রাহুমুক্ত বাঙলাদেশ
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক) বাঙলাদেশ আজ বাহুমুক্ত। গত বৃহস্পতিবার বাঙলাদেশ সময় বিকাল ৫.০১ মিঃ-এ ঢাকার ঐতিহাসিক রেস কোর্স ময়দানে পাক দখলদার বাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেঃ নিয়াজীর আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙলাদেশের উপর ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকচক্রের কর্তৃত্ব ও জবর-দখলের অবসান ঘটে। অবসান ঘটে গত নয় মাসের বিভীষিকার রাজত্বের। মৃত্যু ঘটে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের এবং পূর্বাঞ্চলে বিলুপ্ত হয় ঐ কুখ্যাত তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র পাকিস্তানযে পাকিস্তান ছিল জাতিসমূহের কারাগার। ঘন কুয়াশার আবরণ ভেদ করিয়া পূর্ব দিগন্তে উদিত হইয়াছে এক নবীন সূর্য-গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ। যে-বাঙলাদেশে বাঙ্গালী জাতি পাইবে অবাধ আত্মবিকাশের সুযোেগ, যে বাঙলাদেশের চারটি মূলনীতি হইল : গণতন্ত্র, জোট নিরপেক্ষতা, ধর্ম-নিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র । বাঙলাদেশের অভ্যুদয়ের ফলে বিশ্বের এই অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী কজা শিথিল হইবে-শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজ প্রগতির শক্তি জোরদার হইবে।
পাক দস্যুদের আত্মসমর্পণ। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনীর অতুলনীয় শাের্য-বীর্য ও মানেকশ’র কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করে। জেনারেল মানেকশ’ জবাবে পাক বাহিনীর বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের দাবি জানান এবং ভারতীয় বাহিনীর সদিচ্ছার নিদর্শন হিসাবে ঢাকার উপর বিমান আক্রমণ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখেন। পরদিন নিয়াজীর অনুকূল সাড়া পাইয়া মেজর জেনারেল জ্যাকব ঢাকা যান এবং আত্মসমর্পণের দলিলপত্র তৈরী করেন। বিকালে জেনারেল অরােরা ভারতীয় নৌ ও বিমান বাহিনীর আঞ্চলিক অধিনায়কদ্বয় ও মুক্তিবাহিনীর চীফ অফ স্টাফকে সঙ্গে নিয়া ঢাকায় যান এবং আত্মসমর্পণের দলিল গ্রহণ করেন। মুক্তির আনন্দে উদ্বেল পাক দস্যুবাহিনী আত্মসমর্পণের সংবাদে ঢাকা সহ সারা বাঙলাদেশে আনন্দের জোয়ার প্রবাহিত হয়। নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে অগণিত মানুষ রাস্তায় বাহির হইয়া আসে এবং আনন্দে মাতিয়া উঠে। সর্বত্র বাঙলাদেশের পতাকা উড়াইয়া দেওয়া হয়। কণ্ঠে কণ্ঠে গীত হইতে থাকে আমার সােনার বাঙলা আমি তােমায় ভালবাসি…।’ রাস্তায় রাস্তায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর উপর পুষ্পবৃষ্টি হইতে থাকে।
স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসিতেছে। মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ মূলত সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর সীমাবদ্ধ থাকায় ঢাকা শহর মােটামুটি অক্ষতই আছে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়া আসিতেছে। বাংলাদেশ রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্র শুক্রবার হইতে চালু করা হইয়াছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধান সচিব জনাব রুহুল কুদুসের নেতৃত্বে একদল সরকারী কর্মচারী ঢাকা রওয়ানা হইতেছেন। ইহারা অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা গড়িয়া তােলার কার্য পরিচালনা করিবেন। বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড কবীর আহমদ, ন্যাপ নেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি নূরুল ইসলাম প্রমুখ ইতিপূর্বেই মুজিব নগর হইতে ঢাকা। রওয়ানা হইয়া গিয়াছেন।
মুক্তিযুদ্ধ ১: ২৪
১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯