You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানি ধ্বংসযজ্ঞের অন্যতম লীলাভূমি রংপুরঃ দস্যুরা ৬০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে

রংপুর। গত নয় মাসে পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যবাহিনী ও তাদের নরপিশাচ দালালদের হাতে রংপুরে অন্ততঃপক্ষে ৬০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এদের মধ্যে নর-নারী ও বহু শিশু রয়েছে। তারা ১০ হাজারের অধিক কুমারীর সতীত্ব নষ্ট করেছে এবং ৫ লাখ ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে অথবা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছে। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বিশেষ সংবাদ দাতা রণেশ মৈত্র সম্প্রতি রংপুরে ব্যাপক সফর করে এই তথ্য সংগ্রহ করেছেন। পাকিস্তানি পেশাদারী সৈন্যরা একমাত্র রংপুর শহরেই ৯০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ভুরঙ্গামারীতে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে প্রচন্ড লড়াই হয়েছিল এবং এই শহরটি কয়েকবার হাত বদল হয়। ফলে বহু জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকিস্তানের এই বর্বর সৈন্যরা কুড়িগ্রাম মহকুমা জুড়ে সুপরিকল্পিত উপায়ে প্রতিটি গৃহে অগ্নিসংযোগ করে। ফলে এই মহকুমা শহর ও অধীনস্ত গ্রামগুলোর খুব কম ঘরবাড়িই আছে যা এই পাইকারী দহনযজ্ঞের হাত হতে রক্ষা পেয়েছে। গ্রামগুলো একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে বললে অত্যক্তি হবে না। এ জেলার সদর মহকুমার হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ ও কাউনিয়া থানা, গাইবান্ধা মহকুমার গোবিন্দগঞ্জ ও সুন্দরগঞ্জ থানা, নীলফামারী মহকুমার সৈয়দপুর, ডোমার ও ডিলমা থানাও বিশেষভাবে হানাদারদের হাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। গাইবান্ধা শহরেই শত্রুবাহিনী কমপক্ষে ৭ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে।
পাইকারী কবরঃ সংবাদদাতা আরো জানিয়েছেন যে, মডার্ন সিনেমা হলের সন্নিকটে, মাহিগঞ্জ, শ্মশানভূমি, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির সন্নিকটে, নারীর হাৎ, দামদোরা নিসবতগঞ্জ ব্রীজ, জাফরগঞ্জ ব্রীজ, বালিদী পুকুর, ধ্যামপুর মিলের নিকটে, দরগা সাহেবগঞ্জ, দাসদোবা মসজিদের নিকটে, কাশিয়াবাড়ি, সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা হেলাল পাকিস্তান, পলাশবাড়ি, বাহারাত খালি, বাদিয়া খালি, মাদারগঞ্জ, ধাপের হাট এবং সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমণির হাটের আরো বহু জায়গায় পাইকারী কবরের কঙ্কাল পাওয়া গেছে।
মহিলা নির্যাতনঃ এ জেলায় পাইকারী হারে মহিলাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালানো হয়েছিল। জেলার বিভিন্ন এলাকা হতে রংপুর আর্ট কাউন্সিল ভবনে মহিলাদের ধরে এনে আটক করা হতো। বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা এসব ভাগ্যহত মহিলার ওপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের হত্যা করত। এ ভবন হতে বহু মদের বোতল, শাড়ি, স্যান্ডেল ও মহিলাদের জামা-কাপড় পরে উদ্ধার করা হয়েছে। ঠিক অনুরূপ পশু প্রবৃত্তি চরিত্রার্থের জন্যে বর্বর সৈন্যরা রংপুর ক্যান্টনমেন্ট, সার্কিট হাউজ, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি, জাগীরহাট, কারানীহাট, শ্যামপুর, মাহীগঞ্জ, গাইবান্ধায় পাকিস্তান বাহিনীর বহু সৈন্যছাউনি এবং বাঙ্কারকে বেছে নিয়েছিল। এমনকি গ্রাম্য মহিলারাও নরপশুদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
মর্মস্পর্শী কাহিনিঃ সংবাদদাতা একটা মর্মস্পর্শী কাহিনী উদ্ধৃত করে বলেন গত জুলাই মাসের কোনো এক সময়ে কুলিয়া থানার একটা গ্রামে পাকিস্তানি জওয়ানরা একটা কৃষকের বাড়িতে হানা দেয়। একজন সৈন্যকে বাইরে পাহারায় মোতায়েন করে আর সবাই ঘরে ঢুকে পড়ে। তারপর একের পর এক কৃষকটির হতভাগ্য স্ত্রীর ওপর বলাৎকার চালায়। এমতাবস্থায় গৃহস্বামী কৃষক একখানা রামদাও-এর সাহায্যে দুজন পশুকে কেটে ফেলে। পরে তার স্ত্রীকেও হত্যা করে। প্রহরারত পাকিস্তান সৈন্যটি এমতাবস্থায় পালিয়ে গিয়ে তাদের ক্যাম্পে খবর দেয় যে উক্ত গ্রামে বহু মুক্তিফৌজ আত্মগোপন করে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বহু ট্রাক পাকিস্তানি সৈন্য এসে গ্রামে হাজির হয়। তারপর প্রায় দেড় হাজার নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে, আর সমস্ত গ্রামটি জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়ে যায়।৪৫

রেফারেন্স: ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!