You dont have javascript enabled! Please enable it!

গােপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আমি দেখতে চেয়েছিলাম আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হােক। আমার বাংলার সম্পদ বাঙালিরা ভােগ করুক। আমার বাংলার মানুষ সুখী হােক। আমার বাংলার মানুষ শােষণহীন সমাজ গড়ক। আমার সােনার বাংলা সােনার বাংলা হােক। সেই বেঈমানরা (দালাল) বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারবে না। আর যারা আছে তাদের বিচার হবে। বিচারে সাজা হলে ভােগ করতে হবে। যে নিরপরাধ আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। যারা অপরাধ করেছে তাদের ক্ষমা না করে বিচার হবে। সমস্ত বকেয়া এবং খাজনা আমি মাফ করে দিলাম। আমার গরীব খাজনা দেবে কোথা থেকে? সুদসহ মাফ করে দিলাম। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা আমি মাফ করে দিলাম। লবণে ট্যাক্স আমি মাফ করে দিলাম। মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স আমি মাফ করে দিলাম। আমার গরীব প্রজারা দিবার পারে না। আমি কেমন করে ওদের উপর খাজনা চাপিয়ে দেব। আর খাজনা না হলেও সরকার চলবে কেমন করে। আর এ দেশের মানুষকে বাঁচাবাে কি করে? এ বছর ৭৩ সালে আমাকে প্রায় ১ লক্ষ টন খাবার। কিনতে হয়েছে, জাহাজে করে আনতে হবে। চট্টগ্রামে পৌছাতে হবে। চালনায় পৌছাতে হবে। জাহাজে করে গ্রামে গ্রামে পৌছাতে হবে। রাস্তা নাই, ঘাট নাই, বাস নাই, ট্রাক নাই, লঞ্চ নাই, সমস্ত ডুবাইয়া, পােড়াইয়া ছারখার করে দিয়ে গেছে। স্কুল, কলেজ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। আমার না হলেও ২ হাজার, ৩ হাজার টাকা করে যারা মারা গেছে (শহীদ) এ পর্যন্ত প্রায় ৫ কোটি টাকা। দিতে হয়েছে যাতে তারা অন্ততপক্ষে দুবেলা পেট ভরে খেতে পারে। এতিম, মিসকিন, কোথায় দাঁড়ায়? যাদের স্বামী মারা গেছে, ভাই মারা গেছে, মা মারা গেছে, কোথায় পাবে পয়সা? আমাকে ভিক্ষা করে এনে তাদেরকে দিতে হয়েছে। ২০০০, ৩০০০ করে গরীবদের। আমার মুক্তিযােদ্ধার ছেলেরা পঙ্গু হয়ে গেছে যুদ্ধে, কি করে ওদের বাঁচবাে। ৪ কোটি টাকা দিয়ে আমাকে মুক্তি বাহিনী ট্রাস্ট করতে হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে তারা খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারে। আমাকে প্রত্যেক কলেজে, স্কুলে টাকা দিতে হয়েছে। কোথা থেকে দেব? সমস্ত বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়ে গেছে পাকিস্তান সরকার। আমাকে প্রায় ১০০ কোটি টাকার উপরে রিলিফ আইনা এই বাংলার মানুষকে দিতে হয়েছে। আমাকে তাে গ্রামে গ্রামে টেস্ট রিলিফের টাকা দিতে হয়েছে। আমাকে তাে টাকা নিয়ে। লােন দিতে হয়েছে। আমাকে তাে সরকারি কর্মচারীর বেতন দিতে হয়েছে। আমাকে তাে দুঃখী মানুষের দুই মুঠো খাবারের জন্য চাল আনতে হচ্ছে। কোথায় পাবাে? কে দেবে? কোথা থেকে আনবাে? যদি আপনারা উৎপাদন না করেন, ভিক্ষুকের জাতের কোনদিন সম্মান নাই। আপনাদের উৎপাদন বেশি করতে হবে। তাহলে আপনারা পেট ভরে খেতে পারবেন। তাই আপনাদের কষ্ট করতে হবে। দুঃখ করতে হবে। বাংলাদেশকে আজ ৯৭ টা দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ দুনিয়ার কাছ থেকে সাহায্য পাচ্ছে। যাতে করে সাহায্য বন্ধ হয়, যাতে বাংলাদেশের অসম্মান হয়, যাতে শেখ মুজিবের অসম্মান হয় সেই জন্য তারা স্বাধীনতা বিরােধী ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু, অনেক ষড়যন্ত্র দেখেছেন। ইয়াহিয়া খানের মেশিনগান, আইয়ুব খানের মেশিনগান, চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর মেশিনগান, ইস্কান্দার মির্জার মেশিনগানের কাছে যখন শেখ মুজিব কখনাে মাথা নত করে নাই এখন এই চুনপুঁটির কাছে শেখ মুজিবুর কোন দিন মাথা নত করতে পারে না। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা চলতে পারে না। বাংলাদেশ চলবে চারটা স্তম্ভের উপরে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আমরা বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, আমার মাটি। বাংলার হাওয়া আমার হাওয়া। বাংলার সংস্কৃতি আমার সংস্কৃতি। আমি চাই সমাজতন্ত্র। এখানে বাংলাদেশের সম্পদ হবে সমস্ত গরীবের সম্পদ। আমি চাই কৃষক, মজদুর, এদের রাষ্ট্র কায়েম হােক এবং শােষণহীন সমাজ হােক। বড়লােক যেন এদেশের গরীবকে আর লুট করে খেতে না পারে। সেজন্য আমি দলিল করে দিয়েছি। জীবনে আর বাংলার গরীবকে কেউ লুট করে খেতে পারবে না। আমি শাসনতন্ত্র দিয়েছি এবং সম্পদের সুষম বণ্টন করতে হবে। যাতে গরীব তার ন্যায্য অধিকার পায়। লুট করে খাওয়া চলবে না।
ব্যাংক, ইসুরেন্স কোম্পানি দেখেন আগে মালিক ছিল একজন দুইজন, আজ বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ মালিক। সেই জন্য আমি চাই সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র করতে সময় লাগবে কষ্ট করতে হবে। ভবিষ্যৎ বংশধর সুখে বাস করবে। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র। মানুষ ভােট দিয়ে লােক পাঠাবে, তাদের প্রতিনিধি সরকার চালাবে। কোন ডিকটেটারিজম বাংলাদেশে চলতে পারে না এবং মানবিক অধিকার মানুষের থাকতে হবে, তাই আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। ধর্মনিরপেক্ষতা আমি বিশ্বাস করি। তার অর্থ হবে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান তার ধর্ম কর্ম পালন করবে। কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না। হিন্দু তার ধর্ম কর্ম পালন করবে, খৃষ্টান তার ধর্ম কর্ম পালন করবে, বুদ্ধিষ্ট তার ধর্ম কর্ম পালন করবে, কেউ বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু ধর্মহীনতা নয় ধর্মনিরপেক্ষতা। যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করবেন তাদের মনে রাখা উচিত যে বাঙলার মানুষ তাদের কিছুতেই সহ্য করবে না। পাটের দাম যদি দিবার পারি গরীব হিন্দু, গরীব মুসলমান সমানভাবে পাবে। খাজনা মাফ করেছি গরীব হিন্দু, গরীব মুসলমান সমানভাবে মাফ পাইয়া গেছে। এ মাটিতে প্রত্যেকের সমান অধিকার রয়েছে।
সম্প্রতি যারা বিদেশে দেশের সুনাম ও মর্যাদা ক্ষুন্ন এবং বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে বিদেশি সাহায্যের পথে বাধা সৃষ্টি করছেন, তার পার্টি এবং সরকার জনগণের অপরিসীম ভালােবাসা, আশীর্বাদ ও সহযােগিতা নিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে। এ সব দুষ্কৃতিকারী বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের ছত্রছায়ায় এবং সাহায্যে এধরনের কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে।
মধুমতী নদীর তীরে বঙ্গবন্ধু কলেজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় সমাবেত হাজার হাজার নারী-পুরুষ তাদের মহান নেতার বক্তৃতা শ্রবণ করে। বঙ্গবন্ধু জনতার ভালােবাসার শক্তিতে আর অপরিসীম আস্থার কথা উল্লেখ করে বলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালিই আমরা অস্ত্র। এসব মারাত্মক ব্যক্তিদের সম্পর্কে সতর্ক ও তাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। দুর্নীতিবাজদের সমূলে উৎখাত, সকল রাষ্ট্র বিরােধী ও সমাজবিরােধী ব্যক্তিকে গণ বিরােধী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য পুনরায় আহ্বান জানান। তিনি এসব লােকদের মুখােশ খুলে দেয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, এদের আইন রক্ষাকারী এজেন্সীগুলাের হাতে তুলে দিতে হবে। জনগণ যদি এসব সমাজ বিরােধীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সরকারের সাথে সহযােগিতা না করে তাহলে সমাজ বিরােধীদের তৎপরতা দেশ থেকে সমূলে উৎখাত করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু জনতার সম্মতি আছে কি না জানতে চাইলে অসংখ্য হাত উত্তোলিত করে জনতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের আস্থার কথা জানিয়ে দেয় এবং ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘জয় মুজিববাদ’ শ্লোগানে গােপালগঞ্জের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধু তার জন্মভূমি গােপালগঞ্জের কথা উল্লেখ করে আবেগে উদ্বেলিত হয়ে পড়েন। তিনি গােপালগঞ্জের সাথে তার জীবনের ঘটনাবহুল অতীত দিনগুলাের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন এমন দিন যায়নি, যেদিন তিনি এই গ্রামে আসেননি এবং এমন ঘর নেই, যেখানে তিনি যাননি। অশ্রুসিক্ত নয়নে বঙ্গবন্ধু বলেন, তিনি ক্ষমতা, মর্যাদা কিংবা সম্মানের জন্য রাজনীতি করছেন না। কোটি কোটি শােষিত বাঙালির দুর্দশা লাঘব এবং সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের জন্য তার রাজনীতি। তার জীবনের একমাত্র স্বপ্নই হলাে এই দেশকে সােনার বাংলায় পরিণত করা। বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যােগসাজশে যারা গণ-হত্যা, পাশবিক অত্যাচার ও লুটতরাজ করেছে তাদের বিচার অবশ্যই হবে। যেসব দালাল পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে তাদের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, এরা কখনােই বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারবে না। দেশের খাদ্য সমস্যার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, দেশের ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানি করছে। কিন্তু এদেশ এভাবে চিরকাল চলতে পারে না। জাতি অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে পারে না। আমাদের অবশ্যই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি কৃষক ও শ্রমিকদের আরও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানান।২৭

রেফারেন্স:  দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!