You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাবনা জেলার নগরবাড়ির জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

বাংলাদেশের মানুষ হিন্দু মুসলমান জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অস্ত্র ধরেছিল এক পৈচাশিক শক্তির বিরুদ্ধে। তারা মানুষ নয়, তারা অমানুষ। তারা পশুর চেয়ে খারাপ। দুনিয়ার ইতিহাসে কোনোদিন দেখা যায় নাই যে নিরীহ মা-বোনদের ওপর এতো অত্যাচার করে হত্যা করে। বৃদ্ধ-বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করে রাস্তায় রাস্তায় গর্ত করে স্তুপ করে রেখে দিয়েছে। দুনিয়ায় দেখি নাই যে মা-বাপের সামনে থেকে ধরে তাদের গায়ের সমস্ত রক্ত, হত্যা করে নদীতে মেরে ফেলে দিয়েছে। দুনিয়ায় দেখা যায় নাই চামড়া উঠিয়ে ফেলে দিয়েছে। তাজা মানুষের চামড়া উঠিয়ে ফেলে দিয়েছে তারপর নুন মেরে দিয়েছে। দুনিয়ায় দেখা যায় নাই যে একদিন, দুই দিন, তিন দিন, চারদিন, মাসের পর মাস অত্যাচার করে আমার দুধের বাচ্চাদের হত্যা করেছে। দুনিয়ায় দেখা যায় নাই কোটি কোটি মানুষের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা যায় নাই এক কোটি লোক ঘর বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আমার বাংলাদেশের এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল এদেশের তিন কোটি লোকের ঘর বাড়ি। পশুরা বলে তারা নাকি মুসলমান। তিন লক্ষ মা-বোন এসেছে আমাদের কাছে এসেছে এ পর্যন্ত। যাদের ঘরে ঘরে গিয়ে পাশবিক অত্যাচার করেছে। আমার আজকের ত্রিশ লক্ষ লোক, আমার বাংলার কৃষক, আমার বাংলার যুবক, আমার বাংলার শ্রমিক, আমার বাংলার ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে। আমি কল্পনা করতে পারি না। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমি কেন বেঁচে এলাম? আমার এই দেশকে দেখার জন্য! এদেশে আমার মানুষ আজ সর্বহারা, এদেশে আমার মানুষ আজ গৃহহারা, এদেশে মানুষ আজ না খাওয়া। আজ লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি যুবক বেকার। পাটের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, পোর্ট নষ্ট করেছে, আমার সমস্ত সম্পদ ধ্বংস করে দিয়ে চলে গেছে। এত রক্ত কোন দেশ কোন জাতি দেয় নাই যা আমার বাংলাদেশের ভাইয়েরা, বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য। খালি হাতের এই সরকার আমাকে নিতে হয়েছে। আমার দলকে নিতে হয়েছে। আমার শতকরা ৭০ জন পুলিশকে হত্যা করেছে। আমার ইপি আর শতকরা ত্রিশ-পঞ্চাশ জনকে হত্যা করেছে। আমার সামরিক বাহিনীর ছেলেদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। আমার ভালো ভালো কর্মচারিদের নিয়ে হত্যা করেছে। আমার বুদ্ধিজীবি কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, যারা যোগ্য লোক, যারা সাংবাদিক তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছে কার্ফিও দিয়ে। দুনিয়ার মানুষ আশ্চর্য হয়ে যায়, যখনই খবর পায়, আমি আমার সহকর্মীদের বলি, ওরা আমায় বক্তৃতা করতে বলে। সত্যি আজকে আর আমি বক্তৃতা করতে পারি না। আমি আর সেই মুজিবর রহমান এখন আর নাই। আমার মুখের থেকে সে আগুন চলে গেছে। আমি যেন ভেঙে পড়ি। আমি যখন চিন্তা করি, চারিদিকে দেখি বাংলার গ্রাম শেষ, দেখি কৃষকের ফসল নাই, দেখি তাদের ঘর বাড়ি নাই, দেখি আমার পুলিশ বাহিনী নাই, দেখি তাদের পোশাক নাই, দেখি আমার শ্রমিক ভাইদের ত্রান দিতে পারি না, আমার কৃষক ভাইদের, দুঃখী ভাইদের খাবার দিতে পারি না, আর আমার যে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ ভাই বোনেরা এতিম হয়েছে, মা হয়েছে পুত্রহারা, স্ত্রী হয়েছে স্বামীহারা, ভাই হয়েছে ভাইছাড়া- এদের আমি কি দিয়ে শান্তনা দেব? এদের কোথা থেকে সাহায্য করব? কি করে এদের মুখে অন্ন দেব, কি করে এদের আমি পানি খাওয়ার ব্যবস্থা করব? দস্যুর দল যাবার পূর্বে আমার মানুষদের শুধু হত্যা করে যায় নাই, আমার সম্পদকে শেষ করে দিয়ে গেছে। আমার মুক্তিবাহিনীর ভাইয়েরা, তোমরা সংগ্রাম করেছ, জীবন দিয়েছ, তোমাদের কাছে আমার জাতি কৃতজ্ঞ। সমস্ত জাতি তোমাদের একটি অংশ। তোমরা যাতে দেশ গড়তে, কাজ করতে পার সেজন্য ক্যাম্পে এসে কার্ড জমা দিয়ে তোমাদের নাম রেজিস্ট্রি করতে বলেছি। রেজিস্ট্রি করার পরে যারা বাংলাদেশ রক্ষী বাহিনীতে যেতে চায়, যতদূর সম্ভবপর সেখানে নেয়া হবে। কিছু সংখ্যক নেওয়া হবে পুলিশে। যারা ছাত্ররা, যারা যুদ্ধ করেছে, তারা লেখাপড়া করার জন্য স্কুল কলেজে ফিরে যাবে তাদের জন্য যতদূর সম্ভব সাহায্য সহযোগীতার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। যারা মাঠে আছে তাঁরা সার্টিফিকেট নিয়ে ২৯ তারিখের মধ্যে ক্যাম্পে গিয়ে আপনার যার যার গ্রামে ফিরে যান। কাস্তে কোদাল হাতে নেন। যখন সময় আসবে নিশ্চয়ই আপনাদের আমি দেখব কি করে আপনাদের একটা ব্যবস্থা করা যায়। আপনাদের ভুললে চলবে না যে, ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে, তাদের সংসার রয়েছে, তাদের আমি কি দিতে পেরেছি? আপনাদের অন্তত এক মাসের খাবারের বন্দোবস্ত করতে পারি না। কিন্তু ত্রিশ লক্ষ লোক যাদের মা ভাই বোন মারা গেছে, তাদের আজ পর্যন্ত এক প্যাকেট খাবার দিতে পারি নাই। এক আনা পয়সাও দিতে পারি নাই। আমি করছি কোন রকমে। ইস্ট বেঙ্গলে এই ত্রিশ লোক যাদের মারা গেছে ভাই-বোন, তাদের সাহায্য করতে পারি না? যে বোনেরা আমার বিধবা হয়েছে, তাদের আমার ক্যাম্পে রাখতে হয়েছে। দুনিয়া থেকে ভিক্ষা করে লঙ্গরখানায় এনে তাদের আমি দিয়েছি, যাতে তাদের সংসার টিকে থাকতে পারে। যুবক ভাইয়েরা আমার, যে বোনেরা, আমার যে মেয়েরা পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বরদের কাছে ধর্ষিতা হয়েছে, তাদের ইচ্ছে করে ইজ্জত দেয় নাই, তাদের ইজ্জত নষ্ট করা হয়েছে। তারা আমার মা, তারা আমার বোন, তারা আমার কন্যা।
যারা ত্যাগ দিয়ে তোমরা যুদ্ধ করেছ, তোমাদের কাছে আমার আবেদন, এই ত্যাগ নিয়ে তোমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এই মেয়েদের তোমাদের অনেকের বিবাহ করতে হবে। দুনিয়াকে দেখাতে হবে যুদ্ধ শুধু অস্ত্রই নিতে পারে নাই মা বোনের ইজ্জতও যেন এগিয়ে দিতে পেরেছে। তারা ধর্ষিত হয়েছে তাদের দোষে নয়, স্বাধীনতার সংগ্রামে। যেমন তোমাদের উপরে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে তাদের ওপরেও সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। তোমরা যারা আমার ভক্ত, তোমাদের কাছে আমি বড় ভাই হিসেবে, তোমরা যারা আমাকে আদর করে মুজিব ভাই বল, এই হিসেবে তোমাদের কাছে আমার এই আবেদন রইল তোমরা জেলায় জেলায় লিস্ট কর, যারা ধর্ষিতা কন্যাদের সাদী করতে চায়। তাদের জন্য আমি সব ব্যবস্থা করব যা আমার তওফিকে কুলায়।
যারা আমার কথা শুনে না, যারা আমার হুকুম মানেনা, তারা মুক্তিবাহিনী নয়, তারা বদরবাহিনী, রাজাকার। আর আজকে কিছু কিছু লোক, কিছু কিছু ছেলে, যারা বদরবাহিনী, রাজাকারে ছিল ১৬ তারিখের পরে জামা বদলাইয়া মুক্তিবাহিনী হয়েছে। লুটতরাজ করে, মা বোনদের ওপর অত্যাচার করে, তারা অন্যের সম্পত্তি লুট করে গাড়ি দখল করে, বাড়ী দখল করে। আমি পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই এ রকমের যে অত্যাচার-অবিচার করবে, আমি পুলিশ ব্যবহার করতে চাইনা, পুলিশ দিয়ে আমি স্বাধীনতার সংগ্রাম করি নাই- আমি করেছি সাড়ে সাতকোটি লোক দিয়ে। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, তাদের প্রতিরোধ করো, তাদের দাবাও।
আজকে এই গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে যারা দেশকে ভালোবাসে, তারা গুন্ডা বদমাইশদের শাসন কর। শুধু মনে রেখো, কোনো নিরপরাধ লোকের ওপর যেন অত্যাচার না হয়। আমার মুখের উপর যেন কালি না পরে। দ্বিতীয় কথা আরেকটা বলে দিতে চাই, নেতৃবৃন্দের রিকমান্ড করা বন্ধ করে দেও। সাত কোটি মানুষের নেতা আমি। সাত কোটি লোক আমাকে ভালোবাসে, আমি তাদের ভালোবাসি। আমার চোখে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নাই। আপনারা রিকমেন্ড করা বন্ধ করেন। যা যা শক্তি আছে, যতদূর যার বুদ্ধি আক্কেল আছে, সেভাবে সরকারি সুযোগ সুবিধা পাবেন। তার ওপরে আমার দলের মন্ত্রী হন, অন্যদলের নেতা হন, প্রাক্তন নেতারা হন, যুক্তফ্রন্টের ভাইরা হন, তারা মনে রাখবেন দলের লোককে খুশি করার জন্য রেকমেন্ড দিবেন না। আর যে লোককে রিকমান্ড দিবেন, আমি আমার সরকারকে হুকুম দিয়েছি, তার চাকরি কোনোদিন জীবনে হবে না। শহরের লোক তোমাদের বাড়িতে বাড়িতে যাবে, তোমরা দরখাস্ত করবে। আমি ক্রমিক নং বসিয়ে দেবো। সে ক্রমিক নং অনুযায়ী ইন্টারভিউ হবে। যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি হবে। কোন সুপারিশ এদেশে চলবে না। তবে যারা মুক্তিবাহিনীতে সংগ্রাম করেছে, যারা সার্টিফিকেট পেয়েছে, তারা ২৯ তারিখে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবে, তাদের জন্য একটা প্রভিশন রাখা হয়েছে, যাতে তাদের প্রতি প্রথমে সুবিচার করা হয় এবং তাদের জন্য দরকার হলে একটা কোটা করে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য আমার কাজ করতে হবে। পৃথক সুযোগ সুবিধা নেয়া উচিৎ হবে না।
ভাইয়েরা আমার, আমি বলছি আমি জেল থেকে বেরিয়ে এসেছি। ফাঁসির কাস্ট থেকে আসছি আমি শুধু খালি হাতে নয়, খালি হাতে হলেও ভালো হয়। খালি হাত থেকেও খারাপ অবস্থায় এই সরকারের ক্ষমতা নিয়েছি। টাকা, পয়সা, সোনা, রূপা যা ছিল চুরি করে লুটের দল বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে নিয়ে গেছে। আমাকে দিন রাত ভিক্ষা করতে হচ্ছে যে আমাকে চাল দাও, আমাকে ঔষধ দাও, আমাকে কাপড় দাও, আমাকে ডাল দাও, আমার মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমি পারিনা, আমি সত্যি পাগল হয়ে যাই। জেল থেকে বের হয়ে এসে নামার পর থেকে আজো পর্যন্ত একটা দিন কেমন করে ভালো করে বিশ্রাম করতে হয়, তা আমি জানি না। আমি বিশ্রাম নাই, আমার প্রয়োজন নাই। যতদিন বেঁচে আছি কাজ করে যাব, তারপরে আমি বিদায় হয়ে যাব।
সংগ্রামে নেমেছিলাম মরবার জন্য। বেঁচে আছি আমি আপনাদের দশজনের দোয়া। এছাড়া বাঁচবার আমার কোন উপায় ছিল না। আপনাদের কাজ করতে হবে। কিচ্ছু আমার নাই। যদি কেউ বলেন এটা দেন ওটা দেন, আমি বলি কিচ্ছু নাই, কিচ্ছু দিতে পারব না। চেষ্টা করেছি আনার জন্যে, যদি আসে পাবেন। যদি না আসে আমি পারব না। আমি আমার স্বাধীনতা বিক্রী করতে পারব না। আমি আমার লোকদের গোলাম করতে পারব না। আমি সাহায্য চাই। আমার সাহায্যের জন্য স্বার্থ ছাড়ব না। আমি দুনিয়ার খেলা বুঝি। আবার যদি আমি আপনাদের গোলাম করে যাই, মরে গেলেও আমি আর শান্তি পাব না। বহু রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা এনেছি, আপনারা এনেছেন। এ স্বাধীনতা রাখতে হবে। শান্ত হন, কষ্ট করতে হবে। একটা গাছ লাগালেও পাঁচ বছরের আগে ফলন হয় না। আর সাত কোটি মানুষের গাছ, গাছকে পথের ভিখারী করে দিয়ে গেছে। তাঁকে বাঁচাতে হলে কি প্রয়োজন তা আপনারা বুঝেন। আমি কি করব? আমার কৃষক খাজনা দিতে পারে না। আমি বলে দিলাম, গভর্মেন্ট বলে দিল বকেয়া খাজনা সুদসহ মাফ। তাহলে গভর্মেন্টের টাকা আসবে কোত্থেকে। মাফতো করে দিছি। নুনের ওপর ট্যাক্স মাফ, সরকার ট্যাক্স পেল না। এ রকম গরীবের যা ছিল, সেগুলো মাফ করে দিছি। ২৫ বিঘা যাদের জমি আছে, ২৫ বিঘা পর্যন্ত তাদের খাজনা, মনে আছে আপনাদের বলেছিলাম, এখানে আগে যে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত মাফ হয়ে যাবে। মাফ করে দিসি আর খাজনা দিতে হবে না। শুনেন ট্যাক্স দিতে হবে, না হলে জমির মালিকানা থাকা কষ্টকর হবে। যদি দেন অন্যান্য যে ট্যাক্স আছে তা দিতে হবে, না হয় সরকার চালানো যাবে না। যাতে আপনাদের সহজ সরল পেয়ে হেনের টাকা ওনে নিয়ে, দুই টাহা পাঁচ টাহা নিয়ে দৌড় না পারতে পারে সেজন্য ২৫ বিঘা পর্যন্ত তাদের খাজনা মাফ। সেজন্য আপনাদের কাজ করতে হবে। আপনাদের গ্রামে গ্রামে এই যে কুড়ালি পয়সা যদি আমার থাকত আমি বলতাম পয়সা, খুড়াও কুড়াল, পয়সা নাই বলে আমি বলছি। আমিও কুড়াল মারি, তোমরাও মার। ইনভেস্টমেন্ট যত রাস্তা খাল এগুলো আপনাদের কাটতে হবে। তাছাড়া কিছু কিছু জায়গাও ব্যক্তিগতভাবে আপনাদের দিছি। এর মধ্যেও দিয়ে ফেলেছি, তাই আল্লাহর মর্জি আপনাদের দোয়ায় দুনিয়ার ৪৫টি দেশ বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছে। এই ষড়যন্ত্রকারীরা ঐ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা যে লাগছে, সে দাবা খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আর ভাই ভুট্টো সাহেবের হারাধনের একটি ছেলে পাগল হয়ে গেছে। সুখে থাক। তোমাদের কাছে মাফ চাই, আর না। তোমরা যা করে গেছ, তা যদি পশ্চিম পাকিস্তানের মা-বোনেরা জানত, তাহলে মনে হয় সে দেশেও আগুন জ্বলে উঠতো।
তবে একথা সত্য আমার চার লক্ষ বাঙালি আছে পশ্চিম পাকিস্তানে, সরকারি কর্মচারী আছে, সামরিক বাহিনীর লোকেরা আছে, আমি চাই তোমার লোক তুমি নিয়ে যাও, আমার লোক আমাকে দিয়ে দাও। তবে মনে রেখ, যারা আমার বোনকে হত্যা করেছে, যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে, যারা আমার মাবোনকে পথের ভিখিরি করেছে, যারা আমার নিরপরাধ দুধের বাচ্চাদের হত্যা করেছে- সে হিসেব বাংলার মাটিতে হবে যদি শেখ মুজিবর রহমান বেঁচে থাকে। আর যারা দালালী করেছে, পশ্চিমার দালালী করেছে, যারা পশ্চিমাদের রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে আমার গ্রামকে জ্বালিয়ে দিয়েছে, যারা আমার ছেলেদের ধরিয়ে দিয়ে গুলি করে মেরেছে, ওদের গ্রেফতার কর। কিন্তু নিরপরাধ কোন লোকের উপর যেন হত্যা না চলে, দেশের বদনাম হবে। আল্লাহ বেজার হবে। আমি সবিনয় অনুরোধ করছি, স্কুল কলেজে আশ্রয়ে যারা আছে, যারা যুদ্ধ করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা আমার বাহিনীর ছেলেরা এবং যারা গরীব তাদের জন্য আমি কার্ড সাহায্যের বন্দোবস্ত করে দিয়েছি। স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করা তেমনি কষ্টকর। আজ স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি এদেশে দুঃখী মানুষের পেটে ভাত না হয়। স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি আমার সোনার বাংলা গড়ে না উঠে। স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি আমার ছেলেরা কাজ না পায়, কিন্তু সময়ের প্রয়োজন। আপনাদের থেকে আসবে না যে, আমি তাড়াতাড়ি সবকিছু করে দিতে পারব। আপনাদের সহ্য করতে হবে, কাজ করতে হবে, খাটতে হবে। আর আমি বলছি কৃষি বিপ্লব করতে হবে। আমরা দুনিয়ার কাছ থেকে খালি কিনতে হবে-পারব না। খাবার তৈরী করতে হবে। আপনাদের গ্রামে গ্রামে খাবার উৎপাদন করতে হবে। আমি জানি বন্যায় নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু পয়সা কোথায়? চেষ্টা করছি। সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রাখতে হবে। এই দায়িত্ব যেমন সরকারের এই দায়িত্ব তেমনি জনসাধারণের। আপনারা সকলে যেমন নষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানিদের, টিক্কা, ইয়াহিয়া খানদের তাড়িয়ে ছিলেন, তেমনি করে গুন্ডা পান্ডা বদমাইশদেরও তাড়িয়ে দেবেন। আল্লাহর মর্জি মদ খাওয়া পাকিস্তানে ছিল। ওরা ইসলামী রাষ্ট্র, বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে গেছে। ওটা ছিল ইসলামী রাষ্ট্র সেজন্য ওখানে মদ খাওয়া হতো। আল্লাহর মর্জি এখন এদেশে একদম বন্ধ। এদেশে মদ খাবে কেন? হারাম, বন্ধ করে দিলাম। আপনারা সেদিকেও খেয়াল রাখবেন, রাত্রিবেলা যেন পালিয়ে মদ খেতে না পারে। এই মদ খাইলেই মাতলামী করে, মাতলামী করলেই বদমাইশি করে। এই মদ বন্ধ করতে হবে। আপনারা কাজ করেন, আপানাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি, আপনারা আওয়ামী লীগ গঠন করেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগ গঠন করেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। আর আমি রক্ষীবাহিনী গঠন করেছি, যারা আমার মুক্তিবাহিনীতে ছিল তাদের মধ্যে কিছু লোক নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে তাদের নিয়েছি। আপনারা আজ আমাকে কথা দিন সবাই মিলে আপনারা কাজ করবেন কিনা? কোথায় পুকুর নাই পুকুর কেটে দাও, কোথায় রাস্তা নাই রাস্তা কেটে দাও। যেখানে গরীব কাজ করতে পারে না, কাজ দিয়ে দাও। সকলে মিলে মিশে আপনারা কাজ করবেন কিনা আমি জানতে চাই। জয় বাংলা।১২৪

[মুজিব বাঁধ হওয়ার ফলে পাবনা জেলা খাদ্যে উদ্ধৃত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বাঁধ উদ্বোধনের জন্য অনুরোধ ও উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন এম.এন.এ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ।]

রেফারেন্স: দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!