মুক্তির আনন্দে উচ্ছল সােনার বাঙলা
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক) মুক্তির আনন্দে উচ্ছল, উদ্বেল-নবজীবনের স্পন্দনে মুখরিত ঢাকা নগরী, সারা বাংলাদেশ। ঢাকার কালাে পীচঢালা প্রশস্ত রাজপথগুলিতে অগণিত মানুষের হাজারাে মিছিল বাঁধভাঙা জোয়ারের উপমা। দীর্ঘ নয় মাস পর মানুষের চোখে-মুখে আবার ফিরিয়া আসিতেছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার, নিরাপত্তাবােধের ছাপ। ভয়-ভীতি ও সন্ত্রাসের চিহ্ন গিয়াছে মুছিয়া। গত নয় মাসে যেসব নগরবাসী বাড়িঘর ছাড়িয়া গ্রামে চলিয়া গিয়াছিলেন তাঁহারা দলে দলে ফিরিয়া আসিতে শুরু করিয়াছেন। পরিত্যক্ত বাড়িঘরকে আবার বাসােপযােগী করিয়া তুলিতেছেন। অনেক বাড়িঘর পাক দস্যুদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত, সেগুলি মেরামতের কাজও শুরু হইয়া গিয়াছে। শহরে, গ্রামে, সর্বত্র নবজীবনের সাড়া। প্রত্যেকটি মানুষের চোখে-মুখে আনন্দের অভিব্যক্তি, বিজয়ের উল্লাস-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ের আভাস স্পষ্ট। ঢাকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ঢাকার জীবনযাত্রা এখন স্বাভাবিক। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কোন কোন সংবাদ প্রতিনিধি বাঙালী অবাঙালী দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রভৃতির অতিরঞ্জিত বিবরণ দিয়া বাঙলাদেশের স্বাধীনতাকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা করিয়াছিল। কিন্তু উহা ব্যর্থ হইয়াছে। বাঙলাদেশ সরকার ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর দৃঢ় হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হইয়া আসিয়াছে। ঢাকা মুক্ত হওয়ার পর প্রথম দুই একদিন কিছুটা গােলযােগ দেখা দিয়াছিল সত্য। কিন্তু উহা গত নয় মাসের চরম অরাজকতারই জের। পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের একদিন আগে ঢাকার বহুসংখ্যক বিশিষ্ট বাঙালী বুদ্ধিজীবীকে হত্যা এবং নওয়াবপুর, ঠাটারী বাজার প্রভৃতি এলাকায় পাক বাহিনীর সহযােগী একশ্রেণীর দুষ্কৃতকারীর ব্যাপক আক্রমণ জনসাধারণের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তদুপরি পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরও জনসাধারণের উপর চোরাগােপ্তা আক্রমণ প্রভৃতি এই উত্তেজনার আগুনে ইন্ধন যােগায়। কিছু সংখ্যক উগ্রপন্থী তরুণ জনসাধারণের এই বিক্ষোভ ও উত্তেজনাকে সম্বল করিয়া হাঙ্গামা সৃষ্টির চেষ্টা করে। কিন্তু বাঙলাদেশ সরকার ও ভারতীয় বাহিনীর দৃঢ় হস্তে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা এবং ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির দাঙ্গা বিরােধী। রাজনৈতিক প্রচার পরিস্থিতিকে সহজ করিয়া তােলে।
বর্তমানে অবাঙালী জনসাধারণের নিরাপত্তার প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা হইয়াছে এবং কোনরূপ অপ্রীতিকর ঘটনার সংবাদ পাওয়া যাইতেছে না। কর্তৃপক্ষ বাঙালী অবাঙালী নির্বিশেষে দুষ্কৃতকারীদিগকে শাস্তিদান ও নিরীহ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধানের যে-নীতি ঘােষণা করিয়াছেন উহাতে শান্তিকামী জনসাধারণ সন্তুষ্ট। দালালদের গ্রেপ্তার করা হইতেছে এদিকে ইয়াহিয়ার দালাল ডাঃ মালেক ও তাহার মন্ত্রিবর্গকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। চট্টগ্রামের কুলাঙ্গার মুসলিম লীগের পাণ্ডা ফজলুল কাদের চৌধুরী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য’ সাজ্জাদ হােসেনকেও গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। এক সংবাদে জানা যায়, খুলনার কুসন্তান খান সবুর নাকি বিষ খাইয়া আত্মহত্যার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু যমও তাহাকে গ্রহণ করিতে রাজী হয় নাই এখন একটি হাসপাতালে রহিয়াছে। জামাতে ইসলামী গােলাম আজম নাকি মক্কা চলিয়া গিয়াছে। সিলেটের মাহমুদ আলী, কক্সবাজারের ফরিদ আহমদ, গােপালগঞ্জের বীরপঙ্গু ওয়াইদুজ্জামানের খবর নাই। অর্থব নুরুল আমীন ও চাকমা রাজা ত্রিবিদ রায় ভুঠোর মন্ত্রিসভা ‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে কৌতুকের খােরাক যােগাইতেছে । কুখ্যাত ‘আল বদর বাহিনী নেতা বলিয়া কথিত খালেক নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। সে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার সহিত জড়িত সামরিক ও অসামরিক ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করিয়াছে।
মুক্তিযুদ্ধ।১: ২৫
২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯