমাদের উপর কর্তব্য রয়েছে। গ্রামে গ্রামে চুরি-ডাকাতি বন্ধ করার জন্য এবং বাংলার মানুষ যাতে রাতে ঘুমাতে পারেন সে জন্যেই মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্যোগী হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মুক্তিযােদ্ধাদের চাকরির সংস্থান করার জন্যে একটি হস্তচালিত তাঁত ও কুটির শিল্প সংস্থা গঠন করা হবে। তিনি বলেন, মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
চোর আর চাটায় দেশ ভরে গেছে : তিনি বলেন, চোর আর চাটার দলে দেশ ছেয়ে গেছে। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ এবং অনাবাদের ফলে দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ২ লক্ষাধিক মুক্তিযােদ্ধাই আমার লাল ঘােড়া। তিনি চোর আর চাটার দল দমনের জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি আন্দোলন করার আহ্বান জানান।৭৭

রেফারেন্স: ২১ জানুয়ারি ১৯৭৩, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!