বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত- বঙ্গবন্ধু
কোলকাতা। বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ কোলকাতায় ঘোষণা করেছেন যে, বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা এই চারটি আদেশের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ সম্পর্ক দিন দিন আরো দৃঢ় হবে এবং চির অটুট থাকবে। আজ কোলকাতা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ভারতের ইতিহাসে বৃহত্তম জনসমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় বাংলাদেশের জাতির পিতা উপরোক্ত ঘোষণা করেন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান বিশাল জনসমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন যে, লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বিশ্বের কোন শক্তি এ স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। বাংলাদেশের শেষ ব্যক্তিটি পর্যন্ত কঠিন মূল্যে অর্জিত এ স্বাধীনতা রক্ষা করবে। আমাদের মতো অপর কোন জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এত মূল্য দিতে হয় নি। বঙ্গবন্ধু বলেন, ভারতের জনগণ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সমর্থন না থাকলে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম না। ভারতের জনগণের এই ঋণ কোনদিন শোধ দেওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, বাংলাদেশের জনগণ শান্তিপ্রিয় ও সমঝোতাকামী। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলা ও ষড়যন্ত্র চূর্ণ করতেও তারা সক্ষম। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এই জনসভায় তিনি আরো বলেন যে, বাংলাদেশ এখন একটা স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ এবং চারটি স্তরের (গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) ওপর প্রতিষ্ঠিত। দখলদারবাহিনীর হাতে বিধ্বস্ত সোনার বাংলা পুনর্গঠনে জনগণের সেই একই ঐক্য থাকবে বলে বঙ্গবন্ধু আশা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের জনগণ, বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশ্যে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ভারতের জনগণ ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সমর্থন না থাকলে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম না। দু’দেশের একই আদর্শ, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বলেই দু’দেশের মধ্যেকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক দিন দিন আরো জোরদার হবে এবং চির অটুট থাকবে। বিশাল জনসমুদ্র অধীর আগ্রহে দুই নেতার বক্তৃতা শুনেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের সরকার ও জনগণকে এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানান। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের নীতি সমালোচনা করে বলেন যে, খুনি ইয়াহিয়ার সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে জেনেও তারা পাকিস্তানে যেয়ে অস্ত্র সরবরাহ করেছেন। মার্কিন সরকার ভারতকেও সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দেয়। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, মার্কিন সরকার কেবলমাত্র পাকিস্তানের বাজার রক্ষার উদ্দেশ্যে এসব করেছে। তবে সাম্রাজ্যবাদের দিন ফুরিয়ে গেছে বলে তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। শেখ মুজিব বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘকালের সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রাম অনেক আগেই শুরু হয়েছে। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের জনগণকে দমন করে রাখবার জন্যে উপর্যুপরি চেষ্টা চালিয়েছেন, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ কখনো নত স্বীকার করেনি। বাঙালিরা বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের জন্যে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে সংগ্রাম করেছে এবং জীবন দিয়েছে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে। বাঙালিরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কেবলমাত্র বাংলাদেশকে একটি উপনিবেশে পরিণত করা ও সমস্ত সম্পদ লন্ঠনের উদ্দেশ্যেই আইয়ুব খান বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারি করেছিল। কিন্তু এসব অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সবসময়ই বাঙালিরা রুখে দাঁড়িয়েছেন। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর পশ্চিম পাকিস্তানে শাসকচক্রের ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাত্রে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তখনও তিনি জানতেন না আর তিনি জনগণের মধ্যে ফিরে আসতে পারবেন কিনা। তবে ৭ মার্চের জনসভায় তিনি যার যা আছে তাই নিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ ভাবে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। ভারতীয় জনগণ সর্বতোভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। তারা বাংলাদেশের জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিসংগ্রাম করেছেন। বাংলাদেশের জনগণ জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। কোলকাতার এই জনসমুদ্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও ভাষণ দেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার ২০ মিনিট ব্যাপী বক্তৃতার উপসংহারে বলেন, ‘আমি একজন সোজা মানুষ। আমি যা বুঝি ও মনে করি তা আপনাদের কাছে বলেছি। আমি আবার ঘোষণা করছি যে, আমাদের বন্ধুত্ব চিরঅটুট ও চিরস্থায়ী হবে।’ পরিশেষে তিনি জয় বাংলা, জয় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, জয় হিন্দ ও ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী অমর হোক স্লোগান তুললে লাখ লাখ স্রোতা তার কন্ঠে কন্ঠ মিলায়। ১২ মুজিব ইন্দিরা তিন ঘন্টাব্যাপী আলোচনা কোলকাতা। আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ভবিষ্যত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও ভারত-বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন। তাঁদের এই আলোচনা দু’টো বৈঠকে তিন ঘন্টারও বেশী সময় অব্যাহত থাকে। ৭৫ মিনিট ব্যাপী প্রথম বৈঠকটি শুধু দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেই সীমিত থাকে। পরে বৈঠকে তাদের উপদেষ্টারাও ছিলেন। গভীর সমঝোতার মনোভাব নিয়ে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করেন। জানা গেছে যে, দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেন। দ্বিতীয় আলোচনা বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, পররাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারি এস এম করিম ও অর্থ দপ্তরের সেক্রেটারি মতিউল ইসলাম সাহায্য করেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে সাহায্য করেন স্বরাষ্ট্র বিষয়ক ষ্টেট মন্ত্রী কে. এস পন্থ, নীতি নির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর, প্রধানমন্ত্রীর প্রধান সেক্রেটারি পি এন হাক্সার এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড.সুখময় চক্রবর্তী। আলোচনা শেষে শ্রী ডি পি ধর অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের জানান যে, আলোচনা ফলপ্রসু ও সন্তোষজনক হয়েছে। তিনি সুখী হয়ে ফিরেছেন বলে জানিয়েছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আরেক দফা বৈঠক করার জন্যে তাঁর দিল্লি ফিরে যাওয়া আগামিকাল পর্যন্ত বিলম্বিত করেছেন। সকাল সাড়ে ১০টায় এই বৈঠক শুরু হচ্ছে। আগামিকাল অথবা তার পরদিন সম্ভবতঃ একটি যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হবে। ১৩
রেফারেন্স: ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ