জিয়াকে নিয়ে কিছু স্মৃতি কিছু কথা | হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১০ জুলাই ১৯৮১
১৯৭২ সাল। স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাস পরের কথা। কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকা কর্তৃপক্ষ একটি সুদৃশ্য সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করলেন। নাম—‘বাংলা নামে দেশ’।
এই বইটি একটি নিপীড়িত জাতির মুক্তি সংগ্রামের প্রতি মুহূর্তের অন্তরঙ্গ দলিল। বহু অজ্ঞাত তথ্যে সমৃদ্ধ….। হ্যাঁ, ‘বাংলা নামে দেশ’ গ্রন্থের পরিচিতি পত্রে অনেক কথার মাঝে লেখা ছিল এসব কথা। কিন্তু, ‘আনন্দবাজারী’ আলখেল্লায় মোড়ানো এই গ্রন্থের অনেক তথ্যই ছিল অপূর্ণ, অর্ধসত্য এমনকি ডাহা মিথ্যে। বইটি পড়লে একটি কথাই মনে হবে তা হলো স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা ছিল গৌণ।
গ্রন্থটি হাতে পাওয়ার পর দৈনিক বাংলা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলেন এর জবাব হিসেবে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ বাহিনীর রণ-কৌশল ও অপারেশন যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। ১৯৭২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর প্রতিদিন দৈনিক বাংলার শেষের পাতায় এসব প্রতিবেদন ছাপা হবে। পুরো পাতা জুড়েই থাকবে প্রতিবেদন। জেনারেল ওসমানী, জেড ফোর্স, এস ফোর্স; কে ফোর্সের তিন অধিনায়ক; বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডার ও বিশিষ্টি মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার।
এই পুরো কাজের দায়িত্ব দেয়া হলো আমাকে। অর্থাৎ ইন্টারভিউ নেয়া এবং প্রতিবেদন লেখার দায়িত্ব।
নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের এক সন্ধ্যা। ইন্টারভিউ নেয়ার জন্যে জেড ফোর্সের যুদ্ধকালিন অধিনায়ক জিয়াউর রহমানের ক্যান্টনমেন্টের বাসায় গেলাম। এতেই এপয়েন্টমন্ট করা ছিল। আমার সঙ্গে ছিলেন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ দপ্তরের (আই এস পি আর) পরিচালক জনাব জাহিদ হোসেন। ড্রইং রুমে সেই সন্ধ্যায় বসা ছিলেন জিয়া সাহেবের বন্ধু ও মুক্তি সংগ্রামের একজন বিখ্যাত সমর-নায়ক ও আরও কয়েকজন। আমি বসতেই সেই সমর-নায়ক বললেন,—গেট দ্য দ্য ইন্টারভিউ। ক্যারি অন চাম্। চলে গেলেন তিনি। চা এলো। খানিকক্ষণ গল্প গুজব হলো। তারপর আমি আমার টেপ-রেকর্ডার আর নোট খাতা খুলে বসালাম। জিয়া সাহেব ইন্টারভিউ দেয়া শুরু করলেন। মিনিট পাঁচেকও বোধহয় যায়নি। এমন সময় একটি টেলিফোন এলো। জিয়া সাহেবের ফোন। ফোনে কথা সেরে ফিরে এলেন মুখ গম্ভীর। বললেন,—অব দ্য রেকর্ড। ফোন এসেছে। স্যরি আমার পক্ষে আর এখন ইন্টারভিউ দেয়া সম্ভব নয়।
বেশ অস্থির এবং ক্ষুব্ধ মনে হচ্ছিল জিয়া সাহেবকে। আমি আর জাহিদ বিমূঢ়। খানিক পর আমি বললাম, আমাদের পাঠকরা তো ভাববে আমি আপনার ইন্টারভিউ নিতে পারিনি। কি জানি, অফিসও হয়তো বিশ্বাস করবে না। আপনি ব্যাপারটা টেলিফোনে না হয় তারা ভাইকে বলুন।
জনাব ফওজুল করিম—তারা ভাই। জিয়া সাহেবের আপন চাচাত ভাই। দৈনিক বাংলার বার্তা-সম্পাদক। জিয়া সাহেব বললেন, ঠিক আছে আপনিও চলুন। ফোন করছি।
ফোন করলেন। বললেন, তারা ভাই, আমি কমল বলছি। শুরু করেছিলাম; কিন্তু ইন্টারভিউ দেয়া সম্ভব হলো না। মোরশেদ সাহেব আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। সব পরে শুনবেন। রাখি। খোদা হাফেজ।
ড্রইং রুমে ফিরে আসার পরেও বেশ কিছুক্ষণ তাঁর মুখে কোন কথা নেই। এক অস্বস্তিকর নীরবতা। এক সময় জাহিদ বললেন, স্যার, আমরা এবার আসি। জিয়া সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। গার্ড হাউস পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এলেন। যুদ্ধের সময় যে জীপটি তিনি ব্যবহার করতেন সেটি তখনও তাঁর ব্যবহারেই ছিল। সেই জীপে আমরা উঠলাম। ফিরে আসার আগে তিনি বললেন, ওকে, ইটস পার্ট অব দ্য লাইফ। ফরগেট ইট। খোদা হাফেজ। আমার তখন মনে হচ্ছিল তাঁর চোখ কি ভেজা? নাকি শাণিত?
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এটি ছিল আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। এর আগে একাত্তর সালে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বিমান বাহিনীর অফিসার্স মেসে এয়ার ভাইস মার্শাল মরহুম এম কে বাশারের সঙ্গে প্রথম আমি তাঁকে দেখি। আমি ও কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক সেখানে গিয়েছিলাম। বাশার সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন,—ইনি-ই সেই জিয়া। সেই প্রথম দর্শনে আমার মনে হয়েছিল ভদ্রলোক অর্থাৎ জিয়া সাহেব বোধ হয় খুব লাজুক। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষক, জেড ফোর্সের অধিনায়ক জিয়াকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম আমার কল্পনার সঙ্গে। কথা বলছেন মৃদুস্বরে। কান পেতে না শুনলে অনেক কথা ঠিক বোঝাও যায় না। তাছাড়া কথাও বলছিলেন খুব কম। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের আগে যারা জিয়া সাহেবকে দেখেছেন তারা আমার এই কথায় সায় দেবেন।
এক সময় আমি বললাম, দৈনিক বাংলা পত্রিকায় আমি ঢাকার গেরিলা অপারেশন সম্পর্কে ধারাবাহিক স্টোরি লিখছি। আমি এরপর আপনার একটি ইন্টারভিউ পত্রিকার জন্যে নিতে চাই। দেবেন?
আবার সেই মৃদু হাসি। বললেন, প্রেসিডেন্ট ফিরে আসুন। তারপর দেখা যাবে।
বললাম, আপনি যুদ্ধের কাহিনী লিখুন। লিখে রাখা দরকার।
বললেন, একদিন আসুন। আমার ডায়েরী দেখাব। পুরনো ঘটনাগুলো কিছু কিছু টুকে রেখেছি। এখনও লিখছি।
প্রধান সামরিক প্রশাসক হওয়ার আগে বেশ কয়েকবার তিনি তাঁর বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। জনাব ফওজুল করিমের কাছেও দু-একবার বলেছেন। কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি। পরে এক সময় এ প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বলেছিলেন, আপনাদের অনেকেই বড় ফাঁকিবাজ। কথার কোন দাম নেই।
এসব ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের আগের কথা। পরে যখন তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট হলেন তখন আর বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ আসেনি। তাঁর ভূবনের দিগন্ত তখন ক্রমশঃ প্রসারিত হচ্ছে। সংগত কারণেই তাঁর আগের সেই ঘরোয়া অন্তরঙ্গতার জের জেনে চলা সম্ভব নয়। শুনতাম আত্মীয়-স্বজনেরাও তাঁর বাসায় পারতপক্ষে যান না, কারণ তিনি বিব্রত বোধ করেন। পার্বণে বা বিশেষ কোন অনুষ্ঠান হলেই আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত হয়, কিন্তু তা-ও নিশ্চিত নয়। কিন্তু একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে যতটুকু অন্তরঙ্গতা শোভন সান্নিধ্য সহৃদয়তা ও ভালবাসা পাওয়া সম্ভব আমি প্রেসিডেন্ট জিয়ার কাছ থেকে বেশি ছাড়া কম পাইনি। আমার আজ সব সময় মনে হয়—আমার একজন বড় শুভাকাঙ্ক্ষী আজ আর নেই।
তাঁর রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কভার করেছি। অনেক তথ্যই পত্রিকার পাতায় আমি সঙ্গত কারণেই তুলে ধরতে পারিনি। সম্ভব ছিল না, আজও সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালের ১৯ কিংবা ২০ ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় ফিরে এসে কয়েকদিন মগবাজার এলাকায় এক বাড়িতে ছিলেন। দু-একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তখন তাঁর খোঁজখবর নিতে দেখেছি। তাদের একজন হলেন বিচিত্রার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী। জিয়া সাহেবের সঙ্গে তাদের আলাপ আগে থেকেই ছিল।
ঢাকায় আসার কিছুদিনের মধ্যে জিয়া সাহেবকে কুমিল্লা বদলী করা হলো। শুনেছি রণাঙ্গনে থাকতেই ১৬ ডিসেম্বরের আগে শফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান; খালেদ মোশাররফ সাহেবের পোস্টিং ঠিক করা হয়েছিল। জানি না এই তথ্য সত্যি কিনা। এও জানি না, সেদিন সে মুহূর্তে এই স্থানান্তরের পেছনে শক্তিশালী কারো মেজাজ-মর্জি কাজ করেছিল কিনা। কিন্তু তাঁর যারা ঘনিষ্ঠজন তারা অনেকেই জানেন, জিয়া সাহেব এই বদলীর ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন নি। কারণ তিনি ছিলেন এদের মধ্যে সবচে সিনিয়র।
[দুই]
আমার এই লেখা নিছক স্মৃতিচারণ। জিয়া সাহেবের রাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতির কোন মূল্যায়ন নয়। সেই প্রচেষ্টাও আমার এই লেখায় গরহাজির। এদেশের রাষ্ট্রীয় ও রাজনীতির ভূবনে বিপুল সুকৃতির দৃষ্টান্ত যিনি রেখে গেছেন, যিনি এই বাংলাদেশের মাটিতে লালিত এক খাঁটি বাংলাদেশী হিসেবে বাঁচতে চেয়েছেন, যিনি ছিলেন এদেশের একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত অথচ চরিত্রে যাঁর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অপ্রার্থিত সুবিধাভোগী বৈশিষ্ট্যকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন সেই মহৎ প্রাণ মানুষটিকে আমি খোলা চোখে যেভাবে দেখেছি তারই কিছু স্মৃতি কিছু কথা আমি তুলে ধরেছি। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক জীবনের এমন বহু অন্তরঙ্গ ঘটনা রয়েছে যার পুরো স্মৃতিচারণ এই মুহূর্তে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই স্মৃতিচারণও সম্পূর্ণ ও সমগ্র নয় :-
[ক]
ঢাকার বাইরে তাঁকে পাওয়া, তার সঙ্গে কথা বলা একজন সাংবাদিকের কাছে ঢাকার চেয়ে অনেক সহজ ছিল। ঢাকায় যেখানে প্রটোকল ও নিরাপত্তার নানা ঝামেলা এবং বঙ্গভবনের দরজা পেরিয়ে তার দেখা পাওয়া ছিল অনেকটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সেখানে ঢাকার বাইরে যখনই ছিল তিনি গেছেন লক্ষ্য করেছি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে তিনি উদগ্রীব থাকেন। তিনি চাইতেন সাংবাদিকরা তাঁর সঙ্গে এসে কথা বলুক। অনেক সময় অনুযোগ করতেন যে, সাংবাদিকরা তাঁর কাছে এসে বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইছেন না কেন? অনেক সময় বলতেন, কি ব্যাপার পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান কেন? আবার বলতেন আরে ভাই, আমার বক্তৃতা আর কত নোট করবেন? লোকজনের সঙ্গে মিশুন, কথা বলুন, তাদের রিএ্যাকশনের কথা লিখুন। ফিড ব্যাক দরকার। মাঝে মাঝে একটু খারাপও লাগতো। মনে হতো, তিনি কি আমাদের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের লোক মনে করছেন? পরে আবার মনে হতো, না আন্তরিকভাবেই তিনি এসব কথা জানতে চাইছেন। তাঁর সঙ্গে বাইরে এ্যাসাইনমেন্টে গেলে প্রায়ই একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হতো। সাংবাদিকদের কাছে পেলেই তিনি পাল্টা জেরা করতেন। নানা কথা জানতে চাইতেন। লক্ষ্য একটি—লোকে কি ভাবছে তা জানা।
১৯৭৭ সালে জানুয়ারী মাসে জিয়াউর রহমান গ্রামের পর গ্রাম পায়ে হেঁটে জন-সংযোগ সফর প্রথম শুরু করেন। সে বছর ২৪শে জানুয়ারী তিনি সিলেটে হাওড় এলাকায় একদিনে ৯ মাইল পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। দেড় মাস পর ১৯৭৭ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী শুরু হলো পর পর তিন দিন পায়ে হেঁটে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন গ্রামে ৩২ মাইল সফর। তিনি তখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। এদেশে কোন রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনীতিবিদ এমনিভাবে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে কোনদিন বেড়াননি।
১৫ ফেব্রুয়ারী সকালে পদ্মার পাড়ে গঙ্গা কপোতাক্ষ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাধানের পথ খুঁজে বের করা ও পন্থা নির্দেশের কাজও বের করা। এর উদ্দেশ্য ছিল—জনগণের সঙ্গে সরকারের প্রকল্পের ইনটেক চ্যানেল এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করা। তারপর কখনো ক্ষেতের আইল ধরে, কখনো ইউনিয়ন বোর্ডের সড়ক বেয়ে মাইলের পর মাইল পথ চলা। সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা রয়েছেন. বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কর্মকর্তা রয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে সংখ্যায় তাঁর সঙ্গী হিসেবে যারা বেশি তারা হলো গ্রামের লোকজন।
প্রথম দিনে নানা জায়গায় সভা করে, লোকজনের খবর জেনে বারো মাইল পথ চলার পর রাতের জন্য যাত্রা বিরতি হলো মীরপুর থানা সদরে। সন্ধ্যার পর আমাদের সাংবাদিকদের কারো কারো ইচ্ছে ছিল কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে গিয়ে রাত কাটানো। তাছাড়া, ঢাকায় স্টোরিও পাঠাতে হবে। কিন্তু মীরপুর পৌঁছেই কর্নেল ওয়ালী খবর দিলেন, সন্ধ্যার পর জিয়া সাহেব সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করবেন।
মাগরেবের নামাজ পড়ে জিয়া সাহেব এলেন। মীরপুর থানা সদরের একটি সরকারী মিলনায়তনে আমরা সবাই জড়ো হয়েছি। জিয়া সাহেব এসে তাঁর পার্সোনাল স্টাফদের বললেন, আপনারা সবাই বাইরে চলে যান আর দরজাগুলো বন্ধ করে দিন।
আলাপ আলোচনা শুরু হলো। প্রথমেই তিনি বললেন, আমার চেয়ে আপনারা অনেক বেশি জানেন। আমার বক্তৃতার জন্যে কিছু পয়েন্টস দিন। লোকে এই দেশ সম্পর্কে কি ভাবছে, তারা কি চায়, সমস্যা কি তা আমার জানা দরকার। আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে রেডিও বাংলাদেশের এক সাংবাদিক বন্ধু হঠাৎ বলে বসলেন, স্যার গ্রামের লোকেরা বলছিল রাজা আমাদের বাড়ির উঠান দিয়ে হেঁটে গেছেন। জিয়া সাহেব কথাটি শুনে খুশী হওয়ার বদলে ক্ষুব্ধ হলেন। বললেন, কলোনিয়াল আউটলুক আপনাদেরও বদলাতে হবে। রাজা ফাজা আর দেশের বাবা-চাচার দিন ফুরিয়ে গেছে। আসলে ব্যাপার কি জানেন, যে সব গ্রামে এস ডি ও বা সি ও সাহেবরা বছরে একবার এসব গ্রামে আসেন না। তাই গ্রামের লোকজন খুব খুশী হয়েছে। গ্রামে আমাদের সবাইকে আসতে হবে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কখনো কখনো হালকা রসিকতা করে তিনি রীতিমত বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিতেন। একবার ক্যান্টনমেন্ট গলফ ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক চা চক্রে তিনি হঠাৎ একজনকে বলে বসলেন, ঠিক আছে আপনি বরঞ্চ লোন নিয়ে একটা ট্রলার কিনে ফেলুন। ব্যবসা আপনি ভালই করবেন। সেই সাংবাদিক ভদ্রলোক জিয়া সাহেবের সঙ্গে সারাক্ষণ কেবল ব্যবসা আর পারমিট ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা তুলেছিলেন।
ঢাকার এক সংবাদ সংস্থার এক সাংবাদিক বন্ধু তাঁর সঙ্গে প্রায়ই এ্যাসাইনমেন্টে যেতেন। কোন একবার আলাপ-আলোচনার সময় তিনি বোধহয় জিয়া সাহেবকে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছিলেন। জিয়া সাহেব বোধহয় বলেছিলেন—আপনি আমাকে এসব বক্তব্য লিখিতভাবে দিন। কিন্তু সেই সাংবাদিক বন্ধুটি আর দেননি। তারপর দেখা হলেই জিয়া সাহেব তাঁকে বলতেন, কি ভাই আপনার সেই ইকনোমিক্সের ওপর রিসার্চ পেপারটা আমাকে দিলেন না?
[খ]
১৯৮০ সালের ১লা এপ্রিল ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর মোট ২৬ জন সাংবাদিককে নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া কক্সবাজার গেলেন। বিকেলে আমরা সবাই কক্সবাজার পৌঁছলাম। কেন এলাম, হঠাৎ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এতজন সাংবাদিককে কেন আনা হলো কিছুই জানি না। কক্সবাজার পৌঁছে শুনলাম, পরদিন সকালে আমাদের পাতলী খাল দেখাতে নিয়ে যাওয়া হবে। বিদেশের যত ডিগনেটরী আসতেন, তাদের প্রায় সবাইকেই এক পাতলী খাল দেখাতে নিয়ে আসা হতো। কয়েক মাস আগে নেপালের রাজা বীরেন্দ্রও এই খাল দেখে গেছেন। প্রোগ্রাম শুনলাম সন্ধ্যার পর সাগরিকা হোটেলে সবাই মিলে বাংলা ছায়াছিবি দি ফাদার দেখবো। তারপর নৈশাহার ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গল্প-গুজব। প্রোগ্রাম শুনে সত্যি বলতে কি আমরা সবাই খুব অবাক হলাম। শুধু এই জন্যেই প্রেসিডেন্ট এসেছেন। বিশ্বাস হয় না। তাছাড়া নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম এ খানকেও যে মোটেল উপল-এ দেখেছি। সাংবাদিকের চোখ আর নাসিকা তৎপর হয়ে উঠল।
সন্ধ্যার পর ছবি দেখলাম। দেখা শেষ হলে সবাই এলাম খাওয়ার টেবিলে। প্রেসিডেন্ট সাহেব ও সাংবাদিকরা এক টেবিলে বসেছি। প্রেসিডেন্ট সাহেব প্রথমেই দেশের চলচ্চিত্র শিল্প, তার কাহিনী সঙ্গীত এবং পুরো নির্মাণধারা সম্পর্কে কথা বললেন। একজন চলচ্চিত্র সমালোচকের মতো তিনি কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় সম্পর্কেও কথা বললেন। চলচ্চিত্র থেকে আলোচনা গড়ালো টেলিভিশন অনুষ্ঠান, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন-বন্টন. খাল-খনন কর্মসূচী ইত্যাদি নানা বিষয়ে। এক সময়ে দেখা গেল, ঢাকার একটি নামকরা পত্রিকার চট্টগ্রামস্থ প্রতিনিধি আবার সেই এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট, ইনডেন্টিং ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। চুপ করে সেই ভদ্রলোকের একটানা কথাবার্তা খানিকক্ষণ শুনছেন জিয়া সাহেব। হঠাৎ তিনি বলে বসলেন, আমাদের প্রব্লেম কি জানেন—আমাদের অনেকেই ফার্টাইল ব্রেন রয়েছে কিন্তু তারা নানা দিক চিন্তা করে তার বড় অপচয় করেন। এরপর পরই ঢাকার একটি ছোট-খাট দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক দৈনিক বাংলার কয়েকজন সাংবাদিকের নামে হঠাৎ প্রেসিডেন্ট সাহেবের কাছে বিষোদগার শুরু করলেন। প্রেসিডেন্ট সাহেব কোন মন্তব্য করলেন না। কিন্তু আমরা ঢাকার যারা ছিলাম তারা বিলক্ষণ ক্ষুব্ধ হলাম। সম্পাদক ভদ্রলোক তা টেরও পেলেন। রাতে মোটেলে তার উপর চড়াও হতে পারি ভেবে বেশ ভয়ে ভয়েই ছিলেন। রাতে চড়াও-ও হয়েছিলাম। পরদিন সকালে আমরা সবাই যখন পাতলী খাল দেখতে গেছি তখন এক ফাঁকে প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাদের দু’-একজনকে কাছে পেয়ে বললেন, কি ব্যাপার? রাতে কি হয়েছিল? আমি সব খবরই রাখি। আপনারা মাঝে মাঝে বড় সেন্টিমেন্টাল হয়ে যান।
খাল দেখে আমরা আবার বিমানে চেপে ঢাকায় ফিরছি। প্রেসিডেন্ট সাহেবের আসনের ঠিক সামনেই ডান পাশে আমার আসন। বিমানে উঠেই তিনি বললেন, মোরশেদ সাহেব সব সময়ই তো আমারই ইন্টারভিউ নেন। আজ আপনার ইন্টারভিউ নেবো। আমার এখানে এসে বসুন। বসলাম। ঠিক ডান পাশের আসনে মন্ত্রী জনাব হাবিবুল্লাহ খান এবং তথ্য উপদেষ্টা জনাব দাউদ খান মজলিশ বসা। ঠিক সামনের আসনে তথ্য সচিব জনাব খোরশেদ আলম। প্রেসিডেন্ট সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এই খাল কাটা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? আমার যা অভিমত বললাম। জিয়া সাহেব বললেন, অযথা আপনারা বিবেকের ওপর পাথর চাপা দিয়ে রাখবেন না। তাতে আমাদের সবারই ক্ষতি হবে।
কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করে বসলেন, আপনি কত বেতন পান? আমি জানালাম। জনাব শুনে তিনি বললেন, আপনি তো আমার চেয়ে বেশি বেতন পান। আমি বললাম, কিন্তু সব মিলিয়ে আপনার চেয়ে তো একশ গুণ কম সুযোগ-সুবিধা পাই। বলেই ভাবলাম বোধহয় রেগে যাবেন। কিন্তু না, তখন তিনি মিটিমিটি হাসছেন। তাঁর কাছ থেকে সরে আসার জন্য আমি একটি বাহানা খুঁজে বের করলাম। বললাম, ঢাকার ওমুক দৈনিক পত্রিকার ঐ সাংবাদিক বন্ধুটি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চান। তিনি বললেন, ঠিক আছে তাঁকে ডেকে আনুন।
ডেকে আনলাম। তিনি পাশের আসনে বসলেন। আমি আমার আসনে ফিরে গেলাম। বসেই সেই সাংবাদিক বন্ধুটি রীতিমত ফরমান ইন্টারভিউ-এর মতো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। কি আর করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। ডেকে এনে কাজে বসিয়েছেন। জবাব তো দিতেই হবে। জবাব দিচ্ছেন। আমরাও যতটা সম্ভব কান পেতে শোনার চেষ্টা করছি। পরদিন সেই পত্রিাকয় প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ-র একটি স্টোরি বেরলো। ফার্স্ট লীড। বক্তব্য আংশিক এসেছে কি পুরো এসেছে সেই তর্কে আমি যেতে চাই না। তবে স্টোরিটি সে সময় দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল।
[গ]
১৯৭৮ সালের কথা। নদী ও সড়ক পথে এক নাগাড়ে তিন দিন চার দিন করে প্রেসিডেন্ট জিয়া উপকূল এলাকা সফর করছেন। কোন রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজনীতিকের এ ধরনের এমনি সফর এটাই ছিল প্রথম। সফরের এক পর্যায়ে এক শেষ বিকালে তিনি ও আমরা গেলাম সন্দ্বীপ। এই দ্বীপটিতে বড় রাস্তা বলতে একটি। যান-বাহনও তেমন নেই। সফরের প্রয়োজনে দু-তিনটি মিনি জীপ গাধা-বোটে করে সেদিন সকালে সন্দ্বীপ আনা হয়েছে। লঞ্চঘাটে একটি সুন্দর তোরণ। প্রেসিডেন্ট সাহেব নেমে জীপে চেপে চলে গেলেন। সেই জীপ ফিরে আসার জন্যে আমরা সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছি। এমন সময় দেখলাম কয়েকজন লোক সেই তোরণটিকে আলী আলী বলে মাটি থেকে কাঁধে তুলে রওয়ানা দিলেন। আমরা হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছি। পরদিন সকালে সদ্বীপের এক ময়দানে জনসভা। আমরা একটু আগে ভাগেই গেছি। এমন সময় দেখি কয়েকজন লোক কাঁধে করে সেই তোরণটি নিয়ে এলেন এবং ময়দানের প্রবেশ পথে গর্ত খুঁড়ে দাঁড় করালেন। রাতে এই তোরণটি ছিল প্রেসিডেন্ট সাহেব যেখানে ছিলেন তার প্রবেশ পথে। সভা শুরু হলো। প্রেসিডেন্ট সাহেব বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়েই প্রথমে বললেন, আল্লাহতালা সংযমীদের ভালবাসেন। যারা অহেতুক অপচয় করেন তাদের পছন্দ করেন না। আল্লাহর এক বান্দা হিসেবে আমি সত্যি খুব খুশী হয়েছি যে, আপনারা একটি গেট বানিয়ে দিয়ে তিন জায়গায় কাজ সারলেন। গেট না হলেই বেশি ভাল হতো। অযথা তোরণ বানাবেন না, এগুলো অপব্যয়।
[ঘ]
টেনশনে থাকলে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মাঝে মাঝে সিগারেট খাওয়ার দারুণ তেষ্টা পেতো। একদা তিনি কাঁটা চামচ দিয়ে কই মাছ খেতেন বলে শুনেছি। সিগারেটও খেতেন নাকি বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে। কিন্তু পরে এসব অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ যে বললাম, টেনশন চাপলেই সিগারেটের তৃষ্ণা পেতো। ঢাকার বাইরে খুলনা কিংবা কুষ্টিয়ার কথা। ঢাকায় স্টোরি পাঠিয়ে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু আড্ডা মারছি। রাত তখন প্রায় দেড়টা। একই সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট সাহেবও রয়েছেন। সেই রাত দুপুরে প্রেসিডেন্ট সাহেবের এক পার্সোনাল স্টাফ আমাদের রুমে এসে হাজির। বললেন, আপনাদের কারো কাছে কয়েক স্টিক সিগারেট হবে? প্রেসিডেন্ট সাহেব খোঁজ নিতে বললেন। এত রাতে তো দোকান-পাটও বন্ধ হয়ে গেছে।
আমাদের এক বন্ধুর কাছে ছিল স্টার সিগারেটের পুরো একটি প্যাকেট। তিনি বললেন, এই ব্র্যান্ডে চলবে? পার্সোনাল স্টাফ সায় দিলেন। সিগারেটের প্যাকেটটি নিয়ে গেলেন। একটু পরেই আবার ফিরে আসলেন। হাতে প্যাকেটটি। বললেন, স্যার খুব খুশী! আপনার সারা রাত চলবে কি করে? তাই এই পাঁচটি সিগারেট আপনাকে দিয়েছেন।
টেনশন থাক বা নাই থাক প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাফারী আর স্যুটের পকেটে সব সময় কিছু না কিছু ওষুধ থাকতো। আর থাকতো লবঙ্গ। খানিক পর পরই লবঙ্গ মুখে দিতেন। আর দিনে রাতে কয়েকবার মুখে পুরে দিতেন স্ট্রেপসিল। একবার আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলছি। শরীর ভাল লাগছিল না। জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? বললাম। পকেট থেকে একটি ছোট্ট সাদা ট্যাবলেট বের করে দিয়ে বললেন, সোডামিন্ট ট্যাবলেট। এক ঢোক পানি দিয়ে খেয়ে নিন। ভাল হয়ে যাবেন।
লবঙ্গ প্রসঙ্গে একদিনের কথা মনে পড়ছে। রংপুর, বগুড়ায় সফর শেষে ঢাকা ফিরছি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। নগরবাড়ী থেকে ফেরীতে ওঠার পর লাউঞ্জে বসে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন। জাহাজের একজন ওয়েটারকে ডেকে বললেন, লং এলাচ আছে ভাই? দু-একটা দেবেন?
একটি কোয়ার্টার প্লেটে করে গোটা দু-এক লবঙ্গ এবং একটি ছোট্ট এলাচ ওয়েটারটি নিয়ে এলেন। প্রেসিডেন্ট বললেন, আর নেই? ওয়েটার বললেন, স্যার জিনিসপত্রের যা দাম এটুক দেওনই মুশকিল। প্রেসিডেন্ট সাহেব আর কোন কথা বললেন না। মুখে সেই মিটি মিটি হাসি।
[ঙ]
ঢাকার বাইরে যখন তিনি ট্যুরে যেতেন তখন শুনেছি তিনি কোন টি এ ডি এ নিতেন না। সার্কিট হাউসের ভাড়াও নিজের পকেট থেকে দিতেন বলে শুনেছি। সফর উপলক্ষে ঢাকার বাইরে এক সার্কিট হাউসে রাত কাটালেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। একই সার্কিট হাউসে সাংবাদিকরাও রয়েছেন। সকালে ঢাকায় ফিরে আসব। গোছ-গাছ চলছে। এমন সময় প্রেসিডেন্টের একজন পার্সোনাল স্টাফ এসে বললেন, আপনাদের কারো কাছে বাড়তি টাকা আছে? বিল দিতে হবে। প্রেসিডেন্ট সাহেবের টাকা কম পড়েছে। ঢাকা ফিরেই তিনি টাকা শোধ করে দেবেন। এনার এক সাংবাদিক বন্ধু দেড়শ’ টাকা প্রেসিডেন্ট সাহেবকে ধার দিলেন। ঢাকায় ফিরে জিয়া সাহেব সেই টাকা শোধ করেছিলেন।
[চ]
বাইরে খুব ফিটফাট পোশাকে থাকতেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। আমার চোখে প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন টিপ-টপ পোশাক পরিহিত একজন স্মার্ট লোক। এবং সুন্দর পোশাক পরা স্মার্ট লোককেও তিনি খুব পছন্দ করতেন। ১৯৭৭ সালে বঙ্গভবনে একুশে পদক বিতরণী অনুষ্ঠানের কথা। অনুষ্ঠানের শেষে চা চক্র। সেবারের অন্যতম পদক বিজয়ী কবি শামসুর রাহমান এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে জিয়া সাহেব আলাপ করছেন। শামসুর রাহমানের পরনে একটি সুন্দর কাটের সুন্দর লাউঞ্জ স্যুট। সঙ্গে ম্যাচ করা সুন্দর টাই। হঠাৎ জিয়া সাহেব তাঁকে বললেন, আপনার স্যুটটা খুব সুন্দর। কবি হলেই যে ঢলঢলে পায়জামা-পাঞ্জাবী পরতে হবে এর কোন মানে নেই।
অপরের সুন্দর পোশাকের প্রতিও তার দারুণ কৌতুহল ছিল। অনেক সময় একে মনে হতো নিষ্পাপ ছেলেমানুষি কৌতুহল। কারো গায়ে সুন্দর জামা বা পরনে সুন্দর টাই দেখলে তিনি অনেক সময়ই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খোঁজ নিতেন। কোন দোকান থেকে কিনেছেন, কত দাম পড়ল কোন টেইলর বানিয়েছে ইত্যাদি। অন্যদের খবর জানি না তবে সাংবাদিকদের বেলায় এরকম বহুবার ঘটেছে। ৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সময়কার কথা। পুরনো গণভবন প্রাঙ্গণে জিয়ার সাংবাদিক সম্মেলন। সম্মেলন শেষে সবাই চা খাচ্ছি। চায়ের পেয়ালা হাতে জিয়া সাহেব সাংবাদিকদের জটলার কাছে নিজেই চলে এলেন। বন্ধু গিয়াস কামাল চৌধুরীর পরনে সেদিন ছিল একটি সুন্দর শার্ট। বুকে সুন্দর একটি মনোগ্রাম। হঠাৎ মনে হয়, দুটি ধানের শীষ যেন পাশাপাশি রয়েছে। রাজনৈতিক কোন আলোচনা না তুলে হঠাৎ বললেন, গিয়াস সাহেবের শার্টটাতো ভারী সুন্দর। কোত্থেকে কিনেছেন? দোকান থেকে না দর্জি দিয়ে বানিয়েছেন? বুকে দেখি দুটো আবার ধানের শীষ।
পাশে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার পরনে সেদিন ছিল প্রিন্টের একটি শার্ট। হঠাৎ আমার শার্টের এক কোণা ধরে পোশাকের ব্যাপারে কখনো কখনো তাঁর কথায় বিড়ম্বনাও বোধ করেছি। মাঝে মাঝে খারাপও লাগতো। যেমন অনেক সময় আমাদের পরনে সুন্দর স্যুট বা জামা দেখলে বলতেন, দেখুন তো দিনকাল এখন কত ভাল আপনাদের। সুন্দর সুন্দর স্যুট পরছেন।
পোশাক সম্পর্কে মোজার কথা মনে পড়লো। সে এক দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। কুষ্টিয়ায় তিন দিনের পদযাত্রা প্রথম দিনেই আমাদের কয়েকজনের পায়ে ফোস্কা পড়ে গেল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি দেখে প্রেসিডেন্ট বললেন, মোজা পরার নিয়ম আছে শোনেন। প্রথমে একবার সাবান দিয়ে মোজা ধুয়ে ফেলবেন। তারপর আবার সাবান লাগিয়ে অমনিভাবেই শুকাতে দেবেন। দেখবেন মোজা বেশ গ্লসি হয়ে গেছে। তখন আর ফোস্কা পড়বে না। এটা হলো আর্মির নিয়ম।
আমাদের কেউ কেউ সে রাতে অমনিভাবে সাবান লাগিয়ে মোজা শুকালাম। পরের দিন সেই মোজা পায়ে দিয়ে আবার মাইলের পর মাইল হেঁটে চলা। কয়েক মাইল চলার পরেই অনেকের মাথার তালু দিয়ে ঘাম বেরনো শুরু করলো। পা গরম সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। জিয়া সাহেব নিজেই এক সময় জিজ্ঞেস করলেন, মোজায় সাবান দিয়েছেন? সব শুনে হেসে ফেললেন। বললেন অভ্যাস নেই তো তাই তালু দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ঠিক হয়ে যাবে।
[ছ]
জনসভা ছাড়াও প্রেসিডেন্ট জিয়া ঢাকার বাইরে তাঁর প্রত্যেকটি সফরের সময় ক্রস-সেকশন পিপল অর্থাৎ সর্বস্তরের জনসাধারণের সঙ্গে সমাবেশে মিলিত হতেন। একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের এমনি ধরনের অনেক সমাবেশ কভার করেছি। কিন্তু জিয়া সাহেবের এ ধরনের সাক্ষাৎকার সমাবেশ ছিল পুরোপুরি আলাদা ধরনের। সবাইকে নিয়ে বসতেন। এলাকার সমস্যাবলী এবং তার সম্ভাব্য সমাধান ও পথ-নির্দেশ সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করতেন। সেই আলোচনায় যদি কেউ প্রতিবাদী কোন বক্তব্য রাখতে চাইতেন তাও খোলামেলাভাবেই রাখতে পারতেন। আলোচনা বৈঠকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার কথা জিয়া সাহেব জানিয়ে দিতেন। যাকে বলে অন দ্য স্পট ডিসিশন। ১৯৭৭-৭৮ সালে দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইম-এ আমি ও বন্ধু আলমগীর মহিউদ্দিন এই সমাবেশের নাম দিয়েছিলাম মিনি পার্লামেন্ট। তাঁর সঙ্গে যতবার সফরসঙ্গী হয়েছি। লক্ষ্য করেছি এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যাওয়ার মাঝের পথটুকু তিনি ফাইল আর ম্যাপ নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন। সেই এলাকার সমস্যা নিয়ে অফিসিয়ালদের সঙ্গে আলোচনা করছেন।
সমাবেশের এমনি একটি প্রাক বৈঠকের কথা। দিশারী মোটর লঞ্চে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জিয়া হাতিয়া—সময় ১৯৭৮ সাল। বৈঠক কক্ষের পাশ উঁকি-ঝুঁকি মারছি দেখে তিনি আমাকেও ডেকে নিলেন। বসতেই একটা নোট খাতা আর পেন্সিল এগিয়ে দিলেন। বললেন, আপনার কোন পয়েন্ট থাকলে নোট করুন। হাতিয়া চ্যানেলের ইস্যু নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বারবার ইস্যুটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এসব দেখে প্রেসিডেন্ট সাহেব একটু উষ্ণ হয়ে উঠলেন। বললেন, আপনারা খেশারী ডাল বেশি খান নাকি? প্রশ্নটি বুঝতে না পেরে সবাই নির্বাক। প্রেসিডেন্ট আবার বললেন, পত্রিকায় পড়েছিলাম খেশারী ডাল বেশি খেলে লেথারিজম রোগ হয়। ও রোগে নাকি হাত-পা নড়তে চায় না। অবশ হয়ে আসে। কাজের বেলায় আপনাদেরও তো এমন অবস্থা দেখছি। ঠিক আছে আমাকে ম্যাপে এরিয়াটা বোঝান। কয়েকজন কর্মকর্তার তখন প্রায় গলদঘর্ম অবস্থা।
এ প্রসঙ্গে দেশে গম-চাষ সম্পর্কে একটি কথা মনে পড়ল। দেশে ব্যাপকভাবে গম চাষের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। শুনেছি ব্যাপকভাবে এ গম চাষ শুরুর প্রথমদিকে মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা অনেকে এর তেমন স্বপক্ষে ছিলেন না। তাঁদের বক্তব্য ছিল—পরিকল্পনা সফল হবে না। কিন্তু একরোখা বাস্তববাদী জিয়া প্রমাণ করে গেছেন যে, পরিকল্পনা সফলতার মুখ দেখেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার এমনি আরেকটি পরিকল্পনা হলো—তুলা চাষ। ইতিহাসের পাতা থেকে নজীর টেনে তিনি বলতেন, দেশের কয়টি এলাকায় আজ থেকে দেড়শ’ দুশ’ বছর আগে ব্যাপকভাবে তুলা চাষ হতো। তুলা চাষের উপযোগী মাটি ও আবহাওয়া আজও আছে। তুলা চাষ হবে না কেন?
সর্বস্তরের লোকের সঙ্গে সমাবেশ প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। বগুড়ায় এমনি ধরনের এক সমাবেশের ঘটনা। এক পর্যায়ে কোন এক ব্যাপারে সমাগত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন স্থানীয় এক প্রশাসনিক কর্তার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনলেন। তার অভিযোগের মূল কথা ছিল—সেই প্রশাসনিক কর্তার নাগাল মেলা ভার। সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি তার অনুকূলে কাজ না করে খেয়াল-খুশীমত কাজ কারবার করেন। সমাবেশে সেই কর্তা হাজির ছিলেন। প্রেসিডেন্ট তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার যদি কিছু বলার থাকে বা কৈফিয়ৎ তবে থাকে বলুন।’
সেই প্রশাসনিক কর্তা মাইকের সামনে গিয়ে বললেন, ‘ক্ষমাই মহত্বের লক্ষণ। আমি জনগণেরই লোক। আর ভুল হবে না। আমীন, সুম্মা আমীন।’ সমবেত সবাই হেসে উঠলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ারা মুখেও মৃদু হাসি।
সেই সমাবেশেরই আরেকটি ঘটনা। গ্রামের মেয়েদের কুটীর শিল্পের কাজের বিভিন্ন বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে এক আকর্ষণীয় ভদ্রমহিলা বেশ চড়া গলায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। প্রেসিডেন্ট এক পর্যায়ে বললেন, ‘আপনার শেষ হয়েছে?’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘না স্যার; পৃথিবীতে কোন কথা কি শেষ হয়? এক কেন সহস্র কেন-র জন্ম দেয় স্যার।’ প্রেসিডেন্ট জিয়া হেসে ফেললেন। বললেন, ‘আপাততঃ কথা শেষ করতে হবে। এবার আমার কথা শুনতে হবে। আপাততঃ কয়েকটি কেন-র জবাব দিয়ে নেই। পরে যেসব কেন-র জন্ম হবে তাকে ভালভাবে পালবেন পুষবেন। ওদেরকে পরে দেখা যাবে।’
[জ]
‘চল চল গ্রামে চল’ শ্লোগান এদেশে প্রথম সার্থকভাবে তুলেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। এদেশের রাজনীতিকেও তিনি সেই ‘গ্রাস রুট লেভেল-এ’ তিনি নিয়ে গিয়েছেন। প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণের প্রথম সফল পদক্ষেপও তিনি নিয়েছেন। পায়ে হেঁটে ‘ক্রস কান্ট্রি’ অর্থাৎ গ্রামের পর গ্রাম পথ চলা; ট্রেনে চেপে এক নাগাড়ে দুদিন তিনদিন রেল-সড়কের পাশে স্টেশনে স্টেশনে সভা করা; নিজের হাতে কোদাল নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন আর সড়ক নির্মাণের কাজে শরীক হওয়ার যে দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন তা এদেশে অভূতপূর্ব। গত তিন বছর গাঁয়ের লোকদের কাছে বার বার তিনি কয়েকটি কথাই বলে গেছেন—‘স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন করুন; বছরে দু’তিন ফসল আবাদ করুন; হাজা-মজা পুকুর সংস্কার করুন; পুকুরে মাছের পোনা ছাড়ুন; রাস্তার পাশে ফলের গাছ লাগান; নিরক্ষরতা দূর করুন; গ্রামের মেয়েদের জন্য কুটীর শিল্পের ব্যবস্থা করুন; পরিবার পরিকল্পনা করুন ইত্যাদি। বার বার আরেকটি কথা তিনি বলতেন—‘আমাদের অনেক সম্পদ রয়েছে। আমরা গরীব থাকব না আর কোনদিন কারো গোলামও হবো না।’
গ্রামের লোকদের জন্য তিনি গ্রামের ভাষায় সরাসরিভাবে বলার চেষ্টা করতেন। রংপুরে একবার এক জনসভায় তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন এমনিভাবে—‘হা বাহে হামার কথা শোনেন।’ সঙ্গে সঙ্গে সভায় প্রচন্ড করতালি। বগুড়ার এক সভায় তিনি বক্তৃতা শুরু করার আগে দেখতে পেলেন কিছু কিছু লোক জায়গা ছেড়ে উঠে এধার ওধার যাচ্ছেন। জিয়া বক্তৃতার এক পর্যায়ে বললেন, ‘কুনঠে যাচ্ছু? হামি বোগড়ার ছোল।’ সিলেটে বেশ কয়েকটি জনসভায় আমি তাঁকে বলতে শুনেছি—‘বউক্যা বউক্যা’। একবার সিলেটে সর্ব পর্যায়ের লোকের এক ঘরোয়া সমাবেশে তিনি চারু-বাক এক ভদ্রলোকের কথা থামাবার জন্যে বলে উঠলেন—‘বেশি মাত মাতে না বা।’ গম্ভীর মুখে মৃদু হাসির ঝিলিক আর তার সঙ্গে ‘চড়া গলার বক্তৃতায়’ এসব স্থানীয় কথার ভিয়েনে জনগণ তাঁর সঙ্গে আরও বেশি একাত্ম হয়ে যেতো।
[ঝ]
সিলেট প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাষ্ট্রীয় জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ঢাকার বাইরে মন্ত্রীসভার বৈঠক প্রথম অনুষ্ঠিত হয় সিলেটে। এর আগে সারা দেশে একটি গুঞ্জন সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়ার জমির সিলিং নামিয়ে দিচ্ছেন; জমি কেড়ে নিচ্ছেন; যাদের একটির বেশি দুটি বাড়ি আছে তাদের বাড়ি কেড়ে নিচ্ছেন ইত্যাদি। প্রতিদিনই কিছু একটা ঘোষণা হবে এমনি এক অবস্থা। এ ব্যাপারে ‘দৈনিক বাংলা’র পক্ষ থেকে আমি প্রেসিডেন্টের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার চাইলাম। বঙ্গভবন থেকে বলা হলো, সিলেটে প্রেসিডেন্ট সাহেবের সঙ্গে চলেন, সেখানে তিনি আপনার সঙ্গে আলাপ করবেন। যে প্লেনে প্রেসিডেন্ট যাবে সে প্লেনে আসন নেই। কিন্তু বিশেষ একটি আসন আমার জন্য বরাদ্দ করা হলো। সিলেটে পৌঁছে দেখলাম, রাজধানীর বাইরের মন্ত্রীসভার এই প্রথম বৈঠক কভার করার জন্যে সংবাদ সংস্থার কোন সাংবাদিককেও ঢাকা থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্যেও একেবারে প্রবেশ নিষেধ। দুপুরে হজরত শাহ জালালের মাজারে প্রেসিডেন্ট নামাজ আদায় করতে গেলেন। প্লেনে বসেই কথা হয়েছিল, নামাজের পর দুপুরে তিনি আমাকে বিশেষ সাক্ষাৎকারটি দেবেন। কিন্তু নামাজ শেষে ফিরে আসার পর আমি শুনলাম, প্রেসিডেন্ট নাকি এখন কথা বলতে পারবেন না। রাত দশটার পর আলাপ হলেও হতে পারে। মনে হলো—তিনি যেন আমাকে খানিকটা এভয়েড করতে চাচ্ছেন। এমনটি এর আগে আর কখনো হয়নি। খুব খারাপ লাগল। টেলিগ্রাফ অফিসে গিয়ে পত্রিকার জন্য একটি টেলিগ্রামই ফাইল করলাম। তাতে লিখলাম, ‘ইন্টারভিউ ইজ আনসার্টেইন। প্রেসিডেন্ট সিমস টু বি এক্সটিমলি নন কো-অপারেটিভ। হি সোয়ালোড হিজ প্রমিজ।’
যা চেয়েছিলাম, তাই হলো। টেলিগ্রামটি ঢাকায় এলো না। ওর ভাষ্য দেখে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের হাতে টেলিগ্রামটি তুলে দিলেন। ঘন্টা দুয়েক পরে প্রেসিডেন্ট সাহেব ডাকলেন। বললেন, ‘আমি কি রকম ব্যস্ত তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। আপনার ইন্টারভিউ কি পালিয়ে যাচ্ছিল? ঠিক আছে; বিকেলে ‘ক্রস-সেকশনের’ সঙ্গে মিট করছি। আপনিও সেখানে থাকবেন।’
তারপর অনেক কথা। প্রেসিডেন্ট সেই সভায় বললেন, ‘আমি কি আপনাদের বলেছি যে, জমি কেড়ে নেবো; বাড়ি কেড়ে নেবো ইত্যাদি।’ আমি আমার নিউজ পেয়ে গেলাম। প্রেসিডেন্টের প্রেস সেক্রেটারী কাফি ভাইকে (কাফে-খান) বললাম, ‘আমার ইন্টারভিউ-এর দরকার নেই। স্টোরি আমি পেয়ে গেছি। আমি ঢাকায় এক্ষুণি টেলিফোনে খবরটা দিতে চাই। আপনি কাইন্ডলি একটু জেনে দিন প্রেসিডেন্ট সাহেব এসব কথা ‘অব দ্য রেকর্ড’ বলেছেন কিনা। আর ঢাকার লাইনটা আপনি আপনার পরিচয় দিয়ে তাড়াতাড়ি পাইয়ে দিন। প্রেসিডেন্ট সাহেবের কাছে গেলেন কাফি ভাই। প্রেসিডেন্ট সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে, তবে ভাষ্যটা আমাকে যেন একটু দেখিয়ে নেয়।’
টেলিফোনের সামনে গিয়ে বসলেন কাফি ভাই। এক দু’মিনিটের ভেতরেই আমি লাইন পেলাম। ঢাকায় আমাদের নিউজ ডেস্কে তখন নিউজ পাঠানো আমি শুরু করেছি। হঠাৎ মনে হলো—প্রেসিডেন্ট সাহেবকে তো ভাষ্যটি শুনিয়ে নিতে হবে। এ সময় প্রেসিডেন্ট সাহেব সবার সঙ্গে চায়ের টেবিলে এসেছেন। যেখান থেকে টেলিফোন করছি তার পাশেই মাঠে চায়ের ব্যবস্থা। ফোনে আমার কথা সব শোনা যাচ্ছে। আমি ফোনটি রেখে দৌড়ে প্রেসিডেন্ট সাহেবের কাছে গেলাম। বললাম, ‘স্যার; আমি লাইন পেয়ে গেছি। আমি জোরে জোরেই বলছি আপনি সব শুনতে পাবেন। যদি কোন ভুল হয় আমাকে হাত নেড়ে বারণ করবেন।’
প্রেসিডেন্ট সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে।’ আমি আবার খবর পাঠানো শুরু করলাম। পেশাগত দিকে কাজের নানা অসুবিধার প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই মহৎ মনোভাবের কথা আমি কোনদিন ভুলব না। পরের দিন ‘দৈনিক বাংলা’য় খবরটি প্রথম লীড হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল এবং একমাত্র ‘দৈনিক বাংলা’তেই খবরটি ছিল।
[ঞ]
এমনি আরও অনেকবার আমি একজন সাংবাদিক হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়ার কাছ থেকে সহৃদয় সহযোগিতা পেয়েছি। যা ভোলা মুশকিল। ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে রাঙ্গামাটি সফরে গেলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। রাতে রেস্ট হাউসে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩০৯ জন হেডম্যান এবং তিন রাজা-চাকমা রাজা, বান্দরবানের রাজা এবং খাগড়াছড়ির রাজার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার কক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। রেস্ট হাউসের দোতলায় বৈঠক বসবে। শুনলাম, বৈঠকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে থাকবে রাজমাতা বিনীতা রায়; চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এবং মেজর জেনারেল মঞ্জুর ও মেজর জেনারেল আতিকুর রহমান। আর কেউ নয়। আমি প্রেসিডেন্টকে বললাম, ‘স্যার; আমি কোন রিপোর্ট করব না। কিন্তু বৈঠকে আমিও হাজির থাকতে চাই। ব্যাক গ্রাউন্ড ম্যাটেরিয়াল হিসেবে হয়তো কোনদিন কাজে লাগবে। প্রেসিডেন্ট সাহেব, ‘ঠিক আছে’। কিন্তু কোন রিপোর্ট নয়; কোন রেফারেন্স নয়। হ্যাঁ, সেই বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম। সহগামী সাংবাদিক বন্ধুরা অনেকে হয়তো আমার ওপর সে রাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের কেউই প্রেসিডেন্ট সাহেবকে এ্যাপ্রোচও করেননি।
[ট]
রেডিও বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদ বুলেটিনে তখন দেশী হোক বিদেশী হোক; মুসলিম হোক অমুসলিম হোক; সবার নামের আগেই জনাব বলা শুরু হয়েছে।
ঢাকার বাইরে কোন এক সফরকালে আমি প্রেসিডেন্ট জিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হঠাৎ সবার বেলায়ই এই জনাব বলা শুরু হলো কেন? ভারতীয় বেতারে এর আগে মুসলমানদের নামের আগে সব সময় যে ‘শ্রী’ ব্যবহার করা হতো এটা কি তার পাল্টা জবাব?’
প্রেসিডেন্ট জবাব দিয়েছিলেন, ‘পাল্টা জবাব কিনা আপনারাই ভাল বুঝবেন। তবে একটা কথা মনে রাখবেন প্রত্যেক জাতিরই একটি নিজস্ব আইডেনটিটি থাকা দরকার। যুক্তিসঙ্গত আইডেনটিটি। আপনাকে আরেকটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলছি, ফরাসীরা কাউকে সম্বোধন করতে হলে ‘মঁশিয়ে’। ইটালীয়ানরা বলে ‘সিনর’। জার্মানরা বলে হের। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে যান দেখবেন, তারা নামের আগে ব্যবহার করছে ‘সৈয়দ’। যেমন সৈয়দ জিয়াউর রহমান, সৈয়দ জিমি কার্টার ইত্যাদি। তেমনি আমরা বাংলাদেশী মুসলমানরা ব্যবহার করছি ‘জনাব’। অতএব, এটা আমাদের আইডেনটিটিরই নিদর্শন। আর একথা তো সবাই স্বীকার করবেন যে, সুস্পষ্ট আইডেনটিটির জন্য আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলেও বাঙালী নই—আমরা বাংলাদেশী।’
[ঠ]
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রসঙ্গ বহুবার তাঁকে প্রশ্ন করেছি। বলা চলে, বাইরে তাঁর সঙ্গে এখনই কোন এ্যাসাইনমেন্টে গেছি তা সুযোগ পেলে নানা প্রশ্নের মধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কেও প্রশ্ন রেখেছি। এমনি এক বাক্যের কথা।
প্রশ্ন ছিল, ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে আপনার মনোভাব কি?’
জবাব দিলেন, ‘এ সম্পর্কে যা বলার তা তো সরকারের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝেই বলা হচ্ছে। একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের নিজস্ব একটি আইডেনটিটি আছে। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সঙ্গে এই আইডেনটিটিও সহগামী ও সমার্থক। আরেকটি কথা, একটি বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া ফ্যাসাদ লাগিয়ে রেখে কেউ কোনদিন শান্তিতে স্বস্তিতে থাকতে পারে না। এই বাস্তব কথাটি ভুলে যাওয়া উচিত নয়। আমরাও ভুলে যেতে চাই না। কিন্তু কথা হলো কোন প্রতিবেশী যদি দুর্জন হতে চায় অথবা অবুঝ হয়ে যায় তাহলে ঝামেলা বাড়ে, কমে না। কথায় বলে দুর্জনের ছলের অভাব নেই। আমরা সবার মধ্যে সুজনকে চাই; দুর্জনকে নয়। দুর্জনকে চাই না বলেই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। যদি কেউ বাস্তব পরিস্থিতিতে ‘বিগ ব্রাদার’ হয়ে দাঁড়ায় তখন বাস্তবতাকে যেমন অস্বীকার করা যায় না; তেমনি তার অহেতুক ও অযৌক্তিক বড় ভাই সুলভ আচরণকেও স্বীকার করে নেয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দু্ই বিঘা জমি’ কবিতাটি পড়েছেন? কবিতার সেই বাবু যদি কেউ হতে চায় তাহলে তাকে রুখতেই হবে। জান বাজি করে রুখতে হবে।’
[ড]
প্রেসিডেন্ট জিয়ার আরেকটি সত্ত্বার কথা কোনদিন ভুলতে পারব না। জিয়া ছিলেন একজন আল্লাহওয়ালা পরহেজগার লোক। যা বাইরে থেকে কখনো তেমন বোঝা যেত না। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর রহম আর নবীর করম নিয়ে আমি জীবন কাটাতে চাই।’ হ্যাঁ, তিনি সেভাবেই আমৃত্যু ছিলেন।
৭৭ থেকে ৮১ এই পাঁচ বছরে তাঁর জীবনধারা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, রাষ্ট্রীয় কাজের সঙ্গে তিনি ধর্মীয় আচার-আচরণ ও আবেগ-অনুভূতির দিকগুলো সুন্দরভাবে মিলিয়ে নিয়েছিলেন। দেখা গেছে, কোন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কর্মসূচীতে হাত দেয়ার আগে তিনি সিলেটে হজরত শাহ জালাল (রাঃ) এবং দেশের অন্যান্য স্থানে ওলী আউলিয়াদের পবিত্র মাজার শরীফে জিয়ারতে যাচ্ছেন। তাছাড়া যখনই সুযোগ পাচ্ছেন পবিত্র ধর্মীয় স্থানগুলো পরিদর্শন করছেন। দেশে হোক কিংবা বিদেশে হোক, সেখানে যদি কোন পীর ওলী আউলিয়ার মাজার থাকে সেখানে তিনি যাবেনই। এর কোন ব্যতিক্রম কখনো হয়নি।
তাঁর বিদেশ সফরকালে একবারের কিছু ঘটনার কথা বলছি—যা আমার সব সময় মনে পড়ে। ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট গেলেন ইরাক সফরে। ইরাকে এটি ছিল তাঁর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর। ইরাক সফরের আগে সৌদি আরব সফর করেন। ওমরাহ পালন ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থান পরিদর্শনের জন্যে।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে অনেকে দেশে-বিদেশে বহু জায়গায় ঘুরেছেন। কিন্তু সেবারের সেই সফর সবার জীবনে কয়েকটি বিরল সুযোগ এনে দিয়েছিল। যা কোনদিন ভোলার নয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া পেয়েছিলেন বিরল কিছু সম্মান যা খুব বেশি মুসলমান রাষ্ট্রপ্রধানরা ঐভাবে পাননি।
৪ঠা মার্চ প্রেসিডেন্ট জিয়া জেদ্দা পৌঁছলেন। এবং তারপর পরই সফরসঙ্গীদের নিয়ে তিনি পৌঁছলেন পবিত্র মক্কা নগরীতে। মসজিদুল হেরেমে আসর ও মাগরেবের নামাজ আদায় করলেন। আর পেয়েছেন এক বিরল সুযোগ—পবিত্র খানায় কাবা’র ভেতরে ঢুকে নামাজ আদায়ের সুযোগ। পবিত্র কাবা শরীফে ঘর পরিষ্কার করেন। আর খোলা হয় মুসলিম বিশ্বের কোন বিশেষ সম্মানিত ও নেকবখত ব্যক্তিত্ব যদি অনুরোধ জানান তাঁর অনুরোধ রক্ষার জন্যে। গত কয়েক দশকে এমনি মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন এই বিরল সুযোগ পেয়েছেন। আর পেলেন জিয়া ও তাঁর সফরসঙ্গীরা।
পবিত্র খানায় কাবার দরজা খুলে দেয়া হলো। পবিত্র ঘরে উঠবার জন্য লাগানো হয়েছে অস্থায়ী সিঁড়ি। প্রেসিডেন্ট জিয়া ও তাঁর সঙ্গীরা একে একে উঠে গেলেন পবিত্র ঘরের ভেতরে। উচ্চারিত হচ্ছে সুরেলা কন্ঠে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা…..’।
ভেতরে ঢুকে চারদিকে মুখ করে সবাই দু’রাকাত করে নফল নামাজ পড়লেন। আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে দোয়া ভিক্ষা করে আবেগে আপ্লুত সবাই কিছুক্ষণের জন্যে হারিয়ে গেলেন এই নশ্বর পৃথিবী থেকে। ভেসে আসতে লাগলো কান্নার চাপা আওয়াজ। প্রেসিডেন্ট জিয়া কাঁদছেন, কাঁদছেন সবাই। এরপর সবাই খানায় কাবা’র মেঝে ঝাড় দিলেন। পবিত্র নেয়ামত হিসেবে সেই ঝাড়ন হাতে নিয়ে কেউ কেউ নীচে নেমে এলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া কিছুক্ষণের জন্যে বুকের কাছে জড়িয়ে রাখলেন একটি ঝাড়ন।
৪ঠা মার্চ সৌদি আরব সময় রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট জিয়া ও তাঁর সঙ্গীরা পৌঁছলেন মদীনা-মনওয়ারায়। বাংলাদেশ সময় তখন রাত পৌণে দু-টা। কথা ছিল বিমান বন্দর থেকে সবাই রাতের আবাসের জন্য যাবেন রাজকীয় অতিথি প্রাসাদে। কিন্তু প্রোগ্রামের রদ-বদল হয়ে গেল। মদীনার মাননীয় গভর্নরকে প্রেসিডেন্ট অনুরোধ জানালেন, সবার আগে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা রসুলে করীমের (সঃ) পবিত্র রওজা মোবারকের ভেতরে যেতে চান। সাধারণতঃ এই অনুমতি কোন বিদেশী মুসলমান রাষ্ট্রপ্রধানকেও দেয়া হয় না। গভর্নর রাজী হলেন। তিনি বললেন, ‘চলুন রসুলে করীমের রওজা পাকের ভেতরে আমরা বাংলাদেশের মুসলিম ভাইদের নিয়ে যাব।
রওজা মোবারক থেকে জিয়া ও তাঁর সঙ্গীরা যখন রাজকীয় অতিথি প্রাসাদে ফিরে এলেন তখন মদীনায় মধ্যরাত। বাংলাদেশে সোবহে সাদেক। প্রাসাদে ফিরে প্রেসিডেন্ট আমাদের পরবর্তী প্রোগ্রাম জানিয়ে দিলেন। তাহাজ্জুদের নামাজ এবং ফজরের নামাজ এবং ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে নব্বীর উদ্দেশ্যে আবার রওয়ানা হতে হবে রাত সাড়ে তিনটায়। মাঝে বিশ্রাম ও ঘুমের জন্য ঘন্টা তিনেক সময়। ঢাকা ত্যাগ করার পর সময় পেরিয়ে গেছে প্রায় কুড়ি ঘন্টা। গেছে দীর্ঘ বিমান ভ্রমণ। শরীরে খানিকটা ক্লান্তি এলেও মনে কারো ক্লান্তি নেই। প্রায় সবাই না ঘুমিয়ে বাকি সময়টা কাটিয়ে দিলেন। পরের দিন অর্থাৎ আটাশে ফেব্রুয়ারীর রাতের আগে অব্দি দীর্ঘ প্রায় পঁয়তাল্লিশ ঘন্টা (বাংলাদেশ সময় অনুসারে) প্রায় সবাই ছিলেন বিনিদ্র।
মসজিদের নব্বীতে সবাই যখন পৌঁছলেন তখন রাত প্রায় চারটা। বহুলোক তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করছেন। নামাজ আদায়ের জন্যে জিয়া ও তাঁর সফরসঙ্গীরা যেখানে বসলেন সেটি হলো মসজিদে নব্বীর মূল এলাকা। রসুলে করীমের আমলে যেখানে মসজিদে ছিল সেই আদি জায়গায় বসলেন জিয়া ও তাঁর সফরসঙ্গীরা। লাগোয়া দক্ষিণে রসুলে করীমের (সঃ) মাজার। তাঁর পাশে দক্ষিণে অন্তিম শয়ানে শায়িত ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবুবকর (রাঃ) এবং তাঁর দক্ষিণে দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের (রাঃ) মাজার। একই প্রকোষ্ঠের মধ্যে রসুলে করীম (সঃ) এবং তাঁর দুই প্রিয়তম উম্মতের রওজা মোবারক। রসুলে করীম (সঃ) একদিন যেখানে দাড়িয়ে নামাজ পড়েছেন ঠিক সেখানেস দাঁড়িয়ে আমরাও একদিন নামাজ পড়ার সুযোগ পাবো—তা ক’জন ভাবতে পেরেছিলাম?
ইরাকে জিয়া তাঁর রাষ্ট্রীয় সফর করেন ৭৯ সালে ৬ মার্চ। সৌদি আরবে ছিল বেসরকারী সফর। কিন্তু সৌদি আরবের মতো ইরাকেও প্রেসিডেন্ট জিয়া ইসলামের বহু পবিত্র স্থান পরিদর্শন করেন। জিয়ারত করেন বহু মাজার। ইরাকী প্রটোকলের একজন আমাকে বলেছিলেন, ‘এর আগে কোন মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান ইরাক সফরে এসে রাষ্ট্রীয় দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার পাশাপাশি এত বেশি ধর্মীয় স্থান পরিদর্শন করেন নি। তিনি ও তাঁর সফরসঙ্গীরা দিনের প্রথম কর্মসূচী শুরু করেন বড় পীর সাহেবের মাজার জিয়ারত ও গিলাফ পরানোর মাধ্যমে সেদিনের সেই দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসছে।
গওসুলে আজম বড়পীর সাইয়েদেনা হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রাঃ)-এর মাজারে গিলাফ পরানো হলো। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেয়া গিলাফ। রওজা মোবারকের দরজা খুলে দেয়া হলো। ভেতরে ঢুকে গিলাফ পরালেন প্রেসিডেন্ট জিয়া ও সফরসঙ্গীরা।
কালো রেশমী কাপড়ের গিলাফ। তার ওপর সোনালী সূতায় লেখা রয়েছে পবিত্র কালাম। আর রয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। মাজারে গিলাফ পরানোর পর দেখা গেল বড়পীর সাহেবের ঠিক সিনার উপরে পড়েছে জাতীয় পতাকা।
পীর মোহসেনউদ্দীন দুদু মিয়া বললেন, ‘আল্লাহর অশেষ রহমত। জাতীয় পতাকাটি বড় সুন্দর জায়গা পড়েছে।
গিলাফ পরানোর পর সবাই দু’রাকাত নফল নামাজ পড়লেন। তারপর মোনাজাত। পরিচালনা করলেন, বড়পীর সাহেবের বংশধর ও হজরত আবদুল কাদের জিলানী ওয়াকফ ট্রাস্টের মোতাওয়াল্লী সৈয়দ ইউসুফ জিলানী। মোতাওয়াল্লী সাহেব পুরনো গিলাফটি বাংলাদেশকে উপহার দিলেন।
গিলাফ পরানো ও জিয়ারতের পর জিয়া ও তাঁর সফরসঙ্গীরা গেলে কাদেরিয়া লাইব্রেরীতে। বড়পীর সাহেবের রওজা মোবারকের পাশে প্রাঙ্গণের পূর্ব দিকে রয়েছে এই পাঠাগারটি। অতীতে বহুবার এই গ্রন্থাগারটির সুনাম শুনেছি। বিদেশী পত্রিকায় এ সম্পর্কে লেখা নিবন্ধ ও ফিচার স্টোরি পড়েছি। পিএইচডি লাভের জন্যে থিসিস রচনার কাছে বহু গবেষণাকর্মী এখানে এসে থাকেন। এবার সেই গ্রন্থাগার দেখার সুযোগ পেলাম। গ্রন্থাগারে বর্তমানে মোট গ্রন্থের সংখ্যা হলো ৭৩ হাজার। ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের বই। আর রয়েছে হাতে লেখা সাত হাজার মূল্যবান পান্ডুলিপি। এর মধ্যে ইমাম গাজ্জালীর (রাঃ) হাতে লেখা পান্ডুলিপিও রয়েছে।
গ্রন্থাগার পরিদর্শনের পর ‘পরিদর্শন বহি’তে মন্তব্য লেখার জন্যে অনুরোধ জানানো হলো প্রেসিডেন্ট জিয়াকে। জিয়া বাংলায় লিখলেন—‘আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ’।
গ্রন্থাগার থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছেন এমন সময় আসর নামাজের আজান পড়লো। প্রেসিডেন্ট জিয়া বললেন, ‘আসর নামাজের আজান পড়েছে। চলুন মাজারের মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে যাই।’
[ঢ]
আরেকটি ঘটনা। ১৯৮০ সালের শেষভাগে প্রেসিডেন্ট জিয়া বিশেষ ট্রেনে তাঁর জন-সংযোগ সফর শুরু করেন। এ ধরনের সফর এটাই ছিল প্রথম। দু’মাসের মধ্যে চারবার তিনি এই সফরে বেরোন। প্রথম দুটি সফরে আমি ছিলাম। প্রথম সফরের সময়ের কথা। রেল সড়কের পাশে একটি জনসভা সেরে তিনি আবার ট্রেনে উঠছেন। এমন সময় আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘পালাবেন না আগামী স্টেশনের সভায় আপনাকে বক্তৃতা দিতে হবে।’ পরে সেই স্টেশনে এসে ট্রেন থামতেই আমি সোজা পেছনের দিকের এক বগীতে গিয়ে বসে রইলাম। সভা শেষে ট্রেন আবার ছাড়লো। পরের সভা যে স্টেশনে সেখানে ট্রেন থামার পর দেখতে পেলাম, প্রেসিডেন্ট সাহেবের এক পার্সোনাল স্টাফ প্রতি কামরায় ঢু মারছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘চলুন; প্রেসিডেন্ট সাহেব আপনাকে ডাকছেন।’ গেলাম। তিনি তখন সভামঞ্চে। আমাকে দেখতে পেয়ে তাঁর পাশের একটি চেয়ারে নিয়ে বসালেন। বললেন, ‘এরপরেই আপনাকে বক্তৃতা দিতে হবে।’ আমি বললাম, ‘স্যার, আমি সাংবাদিক হিসেবে এ্যাসাইনমেন্টে এসেছি। বক্তৃতা দেয়া যাবে না স্যার। আর তা ছাড়া আমি কোন দলীয় রাজনীতি করি না।’ প্রেসিডেন্ট সাহেব বললেন, ‘আরে ভাই; গালি দেওয়ার ইচ্ছা হলে গালি দেবেন। কিন্তু মাইকের সামনে যেতে হবে।’ এই বলে তিনি আমার জামার আস্তিন ধরে রাখলেন যাতে পালাতে না পারি। সভার সব লোক তখন এদিকে তাকিয়ে আছে। পরে বোধহয় তাঁর দয়া হলো। বললেন, ‘ঠিক আছে, আজকের বাকি পথ আপনি আমার সঙ্গে সেলুনে বসে যাবেন।’
সেলুনে গেলাম। বললাম, ‘স্যার; আপনি সাধারণতঃ দেশের সাংবাদিকদের এক্সক্লুসিভ বা স্পেশাল ইন্টারভিউ দিতে চান না। অথচ বিদেশী বিদেশী সাংবাদিকরা এ্যাপ্রোচ করলেই আপনার ইন্টারভিউ পেয়ে যায়।’
প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘কেন আপনাদের সাপ্তাহিক বিচিত্রাতে এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ দেইনি? কয়েকবারই তো দিয়েছি।’
বললাম, ‘কিন্তু ঢাকার কোন দৈনিক পত্রিকাকে কি দিয়েছেন? আমার তো মনে পড়ে না।’
জবাব দিলেন, ‘বোধ হয় দেইনি। কিন্তু আপনারাও তো ঠিকমত এ্যাপ্রোচ করেন না। আরে সাহেব, আপনারাই পালিয়ে পালিয়ে থাকেন। ঠিক আছে, আপনি কি চান,
‘একটি এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ’।
বললেন, ‘ঠিক আছে; দেবো। আগে চানাচুর খান।’
এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ দিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। শুধু সেবারিই নয়, তার পরের বারের বিশেষ ট্রেন সফরেও।
সেবারের সেই দুই এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউতে তিনি অনেক ডেলিগেট প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন। অবশ্যই ‘অব দ্য রেকর্ড’। যে সব প্রশ্নের জবাব ‘অন রেকর্ড’ ছিল তার পুরোটাও আমি লিখিনি। ট্রেন সফর থেকে ফিরে এসে দুবারই সেই ইন্টারভিউ-র পুরো বিবরণ বার্তা সম্পাদক সাহেবকে শুনিয়েছি।
যা সেদিন লিখিনি তেমনি কিছু কথা আজ মনে পড়ছে। প্রশ্ন করেছিলাম, ‘জিয়া যেদিন থাকবেন না সেদিন বি, এন, পি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং ধীরে ধীরে ছত্রখান হয়ে যাবে। অনেকের এই বক্তব্য সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?’
প্রথমে তিনি বললেন, ‘এই বিষয়ে আলোচনাটি থাক।’ পরে আমি পীড়াপীড়ি করায় বললেন, ‘আপনার কৌতুহল দূর করার জন্য বলছি। তবে সব ‘অফ দ্য রেকর্ড’। আমি বিশ্বাস করি, বি, এন, পি ভাঙবে না এবং ভাঙতে পারে না।’ আসলে এমনি কথা সব সময়ই আমার কানেও আসে। তখন বেশ খারাপ লাগে। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। দেখেন, কায়েদে আজম, কায়েদে মিল্লাত, জাতির জনক এসব কনসেপ্ট আর চলবে না। লোকে পছন্দ করে না। তেমনি আমি মনে করি কোন দলের কোন একক জনক বা ক্রিয়েটার থাকতে পারে না। এ্যাট বেস্ট কোন ব্যক্তি কোন দলে মেজর ফ্যাক্টর হিসেবে থাকতে পারেন। দেখেন, আমি ৭২ সাল থেকেই এদেশের পলিটিক্স ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করতাম। বিভিন্ন দলের টেম্পারারমেন্ট বোঝার চেষ্টা করতাম। সব রাজনৈতিক দলের পুরোপুরি টেম্পারারমেন্ট আর চরিত্র যে পুরোপুরি আমি এখন বুঝে ফেলেছি তা দাবি করি না। তবে তাদের অনেকটাই আমি জানি, বুঝি। ক্যান্টনমেন্টে আমার বাসায় বিরোধী দলের অনেক ডাকসাইটে নেতাও যান। কয়েকদিন আগে এমনি একজন বিপ্লবী নেতা গিয়েছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ময়দানে বক্তৃতায় যে সব কথা বলেন তার সব কথা কি নিজে বিশ্বাস করেন? তিনি জবাব দিলেন, ওটা পলিটিক্স। তো এই পলিটিক্স আমি জানি না এবং বুঝি না। বি, এন, পি-তে অনেক দল থেকেই লোক এসেছেন। হ্যাঁ, কিছু বাজে লোকও এসেছেন। তাদের চেহারা এখন আমি ধীরে ধীরে চিনতে পারছি। এই বাজে লোকদের আমি প্রথমে শোধরাতে চেষ্টা করব। যদি ব্যর্থ হই দল থেকে বের করে দেবো। আমি এ্যানিহিলেশন-এর চেয়ে ইউটিলাইজেশন-এ বেশি বিশ্বাস করি। এবং সবচেয়ে বড় যা দরকার তা হলো-ইউটিনি ইন ডাইভারসিটি। যদি আমাদের লক্ষ্য, আদর্শ ও কর্মপন্থার একটি সাধারণ ও সুষ্ঠু প্ল্যাটফর্ম থাকে তাহলে বি, এন, পি কেন কোন দলই ছত্রখান হবে না।’
প্রশ্ন করলাম, ‘খোদা না করুন আপনি যেদিন থাকবেন না, সেদিন কি হবে?’
জবাব দিলেন, ‘মারা যাওয়া কথা বলছেন? আমি নিজেকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে রেখেছি। আমাকে যখন নিয়ে যাওয়ার তখন নিয়ে যাবেন। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, মৃত ব্যক্তিকে ক্যাপিটাল করে রাজনীতি এগিয়ে নেয়া যায় না। কিন্তু নীতিমালা থাকবে আদর্শ থাকবে। কর্মসূচী থাকবে। তাকে কেন্দ্র করে কাজ হবে। তাকে কেন্দ্র করেই রাজনীতির ধারা এগিয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ। এ বিশ্বাস আমার আছে।’
।। চার ।।
জিয়াউর রহমানের রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির কোন মূল্যায়ন আমি করিনি। একথা আমি আগেই বলেছি। কিন্তু একটি কথা আজ আমার মনে হচ্ছে। জিয়া ছিলেন একটি ইন্সটিটিউশন। তিনি যখন জীবিত ছিলেন; তখন হয়তো তা তেমন বোঝা যায়নি। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে তিনি নেই।
আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলেই প্রথমেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘হাউ ইজ ইওর ফ্রেন্ড?’ অস্বীকার করব না, তাঁর এই প্রশ্নে আমি হয়তো অর্বাচীনের মতই বিব্রত হতাম। গত দু’বছরে তাঁর এই কথার পিঠে পাল্টা কথাও আমি ছুঁড়ে দিয়েছি। আজ আমার সেই সাংবাদিক বন্ধু আগের সেই প্রশ্ন করবেন না। যদি করতেন তাহলে বলতাম, ‘হি ইজ এরাউন্ড আস’।
০০০
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1981.07.10-bichitra.pdf” title=”1981.07.10 bichitra”]