You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীরশ্রেষ্ঠদের যুদ্ধ | জীবন ও গৌরবের কাহিনী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৪ মার্চ ১৯৮২
মেজর কামরুল হাসান ভুঞা/মাহফুজউল্লাহ

ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার মোঃ রুহুল আমিন, বীর শ্রেষ্ঠ
জীবন কাহিনী

পরনে লাল পাড়ে সবুজ শাড়ী। বয়স হার মেনেছে জীবনীশক্তির কাছে। কিন্তু জীবনের সব আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে দারিদ্রের কাছে। সেই সঙ্গে এসেছে পুত্রশোক।
স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে সাহসী পুত্রের মুখচ্ছবি। কিন্তু আর কিছুই মনে করতে পারেন না নবতিপর বৃদ্ধা জোলেখা খাতুন। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের মা। নোয়াখালীর এক সাধারণ গ্রামে কেটে যাচ্ছে তার সময়। বিগত দশ বছরের অর্থনৈতিক অনিশ্চিত আরো কতদিন থাকবে তা তিনি জানেন না। এ প্রশ্নের জবাব জানেন রুহুল আমিনের পরিবারের কেউ।
রাতের মেলট্রেন থেকে যখন সোনাইমুড়ি স্টেশনে নেমেছে তখনো ভোরের কুয়াশার ফাঁকে সূর্য দেখা দেয়নি। গ্রামের এবড়ো খেবড়ো পথ দিয়ে চলেছে আমাদের রিকশা। ধীরে ধীরে জেগে উঠছে গ্রামগুলো।
নান্দীবাজারে পৌঁছুতে পৌঁছুতে চলমান জীবন ধরা দিল চোখের সীমানায়। এখানেই রিকশা ছাড়তে হবে। এরপর পাঁচ মিনিটের মেঠো পথ। জেলা বোর্ডের রাস্তা থেকে চোখে পড়ে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের বাড়ী।
জীর্ণ খড়ের ঘর দাঁড়িয়ে আছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব চোখে পড়ে। সমস্ত বাড়িতে যেন প্রাণের স্পন্দন নেই। না থাকবারই কথা। রুহুল আমিনের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে বাঘচাপটা গ্রামের পর্ণ কুটীরে পড়ে আছেন তাঁর মাত জোলেখা খাতুন।
রুহুল আমিনের জীবনের সঠিক তথ্য তাঁর পরিবারের কারো জানা নেই। ঘটনার দিন তারিখও মনে করতে পারেন না।
জোলেখা খাতুন মনে করতে পারেন না কোন বছর রুহুল আমিন জন্মেছিলেন? শুধু মনে আছে, কোন এক আষাঢ় মাসের শুক্রবার রাতে তার কোল আলো করে এসেছিল ফুটফুটে এক শিশু। সেই তার প্রথম সন্তান। অনেক আদরের ধন। কালক্রমে যে বেড়ে উঠেছিল সুঠাম দেহের এক আকর্র্ষণীয় পুরুষ হিসেবে।
রুহুল আমিনের বাবা আজাহার পাটোয়ারী ছিলেন সাধারণ গৃহস্থ। দেশ স্বাধীন হবার তিন দিন আগে বাবা মারা যান। সংসারে তেমন একটা স্বচ্ছলতা ছিল না। যুদ্ধের দিনগুলো বাদে মোটামুটি কেটে গেছে। রুহুল আমিন চাকুরী জীবনে সংসার চালিয়েছে, বাড়িঘরের খোঁজখবর নিয়েছে, ভাইবোনদের মানুষ করেছে। বোনদের বিয়ের ব্যাপারে মাথা ঘামিয়েছে। পরিবার-পরিজন আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামের মানুষদের কাছে রুহুল আমিন ছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ। দীর্ঘদেহী, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী রুহুল আমিনকে বহু দূর থেকে দেখেও চেনা যেত।
রুহুল আমিনরা চার বোন, তিন ভাই। অন্য দু’ভাই এখন চাকুরী করে একজন দুবাই, অন্যজন চট্টগ্রামে। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। একজন আবার বিধবা হয়ে ফিরে এসেছেন এ বাড়িতে। নির্ভর করতে হচ্ছে দরিদ্র পরিবারের ওপর। কিন্তু পরিবারের সে সামর্থ্য নেই বাড়তি একজনের খরচ জোগানোর। এ পরিবারের এখন কেউ উপার্জনক্ষম নেই।
স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন রুহুল আমিন গ্রামের বাড়িতে। ছুটিতে এসেছেন। কিন্তু আর ফিরে যাওয়া হয়নি। যাওয়ার মত অবস্থাও ছিল না। প্রথমদিকে নান্দীবাজারে ছোটখাট একটা দোকান খুলেছিলেন। কিন্তু ভাগ্য ফেরেনি। সংসার জীবনে যেটুকু সোনার অলংকার ছিল স্ত্রীর, তাও এসময় পেটের টানে হাতছাড়া হয়ে যায়।
যুদ্ধের প্রথম দিকেই শ্বশুরবাড়িতে মারা যান রুহুল আমিনের স্ত্রী। তারপর সংসারের টান অনেকখানি হালকা হয়ে আসে। এসময় মানসিকভাবেই তৈরি হয়ে নেন যুদ্ধে যাবার জন্য।
যুদ্ধে যাবার সময় নিজের ছেলেমেয়েদের রেখে যান মায়ের হেফাজতে। রুহুল আমিনের ছেলে মেয়েরা এখন বড় হয়েছে। চট্টগ্রামে পড়াশোনা করছে। নৌবাহিনী থেকে সাহায্য পাচ্ছে। কিন্তু বড় মেয়ে নূরজাহান ছাড়া আর কেউই বাবার কথা মনে করতে পারে না। স্বাধীনতার পর নূরজাহানের বিয়ে হয়েছে।
রাতের বেলা বাবা যখন যুদ্ধে যান, তখন একমাত্র নূরজাহান জেগে আছে। নূরজাহানের চোখ ছলছল করে সেসব কথা মনে হলে—‘উনি যখন যায়, সবাই ঘুমে। আমি কেঁদেছি। ওনাকে যেতে বারণ করেছি। বাবা বলেছিলেন—আমি পাকিস্তান যাব, যুদ্ধ করতে। তখনো বুঝিনি সেই হবে শেষ দেখা।’ নূরজাহানের দু’ভাইয়ের একজন মোহাম্মদ আলী এখন প্রথম বর্ষ ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, অপরজন শওকত আলী মাদ্রাসার ছাত্র। ছোট দু’বোন, রেজিয়া বেগম এবং ফাতেমা বেগম, উভয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী।
বাবাকে নিয়ে নূরজাহানের একটি স্বপ্নের কথা আজো মনে পড়ে। বাবা দেশান্তরী হবার দু’মাস পর স্বপ্নে দেখি একটা জাহাজ মারা গেছে। তখন বুঝি আব্বা যুদ্ধে গেছেন।’ বোশেখ মাসে বাবা চলে যান বাড়ি থেকে। তার মৃত্যু সংবাদ আসে পৌষের শেষাশেষি। তখন নূরজাহান তার নানার বাড়িতে।
ছেলেমেয়েদের নিয়ে রুহুল আমিনের অনেক স্বপ্ন ছিল। তার স্ব্প্ন ছিল তাদের ভালো লেখাপড়া শেখাবেন। ছুটিতে বাড়িতে এলে সব সময় ছেলেমেয়েদের চোখে চোখে রাখতেন। তাদের সঙ্গেই কেটে যেত তার সময়। আজ নূরজাহানের প্রশ্ন ‘আমাদের ঘিরে তার অনেক স্বপ্ন ছিল—সেসব পূর্ণ হয়েছে কিনা জানি না।’
রুহুল আমিনের কিছু কিছু স্মৃতি চিহ্ন এখনো তার ছেলেমেয়েদের কাছে আছে। অনেক সযত্নে তারা রক্ষা করেছে তার বীরশ্রেষ্ঠ পদকটি যা অন্যান্য বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবারের কাছে নেই। কিন্তু কোন ছবি নেই কোথাও রুহুল আমিনের। মৃত্যু সংবাদ শোনার পর পরিবারের সদস্যরা তার ছবি দেখেছিল। কিন্তু সে ছবির আর কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
সরকারীভাবে রুহুল আমিনের জন্ম ১৯৩৫ সালে। মূল হিসেবে এর সামান্য তারতম্য হতে পারে। বাগপাচড়া প্রাইমারী স্কুল ও আমিষাপাড়া হাইস্কুলে রুহুল আমিনের সহপাঠীরা এখনো তার কথা মনে করে।
যুদ্ধে যাবার আগে মায়ের কাছ থেকে রুহুল আমিন বিদায় নিয়ে যায়। মার চোখে এখনো ভাসে সেই স্মৃতি ‘এক কাইক আগায়, আবার হিরি তাকায়। আবার আগায়, আবার তাকায়। হেই যে গ্যাল, বা’জান আঁর’ আর আইলো না। আষাঢ় মাসে খবর অয় হেতে ভালা জাগাত আছে। জেরে খবর অয় খুলনা মারা গেছে।’
আষাঢ়ে যে শিশুর জন্ম, সে শিশুর জন্য এখনো মায়ের চোখে ঝরে আষাঢ়ের ধারা। কিন্তু মায়ের কাছে কোন সমাধান নেই। দারিদ্র মায়ের শেষটুকুও নিয়ে গেছে।

গৌরবের কাহিনী
ই আর এ-১ মোঃ রুহুল আমিন ১৯৫৩ সালে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ভর্তির অব্যবহিত পরে করাচীর অদূরে আরব সাগরে মেনোরা দ্বীপে পি এন এস বাহাদুরে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর পি এন এস কারসাজে (নৌবাহিনীর কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে তিনি পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করেন। ১৯৬৫ সালে মেকানিশিয়ান কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন এবং পি এন এস কারসাজে কোর্স শেষের পর আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম পি এন এস বখতিয়ারে নৌ ঘাঁটিতে বদলী হন।
২৫ মার্চ ’৭১-এর পর পি এন এস বখতিয়ার ঘাঁটি ত্যাগ করে এপ্রিল মাসে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে ও ২ নং সেক্টরে যোগদান করেন। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি ২ নং সেক্টরের অধীনে বহু স্থল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন মনেন্দ্র নাথ সামন্তের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সেক্টর ও সাব সেক্টর থেকে নৌবাহিনীর সদস্যদের সেপ্টেম্বর মাসে আগরতলায় একত্রিত করা হয়। ই আর এ-১ মোঃ রুহুল আমিনও নৌবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আগরতলায় একত্রিত হয়ে কলকাতায় আসেন।
ভারত সরকার কলকাতা বন্দরে কর্তব্যরত দুটি টাগ বোট বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের জন্যে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীকে উপহার দেন। এ দুটি টাগ বোটকে কলকাতার গার্ডেন রীচ নৌওয়ার্কশপে আনা হয় এবং প্রত্যেকটি টাগ বোটে কানাডীয় ধরনের দুটো বাফোর গান লাগিয়ে এবং বৃটিশ ধরনের ৫০০ পাউন্ড ওজনের চারটি মার্ক মাইন বহন করার উপযোগী করে গানবোটে রূপান্তরিত করা হয়। ১২ অক্টোবর ’৭১ কলকাতার মেয়র প্রফুল্ল কুমার ঘোষ গার্ডেন রীচ জেটিতে আনুষ্ঠানিকিভাবে গানবোট দুটিকে পানিতে ভাসান। গানবোট দুটির নামকরণ করা হয় ‘পদ্মা ও পলাশ’।
ই আর এ-১ মোঃ রুহুল আমিন আগরতলা হতে কলকাতা আসার পর থেকে গানবোট পলাশের প্রধান ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।

গানবোট ব্যাটল পলাশ নকশা :

৬ ডিসেম্বর যশোর সেনানিবাস পতনের পর ‘পদ্মা’ ‘পলাশ’ এবং একটি ভারতীয় (রাশিয়ার তৈরি) গাটবোট ‘পানভেল’ হিরন পয়েন্ট, মংলা বন্দর এবং খুলনার খালিশপুরে পাকিস্তানী নৌঘাঁটি পি এন এস তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে হলদিয়া ঘাঁটি থেকে বৃটিশ ইন্ডিয়ান স্টীমার পথ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সুন্দরবনের আড়াইবানকিতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পেট্রোল ক্রাস্ট চিত্রাঙ্গদা ৮ ডিসেম্বরে গানবোট পদ্মা, পলাশ ও পানভেলের সঙ্গে যোগ দেয়। এই নৌ অভিযানের অফিসার ইন ট্যাকটিক্যাল কম্যান্ড ছিলেন ক্যাপ্টেন মনেন্দ্র নাথ সামন্ত। ৯ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে কোন বাঁধা ছাড়াই গানবোটগুলি হিরন পয়েন্টে প্রবেশ করে। হিরন পয়েন্টে রাত্রি যাপনের পর ১০ ডিসেম্বর ভোর ৪টার দিকে গানবোট মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এবং পাকিস্তানী সৈনিকদের কোন বাঁধা ছাড়াই সকাল সাড়ে ৭টায় মংলা বন্দরে পৌঁছে। মংলা বন্দরে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর পেট্রোল ক্রাস্ট চিত্রাঙ্গদা থেকে যায়। সকাল সাড়ে ৯টায় শুরু হয় চূড়ান্ত অভিযান। গানবোট পানভেল আগে, পেছনে পলাশ ও তার পেছনে পদ্মা। প্রায় ১২টায় গানবোটগুলি যখন খুলনা শিপইয়ার্ডের নিকটে তখন অনেক উঁচুতে তিনটি জঙ্গী বিমান দেখা দেয়।
শত্রুর বিমান অনুমান করে পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হয়। জবাবে ক্যাপ্টেন সামন্ত জানান, বিমানগুলি ভারতীয়। হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে বিমানগুলি নীচ দিয়ে উড়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে চলে যায়। বিমানগুলি এরপর ঘুরে আসে পেছন থেকে। বিমানগুলি গোলাবর্ষণ করে প্রথমে গানবোট পদ্মা এবং পরে গানবোট পলাশের উপর। গোলা সরাসরি গানবোট পদ্মার ইঞ্জিনরুমে পড়ায় ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। বহু নাবিক নিহত ও আহত হয়। অনেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু গানবোট পলাশ এবং পানভেল তখন সচল। এমন সময় পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কম্যান্ডার রায় চৌধুরী আদেশ দেন ‘জাহাজ ত্যাগ কর’। ই আর এ-১ মোঃ রুহুল আমিন ইঞ্জিনরুমে প্রাণপনে চেষ্টা করছিলেন জাহাজ সচল রাখতে। লেফটেন্যান্ট কম্যান্ডার রায় চৌধুরীর জাহাজ ত্যাগ করার আদেশে তিনি ক্ষুব্ধ হন। উপরে উঠে এসে চিৎকার করে জানতে চান জাহাজ থামাতে বলা হয়েছে কেন? পরাজয়ের গ্লানি বরণ করবেন এ তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। তারস্বরে সবাইকে অনুরোধ করে বলতে লাগলেন ‘মৃত্যুর ভয়ে আমরা ভীত নই। আমরা এগিয়ে যাবই। যুদ্ধ করে জয় করবো। কিছুতেই উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যূত হব না।’ কামানের ক্রুদের বললেন বিমানের দিকে গুলি করতে। নিজে ফিরে গেলেন ইঞ্জিনরুমে। অধিনায়কের আদেশে বিভ্রান্ত সব নাগরিক। বিমান গুলি আবার ফিরে এসে পেছন থেকে গোলাবর্ষণ করল গানবোট পলাশের উপর। ধ্বংস হল পলাশের ইঞ্জিনরুম পলাশের রং গায়ে মেখে শহীদ হলেন মোঃ রুহুল আমিন।
চরম আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের জন্য আমরা ই আর এ-১ মোঃ রুহুল আমিনকে দিয়েছি দেশের সর্বোচ্চ সম্মান। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রকাশ্য নিলামে বিক্রি করে দিয়েছি গানবোট পদ্মা ও পলাশকে।
০০০

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোঃ মতিয়ুর রহমান, বীর শ্রেষ্ঠ
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ুর রহমান রিসালপুরে পাকিস্তান বিমানবাহিনী একাডেমীতে ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করেন ১৫ আগস্ট’৬১ সালে। ১৯৬৩ সালের ২৩ জুন বৈমানিক হিসেবে কমিশন পান।
২৫ মার্চ ’৭১ সকালে মসরুর বিমান ঘাঁটিতে বেস কম্যান্ডার সব বাঙালী বৈমানিককে একত্রিত হতে নির্দেশ দেন তারা এখন থেকে কোন অপারেশনাল এলাকায় যেতে পারবে না এবং তাদের জন্য উড্ডয়ন আপাততঃ বন্ধ।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ুর রহমানের ছবি ও বিমান অভিযানের নকশা :

এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বাঙালী বৈমানিককে বিমান চালানো ছাড়া বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করা হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ুরকে মসরুর ঘাঁটিতে বেস ফ্লাইট সেফটি অফিসার নিয়োগ করা হয়। ২৫ মার্চের আগে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ুর ছিলেন পাকিস্তানী বৈমানিক পাইলট অফিসার রাশেদ মিনহাজের জেট বিমান উড্ডয়ন প্রশিক্ষক। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ুর ঠিক করেছিলেন তিনি মিনহাজের উড়বার পূর্ব মুহূর্তে তাকে সহ বিমান ছিনতাই করে ভারতের গুজরাটের বিমান ঘাঁটি জামনগরে অতবরণ করবেন।

সেদিন ২০ আগস্ট, শুক্রবার। সময় সকাল সোয়া এগারোটা। পাইলট অফিসার মিনহাজ টি-৩৩ বিমান নিয়ে উড়বার জন্য প্রস্তুত। কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য পাইলট অফিসার মিনহাজের কল সাইন ছিল ব্লু বার্ড ১৬৬। পাইলট অফিসার মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারে উড়বার অনুমতি চাইলে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে তাকে স্ট্যান্ডার্ড ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয়। কন্ট্রোল টাওয়ারে তখন ডিউটি করছিলেন বাঙালী বৈমানিক পাইলট অফিসার ফরিদউজ্জামান এবং পাকিস্তানী বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আসিম। পাইলট অফিসার মিনহাজ যখন তাঁর টি-৩৩ বিমানটি নিয়ে রানওয়ে ২৭-এ ঢোকার জন্য ৪ নং ট্যাক্সি ট্র্যাক দিয়ে এগিয়ে টিলার আড়ালে পৌঁছেন (নকশা দ্রষ্টব্য) ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ুর তখন তীব্র গতিতে ছুটে গেলেন তার নিজের কার নিয়ে ৪ নং ট্যাক্সি ট্র্যাকে এবং এমন কোন সংকেত মিনহাজকে দেখালেন যে তিনি বিমানটি থামিয়ে দেন। ফ্লাইট সেফটি অফিসার বিশেষক্ষেত্রে বৈমানিককে নির্দিষ্ট সংকেত দেখালে বৈমানিক ক্ষণিকের জন্য বিমান থামাতে অথবা বিমানের ইঞ্জিন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে বা কেনোপি (বৈমানিকের বসার স্থানের উপর স্বচ্ছ আবরণ) খুলতে বাধ্য থাকেন। কিন্তু কেনোপি খোলাতে সক্ষম হলেও ঠিক কি করে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ুর রহমান বিমানের ককপিটে পেছনের আসনে বসলেন তা এখনো অজানা। বিমানের ককপিটে ওঠার আগে নিজের গাড়ীটিকে বিমানটির পেছনে আড়াআড়ি করে রেখেছিলেন যেন অন্য কোন বিমান দ্রুত ধাওয়া করতে না পারে।
রানওয়েতে ঢোকার ট্যাক্সি ট্র্যাকের মাঝপথে বিমানটি থেমে যেতে দেখে এবং কেনোপি খোলা দেখে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে পাইলট অফিসার ফরিদউজ্জামান ব্লু বার্ড-১৬৬কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোন রকম অসুবিধা আছে কিনা জানাতে। কিন্তু ব্লু বার্ড-১৬৬ থেকে জবার পাওয়া যায়নি। হঠাৎ করে ব্লু বার্ড-১৬৬ দ্রুত রানওয়ের দিকে এগিয়ে যায়। ঠিক তখনই একটি বিমান অবতরণ এবং রানওয়ে খালি হওয়াতে ব্লু বার্ড-১৬৬ আকাশে ওঠে। যদিও কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে অনুমতি না নিয়ে কোন বিমানেরই রানওয়েতে ঢোকার কথা নয়। ব্লু বার্ড-১৬৬ যখন উড়ছে তখন বিমানটি এমন ভয়ঙ্করভাবে ডানে বামে, উপর নীচ করছিল যে বাইরে থেকে দেখে সহজেই অনুমান করা গেছে বিমানটির নিয়ন্ত্রণের জন্য ককপিটের ভেতরে লড়াই চলছে। রানওয়ের মাত্র কয়েক ফুট উপর দিয়ে বিমানটি থেকে কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানান হল ‘ব্লু বার্ড-১৬৬ ছিনতাই হয়েছে।’ কন্ট্রোল টাওয়ারে বিমানটির নিয়ন্ত্রণ পাইলট অফিসার ফরিদউজ্জামান ব্লু বার্ড-১৬৬কে বললেন, ‘ছিনতাই নিশ্চিত করে জানাও।’ জবাব এলো ‘নিশ্চিত’। বেতার সেটে গলার স্বর শুনে তখন পরিষ্কার বোঝা গেল যে ওটা মতিয়ুরের গলা। সাধারণতঃ এই দিক থেকে উড়বার পর বিমান ডান দিকে ঘুরে যায়, কিন্তু ব্লু বার্ড-১৬৬ অত্যন্ত নীচু দিয়ে বামদিকে ঘুরে গেল। বিমানের ডানা দুটি তখনও জোরে কাঁপছে। বিমানটি করাচী বন্দরের দিকে যাত্রা করে অল্পক্ষণের মধ্যে দিগন্তে মিলিয়ে যায়। এর মধ্যে কন্ট্রোল টাওয়ারে পাকিস্তানী অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আসিম হট লাইনে বেস কম্যান্ডারকে ব্লু বার্ড-১৬৬ ছিনতাইয়ের সংবাদ জানান। কিছুক্ষণের মধ্যে বেস কম্যান্ডার টাওয়ারে এসে উপস্থিত হলেন। এরপর দু’টি এফ-৮৬ জঙ্গী বিমান ব্লু বার্ড-১৬৬ এর খোঁজে উড়ে গেল। বাদ্বীন এব থাট্টার পাকিস্তান বিমানবাহিনীর রাডার স্টেশনের ব্লু বার্ড-১৬৬-এ অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ দিতে বলা হলে তারা জানায় যে, কেউই বিমানটির গতিবিধি জানে না। সম্ভবতঃ ব্লু বার্ড-১৬৬ এত নিচু দিয়ে উড়েছিল যে রাডারে বিমানটির অবস্থান ধরা যায়নি।
ব্লু বার্ড-১৬৬ সম্পর্কে কোন খবরই কেউ করতে পারেনি। তবে সেদিন বিকালেই জানা গেল যে, থাট্টার অদূরে তালাহারে ব্লু বার্ড দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে এবং বিমানের দুজন বৈমানিকই নিহত হয়েছেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা দুঃসাহসী করে তুলেছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ুরকে। প্যারাস্যুট, হেলমেট এবং বৈমানিকের বিমান চালানোর কোনরকম সরঞ্জাম ছাড়াই মতিয়ুর উঠেছিলেন বিমানে। ধারণা করা হয় যে, অত্যন্ত নিচু নিয়ে উড়ে যাবার সময় শেষ মুহূর্তে পাইলট অফিসার মিনহাজ প্যারাস্যুটের সাহায্যে নামার চেষ্টা করেছিলেন এবং ভূমি থেকে উচ্চতা কম হওয়ার দরুণ তিনি সফল হননি ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ুর রহমান ছিটকে পড়েন মাটিতে। পাইলট অফিসার মিনহাজের দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ুর রহমানের দেহ প্রায় অক্ষতই ছিল। পাকিস্তানীরা পরে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ুর রহমানকে মশরুর বিমান ঘাঁটির ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত কবরস্থানে জানাজা এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই কবর দেয়।
০০০

সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমান, বীর শ্রেষ্ঠ
সিপাহী হামিদুর রহমান ১৯৭১ সালে ২ ফেব্রুয়ারী ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে ভর্তি হন। ভর্তির পর তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে প্রশিক্ষণের জন্য যান। ২৫ মার্চ ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।
সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল থানার আনুমানিক দশ মাইল দক্ষিণ পূর্বে ধলই। সীমান্তের প্রায় চারশ’ গজ দূরে ধলই চা বাগানের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ধলই বর্ডার আউট পোস্ট। সামরিক দিক থেকে এ এলাকাটি দখল করা ছিল মুক্তিবাহিনীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধলিই বিওপি দখল করার দায়িত্ব দেয়া হয় ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানীকে। ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল তখন ‘জেড’ ফোর্সের একটি ইউনিট এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলে শহীদ কর্নেল (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও অবসরপ্রান্ত) জিয়াউর রহমান।

সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের ছবি :

২৮ অক্টোবর ভোরে আক্রমণের দিন ও ক্ষণ হিসাবে নির্ধারণ করা হয়। ২৭ অক্টোবর রাত দশটায় যাত্রা শুরু হয়। ভোর চারটায় লক্ষ্যবস্তুর নিকট পৌঁছে বিওপি’র ওপর চূড়ান্ত আক্রমণ করার কথা।
রাতের আঁধার ও কুয়াশার জন্য ২০/২৫ গজ দূরে সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আক্রমণের সময় দুই প্লাটুন সামনে ও এক প্লাটুন অনুসরণকারী থাকার জন্য কোম্পানী অধিনায়ক নির্দেশ দেন। অন্ধকার কেটে যাওয়ার পর লেফটেন্যান্ট কাউয়ুম হাবিলদার (বর্তমানে নায়েক সুবেদার) মকবুলকে শত্রুর অলক্ষ্যে গাছের ওপর উঠে শত্রুর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করার নির্দেশ দেন। নায়েক সুবেদার মকবুল পর্যবেক্ষণ শেষে গাছ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই শত্রু বিওপি থেকে কোম্পানীর ওপর গুলি শুরু করে। শত্রুর গুলির মোড় ঘোরানোর জন্য লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে শত্রুর ওপর পাল্টা গোলাবর্ষণের জন্য বেতারে যোগাযোগ করেন। গোলাবর্ষেণের কিছুক্ষণ পর শত্রু গুলি বন্ধ করে দেয়। গোলাবর্ষণের ফলে বিওপি’র এক অংশে আগুন ধরে যায়। আক্রমণে ৭ নং প্লাটুন ডানে ৯ নং প্লাটুন বামে ও ৮ নং প্লাটুন অনুসরণকারী ছিল। চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে শত্রুরা তুমুল গুলি শুরু করে। প্রাথমিক পর্যায়েই কিছু সৈনিক হতাহত হয়। আক্রমণকারী সৈন্যরা বিওপি’র আরো কাছাকাছি এলে শত্রুর লাগানো মাইন ফিল্ডে কিছু সৈনিক হতাহত হয়। এ পর্যায়ে শত্রুর গুলিবর্ষণের তীব্রতায়ও হতাহতের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আক্রমণকারী সৈন্যরা ভূমিতে অবস্থান নেয়। লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম তখন কর্নেল জিয়াকে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন কিন্তু জেড ফোর্স অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমকে আদেশ দেন ক্ষতির পরিমাণ লক্ষ্য না করে বিওপি দখল করতে।

ধলই বিওপি’র যুদ্ধ নকশা :

আক্রমণকারী সৈন্যরা লক্ষ্যবস্তুর খুব কাছে এলেও বিওপি দখলা করা সম্ভব হচ্ছিল না। বিওপি’র দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় শত্রুর এল এম জি’র অবস্থানের ফলে গাছপালার জন্য নিজস্ব মেশিনগান দিয়ে গুলি করেও কোন ফল হচ্ছিল না। তখন লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম সহযোদ্ধা সিপাহী হামিদুর রহমানকে আদেশ দেন শত্রুর সেই এল এম জিটি নিস্ক্রিয় করার জন্য। ক্রলিং করে শত্রুর অগোচরে এল এম জি পোস্টের কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। চারিদিকে উভয় পক্ষের অবিরাম গুলি উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন উল্লেখিত এল এম জি পোস্টের উপর। একাই লড়াই শুরু করলেন শত্রু এল এম জি চালনায় নিয়োজিত দুই শত্রুসেনার সঙ্গে। এল এম জি নিঃস্তব্ধ হল, দখল হল ধলই বিওপি। এল এম জি পোস্টে পাওয়া গেল শহীদ হামিদুর রহমানকে নির্জীব আহত দুই শত্রুসেনার সঙ্গে। পরে ভারতের মাটিতেই চিরনিদ্রায় শুইয়ে দেয়া হয় এই শহীদকে।
০০০

ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ, বীর শ্রেষ্ঠ
ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ ১৯৬৩ সালের ৮ মে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্-এ ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের ২৫-এ মার্চের আগে চট্টগ্রামে ১১ উইং-এ চাকরিরত ছিলেন। পরে ৮ মে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন।

ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফের ছবি :
যুদ্ধ শুরু হলে ৮ মে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথ প্রতিরোধ করার জন্য চিংড়ি খালের দুই ধারে বুড়িঘাট নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২ কম্যান্ডো ব্যাটেলিয়নের আনুমানিক দুই কোম্পানী সৈন্য, সাতটি স্পীড বোট এবং দুই লঞ্চে করে ৮ ইস্টবেঙ্গলের বুড়িঘাট প্রতিরক্ষার দিকে অগ্রসর হয়। প্রতিরক্ষার সামনে এসে শত্রু ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং অন্যান্য অস্ত্র দ্বারা তুমুল গুলি শুরু করে। শত্রুর মর্টারের গোলার তীব্রতায় আমাদের প্রতিরক্ষায় বিশৃংখলা দেখা দেয় এবং প্রায় সৈনিক বিভিন্নভাবে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। ল্যান্স নায়েক আবদুর রউফ নিজ পরিখা থেকে তাঁর মেশিনগান দিয়ে গুলি করতে থাকেন। এ গুলিবর্ষণের ফলে শত্রুর সব ক’টি স্পীড বোট ডুবে যায় এবং সব আরোহী হতাহত হয়। এ আকস্মিক ক্ষতিতে শত্রুর মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পেছনের লঞ্চ দুটি পশ্চাদপসরণ করে রউফের মেশিনগানের রেঞ্জের বাইরে চলে যায়। শত্রুর লঞ্চ দুটি পেছনে গিয়ে সমস্ত প্রতিরক্ষা এলাকার ওপর প্রবলভাবে মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। শত্রুর একটি মর্টারের গোলা এসে সরাসরি ল্যান্স নায়েক আবদুর রউফের ওপর পড়ে। স্তব্ধ হয়ে যান ল্যান্স নায়েক আবদুর রউফ, নীরব হয়ে যায় তার মেশিনগান।
০০০

ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ, বীর শ্রেষ্ঠ
ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ১৯৫৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্-এ ভর্র্তি হন। ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত তিনি ৮ উইং দিনাজপুরে চাকরিরত ছিলেন। মার্চ মাসে ৪ উইং যশোরে বদলী হন। ৪ উইং-এ যোগদানের আগে ছুটিতে থাকার সময়ই স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।

ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের ছবি :

সূতিপুরে নিজস্ব প্রতিরক্ষার সামনে গোয়ালহাটী গ্রামে একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রোল পাঠানো হয়। অধিনায়ক ছিলেন ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ এবং সঙ্গে ছিলেন চারজন সৈনিক। ৫ সেপ্টেম্বর ’৭১ আনুমানিক সকাল সাড়ে ন’টায় শত্রু নিজস্ব প্রতিরক্ষার তিন দিকে অবস্থান গ্রহণ করে। স্ট্যান্ডিং পেট্রোলটিকে তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। নিজস্ব প্রতিরক্ষা থেকে শত্রুর ওপর গুলি চালিয়েও পেট্রোলটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছিল না। ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ তার পেট্রোলকে পেছনে নিয়ে এসে নিজ প্রতিরক্ষায় যোগ দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। এমন সময় সিপাহী নান্নু মিয়ার গায়ে গুলি লাগে এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ সিপাহী নান্নু মিয়ার এল এম জি নিজে তুলে নিয়ে এমনভাবে ডানে ও বামের বিভিন্ন অবস্থান থেকে শত্রুর ওপর গুলি করেছিলেন যেন শত্রু তাদের পশ্চাদপসরণের সঠিক পথ অনুধাবন করতে না পারেন। ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ এ সব করেছিলেন আহত সিপাহী নান্নু মিয়াকে কাঁধে নিয়ে। এ সময় শত্রুর একটি ২ ইঞ্চি মর্টারের গোলা এসে পড়ে তার ঠিক ডানে। নূর মোহাম্মদের ডান হাঁটু ভেঙে চুরমার হয়ে যায় এবং ডান কাঁধ আঘাত পান। শেষ পরিণতি বুঝতে পেরে তিনি সহযোগী সিপাহী মোস্তফাকে আদেশ দিলেন আহত সিপাহী নান্নু মিয়াকে এবং তার এল এম জিটি নিয়ে পশ্চাদপসরণ করতে। সিপাহী মোস্তফাকে অনুরোধ করলেন রাইফেলটি তাঁকে দিয়ে যেতে। সিপাহী মোস্তফা ল্যান্স নায়েক নান্নু মিয়া ও ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদকে সহ পশ্চাপসরণ করতে চাইলেন। নূর মোহাম্মদ পিছু হটার প্রতিবাদ করেন। এ সময় দুটি পথ খোলা ছিল পশ্চাদপসরণ করে নিজ প্রতিরক্ষায় যোগ দেয়া নয়তো মৃত্যুবরণ করা। ল্যান্স নায়েক তখন রক্তক্ষরণের ফলে প্রায় সংজ্ঞাহীন। সিপাহী মোস্তফা যখন তাকে নিয়ে যেতে চাইলেন তখন নূর মোহাম্মদ পাশের গাছের শিকড় আকড়ে ধরে থাকেন। সিপাহী মোস্তফাকে বোঝালেন তাঁকে নিয়ে পশ্চাদপসরণ করতে গেলে সিপাহী নান্নু মিয়াসহ সবাই মারা যাবে। নিরুপায় সিপাহী মোস্তফা ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। চেষ্টা করে অপারগ হয়ে বহু কষ্টে সিপাহী নান্নু মিয়াকে এল এম জিসহ পেছনে প্রতিরক্ষায় এসে মিলিত হন। ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ আহত অবস্থায় শত্রুর ওপর গুলি করতে লাগলেন যেন সিপাহী মোস্তফা এবং সিপাহী নান্নু মিয়া পশ্চাদপসরণ করতে পারেন। প্রায় এক ঘন্টা পর আরো সৈন্য এনে প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করা হয়। ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদের মৃতদেহ পাশের একটি ঝাঁড় থেকে উদ্ধার করা হয়। পাকিস্তানী সৈনিকরা সব নিয়ম-কানুন লংঘন করে আহত এ মুক্তিযোদ্ধার কোঠর থেকে চোখ দু’টি বের করে ফেলে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
০০০

সিপাহী মোঃ মোস্তফা কামাল, বীর শ্রেষ্ঠ
সিপাহী মোস্তফা কামাল ১৬ ডিসেম্বর ’৬৭ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট-এ ভর্তি হন। ’৬৮ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। তারপর তাঁকে ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলী করা হয়।
২৫শে মার্চে ১৯৭১ এর আগে ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কাজে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাঠানো হয়। ২৫ মার্চের পর ২৭ মার্চ ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ২৭ মার্চ সকাল সাড়ে ন’টায় ৪র্থ ইস্টবেঙ্গলের অবাঙালী অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত খান ও অন্য দু’জন অফিসারকে বন্দী করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে প্রাথমিক প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করার পর ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল কুমিল্লা সেনানিবাসের চারপাশে পাকবাহিনীর অপারেশনাল চলাফেরা রোধকল্পে ছোটখাট হামলা পরিচালনা করে। এ সময়ে পুলিশ, বি ডি আর, আনসার মুজাহিদ ও ছাত্র জনতা ৪র্থ ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে যোগ দেয়। ২৯ মার্চ বিকাল চারটায় কুমিল্লা সেনানিবাসে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ৪র্থ ইস্টবেঙ্গলের রিয়ার পার্টির উপর আক্রমণ করে এবং দীর্ঘ সাড়ে চার ঘন্টা সংঘর্ষের পর ৭০ জন বীরসৈনিক শাহাদাৎ বরণ করেন এবং ২৩ জন ব্ন্দী হন। ২য় ইস্টবেঙ্গল তখন ভৈরব সেতুর পার্শ্বে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করেছিল। ১৪ এপ্রিল পাকবাহিনী ২য় ইস্টবেঙ্গল ও ৪র্থ ইস্টবেঙ্গলের উপর বিমান হামলা থেকে শুরু করে ভূমিতে হেলিকপ্টার দিয়ে সৈন্য নামিয়ে দীর্ঘ নয় ঘন্টা আক্রমণ চালায়। ১৬ই এপ্রিল ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে উজানীস্বর সেতু ধ্বংস করে এবং সেখানে একটি কোম্পানী প্রতিরক্ষা নেয়।

সিপাহী মোঃ মোস্তফা কামালের ছবি :
২৫ মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলার পর শত্রুর চাপের মুখে পশ্চাদপসরণ-এর সময় বাংলাদেশ রাইফেলসের কিছু সৈনিক গঙ্গাসাগর এলাকায় অবস্থান নেয়। আখাউড়ায় অবস্থিত ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিণ দিক থেকে শত্রুর আকস্মিক আক্রমণ হতে নিরাপত্তার জন্য গঙ্গাসাগরের উত্তরে দরুইন গ্রামে ২ নং প্লাটুনকে অবস্থানের নির্দেশ দেয়। উপর্যুপরি দু’দিন উক্ত প্রতিরক্ষা এলাকায় কোন রকম খাবার না পৌঁছায় ১৭ এপ্রিল সিপাহী মোস্তফা দরুইন থেকে ব্যাটেলিয়ন সদর দফতরে আখাউড়ায় আসেন। ৪র্থ ইস্টবেঙ্গলের সহ অধিনায়ক মেজর (পরে কর্নেল ও অবসরপ্রাপ্ত) সাফায়াত জামিল সিপাহী মোস্তফাকে আখাউড়ায় দেখতে পেয়ে কঠোর তিরস্কার করে প্রতিরক্ষা এলাকা ত্যাগ করে আসার কারণে। সিপাহী মোস্তফা ক্ষুন্ন হয়ে ফেরত চলে যায় দরুইন গ্রামে প্রতিরক্ষায়।
১৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৪র্থ ইস্টবেঙ্গলকে আক্রমণ করার জন্য কুমিল্লা-আখাউড়া রেল লাইন দিয়ে উত্তর দিকে এগোতে থাকে। ১৭ এপ্রিল সকাল থেকে তারা দরুইন গ্রামে নিজ প্রতিরক্ষার উপর মর্টার ও আর্টিলারীর গোলাবর্ষণ শুরু করে। নিজ প্রতিরক্ষা যথেষ্ট শক্তিশালী নয় বুঝতে পেরে মেজর সাফায়াত জামিল ‘ডি’ কোম্পানীর ১১ নং প্লাটুনকে দরুইন গ্রামে পূর্বের প্লাটুনের সঙ্গে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। হাবিলদার (বর্তমানে সুবেদার) মুনির আহম্মদ ১৭ এপ্রিল ১১ নং প্লাটুন নিয়ে দরুইন পৌঁছেন। সিপাহী মোস্তফা হাবিলদার মুনিরের নিকট থেকে এসে গুলি নিয়ে যান এবং বলে যান আর কখনো নিজ পরিখা ত্যাগ করবে না। শেষ রাতের দিকে শত্রুর গোলাবর্ষণ কিছুটা কমে আসে। পরদিন ভোর হতেই আকাশ কালো করে মেঘ আসে। তিনদিন অপেক্ষার পর দশটার দিকে খাবার এলো প্রতিরক্ষা এলাকায়। আনুমানিক এগারোটার দিকে আবার শত্রু গোলাবর্ষণ শুরু করে। আটটার দিকে শত্রুর কয়েকটা হেলিকপ্টারকে পশ্চিমে উজানীশ্বর পুলের দিকে উড়ে যেতে দেখা যায়। শত্রুর গুলি শুরু হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। সিপাহী মোস্তফা কর্তব্যে অবহেলায় অভিযুক্ত হয়ে অভিমান করে নিজের খাবারও নিতে আসেননি। প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে মোগলা বাজারের ও গঙ্গাসাগরের অবস্থান থেকে শত্রু প্রচন্ড গুলি শুরু করে। মোগলা বাজারের দালানের ছাদের উপর লাগানো ছিল শত্রুর একটি মেশিনগান। এ মেশিনগানটি সবচেয়ে কার্যকর ফায়ার করছিল নিজ প্রতিরক্ষার উপর।

আখাউড়া ও গঙ্গাসাগরের যুদ্ধ নকশা :

প্রকৃত আক্রমণ হয় পশ্চিম দিক থেকে দুপুর বারোটার সময়। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ছিল। প্রতিরক্ষার সৈনিকরা আক্রমণের আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে যায়। কিন্তু মোস্তফা পুর্নদ্যমে তার এল এম জি দিয়ে শত্রুর উপর দক্ষতার সঙ্গে গুলি করতে থাকে। মোস্তফা পূর্ব দিকের প্রায় প্রতিটি সৈনিকই তখন পশ্চাদপসরণ করে নতুন অবস্থানে যাচ্ছে। পশ্চাদপসরণকারী সহযোগী সৈনিকরা পশ্চাদপসরণের সময় মোস্তফাকে অনুরোধ করে তাদের সঙ্গে যাবার জন্য। মোস্তফা রাজী হয়নি। এ অবস্থানে থেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সিপাহী মোস্তফা।
০০০

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীর শ্রেষ্ঠ
ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৯৬৭ সালের ৫ই অক্টোবর পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালের ২ জুন ইঞ্জিনিয়ার্স কোরে কমিশন হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদানের আগে পাকিস্তানে ১৭৩ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটেলিয়নে কর্তব্যরত ছিলেন।

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের ছবি :

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানে আটকে পড়া আরো তিনজন অফিসার শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন, বীর উত্তম, মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) শাহরিয়ার ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আনাম এর সঙ্গে তিনি পালিয়ে আসেন এবং পশ্চিম বাংলার মালদহ জেলার মেহেদীপুরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে যোগদান করেন।
রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের জন্য সেক্টর কম্যান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুজ্জামান, মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) গিয়াস, মেজর (বর্তমানে কর্নেল) রশীদ এবং ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে তিনটি দলগঠন করেন। মেজর গিয়াসকে দায়িত্ব দেয়া হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী সড়কে ব্লকিং পজিশন নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে রাজশাহী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে। মেজর রশীদকে দায়িত্ব দেয়া হয় কাট অফ পার্টি নিশ্চিত করার জন্য। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে দায়িত্ব দেয়অ হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখল করার জন্য। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ১০ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট (বর্তমানে মেজর) কাইয়ুম, লেফটেন্যান্ট (বর্তমানে মেজর) আউয়াল ও আনুমানিক ৫০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারোঘরিয়া এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুদ্ধ নকশা :

মহানন্দা নদীর পূর্ব অংশে চর ও বাঁধ এলাকায় ছিল শত্রুর প্রতিরক্ষা (স্কেচ দ্রষ্টব্য)। প্রতিরক্ষা সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল উল্লেখিত চর এলাকায়। আক্রমণের পূর্বে শত্রুর প্রতিরক্ষা এলাকাসমূহের উপর আর্টিলারীর গোলাবর্ষণ করে শত্রুকে বিভ্রান্ত ও দুর্বল করার জন্য ১১ ডিসেম্বর নিজেদের প্রয়োজনীয় গোলাবর্ষণ করার কথা। এ দায়িত্ব ছিল ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর ওপর। ভারতীয় অফিসার ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিং এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ও করা হয়েছিল, কিন্তু ১১ ডিসেম্বর নির্ধারিত সময়ে শত্রুর উপর ভারতীয় গোলাবর্ষণ হয়নি। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের আক্রমণ করার কথা ছিল একই দিন। পরবর্তী দু’দিন গোলন্দাজ ফায়ারের জন্য ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগদান করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। অবশেষ গোলন্দাজ সাহায্য ছাড়াই শত্রু অবস্থানের উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১৪ ডিসেম্বর, সকাল প্রায় আটটায় মাত্র জনা বিশেক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর বারোঘরিয়া এলাকা থেকে ৩-৪টি দেশী নৌকা করে রেহাই চর এলাকা দিয়ে মহানন্দা নদী অতিক্রম করেন।
নদী অতিক্রম করার পর তিনি উত্তর দিক থেকে একটি করে প্রত্যেকটি মরিচার শত্রু খতম করে দক্ষিণে এগোতে থাকেন। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এমনভাবে আক্রমণ পরিকল্পনা করেছিলেন যাতে উত্তর থেকে শত্রু ধ্বংস করার সময় দক্ষিণ দিক থেকে শত্রু গুলি করতে না পারে। সম্মুখ ও হাতাহাতি যুদ্ধ চলছিল তখন। বাঁধের উপর থেকে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের ৮/৯ জন সৈনিক তখন দৌড়ে চর এলাকায় শত্রুর প্রতিরক্ষায় এসে যোগ দেয়। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এর ২-৩ জন সহযোদ্ধা মহানন্দা নদী সাঁতরিয়ে বারোঘরিয়া এসে জানায় যে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের কপালে গুলি লেগেছে। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের মৃত্যুতে বাকী মুক্তিযোদ্ধারা আরো প্রত্যয়ী হয়ে উঠে। পুনর্বার আক্রমণ পরিকল্পনা করা হয়। একই দিন বিকেলে আরো শক্তি নিয়ে শত্রু অবস্থানের উপর আক্রমণ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখল করা হয়। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ চর এলাকায় একটি মরিচা থেকে উদ্ধার করা হয়। সে দিনই ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ সোনা মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সোনা মসজিদের এলাকার ভিতর সমাহিত করা হয়।
০০০

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1982.03.26-bichitra-1.pdf” title=”1982.03.26 bichitra”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!