You dont have javascript enabled! Please enable it!

পটুয়াখালীতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

২৫ বছর পর্যন্ত পাকিস্তানের দস্যু দল আমার বাংলাদেশের সব কিছু সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে। ২৫ বছর পর্যন্ত ছলে বলে কৌশলে আমার বাংলার সম্পদ লুট করে পশ্চিম পাকিস্তান ভূমিকে সুজলা সুফলা করেছে। আর আমার সােনার বাংলা শেষ হয়ে গেছে। বার বার ওদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। বার বার ওরা আমাকে জেলখানার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। ২৫ মার্চ তারিখে ঢাকা শহরে বি ডি আর-এর হেডকোয়ার্টার পিলখানা, পুলিশের হেডকোয়ার্টার রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আর আমার সৈন্যবাহিনীকে আক্রমণ করে। মেশিনগান দিয়ে গুলি করে, হাজার হাজার লােক ঢাকা শহরে, বাংলাদেশে তারা হত্যা করে। আমি দেখলাম আমার শেষ সময় এসে গেছে। বােধহয় জীবনে আর ফিরবাে না। আমার শেষ আদেশ আমি দিয়ে যাই। আমি শেষ আদেশ দিলাম। বাংলার মানুষকে আমি অনুরােধ করলাম। আমি যদি আর তােমাদের হুকুম দেবার না পারি তােমরা এই পশ্চিম পাকিস্তানের পশুদের বাংলার উপর থেকে তাড়িয়ে দাও। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা কর। বাংলার মানুষ আমার কথা রাখল, যে পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন না হয়, যে পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা থেকে বিতাড়িত না হয়। যুদ্ধ করেছে আমার বাংলাদেশের মানুষ, যুদ্ধ করেছে আমার বাংলাদেশের মুক্তি ফোর্স। যুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের সবাই। যুদ্ধ করেছে বাংলার সামরিক বাহিনীর ছেলেরা। যুদ্ধ করেছে বি ডি আর। যুদ্ধ করেছে যতরকম ফোর্স ছিল বাংলাদেশের সকলে মিলে। যুদ্ধ করেছে ছাত্র, শ্রমিক, যুদ্ধ করেছে। কৃষক, বুদ্ধিজীবী। যুদ্ধ করেছে স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীনতা পেয়েছে। রাস্তাঘাট ভেঙ্গে দিয়েছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। ব্রীজগুলাে উড়িয়ে দিয়েছে। পাের্টকে ধ্বংস করেছে। অর্থ-সম্পদ লুট করেছে। কারেসি নােট জ্বালিয়ে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়ে গেছে। শেষকালে যাওয়ার সময় কারফিউ দিয়ে আমার দেশের বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। যা দুনিয়ায় কোন দিন দেখা যায় নাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর, সাংবাদিক, বৈজ্ঞানিক যাকে যেখানে পেয়েছে, কাফু দিয়ে ঘর থেকে ধরে নিয়ে ছেলে মেয়েদের সামনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। চোখের ডাক্তারের চোখ উঠিয়ে ফেলেছে, তারপর হত্যা করেছে। হার্টের ডাক্তারের হার্ট কেটে বের করেছে। তারপর হত্যা করেছে। সাংবাদিকদের আঙ্গুল কেটেছে তারপর হত্যা করেছে। ছাত্রদের হাত পা কেটে ফেলেছে। তারপর হত্যা করেছে। এভাবে কষ্ট দিয়ে বনের জানােয়ারেরাও হত্যা করে না। যা পশ্চিম পাকিস্তানের জানােয়াররা করেছে। ২ লক্ষ মা-বােনের উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে। তাদের জন্য দোয়া করেন, তাদের রক্ত বৃথা হয়ে যাবে যদি এদেশের দুঃখী মানুষকে আমি পেট ভরে খাবার দিবার না পারি। তাদের রক্ত বৃথা হয়ে যাবে যদি এদেশের মানুষ তাদের মাবােন পেট ভরে ভাত না পায়। সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে না পারে। আর সােনার বাংলা যদি গড়ে তুলতে না পারি তাদের আত্মা শান্তি পাবে না। তাই আমি আপনাদের কাছে অনুরােধ করবাে, যে যেখানে আছেন সরকারি কর্মচারী হােন, যারা যেখানে আছেন মাতৃভূমিকে ভালােবাসেন। দেশের সেবা করেন। দেশের সম্পদ আরও বাড়ান, দুর্নীতি বন্ধ করেন। ঘুষ বন্ধ করেন। ডাকাতি বন্ধ করেন। জাতির পিতা হিসাবে জাতির বন্ধু হিসাবে আপনাদের কাছে আমি এই আবেদন করি। শেখ মুজিবুর। রহমানকে বেটে খাওয়ালেও বাংলা সােনার বাংলা হবে না, আপনারা যদি সােনার বাংলায় সােনার মানুষ পয়দা করতে না পারেন। আজ আমার দুঃখ হয় বারাে মাস হলাে না, আমার দুঃখ হয় রক্তের দাগ আজও দেয়াল থেকে মুছে ফেলা যায় নাই। আমার দুঃখ হয় মায়ের চোখের পানি আজও মুছে নাই, আজও শুকায় নাই। দুঃখ হয় আজ যখন আমি বরিশালের শহীদ মিনার ওপেন করি বােনেরা এসে যে ভাবে আমার সামনে ঠুকে ঠুকে কাঁদতে আরম্ভ করল আমি সহ্য করতে পারি নাই। মানুষের দুঃখ আমি সহ্য করতে পারি না। মানুষের ব্যথা আমি সহ্য করতে পারি না। ক্ষমতার মােহে আমি রাজনীতি করলে আমি জীবনে অনেক আগে প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম। আমি রাজনীতি করছি। এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাের জন্য। বাংলার মানুষকে স্বাধীন করার জন্য। আমার স্বপ্ন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার দ্বিতীয় স্বপ্ন সােনার বাংলা হওয়া, সােনার মানুষ, সােনার দেশে সকলে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করুক এটাই আমি আশা করি। সবাই স্লোগান দেয় বঙ্গবন্ধু কঠোর হও। কঠোর আমি হবার পারি কি না তা ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খান জানে। কিন্তু আমি কার বিরুদ্ধে কঠোর হব? যেদিকে চাই দেখি তারা আমার। কিন্তু এর মধ্যেও যারা চোর, বদমাইশ, যারা গুন্ডা, যারা ঘুষখাের, যারা দুর্নীতিবাজ তাদের উপর আমার কোন দয়া মায়া নাই। তাদের আমি ওয়ার্নিং দিচ্ছি বার বার। এইবার আমি আর ওয়ার্নিং দিতে চাই না। আমি আমার পুলিশকে, আমি রক্ষী বাহিনীকে বাংলার জনসাধারণকে আমার পার্টির কর্মীদের, ছাত্রদের অনুরােধ করবাে যারা দেশকে ভালােবাসে, যারা সংগ্রাম করেছে, যারা রক্ত দিয়েছে, এই বাংলার মাটি থেকে এই দুর্নীতিবাজদের ধ্বংস করে দাও। দুঃখী মানুষের দুঃখ নিয়ে খেলা করার অধিকার বাংলার মাটিতে কারাে নাই। ভাইয়েরা বােনেরা, আমি আপনাদের কৃষক ভাইদের জন্য ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দিয়েছি। ক্ষমতায় বসার প্রথম দিনে বকেয়া খাজনা সুদসহ মাফ করেছি। ৪ লক্ষ ৬৫ হাজার একর জমি যা খাস মহলের জমি ছিল সেখানে আপনাদের আগে সেলামি দিতে হতাে। সেলামি দেয়া লাগবে না। তাদের মধ্যে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে সেলামি বাদে। আর যার ১০০ বিঘার উপর জমি আছে তাদের বের করে এনে গরীবের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে। আপনাদের রাষ্ট্র বাঁচাবার জন্য ফসল উৎপাদন করতে হবে। শ্রমিক ভাইদের কাজ করতে হবে। তা না হলে ভিক্ষা করে দেশকে বাচানাে যায় না। আমার দুঃখ হয় মাঝে মাঝে। কি হলাে এই দেশের? মানুষ এমন লােভী হবে কেন ? সম্পদ নিয়েতাে কবরে যাবে না। সম্পদ তাে পড়ে থাকবে। এদের তাে মরতে হবে একদিন। সেই সামান্য জায়গা আর এক গজ কাপড় ছাড়া তাে কিছুই সঙ্গে নিতে পারবে না। তারপরে কেন চুরি করবে? তারপরে কেন ঘুষ খাবে? তারপরে কেন অত্যাচার করবে? আমি বুঝতে পারি না। যাই হােক চোর না শােনে ধর্মের কাহিনী। তাই উনাদের একটু দমন করতে হবেই, উপায় নাই। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের চোখের দিকে চেয়ে দমন করতে হবে। ছাত্র ভাইয়েরা লেখা পড়া করাে, আর নকল করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। তােমরা কী করবা, লেখাপড়া শিখবা নাকি নকল করে পাস করবা। মানুষ হও। নকল করে পাস করে তাে মানুষ হওয়া যাবে না। ডিগ্রি নেয়া যেতে পারে। তােমাদে তাে মানুষ হতে হবে। আপনারা জানেন না? বড় বড় চটকল, আদমজী চটকল, কাপড়ের কল, চিনির কল, মহাজনদের ও বড় বড় লােকদের ছিল। জানেন না? সেগুলাে কেড়ে নিয়ে জাতীয়করণ করে সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি না রেখে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্পদ করে দিয়েছে। সকল সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশের মালিক সাড়ে সাত কোটি মানুষ। তারা আপনারই বাপ-মা, আপনারই ভাই-ব্রাদার, আপনি ধরেন আসছেন বরিশাল থেকে পটুয়াখালী জেলা বা খুলনা জেলা থেকে। আপনার বাপ-মা এখানে আছে। যেখানে সেবা করছেন, মনে করেন তাদেরই ভাই, তাদেরই ব্রাদার তাদের সেবা আপনারা করছেন। আপনার বাপ-ভাইয়ের সেবা করছেন। সেবার মনােবৃত্তি নেন। আপনারা শাসক নন। আপনারা হলেন সেবক। এই মাটির মানুষ। আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানের অফিসার নন। বাংলার মায়ের সন্তান। যে গ্রামে আপনি জন্মগ্রহণ করেছেন, আমি জন্মগ্রহণ করেছি, সেই গ্রামে কৃষক দুঃখী মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে। চক্ষু বুজে চিন্তা করবেন। দেখবেন হয় তার বাবার মত চেহারা আপনার বাবার মতাে চেহারা, আপনার ভাইয়ের মত চেহারা নয় আপনার দাদার মত চেহারা, নয় আপনার খালুর মতাে চেহারা। নয় আপনার মামুর মতাে চেহারা, নয় আপনার ফুপার মতাে চেহারা। সেবা করেন। জান পরান দিয়ে খাটেন। ধ্বংসস্তুপ। আপনারা বুঝতে পারেন নাই। আপনারা মায়না পাচ্ছেন মাসে মাসে। আপনারা জানেন না বিপ্লবের বেলায় কি হয়? আপনাদের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য দলিল করে দিয়েছি যাতে এই বাংলার জনগণই হবে বাংলাদেশের মালিক। কোন ব্যক্তি মালিক হতে পারবে না। সেই জন্য আপনাদের আমি ১১ মাসের মধ্যে শাসনতন্ত্র দিয়েছি। যা কোন দেশ কোন যুগে কেউ পারে নাই বিপ্লবের পরে এত তাড়াতাড়ি শাসনতন্ত্র দিতে। সেটাতেই আপনাদের অধিকার লেখা রয়েছে। কেউ সে দলিল খতম করতে পারবে না। তাদের আমি বলে দিতে চাই বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে ষড়যন্ত্র করে বাংলার মাটিতে বেশি সুবিধা হবে না। ঐদিন যখন কেউ পারে নাই। যখন পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য, পশ্চিম পাকিস্তানের অফিসার, পশ্চিম পাকিস্তানের টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি যখন পারে নাই বাংলার মাটিতে। আমি মােকাবেলা করেছি তাদের আর আজ সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আমার পেছনে। রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা আনা হয়েছে। বাংলার যুবক আজ জাগ্রত। বাংলার কৃষক আজ বােঝে। বাংলার শ্রমিক আজ জানে ঐ নতুন খেলা চলবে না। ও খেলা কেমন করে বন্ধ হয় শীঘ্রই এর মজা আপনারা পাবেন।১৭

রেফারেন্স: দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৩, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!