You dont have javascript enabled! Please enable it!

সামরিক আইন জারী সংবিধান স্থগিত পার্লামেন্ট ও সরকার বাতিল
সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারের ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
জেনারেল এইচ এম এরশাদের ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৪ মার্চ ১৯৮২

সামরিক আইন জারী সংবিধান স্থগিত পার্লামেন্ট ও সরকার বাতিল

গত ২৪ মার্চ শেষ রাতে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। উপ-প্রধান প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম এ খান এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ।
সামরিক আইন জারির সঙ্গে সঙ্গে সংবিধান স্থগিত হয়েছে। পার্লামেন্ট ও সরকার বাতিল হয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট তাঁর পদে আর বহাল নেই। সামরিক আইন ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতাবলে আজ ২৪ মার্চ বুধবার থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সকল ও পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন।’

সামরিক আইনের ঘোষণা
যেহেতু দেশে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যাতে অর্থনৈতিক জীবনে নেমে এসেছে অচলাবস্থা, বেসামরিক প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারছে না, সকল স্তরে যথেচ্ছ দুর্নীতি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ফলে জনগণ অসহনীয় দুর্দশায় পড়েছে, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির বিপজ্জনক অবনতি ঘটেছে—শান্তিস্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, মর্যাদার সঙ্গে জীবন যাপন করা মুশকিল হয়ে পড়েছে. রাষ্ট্রীয় কর্তব্যে অবহেলা করে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করেছে।
যেহেতু দেশের জনগণ চরম নৈরাশ্য, হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে গেছে।
এবং
যেহেতু বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ এবং জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে কষ্টার্জিত দেশকে সামরিক আইনের অধীনে ন্যস্ত করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে এবং জনগণ ও দেশের প্রতি তাদের কর্তব্যের অংশ হিসাবে এ দায়িত্ব সশস্ত্র বাহিনীর উপর পড়েছে।
এখন অতএব, আমি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ, সর্বশক্তিমান আল্লার সাহায্য ও করুণায় এবং আমাদের মহান দেশপ্রেমিক জনগণের দোয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ বুধবার থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সকল ও পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করছি এবং ঘোষণা করছি যে, গোটা বাংলাদেশ অবিলম্বে সামরিক আইনের আওতায় আসবে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আমি বাংলাদেশের সকল সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ণ ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করছি।
এ ব্যাপারে আমার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা বলে আমি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ আরো ঘোষণা করছি যে :-
(ক) ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ বুধবার থেকে আমি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি।
(খ) আমি যে কোন ব্যক্তিকে দেশের প্রেসিডেন্ট মনোনীত করতে পারি, যিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি অথবা আমার মনোনীত সুপ্রীম কোর্টের যে কোন বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণ করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। আমি সময় সময়ে এমন মনোনয়ন বাতিল বা রদ করতে পারি এবং আর এক ব্যক্তিকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনোনীত করতে পারি। আমার মনোনীত প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপ্রধান হবে এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রূপে আমার উপদেশ অনুসারে কাজ করবেন এবং আমি তাকে যেসব কাজের দায়িত্ব দেবো তা পালন করবেন।
(গ) আমি সময়ে সময়ে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সামরিক আইনবিধি, আদেশ ও নির্দেশ প্রণয়ন করতে পারি।
(১) যাতে সামরিক আইনবিধি ও আদেশ লংঘন বা তার পরিপন্থী যে কোন অপরাধের জন্য এবং অন্য কোন আইন অনুসারে অপরাধের বিচার ও শাস্তি দেবার জন্য সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত, ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ সামরিক আদালত প্রতিষ্ঠার বিধান থাকবে;
(২) এই ধরনের বিধি অথবা আদেশ কিংবা তার পরিপন্থী অপরাধের এবং অন্য কোন আইনের আওতায় অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে;
(৩) কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনালকে এই ধরনের বিধি কিংবা আদেশের আওতায় অথবা তার পরিপন্থী যে কোন অপরাধের বিচার ও শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা থাকবে;
(৪) সামরিক আইনবিধি অথবা আদেশে বর্ণিত যে কোন অপরাধের বিচার করা থেকে যে কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার রদ করার বিধান থাকবে; এবং
(৫) অন্য কোন বিষয় অথবা অন্য কোন আইনের বিধান অনুসারে বা বিধিবদ্ধ বা তাতে নির্দিষ্ট যে কোন বিষয় বা ব্যাপারসহ যেকোন বিষয়ের ক্ষেত্রে অথবা অন্য বিষয়।

(ঘ) আমি এই ঘোষণার দ্বারা ঘোষিত সামরিক আইন যে কোন সময় সারা বাংলাদেশে অথবা তার যে কোন অঞ্চলে রদ করতে পারি এবং আর একটি নতুন ঘোষণার দ্বারা সারা বাংলাদেশে বা তার যে কোন অঞ্চলে পুনরায় সামরিক আইন জারী করতে পারি।
(ঙ) সাময়িকভাবে বলবৎ যে কোন আইনে যাই সন্নিবেশিত থাকুক না কেন, আমার দ্বারা ঘোষিত সামরিক আইন বিধি এবং আদেশ এবং অন্যান্য আদেশ এবং নির্দেশ মোতাবেক ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে।
(চ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের কার্যকারিতা এই মুহূর্তে থেকে স্থগিত থাকবে।
(ছ) ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ বুধবার সকালে বলবৎ সকল আইন, অর্ডিন্যান্স, প্রেসিডেন্টের আদেশ ও অন্যান্য আদেশ, ঘোষণা, বিধি, নিয়ম-কানুন, উপবিধি, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত ব্যবস্থা রদ, বাতিল বা সংশোধিত না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিবৃন্দ, এ্যাটর্নী জেনারেল, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার বা কমিশনারবৃন্দ, সরকারী কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ, কন্ট্রোলার ও অডিটর জেনারেল এবং প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োজিত অপর সকলে দায়িত্ব পালন করে যাবেন। স্থগিত সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক রীট আবেদনসমূহের ফলে উদ্ভূত ও তৎসংক্রান্ত সকল মামলা বাতিল গণ্য হবে।
(জ) সুপ্রীম কোর্টসহ কোন আদালত কিংবা ট্রাইব্যুনাল কিংবা কর্তৃপক্ষেরই কোনভাবে এই ঘোষণা বা কোন সামরিক আইন বিধি বা আদেশ কিংবা তদনুযায়ী আমার দেয়া অন্য আদেশ কিংবা এই ঘোষণা বলে বা তদনুযায়ী প্রদত্ত কিংবা প্রদত্ত হয়েছে বলে এই ঘোষণায় উল্লিখিত কোন ঘোষণা কিংবা এই ঘোষণা বলে বা তদনুযায়ী কৃত কোনকিছু কিংবা গৃহীত অথবা কৃত বা গৃহীত হয়েছে বলে উল্লিখিত কোন ব্যবস্থা অথবা কোন সামরিক আইন বিধি বা আদেশ কিংবা এই ঘোষণা অনুযায়ী আমার দেয়া অন্য আদেশ বলে বা তদনুযায়ী কৃত কোনকিছু, কিংবা গৃহীত কোন ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করার কোন ক্ষমতা থাকবে না।
(ঝ) উপরোক্ত বিধানসমূহ সাপেক্ষে এই ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বে চালু থাকা সুপ্রীম কোর্টসহ সকল আদালত কাজ করে যাবে, তবে তা সামরিক আইন বিধি, আদেশসমূহ কিংবা আমার দেয়া অন্যান্য আদেশসাপেক্ষে।
(ঞ) সামরিক আইনবিধি ও আদেশসমূহ ও অন্যান্য আদেশ ও নির্দেশ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক কর্তৃক প্রদত্ত হবে।
(ট) প্রধান সামরিক আইন প্রশাসককে তাঁর দায়িত্ব পালনে সাহায্য ও পরামর্শ দেয়ার জন্যে একটি উপদেষ্টা, পরিষদ/মন্ত্রিপরিষদ থাকবে। এই উপদেষ্টাবৃন্দ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং তাঁরা তাঁর সন্তুষ্টি অনুযায়ী এই পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। কোন উপদেষ্টা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের কাছে লিখিতভাবে তাঁর পদে ইস্তফা দিতে পারে; প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হবেন প্রধান নির্বাহী ও সরকার প্রধান।
(ড) এই ঘোষণার অব্যহিত পূর্বে প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপ-মন্ত্রী, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, চীফ হুইপ ও হুইপ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ এই মুহূর্ত থেকে আর তাঁদের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন না। এই ঘোষণার পূর্বে যে মন্ত্রিপরিষদ ও পার্লামেন্ট ছিল তা এই মুহূর্ত থেকে বাতিল হয়ে গেল।
(ঢ) প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সামরিক আইনের কার্যকর প্রয়োগের জন্যে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক, উপ-আঞ্চলিক ও সামরিক আইন প্রশাসক ও জেলা সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করতে পারেন। তবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, উপ-আঞ্চলিক ও জেলা সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগে তাঁর ক্ষমতা আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসককে অর্পণ করতে পারেন। আমি সময়ে সময়ে তাদের যেসব ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেবো তাঁরা তা প্রয়োগ ও পালন করবেন।
আমি
(ক) নৌবাহিনীর স্টাফপ্রধান পি নং ৩ রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান, ও
(খ) বিমান বাহিনীর স্টাফপ্রধান বিডি/৪২৯৫ এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ বিইউ-কে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করছি।
০০০

জাতীয় ঘটনা
এই সপ্তাহেই ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারম্যান বিচারপতি সাত্তার পুরানো জাতীয় কমিটি বাতিল করে দিয়ে নতুন স্থায়ী কমিটি গঠন করেন।
বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে বিশেষ করে খুন ও বেআইনী অস্ত্র রাখার অভিযোগে এ সপ্তাহে গ্রেফতার করা হয় জাতীয়তাবাদী দলের ঢাকা মহানগরী শাখার প্রচার সম্পাদক ও পৌর কমিশনার কাজী ইউনুস আবদুল্লাহ সেন্টু, ও ঢাকার সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সহ-সভাপতি দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী ওরফে দীলাকে। এছাড়াও রাজধানীর একটি গোপন বোমা তৈরির কারখানায় হানা দিয়ে পুলিশ ৫ জনকে গ্রেফতার করে।
এই পটভূমিতে ২৩ মার্চ নতুন ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুহম্মদউল্লাহ শপথ নেন। এর আগে দুঃখের সঙ্গে ডঃ এম এন হুদা ভাইস-প্রেসিডেন্টের পধ থেকে পদত্যাগ করেন।
এছাড়াও মন্ত্রীদের সুপারিশে দেয়া আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়। মন্ত্রীদের সুপারিশের কোন সীমা ছিল না এ ব্যাপারে এবং অনেক লোকই যারা আগ্নেয়াস্ত্র পেয়েছে এ সুপারিশে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
এমনি এক পরিস্থিতিতে ২৪ মার্চ সকালে সেনাবাহিনী স্টাফ প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ সমগ্র বাংলাদেশে দুর্নীতি নির্মূল দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ ও উৎপাদন বৃদ্ধির সংকল্পে সামরিক আইন জারী করেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
০০০

আমি সমগ্র বাংলাদেশকে নিম্নোক্তভাবে পাঁচটি সামরিক আইন অঞ্চলে ভাগ করছি :
অঞ্চল ‘ক’—ঢাকা, ঢাকা মেট্রোপলিটন নগরী, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও জামালপুর বেসামরিক জেলাসমূহ।
অঞ্চল ‘খ’—বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী ও পাবনা বেসামরিক জেলাসমূহ।
অঞ্চল ‘গ’—চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বান্দরবন বেসামরিক জেলাসমূহ।
অঞ্চল ‘ঘ’—কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেট বেসামরিক জেলাসমূহ।
অঞ্চল ‘ঙ’—যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ফরিদপুর বেসামরিক জেলাসমূহ।

এবং নিম্নোক্ত আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকদের নিয়োগ করছি :
অঞ্চল ‘ক’—বি এ-১২১ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবদুর রহমান, জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং, নবম পদাতিক ডিভিশন।
অঞ্চল ‘খ’—বি এ-১১৯ মেজর জেনারেল আর এ এম গোলাম মোকতাদির, জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং, একাদশ পদাতিক ডিভিশন।
অঞ্চল ‘গ’—বি এ-১১২ মেজর জেনারেল আবদুল মন্নাফ, জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং, ২৪তম পদাতিক ডিভিশন।
অঞ্চল ‘ঘ’—বি এ-১৩২ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং, ৩৩তম পদাতিক ডিভিশন।
অঞ্চল ‘ঙ’—বি এ-১৮৩ ব্রিগেডিয়ার কে এম আবদুল ওয়াহেদ, অফিসিয়েটিং কম্যান্ডার, ৫৫তম পদাতিক ডিভিশন।

তারা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অভিপ্রায় অনুযায়ী ক্ষমতায় থাকবেন এবং সামরিক আইনের কার্যকর প্রয়োগের এবং তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইন ও শৃংখলা বজায় রাখার জন্যে দায়ী থাকবেন। অঞ্চলসমূহের জন্যে উপ-আঞ্চলিক ও জেলা সামরিক আইন প্রশাসকদের নিয়োগের কর্তৃত্ব দিচ্ছি।
আমার জারিকৃত এই ঘোষণা (প্রোফমেশন), সামরিক আইনবিধি আদেশাবলী ও অন্যান্য আদেশসমূহ নির্দেশাবলী বলবৎ থাকাকালে সেগুলিই দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে গণ্য হবে এবং অপর যে কোন আইন, যদি এগুলোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে সেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ অপর আইন বাতিল বলে বিবেচিত হবে।
সরকারী গেজেটে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমি এই ঘোষণা (প্রোফমেশন) সংশোধন করতে পারি।
স্বাক্ষর : লেফটেন্যান্ট জেনারেল, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, (হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ), ঢাকা, ২৪শে মার্চ, ১৯৮২।
০০০

সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারের ভাষণের পূর্ণ বিবরণ

প্রিয় দেশবাসী,
আসসালামু আলাইকুম।
দেশের আইন-শৃংখলা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে জাতীয় স্বার্থে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সারা জীবন আমি ঐকান্তিকতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দেশের জন্য কাজ করেছি এবং সর্বদাই দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের সার্বিক অবস্থার যাতে উন্নতি হয়, তাই কামনা করেছি। দেশের বর্তমান এই অবস্থায় দেশের জন্য রয়েছে আমার আন্তরিক মঙ্গল কামনা। আমি পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার কাছে এই মোনাজাতই করি যে, তার অশেষ রহমতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে শান্তি, ন্যায় বিচার, প্রগতি ও সমৃদ্ধির এক নবযুগের সূচনা হবে।
বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসাবে আমার সঙ্গে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং আমাকে সব রকমভাবে সাহায্য করার জন্যে সশস্ত্র বাহিনীর সকলকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
আমাদের দেশবাসীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন সাধনের জন্য দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর এই মহান প্রচেষ্টার আমি সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করছি। জাতির প্রয়োজনে দেশের জন্য আমি যে কোন কর্তব্য পালনে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করব না। পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। খোদা হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
০০০

জেনারেল এইচ এম এরশাদের ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
বেতার ও টেলিভিশনে জাতীর উদ্দেশে প্রদত্ত প্রধান সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ-এর ভাষণ :

বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম,
প্রিয় দেশবাসী,
আচ্ছালামু আলাইকুম,
জাতীয় জীবনের এক চরম সংকটময় মুহূর্তে আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখা এবং সামাজিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করার লক্ষ্যে সশস্ত্র বাহিনীকে দেশের শাসনভার হাতে নিতে হয়েছে। সারাদেশে সামরিক আইন জারী করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টকে তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং মন্ত্রিপরিষদ ও জাতীয় সংসদ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। শাসনতন্ত্র সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। আমি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে একজন বেসামরিক ব্যক্তিকে মনোনীত করা হবে এবং তিনিই রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। সরকার প্রধান হিসাবে আমাকে সহায়তা করার জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হবে। শান্তি ও শৃংখলা রক্ষার জন্য ইতিমধ্যে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সে সম্পর্কে আপনার শীঘ্রই বিস্তারিত জানতে পারবেন। যে পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সশস্ত্র বাহিনীকে এই গুরুদায়িত্ব হাতে নিতে হয়েছে সে সম্পর্কে আমি এখন আপনাদের কিছু বলতে চাই।
আপনারা জানেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃংখলা, নজিরবিহীন দুর্নীতি, বিপর্যস্ত অর্থনীতি, প্রশাসনিক অচল অবস্থা, আইন-শৃংখলার চরম অবনতি, ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও খাদ্য সংকটের ফলে জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আজ এক দারুণ হুমকির সম্মুখীন।
ক্ষমতাসীনদের হীন স্বার্থপরতা, অযোগ্যতা, স্বজনপ্রীতি, সীমাহীন দুর্নীতি এবং কোন্দল এই সরকারকে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই সরকারের উপর আজ দেশবাসীর কোন আস্থা নেই। আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে যে, বিগত ১১ই ফেব্রুয়ারী জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিজেই তাঁর দুর্নীতিপরায়ণ মন্ত্রিসভার কথা অকপটে স্বীকার করেন এবং সেই অযোগ্য মন্ত্রিসভা বাতিল করেন এবং সৎ, নিষ্ঠাবান ও যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে এক নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। জনগণ আরো একবার আশা করল যে তাদেরই ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবার তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে এমন একটি মন্ত্রিসভা গঠন করবেন যার সদস্যদের যোগ্যতা ও সততা সম্পর্কে জনমনে সংশয়ের কোন অবকাশ থাকবে না। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভা জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে আরো একবার ব্যর্থ হল। কারণ, নবগঠিত মন্ত্রিসভার সেইসব পুরনো ব্যক্তিদেরই সমাবেশ ঘটল যাদের সততা ও নিষ্ঠা সম্পর্কে জনমনে সংশয় ও প্রশ্ন জেগেছিল। মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ ও দফতর পুনর্বন্টনের মাধ্যমে পরবর্তী পর্যায়ে পরিস্থিতির কিছু পরিবর্তন সাধনের প্রচেষ্টা চালান হয়। কিন্তু মূলতঃ এই বাহ্যিক পরিবর্তন সরকারের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ও অযোগ্যতা দূর করার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। জনগণের আশা ছিল যে, এই পরিবর্তন তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। অর্থাৎ দুর্নীতিমুক্ত, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী ও জনগণের আস্থাশীল সরকার গঠনে সহায়ক হবে। কিন্তু তাদের সে আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হল। আর সমগ্র জাতি নিমজ্জিত হল এক গভীর হতাশা ও এক চরম অনিশ্চয়তার মাঝে।
বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্রের উপর অতীতে একাধিকবার হামলা এসেছে কিন্তু গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী এদেশের মহান জনগণ ও দেশপ্রেমিক সশস্ত্রবাহিনী তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিবার। বিগত ৩০শে মে থেকে ১১ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা জনগণের সেই সম্মিলিত প্রচেষ্টারই উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে। কিন্তু পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন মহলের অযোগ্যতা, দুর্বলতা ও সীমাহীন স্বার্থসিদ্ধি অপপ্রয়াসে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় এক চরম নৈরাজ্য ও অচলাবস্থা। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় চরম অস্থিতিশীলতা। সম্প্রতি জনমনে এমন একটি ধারণার সৃষ্টি করা হয় যে, এই অযোগ্য সরকারের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের পেছনে দেশপ্রেমিক সশস্ত্রবাহিনীর প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। এমন কথাও রটানো হয়েছে যে সশস্ত্রবাহিনীর চাপের মুখে সরকার কোন কোন বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে আপনাদেরকে জানাতে চাই যে, এটা ছিল সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যমূলক। সরকার তাদের স্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে নিজেদের অপকর্ম ঢেকে রাখার ব্যর্থ প্রয়াসে জনমনে এই বিভ্রান্তির অপচেষ্টা চালায়।

প্রিয় দেশবাসী,
দেশ ও জাতির এই দুর্দিনে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে এই চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনগণের ডাকে সাড়া দিতে হয়েছে। কারণ, এছাড়া জাতির সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না। অন্যথায় দেশের নিরাপত্তা তথা অস্তিত্ব হতবিপন্ন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর ঘটত সামগ্রিক অবলুপ্তি। সীমাহীন দুর্নীতির ফলে দেশে এমন এমন নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী তার সরকারী বাসভবনে একজন ঘৃণ্য খুনী আসামীকে আশ্রয়দান করতে দ্বিধাবোধ করেননি। আপনারা জেনে বিস্মিত হবেন যে, এই ন্যক্কারজনক ঘটনা যাতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হয় সেজন্য সরকারের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিগত সেদিন যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের নির্ভীক সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকগণ সেই কুচক্রী মহলের কাছে নতিস্বীকার না করে সাংবাদিকতার মহান আদর্শ সমুন্নত রাখতে সমর্থ হন। যার ফলে এ দুনীর্তিবাজ সরকারের মুখোশ খুলে পড়ে জনগণের সম্মুখে এবং তারই ফলশ্রুতিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার বাধ্য হয়।

আপনারা জানেন জাতীয় অর্থনীতি আজ সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত। এর ফলে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আজ সুদূরপরাহত। সরকারের ভ্রান্তনীতি ও সুষ্ঠু অর্থনৈতিক কর্মসূচী ও সর্বোপরি দক্ষ পরিচালনার অভাবে সৃষ্ট অর্থনেতিক বিশৃংখলা বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণের মধ্যকার ব্যবধান ক্রমশ বাড়িয়ে তোলে। ফলে কারখানায় উৎপাদন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। অন্যদিকে চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির ফলে ব্যাংক, অফিস, আদালত, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানায় লুটতরাজ, সম্পত্তির অপচয় ও ক্ষমতার অপব্যবহার বাধাহীন গতিতে এগিয়ে চলে। চোরাচালানী, কালোবাজারী, আড়তদার ও মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্যে জনজীবন হয়ে উঠে অতিষ্ঠ। সরকারের অদূরদর্শিতা ও সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা দেশকে এক চরম খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। আমদানী, রফতানী, বৈদেশিক মুদ্রা ইত্যাদির ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থার ফলে দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণ বাংলাদেশে অর্থবিনিয়োগ করতে অনীহা প্রকাশ করে বিদেশী সাহায্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব ক্রমশঃ সরকারের প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করে। ফলে জরুরী অবস্থায় তাদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পেতে ব্যর্থ হয় এই সরকার। সামগ্রিকভাবে দেশ দেউলিয়া হবার পথে দ্রুত এগিয়ে চলে।
দেশের জনগণ আশা করেছিল বিগত নির্বাচনের পর এই নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা, সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। আশা ভঙ্গের বেদনায় জাতি দারুণ হতাশায় নিমজ্জিত হল। ক্ষোভ ও হতাশার মাঝে জাতি প্রত্যক্ষ করল, সমাজের নিন্দিত স্বার্থান্বেষী মহলের চাপের মুখে নতি স্বীকার করলেন তাদেরেই ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তিনি বরখেলাপ করলেন জাতির কাছে দেয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল লিপ্ত হল ব্যক্তিস্বার্থে এক নজিরবিহীন অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্য লিপ্ত হল প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে। ফলে দেশের সর্বত্র এবং সর্বক্ষেত্রে নেমে আসে এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা এবং সৃষ্টি হয় এক দুরূহ অচলাবস্থা।

প্রিয় দেশবাসী,
আমাদের জনগণ মূলত দেশপ্রেমিক ও সৎ। তাঁরা ধৈর্যশীল ও পরিশ্রমী এবং যোগ্য নেতৃত্ব পেলে তারা খ্যাতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারে। মরহুম নেতা জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য ও গতিশীল নেতৃত্বে তার প্রমাণ তাঁরা দিয়েছে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর দেশে যে চরম রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃংখলার সৃষ্টি হয় সেই পরিস্থিতিতে জনগণ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়।
সশস্ত্র বাহিনীর কর্তব্য সম্পর্কে দেশবাসী সম্পূর্ণভাবে সচেতন। দেশ ও জাতির সংকটকালীন অবস্থায় এদেশেরই সন্তান সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা যে জনগণের পাশে এসে দাঁড়াবে, সে বিষয়ে দেশবাসী ছিল সুনিশ্চিত। কারণ, এ দায়িত্বের পরিচয় তাঁরা পেয়েছে অতীতে, বিশেষ করে গত ৩০মে মে’র দুর্ঘটনার পর। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহের পর সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনগণ সশস্ত্র বাহিনীর উপর থেকেও আস্থা হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছিল। কারণ, আমরা তাদেরকে দেশ ও জাতির এই চরম সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসছিলাম না। চরম দুর্নীতিপরায়ণ ও অসৎ লোকদের কবলে পড়ে তাদের জীবন ক্রমশঃ দুর্বিসহ হয়ে উঠছিল। দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এই হতাশাব্যঞ্জক ও দুর্যোগময় পরিস্থিতির মুখেও এতদিন ছিল নীরব। কারণ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি তাদের আস্থা ছিল অবিচল। তাই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও তাদের বেসামরিক ভাইদের মতই ধৈর্যধারণ করেছিল। তারাও আশা করেছিল তাদেরই ভোটে নির্বাচিত সরকার এই সমস্যার মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অক্ষুন্ন রাখার জন্য সশস্ত্র বাহিনী যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এতদিন যাবৎ পালন করে এসেছে তা আপনাদের অজানা নয়। বিগত ৩০শে মে’র পর থেকে আমাকে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য অনেকেই অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পরিস্থিতির নিরিখে হয়ত তখন তা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও আশানুরূপ হত। কিন্তু আপনাদের হয়ত জানা নেই যে সে সব অনুরোধ আমি তখন দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করি। কারণ, আমার বিশ্বাস ছিল আমি নিজ স্থানে বহাল রেখেই ভালভাবে দেশসেবা করতে সক্ষম হব। গণতন্ত্রের মহান মূল্যবোধের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধার কারণে আমি আশা করেছিলাম যে দেশের রাজনীতিবিদগণ, বিশেষভাবে যাঁরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন তাঁরা জাতির এই সংকটকালে উপযুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ করবেন এবং দেশকে অগ্রগতির ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ আমাদের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিসাৎ করে দিল। ক্ষমতাসীনদের হীন স্বার্থান্বেষী কার্যকলাপের ফলে জাতির জীবনে নেমে এল চরম দুর্যোগ—গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে আমাদের সকল প্রচেষ্টা হল নিদারুণভাবে ব্যর্থ। এটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার, কিন্তু তবুও এই পরিস্থিতি ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। এবং এর সমাধান আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। আপনাদের সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সক্রিয় সহযোগিতায় আমরা এই চ্যালেঞ্জকে ইনশাআল্লাহ সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হব। দেশের এই করুণ পরিস্থিতিতে ও সংকটকালে আর আমরা বসে থাকতে পারি না।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের জনৈক বিচারপতি ১৬ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে বলেন যে, ‘সমাজজীবনে আজ এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যে যার যত ক্ষতি করার ক্ষমতা তার ততবেশি প্রতিপত্তি। সমাজে যারা সৎ ও ভাল মানুষ তারা বড় অসহায় অবস্থায় কাল কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। ধীরে ধীরে ভাল মানুষেরা জনজীবন হতে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিচ্ছে, ফলে সমস্ত অসৎ ও দুর্নীতিবাজদের দাপট ও প্রতিপত্তি বেড়েই চলেছে। আজ আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের মূল্যবোধের এমন ভয়াবহ অবক্ষয় ঘটেছে যে সাহসিকতার সঙ্গে এর মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসাবে আমাদের সম্মান বিপন্ন হয়ে পড়বে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, জাতীয় সম্পদ অপচয়ের ও আত্মসাতের কথা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোন সমুচিৎ বিহিত হল না। দুর্নীতির জোয়ারে দেশ ভেসে যাচ্ছে। আর আমরা অসহায়ের মত তাকিয়ে দেখছি, না হয় সে জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিচ্ছি। দুর্নীতির দুষ্টক্ষত সমাজদেহে ক্রমে ক্রমে ক্যান্সারের রূপ নিচ্ছে। এহেন পরিস্থিতি আর চলতে দেয়া যেতে পারে না। এর মোকাবিলা করার জন্য আমরা আজ বদ্ধপরিকর। এহেন অবস্থায় আমাদের দর্শকের ভূমিকা অথবা বুজে থাকা দেশ ও দেশবাসীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
এই প্রসঙ্গে আমি আপনাদের কাছে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করতে চাই, যে আমার কোনদিন কোন রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল না। আমি রাজনীতিবিদ নই, আমি একজন সৈনিক এবং সৈনিকের গর্ব নিয়েই জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই। আমি আপনাদের সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে, আমাদের চরম ও পরম লক্ষ হল দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। তবে তা এমন গণতন্ত্র হতে হবে যা জনগণের ধ্যান-ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তাদের চাহিদা পূরণে সক্ষম। সেটা হবে এমন গণতন্ত্র যার মাধ্যমে জনগণ দেশের সকল কর্মকান্ডে পুরোপুরি এবং কার্যকরভাবে অংশগ্রহণে সক্ষম হবে। এ গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণ এমন একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার লাভ করবে যা হবে একমাত্র তাদেরই হাতে তৈরি তাদেরই জন্য এবং তাদের কল্যাণে নিবেদিত। যদি আমরা সকলে আন্তরিকতার সাথে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি তবে সেই লক্ষ্য অর্জনে বিলম্ব হবে না, ইনশাআল্লাহ। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হবে যত শীঘ্র সম্ভব পরিস্থিতি অনুকূলে এনে দেশে সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে যথাশীঘ্রই সম্ভব দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

প্রিয় দেশবাসী,
এবার আমি সামরিক আইন প্রয়োগ সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। বর্তমান সামরিক শাসন কোন সনাতনী পুরনো ধ্যানধারণার বিধিবদ্ধ সামরিক শাসন নয়। এ সামরিক শাসনের প্রধান উৎস হল দেশের ন’কোটি মানুষ—তাই এর সাথে তাদের ভাগ্যোন্নয়নের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জনগণের তাগিদে প্রবর্তিত এই নতুন ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হল দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার সঠিক প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী এবং শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা।
আপনারা জানেন, বর্তমান রাজনৈতিক দুরবস্থা দূর করতে না পারলে গণতন্ত্রের পথ সুগম ও স্থিতিশীল করা যাবে না। তাই আমাদের লক্ষ্য হল এমন এক সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা যেখানে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশে কোন বাঁধা বিঘ্নের সৃষ্টি না হয়, দেশ ও জাতি যেন বার বার দুর্যোগ ও সংকটে নিপতিত না হয়। বর্তমানের এই প্রকট অর্থনৈতিক সমস্যা যেমন একদিনে সৃষ্টি হয়নি তেমনি এই পর্বতপ্রমাণ সমস্যার কোন তাৎক্ষণিক সমাধানও সম্ভব নয়। সততা, নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম ও দেশপ্রেমের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন ও একটি শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েম করার জন্য এক অর্থনৈতিক বিপ্লব গড়ে তুলতে হবে।
এই নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্য হবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করা, জরুরী ভিত্তিতে খাদ্য সংকট দূর করা, বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানাগুলিকে ব্যবসায়িক ভিত্তিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। এজন্য প্রয়োজন হবে আমাদের কৃচ্ছতা সাধন ও প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করা এবং জাতীয় সম্পদের অপচয় রোধ করা। অর্থনৈতিক অব্যবস্থা ও অপরাধসমূহ সামরিক আইনের আওতায় কঠোর হস্তে দমন করা হবে।
বেসরকারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের বৈপ্লবিক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। শিল্পোন্নয়ন ক্ষেত্রে আমাদেরকে বাস্তবমুখী ও কার্যকর কর্মসূচী গ্রহণ করে বিরামহীন উৎপাদন সুনিশ্চিত করতে হবে। সাথে সাথে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সচেষ্ট হতে হবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির দ্রুত হার আমাদের সকল উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে চলেছে। এই পরিস্থিতিকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করে তোলা হবে আমাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। দেশের বেকার সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে আমাদের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাতে এই বিপুল উদ্বৃত্ত জনশক্তিকে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ডে সফলভাবে নিয়োগ করা যায়। জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখার জন্য সশস্ত্রবাহিনী জনগণের সাথে এই নয়া উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নবদিগন্তের সূচনা করবে।
আমাদের আশু সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান সমস্যা হল দুর্নীতি যা মারাত্মক ক্যান্সার ব্যাধির মত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে সমাজ জীবনকে করে তুলেছে কলুষিত ও বিষাক্ত। এই সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কবল থেকে সমাজকে মুক্ত করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আজ থেকে দুর্নীতিকে জাতীয় শত্রু হিসাবে আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে আমরা সর্বাত্মক জেহাদ ঘোষণা করছি। আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে চাই যে এই জাতীয় শত্রু দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামরিক আইনের সর্বশক্তি নিয়োগ করে সকল শ্রেণীর দুর্নীতিবাজদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই দুর্নীতির শিকড় অত্যন্ত গভীর এবং কায়েমী স্বার্থের মত দুর্নীতির চক্র অত্যন্ত শক্তিশালী। রাজনীতি ও অর্থনীতির উঁচু স্তরের পরাক্রমশালী কায়েমী স্বার্থবাদীরাই এই দুর্নীতির দুর্গ গড়ে তুলেছে বলে এই ঘৃণ্য ব্যাধির ব্যাপকতা এত গভীর। তাই এই মারাত্মক সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রবল গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলে একে সমাজ জীবন থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
রাজনীতি ও শ্রমিক আন্দোলনের নামে দেশে বহু বিক্ষোভ আন্দোলন, ঘেরাও, ধর্মঘট ও হরতাল অনুষ্ঠিত হয়েছে। বলাবাহুল্য, এসব কার্যকলাপ আমাদের মত একটি দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং দেশকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। দেশের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে এসব কার্যকলাপ আর কিছুতেই বরদাশত করা হবে না।
দেশে উৎপাদন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সৃষ্টি হয়েছে এক অচলাবস্থা। তাই এখন থেকে সব ধরনের বিক্ষোভ মূলত এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হল।
প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমাদের আমূল পরিবর্তন সাধন করতে হবে। এমন একটি নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করতে হবে যা হবে জনকল্যাণমুখী এবং যার ফলে প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধান দূর করা সম্ভব হবে। বস্তুত প্রশাসনে গণপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে হবে এবং স্থানীয় প্রশাসনকে এভাবে গণমুখী করে জনগণের প্রকৃত খাদেমরূপে গড়ে তুলতে হবে। এই নয় প্রশাসনকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। প্রশাসন থেকে ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, কর্তব্যের অবহেলা, সম্পদের অপচয় ইত্যাদি সব ধরনের অপরাধ দূর করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও সংস্কারমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে, যাতে করে যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে, কম খরচে জনগণ ন্যায় বিচার লাভে সমর্থ হয়।

আপনারা জানেন, অতীতে ব্যক্তিগত অথবা নিছক রাজনৈতিক কারণে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহকে নির্জীব ও অচল করে তোলা হয়েছিল। এখন থেকে তাদেরকে কোন রকম ভয়ভীতি অথবা আনুকূল্য প্রদর্শন না করে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করে যেতে দেওয়া হবে।
আমাদের সামনে আরো একটি গুরুদায়িত্ব রয়েছে। সেটা হল শিক্ষাঙ্গনকে কলুষমুক্ত করে শিক্ষার পবিত্র পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। আপনারা জানেন অতীতে একশ্রেণীর রাজনীতিবিদগণ তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত করে শিক্ষাঙ্গনের পবিত্র পরিবেশ কলুষিত করতেন। ছাত্র আন্দোলনের নামে এসব কায়েমী স্বার্থবাদীরা শিক্ষাথীদের তাদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাতেন। এর ফলে শিক্ষাঙ্গনগুলি পরিণত হয় এক একটি রণাঙ্গনে—অস্ত্রের ঝনঝনানিতে বিষাক্ত হয়ে ওঠে শিক্ষার মুক্ত ও পবিত্র পরিবেশ। এই পরিস্থিতি জাতির জন্য নিঃসন্দেহে চরম ক্ষতিকর। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি অবিলম্বে যেকোন মূল্যেই হোক শিক্ষাঙ্গনের পবিত্র পরিবেশ ফিরিয়ে আনতেই হবে। শিক্ষার্থীদের তাদের লেখাপড়া করার উপযুক্ত সুযোগ দিয়ে তাদেরকে দেশের যোগ্য সন্তান ও আদর্শ নাগরিকরূপে গড়ে তুলতে হবে। আমি আপনাদেরকে আশ্বাস দিতে চাই যে এ বিষয়ে কোন রকম আপোষ না করে অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

প্রিয় দেশবাসী,
মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ ও অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশের জনগণ ধর্ম বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাধীনতার আদর্শে দীক্ষিত প্রতিটি নাগরিক সেদিন জীবনপণ করে এগিয়ে এসেছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম স্বদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপনারা জানেন শুধুমাত্র একখন্ড জমি অথবা একটি পতাকার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ করা হয়নি। এটা করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে একটি শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যে। আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি, শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য স্বাধীনভাবে লালন করা। আমাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে ধর্মের প্রতিফলন সুনিশ্চিত করাও ছিল এই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য। চরম আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বহনকারী আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা কিছু পাবার আশায় যুদ্ধ করেনি, বরং সবকিছু উজাড় করে দিয়ে একটি সত্যিকারের স্বাধীন ও সার্বভৌম, শক্তিশালী ও আত্মনির্ভরশীল দেশ গঠনের জন্যেই তাঁরা মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে আজ আমাদেরকে নতুন করে শপথ নিতে হবে এবং প্রয়োজন হলে সব রকমের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করতে চাই যে কৃতজ্ঞ জাতি তার বীর সন্তানদের অতি সাধের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে।

প্রিয় দেশবাসী,
আমি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে চাই যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়—এ পররাষ্ট্রনীতিতে আমরা দৃঢ়বিশ্বাসী। সার্বভৌমিক সমতা, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা, সকল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান—এই নীতিমালা হবে আমাদের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ও শুভাকাঙ্ক্ষী সকল রাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উপর আমরা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করি। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা স্থাপনের জন্য মরহুম জিয়াউর রহমান যে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তা বাস্তবায়নে আমরা আমাদের প্রয়াস অব্যাহত রাখব।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতি মূলতঃ জাতিসংঘ সনদ, ইসলামী দেশসমূহের সাথে মৈত্রী এবং তৃতীয় বিশ্ব ও জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহের সাথে পূর্ণ একাত্মতার সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। এই নীতির মূল লক্ষ্য হবে বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ ও সুসংহত করা এবং আমাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা। এই লক্ষ্য ও নীতি অনুসরণ করে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্প্রসারণ করতে আমরা সংকল্পবদ্ধ। আমরা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে সর্বপ্রকার উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ, আগ্রাসন ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমাদের পূর্ণ সমর্থনের কথা পুনঃব্যক্ত করছি।
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেসব চুক্তি ও সমঝোতা রয়েছে তা আমরা মেনে চলবো। ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ও তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের সঙ্গে আমাদের মৈত্রী বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে বলে আমি আস্থা রাখি, আমাদের ফিলিস্তিনী ভাইরা যারা তাদের মাতৃভূমি পুনঃউদ্ধারের জন্য জীবনপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের প্রতি আমাদের অকুন্ঠ সমর্থন অব্যাহত থাকবে। বৃহৎ শক্তিসমূহের সাথেও আমরা আমাদের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। তবে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে একথাও ঘোষণা করতে চাই যে বিদেশী যে কোন রাষ্ট্রের বন্ধুত্বই আমাদের কাম্য—কারো আধিপত্য নয়।

প্রিয় দেশবাসী,
দেশের সাম্প্রতিক অবস্থার একটি চিত্র তুলে ধরা ও আমাদের মূলনীতি ও লক্ষ্য সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করার উদ্দেশ্যেই আমি এতক্ষণ আপনাদের কাছে এই বক্তব্য পেশ করেছি। আমার আরো উদ্দেশ্য ছিল আপনাদেরকে পরিষ্কারভাবে বলা যে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এবং বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার খাতিরেই এই চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে সমগ্র দেশবাসীকে বিশেষভাবে রাজনীতিবিদ, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, সৈনিক, শ্রমিক, সরকারী-বেসরকারী কর্মচারী, ব্যবসায়ী শিল্পপতি, বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাসহ সমাজের সকল শ্রেণীর জনগণের প্রতি আমার আবেদন—আসুন দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করি।
আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ আমাদের এই মহান প্রচেষ্টাকে সাফল্যমন্ডিত করে তুলবে। সামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ এবং সশস্ত্র ও আধা সশস্ত্রবাহিনীর সকল সদস্যগণের প্রতি আমার আবেদন আপনারা আপনাদের এই মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য নিরপেক্ষতা, সততা, ন্যায় নিষ্ঠা ও বিশ্বস্থতার সাথে আপোষহীনভাবে পালন করুন। সমগ্র জাতি আজ আপনাদের দিকে চেয়ে আছে। আপনাদের কাজের উপর নির্ভর করছে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
আসুন আমরা পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা জানাই, যাতে করে আমরা এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একটি শক্তিশালী আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত হতে পারি এবং যত শীঘ্র সম্ভব একটি পূর্ণগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে পারি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সহায় হউন। খোদা হাফেজ।
বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
০০০

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1982.03.26-bichitra.pdf” title=”1982.03.26 bichitra”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!