বাঙালি এমন এক জাতি যারা রক্ত দিতে জানে- বঙ্গবন্ধু
“ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকারের আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন। সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল চরম সংগ্রামের প্রস্তুতি। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোমবার তাঁর ভাষণে উপরোক্ত মন্তব্য করেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এবছরও অমর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হবে। এ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, ” ১৯৪৮ সাল থেকে আস্তে আস্তে এ সংগ্রাম শুরু হয়, ৫২ সালে এই সংগ্রাম চরম পর্যায়ে উপনীত হয়।” মহান একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ভাষণের পূর্ণ বিবরণ এখানে দেয়া হলো : দেশবাসী ভাই ও বোনেরা আমার, আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা স্বাধীন দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো শহীদ দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকেই এ সংগ্রাম শুরু হয়। সেদিন আমরা গ্রেফতার হয়ে ছিলাম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। সেটা শুধু ভাষা আন্দোলনই ছিল না এবং কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনই সেদিন শুধু হয় নাই এ আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৯৪৮ সাল থেকে আস্তে আস্তে এ সংগ্রাম শুরু হয়। ৫২ সালে এই সংগ্রাম চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। সেদিন আমাদের দেশের ছেলেরা রক্ত দিয়েছিল, শহীদ হয়েছিল বাংলাভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কিন্তু সেটা কি শুধু ভাষা আন্দোলনই ছিল? সেটা কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনই ছিল না। ছেলেরা রক্ত দিয়েছিল কেবলমাত্র ভাষার জন্য নয়। এর সঙ্গে ছিল সাংস্কৃতিক স্বাধীকার আর মানুষের মতো বাঁঁচবার অধিকারের সংগ্রাম। সেদিন অনেকেই বুঝতে চেষ্টা করেন নি যে, বাংলার মানুষ জেগে উঠেছে, বাংলার মানুষকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল চরম সংগ্রামের প্রস্তুতি। বছরের পর বছর এ দিনটি আমার দেশের ভাইবোনেরা পালন করছে শহীদ দিবস হিসেবে। কিন্তু শহীদ দিবস পালন করলেও বারবার এর ওপর আঘাত এসেছে। এদিনটি সত্যিকার অর্থে আমরা উদযাপন করতে পারি নি। কারণ শোষকগোষ্ঠী এই দিনটিকে হিংসার চোখে দেখতো এবং তারা এটাকে ধ্বংস করতে বারবার চেষ্টা করছে। এমনকি যে সীমানায় শহীদমিনারটি গড়ে উঠেছিল তার ওপর বারবার এই ষড়যন্ত্রকারীরা এবং শোষকশ্রেণী আঘাত করেছে।
তারপর থেকে বছরের পর বছর অনেক ভাই বোন, দেশের জনসাধারণ জীবন দিয়েছেন। জীবন দিয়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। তারা বাঁচতে চেয়েছে মানুষের মতো। তারা চেয়েছে তাদের অধিকার, তারা চেয়েছে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে তারা বাস করবে। কিন্তু পৈচাশিক শক্তি সেটা কিছুতেই মানতে চায় নি। হত্যা করেছে আমার ভাই বোনদের। আঘাত করেছে আমাদের সাংস্কৃতির ওপর, আঘাত করেছে আমাদের অর্থনীতির ওপর। নির্যাতন করেছেন আমার মা-বোনদের। ভিখারী করেছে বাংলার জনসাধারণকে। কিন্তু বাঙালি এমন এক জাতি যারা রক্ত দিতে জানে। যে জাতি মরতে শিখে, সে জাতিকে কেউ রুখতে পারে না- শাসকগোষ্ঠী বুঝে নাই। তাই তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে তারা আক্রমণ করেছিল। আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি সত্যি কিন্তু তা অনেক রক্তের বিনিময়ে। এতো রক্ত কোনো দেশ কোনো জাতি স্বাধীনতার জন্য দেয়নি। কিন্তু এ রক্ত আমাদের বৃথা যাবে, এ স্বাধীনতা আমাদের বৃথা যাবে যদি আমরা হাসি ফোটাতে না পারি, যদি এদেশের মানুষকে শোষণমুক্ত করতে না পারি, শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করতে না পারি। এবং তা যদি করতে হয়, তাহলে এদেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। আমি আশা করি, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এবার এ শফথই নেবে।
আমরা স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু স্বাধীন হলেও আমরা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবো না-যদি শোষণমুক্ত সমাজ গঠন না করতে পারি। সেজন্য জাতি-ধর্ম-দলমত-নির্বিশেষে ছাত্র যুবক কৃষক-শ্রমিক সকলকে অগ্রসর হতে হবে- এটাই আমরা আশা করি। এদিনে আমাদের শফথ হবে যে স্বাধীনতা আমরা এনেছি, যদি প্রয়োজন হয় রক্ত দিয়ে এ স্বাধীনতা রক্ষা করবো। যদি প্রয়োজন হয় দেশ গড়ে তোলার জন্য আরও রক্ত দেবো। আজ প্রতিজ্ঞা করতে হবে, শহীদের রক্তের কথা মনে করে, যারা মারা গেছে, যারা শহীদ হয়েছে, যাদের মায়ের বুক খালি হয়েছে, যে বোন বিধবা হয়েছে, যে কোটি কোটি মানুষ আজ গৃহহারা হয়েছে তাঁদের কথা স্মরণ করে শফথ নিতে হবে, বাংলার মাটিতে শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করতে হবে। মানুষ যাতে আর দুঃখ-কষ্ট না পায়, আর কোনোদিন অত্যাচারিত নিপিড়ীত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের কাজে অগ্রসর হতে হবে। তাই আমি অনুরোধ করছি, বিশেষভাবে যুব সমাজ, ছাত্র সমাজ, কৃষক-শ্রমিক ভাইদের সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে। আমরা মহাবিপদের মধ্যে আছি। আমাদের কিছুই নাই। নতুন করে সবকিছু গড়তে হবে। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে গড়ে তুলি, একটি শোষণহীন সমাজ তৈরি করি। শহীদ স্মৃতি অমর হোক। জয় বাংলা।
রেফারেন্স: ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ