রণক্ষেত্রে শিবিরে
ভারতীয় বাহিনী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সহায়তায় গত ১১ই ডিসেম্বর বাঙলাদেশের উত্তর পশ্চিম রণাঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ শহর কুষ্টিয়া শক্র কবল মুক্ত করেছেন। এর আগে যশােহর ক্যান্টনমেন্টের পতনের পর এই খন্ডের পাক সৈন্যরা এখন খুলনায় ঘাঁটি গেড়েছে। ভারতীয় বাহিনী এখন খুলনায় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচন্ড সংঘর্ষে লিপ্ত। ভারতীয় বিমান বাহিনী কুষ্টিয়া শহরে ভাড়া করলে পাক সৈন্যরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। পদ্মর ওপর বাঙলাদেশের বৃহত্তম রেল সেতু শত্রুসৈন্যরা পালিয়ে যাবার সময় ধ্বংস করে দিয়ে যায়। ঢাকা অভিমুখে ভারতীয় বাহিনী যাতে এগােতে পারে সেজন্য পাকিস্তানী সৈন্যরা এই সেতুটি নষ্ট করে। গত শনিবার কুমিল্লা খণ্ডে মেঘনা নদীর পূর্বতীরে থেকেও পাক সৈন্যদের তাড়িয়ে দেয়া হয়। ইতিপূর্বে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সহায়তায় ভারতীয় বাহিনী মেঘনা নদী পার হয়ে নরসিংদী পর্যন্ত অগ্রসর। হয়েছে। ১১ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা সংগামীদের বিজয় অভিযানের মধ্যে রয়েছে হিলি, জামালপুর এবং নােয়াখালি। কুমিল্লা খণ্ডে শত্রুসৈন্যের পালানাের পথ রুদ্ধ হওয়ায় বিপুল সংখ্যক পাক সৈন্য স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে তেইশতম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক এবং উপ-অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল আশরাফ আলী সৈয়দ এবং মেজর ইকবালও রয়েছে। সর্বমােট এগারােজন অফিসার, ১৬ জন জেসিও এবং ১৬০০ সাধারণ সৈন্য আমাদের হাতে বন্দী হয়েছে। এদের প্রত্যেকেই ২৩তম পাঞ্জাব, ৩০তম পাঞ্জাব, ২৫তম সীমান্ত বাহিনী এবং ২১তম আজাদ কাশ্মীর ব্যাটেলিয়ানের অন্তর্ভুক্ত। পাক সৈন্যরা এখন ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ভারতীয় সৈন্যদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। জামালপুর বিজয় একটি উল্লেখযােগ্য বিজয়। সেখানে প্রায় ৮০০ জনের মতাে পাক সৈন্য ছিল। সম্মিলিত বাহিনী ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে আচমকা আক্রমণ চালালে এদের প্রত্যেকেই আমাদের হাতে বন্দী হয় । একত্রিশতম বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেঃ কঃ সুলতান আহমেদও বন্দী হয়েছে। এই বিজয়ে ৬টী ১২০ মিলিমিটার মর্টার, আটটি ১০৫ মিলিমিটার বন্দুক, আটটি ১০৬ আর সি এল বন্দুক, ৭২টি হালকা ও মাঝারী মেশিন গান এবং ৬টি ছ পাউন্ডের বন্দুক সহ প্রচুর গােলা বারুদ হস্তগত হয় । এদিকে হালুয়াঘাটের দিক থেকে এসে ময়মনসিংহ শহরটিও সম্মিলিত বাহিনী মুক্ত করে নিয়েছেন।
এক সপ্তাহ যুদ্ধের পর হিলি শহরটিও এখন মুক্ত হয়েছে। রংপুর জেলার গাইবান্ধা ফুলছড়ি, বাদুড়িয়া, দুর্গাদীঘি, পিশাপাড়া, বাইগ্রাম এবং চন্ডীপুর শহরগুলাের মুক্ত হয়েছে । গত রবিবার দিন থেকে অধিকৃত ঢাকা শহরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা আরাে জোরদার হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী মুক্তি বাহিনীর সহায়তায় ভৈরব থেকে এগিয়ে ঢাকার পাট বিক্রয় কেন্দ্র নরসিংদী দখল করে নেন। এদিকে সম্মিলিত বাহিনী কুমিল্লা শহর দখল করে পাক সৈন্যকে এখন ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছেন। মেঘনার পূর্ব তীর এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। সম্মিলিত বাহিনী দাউদকান্দিকে এখন অবস্থানরত। অন্য দিকে ময়মনসিংহ দখল করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে গিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা টাঙ্গাইল জেলাটিও মুক্ত করে নিয়েছেন। সরবরাহ রাস্তা পুরােপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় নতুন করে সৈন্য নিয়ােগের পথও পাকবাহিনীর আর রইল না। এদিকে রংপুরে দিনাজপুর খন্ড এবং খুলনা শহরে সম্মিলিত বাহিনী এবং পাকবাহিনীর প্রচন্ড সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। টাঙ্গাইল দখলের পর মুক্তিবাহিনী জয়দেবপুর পর্যন্ত চলে এসেছেন। এই জয়দেবপুরের পরেই কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট। এই পথেই অগ্রসর হতে সম্মিলিত বাহিনীকে একটুও বেগ হবে না। গত সােমবার সম্মিলিত বাহিনী ভেড়ামারা, রংপুর, ময়নামতি এবং নরসিংদীতে শত্রুবাহিনীর ওপর প্রচন্ড আঘাত হানেন। তাছাড়া শত্রুর কয়েকটি মটর বােট এবং অস্ত্রবাহী জাহাজও গােয়ালন্দ ঘাটে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রামের ২২ মাইল দূরে সীতাকুণ্ড শহরটিও সােমবার দিন মুক্ত করেন। এছাড়া বগুড়া শহরটি শত্রু কবল মুক্ত হয়েছে বলে জানা যায়।
অভিযান ১ : ৪
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯